শুধু তুই পর্ব-০১

0
81

#শুধু_তুই
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_উদন্তিকা_নাথ_বর্ষা

“তরু তুই এখন রুমে আসবি না আমি আগে কাপড় পড়বো তারপর আসবি।

না আদ্রিক ভাইয়া আমি তোমাকে না নিয়ে যাবো না, বড়আম্মু বলেছে তোমায় জোর করে নিয়ে যেতে না হলে তুমি না খেয়ে স্কুলে চলে যাবে।

৮ বছরের ছোট্ট তরু তাকে যে যেটা বলে সেটাই শুনবে আর করব , কখনোই না শব্দ বের হয় না। তাই এখনো ব্যতিক্রম নয়। সে বলেছে মানে জোর করেই আদ্রিক কে সে নিয়ে যাবে। তাই কথা বলা শেষ হতে না হতে রুমে ঢুকে পরেছে। এদিকে আদ্রিক নিজের ইজ্জত বাঁচাতে কোনো রকম তোয়ালে পেচিয়ে নিয়েছে। এই তরু মান ইজ্জত রাখবে না আহাম্মক একটা। তরুর দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। এদিকে তরু আদ্রিক কে দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর বলছে,ভাইয়া তুমি অলস কেনো? কাপড় পড়তে এতো সময় লাগে।

চুপ কর পাকা বুড়ি, যা এখান থেকে নয়তো কান মলে দিবো তোর।

ঠিক আছে যাচ্ছি আমি, কিন্তু আজকে তোমাকে না খেয়ে স্কুল আমি যেতে দিবো না। কথাটা বলেই দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো তরু। আদ্রিক তারাতাড়ি করে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে কাপড় পরে নিলো। তারপর রেডি হয়ে নিচে নেমে গেলো অনেক লেট হয়ে গেলো। ডাইনিং রুমে গিয়ে আদ্রিক তরুকে ফ্লোরে বসে খেতে দেখে রাগে গা জ্বলে উঠলো। চোখে মুখ শক্ত করে রাগান্বিত কন্ঠে বলে, তরু।”

তরু সবে মাত্র খেতে বসেছে। দুই লোকমা ভাত খেয়েছে, আরেক লোকমা ভাত মুখে দিবে সেই মুহুর্তেই আদ্রিক এসে হাজির। আদ্রিকের এমন ডাক শুনে ছোট্ট তরু ভয়ে কেঁপে উঠলো। তড়িৎগতিতে দাঁড়িয়ে পরলো সে। ডাইনিং টেবিলে রিয়া, টিয়া,আয়না, ফাহিম সবাই খেতে বসেছিলো। আদ্রিকের কন্ঠ শুনে তারাও খাওয়া বন্ধ করে দেয়। কিচেন থেকে আয়েশা বেগম, রজনী বেগম বেরিয়ে আসে। লিভিং রুমে বসে ছিলেন বৃষ্টি বেগম আর জাফর মির্জা। তারাও আদ্রিকের কন্ঠ শুনে বেশ কৌতূহল নিয়ে জিগ্যেস করেন, কি হয়েছে আদ্রিক,তরু আবার কি করলো?
কিন্তু প্রত্ত্যুতরে কোনো জবাব এলো না।

মির্জা বাড়ির বড় ছেলে আদ্রিক মির্জা তার রাগ সমন্ধ সবারই জানা, কারোর অজানা নেই। আদ্রিক তৎক্ষনাৎ তরুর কাছে চলে এসেছে। এসেই তরুর হাত শক্ত করে ধরে কর্কশ কন্ঠে বলছে, তোকে কে এখানে খাবার খেতে বসতে বলেছে বল? ”

ছোট্ট তরু অল্পতেই ভিষণ ভয় পায়। ছোট হলে কি হবে বুঝ আছে তার। এই যে এখন এটা নিয়ে পুরো মির্জা বাড়ি তুলকালাম করে ছেরে দিবে। এটা তরু খুব ভালো করেই জানে। তাই সে চুপ করে আছে, কিছুই বলছে না।
পাশ থেকে আয়না বলে, মেঝো মা বলেছেরে।”

এবার রাগ যেনো দ্বিগুণ বেরে গেলো আদ্রিকের। সে এবার উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলছে, মা মা কোথায় তুমি?”

আদিবা বেগম কাজের মেয়ে মদিনাকে নিয়ে ছাঁদে গিয়েছিলো। ছাঁদের কাজ শেষ করে সিরিতে পা দিবে সেই সময় আদ্রিকের ডাক কর্ণকুহরে পৌঁছায়। তিনি দ্রুত নিচে নেমে আসেন। এদিকে আদ্রিক বাড়ির কারোর কথা
কানে নিচ্ছে না, তার জবাব তার মাকেই দিতে হবে। আদিবা বেগম এসেই ছেলে পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, কি হয়েছে বাবা?

আদ্রিক নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, তরুকে কেনো ফ্লোরে খেতে দিয়েছো? তোমাকে আমি বলিনি এবাড়ির আর পাঁচটা মেয়ে যেমন করে বড় হচ্ছে তরুও ঠিক তেমন করে বড় হবে। তাহলে ওকে কেনো তোমরা অবহেলা করছো। আমার কথা কি কারো মনে নেই নাকি।”

আদিবা বেগম আদ্রিকের এমন আচরণ দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে, আদ্রিক এটা মির্জা বাড়ি। আর তুই তরুর জন্য প্রতিদিন বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখছিস। তোকে কি শিক্ষা দিচ্ছি আমি। একটা ভদ্র ছেলের ব্যবহার এমন হয় না।”

মা এটা আমার জবাব নয়৷ আমি বলেছি তরুকে কেনো ফ্লোরে খেতে দেওয়া হয়েছে। আমার কিন্তু এক কথা বারবার রিপিট করতে ভালো লাগে না।

আদিবা বেগম ভালো করেই জানে তার জেদি ছেলে এর উত্তর না পেলে স্কুলে যাবে না বরং আরো বেশি করে ঝামেলা করবে। এই জন্য আর কথা না বাড়িয়ে তিনি তপ্ত শ্বাস ফেলে উত্তর দেন,
” আসলে তরু চেয়ার থেকে টেবিলে হাতে পাচ্ছিলো না তাই ওকে ফ্লোরে বসিয়েছি। এটাকে তুই খারাপ ভাবে নিচ্ছিস কেনো। ওর সুবিধার জন্যই তো..।

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আদ্রিক বলে,

বুঝলাম ও হাতে পায় না, তাহলে তাকে পান্তা ভাত খেতে দিয়েছো কেনো?

আমি খেতে চেয়েছি, মেঝো মা দিতে চায় নি। ” তরু বললো।

তরু তোকে না বলেছি এসব পান্তা ভাত খাবি না। কেনো শুনিস না তুই। আদ্রিকের রাগ দেখে এবার তরু কান্না করে দিলো। তাই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

আমার খেতে মন চেয়েছে, আমি তো আগে মায়ের সাথে পান্তা ভাত খেতাম।

চুপ কর তুই। আর একটা কথাও শুনতে চাই না। চল আমার সাথে।

আদ্রিক তরুর হাত ধরে টেনে মদিনার রুমে নিয়ে যায়। সেখানেই সে থাকে মদিনার সাথে। টেবিলে স্কুল ব্যাগ রাখা ছিলো সেটা হাতে নিয়ে তরুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বাড়ির প্রত্যেক মানুষ সেদিকেই হা করে তাকিয়ে আছে। আদিবা বেগম রেগে হনহন করে নিজের রুমে চলে যায়।
____

রাস্তায় এসে আদ্রিক একটা রিকশা ডেকে নিলো। সেই রিকশায় দু’জনে উঠে বসলো। ছোট্ট তরুর মন ভিষণ খারাপ তাই অন্য দিকে ঘুরে আছে। চোখ দুটো এখনো তার ভেজা। আদ্রিক নিজের রাগ কন্ট্রোল করে তরুর দিকে একটু ঘেসে বসে। তারপর নিজের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তরু কিছুতেই আদ্রিকের দিকে তাকাচ্ছে না। ছোট্ট তরু ভিষণ অভিমানী। আর সেই অভিমান আদ্রিকেই ভাঙাতে হবে।
তাই স্নিগ্ধ কন্ঠ বলে, এই তরু আমার দিকে তাকা।
তরু কিছুতেই শুনলো না। এবার আদ্রিক জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে তরুর চোখের জল মুছে দেয়। তারপর ছোট তরুকে জরিয়ে ধরে বলে,
” জানিস তরু, তুই যখন রাগ করিস তখন তোকে খুব মিষ্টি লাগেরে।”
“ছাড়ো তুমি আমায়, আমি তোমার সাথে কথা বলবো না।

আদ্রিক তরুর অগোচরে আলতো হেসে বলে,
এই পিচ্চি তরু এতো অভিমান কোথা থেকে আসে রে তোর।”

আমি অভিমান বুঝিনা, এটাই জানি তোমার সাথে আমার কথা নেই নেই নেই।”

ঠিক আছে তোকে কথা বলতে হবে না।”

তরুর স্কুলের সামনে রিকশা দাঁড় করলো আদ্রিক। তারপর ভাড়া মিটিয়ে তরুর হাত ধরলো। তরু স্কুলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেও আদ্রিক অন্যদিকে নিয়ে গেলো। সেটা হোটেলের দিকে। স্কুলের সামনেই একটা হোটেল আছে। সেখানে গিয়ে তারা দুজনে বসলো। তরু আদ্রিককে বললো, আমরা হোটেলে কেনো আসলাম, আমরা তো স্কুল যাবো।”

আদ্রিক তরুর মাথায় টোকা দিয়ে বলে, ছোট মাথায় কত বড় বড় কথা বলিস, অথচ এটা জানিস না হোটেলে মানুষ কি জন্য আসে।”

তরু চোখ টিপে বললো, জানি তো খেতে আসে।”

আদ্রিক তরুর চুল গুলো ঠিক করিয়ে দিয়ে বলে, হুম আমরা এখন খাবো রে।”

প্রায় ২০ মিনিট পর দু’জনে বেরিয়ে আসলো হোটেল থেকে। তরুকে নিজের ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে আদ্রিক চলে যায়।
___

সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসলো। চারিদিকে হালকা মৃদু বাতাস বইছে। অল্প অল্প রোদের আচর এসে পরছে তরুর গায়ে। আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখে, আকাশে সাদা মেঘ কত সুন্দর। আর কত পাখি না উড়ে উড়ে চলেছে নিজ গন্তব্যে। শুধু তাদের নয়, তরুরও গন্তব্য আছে, সেদিকেই যাচ্ছে তরু। রাস্তায় ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলো খেলছে তাঁরা তরুকে বলে, কোথায় যাস তরু? তরু হেসো জবাব দিলো, আমি বাড়ি যাচ্ছি।”
কয়েকটা বাড়ি পার হতেই একটা বৃদ্ধ মহিলা লাঠি ভর করে তরুর সামনে এলো। তরু বৃদ্ধ মহিলাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলে, কেমন আছো দাদি?
“খুব ভালো আছিরে। তা তুই এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?
“বাড়ি যাচ্ছি গো দাদি।”
“ও বাড়িতে তো কেউ নেই রে।
” জানি আমি। তুমি যাও আমি গেলাম।”

এদিকে আদ্রিক বাড়িতে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে নেয়। তার মাথাটা ভিষণ ভার হয়ে আছে। কোনো রকম বেডে গা এলিয়ে দেয়। পরমুহূর্তেই মদিনার কন্ঠ আদ্রিকের কর্ণকুহরে আসে, তরু তরু কোথায় তুই? ”
মদিনা আদ্রিকের রুমের বাইরে থেকে বলে, আদ্রিক বাবা এখানে কি তরু আছে?
” না নেই।
” ওহ, আসলে স্কুল থেকে নিয়ে এসে বাড়িতেই ছিলো ঘন্টাখানিক তারপর থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। মেয়েটা যে কখন কোথায় যায় বুঝি না।”
মাদিনার কথা শুনতেই একলাফে বেড থেকে নেমে পরে। তারপর দরজা খুলে বাইরে এসে বলে, খালা তোমাকে না বলেছি তরুকে চোখে চোখে রাখবে।”
“রাখি তো বাপজান। কিন্তু তরু যে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়।
আদ্রিক আর কথা না বাড়িয়ে আবারও পুরো বাড়ি খুঁজলো। আদ্রিক আর মদিনার কথা শুনো পুরো বাড়ির লোক জড়ো হয়ে গেলো। সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো। সবাই খুঁজছে। আদ্রিক বাড়ির বাইরে এসে খোঁজা শুরু করে দিলো। বাড়ির সামনেই একটা দোকান আছে, রহিম মিয়া নামে এক লোক থাকে। তাকে গিয়ে আদ্রিক জিগ্যেস করলো, চাচা তরুকে দেখেছেন?
রহিম মিয়া উত্তরে বলল, দেখছি তো, ওই ডান দিকে গেছে।”
আদ্রিকের আর বুঝতে বাকি রইলো না কোথায় গিয়েছে। বাড়ির ভিতরে এসে সাইকেল নিয়ে সেদিকে রওনা দেয়। আর বাড়িতে বলে গিয়েছে সে তরুকে আনতে যাচ্ছে কেউ যেনো চিন্তা না করে।

কিছুসময় পর একটা পুরনো ভাঙা বাড়ির সামনে এসে সাইকেল থামালো। বাড়ির দরজা খোলা। সে সাইকেল টা জায়গা মতো রেখে ঘরের ভিতর চলে আসে।
ছোট্ট তরু তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। আদ্রিকের বুকের ভিতর কেমন মোছর দিয়ে উঠলো। এতো টুকু মেয়ে কি মায়া জালেই না আবদ্ধ। সে যে ভিতরে ভিতরে কষ্ট পায়, মায়ের জন্য মন খারাপ হয় সে বুঝতে পারে। তরুকে কখনোই সেই কষ্ট উপলব্ধি করাতে চায় না। তরুর মাথার কাছে আসতে করে বসে পরে। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তরু চোখ পিট পিট করে খুলে বলে,মা তুমি এসেছো।

#চলবে?