শেষ পাতার তুমি পর্ব-২৬

0
624

#শেষ_পাতার_তুমি
#ফারিয়া_আফরিন_ঐশী
#পর্বঃ২৬

আসন্ন ভয়ে আয়ানা কাঁদছে আর বারবার বলছে–আমি যাবো না রায়ান প্লিজ।

এখনো বাড়ির সবার মাথায় বন্দুক ঠেকানো।রায়ান নিরুপায়,পরিবারকে বাঁচাতে তাকে তার স্ত্রী কে বিপদের মুখে ফেলে দিতে হলো।

শান্ত চলে যাওয়ার খানিকপর ওর লোকেরাও চলে গেলো।

রায়ান কপাল চেপে চেয়ারে বসে আছে, চোখজোড়া বন্ধ।

রেশমি আর রেদোয়ান ও চুপ করে বসে আছে,আয়ানার কথা ভেবে দুজনেই বেশ টেনশনে আছে।

দাদি তো নিজের ঘরে বসে নামাজ পড়ছেন,কারণ এখন সৃষ্টিকর্তাই ভরসা।

রায়ান আচমকা বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো।

রেশমি জিজ্ঞেস করার আগেই সদর দরজা পার হয়ে চলে গেল রায়ান।

অপরদিকে,

আয়ানা ঘরের এককোণে গুটিসুটি দিয়ে বসে আছে।

একটু দূরে শান্ত খাবার হাতে আয়ানার সামনে বসে আছে।

শান্ত–আয়ু, এমন কেনো করছো?আমরা তো বেস্টফ্রেন্ড।ঐ রায়ান তোমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।

আয়ানা নিশ্চুপ।

শান্ত–প্লিজ কথা বলো।কিছু খেয়ে নেও এটলিস্ট।

আয়ানা এবার চড়া গলাতে বলল–হ্যাঁ আমি খেলেতো সুবিধা তাইনা?আমাকে সেন্সলেস করে পার্টির হাতে তুলে দিতে পারবে।

শান্ত খানিক অবাক হলেও তা বাইরে প্রকাশ না করে বলল–কি সব বলছো?

আয়ানা–একদম নাটক করবে না।

শান্ত প্লেট রেখে দাঁড়িয়ে বলল–আচ্ছা, করলাম না।আর হুমম,খাবারে কিছু মেশাইনি।খাবারের পর ইনজেকশন পুশ করবো তাতে কষ্ট হবে তাই খেতে বলেছি।

আয়ানা উঠে দাঁড়িয়ে শান্তর সামনে এসে কলার টেনে বলল–লজ্জা করে না।আরেকজনের বউ তুলে আনতে।এতো নিচ কাজ করে তা মুখে স্বীকারও করছো।

শান্তর কলার ধরাতে বেশ ক্ষেপে গিয়ে বলল–না করেনা।তোর শাস্তি এখনো বাকি।

বলেই সজোরে এক ধাক্কা দিলো,মাথা ঠেকাতে কপালে হাত রাখলেও হাতে বেশ জোরে আঘাত লাগলো কাঠের টি টেবিলে।

শান্ত নিজের শার্ট ঠিক করে দরজা লক করে চলে গেলো।

আয়ানা হাত সামনে এনে দেখে হাতের আঙ্গুল লাল হয়ে আছে,নাড়াচাড়া করলেই ব্যথা হচ্ছে।

ফুপিয়ে কাঁদছে আয়ানা।

আয়ানা উঠে বারান্দা ঘেষা কাচের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

চোখ থেকে পানি ঝড়ছে,পানিটা ব্যথার তবে ব্যথাটা হাতের নয়।

বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে, শান্ত তাকে কোথায় রেখেছে তা ঠাহর করতে পারছে না আয়ানা।

বাড়ির বাইরে এতো গাছ-পালা দেখে আয়ানা কনিফিউশনে আছে,ঢাকা শহরে এতো গাছপালা ঘেরা জায়গা আছে নাকি।

অপরদিকে,

রায়ান তার এক বন্ধুর সাথে বসে আছে,

মূলত তারা ভার্সিটি দেখে বন্ধু।পুরোটা সময় ইনফরমেশন দিয়ে রায়ান কে তার এই বন্ধু আকিফ ই সাহায্য করেছে।আকিফ আইটি সেক্টরে কর্মরত।

আকিফেরই পরিচিতো আর্মির মেজর জুবায়ের সাহেব।

তারা ৩ জনই শান্তর খোঁজ নিচ্ছে।

আকিফ–শান্তর লোকেশন ট্রেস করতে পেরেছি।

জুবায়ের –গুড।লোকেশন নোট করো ফাস্ট।

আকিফ–স্যার লোকেশনটা ঢাকার বাইরে।নন্দনবাজার।

রায়ান–এটা তো ঢাকা থেকে মেবি বেশ দূর!

জুবায়ের –হুমম।যদি ভুল না হই তোমার ওয়াইফ এখানেই আছে।

রায়ান–আমাদের যাওয়া উচিত এখনি।

জুবায়ের –নো।স্টপ।শান্ত এতো কাঁচা কাজ করবে না যে আমরা যাবো আর আয়ানাকে নিয়ে আসবো।

রায়ান–তাও ঠিক।বাট এখন কি করবো?

জুবায়ের –লিসেন,আজ অলরেডি রাত হয়ে গিয়েছে, কাল সকালে রওনা হবো।আর তুমি রাতে আয়ানার সাথে দেখা করবে।ওকে যাবতীয় প্লান বুঝিয়ে দেবে।

রায়ান–ও কি পারবে??

জুবায়ের –ইনশাআল্লাহ ওকে পারতেই হবে।নাহলে খুব ক্ষতি হতে পারে সবার।

রায়ান চিন্তিত মুখ নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো।

রায়ান বেরিয়ে গেছে খেয়াল হতেই জুবায়ের বলল–ওহ শিট!রায়ানের ওপর এ্যাটাক হতে পারে।আকিফ গো।

বলতেই আকিফ দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।

রায়ান কিছুদূর হেঁটে আসতেই পিছে আকিফের আওয়াজ শুনতে পেলো।

রায়ান মুখ থেকে সিগারেট টা নামিয়ে বা হাতে ধরে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।

আকিফ রায়ানের কাছাকাছি এসে হাঁটুতে ভর করে হাঁপাতে লাগলো।

রায়ান–কি রে!ওমনে দৌড়াচ্ছিস কেনো?

আকিফ হাফ নিতে নিতে বলল–স্যার বলছিলো তোর রিস্ক আছে তাই।

রায়ান সিগারেটে টান দিয়ে বলল–ধুর!চল চা খাই।

আকিফ –ক্যাম্পের ভিতরের ক্যাফে থেকে খাবো চল।

রায়ান আর আকিফ আবারও ক্যাম্পের দিকে গেলো।

চা খেয়ে জুবায়ের কয়েকজন গার্ড সহ রায়ানকে বাড়ি পৌঁছে দিলো।

আর ৬ জন লোককে রায়ানদের বাড়ি সর্বক্ষণ পাহারা দিতে বলল।

রায়ান ঘরে এসে বারান্দায় বসে রইলো।

বারান্দায় এসে আবারো সিগারেট ধরালো।

রেদোয়ান এসে রায়ানের কাধে হাত রাখতেই রায়ান সিগারেট ফেলে বাবাকে বসতে দিলো।

রেদোয়ান –তোর তো এই নেশা ছিলো না বাবু?

রায়ান–আমি আর পারছি না বাবা।বাধ্য হয়েই!

রেদোয়ান –বুঝতে পারছি আমি।তবে স্মোক করা ভালো না বাবু।ছেড়ে দে ধীরে ধীরে।

রায়ান–তোমার বৌমাকে ফিরিয়ে এনেই বন্ধ করে দেবো বাবা।ও যে ক দিন ছিলো আমি স্মোক করিনি।

রেদোয়ান –হুমম! ঠিক হয়ে যাবে সব চিন্তা করিস না।

রায়ান স্হির দৃষ্টিতে রাস্তার পানে চেয়ে রইলো।

অপরদিকে,,

শান্ত বেল্ট হাতে রুমের সোফাতে বসে হাঁপাচ্ছে।

বিছানার নিচের পূর্ব কোণটাতে আয়ু পরে আছে।

তার পরোনে কাঁচা হলুদ শাড়িখানাতে হালকা রক্তের দাগ স্পষ্ট।

হাত, গলা,পিঠের যে অংশটুকু দেখা যাচ্ছে সবটাতে মোটা বেল্টের দাগ,কিছু কিছু ক্ষত থেকে রক্ত ঝড়ছে।

আয়ু ফিকরে কাঁদছে।

হাত-পা নাড়াতে পারছে না।

শান্ত বেল্ট ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলে–আমার কথার বাইরে কাজ করলে এর চেয়ে খারাপ অবস্থা করবো।সো ডোন্ট ডু দিছ।

বলেই শান্ত চলে গেলো।

আয়ানা ডুকরে কাঁদছে।জীবনে কখনো মা-বাবা তাকে একটা টোকাও দেয়নি।

কাঁদতে প্রায় চোখ বুজে আসে তার।ব্যথার দরুণ সেন্স হারায় আয়ানা।

পরদিন,

সকাল সকাল রায়ান,জুবায়ের, আকিফ নন্দন বাজারের উদ্দেশ্যে।

ঘন্টা ৪ পর তারা পৌঁছালো,লোকেশন অনুযায়ী শান্তর বাড়ির কাছাকাছি চলে এলো।

শান্তর এই বাগানবাড়ি বেশ নির্জন জায়গায়,

বেশ দূরে নন্দনবাজার মূল শহর।

আশেপাশে কোনো খাবার দোকানও নেই।

রায়ানরা বেশ দুরত্ব রেখে খোলা মাঠের এক কোণে তাবু টানিয়ে নিলো।সবাই কোনো এক কলেজের টি শার্ট পরে নিলো যাতে বোঝা যায় তারা কলেজ ক্যাম্পিং এ এসেছে।

রায়ানকে দিনের বেলায় তাবু হতে বের হতে বারণ করে দিলো জুবায়ের।

সারাদিন জুবায়ের, আকিফ শান্তর বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে ইনফরমেশন কালেক্ট করে নিলো।

মেইন গেটের বাইরে বেশ কড়া পাহারা।

জুবায়ের এর লোক একজন গার্ডের বেশ ধরে বাড়ির ভেতরের ইনফরমেশন পৌঁছে দিলো।

দিন শেষে,সন্ধ্যা নেমেছে মাত্র,

আয়ানার গা কাঁপিয়ে জ্ব এসেছে।ব্যথার দরুণ এতো জ্বর।ডাক্তার আনা সম্ভব না বলে শান্ত একজন মহিলা মেইডকে ঘরোয়া উপায়ে চিকিৎসা করতে বলেছে তাই সে আয়ুর মাথাতে জলপটি দিচ্ছে, শান্ত শহরে গিয়েছে ওষুধ আনতে।

বাড়ির সামনে কড়া পাহারা থাকলেও পেছনের ঝোপঝাড়ে তেমন পাহারা নাই।

বাড়ির পেছনের পাইপ পেয়ে আয়ানাকে রাখা ঘরের ছোট্ট বেলকোনিতে আসা যায়।

আকিফ রায়ানকে সেই রাস্তা বলে দিলো।

প্লান মোতাবেক রায়ান পাইপ বেয়ে বারান্দাতে উপস্থিত হতেই জলপটি দিতে থাকা মেইড বারান্দার দরজা খুলে বলল–আসুন।

রায়ানকে দরজা খুলে মেইড চলে যায়,

বাইরে থেকে দরজা লক করে।

রায়ান দ্রুত বিছানার কাছে এসে আঁতকে ওঠে।

আয়ানার মুখে বেশ কিছু আঘাতের দাগ সাথে হাতে,গলাতে।

রায়ান ধীর পায়ে কাছে এসে আয়ানার পাশে এসে কপালে হাত রাখতেই বুঝল আয়ুর বেশ জ্বর।

কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিতেই পিটটিট করে চোখ মেলল আয়ানা।

ঝাপসা চোখে রায়ানকে দেখে চোখে ভির করলো হাজারো পানিকণা।

উঠে বসার চেষ্টা করতেই রায়ান ধরে বসিয়ে দেয়।

রায়ান আয়ুর মুখ দুহাতের আজলে নিয়ে–কিভাবে আয়ু?

আয়ানা ভাঙা গলাতে বলল–কোনো একটা পেপারে সই করতে বলেছিলো, করিনি তাই বেল্ট দিয়ে মেরেছে।

রায়ানের চোখ ছলছল করে উঠলো।

আয়ানা উঠে বসাতে আঘাতের স্হান গুলো আরো ভালো করে বোঝা যাচ্ছে।

রায়ান আলতো হাতে টেনে আয়ানাকে নিজের বুকের ওপর নিলো।

দুজনের চোখ থেকেই পানি গড়িয়ে পড়ছে। দুজনেই নিরব।

নীরবতায় আঘাত করে আয়ানা বলল–আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রায়ান।

রায়ান আয়ানার মুখটা সামনে এনে সমস্ত মুখে ঠোঁট ছুয়ে দিলো আর বলল–সব ঠিক হয়ে যাবে।

আয়ানা–কবে?

রায়ান–দ্রুতই।শুধু আমি যা বলবো তাই করবে।

আয়ানা–আমি যদি মরে যাই?

রায়ান একটু রাগী চোখে তাকিয়ে বলল–ফারদার আর এমন ফালতু কথা বলবে না।

আয়ানা ঠোঁট ফুলিয়ে কান্নার বেগ তুলতেই রায়ান বলল–আরে কাঁদছো কেন?তোমার কিছু হলে আমার বাচ্চাদের কি হবে?তারা তো তাদের মা কে মিস করবে।

আয়ানা–সব সময় ফাজলামো।

আয়ানাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছু কাজ বুঝিয়ে দিলো।

আয়ানাকে খাবার খাইয়ে দিয়ে রায়ান চলে যায়।

আর বলে যায়–মাঝরাতে আবারও আসবে।

আয়ানার জ্বর হালকা নামলেও মাথাব্যথা করছে তাই বিছানাতে গা এলিয়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে পাড়ি দেয় ঘুম রাজ্যতে।

ওপরদিকে,

শান্ত ওষুধ এনে দেখে আয়ানা বিভোর ঘুম।ওষুধ রেখে চলে যায়।

রায়ান মাঝরাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

রায়ান গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে,

জুবায়ের পানির বোতল হাতে পাশে দাঁড়িয়ে বলল–একটা কথা বলি।

রায়ান–জি স্যার,বলুন।

জুবায়ের –বিদেশ যাওয়ার চিন্তা ছিলো নাকি কখনো?

রায়ান–ভার্সিটি লাইফের শুরুর দিকে প্লান ছিলো বাট মধ্যবিত্ত বুঝতেই পারছেন স্যার।

জুবায়ের –হুমম।

#চলবে

১২৬০ শব্দ😊