#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৩৪
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
সেইরাতের পর থেকে আমার জীবনটা পুরোপুরি যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। সারাদিন এই আবদ্ধ ঘরে পড়ে পড়ে নরক যন্ত্রণা ভোগ করা,রাত হলে নিজের জন্য খাবার যোগাড় করা,এদিক সেদিক উদ্দেশ্যেহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো।এই ছিলো আমার জীবন।
সেই রাতের পর আমার জ্বিন সত্ত্বার ক্ষমতা অনেকটাই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেই ক্ষমতাগুলো অনেক জলদি রপ্ত করে ফেলি আমি।
এগুলো ব্যবহার করেই আমি নিজের জীবন পার করতে শুরু করি।
আমার না কোনো কথা বলার মানুষ ছিলো না সঙ্গী।
আর আমি কাউকে খোঁজার চেষ্টাও করিনি,আমার অভিশাপ কাটাতে পারে সেই মানুষটাকে পর্যন্ত না।
মায়ের মর্মান্তিক মৃ’ত্যুটা আমার মনে অনেক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো। আমার করা পাপের ফলে আমার নির্দোষ মায়ের এমন করুণ মৃ’ত্যু হয়েছে। সেই অনুশোচনা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো।
মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মূল্য আমি এভাবে দিয়েছি তাকে,আমার কারো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার থাকতে পারেনা। এটাই আমার শাস্তি।
তবে এই একাকিত্ব অনেক অসহ্যকর হয়ে উঠতো মাঝেমাঝে।
অনেক ইচ্ছে করতো মায়ের বকা হলেও শুনতে অন্তত,কিন্তু সারারাত মায়ের সমাধির সামনে বসে থেকে হাজারো বকবক করলেও,তার কোনো জবাব আসতোনা।
এভাবে কেটে যায় ২৫টি বছর। ততোদিনে আমি আমার শক্তিগুলোর প্রতি এবং আমার অভিশপ্ত জীবনের প্রতি পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
তারপর একদিন দেখা হয় আমার সামশের এর সাথে।
গভীর রাত তখন,নির্জনা কুঠির পেছনের জঙ্গলটায় হঠাৎ আমি কিছু মানুষের উপস্তিতি টের পাই।
আমার প্রখর দৃষ্টি দিয়ে আমি দেখতে পাই একদল মানুষ একজনকে ঘিরে আগুন জ্বা’লিয়ে কিসব করছে। আমি ভেবেছিলাম তাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মা’রার চেষ্টা করছে।
দৃশ্যটা আমার কাছে অনেক পরিচিত এবং করুণ ছিলো ,তাই দেখেও না দেখার ভান করতে পারিনি আমি। আমি সামশেরকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলাম সেদিন,তাই সে নিজ থেকে আমার বশ্যতা স্বীকার করে। ওর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলোনা তাই আমিও মানা করিনি ওকে আমার সাথে রাখতে।
কথায় কথায় তার থেকে আমি জানতে পারি সে একজন নিম্ন প্রজাতির জ্বিন। সে একজন মানুষের বশ্যতা স্বীকার করে তার কাছে থাকতো। কিন্তু মানুষটির মৃত্যুর পর সে একা হয়ে পড়ে অনেক।
এদিকে একদল তান্ত্রিক সে জ্বিন সেটা জানতে পেরে তাকে এখানে এনে তন্ত্রসাধনা করে নিজেরা ক্ষমতাধর হতে চেয়েছিলো। তন্ত্রসাধনার জন্য তারা তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো।
আমি কখনো ওকে লজ্জায় বলিনি এটা,কিন্তু ওকে পেয়ে আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। অবশেষে আমি একজন সঙ্গী পেলাম,কারোও সাথে কথা বলতে পেরে অনেক ভালো লেগেছিলো সেদিন আমার। আমার অভিশপ্ত জীবনের কথা পুরো খুলে বলি আমি তাকে। সে তখন থেকেই লেগে পড়ে আমাকে এই কষ্ট থেকে মুক্ত করতে।
সামশের মানুষের সাথে থাকার ফলে সে সব কাজে অনেক পটু ছিলো। সে আসার পর আমার অগোছালো ছন্নছাড়া জীবনটা ধীরে ধীরে গুছিয়ে উঠতে শুরু করে।
আমি ধীরে ধীরে আমার হতাশা থেকে বেড়িয়ে আসি।
সামশের ভাবে আমি তার রক্ষাকর্তা,তার আশ্রয়দাতা,কিন্তু আমি কখনো ওকে লজ্জায় বলে উঠতে পারিনি সে আমার জীবনের প্রথম বন্ধু ছিলো আর আমি কতটা কৃতজ্ঞ তার প্রতি।
সে আমাকে আমার শক্তিগুলো আরও নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে। সে কোনো বিশেষ ক্ষমতাধর জ্বিন না হলেও,এসব সম্মন্ধে প্রচুর জ্ঞান ছিলো তার। সে আমাকে অনেক কিছুই শেখায় যা আমি আগে কখনো জানতাম না।
সে আমার যাবতীয় কাজ সামলানোর পাশাপাশি আমার অভিশপ্ত জীবনের মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে,এমন এক মানুষ যে আমাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসবে।
আমি তখনও এই ব্যপারে পুরোপুরি মনস্থির করতে পারিনি,তাই আমি এই বিষয়টা পুরোপুরি তার উপর ছেড়ে দিই।
সে ই ঠিক করেছে আমার বিবাহ করা উচিত। মা ছাড়া নিঃস্বার্থ ভালোবাসা শুধু একজন সত্যিকারের জীবনসঙ্গী দিতে পারে।
কিন্তু এতোই সহজ নাকি এমন একজন জীবনসঙ্গী পাওয়া?
আমি স্বাভাবিক হলেও এমন মানুষ পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই,ভাগ্য করে মানুষ সত্যিকারের ভালোবাসা পায়।
সেখানে আমার এতো অস্বাভাবিকতার সাথে কে আমাকে ভালোবাসবে?
তার উপর নির্জনা কুঠি তখন কুখ্যাত হানাবাড়ি নামে পরিচিত। এদিকে কেউ সহজে পা মাড়াতো না।
তবে সামশের হাল ছেড়ে দেয়নি,আমি তার উৎসাহ দেখে তাকে আর মানা করতে চাইনি। কিন্তু সাথে আমি কিছু শর্ত জুড়ে দিই,কারণ আমি কোনো নারীসঙ্গ খুঁজে বেড়াচ্ছিনা,একজন জীবনসঙ্গী খুঁজছি যে আমার অস্বাভাবিকতার মাঝেও আমাকে ভালোবাসবে। আর কোনো মিথ্যা বলে সম্পর্ক শুরু করা যাবেনা,যে আমাকে ভালোবাসবে,এতো বড় উপকার করবে তাকে অন্তত মিথ্যার জালে ফাঁসাতে চাইনি আমি। এসব অস্বাভাবিকতা মেনে যে আমাকে বিবাহ করতে চাইবে তাকেই আমি স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবো সে যেমনি হোক।
সামশের এতো বছরে অনেক মেয়ের সম্মন্ধ ই এনেছে আমার জন্য। কেউ এতিম ছিলো যার কেউ নেই,কেউ সর্বস্বহারা যার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই,কারো অনেক টাকার প্রয়োজন ছিলো ইত্যাদি।
কিন্তু এই মেয়েগুলোর কেউ কেউ আমার শর্ত মানতে রাজি না থাকায়,আমাকে বিশ্বাস করতে না পারায় ফিরে গিয়েছে,যারা টাকার প্রয়োজনে এসেছিলো আমি তাদের তোমার মতোই অগ্রিম টাকা দিয়েছিলাম,ফিরে আসলে বুঝবো সে আসলেই এই সম্পর্কে আগ্রহী,কিন্তু তারা ফিরে আসেনি আর,আর যারা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিলো তারা কেউ তাদের কৌতুহল দমন করতে পারেনি,আমার সাথে প্রথম সাক্ষাতেই তারা আমাকে দেখে ফেলে নিয়মভঙ্গ করে।
আমি মূলতই এই চোখ বন্ধ করার শর্তটা দিয়েছিলাম কারণ আমার মতে যারা রূপ দেখে ভালোবাসে সেই ভালোবাসা কখনো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা হতে পারেনা,আর আমি আমার বাবার মতো সৌন্দর্যের পূজারী মানুষগুলোকে ঘৃ’ণা করি।
তাদের সাথে আর যা ই হোক ভালোবাসা হয়না,সৌন্দর্যের মোহ কেটে যেতেই তারা আমার অপূর্ণতাগুলোকে নিয়ে আফসোস করবে।
যাইহোক এতোগুলো বছরে সামশের শত চেষ্টা করেও এমন মেয়ে খুঁজতে পারেনি। যারা এসে ফেরত গিয়েছিলো তাদের আমি কখনো ফেরানোর চেষ্টা করিনি,শুধু পরে এখানে আসার স্মৃতিটুকু মুছে দিয়েছি। এটা আমার ক্ষমতাগুলোর মধ্যে একটি,আমি কারো আংশিক স্মৃতি মুছে ফেলতে সক্ষম,তবে সেটা অনেক সামান্য পরিসরে।
এভাবেই একদিন সামশের নিয়ে আসে এই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির পরিকল্পনা। সে এমন সব বৈশিষ্ট্য সেখানে লিখে যা পুরোপুরি কোনো অসহায় মেয়েকে উপস্থাপন করে।
একজন কালো রঙের ২৫-৩০বছরের কুমারী মেয়ে,যে উত্তীর্ণ হলেই ২৫লক্ষ টাকা পাবে।
বুদ্ধিটা অনেক হাস্যকর ছিলো,আমি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম এটা সামশের এর আরেকটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা হতে চলেছে,এই মেয়ে আসবেই টাকার লোভে,সে আমাকে
ভালোবাসবে কিভাবে?
আমি কি জানতাম নাকি এই হাস্যকর বিজ্ঞপ্তিটি আমার জীবনে আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিটিকে নিয়ে আসবে।
সেদিনও আমি আমার ঘরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলাম,যখন সামশের নীচে মেয়েদের সাথে সাক্ষাৎ করছিলো।
আমার সৃষ্ট বাড়ির সুরক্ষা বলয় ভেদ করে তখন পর্যন্ত দুইজন নারী এসেছিলো,আমি তাদের সব কথা ই শুনতে পেয়েছিলাম,সেই একি ঘটনা,নতুন কিছুই নেই। সূর্য প্রায় অস্ত গিয়েছে যখন এই দ্বিতীয় মেয়েটা বের হয়ে যায়,ভেবেছিলাম আর কেউ আসবেনা আপাতত।
সূর্য মাত্র ডুবে যাওয়ায় ছাড়া পেয়েছিলাম আমি মাত্র,তখনি আবার বুঝতে পারি বাড়ির সুরক্ষা বলয় ভেদ করে নতুন কারো প্রবেশ ঘটেছে।
আমি আমার দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম নতুন অতিথিকে।
তখন শরীর অনেকটা দুর্বল হওয়ায় শুরুর দিকে আমার দৃষ্টি একটু ঝাপসা ছিলো।
সেই ঝাপসা দৃষ্টিতে হঠাৎ তোমাকে দেখে মনে হয়েছিলো মা দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে। চমকে গিয়েছিলাম অনেক আমি,তারপর দৃষ্টি একটু পরিষ্কার হতেই বুঝলাম মনের ভুল ছিলো। তবে পুরোপুরি ভুলও নয়,তুমি মায়ের থেকে অনেক লম্বা আর স্বাস্থ্যবান ছিলে,কিন্তু তোমার চোখ দুটো একদম আমার মায়ের মতো ছিলো,যেখানে তাকালেই শুধু একরাশ অসহায়ত্ব আর জীবনের প্রতি ক্লান্তি দেখা যায়।
সত্যি বলবো শ্যামা,তোমাকে প্রথম দেখেই কেনো জানি ভালো লেগে যায় আমার।
তাই সামশের যখন তোমাকে নীচে রেখে উপরে আমার অবস্থা জানতে আসে তখন আমি নিজ থেকেই বলেছিলাম তাকে আমার এই মেয়েটা ভালো মনে হচ্ছে।
সামশের প্রথমবার আমার উৎসাহ দেখে অনেক খুশি হয়ে গিয়েছিলো,তড়িৎ গতিতে ছুটে গিয়েছিলো নীচে।
এভাবে হুট করে সামনে উদয় হলে তুমি ভয় পাবে এটাও মনে ছিলোনা ওর,ভাগ্যিস তুমি মাথা নীচু করে ছিলে আর ওকে এভাবে উদয় হতে দেখোনি নয়তো সেদিনই পালাতে তুমি।
তবে শেষ রক্ষা হয়নি,তুমিও শর্তগুলোর কথা শুনে মেনে নিতে পারোনি।
তবে অন্য মেয়েগুলির থেকে তুমি পুরোপুরি আলাদা ছিলে,যেখানে ওরা টাকাগুলো পাওয়ার অনিশ্চয়তা নিয়ে রেগে গিয়েছিলো,তাদের সাথে ফ্রড হচ্ছে বলে রেগে গিয়েছিলো,তোমার রাগের কারণ পুরোপুরি ভিন্ন ছিলো।
তুমি রেগে গিয়েছিলে কারণ কেউ তোমাকে টাকার বদলে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করবে সেই কথাটা তোমার আত্মসম্মানে লেগেছিলো তাই।
তুমি আমাকে উদ্দেশ্য করে অনেক কথা ই শুনিয়ে দিয়েছিলে তখন,বেচারা সামশের ভেবেছিলো আমি নিশ্চয়ই রেগে গিয়েছি এসব শুনে,কিন্তু আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তোমার প্রতি। এতোটাই যে এই দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে জানালা পর্যন্ত গিয়েছিলাম তোমাকে একবার সরাসরি দেখার জন্য,তবে তুমি একবারও পিছন ফিরে তাকাওনি রাগের মাথায়।
তখনই আমি ঠিক করে ফেলি আমার তোমাকেই লাগবে স্ত্রী হিসেবে।
প্রথমবার কোনো মেয়ে চলে যাওয়ার পর আমি তাকে ফিরিয়ে আনার পণ করি।
তবে তুমি মেয়েটা এতো ভাবুক হবে কে জানতো?ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে ম’রার পরিকল্পনা করছিলে,ভাগ্যিস রাত বারোটা বেজেছিলো তখন,আমি তোমাকে আমার শক্তি দিয়ে সরিয়ে আনতে পেরেছিলাম।
তারপর আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়,সেই সাক্ষাতে তুমি আমাকে বলেছিলে সবার ভাষায় তুমি অসুন্দর,স্বার্থ ছাড়া কেউ তোমাকে গ্রহণ করবেনা,তোমার কথা শুনে মনে হয়েছিলো তুমি নিজেও তাই বিশ্বাস করো।
আমার অনেক মায়া হয়েছিলো তোমার উপর,আমার মা ও তার গায়ের রঙের কারণে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন।
তোমার প্রতি এই মায়া থেকেই আমি অনেক বড়ো একটি ভুল করি সেদিন।
আমার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ,আমি চাইলেই কাউকে রাতারাতি সুন্দরী করে দিতে পারিনা,তবে আমি তোমাকে জ্বিন হিসেবে একটা বর দিয়েছিলাম সেদিন,তোমার গায়ের রঙ এতোটা মলিন হয়ে যাক যতটা হলে তুমি নিজেকে অসুন্দর ভাবা বন্ধ করবে।
তোমার জীবনে আমি না থাকলেও তুমি যেনো একজন ভালো জীবনসঙ্গী পাও,সেই ইচ্ছা থেকেই আমি তোমাকে এই বর দিয়েছিলাম,কিন্তু এটা আসলেই আমার ভুল ছিলো,কেনো সেটা পরে বুঝতে পারবে।
পরের কাহিনি তোমার জানা শ্যামা। তোমার এই ছোট ছোট বৈশিষ্ট্যগুলো আমাকে অনেক মুগ্ধ করে। তুমি আমাকে না দেখে না জেনে কিভাবে ভালোবেসেছো আমি জানিনা।
কিন্তু আমি তোমার মনে আমার প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা জাগাতে গিয়ে নিজেই তোমাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলি।
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আমার মনের এই অজানা অনুভূতিগুলো শুধুই আমার মুগ্ধতা,আর কিছুই না।
কিন্তু সেই রাতে যখন তোমার ভাই ভাবীর কথায় তোমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো,বিশ্বাস করো শ্যামা আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
ঠিক সেই আতঙ্ক অনুভব করেছিলাম আমি যেটা মায়ের মৃ’ত্যুর সময় অনুভব হয়েছিলো।
অনেক ভয় পেয়েছিলাম আমি যখন ওই ছেলেটা তোমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস সেদিনও সময়মতো উপস্থিত হতে পেরেছিলাম আমি।
সেদিন এতো বছর পর আবার সেই ক্রোধ অনুভব হয় আমার,সবগুলোকে সেই একিভাবে হ’ত্যা করি আমি।
সেদিন যখন তোমাকে সুস্থ অবস্থায় বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছিলাম,অবশেষে আমার বিক্ষিপ্ত মনটা একটু শান্ত হয়েছিলো। সেই মূহুর্তে আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার অনুভূতিগুলো কোনো মুগ্ধতার রেশ নয় যা সময়ের সাথে কেটে যাবে,আমি তোমাকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি। আর আমি তোমাকে যে কোনো মূল্যে হারাতে পারবোনা,সবসময় আমি থাকি না থাকি,তোমার জীবনের সব বিপদ উপড়ে ফেলবো গোড়া থেকে,এটাই পণ করি আমি।
তোমার ভাইকে আমি মে’রে ফেলতে চাইনি,কিন্তু আমার এটা ছাড়া উপায় ছিলোনা। ওকে আমি প্রথমে সতর্ক করে দিই,তোমার ভাবী পরের মেয়ে,তার থেকে কিছুই আশা রাখিনি আমি।
কিন্তু তোমার ভাই,ভেবেছিলাম ও তোমার আপন ভাই,মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হলেও হয়তো নিজের বোনকে রেহায় দিবে। কিন্তু ভারী কা’পুরুষ সে,বউয়ের নরম দুটি কথাতেই সে পুরোপুরি রাজি হয়ে গেলো তোমার চরিত্র নষ্ট করতে,একবার খোঁজ ও নেয়নি সে যে যাদের হাতে তুলে দিচ্ছে কেমন মানুষ তারা। আমি তার মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারলেও,সেই আতঙ্ক তোমার প্রতি দয়া সৃষ্টি করতে পারেনি তার মনে।মনের আতঙ্ক একটু কমলে আবার তোমার ক্ষতি করতো তারা। আমার সব রাগ তোমার ভাইয়ের উপর ছিলো।
স্বার্থপর র’ক্তের সম্পর্ক,একদম আমার বাবা ভাইদের মতো। আমি তবুও হয়তো ছেড়ে দিতাম তাকে তোমার ভাই হিসেবে।
কিন্তু তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করে আমি এদের দুটোকেই তোমার ভবিষ্যৎ জীবন থেকে সরিয়ে দিই। তোমার ভাবী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন,ওই বাচ্চাটার কোনো দোষ নেই,তাই আমি তাকে পুরোপুরি হ’ত্যা না করলেও তাকে তোমার ভাইয়ের হ’ত্যার আসামি বানিয়ে দিই। যাতে সে তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের অংশ না থাকে।
সেই রাতেই সেই ফকিরের সাথে এতোগুলো বছর পর আবার আমার দেখা হয়।
তিনি আমাকে তখন আমার জীবনের ভয়াবহ সত্যিটা মনে করিয়ে দেন,যেটা আমি শুধু আমার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম।
আমি পরিপূর্ণ মানুষ নই,আমি জ্বিন,আর জ্বিনদের কোনো মানুষকে ভালোবাসা নিয়মবিরুদ্ধ,নিয়মভঙ্গ করলে প্রাণ সংশয় ঘটবে তার।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তখন শুনে যে তোমার জীবনের এই বিপদগুলো আমার অভিশাপের কারণে আসছে। সেই ফকির আমাকে আরও জানিয়েছে সেদিন ফেরার পথেই দুর্ঘটনায় তোমার মৃ’ত্যু ঘটতো,কিন্তু তিনি তোমার আগে করা উপকারের বদলে সেই দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিলেন।
সেদিন তুমি যদি সেই বাসে উঠে যেতে তোমাকে আমি সেদিনই হারিয়ে ফেলতাম। তুমি মৃ’ত্যুর এতোটা কাছাকাছি ছিলে আমি জানতামও না।
তিনি আমাকে বলেন,অভিশাপ ভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই একের পর এক বিপদ আসতে থাকবে,হয় তোমাকে নির্জনা কুঠির সুরক্ষা বলয় ছেড়ে বেরোতে না দিই,
নয়তো অন্য কোনো সুরক্ষা বলয়ে নিজ থেকে দূর করে দিই চন্দ্রগ্রহণ পর্যন্ত।
আমি তোমাকে সেজন্য সেদিন যেকোনো মূল্যে থামাতে চেয়েছিলাম। শক্তিশালী সুরক্ষা বলয় সৃষ্টি করতে অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়। আমার ক্ষমতা এতো বেশি নয়।
নির্জনা কুঠির সুরক্ষা বলয় এতো বছর ধরে অনেক শক্তিশালী হয়েছে,এর থেকে সুরক্ষিত স্থান তোমার জন্য আর কোথাও নেই।
কিন্তু তুমি অভিমান করে চলে গিয়েছিলে,আমার আর কোনো উপায় ছিলোনা। আমি তোমার বাড়ির চারদিকে সাময়িক একটা সুরক্ষা বলয় তৈরি করি আর নিজেকে পুরোপুরি তোমার থেকে দূর করে দিই।
কিন্তু এই সুরক্ষা বলয় অনেক দুর্বল ছিলো,এর ফলে বাড়ির ভেতর তোমাকে কেউ ক্ষতি করতে পারবেনা,কিন্তু বিপদ পুরোপুরি দূর হয়নি তখনো।
তুমি নিজেই যখন আমার উপর অভিমান করে নিজের ক্ষতি করতে যাও সেদিন,আমার অপারগ হয়ে তোমার কাছে যেতে হয় সেই রাতে।
আর আমার অভিশাপ আবার তোমার কাছাকাছি চলে আসে তখন,তোমার সবচেয়ে বড়ো বিপদ আমিই ছিলাম।
তাই আমি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম আগামী ২৪ঘন্টায় আবার বড় কোনো বিপদ হবে তোমার,তোমাকে তখনি নিয়ে আসতাম এখানে কিন্তু তুমি রাজি হতেনা মা বাবাকে না জানিয়ে হঠাৎ এভাবে চলে আসতে।
তাই বাধ্য হয়ে রেখে আসতে হয় তোমাকে আমার। তারপর ঠিকই ঘটলো বিপদ।
শ্যামা,আমার দেওয়া টাকাগুলোর কারণেই তোমার ভাই-ভাবী তোমার বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো,আমার কাছে ফিরতে গিয়ে তোমাকে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে হতো,আমার দেওয়া রূপ তোমার প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো,আমার অভিশাপ আমার দ্বারা রেহাই পাওয়া বাচ্চাটাকেই ব্যবহার করেছে তোমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে।
এই মূহুর্তে আমি তোমার জীবনের সবচেয়ে প্রাণঘা’তী বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছি।
চন্দ্রগ্রহণ হতে আরও ১৫টা দিন বাকি,আমি তোমাকে এতো জলদি সবকিছু বলতে চাইনি।
আমি ভেবেছিলাম আমি সবকিছু তোমাকে শেষরাতে বলবো,তাহলে তোমার বেশি কষ্ট পেতে হবেনা।”
শ্যামা এতোক্ষণ নীরবে সব শুনছিলো,তার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন উঠলেও মাঝপথে থামায়নি সে অরণ্যকে।
তবে ‘শেষরাত’ শব্দটি কেনো যেনো কেমন একটি অশুভ ইঙ্গিত দিলো,অজানা আতঙ্ক উঁকি দিতে লাগলো তার মনে। আর চুপ করে থাকতে পারলোনা সে।
(চলবে)
#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৩৫
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
শ্যামা অরণ্যের বুক থেকে সরে সামনাসামনি হয়ে বসে,তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে,
“আমি আপনার কথা বুঝতে পারছিনা অরণ্য। আপনার এই অভিশপ্ত শেকল আজকে আমি দেখতে পেয়েছি আপনার মায়ের মতো,তার মানে তো এটাই যে আমি এই অভিশাপ থেকে আপনাকে মুক্তি দিতে পারবো। এরপরে সব ঠিক হয়ে যাবে তাইনা?
তাহলে আপনি বারবার এমন কেনো বলছেন যে আমি সব আগে জানলে বেশি কষ্ট পাবো?
বারবার আমার ভবিষ্যতের কথা এভাবে বলছেন কেনো যেনো আমার ভবিষ্যতের অংশ হিসেবে আপনি থাকবেন না?
শেষরাত কেনো বলছেন?সেই রাত তো আমাদের জীবনের নতুন শুরু হওয়ার কথা।
অরণ্য আমাদের আর কোনো বাধা থাকবেনা এরপর,
আমরা সারাজীবন একসাথে কাটাবো তাইনা?”
শ্যামা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে ক্ষীণ আশা নিয়ে তাকায় অরণ্যের দিকে।
সে এই মুহুর্তে শুধু শুনতে চায় এই অভিশাপ কাটলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কোনো বাধা থাকবেনা।
অরণ্য ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্যামার এমন প্রশ্ন শুনে,ঠিক এই মুহূর্তটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলো সে। ভয়ে বুক কাঁপছে তার। সে চোখ সরিয়ে নেয় শ্যামার চোখের দৃষ্টি থেকে।
আশাহত হয় শ্যামা অরণ্যের এমন অভিব্যক্তি দেখে,তাহলে কি তার মনের ভয়টা সত্যি হতে চলেছে?
অরণ্য একটি বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে শ্যামার দুটি হাত তার নিজের হাতে পুরে বলে,
“শ্যামা, মায়ের যখন আমার অভিশাপ ভঙ্গের কথা ছিলো,তখনো আমার জীন সত্ত্বা পুরোপুরি আমার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি,তাই সে আমার মানুষ সত্ত্বাকে পুরোপুরি গ্রাস করতেও পারেনি। তাই তখন অভিশাপ ভঙ্গ হতেই আমি সুস্থ হয়ে যেতাম।
কিন্তু সেই রাতে মায়ের সেই ভয়াবহ মৃ’ত্যু একটু একটু করে নিজের চোখের সামনে দেখতে গিয়ে,আমার দুর্বল মানুষ সত্ত্বা সেইরাতে পুরোপুরি শক্তিহীন হয়ে পড়েছিলো।
সেই সুযোগে জ্বীন সত্ত্বা পুরোপুরি আমার মানুষ সত্ত্বাকে তার অধীন করে ফেলে। আমার শরীর মানুষের হলেও আমার জ্বিন সত্ত্বা অনেক আগেই আমার মানুষ সত্ত্বার সাথে মিলে এক হয়ে গিয়েছে। সে আমার আত্মার অংশ,আমার শরীরকে তার মনে করে।
এখন সে মুক্তি পেলে সে আমাকে না নিয়ে যাবেনা।আমার মানুষ সত্ত্বা তার অধীন।
আমার শেকল ছিন্ন হওয়ার সাথে সাথে সেই জ্বীন সত্ত্বার মতো আমিও ভস্ম হয়ে মিলিয়ে যাবো,সেই সাথে মিলিয়ে যাবে আমার রেখে যাওয়া সব স্মৃতি,কারণ সে মনে করে জ্বীনের মৃ’ত্যুর পর কোনো পার্থিব স্মৃতি মানুষের মনে থাকতে নেই।
এসব আমি আমার জ্বিন সত্ত্বার মনোভাব দেখে আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু ওই বৃদ্ধ ফকিরের সাথে দেখা হওয়ার রাতে আমি তার থেকে জানতে চাই আমার ভাবনাটা ঠিক কিনা।
তিনিই নিশ্চিত করেছেন,আমি যা ভাবছি সব সত্য।”
শ্যামা চোখ বন্ধ করে ফেলে এই কথা শুনে,বন্ধ চোখের কর্ণিশ বেয়ে গড়াতে থাকে অশ্রু,সে ফোঁপাতে ফোপাঁতে জিজ্ঞেস করে,
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আমার নিজ হাতে আপনাকে মৃ’ত্যু দিতে হবে?
এজন্যই কি দিব্য আর নীলাকে আমার ভবিষ্যৎ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন?কারণ আপনি থাকবেন না আমাকে ভবিষ্যতে রক্ষা করার জন্য?
এই জন্যই এতো জিজ্ঞেস করার পরেও নিজের সত্যটা বলেননি?শেষরাতের জন্য অপেক্ষা করছিলেন?
মানে শেষ রাতে সবটা বলবেন আমাকে,সেই রাতেই চন্দ্রগ্রহণ হবে,আমার এমন দুর্বল অবস্থায় আপনি আপনার অভিশাপ ভঙ্গ করে চলে যাবেন,আর আমি সকালে চোখ খুলে দেখবো আপনি নেই,আর আমি বুঝতেও পারবোনা আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি?আপনার কোনো স্মৃতি থাকবেনা আমার ভবিষ্যৎ জীবনে তাইতো?
অরণ্য,এতটা পাষাণ এতটা নির্দয় আপনি কিভাবে হতে পারলেন আমার প্রতি?
এটা অন্যায় এটা অবিচার,
কেনো হারাতে হবে আমার আপনাকে?আমি কি দোষ করেছি যে আমার সাথে এমনটা হবে?
আমার আপনার স্মৃতিগুলোও রাখার অধিকার নেই কেনো?
আমি কি এখন কোনোদিন আপনাকে মনে করে কাঁদতেও পারবোনা?
এজন্যই কি বলেছিলেন আমাদের ভালোবাসা ভুল ছিলো? তাহলে ভালোবাসা হয়ে কেনো এসেছেন আমার জীবনে? এসেছেন যখন থাকতে হবে,কোথাও যেতে দিবোনা আপনাকে। এই ঘরবন্দী হয়ে থাকবো আমরা তাহলে আপনি হারিয়ে যাবেননা তাইনা?
চুপ করে আছেন কেনো?কিছু তো বলুন?”
বলতে বলতে জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে শ্যামা,নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা যেনো হঠাৎ।
অরণ্য বিচলিত হয়ে তাকে কাছে টেনে নিতে যায় কিন্তু শ্যামা বাধা দিয়ে অসংলগ্ন পায়ে উঠে দাঁড়ায়,
“আমাকে একটু একা ছেড়ে দিন অরণ্য,কিচ্ছু ভালো লাগছেনা আমার,আমি আমার ঘরে যাই,একটু একা থাকতে দিন আমাকে। ভাবতে হবে অনেক ভাবতে হবে,সব গুলিয়ে যাচ্ছে,সব হারিয়ে যাচ্ছে।”
অরণ্যের চোখ থেকেও অশ্রু গড়াতে থাকে শ্যামার এমন অসংলগ্ন অবস্থা দেখে,সে জোর করে শ্যামাকে কাছে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে,শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকে শ্যামাকে।
শ্যামা ছাড়া পাওয়ার জন্য দস্তাদস্তি শুরু করে,অনবরত অরণ্যের বুকে কিল বসাতে বসাতে ধরে আসা গলায় বলে,
“একা ছেড়ে দিতে বলেছি কথা কানে যায়নি?আমার একটু সময় দরকার,আমাকে একা থাকতে দিন।”
অরণ্য কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“১৫দিন পর একেবারেই চলে যাবো,তখন ইচ্ছামতো একা থাকতে পারবে”
থমকে যায় শ্যামা,অরণ্যের বাহুবন্ধনী থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করার বদলে সর্বশক্তি দিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে,
“মিথ্যে কথা,আপনার ধারণা ভুল,ওই ফকিরও মিথ্যে বলছে। শ্যামা থেকে অরণ্যকে কেউ আলাদা করতে পারবেনা। আমরা এতো বিপদ কাটিয়ে এসেছি শুধু ভাগ্যের জোরে নাকি?
দেখবেন আপনি যত দূরেই হারিয়ে যান,আমি ঠিক খুঁজে আনবো আপনাকে। এই জীবনে আপনাকে,আপনার স্মৃতিগুলোকে কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা আমার থেকে।
বিধাতা এতো নিষ্ঠুর হতে পারেননা,আমিতো কারো ক্ষতি করিনি। তাহলে আমার এতো বড় সর্বনাশ কেনো করবেন তিনি?”
অরণ্য নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে শুধু,কি বলে বোঝাবে ওকে?তার কারণেই এই অবস্থা তার ভালোবাসার মানুষটার। সে নীরবে তার মাথায় হাত বোলাতে থাকে।
ঘড়ির দিকে তাকায় অরণ্য,রাত তিনটা বাজে এখনো।
আজকের রাতটা অনেক দীর্ঘ হতে চলেছে তাদের জন্য।
শ্যামা এখনো তার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে।
কাঁদুক তবু আবেগের বশে নিজের ক্ষতি না করে বসে এই ভয়ে জান শুকিয়ে যাচ্ছে তার।
ওকে ভেঙ্গে পড়তে দেওয়া যাবেনা একদম।
অরণ্য মুখ নামিয়ে শ্যামার কপালে গভীর চুমু খেয়ে বলে,
“আজকের জন্য অনেক হয়েছে শ্যামা। আমি জানি একসাথে অনেক ঝড় বয়ে গেছে তোমার উপর।
আজকের মতো একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো,বিশ্রাম দরকার তোমার। আর কেঁদো না,আমার সহ্য হয়না তোমার এই অশ্রুগুলো।”
“কথা দিন আমাকে,আমাকে ছেড়ে যাবেন না,কোথাও গেলে আমাকে সাথে নিয়ে যাবেন আপনি যেখানে যাবেন,নয়তো এখানেই থাকবেন আমার সাথে।”
“সহ্য করতে পারবে রোজ রোজ আমাকে এই অবস্থায় দেখতে?”
শ্যামা চুপ হয়ে যায়,সে আসলেই পারবেনা,কি বলছে এখন নিজেও জানেনা।
অরণ্য বলতে থাকে,
“তবে আমি তৈরি ছিলাম এভাবেই আরও কয়েকটা বছর থাকতে,একটু কষ্ট হলেও তোমার সাথে আরও কিছুটা সময় কাটানোর অনেক ইচ্ছা ছিলো। এতোদিন কষ্ট সহ্য করেছি,আরেকটু নাহয় করলাম। তোমার সাথে আরেকটু থাকার লোভ দিন দিন বাড়ছিলো আমার শ্যামা।
কিন্তু এখন বিষয়টা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে,তোমার প্রাণ সংকটে আছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব অভিশাপ কাটাতে হবে।
তুমি চাইলেও সারাজীবন এই বাড়িতে আটকে থাকতে পারোনা শ্যামা। কারণ তোমার আমি ছাড়াও আরেকটা পরিবার আছে। আমার অভিশাপ তাদের ক্ষতি করতেও ছাড়বেনা তোমাকে এই বাড়ি থেকে বের করার জন্য।
তাই বলছি শ্যামা,মাঝখানে ১৫টা দিন আছে,ভালো করে ভেবে দেখো তোমার কি করা উচিত।
তোমার কাছে তিনটি পথ খোলা আছে,
এক, আমরা যেভাবে আছি সেভাবেই থাকবো। কিন্তু এই পথ বেছে নিলে তোমার পরিবারের উপর বিপদ আসবে,তোমাকে তোমার প্রাণের মায়া ভুলে হলেও এই বাড়ি ছেড়ে বেরোতে হবে। বিপদ রাতে আসলে আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারবো,কিন্তু দিনের বেলায় হলে অপঘা’তে তোমার মৃ’ত্যু হবে।
আর আমি সারাজীবনের জন্য আটকে যাবো এই পৃথিবীতে। কারণ আমার পক্ষে তোমার পর অন্য নারীকে জীবনে জায়গা দেওয়া অসম্ভব। আমি আর কখনো ভালোবাসা খুঁজতে যেতে পারবোনা অন্য নারীতে।
দুই, ভুলে যাও তোমার বাইরে একটি পরিবার আছে। তাদের বিপদ হলেও তুমি যাবেনা। কিন্তু তবুও শ্যামা,তুমি সাধারণ মানুষ,এক সময় তোমার মৃ’ত্যু ঘটবেই,কিন্তু আমি অমর।
তাই এই ক্ষেত্রেও আমি চিরকালের জন্য আটকে যাবো এই পৃথিবীতে।
আর তিন,যেটা আমি ঠিক মনে করি।
১৫দিন পর আমাকে মুক্তি দিয়ে দাও। আমি আমার সকল অর্থ তোমার একাউন্টে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমি চলে যাওয়ার পর নতুনভাবে নিজের জীবনটা সাজিয়ে নিও।”
“আপনি একটু চুপ করবেন অরণ্য। ভালো লাগছেনা আর,আপনার ভাবনাগুলো আমাকে অবাক করে দিচ্ছে রীতিমতো।
‘নতুন করে জীবন সাজিয়ে নিও’ কতটা সহজে বলে দিলেন। আপনি ভাবছেন আপনার স্মৃতি মুছে যাবে মানে আমি কোনো কষ্ট পাবোনা, স্বাভাবিকভাবে নতুন জীবন শুরু করতে পারবো। ভুল ধারণা আপনার!
আপনিই বলুন, মস্তিষ্কের স্মৃতি নাহয় মুছে যাবে,কিন্তু আমার মনের অনুভূতি গুলোও কি হারিয়ে যাবে নাকি?
সেগুলো ঠিক এমনি থাকবে।
কোনো সুগন্ধির দোকানে গেলে মন ঠিকই সেই এক সুবাস খুঁজে বেড়াবে যেটি খুঁজে না পেয়ে আশাহত হবো আমি,শুধু জানা থাকবেনা কার সুবাস খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি।
লাল র’ক্ত জবাফুল দেখলে অকারণেই মন কেঁদে উঠবে,হঠাৎ করে মনে অভিমান জাগবে এই ফুল আমি ঘুম থেকে উঠে আমার বিছানায় খুঁজে পাইনা কেনো?কিন্তু এই অকারণ অভিমানের কারণটা জানা থাকবেনা শুধু।
রাত বারোটা বাজলে ঠিক কারো শূন্যতা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে,অশান্ত মন সেই শান্তির স্থানকে খুঁজে বেড়াবে,বুক ফেটে কান্না তখনো আসবে কিন্তু কার জন্য কাঁদছে আমার মন সেটাই শুধু জানা হবেনা।
এটুকুই পার্থক্য শুধু আপনার স্মৃতি থাকা আর না থাকার মধ্যে। একদিন এভাবেই সহ্য করতে না পেরে নিজেকে শেষ করে দিবো হয়তো।
তাই বলছি সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে এমন চিন্তা বন্ধ করুন।
আর আপনি যে শেষ রাতে আমার এই হাল করে নীরবে পালাতে চেয়েছিলেন,তার জন্য আমি আপনাকে সারাজীবন ক্ষমা করবোনা।”
“কি করতে চাও তাহলে তুমি?শ্যামা,আমিও চাইনা তোমার থেকে দূরে যেতে। মাঝে মাঝে ভাবনা আসে আমি যাওয়ার পর তুমি অন্য কারো হয়ে যাবে,এই ভাবনাটুকুও পছন্দ নয় আমার।
কিন্তু না চাইলেও তোমার থেকে দূরে আমাকে যেতে হবে,তোমার ভেবেচিন্তে একটা পথ বেছে নিতেই হবে শ্যামা”
“জানিনা আমি,কিচ্ছু জানিনা। পরে ভাববো,এখন আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দিন তো,মাথা ব্যথা করছে অনেক। ঘুমাতে চাই একটু।”
অরণ্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শ্যামাকে ধাতস্থ করতে পেরে। বাকিটা ও আস্তে আস্তে সামলে নিবে এই কদিনে। শ্যামার মাথায় আলতো চুমু খেয়ে নীরবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে অরণ্য।
এভাবেই নীরবতায় কতটা সময় পার হয়েছে জানেনা শ্যামা।
এক সময় অরণ্যের নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকে,তার মাথায় হাত বুলানো বন্ধ হয়ে যায়।
শ্যামা আস্তে আস্তে মুখ তুলে অরণ্যের ঘুমন্ত মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে,
এক সময় এই মানুষটার বুকে মাথা রাখতেই শান্তির ঘুম চলে আসতো,কিন্তু আজ তিনিও পারলেন না তার অশান্ত মনটাকে শান্ত করতে।
তাকে হারানোর ভয়টা চেপে বসেছে মনে,চোখ মুদতেও ভয় হচ্ছে,চোখ বুজলে এই বুঝি মিলিয়ে যাবেন সামনে থেকে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে শ্যামা। রাত চারটা বাজে।
উঠে পড়ে শ্যামা সেখান থেকে,ঘর থেকে বেরোনোর আগে ঘরের জানালাটা লাগিয়ে দিয়ে পর্দা টেনে দিয়ে যায় ভালো মতো।
(চলবে)