#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[১২]
আজ নিয়ে পায়েলের সঙ্গে অনুভবের তিনবার সামনাসামনি দেখা হলো। তারা দেখা করল জহির রায়হান অডিটোরিয়ামের সামনে। পায়েলের পরনে একটা হাঁটু ছুঁই ছুঁই লং শার্ট ও জিন্স। মুখে প্রসাধনীর গাঢ় প্রলেপ। কাজলের মোটা আস্তরণে সজ্জিত চোখ ও টকটকে লাল পুরু ঠোঁটের গড়ন যেকোনো পুরুষের কাড়তে বাধ্য। মনে হয় সাজটা যেন ওকেই মানায়। বাচনভঙ্গি সাবলীল ও চমৎকার অঙ্গভঙ্গি তার। স্বভাবে চঞ্চলতা চোখে পড়ার মতো। অনুভব মুগ্ধ হয়। মেয়েটিকে তার বেশ পছন্দ। কিন্তু মুগ্ধতা মানেই তো ভালোবাসা নয়। প্রেম, প্রগাঢ় ভালোবাসা কিংবা হৃদয়ে একনিষ্ঠ সঙ্গী হিসেবে পায়েলকে এখনো সে স্বীকৃতি দিতে পারেনি। অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে স্বভাবই হয়তো এর জন্য দায়ী।
তারা দুজন হাঁটতে শুরু করে প্রজাপতি পার্কের দিকে। পায়েল বেশ স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে অনুভবের হাত ধরেছে। বাধা দিল না অনুভবও। পায়েল লাজুক স্বরে জানতে চাইল,
“এরপর?”
প্রশ্নটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয় না অনুভবের৷ পায়েল তাকে পছন্দ করে। হয়তো ভালোও বেসে ফেলেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু অনুভবের মন থেকে ঠিক স্বস্তিটা মিলছে না। টুকটুকির কথা অনুযায়ী পিছলে পড়ার মতো হুট করে প্রেমে সে পড়তে পারছে না। দোষটা তারই, পায়েলের নয়। অনুভব মনের কথা গোপন করল না। একটু সময় নিয়ে বলল,
“দেখ পায়েল, আগেই জানিয়েছি আমি একটু বেশিই খুঁতখুঁতে। কিন্তু তোমাকে আমার সবদিক থেকে ভালো লেগেছে। বলতে পারো তুমিই প্রথম যার হাত ধরে আমি হাঁটছি।”
পায়েলের সর্বাঙ্গে খুশির ঢেউ উথলে ওঠে। আরেকটু শক্ত হয় হাতের চাপ। অনুভব দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আবার বলতে থাকে,
“কিন্তু সত্যি কথা হলো, আমার মন এখনো স্বস্তির সুবাতাস পাচ্ছে না। আমি তোমাকে নিয়ে ভাবতে চাইছি। হয়তো আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন। কিন্তু অনুভুতি তো আর একপাক্ষিক বিষয় নয়। তুমি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে গেলে পরবর্তীতে যদি আমার সিদ্ধান্তে বদল আসে তখন কষ্ট পাবে।”
“কী বলতে চান?” পায়েল উদ্বিগ্ন চোখে তাকায়।
“আমি চাই না আমার প্রতি তোমার এক্সপেক্টেশন তৈরি হোক আনটিল আমি মন থেকে সবটা গ্রহণ করতে পারছি।”
পায়েলের ধরে রাখা হাত ঢিলে হয়ে এলো। চোখেমুখে ভর করল ক্ষণিকের অব্যক্ত ব্যথা। এরপর আবারো জোড়ালভাবে অনুভবের হাত চেপে ধরে বলল,
“আপনি মনের কাছে ক্লিয়ার হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে চাই। ততদিন নাহয় এরকমই থাকি?”
অনুভব আলতো মাথা নাড়ে। তার বিশ্বাস পায়েলই পারবে এই অস্বস্তিটা দূর করতে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিছুক্ষণ নিরবতা পালনের পর পায়েল বলল,
“আচ্ছা নন্দিনী আপু কবে থেকে আপনার বন্ধু?”
“ফার্স্ট ইয়ার থেকে। টুকটুকির সুবাদে ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। এখন এক একজন কলিজার টুকরায় পরিনত হয়েছে।”
পায়েল কথাটা শুনে কপাল কুঞ্চিত করে। হুট করে বলে ওঠে,
“আপনি কী নন্দিনী আপুর ব্যাপারে সব জানেন?”
অনুভব মুখ ফিরিয়ে তাকায়। একটু ভেবে বলে,
“কোন বিষয়ে বলোতো?”
“জানেন না আপু এসএসসি পরীক্ষার পর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল?”
অনুভবের দৃষ্টি স্থির হলো পায়েলের দিকে। কথাটা বলার সময় মেয়েটার কন্ঠে সুক্ষ্ম অবজ্ঞার সুর টের পেল! অনুভব একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
“ভাগ্যিস পালিয়েছিল। ওই চমৎকার মেয়েটাকে বন্ধু হিসেবে না পেলে জীবনে অনেক কিছুই মিস করতাম।”
এরপর দুজনের কথা বলা খুব একটা এগোলো না। কোথাও যেন ছন্দ কেটে গেছে। অনুভব পায়েলকে তার হলের সামনে এগিয়ে দিয়ে চলে গেল ভিসি চত্বরে। টুকটুকি আজ সকালে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে সবাইকে এখানেই আসতে বলেছে। দিগন্ত ও নন্দিনী আগেই উপস্থিত ছিল। দেখা গেল বৈঠকের মূল বক্তাই অনুপস্থিত। তারচেয়েও বড়ো কথা নন্দিনী আজ আবারো কালো পোশাকে সেজেছে। অনুভব তার পাশে বসে বলল,
“আবার ব্রেকাপ!”
নন্দিনী কথাটাকে পাত্তাই দিল না। দিগন্ত খেয়াল করে বলল,
“আরেহ! পি’শা’চের মতো নখগুলো অবশেষে কে’টেছিস দেখি! এবার একটু মানুষ মানুষ লাগছে।”
“নখের কাম শেষ।” নন্দিনী হেসে বলল।
অনুভব জানতে চাইল,
“তার মানে?”
“মানে সদ্য হওয়া প্রাক্তন আমারে নির্জনে নিয়া যাইতে চাইছিল গতকাল। লিটনের ফ্ল্যাটে!”
দিগন্ত আর অনুভব একসঙ্গে লাফিয়ে উঠল কথাটা শুনে। অনুভব চিড়বিড় করে বলল,
“হা’রা’ম’জা’দার ঠিকানা দে। মাইয়াগো ফ্ল্যাটে ডাকার সাধ জন্মের মতোন মিটাইয়া দিমু।”
দিগন্ত নাক ফুলিয়ে সবজান্তার মতো বলল,
“ঠিকই আছে, আরো কর প্রেম। তুই এক ব’দমা’ইশ, তোর কপালে বাংলাদেশের সব ব’দমা’ইশ পোলাপাইন-ই জোটে।”
নন্দিনী শ্রাগ করে ওঠে। বলে,
“আরে চিল গাইজ! পোলার মুখে এমন নকশা আঁকছি মাসখানেক ওই মুখ লইয়া মাইনষের সামনে যাইতে পারব না।”
“কী করছিস?” অনুভব সন্দিগ্ধ হয়ে জানতে চায়।
নন্দিনী বড়ো নখগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটু শোকাভিভূত হয়ে বলে,
“সাধের নখগুলা দিয়ে আদর কইরা গভীর আঁ’চড় টানছি দুই গালে। একেবারে চামড়া ছিল্লা দিছি। ব্যাটারে আগেই কইছিলাম আমার পলিটিকাল কানেকশন ভালা। তাই ফোঁসফোঁস করলেও ছো’বল দেওয়ার সাহস পায় নাই।”
ঠিক তখনই অমাবস্যার সবটুকু আঁধার নিজের মুখে ধারন করে টুকটুকি হাজির হলো। ধপ করে বসে নিস্তরঙ্গ গলায় বলল,
“দোস্ত, আমারে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।”
নন্দিনী দুহাতের তালু ঘষে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আহ মামা, অনেকদিন ভালামন্দ খাই না। জলদি হা’ঙ্গা কর।”
দিগন্ত ভ্রু কুচকে বলল,
“হোয়াট ইজ হা’ঙ্গা?”
“হাঙ্গা মিনস ম্যারেজ, বিয়া, শাদী, নিকা, পরিণয়। যেখানে পোষ মানানো হয়।”
“কাকে?”
“জামাইকে। জামাই একটি পোষা প্রাণী। যার বাসস্থান বউয়ের আঁচলের তলায়। হি হি!”
নন্দিনীর কথায় দিগন্ত মুখ কুচকে কিছু শোনাতে উদ্যত হয়েছিল। টুকটুকি ক্ষে’পে উঠল,
“আমি এখানে সমস্যা নিয়া আইছি আর তোরা মজা করতে লাগছোস? ধুর!”
টুকটুকি রে’গে উঠে যাচ্ছিল। অনুভব খপ করে ওর হাতটা ধরে আটকাল। বলল,
“বাদ দে ওদের কথা। এখন বল সমস্যা কই?”
টুকটুকি লম্বা শ্বাস ফেলল। একটু সময় নিয়ে বলল,
“বাবা-মায়ের মতে আমি ম্যাচিওর এনাফ। অনার্সও শেষের পথে। এখনই বিয়ে করার সঠিক সময়। সেই কথার জেরে আজই পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসবে।”
“আসুক। দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।”
“এই কমন ডায়লগটা সকাল থেকে খালা-ফুপিরা ফোন করে করে দিচ্ছে আমায়। তুই অন্তত চুপ যা শিকু।”
“ছেলে যদি ভালোই হয় তবে বিয়ে করতে আপত্তি কোথায়?”
এই প্রশ্নে টুকটুকি একটু থমকে গেল। আপত্তিটা আসলে কোথায় তা স্পষ্ট নয়। পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হবে ভাবলেই অদৃশ্য কান্নায় গলা বুজে যাচ্ছে। মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। উদাসী গলায় বলল,
“মনেরও একটা প্রস্তুতি আছে। আমার মন প্রস্তুত নয়।”
দিগন্ত বলল,
“পাত্রের ছবি দেখেছিস? বুড়া, টাকলা নয়তো?”
“দেখিনি। শুধু জানি তাদের বাড়ি বরিশাল।”
কথাটা নন্দিনী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“তুই না চাইলে আমারে দিয়া দে দোস্ত। আমার অনেক দিনের শখ একটা বরিশালের পোলার লগে প্রেম করার। তারপর, বরিশালের লঞ্চে উইঠ্যা লইব ক্যাবিন রুম বন্ধুরে মোর বুকে লইয়া দিব একটা ঘুম…”
“এখন পদ্মা সেতু আছে গা ধা।” অনুভব ওর মাথায় টীকা দিয়ে বলল।
“তাতে কী? নদী, স্রোত, বাতাসে একটা প্রেম প্রেম ব্যাপার আছে। বুঝবি কেমনে জীবনে তো প্রেম করতে পারোস নাই।”
দিগন্ত ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
“হেহ! ভুইলা যাইয়ো না টাইটানিকের প্রেম কাহিনি পানিতেই ডুবছিল।”
নন্দিনী বিরস বদনে বলল,
“তোরা আমারে রোমান্টিক হইতে দিবি না।”
টুকটুকি না চাইতেও হেসে ফেলল। নিজেকে সামলে ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল,
“চুপ সবাই। তোদের সাথে সিরিয়াস কিছু আলোচনা করাই বৃথা। এখন শোন, পাত্র যদি মনে ধরে যায় চৌদ্দ গুষ্টি আমাকে বিয়ের জন্য জোর করবে। তাই আমি আজ বাড়ি যাচ্ছি না। ইকরির সঙ্গে হলে থেকে যাব।”
নন্দিনী একটু টেনে টেনে হাসল। টুকটুকির দিকে ঝুকে এসে ফিসফিস করে বলল,
“কী ব্যাপার টুকি সোনা? তোমার গায়ে আজকাল রিতা আন্টির বাড়ির গন্ধ পাই যে! মনের অবস্থা ভালো তো?”
টুকটুকি অপ্রতিভ হয়। হুট করেই দুই গাল গোধূলির ডুবন্ত সূর্যের ন্যায় রাঙা হয়ে ওঠে। নন্দিনী আবারো ফিসফিস করে,
“তুমি ফা’ইস্যা গেছ!”
চলবে…