#শ্রাবণ_ধারায় |১৬+১৭+১৮|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
বারিশের ফোন বেজে উঠতেই মুখ থেকে হাত নামিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো সে।ঝড়ের গতিতে ফোনটি হাত থেকে কেড়ে নিয়ে পিচ ঢালায় রাস্তায় সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়ে ফেলল চিনি।আচমকা ঘটনায় চমকে উঠলো বারিশ।ফোনটার তেমন কোনো ক্ষতি হলো না তবে ফোনের গায়ে অসংখ্য সাদা দাগ দেখা গেল।ফোনের স্ক্রিনে “ছোট মা” লেখা ভেসে উঠলো। বারিশ চিনির এমন আচরণে চটে গেল।ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে চিনির দিকে তাকিয়ে বলল,
– কি করলে এটা?
সঙ্গে চিনি তর্জনি তুলে চেঁচিয়ে বলল,
– এই একদম আমার সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলবেন না।আমি কোনো অবলা মেয়ে নয় বুঝেছেন?যে আপনি যা ইচ্ছা তাই করবেন আমার সাথে।
বারিশ অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।চিনি আবারও চেঁচিয়ে বলল,
– কি এমন জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছিল যে আমাকে ফেলেই চলে গেলেন?এখন এই রাতে যদি আমার কিছু তাহলে সে দায়ী তো নিজের ঘাড়ে নিতেন না বরং আমাকে আরো দোষ দিতেন।
বারিশ নত স্বরে বলল,
– আ’ম সরি।আমার মাথা থেকে বেরই হয়ে গিয়েছিল তুমি আমার সাথে আছ।
চিনি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
– হাহ্ তা তো হবেই।
বারিশ এবার কোণা চোখে চিনির দিকে তাকালো।বারিশকে এভাবে তাকাতে দেখে চিনি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
– কি হয়েছে এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?
– চিনি!
বারিশ আমতা আমতা করে চিনির নামটি নিল।চিনি দুই ভ্রু জাগিয়ে ডাকের সাড়া দিল।বারিশ ইতস্তত করে বলল,
– চিনি তুমি কি ফারিশকে ওর ছোটবেলার বিষয়ে জানিয়েছ? কোনো পার্সেল দিয়ে?
চিনি রাগি কন্ঠে চট করে উত্তর দিলো,
– কি বলছেন এসব মাথাটা কি একদম গিয়েছে? আপনি ভাবলেন কিভাবে আপনি নিষেধ করার পরও আমি ফারিশকে এসব কথা বলবো?
কথাটি শেষ করেই সামনের দিকে হাঁটা ধরে চিনি।বারিশ দাঁত দিয়ে জিহ্বায় কামড় দেয়।কতবড় ভুল ভাবতে যাচ্ছিল সে।মানুষের প্ররোচনায় চিনিকে অবিশ্বাস করছিল সে।সামন্য দৌড়ে চিনির পাশাপাশি দাঁড়াল বারিশ।চিনি পাশে হাঁটছে আর আড় চোখে চিনিকে দেখছে।কিছু একটা বলার জন্য উসখুস করছে সে।অবশেষে নিজেকে আঁটকে না রেখে চিনিকে মৃদুস্বরে ডাক দিল,
– চিনি?
চিনি ভ্রু উঁচিয়ে তার দিকে তাকালো। ঘাড় উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল “কি হয়েছে?”। বারিশ আমতা আমতা করে বলল,
– ফারিশ হসপিটালে ভর্তি।আমি সেখানেই গিয়েছিলাম।হঠাৎ করে ফারিশের এমন অবস্থার কথা শুনে মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল তুমি সাথে আছ।
চিনি অবাক হলো।চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করল,
– ফারিশ হাসপাতালে?কেন কি হয়েছে ওর?
– ওকে কেউ একটি পার্সেল পাঠিয়েছিল।যেখানে ছোট মা আর বাবার ডায়েরি ছিল।যেখানে ও কে?ওকে কোথা থেকে আনা হয়েছে সব লেখা ছিল।ছোট মা লিখেছিল।সেগুলো পড়ে ফারিশ ফাঁশ নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
চোখ বেরিয়ে এলো চিনির।অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
– কি বলছেন এসব!
পরমুহূর্তেই তার মুখের রং পরিবর্তন হয়ে গেল।সে সন্দিহান দৃষ্টিতে বারিশের দিকে তাকিয়ে রইলো।বারিশ ছোট একটা ঢোক গিলল।চিনি শক্ত কন্ঠে বলল,
– আর আপনি ভেবেছেন আমি ওকে এই পার্সেল পাঠিয়েছি?
বারিশ আমতা আমতা করতে লাগল।মাথা চুলকে বলল,
– না মানে এখানে তো এমন কেউ নেই যে কথাগুলো আমি,ছোট মা আর তুমি ছাড়া জানে।আমার দাদাবাড়ির সবাই অবশ্য জানে তবে তারা তো আর এশহরে নেই।তাই কয়েক সেকেন্ড এর জন্য আমি সত্যিই ভেবেছিলাম কথাগুলো তুমিই ফারিশকে বলেছ।কিন্তু বিশ্বাস করো আমি জানি তুমি বলোনি।আসলে রাগের মাথায় কি না কি ভেবে বসে ছিলাম।সরি চিনি।
চিনি মুখ ঘুরিয়ে বুকে হাত গুঁজে হাঁটা শুরু করলো।বারিশ সরিসরি বলতে বলতে চিনির পিছু পিছু যেতে রইলো।চিনি চট করে থেমে গেল।পিছন ঘুরে ক্ষিপ্র স্বরে বলল,
– আমি আপনাকে বিশ্বাস করিনা এটা কমন ব্যাপার।কিন্তু আপনি তো আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতেন তাহলে এখন সেসব বিশ্বাস কোথায় গেল?আপনার মতে আমি আপনাকে ছাড়া পৃথিবীর সবাইকে বিশ্বাস করি।এখন তাহলে এটাও প্রমাণিত আপনিও আমাকে ছাড়া পৃথিবীর সবাইকে বিশ্বাস করেন।
– সরি চিনি।আমি বিশ্বাস করিনি তো।সত্যি বলছি আমি বিশ্বাস করিনি।
– তাহলে তখন যে বললেন এক সেকেন্ডর জন্য বিশ্বাস করেছিলেন পার্সেলটা আমিই পাঠিয়েছিলাম।
– তার জন্য তো সরি বলছি আমি।
আর কোনো কথা বলল না চিনি। চুপচাপ এগিয়ে যেতে থাকলো।বারিশ ফোন বের করে ইশান্তকে জানিয়ে দিলো যে সে চিনিকে পেয়ে গিয়েছে।তাকে গাড়ি নিয়ে আসতে বললেই পাশ থেকে চিনি দ্বিমত পোষণ করল,
– না এখন গাড়ি নিয়ে আসতে হবে না।আরেকটু পরে আসো।আমি আরো একটু হাঁটবো।
বারিশ চিনির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল।চিনির কথাকে প্রাধান্য দিয়ে বলল,
– আচ্ছা ইশান্ত তুমি একটু পরে এসো।ম্যামের হাঁটাহাঁটি শেষ হলে আমি তোমাকে কল করবো তখন এসো।
অপাশ থেকে ইশান্তের হাসির শব্দ শোনা গেল।সে বারিশের কথায় সায় দিয়ে কল রেখে দিলো।বারিশ নিজের হাতের ফোনটি এপাশ ওপাশ দেখে বলল,
– কি অবস্থা করেছ ফোনটার দেখেছ?
মিখ ভেঙচিয়ে নিজের মতোই হেঁটে চলে চিনি।চিনির আঁচল নজরে আসতেই বিচলিত হয়ে পড়ে বারিশ। এগিয়ে এসে চিনির আঁচল ধরে জিজ্ঞেস করে,
– একি এটা কি করে হলো?
চিনি টান দিয়ে বারিশের হাত থেকে আঁচল ছাড়িয়ে নিল।কপাল কুঁচকে মুখ ঝামটি দিয়ে জোরে জোরে কদম ফেলল।বারিশ তপ্ত শ্বাস ফেলে বিড়বিড়িয়ে বলল,
– আচ্ছা তাহলে এখন এটাই চলবে সারারাত।
বারিশও এগিয়ে চিনির পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো।পকেটে হাত গুঁজে চিনির পাশে হাঁটছে আর আড় চোখে পাশে নীল সাদা শাড়িতে নিজের সহধর্মিণীকে দেখছে।বারিশ নরম সুরে বলল,
– এখন ইশান্তকে কল করি?
চিনি আবারও সেই একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ ঝামটি দিলো।বারিশ ঠোঁট টিপে হাসল।ডান হাত বুকের ডান পাশে চেপে ধরে করুণ সুরে বলল,
– হায়!দিল স্ট্রোক কার গায়া..!
চিনি আবারও মুখ ঝামটি দিলো। বারিশ এবার শরীর কাঁপিয়ে শব্দ করে হেসে দিল।হঠাৎ করে ফারিশের কথা মাথায় আসতেই বারিশের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়।ফোন বের করে রাণীর নম্বরে কল করে।সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করে রাণী।যেন সে বারিশের ফোনেরই অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। বারিশকে কিছু বলতে না দিয়ে সে প্রথমে বলতে শুরু করলো,
– বাবা বারিশ কোথায় তুই?
বারিশ কিছুক্ষণ থেমে ভাবল।তারপর বলল,
– আমি তো একটা কাজে আছি।ফারিশের জ্ঞান ফিরেছে?
সাথে সাথে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রাণী।কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– না রে বাবা।আমার ছেলেটা শেষ হয়ে গেল। ঐ মেয়ে আমার ছেলেটাকে শেষ করে ফেলল।
চোয়াল শক্ত করে ফেলল বারিশ।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– চিনি কিছু করেনি।আমি জানি ও আমার অগোচরে এমন কিছু করবেনা যাতে আমি কষ্ট পাব।
রাণী থতমত খেয়ে গেল।মনে মনে বলল,”একটু আগেই এখানে তো চিনিকে শাস্তি দেবে বলছিল।হঠাৎ কি হলো?”
পরমুহূর্তেই আবারও হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়ে বলল,
– তুই এখনও ঐ অলক্ষ্মী মেয়েটাকে বিশ্বাস করছিস?পরে পস্তাতে হবে।
খট করে কলটি কেটে দিল বারিশ। ফোনটা বন্ধ করে পকেটে রেখে শ্বাস ফেলল।চিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।বারিশ এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– কি হয়েছে?
চিনি তর্জনি দিয়ে বারিশের পকেটের দিকে ইশারা করে উৎসাহী কন্ঠে বলল,
– কি বলল?ফারিশ এখন কেমন আছে?
বারিশ সামনে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলো,
– এখনো জ্ঞান ফেরেনি।পরে আমি ডাক্তারের থেকে ডিটেইলসে সব জেনে নিবো।
নির্জন ফাঁকা রাস্তায় হাঁটছে একজোড়া বাবুইপাখি।একজন উত্তর মেরু তো আরেক জন দক্ষিণ মেরু।আর বিপরীত মেরুই যে একে অপরকে আর্কষণ করে তার প্রমাণ এই দম্পতি।শীতল বাতাস শরীরে এক অন্যরকম দোলা দিয়ে যাচ্ছে। নিরব যুবক যুবতী নিঃশব্দে হয়তো দুজন দু’জনের নিশ্বাসের শব্দ অনুভবের প্রয়াস চালাচ্ছে।নিস্তব্ধতা কাটিয়ে চিনি তার মিষ্টি কন্ঠে বলল,
– আচ্ছা বারিশ!ফারিশ তো আপনার নিজের ভাই না তাহলে আপনি ওকে এতো ভালোবাসেন কেন?তাছাড়া ও আপনার সাথে অনেক অন্যায় করেছে তারপরও?
বারিশ প্রশ্নের জবাবে আরেকটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
– আমিও তো তোমার রক্তের কেউ নই তাহলে আমাকে কেন এতো ভালোবাসো তুমি?
থমকে গেল চিনি।শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকলো বারিশের দিকে। বারিশ চিনির চোখে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে।মতি ফিরতেই চিনি নিজের দুই গালে আলতো চড় দিয়ে জিহ্বা কেটে বলল,
– ছিঃ!ছিঃ! কি বলছেন এসব আপনি?
বারিশ ইতস্তত করে বলল,
– আসলে আমি বোঝাতে চাইছি কিছু কিছু সম্পর্ক আছে যেগুলোতে রক্তের সংযোগের কোনো প্রয়োজন হয়না।এগুলো আত্মিক সম্পর্ক।আর এই সম্পর্কগুলোই সব চেয়ে মজবুত হয়।বুঝেছ ম্যাম?
ডানে বামে মাথা নাড়াল চিনি।অর্থাৎ সে বুঝতে পারেনি।কপাল চুলকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বারিশ।চিনি ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
– কি জিজ্ঞেস করলাম আর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কিসব বললেন কিছুই তো বুঝলাম না।
– হেড অফিস তো পুরাই ফাঁকা বুঝবে কিভাবে?
বারিশ কথাটি বিড়বিড় করে বললেও চিনি কান খাঁড়া করে শুনে নিলো।ফোঁস করে উঠলো সে কোমরে হাত গুঁজে বলল,
– কি বললেন আপনি?
বারিশ চোখ ঘুরিয়ে বলল,
– কই কিছু না তো।বলেছি যে আমি ছোট থেকে ফারিশের সাথে বড় হয়েছি।আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন থেকে ওকে আমি আমার খেলার সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি।আমার ওকে খুব ভালোবাসতো।বাবা নেহাতই জানতো না ফারিশের কথা জানলে হয়তো সব সম্পত্তি আমার নামে করত না।ওর জন্য ভালোবাসার জায়গাটা আমার ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়েছে।ওর সম্পর্কে সব জানতে পেরে ওর প্রতি আমার সহানুভূতি আর ভালোবাসা আরো তীব্র হয়।ওকে আমি কখনো শাসন করিনি।ওর যখন যা করতে ইচ্ছে করেছে ও তাই করেছে আমি ওর সবকিছুতে সাপোর্ট করিনি।ওকে কখনো আঘাত করিনি।সর্বপ্রথম হয়তো সেদিন ওবাড়িতে আঘাত করেছিলাম।ও আমার ভাই।তাই আমি ওকে এতো ভালোবাসি।
চিনি নিশ্চুপ হয়ে খুব মনোযোগ সহকারে বারিশের কথা শুনলো।বারিশের কথা শেষ হতেই আবার প্রশ্ন করল,
– আপনার মা কিভাবে মারা গেল?
বারিশ বিষন্ন স্বরে বলল,
– আমি এব্রোট যাওয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই মায়ের সাথে কথা হতো।একদিন খুব ভোরে মায়ের কল এলো।আমি এতো সকালে মায়ের কল পেয়ে অবাক হলাম।ফোন রিসিভ করলে ওপাশ থেকে দাদি কান্নারত কন্ঠে বলল মা নাকি বাথরুমে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেছে।তখন ঠিক কেমন অনুভূতি প্রকাশ করা উচিত ছিল আমি বুঝতে পারছিলাম না।আমি শূন্য অনুভূতিতে শুধু ভাবতে থাকলাম আমার মা আর নেই।মায়ের সেই স্নেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকানো শেষ হয়ে গেল।মায়ের সেই মধুর কন্ঠ থেমে গিয়েছে।মা আর আমাকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে না।আমার সকল সমস্যার সমাধানকারী আমার মা নেই।মায়ের হাতের রান্না আর খাওয়া হবে।মাকে আর দেখা হবে না।একসময় হয়তো মায়ের চেহারাটাও স্পষ্ট কল্পনা করতে পারবো না।মাকে মা বলে আর ডাকা হবে না।আমি…আমার মা আর বাবা..কে অনেক মিস করি চিনি অনেক!
ফুঁপিয়ে উঠলো বারিশ।চিনি হতভম্ব হয়ে গেল। সে বারিশকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি আগে কখনো।চিনি বারিশের ডান হাতে নিজের হাত গুঁজে দিল।শক্ত করে বারিশের হাত ধরলো।চিনির চোখও ভরে উঠলো।বারিশের ফুঁপানো বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।হাতে চিনির শীতল কোমল স্পর্শ পেতেই ভ্রম কেটে গেল তার।তৎক্ষনাৎ চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।চিনি আর এক মুহুর্তও দেরি করলো তা জাপ্টে ধরলো বারিশকে।চিনি সহিষ্ণুতা পেয়ে আবারও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো বারিশ। আবারও চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। বারিশের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো চিনি।বারিশের উষ্ণ নিঃশ্বাস চিনির ঘাড়ে পরতেই কেঁপে উঠলো সে।কাঁধ সংকুচিত করল সে।বারিশ চোখ মুছে ফিসফিস করে বলল,
– রাস্তাঘাটে এভাবে জরিয়ে ধরলে মানুষ বলবে আমারদের রুমে দরজা নেই।
হঠাৎ বলা বারিশের কথায় ভ্রুু কুঁচকে ফেলল চিনি।অবাক কন্ঠে বলল,
– কি?
নিজেকে বারিশের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো।কিন্তু বারিশ চিনিকে আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলো।কাঁধ থেকে একগোছা এলোকেশ সরিয়ে দিলো।আলতো অধর ছোঁয়াল সেখানে।চিনির শরীরে যেন বিদুৎ পরিবাহিত হলো।তড়িৎ গতিতে বারিশকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো।চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো বারিশের দিকে।বারিশ নিচের ঠোঁট উল্টিয়ে তাকিয়ে আছে চিনির দিকে।চিনি কাঁধে হাত দিয়ে রাগি স্বরে বলল,
– এইভাবে সুযোগের সৎ ব্যবহার করলেন আপনি!আমি যেখানে আপনাকে সমবেদনা জানাতে আসলাম আর আপনি?আপনি এটা কি করলেন?
বারিশ ঠোঁট চেপে হাসলো।বুকে হাত গুঁজে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
– তুমি জানো না বারিশ মৃধা কারো কাছে ঋণী থাকে না।তুমি আমাকে সমবেদনা দিতে এসেছ আর আমি তোমাকে উপহার হিসেবে উম্ম…
কানে হাত দিল চিনি।নাক মুখ কুঁচকে বলল,
– চুপ চুপ আর বলার দরকার নেই।
বারিশ ঠোঁট চেপে হাসছে।ঠোঁট কামড়ে চিনির কাছে এসে কানে ফিস ফিস করে বলল,
– কেন বলি?
– না।
– কেন একটু বলি না..!
– না বললাম না।
– আমরা আমরায় তো।
চিনি কান থেকে হাত নামিয়ে বারিশকে সামনে ঘুরিয়ে পিছন থেকে ঠেলতে ঠেলতে বলল,
– উফ্ বাড়ি চলেন তো। ইশান্তকে কল করুন।
বারিশ আড় চোখে চিনির দিকে তাকিয়ে বলল,
– তোমার মনে হয় আমাদের নেওয়ার জন্য ইশান্ত এখন জেগে আছে?
চিনি চোখ কপালে তুলে বলল,
– তাহলে এখন কি হবে?
বারিশ নির্লিপ্ত ভাবে বলল,
– কি আর হবে হেঁটে হেঁটেই বাড়ি যেতে হবে।তুমি বললে তোমাকে সেদিনের মতো পিঠে করে নিয়ে যেতে পারি।যাবে?
সঙ্গে সঙ্গে চিনি মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো।তা দেখে মুচকি হাসলো বারিশ।হাঁটু গেড়ে চিনির সামনে বসলো।চিনি বারিশের পিঠে ভর ছেড়ে বারিশের গলা জরিয়ে দিলো।
এদিকে চিনিকে কাঁধে তুলে আরেক বিপদে পড়লো বারিশ। চিনির দুষ্টুমিতে ঠিক মতো হাঁটতেও পারছে না সে।চিনি একবার বারিশের কানে ফুঁ দিচ্ছে আবার বারিশের চুল ধরে টানছে, বারিশের গলার উঁচু অংশে তর্জনি দিয়ে চাপ দিচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে।বারিশ বিরক্ত হয়ে মুখ থেকে “চ্” শব্দ করল।গলার উঁচু অংশে চাপ দিতেই চেঁচিয়ে উঠলো বারিশ,
– আহ্ আহ্ শ্বাস আঁটকে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে খিলখিলে হেসে উঠলো চিনি।তা দেখে বারিশও হেসে দিলো।চিনি এবার বারিশের গাল টেনে ধরলো।বারিশ ভ্রু সংকুচিত করে বলল,
– চিনি কি শুরু করলে বলো তো?বাড়ি যেতে দিবে না নাকি?এবার দুষ্টুমি করলে কিন্তু নিচে ফেলে দিবো।
বারিশের কথা শুনে তড়িৎ গতিতে বারিশের গলা আরো জরে চেপে ধরলো।বারিশ চিৎকার করে উঠলো,
– ওহ্ এই মেয়েটা আজ আমাকে মেরেই তবে থামবে।
ফারিশের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই।সবার আগে তার মুখ থেকে বের হয়েছে যে শব্দ তা হলো,
– মা!
ডাক্তারের নির্দেশে রাণীকে ফারিশের সাথে দেখা করা অনুমতি দেওয়া হয়।রাণীকে দেখে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারপনা ফারিশ।চোখ থেকে অনবর জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।রাণীকে শক্ত করে বুকের মধ্যে জরিয়ে কাঁপা কাঁপা অস্ফুটস্বরে বলে,
– ক্ষমা করো মা।আমার জন্য তোমাকে কত কি শব্দ হয়েছে।নিজের গায়ে কলংক নিয়েও তুমি আমাকে বুক থেকে ছুঁড়ে ফেলে দাওনি।
রাণীর চোখও পানিতে টলমল করলো।সে ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে বলল,
– আমার কলিজার টুকরো তুই।যে সময়টা আমাকে সবাই ছেড়ে গেল সে সময় তুই আমাকে আঁকড়ে ধরলি।আমি আমার বাঁচার কারণ খুঁজে পেলাম।আমি কিভাবে তোকে ছুঁড়ে ফেলি বল?
ফারিশ আগের মতো কেঁদে বলল,
– ভালোবাসি মা।
রাণী ফারিশের মুখটা নিজে নিজের সামনে এনে দুই হাতে আবদ্ধ করে বলল,
– কি করতে চাইছিলি এটা?কেন করতে গিয়েছিস এটা?তুই আমার কথা একবার ভাবলিনা?আমার জীবন সম্পূর্ণটাই মিথ্যা একমাত্র তুই ছাড়া।
– ভুল হয়ে গিয়েছে মা।তখন ঐসব পড়ে আমার সেই মুহুর্তে শুধু একটা কথায় মনে হচ্ছিল আমি আমার শরীরে কোনো অবৈধ রক্ত বয়তে দেব না।
সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে জরিয়ে ধরে রাণী।ছেলের মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে বলে,
– কে বলেছে তুই অবৈধ? তুই আমার ছেলে।
ফারিশ মায়ের মুখটা নিজের হাতের আদলে নিয়ে মায়ের কপালে দীর্ঘ এক চুমু খেল।ভালোবাসার দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে উচ্চারণ করল,
– মা!
রাণী নরম স্বরে বলল,
– এই ডাকটার জন্যই রাণী আজও পৃথিবীর বুকে!
ফারিশ তার গলায় হাত দিলো।গলাটা কেমন ব্যাথা করছে।রাণী তাকালো ফারিশের গলার দিকে তাকাল।কেমন দড়ির কালশিটে দাগ পড়ে গিয়েছে গলায়।রাণী সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বলল,
– বারিশকে একবার কল করে জানিয়ে দিই তো জ্ঞান ফিরেছে।
বারিশকে কল করলো রাণী।কিন্তু তাকে ফোনে পেল না রাণী।পাবেই বা কিভাবে ফোনটা যে বন্ধ করে রেখেছে সে।বার বার কল করার পরও বারিশকে না পেয়ে বিরক্ত হলো রাণী।বিরক্ত নয় বরং রাগ হলো রাণী।ফোঁসফোঁস নিশ্বাস ছেড়ে ফারিশের কেবিনে চলে গেল সে।
শাড়ি গুছিয়ে রাখছে চিনি।বাড়ির টেলিফোন থেকে ইশান্তের সাথে কথা শেষ করে ঘরে আসে বারিশ।ইশান্তকে ঘুমের মধ্যে ফোন করায় উল্টোপাল্টা কিছু প্রলাপও শুনতে হয় বারিশকে।বারিশের ভরাট কন্ঠের এক ঝাড়ি খেয়ে মতি ফেরে ইশান্তের তড়িঘড়ি নিজেকে স্বাভাবিক করে।বারিশের আদেশ অনুযায়ী হাসপাতালের ডাক্তারের থেকে জানতে পারে ফারিশের জ্ঞান ফিরেছে।ফারিশের জ্ঞান ফেরার খবর শুনে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে বারিশ।ইশান্তকে জানিয়ে দেয়, “ফারিশের সব খরচ আমার।” বাহাদুরের মতো কথাটি বলে বুক ফুলিয়ে ঘরে ঢোকে বারিশ।সে ভেবেছিল চিনি এতক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে।কিন্তু ঘরে এসে চিনিকে এখনো জেগে থাকে দেখে চোখ বড় করে বারিশ।বলল,
– একি তুমি এখন ঘুমাওনি?
পিছন ঘুরে তাকায় চিনি।শাড়ি ডিভানের উপর রেখে নিজেকে ঠিকঠাক করে।বারিশ এগিয়ে এসে চিনির সামনে দাঁড়াল।দুই ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে?” চিনি আমতা আমতা করে বলল,
– আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল।
– কি?
চিনি নিচে তাকিয়ে হাতের নক খুঁড়তে খুঁড়তে আমতা আমতা করছে।বারিশ চিনিকে এমন করতে দেখে ধমক দিয়ে বলল,
– কি হয়েছে বলো?
চিনি বারিশের ধমকে কেঁপে উঠল।তা দেখে ঘাবড়ে গেল বারিশ।চিনির দুইহাত ধরে চিনিকে ঝাঁকিয়ে দিলো।চিনি আমতা আমতা করে বলল,
– আচ্ছা আমার প্রেগন্যান্সির রিপোর্টটা আপনার অফিসের ফাইলে লুকিয়ে রেখেছিলেন কেন?
বারিশ মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।বারিশ চিনিকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলো।জোরে একটা শ্বাস টেনে বলতে শুরু করলো,
– যখন প্রথম দুইবার মিসকারেজ হওয়ার পর তৃতীয়বার তুমি প্রেগন্যান্ট হলে বিশ্বাস করো চিনি আমি ভিষণ খুশি হয়েছিলাম।তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে রিপোর্টটা অফিসে দিতে বলি।তারপর…
থেমে গেল বারিশ।একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলা শুরু করল,
– তারপর বাড়িতে এসে শুনলাম তোমার নাকি পি’ড়িয়ড হয়েছে।বড় একটা ধাক্কা খেলাম আমি।কিভাবে সম্ভব? হিসাব মেলাতে না পেরে ভাবলাম হয়তো এবারও মিসকারেজ হয়েছে।তাই তুমি কষ্ট পাবে ভেবে তোমাকে জানতে দিইনি যে তুমি আবার কনসিভ করেছিলে।তাই রিপোর্টটা ফাইলে লুকিয়ে রেখেছিলাম।কিন্তু ওটা দেখে ফেললে আর আমাকে ভুল বুঝে ছেড়ে গেল।দুই মাস আমার থেকে দূরে থাকলে!কিভাবে পারলে তুমি চিনি?তোমার কি আমার কথা একবারও মনে পড়েনি?
গোমড়া মুখে বলল বারিশ। চিনি মাথা নত করে বলল,
– সরি।আসলে তখন রিপোর্টটা দেখে আর নিজের অবস্থান দেখে আমার মাথায় কিছুকাজ করছিল না।তারপর মা এসে বললো আপনি নাকি চাননা আপনার কোনো বেবি হোক। কারণ আপনার বাবা নাকি আপনার বাচ্চার নামে তার সব সম্পত্তি…
বলতে বলতে চিনি বারিশের চোখের দিকে তাকালো বারিশ কটমট চোখে তার দিকে চেয়ে।চিনি শুঁকানো ঢোক গিলে মিন মিন করে বলল,
– সরি।
– হয়েছে শুয়ে পড়েন এখন।সকালে আমার অফিস আছে।
চিনি কোনো কিছু না ভেবেই বারিশের গালে ঠোঁট ছোঁয়াল চিনি।আচমকা এমন হওয়ায় চোখ বড় বড় করে ফেলল বারিশ। পরমুহূর্তেই বারিশ বাঁকা হেসে এক ভ্রু উঁচিয়ে চিনিকে বলল,
– পিঁপড়েকে চিনির সন্ধান দেখিয়ে রাত দুপুরে নিজের বিপদ বাড়ালে!
মাথা নত করে লাজুক হাসলো চিনি।বারিশ আর কালবিলম্ব না করে চিনিকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে এলো।বারিশের এলোমেলো স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠল চিনি।
হাসপাতালের গলিতে এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করছে রাণী।রাগে খিটখিট করছে সে।এলো বেলা হয়ে গেল কিন্তু বারিশ একবারও এলো না!কাল রাতে ওভাবে ছুটে বেরিয়ে গেল। তারপর ফোন কল কোনো কিছু না বলেই কেটে দিল।এরপর ফোনে বন্ধ পাওয়া।সব কিছু অগোছালো লাগছে তার কাছে।কাল তো সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল তাহলে হঠাৎ কি হলো।এখন পরিস্থিতি কোথায় যাচ্ছে তাও তো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।বারিশ কি চিনিকে ওবাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে?কি হলো কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না। যতক্ষণ না ও বাড়ির খবর জানবে ততক্ষণ তো শান্তিও পাচ্ছে না সে।ফারিশকে হালকা পাতলা খাবার খাইয়ে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে।তাই এখন সে ঘুমাচ্ছে। তার এখন পর্যাপ্ত বিশ্রামের প্রয়োজন।শরীরের উপর যে ধকলটা গিয়েছে তারপর কোনো ধরনের স্ট্রেস নেওয়া ফারিশের শরীরের পক্ষে ভালো নয়।ইশান্ত বারিশের কথা মতো রাণী এবং ফারিশের খাবারের ব্যবস্থা করে।খাবারটা চোখের সামনে পড়তেই রাণীর রাগটা তিরতির করে বেড়ে গেল।খাবারের বাটিটি নিজের সর্বশক্তি দ্বারা ছুঁড়ে ফেলে।রাগে ফোঁস ফোঁস শ্বাস ছাড়ে।পাশে ঘুমন্ত ফারিশের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলে,
– এতো বড় রিস্ক নেওয়ার পরও সবটা এলোমেলো হয়ে গেল!
বিশাল থাইগ্লাস ভেদ করে সূর্যের মোলায়েম আলো চোখে পড়তেই কপাল কুঁচকায় চিনি।সকালে সূর্যের আলো তেমন প্রখর নয়।শরীরে পড়লে তেমন বিরক্ত লাগে না বরং ভালোই লাগে।পিটপিট করে চোখ খোলে চিনি।ঘরের ছাঁদে চোখ পড়তেই দেখতে পায় অসংখ্য বেলুনে ভরা ছাঁদ।মৃদু হেসে চোখ কুঁচকে উঠে বসে চিনি।আশেপাশে তাকায় সে।একাধিক রং বেরঙের ফুলে সজ্জিত সারাঘর।খাট থেকে ওয়াশরুম পর্যন্ত মেঝেতে গোলাপ ফুলের পাপড়িতে সাজানো।হঠাৎ কেউ বলল,
– গুড মর্নিং ম্যাম।
সে কন্ঠের উৎসের দিকে তাকালো চিনি।বারিশ দেয়ালে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে।চিনি হেসে বলল,
– আপনি এসব..
বারিশ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
– মনে পড়ে কিছু?ভাবলাম আমাদের বিয়ের পরেরদিনটা আবার রিক্রিয়েট করলে কেমন হয়?তাই করলাম কেমন হয়েছে?
– অনেক সুন্দর!
চলবে…