শ্রাবণধারা পর্ব-৭০+৭১+৭২

0
186

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৭০
(নূর নাফিসা)
.
.
“এই বাড়িটা তোমাদের, তাই না?”
চোখে বিস্ময় জাগিয়ে ফিরে তাকায় শ্রাবণ। অথচ ইফতেখারের মুখাবয়বে এক রকম উচ্ছ্বাস! শ্রাবণ মর্মাহত! সে জানলো কীভাবে? শ্রাবণ তো চায়নি, সে কোনোভাবে জানুক। মূলত তার বাবার ব্যাপারগুলো তুলতেই চায়নি এখানে। আফজাল হোসেনের অন্তঃস্থলেই তা চাপা পড়ে থাকুক চেয়েছিলো। কিন্তু আফজাল হোসেন তাকে জেনেই উঠলো কিছু সময়ের ব্যবধানে! তিনিই জানায়নি তো? কতটা জানিয়েছে? এতে তার কি উদ্দেশ্য হাসিল হয়েছে?
ইফতেখার উচ্ছ্বসিত চোখ নামিয়ে নেয় তার থেকে। অস্পষ্ট মলিনতা মুখগহ্বরে রেখে স্পষ্টতায় ভাসিয়ে দেয় স্বাভাবিকতা। চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,
“চিন্তা করো না। একটু সময় দাও, তোমাদের বাড়ি তোমরা ফিরে পাবে।”
তার মুখভাব বলছে, সে একটা চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে শ্রাবণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু শ্রাবণ তো জানে, আফজাল হোসেন নিজেই বলেছে সম্পদ ফিরিয়ে দিবে। এখানে ইফতেখারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ কেন? শ্রাবণের ভেতরকার মনস্তাপ জ্বলে উঠতে চায় আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে। সে নিষেধ করে আসায় কি এখন ছেলেকে ব্যবহার করছে দায়মুক্ত হতে? ঠিক এজন্যই চাইছিলো না, কেউ সেসব জানুক। ইফতেখার তো একদমই না! আর অবশেষে সে-ই কি না…! শ্রাবণ চোখ নামিয়ে থমথমে মুখে জবাব দেওয়ার ইচ্ছাবোধ করে এবার।
“না। এই বাড়ি আমাদের না।”
“তোমার মুখে অস্বীকারোক্তি! তবে কী বলতে চাইছো, আব্বা আমাকে মিথ্যে বললেন?”
“কী বলেছে আব্বা?”
“বললেন, এই বাড়ি তোমাদের। একসময় টাকার জন্য বিক্রি করা হয়েছিলো তোমার বাবার কাছে। পরে টাকা কিংবা জমি কোনোটাই দেয়নি দাদা।”
“আপনার আব্বা তখনো প্রাপ্তবয়স্ক। দাদার উপর দোষ চাপিয়ে এতো বছর পর তিনি নিজেকে কী প্রমাণ করতে চাইছেন?”
“দেখো, দোষ দাদার হোক কিংবা আব্বার হোক। ওসব তো আমি জানিও না, প্রমাণ নিয়ে টানাটানিও করতে চাইছি না। যারই হোক না কেন, দোষটা এবাড়িতেই আছে। আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই, রাস্তায় নেমে পড়লেও তোমাদের সম্পদ তোমাদের হাতে তুলে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা আমি করবো।”
তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় শ্রাবণ। সুস্পষ্ট গলায় বলে,
“এই বাড়ি আমাদের না।”
“মিথ্যে জবানবন্দি রেখে নিজেকে আড়াল করতে তোমায় আমি আগেও দেখেছি। অন্যের দায় স্পষ্ট রেখে এভাবে আড়াল হলে তো চলে না, শ্রাবণ।”
“আমি কোনো মিথ্যে বলছি না। এই বাড়ি আমাদের না, বাড়ির একটা অংশ আমার বাবা কিনেছিলেন তখন।”
“ঠিক আছে। তবে সেই অংশই তোমরা পাবে।”
“আপনার কি মনে হচ্ছে, এই জমির জন্য এখানে এসেছি আমি?”
“আমি মনে করলে তো অনেক কিছুই করতে পারি। কিন্তু আমার মনের রায় কি পৃথিবীর আদালত স্বীকৃতি দিবে? তবে এইটুকু নিশ্চিত বলতে পারি, আমি যেমন পছন্দ করে তোমার জীবনে নিজেকে জড়িয়েছি; তুমি তা করোনি।”
কথাটা হৃদয়াবেগে ছুঁয়ে যায় শ্রাবণের। ইফতেখারের চোখে তাকিয়ে নিজের চোখদুটোও ভিজে আসতে চায় যেন। কঠোর চেষ্টায় আটকে রাখে তবুও।
“আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে। আমি জমির জন্য আসিনি। জমির ব্যাপার কারো কাছে তুলতেও চাইনি। জানানোর হলে আপনাকেই জানাতাম আগে।”
“হ্যাঁ, আমি এ-ও জানি তুমি কেন এসেছো। তোমার বাবার ওয়াদা পূর্ণ করতে তুমি এখানে এসেছো। ভাগ্যিস! উনি কথা দিয়ে গিয়েছিলেন। নয়তো শ্রাবণমুখ তো আমার আর দেখা হতো না!”
শ্রাবণ বুঝতে পারছে না, কথাগুলো তাচ্ছিল্যের সাথে বলছে নাকি অভিমানের সাথে। তবে এটা অস্বীকার সে নিজেও করতে পারবে না যে, ইফতেখারকে পছন্দ করে সে এবাড়ি আসেনি। বরং এসে তারপরই পছন্দ করা হয়েছে৷ ইফতেখার চায়ের কাপ হাতে ধীর পায়ে বারান্দামুখী হয়ে বলে,
“এতোদিন তো শুধু আম্মার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতাম যে, তিনি এবাড়ির সদস্য না হলে শ্রাবণকে ইফতির পাওয়া হতো না। কিন্তু আজ ঠিক বুঝতেই পারছি না, এতে আম্মার অবদান বেশি; নাকি আব্বার বন্ধুত্বের অবদান!”
শ্রাবণ চুপ করে থাকে। কী বলবে, সে নিজেও বুঝতে পারছে না। ইফতেখার যেটুকু এগিয়েছে সেইটুকু আবার ফিরে দাঁড়ায় অবসর পায়েই। কাপের মধ্যে চা নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,
“গত রাতে আমি আব্বার সাথে রাগারাগি করেছি এজন্য। তিনি বলেছেন, দাদা সমস্যায় পড়ে প্রথমে রাজি হয়েছেন বিক্রির জন্য। কবরস্থানের ওপাশের অংশটুকুই নাকি ছিলো৷ আলাদাও করে রেখেছিলেন। পরে সমস্যা ছাড়াতেই নিজের জমিটুকু হারাতে চায়নি। টাকা নাকি ফেরাতে চেয়েছিলো। কিন্তু…”
“মিথ্যে কথা!”
ইফতেখারের কথার মাঝখানেই শ্রাবণের কণ্ঠ হুট করে ক্ষেপে উঠে। ঘন নিশ্বাসে নিংড়ে পড়ে ঘৃণা আর ক্ষোভ। ইফতেখার কথায় থেমে দেখে, তার মনস্তাত্ত্বিক গর্জে উঠাকে। দেখে, তার চোখ ও নিশ্বাসের কঠোরতাকে। পড়ে, মনের ভাব। তবে নিজের মধ্যে বহমান একইরকম স্বাভাবিকতা। সে আবার বলতে শুরু করে,
“টাকার ব্যাপার সত্য না মিথ্যা, তা জানি না। তবে যা-ই হোক না কেন, জমিটা যে আব্বা কিংবা দাদা কেউই ছাড়তে চায়নি; সেটা আমি এমনি বুঝেছি। আর এজন্যই মূলত আব্বার সাথে রাগারাগি করেছি যে, দাদা তো সেই কবেই মারা গেছেন। এতোগুলো বছরে তিনিও কেন ফেরানোর ইচ্ছা রাখেননি। কেন সন্ধান করেননি সেই বন্ধুর। যার থেকে কথা আদায় করে রেখেছে, অথচ নিজের দেওয়া কথা পূর্ণ করতে তিনি এগিয়ে যাননি! এখানেই উনার সবচেয়ে বড় ভুল বা দোষ যা-ই বলা হোক না কেন।”
“তা পূর্ণ করতে গেলে তিনি উঠতেন কী করে এতো উপরে!”
বিড়বিড় করে শ্রাবণ। তা শুনে ইফতেখার তাচ্ছিল্যের কিঞ্চিৎ হাসি ঠেসে ঠোঁটের কোণে। বলে,
“উপরে উঠতে হলে আরও উপায় উনার ছিলো। কেননা এই অংশ বাদেও উনার যথেষ্ট পরিমাণ জমি আছে৷ দাদার আমল থেকেই। তিনি কেন এমন করলেন, তিনিই ভালো জানেন। তবে তোমার উপর সন্দেহ আমার মিথ্যে ঠেকেনি। শুরু থেকেই আব্বার প্রতি তোমার আচরণ আমি স্বাভাবিক নিতে পারছিলাম না। কারণ, দুই পক্ষকেই আমি অন্তরের আপন মর্যাদায় রাখি। কিন্তু তুমি আমার উপর অন্যা… অন্যায় না ঠিক, এক প্রকার মানসিক অত্যাচার করে গেছো একের পর এক ধোঁয়াশা তৈরি করে। কি জানি, আরও কোনো বাকি নাকি খোলাসার! তবুও কি পেরেছো তা ধোঁয়াতে আঁধার করে রাখতে?”
অপরাধী চোখ জোড়া এক পলকের জন্য ইফতেখারের চোখে তুলেও আবার নামিয়ে নিয়েছে শ্রাবণ। সে আজও চায় না ইফতেখার কিছু জানুক। সব জেনে উঠার পরও এখনো মন বলে, না জানলেই ভালো হতো! দৃষ্টি নত করেই ইফতেখারের প্রত্যুত্তর করে,
“যেটুকু জানানোর ছিলো, সময়ে ঠিকই জানিয়েছি। যেটুকু জানানোর নয়, কখনোই জানাতে চাইনি।”
“অথচ প্রতিটি ব্যাপারেই উচিত ছিলো আমাকে ধোঁয়াশা হতে বের করার। আমি জানি না তোমার কাছে আমার মর্যাদা কতটুকু। কিন্তু আমি এটা খুব মানতাম যে, বিবাহ বন্ধন বুঝি দুটি পক্ষের সম্পর্কের সাথে মনকেও এক করে রাখে। এজন্যই তো বুঝি অর্ধাঙ্গী, অর্ধাঙ্গিনী নামেও তাকে অবিহিত করা হয়েছে৷ কিন্তু আমার ধারণা তো সব দিক থেকে আর ঠিক হতে পারে না।”
“আপনি আমায় ভুল বুঝছেন। এই পরিবারের প্রতিটি মানুষের মর্যাদা আমার কাছে আলাদা, আলাদা। আমি আপনাকে কখনোই মর্যাদায় অবহেলা করি না। হ্যাঁ, এ সত্য যে আমি ফাতিহা আম্মার তথ্য প্রকাশ ও অধিকার ফেরানোর জন্য এই গ্রামে এসেছি। আবারও এ-ও সত্য, আমি আমার বাবার কথা রক্ষার জন্যই সংসার গড়ে আপনার ঘরে উঠেছি। তবে তার চেয়ে বড় সত্য, আমি আপনাকে পছন্দ করি বলেই আজও আপনার ঘরে দাঁড়িয়ে আছি; আপনার পরিচয় ও অধিকারে নিজের ভাগ বসিয়ে রেখেছি। এখানে নিজেকে অবহেলিত প্রমাণ করাটা আপনার ভুল ভাবনা। শুধু শুধু অভিমানের জন্ম দিচ্ছেন।”
“যাইহোক, বাদ দাও। সেটা তোমার আর আমার ব্যাপার। সংসার অব্যাহত আছে যখন একবার ভুল বুঝাবুঝি, ঝগড়া বিবাদ হবে; আবার মীমাংসাও হবে। তবে এখন যে ব্যাপারটা মীমাংসা করা দরকার, সেটাই আমি তোমায় বলছি। বিপুর বিয়ের আয়োজনটা শেষ হতেই তখনকার মূল্য অনুযায়ী বর্তমান মূল্যে জমি ফেরানোর কথা আব্বাকে বলেছি। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের হক তোমরা ফিরে পাবে।”
“আর দিনগুলো? যেই দিনগুলো আমাদের দুর্বিষহ কেটে গেলো, সেই দিনগুলো? যেই দিনগুলোতে আমার বাবাকে নিজের আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করতে করতে আহারকে ভুলে যেতে হয়েছে, সেই দিনগুলো? যেই দিনগুলোকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় জড়িয়ে বাবা মরণ ব্যাধি জড়িয়ে নিলেন স্বল্প বয়সে, সেই দিনগুলো? যেই দিনগুলোতে বাবার ওষুধপত্রের ভার বড্ড ভারি হয়ে উঠেছিলো একটা পরিবারের উপর, সেই দিনগুলো? যেই দিনগুলোতে আমাদের পৃথিবীটা থমকে গিয়েছিলো এতিম পরিচয়ে, সেই দিনগুলো? আমার মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের নিভু নিভু সেই দিনগুলো কীভাবে ফিরে পাবো? সেগুলোও তো আমাদের হক ছিলো।”
মনের ব্যাথায় চোখের জল গড়িয়ে পড়ে ঠোঁটে কম্পন ধরে যায়। কিন্তু নিজেকে সামলে নিতে এই মেয়ে আরও আগেই শিখে গেছে। প্রতিবার সক্ষমও হয়েছে, যখন থেকে নিজের জগতটাকে চিনে উঠতে পেরেছে। ইফতেখার তার চোখেমুখে দেখে। অসম্ভব ক্ষমতায় হাত বাড়ানোর সাহস কিংবা ইচ্ছা, কোনোটাই তার নেই। তাই সে মলিন, স্বাভাবিক কণ্ঠেই নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে।
“সেই দিনের জন্য কিছু করা হয়তো সম্ভব না। সেই দিনগুলোতে বিধ্বস্ত হওয়া পরিবারকে গুছিয়ে তোলাও সম্ভব না। তবে এইটুকু চেষ্টা করে যেতে পারি, সেই দিনের এই তোমার আগামী দিনগুলো সাধ্যমতো সুন্দর করে রাখতে। এমন একটা প্রতিশ্রুতি আমার কাছ থেকে নিতে পারো, যদি কিঞ্চিৎ বিশ্বাস আমার উপর রাখা সম্ভব হয় তো।”
চোখের ধার মুছে দৃঢ় গলায় শ্রাবণ বলে,
“আপনার উপর এখন অব্দি অবিশ্বাস আমার জাগেনি। কখনোই না জাগুক। আর আপনি আমার জন্য প্রতিদান স্বরূপ কিছু করুন, তা-ও আমি কখনোই চাই না। আমার উপর আপনার অধিকার যেটুকু বর্তায়, সেটুকুতেই আমি সন্তুষ্ট।”
“যদি তা-ই হয়ে থাকে, আমার অধিকার ও কর্তব্য আমি ঠিক পালন করে যাবো। দুর্বিষহ হলেও তোমার দিন থেমে থাকেনি। আল্লাহর করুণায় আমার প্রচেষ্টাও আজ না থামুক।”
“আমি এই জমি নিবো না। আল্লাহ আমায় সেদিনও চালিয়েছেন, আজও ঠেকিয়ে রাখননি। আপনি আমায় এসবে বাধ্য না করলেই খুশি হই।”
“এই না বললে, আমার দায়িত্ব পালনের কথা?”
“প্রতিদান দিতে বলিনি তো!”
আরেকটু এগিয়ে ইফতেখার চায়ের খালি কাপটা শ্রাবণের হাতে তুলে ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে বলে,
“স্বামী হিসেবে তোমার প্রতি যেমন দায়িত্ব স্থির, ছেলে হিসেবে তো পিতার প্রতিও আমার দায়িত্ব স্থির। পিতা পৃথিবীর যত নিকৃষ্ট কাজ করে থাকলেও আমি উনার সন্তান। আর উনাকে দায়মুক্ত করা আমার কর্তব্য। যেমনটা কর্তব্য মনে করে তুমি এসেছো তোমার পিতার ওয়াদা পূর্ণ করতে, তেমনই আমারও কর্তব্যে জাগে নিজ পিতাকে দায়মুক্ত করা। হোক সেটা নিজের তিলে তিলে গড়া কোনো সম্পদের বিনিময়েই!”
চায়ের কাপ হস্তান্তর করে এবার হাত ছেড়ে দেয় ইফতেখার। নিষ্পলক, স্থীর চোখে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণ তার চোখের দিকে। ইফতেখার বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়েছিলো। ফিরে দাঁড়িয়ে কানের পাশে আবার বললো,
“আমি তোমার উপর কখনোই কোনো ক্ষোভ রাখতে চাইনি এবং চাই না। ওইযে, অভিমানটুকুর কথা বললে না? এটাও আমার মাঝে বেশিক্ষণ থাকে না। আমি এইটুকুও ভুলে যাবো যদি আমায় একটু আপন করে নিতে পারো, তবে। আমায় আপন মানুষ হয়ে থাকার সুযোগ দাও একটু, আমি মনে পড়তেই দিবো না যে কখনো তোমার প্রতি আমার অভিমান জন্মেছিলো। এইটুকু সুযোগ বঞ্চিত করতে গিয়ে দায়ের ভারে আমাকে বহুদূর ঠেলে দিয়ো না যেন। ফায়সালা এখন তোমার হাতে!”
শান্ত গলায় তীক্ষ্ণ ভাবার্থ কথা বলে সে অশান্ত করে চলে গেলো শ্রাবণের মনকে। এই জমি ফেরানোটাকে ঠিক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই গ্রহণ করে নিলো যেন ইফতেখার। তাতে বড়ই হতাশাগ্রস্ত হয়ে চোখের পাতা দুটো বন্ধ করে নেয় শ্রাবণ। এই ব্যর্থতা তাকে চরম যন্ত্রণা দিচ্ছে। আজ কেন মনে হয়, জীবনটাকে এই মানুষটার দিকে না ঘোরালেই ভালো হতো? যে জমির জন্য তার বাবা লড়েনি, বন্ধুত্বের মর্যাদাকে উঁচুতে রেখে আত্মসম্মান নিয়ে ফিরে গেছে। বুকে ব্যাথা বেঁধে রেখেছে মরণ অব্দি, সেই জমি আজ সে নিবে কী করে! মা তো এজন্যই তাকে বারবার সাবধান করছিলো, রেগেছিলো বিয়ের কথা শুনেও! আজ সেই ব্যর্থতাই নেমে এলো তার চোখের কোটরে, বড্ড ভারি হয়ে? এ-তো অসহনীয় ব্যাথার জন্ম দিলো নতুন করে!

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৭১
(নূর নাফিসা)
.
.
প্রায় দুটোদিন ভাবনায় মত্ত থাকে শ্রাবণ। ইফতেখারের ভালো মনুষ্যত্ব, ভালোবাসা, যত্নগুলোই তার যত দুর্বলতা। প্রিয়জনদের মর্যাদা রক্ষার্থে সে খুবই সিরিয়াস। স্ত্রীর সাপোর্টার হয়েও সে পিতার পক্ষ ছেড়ে দিলো না। শ্রাবণও চায়নি যে সে পিতার পক্ষ ছেড়ে দেক। ক্ষোভটা শুধুমাত্র আফজাল হোসেনের উপর তৈরি। অন্যদের সাথে তার ক্ষোভের সম্পর্ক না। বরং পরিবারকে একত্রিত রাখতে চেয়ে এসেছে এযাবৎ। আফজাল হোসেনকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ না করলেও এমনটা সে কখনোই চায়নি যে, তার পরিজনরাও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিক! বরং ইফতেখারের ব্যক্তিত্বে অবগত থেকে এই ভয় পেয়ে এসেছে, সে জানলে তার পিতাকেও না জানি ঘৃণা করতে শুরু করে। সে যেন পিতা পুত্রের সম্পর্ক নষ্টের কারণ না হয়! যেমনটা সেদিন চায়নি তাদের মা ছেলের ক্ষেত্রেও৷ তার জন্য পরিবার ভাগ হয়ে যাবে, এমন প্রত্যাশা সে কখনোই করে না। এখনো না। বরং নিজের দিকে ব্যর্থতা ঢাল হয়ে এলেও ইফতেখারের প্রতি সম্মানটা বেড়ে আসে, সে নিজ জায়গায় অটল আছে বলে। কিন্তু নিজের বাবার অমর্যাদাই সে করবে কী করে? অন্যথায় ইফতেখার তাকে মানসিক অত্যাচারী হিসেবে দায়ী করলো যে! অভিমান করে রইলো মর্যাদার অস্পষ্টতায়! কিন্তু কীভাবে বুঝাবে, সে তার ভালোবাসার অমর্যাদা করেনি যে? কীভাবে বুঝাবে, ইফতেখারের জায়গা তার মনে গাঢ়তর দাগ কেটে গেছে দিনের পর দিন? কীভাবে নষ্ট হতে দিবে এই সম্পর্ক? কীভাবে মুক্তি দিবে তাকে মানসিক অশান্তি থেকে? তা করতে হলে যে জমিটাও তাকে বরণ করে নিতে হবে!
একদিকে ইফতেখারের ভালোবাসার প্রতিদান, অন্যদিকে পিতার আত্মসম্মান; সবটা নিয়েই দুশ্চিন্তা ও মলিনতায় আটকে থাকে তার দিন দুটো। অবশেষে একটা সিদ্ধান্ত আঁকড়ে ধরে আজ। রাগারাগির পর যে পিতার সাথেও ভালোভাবে কথা বলছে না ইফতেখার, তা-ও নজর এড়ায়নি। সাত্তার আয়োজন করেই মেয়ে পাঠাবে জানিয়েছে, সেই খবরটা পর্যন্ত সে ঘরে থেকে দেয়নি। খালিদকে দিয়েই পিতার কানে পৌঁছেছে। দুপুরে খাওয়ার পর আফজাল হোসেন তাকে ডাকলেও সে গম্ভীরমুখে এসে সামনে দাঁড়ায়। আফজাল হোসেন জিজ্ঞেস করে,
“শ্রাবণ কী রাজি হইছে, জমির ব্যাপারে? আমার কাছে তো সেদিন নিবো না বললো।”
বদমেজাজি রূপটা মুহুর্তেই ভেসে উঠে ইফতেখারের মুখাবয়বে। প্রত্যুত্তরে বলে,
“নিবে মানে কী? সে কি চেয়ে নিতে আসবে আপনার কাছে? আপনার দেওয়া উচিত, আপনি দিবেন।”
“আমি তো না করি নাই যে, দিতাম না। সেধেই দিতাছি।”
“তো আর এতো জিজ্ঞাসা কীসের? এই সাধাসাধি তো আরও বহু আগেই করার দরকার ছিলো। তবে কী আর নিজের কাছে নিজেদেরই ঘৃণিত লাগতো?”
ছেলের মেজাজ দেখে থমথমে মুখে বসে থাকেন আফজাল হোসেন। চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে ইফতেখার চলে গেছে দালানে। শ্রাবণ রান্নাঘরে থেকে শুনেছে তাদের কথপোকথন। থালাবাটি সব গুছিয়ে রেখে ঘরে আসে। জানায় তার মনস্থির করা সিদ্ধান্ত।
“আমি জমি নিবো।”
ইফতেখারের চোখে আশার আলো জ্বলে উঠে যেন মুহুর্তেই। কিছুক্ষণ আগে পিতার উপর জাগ্রত হওয়া মেজাজ এখন পুরোপুরিই শান্ত হয়ে আসে প্রত্যাশা পূরণে। সে খুব করেই চাইছিলো, শ্রাবণ রাজি হয়ে যাক। অপূরণীয় দায় হতে নিজেদেরকে দায়মুক্ত করুক। সম্পর্কটা আরও গভীর হয়ে আসুক। দায়ে আটকে থাকলে তো এই সম্পর্ক হতে সংশয়ই কাটবে না কভু! মনের কোণে অশান্তির রেশ থেকেই যাবে দিনের পর দিন। তাই এমন সিদ্ধান্তে মুহুর্তেই পুলকিত হয়ে উঠে মনটা। শ্রাবণ তার এক বাক্যেই ইফতেখারের মুখভঙ্গি বদলে যেতে দেখে। মনে স্বস্তির নির্দেশনা আসে, যে ব্যক্তিটা তার হাসি কুড়িয়ে যত্নে আগলে রাখতে চায়; তাকে শ্রাবণ সুযোগ বঞ্চিত করবে না। যতটা আপন সে হতে বাকি মনে করছে, ততটা আপন তাকে করে নিবে৷ ওই মনের প্রণয়ের কারণ যখন সে নিজে হয়েছে, ওই মুখের হাসির কারণও সে হতে চায়। তাই তার এমন সিদ্ধান্ত পেশ করে দেয়। ইফতেখারের গলায় নীরব উল্লাস বিদ্যমান।
“আব্বা তোমার মতামত জানতে চাইছিলেন একটু আগেই।”
“আমি শুনেছি। আব্বাকে জানিয়ে দিয়েন, আমি নিবো। কিন্তু আমার একটা শর্ত থাকবে।”
“কীসের শর্ত?”
“যেটুকু পৃথক করে রাখা হয়েছিলো বলেছেন, সেটুকুই নিবো।”
ইফতেখারের ভ্রু মাঝে সূক্ষ্ম ভাঁজের সৃষ্টি হয়।
“সেটা তো কবরস্থান।”
“হ্যাঁ, কবরস্থানের জমিই নিবো।”
“এই জমি নিয়ে তুমি কী করবে!”
“কী করবো, সেটা পরে দেখা যাবে। প্রয়োজনে পারিবারিক না রেখে সামাজিক কবরস্থান হিসেবে রাখবো। যার দুনিয়ায় জমি নেই, সে-ও যেন জীবনের শেষ আশ্রয়টুকু এখানে করে নিতে পারে। দায়মুক্ত হওয়াই তো আপনার প্রস্তাবের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো? তো আমি এবং আমরা এই শর্তের বিনিময়ে আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে প্রস্তুত।”
ইফতেখার একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। নিবে যখন, এমন শর্তেই রাজি হলো! সে তো আরও চেয়েছিলো বিশেষ সুবিধাজনক কোনো জমি আদায় করে দিবে পিতার কাছ থেকে, যাতে তারা সেখানে নিজেদের আশ্রয়স্থলের ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে পারে! শর্ত জানার পরেও ইফতেখার মতামত রাখে,
“এরচেয়ে ভালো হয় না, একটা ভালো জায়গা পাও; বাড়ি করো, মা-বোনকে এনে কাছে রাখো, একটা আশ্রয়স্থল সুনিশ্চিত করো?”
শ্রাবণ মলিন মুখে অতি সামান্য হাসি এলিয়ে বলে,
“যতদিন নিশ্বাস চলে, কোনো না কোনো ছাদের নিচে মানুষ মাথাটা পেতে রাখতে পারে। যা এতোবছর ধরেই রেখে এসেছি আমরা। কে জানে, এই নিশ্বাস আর কতদিন চলতে বাকি! যেদিন নিশ্বাসটা হারিয়ে যাবে, কোনো ছাদের নিচেই তো আর জায়গা হবে না সেদিন। তারচেয়ে কি ভালো নয়, আশ্রয় থাকা সত্ত্বেও আশ্রয় সুনিশ্চিত করার আগে আশ্রয় না থাকার দিনটা নিয়েই ভাবি?”
যদিও ইফতেখারের মন সায় দিলো না এমন শর্তে, তবুও দায়মুক্ত হওয়া নিয়েই তাকে ভাবতে হলো। সুতরাং সে নিশ্চুপ হয়ে গেলো। তবে ভাবনাগুলো ডুবে আছে মুখাবয়ব জুড়ে! শ্রাবণ তার ভাবুক মুখে তাকিয়ে কাছে এগোয়। পাশে থেকে এক হাতে বাহু স্পর্শ করতেই ইফতেখার ভাবনায় পলক ফেলে শ্রাবণের চোখে তাকায়। শ্রাবণ হালকা ভেজা চোখে স্থির তাকিয়ে থাকে তার দিকে। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,
“আমার প্রতি ভালোবাসা স্পষ্ট রাখলেও আপনি যে আমার ভালোবাসায় ভরসা খুঁজে পান না, সেটা আমি বেশ ভালোই জানি। আমি প্রমাণ না রাখতে পারি, বুঝাতে ব্যর্থ হতে পারি। তবে এইটুকু আপনি জেনে রাখতে পারেন, সম্পদের দায় হতে আপনার পরিজন মুক্ত হলেও প্রণয়ের দায়ে আপনাকে চিরকাল আটকে রাখবে শ্রাবণ। কালক্রমে কখনো যদি দূরত্বও বেড়ে আসে, তবুও আপনি এই দায় হতে মুক্তি পাবেন না জনাব। কোনো কিছুর বিনিময়েও না।”
ইফতেখারের মনটা কেমন হাহাকার করে উঠে। সে কি আসলেই ভরসা করে না শ্রাবণের প্রণয়ের প্রতি? শ্রাবণের মনে করাঘাত করেছে যে তার সেই অভিমানপূর্ণ অভিযোগ! প্রিয়জনের মনের আঘাত তো তার মনেও প্রলয় সৃষ্টির কারণ! সে চোখে চোখ রেখেই সুধায়,
“তুমি কি আমার কথায় আঘাত পেয়ে তবে জমির প্রস্তাব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে?”
শ্রাবণ ডানেবামে মাথা নাড়ে। ইফতেখার বুঝে নেয় সহজেই তার মনোভাব। মাথার পিছু হাত রেখে কপালে কপাল ঠেসে চোখ বুজে নেয় আবেশে। হিসহিসে গলায় বলে,
“যদি তা না-ই হয়, তবে আটকে রেখো আমায় প্রণয় দায়ে। ইফতি চিরকালই প্রস্তুত এমন দায়ে আটকে থাকতে তোমার তরে। দূরত্ব কেন? কাছে থেকে থেকেই অবিরত আটকে রেখো জনম ভরে।”
শ্রাবণের চোখের পাতাও নেমে আসে সুখ আবেশে। বন্ধ চোখের অশ্রু গড়িয়ে যায় গাল বেয়ে। সে জানে না, এই গড়িয়ে যাওয়া অশ্রুপাতে লুকিয়ে আছে কি না কোনো ব্যর্থতার গল্প। তবে আত্মবিশ্বাস, ব্যর্থতাকে টিকতে দিবে না। ক্ষয় হতে দিবে না বাবার আত্মসম্মানবোধকে। এই মানুষটাও তো তার জীবনের অন্যতম অধ্যায়। সুতরাং তাকে খুশি রাখার মাধ্যমেই পিতার আত্মসম্মান রক্ষার কাজ চালিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা সে করবে।
নিজের করা সিদ্ধান্ত নিয়ে মায়ের সাথেও ফোনালাপে পরামর্শ করতে চেয়েছে সন্ধ্যায়। কিন্তু সুলতানা বিশেষ কোনো মতামত রাখেনি। কেননা এই ব্যাপারে তিনি এমনিতেই শ্রাবণের উপর রাগান্বিত। উল্টো দোষারোপ টানলো, সে এই জমি নিতেই এখানে এসেছে কি না। শ্রাবণও মাকে আশ্বাসিত করলো, এই জমি সে নিয়ে যাবে না কোথাও। এখানেই থাকবে। চেয়ারম্যানের সীমানায়। আর কীভাবে থাকবে, তা-ও বুঝিয়ে বললো তাকে। সুলতানা নিশ্চুপ শুনে গেলেন। মেয়ে যা করতে চায়, তাতে সে স্পষ্ট বাঁধা দিচ্ছে না ঠিক। কিন্তু সম্মানহানিকর কিছু করা হলে যে একটা করাঘাত মায়ের তরফ হতে আসবে, তা শ্রাবণ তার নীরবতার মধ্যেই ভারি উপলব্ধি করতে পেরেছে। কাজেই রুম ছেড়ে চলে গেছে ছাদে। নিরিবিলিতে মায়ের সাথে আরও গল্প করা তার বাকি রয়ে যায় যেন৷ তা পূর্ণ করতেই ইফতেখারের বিষয়াদিও তুলে ধরে। সে যেমন চাইছে নিজ পিতার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে, ইফতেখারও চাইছে তার পিতাকে দায়মুক্ত করতে। দুজনেই দুজনার জায়গায় ঠিক। সুতরাং এর থেকে ভালো উপায় শ্রাবণ আর খুঁজে পাচ্ছে না। আর তাই জমি ঠিকই নিবে সে। কিন্তু নিজে ভোগ করার জন্য নিবে না।

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৭২
(নূর নাফিসা)
.
.
শ্রাবণ চেয়েছিলো চাকরির অনুমতি। ইফতেখার তার হাতে ধরিয়ে দিলো হিসেবনিকেশের খাতা! ক্লাবে বসে বসে দিনশেষে তার ব্যবসায়ের যেই হিসেবনিকেশগুলো সে কষে যেতো, তার দায় এখন শ্রাবণের হাতে তুলে দিলো। শ্রাবণ একটু চিন্তিত হয়েই তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“এটা কী?”
“তোমার চাকরি।”
“মানে?”
“নিজ থেকে কিছু করতে চেয়েছিলে না? তো ব্যবসায়ে আমার সহকারী হয়ে যাও। ঘরে থেকেই সংসারের বাইরে কাজ করে উপার্জন করো।”
শ্রাবণ অতি সামান্য হতাশা জাগিয়ে বলে,
“তার মানে ওই চাকরিটা করবোই না?”
“আমি বেতন দিবো তো মাসে মাসে।”
ভালো সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় ছোটোখাটো এক হতাশার নিশ্বাসও ফেললো সে। পরক্ষণে বললো,
“তো আপনার এই চাকরিটা আমি করবো কীভাবে? ঘরে বসে থাকলে আমি জানবো, আপনার ব্যবসা কেমন চলছে? তখন আমাকে বাইরে যেতে হবে না?”
“দেখাশোনার ভার তো আর তোমাকে দিচ্ছি না। আমি কী বসে থাকবো নাকি? এমনিতেই একজন ম্যানেজার রাখা প্রয়োজন মনে করছিলাম। আমাকে তো ছোটাছুটির উপর থাকতে হয়। দেখা যায় সময়মত লিখে না রাখলে, পরে আর সব হিসাব মেলাতে পারি না। এখন থেকে প্রতি লেনদেনের পরপর আমি তোমায় ফোনকলে সাথে সাথেই জানিয়ে দিবো, আর তুমি লিখে নিবে। মাস শেষে হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে বেতন নিয়ে নিবে। ম্যানেজার রাখলে যে হিসাবটা আমাকে ক্লাব থেকে বুঝে আসতে হতো, দেখা গেলো সেটা আমি ঘরে এসে যখনতখনই জানতে পারলাম; দেখতে পারলাম।”
শ্রাবণ খাতা খুলে দু-চার পাতা উল্টেপাল্টে আবার বন্ধ করে দিলো। ইফতেখার জিজ্ঞেস করে,
“পছন্দ হয়নি চাকরি?”
“আপনি পছন্দ করে দিয়েছেন যখন, আমি নিয়ে নিলাম।”
খাতা গুছিয়ে আলমারির দিকে এগিয়ে যায় শ্রাবণ। ইফতেখার জানতে চায়,
“বেতন কত নিবে?”
এবার ফিক করে হেসে উঠে শ্রাবণ। আলমারি খোলা রেখেই পিছু ফিরে বলে,
“পৃথিবীতে এই প্রথম দেখলাম, কর্মীর কাছে জিজ্ঞেস করে কর্মকর্তা বেতন নির্ধারণ করে!”
বিপরীতে ইফতেখারের মুখেও জাগে হাসি। বলে,
“তুমি বেতন না জেনেই রাজি হয়ে গেলে যে, তাই আমিই জানতে চাইলাম।”
“এখন আমি লাখ চাইলে লাখই দিবেন?”
“ধুর! লাখ টাকা আমার আয় হবে কি না যে, লাখ টাকার চাকরি দিবো! থাক তোমার বলতেই হবে না। আমার ইচ্ছেমতোই দিবো।”
মুখে মুচকি হাসি বজায় রেখে আলমারি লক করতে করতে শ্রাবণ বলে,
“আয় হবে না কেন? আল্লাহর নামে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। ব্যবসায়ের পরিধি বাড়লে আয়ও বেড়ে আসবে ইনশাআল্লাহ।”
“দোয়া করো। তখন নাহয় তোমার বেতনও লাখে নিয়ে যাবো।”
“তখন? তখন আর এক কর্মীতে আপনার হবেও না। যত বড় ব্যবসায়, তত বড়ই হবে কর্মসংস্থান। নাশতা কী খাবেন? রুটি না ভাত?”
“রুটি না করে একটু পরটা করতে পারো না?”
“আব্বা আম্মার তো পরটায় হবে না। আসুন, ভেজে দিচ্ছি তেলে।”
দুজন একত্রেই যায় টিনচালার ঘরে। ইফতেখার গিয়ে ঘরে বসে, শ্রাবণ যায় রান্নাঘরে তার জন্য পরটা ভেজে নিতে। পরী আর পারভীন এখানে বসেই নাশতা করছিলো। শ্রাবণ পরটা ভেজে ডিম নিতে গেলে পরী বলে,
“ডিম ভাজা আছে বাটিত।”
“কেন, অর্পার জন্য না রেখে গেলাম। খায়নি?”
“না, আপায় খায় নাই। পেটে কুড়কুড়ানি ধরছে। তাই ডাইল দিয়া খাইয়া স্কুলে দৌড় দিছে।”
“কুড়কুড়ানি মানে?”
“আরে, গ্যাস্টিক! গ্যাস্টিক!”
শ্রাবণ শব্দহীন হেসে উঠে তার হাস্যকর কথাতে।
“যা বলবে তুমি! অর্পা খায়নি যখন, তুমিই খেয়ে নিতে।”
“আমার এই ভাজা টাজা ভাল্লাগে না। মাঝেমধ্যে মন চাইলে সিদ্ধ কইরা খাইয়া বইসা থাকি। ওইডাই শান্তি।”
ইফতেখারের জন্যই ভাজা ডিম তুলে নেয় প্লেটে। বাটিতে নেয় ডাল। এদিকে শ্রাবণের উদ্দেশ্যে পারভীন বলে,
“ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার আগে গয়নার দোকানে যাবো কিছুক্ষণ পরে। হার আর বালার অর্ডার দেওয়া লাগবো। তুমি কি পুরাতনটা নিবা, নাকি নতুন যেইটা বানামু ওইটা? ডিজাইন একই থাকবো। দুই বউয়ের দুইটা। একজনের নজর আরেকজনেরটায় যাইবো না তবে।”
মাঝখানে পরী সায় দেয়,
“এইডাই ঠিক হইবো, আম্মা। কেউ কইতে পারবো না যে, তারটা সুন্দর বেশি!”
“হু। আর আমি যেইটা পরি, ওইটা অর্পার জন্য রাখবো।”
“এ…হ! নবাবী আপায় আপনার পুরান হার নেওয়ার জন্য বইসা রইছে!”
“চুপ থাক, গাধা! স্বর্ণ কি পুরাতন হয়?”
“স্বর্ণ পুরান না হোক, ডিজাইন কি পুরান হয় না? আপনার মাইয়া এখনই যেই আগডুম বাগডুম করে, বিয়ার সময় এই পুরাইন্না ডিজাইন পছন্দই করতো না।”
“তখনকারটা তখন দেখা যাইবো। পছন্দ না হলে ভেঙে পছন্দ অনুযায়ী বানায় নিবো।”
পরক্ষণে আবার শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“হাতের মাপ কি তোমার আর কান্তার সমান সমান হইবো নাকি?”
শ্রাবণ প্লেট আর বাটি হাতে তুলে নিয়ে জবাব দেয়,
“হাতের মাপ তো সমানই হবে। কিন্তু আমার নতুন কিংবা পুরাতন কোনোটাই লাগবে না, আম্মা। আপনি চাইলে বিপুর বউকে আগেরটা দিয়েই ঘরে তুলতে পারেন। একাধিক বানানোর প্রয়োজন নেই। শ্রাবণ কখনোই বলবে না যে, শাশুড়ি তাকে গহনা দেয়নি।”
হাসিমুখে জবাব দিয়ে চলে গেলেও এপাশটা যেন অসন্তোষের রেশে থমকে রইলো। অবাক চোখে পরী তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে। পারভীন বসে রইলো থমথমে মুখে। সেদিন গহনা ফিরিয়ে নেওয়াতেই বুঝি সে অভিমানে নিতে অস্বীকার করে গেলো! সেজন্য নিজের ভেতরই কেমন অপরাধবোধ জেগে উঠলো। যেভাবে চেয়ে নিয়েছিলো, অভিমান করাটাও তো অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া তারই দোষ কী? যা কাহিনী হচ্ছিলো, হারিয়ে ফেলার ভয় তো পাওয়ারই কথা। কিন্তু পুনরায় দিতে গিয়ে যত দ্বিধা! তাই দ্বিতীয় কোনো বাক্য বলার মতো ইচ্ছাশক্তিও পেল না। পরী তার থমথমে মুখে তাকিয়েই নাশতাপর্ব চালিয়ে যায়।
এদিকে ইফতেখার রুমে বসে বসে সবই শুনেছে রান্নাঘরের কথপোকথন। ভাবনায় মত্ত আছে স্ত্রী ও মায়ের বলা বাক্যগুলো নিয়ে। শ্রাবণ নাশতার থালা এনে রাখে তার সামনে। নাশতা আগেই সেরে নেওয়া সত্ত্বেও পাশেই বসে থাকে এবং পানি ঢেলে রাখে গ্লাসে৷ হাতের কাছে নকশাযুক্ত হাতপাখাটা পেয়ে অকারণেই ঘোরাতে থাকে। মনে সাড়া দেয় বাস্তবরূপী নাট্যদৃশ্য। বর ভাত খায় আর স্ত্রী পাশে বসে বসে হাত পাখায় বাতাস চালায়। তার আর বসে থেকে কাজ কী? সে মুচকি হেসে ইফতেখারের দিকে একটু পাখা নাড়িয়ে বলে,
“মাথার উপর তো ফ্যান চলছে। হাতপাখায় বাতাস করার কী প্রয়োজন আছে?”
ইফতেখার খাওয়ার মনোযোগ তার দিকে উঠিয়ে মুখের হাসিতেই খুঁজে পায় মস্করা। পুনরায় খেতে মনোযোগ স্থির করে জবাবে বলে,
“ফ্যান বন্ধ করে বাতাস করো।”
“তারপরও করতেই হবে?”
“কী আর করবে। অবসর আছো যখন। বাতাস্রর দোলে দোলে একটু পর না আবার আবদারের পাতা খুলে বসো। এমনটাই তো দেখা যায় টিভির পর্দায়।”
শ্রাবণ খিলখিলিয়ে হেসে বলে,
“আপনি যেন আগেই ভয় পেয়ে গেলেন!”
কোণঠাসা হেসে খেতে থাকে ইফতেখার। শ্রাবণ পাখা উল্টেপাল্টে নকশা দেখে। মিনিট দুয়েক নীরব থেকেই ইফতেখার বলে,
“গয়না নিতে অমত করলে কেন? এভাবে ঠকে যাচ্ছো কিন্তু।”
শ্রাবণ মুখে মুচকি হাসির রেশ পুনরায় ফুটিয়ে তোলে। পাখার নকশায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রত্যুত্তর করে,
“মানুষ মানুষকে ঠকাতে পারে, কিন্তু ঠেকাতে পারে না। জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতেও কেউ ঠেকাতে পারেনি, আগামী দিনগুলোতেও নয়৷ আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে ঠেকিয়ে দেওয়ার সেই সামর্থ্যই হয়তো দান করেননি। ঠেকানোর একমাত্র মালিক কেবল তিনিই।”
“তাই বলে তোমার হক, তুমি নিবে না? ওই গহনাগাঁটিও কিন্তু তোমার হক।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে সুস্পষ্ট করে তাকায় তার দিকে। নিজের গলার চেইনটা ছুঁয়ে বলে,
“ওই হারের চেয়ে আপনার দেওয়া এই চেইনটার ওজন বেশি মনে হয় আমার কাছে। এমনকি গহনাগাঁটি পরিধানের দিক থেকেও এইটুকুতেই আনন্দিত এবং পরিপূর্ণ লাগে। আর কিছুর প্রয়োজন নেই। গড়ে দেওয়া এই চেইনের শিকলে শিকলে গাঁথা আপনার জেদটুকুই যথেষ্ট হয়ে গেছে আমার জন্য।”
কথায় মন তুষ্টকর হলেও শ্রাবণের গহনার অধিকার গ্রহণ করার প্রত্যাশা ইফতেখার রেখেছিলো। তবে সে নিজে চায়নি যখন, ইফতেখার আপাতত এ নিয়ে আর কথা বাড়ায় না।
সারাদিন বাবা-মা আর ছেলেরা বাড়ি ছিলো না। পরী আর শ্রাবণের কেটেছে ভারি অবসর সময়। কখনো ঘরে বসেই গল্প করছিলো বিপুর বিয়ে নিয়ে। সে কি পরিকল্পনা সাজিয়ে চলেছে পরীটা! কখনো উঠুনে হেঁটে সময় কাটিয়েছে তারা। পশ্চিম প্রান্তে এগিয়েছে দুজন পেয়ারা পারতে। বকুল কাকার সাথেও কিছু গল্প চলেছে শ্রাবণের। ততক্ষণে পরী গাছে চড়ে নিজ হাতেই পেয়ারা নিয়ে ঢিল ছুঁড়েছে শ্রাবণের হাতে। পরক্ষণে বারান্দার মেঝেতে বসে বসে পেয়ারা মেখে খেয়েছে কাসুন্দিতে। বকুল কাকাকে সাধলে তিনি দাঁতে সমস্যা আছে বলে খেতে অস্বীকৃতি জানান। দুজন হাতের কাজ সম্পন্ন করে গোসল সেরে নিতেই আবার বকুল কাকা হাজির নিজেদের গাছের পেয়ারা নিয়ে। শ্রাবণকে ডেকে বলে,
“এইগুলা খাইয়া দেখো, বউজান। মিষ্টি আছে।”
“আরে আপনি আবার আনতে গেলেন কেন, কাকা! খেলাম না তখন!”
“নিজের গাছের। খাও।”
সাথে ছিলো আমড়া ফল। ভাত খাওয়ার পরই আমড়ার স্বাদ উপভোগ করলো দুজনে। দুপুরের পরপর অর্পা আর বিপু বাড়ি ফিরলে বিকেলে আবার চারজনের পেয়ারার ভর্তা জমে যায় ছাদে। বকুল কাকাদের গাছের পেয়ারাগুলোই। সেই সাথে চৌধুরী বাড়ির এই বড়মাপের ছানাপোনাদের হাসিঠাট্টা আর ঝগড়াঝাটি তো আছেই! আফজাল হোসেন ও পারভীন কিছু আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণ কার্য সেরে ফিরেছে সন্ধ্যায়। ইফতেখার সারাদিন কাজে। রাতে মায়ের সাথে কথা হয় শ্রাবণের। সুলতানা ফোন করেই বলে,
“তুই এলি না যে সাথে?”
“আমি? কোথায়?”
“বাসায়। ইফতি এলো যে, তুইও এসে ঘুরে যেতি।”
“উনি গিয়েছেন? কখন?”
“আজ বিকেলেই তো এলো। কেন, বলে আসেনি?”
“না, আমাকে বলেনি তো কিছু। কোনো কাজে গিয়েছিলো হয়তো ওদিকে। তাই দেখা করে এসেছে।”
“না, দাওয়াত দিতে এলো বিয়ের। তোর দেবরের নাকি বিয়ে?”
শ্রাবণ বুঝতে পারে, তবে এজন্যই তাকে কিছু জানিয়ে যায়নি। সে যদি যেতে নিষেধ করে, দাওয়াত দিতে হবে না! কিন্তু ইফতেখার কি নিজ থেকেই গিয়েছে, নাকি তার পরিবারকে আনার জন্য আফজাল হোসেনের কোনো চক্রান্ত? এমন যদি হয়, তিনি কি নিজের উপর খুব আত্মবিশ্বাস রাখছেন যে সম্পর্কটা আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে? এটা কেন বুঝতে পারছেন না; যতই আসাযাওয়া হোক, মনের দাগ সজ্ঞানে যে কোনোমতেই মুছে না!
ইফতেখার বাড়ি ফিরলেই শ্রাবণ জানতে চায়,
“কোণাপাড়া নাকি গিয়েছিলেন?”
সে ইতিমধ্যে জেনে গেছে তাই মুচকি হাসি ভাসে ইফতেখারের মুখে।
“গেলাম তো।”
“জানালেনও না যেন?”
“না জানিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া যায় না?”
“যাবে না কেন! আপনি তো আমার সাথে যেতেই লজ্জা পান। এজন্যই বললাম আরকি।”
“তুমি ছাড়া গিয়ে দেখলাম, লজ্জা লাগে নাকি!”
“আচ্ছা? তো ফলাফল কী হলো?”
“দেখলাম, সেখানে লজ্জায় ফেলার মতো একটা শ্রাবণ অনুপস্থিত। তাই সংশয় ছাড়া ভালোই খাওয়াদাওয়া করে এলাম। সেদিনের থেকে বেশি।”
শ্রাবণ নিচু স্বরে খিলখিলিয়ে হাসে। দাওয়াত নিয়ে কথা আর তুলেনি। দেখতে চেয়েছে, ইফতেখার নিজ থেকে বলে কি না। কোনোরকম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে ভেবে ইফতেখার নিজেও বলেনি। অথচ এ ব্যাপারে মায়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ফুটাতে প্রস্তুতই ছিলো না শ্রাবণ। মা নিজেই সিদ্ধান্ত নিবেন। তবে ইফতেখার যে তার মা বোনের সাথে সহজ হয়ে যেতে পেরেছে, তাতে বেশ ভালো অনুভব করছে সে।

চলবে।