#সংসার
পর্ব ১
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
নাজমুল সাহেব সন্ধ্যার নাশতা খেলেন। দুধ -মুড়ি। খাওয়া শেষ করে বসে রইলেন চায়ের জন্য। বড় ডাইনিং হল। তারপরে বিশাল এক রান্নাঘর। গৃহকর্মীদের কোনো সাড়াশব্দ নেই। ছেলে-ছেলেবৌ-নাতিরা কে কোনখানে, নাজমুল সাহেব বুঝতে পারছেন না। পুত্রবধূর কাছে কোনো কিছু চাওয়ার অভ্যাস একেবারেই নেই নাজমুল সাহেবের, তবে ছেলেকে পেলে চায়ের কথা বলতে পারতেন। নিশাত সারাজীবন সুনিপুণ ভাবে সংসারের সবার দেখভাল করেছেন সময়মতো। নানা অসুস্থতার ভারে এখন অতোটা পেরে উঠেন না। নিশাত সুস্থ থাকতে সংসারে কোনো অনিয়ম হতে পারতো না। নিশাত রীতিমতো দশভূজা নারী।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নাজমুল সাহেব হানিফাকে ডাকলেন। উত্তর নেই। ডাইনিং রুমে একটা কলবেল আছে রান্নাঘরে আর সারভেন্ট রুমে কল করার জন্য। নাজমুল সাহেব কলবেল বাজালেন। নাহ্, কেউ এলোনা। নাজমুল সাহেব শোয়ার ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন। মনটা বড় খারাপ লাগছে। তিনি পরম চা ভক্ত, তা নয়। তবে সকালে আর সন্ধ্যার নাশতার পরে এক কাপ চা খান। একটা টি ব্যাগ দিয়ে বানানো লিকার চা। সেটা দিতেও এদের মনে থাকেনা। আজ দিলো না, এর আগেও কয়েকবার দেয়নি। তারা নাকি ভুলে যায়!
নাজমুল সাহেবতো কারোর প্রতি দায়িত্ব পালন করতে ভুলে যান নি। সারাজীবন দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। বাসায়,অফিসে, দেশের বাড়িতে,সব জায়গায়। তাঁর কাছে দায়িত্ব মানে হলো দায়িত্ব। করতেই হবে। কোনো অজুহাত চলবেনা। তাই নিজের আরাম আয়েশ, শখ আহলাদের দিকে না তাকিয়ে শুধু কর্তব্য করে গেছেন। বেশি দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে নিশাতকেও বঞ্চিত করেছেন আর্থিক ভাবে। এই বাড়িটা তাঁর ও নিশাতের। সংসারের অনেক খরচ তাঁরা বহন করেন। কিন্তু নিজেকে ইদানিং খুব অবহেলিত মনে হয়। এই যে এরা তাঁকে চা দেওয়ার কথা প্রায় ভুলে যায়, আগে এটা কল্পনাও করা যেতো না। এর প্রধান কারণ ছিলো অবশ্য নিশাতের নিখুঁত ব্যবস্থাপনা। এছাড়া গৃহকর্মীরা তটস্থ থাকতো। তাঁর গাড়ি যখন অফিসের গেইট দিয়ে ঢুকতো, টপাটপ সবাই দাঁড়িয়ে যেয়ে সালাম দিতো। সারাক্ষণ কানের কাছে “স্যার,স্যার।” কাজের তীব্র চাপ। অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার জন্য নিজের মায়ের মৃত্যুকালে উপস্থিত থাকতে পারেননি। মা ঢাকাতে তাঁদের দু’ভাইয়ের বাসাতে থাকতেন, অনেকদিন যাবৎ খুব অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন, এরপরে জেদ ধরলেন গ্রামের বাড়ি যাবেন, সেখানেই তিনি মরতে চান। দুই ছেলের প্রচন্ড আপত্তি উপেক্ষা করে মা গ্রামে চলে গেলেন। ছেলেরা প্রায়ই চলে যেতেন মা’কে দেখতে। প্রায়ই। শেষের দিকে ঘন ঘন ছুটি নিতে হতো দুই ভাইকে। নাজমুল সাহেবের মায়ের এখন তখন অবস্থা, তবু নাজমুল সাহেবকে ঢাকায় ফিরতে হয়েছিলো অফিসের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য। সারারাত বাস জার্নি করে বাসায় এসে কোনোভাবে ফ্রেশ হয়ে অফিস চলে গেলেন, কাজের চাপে দম ফেলার সময় নেই এমন অবস্থা, আর ঠিক সেই সন্ধ্যাতেই শামসুন্নাহার চলে গেলেন। মায়ের মৃত্যু সংবাদ নাজমুল সাহেব অফিসে কর্মরত অবস্থায় পেলেন। বাকি যেটুকু কাজ ছিলো, বুকে পাথর বেঁধে সেগুলো শেষ করে বাসায় ফিরে নিশাতকে নিয়ে আবার দেশের বাড়ি রওনা।
সেই মানুষটার এখন নিজের বাড়িতে নিজেকেই অবাঞ্ছিত মনে হয়। সারাক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকেন। আপন মনে কি ভাবেন, কে জানে!
“চা খেয়েছো?”
নিশাতের কথায় ধ্যান ভাঙলো নাজমুল সাহেবের।
“না।”
“কেন? হানিফা চা দেয়নি না তুমি খাওনি? ”
“দেয়নি।”
রাগে নিশাতের শরীর জ্বলে গেলো। যে বয়সে ও শারীরিক অবস্থায় তাঁর আরাম করার কথা, সেখানে আরাম তো দূর, দুনিয়ার সব কিছু তাঁকে দেখতে হয়। বারবার হানিফাকে বলে রেখেছেন দাদার নাস্তা খাওয়ার সাথে সাথে চা দিবে,ভুল যেন না হয়, তা হানিফা বেগম প্রায় ভুল করে ফেলেন।
বাড়িতে মানুষ ছয়জন,গৃহকর্মী তিনজন, দু’জন বাঁধা, একজন ছুটা। কাজের কি এতো চাপ যে সব কথা শুধু ভুলে যায় এরা? নিশাত রান্নাঘরে যেয়ে হানিফাকে ধরলেন। কড়া গলায় বললেন,”মনে রেখো,আমাদের বাড়িতে তুমি আছো। আমি যদি ইচ্ছা করি, তোমাদের যে কাউকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি। অন্য জায়গায় কাজ কোরো। কিন্তু এই বাড়িতে থাকতে হলে আমার কথা মন দিয়ে শুনতে হবে,মনে রাখতে হবে।এমন ভুল যেনো আর না হয়। ”
আজ নোমান -তমা দু’জনেই বাসায় আছে। সন্ধ্যায় বাবা-মায়ের সাথে বসে একসাথে চা খেতে পারতো না? তমার কাছে নিশাতও কিছু আশা করা বাদ দিয়েছেন বহু আগে, কিন্তু নোমানের তো উচিৎ ছিলো সন্ধ্যায় বাপ-মা কি খেলো না খেলো, খেয়াল করা।
নোমান যথেষ্ট খেয়াল করে। বিপদে আপদে কথাই নেই। কিন্তু ছেলেটা সবসময় গুছিয়ে কাজ করতে পারে না। সময়ের কাজ সময়ে সারতে পারেনা বলে নোমানের কাজ জমতেই থাকে। নোমান-তমা দু’জনেই প্রাইভেট সেক্টরে উঁচু পদে আছে। কর্পোরেট জব। কিন্তু কর্পোরেট জব করা মানে এই না যে সংসারের দিকে ফিরেও তাকানো যাবেনা। নোমান যদিও কিছুটা সাংসারিক, তমা একেবারেই না। অফিসের কাজ ছাড়াও তমা বহির্মুখী। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। কোনো দাওয়াত, কোনো আনন্দানুষ্ঠান বাদ দেয় না। খুব ভালো কথা। নিশাত বৌমার এই স্পিরিট পছন্দ করেন,প্রশংসা করেন আবার এও ভাবেন,খুব বেশি ক্যারিয়ারিস্ট ছেলে বা মেয়ের বিয়ে করা উচিৎ না। ক্লান্তি ভরা শরীর নিয়ে সংসারের সব কিছু ম্যানেজ করতে হয় নিশাতকে। ওরা ভাবে, কাজের মানুষ আছে, তারাইতো সব কিছু করে। কিন্তু কাজের মানুষদের চালানোর যে কি জ্বালা,তা যে চালায়, সে ই জানে। তাদের রান্না শেখানো, পেছনে লেগে থেকে কাজগুলো করিয়ে নেওয়া, ফ্রিজে কি আছে কি নাই দেখা, বাজারের লিস্ট তৈরি করা, দুই নাতি ইরফান আর আয়মানের দিকে খেয়াল রাখা, শরীরে এখন কুলায়না নিশাতের। নাজমুল সাহেবকে তিন বেলা বেশ কিছু ওষুধ খেতে হয়,ইনসুলিন নিতে হয়। এক সময় যে ভদ্রলোক বড় বেশি আত্মনির্ভরশীল ছিলেন, এখন তিনি নিজের ওষুধ গুছিয়ে খেতে পারেন না। নিশাত তিন বেলা স্বামীর এই এত্তোগুলো ওষুধ গুছিয়ে দেন। কেন, ছুটির দুপুরে বা রাতে নোমান এই কাজটা করতে পারে না? তমার কাছে আশা করার প্রশ্নই উঠে না।
কখনো যদি এগুলো নিয়ে কথা ওঠে, নোমান বলে, “বাবা-মায়ের জন্য কি করার আছে? সবকিছুতে উনাদের না বলা অভ্যাস।সারাদিনের জন্য একজন সিস্টার রেখে দিতে চাচ্ছি, সেই সবকিছু দেখাশোনা করবে,তাতে দুজনেরই আপত্তি। ”
সত্যিই নাজমুল -নিশাত দু’জনেরই এতে আপত্তি। নার্স রাখার মতো সময় আল্লাহর রহমতে এখনো আসে নি। বাসা বড়, সন্দেহ নেই। কিন্তু বেডরুম তিনটা। ফ্যামিলি লিভিং স্পেস,ডাইনিং, ড্রইং। সারাদিন একটা বাইরের লোক কোথায় বসে থাকবে? তাকে তিন বেলা খাবারটাতো নিশাতকেই সাজিয়ে দিতে হবে। তাহলে এতো টাকা দিয়ে নার্স রাখার কি দরকার?
চলবে।