#সংসার
৮ম পর্ব
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
“আমাদের সোনার নূপুর কোথায় বাবা? ”
আসিফ রাজেশ্বরীর দিকে তাকালো। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক, কপালে বড় লাল টিপ, দুই গালে রুজ নামের কোনো বস্তু। একই সাজে পাশে জমজ বোনটিও দন্ডায়মান।
গতকাল হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। সাড়ে নয় বছর বয়সী তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া দুই বোনই একাধিক বিষয়ে ফেল করেছে। অংকটা কমন। অংক ছাড়াও রাজ সমাজে এবং লুম্বিনী বিজ্ঞানে ফেল করেছে। দুই বোনই নির্বিকার। বেচারি তিতির কি যত্ন এবং কষ্ট করেই না পড়ায় মেয়ে দুটো আর ছোটো ছেলে আরহাম ওরফে তুতুনকে। আগে বড় ছেলে বুবুনকেও পড়াতো। হাসপাতালে ডিউটি করে ছেলেমেয়ে পড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। তিতির পড়ায় খুব সুন্দর ও যত্ন করে। ওর পড়া বোঝানোর ক্ষমতা দেখে আসিফ প্রথম থেকেই মুগ্ধ। সমস্যা হলো,চারটা বাচ্চাই ফাঁকিবাজ। ফাঁকি দিলেও ছেলে দুটো পরীক্ষার আগে সামলে নেয়,ভালোই ফল করে, কিন্তু পেকে ঝুনো নারকেল হয়ে যাওয়া সাজুনি বুড়ি দুটো সামাল দিতে পারেনা, বলা ভালো,সামাল দেয়না। পরীক্ষায় পাশ-ফেল নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। আসিফ -তিতির কেউ বাচ্চাদের মার তো দিতেই পারে না, বকাও তেমন দেয়না।এই সুযোগের সদ্ব্যাবহার ভালো মতোই করছে চার ছেলেমেয়ে। তবে তিতির ছেলেমেয়েদের গল্পচ্ছলে অনেক বোঝায়, ভালো মানুষ হওয়ার গুরুত্ব, লেখাপড়ার গুরুত্ব, ভালো খাওয়া দাওয়ার গুরুত্ব। বোঝানোটাই সার।
তিতির আসিফের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়েদের সব আবদার মুহূর্তের মধ্যে পূরণ করে দেয় আসিফ, এজন্যই নাকি মেয়ে দুটোর ভয়াবহ হাল।
“কই বাবা,সোনার নূপুর কই?”
“তোমাদের তো অনেক নূপূর আছে।”
“সোনারটা নাই। সুমেহরার নূপুরের মতো নূপুর লাগবে।এক্ষুনি দোকানে চলো।”
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। কর্পোরেট হাসপাতালের নামী ডাক্তার আজ আগেভাগেই বাড়ি ফিরেছে। শরীরটা জুতের ঠেকছে না। তিতির নীরবে চা -পথ্য যুগিয়ে ছোটো ছেলের ঘরে শুয়ে আছে।
“রাজ,লুম্বিনী, এবারে তোমাদের রেজাল্ট এতো খারাপ কেন হলো?”
বিষ্ময়ের সাথে রাজেশ্বরী বললো,”আমরা তো সবসময়ই খারাপ রেজাল্ট করি।আমাদের পড়তে ভালো লাগেনা। বড় হলে আমরা সিনেমার নায়িকা হবো। তাই পড়াশোনার দরকার নেই। ”
আসিফ জীবনে এই প্রথম কষে এক চড় লাগালো রাজের গালে। এমন ঘটনা এই বাড়িতে রেয়ার। আর রাজ-লুম্বিনীকে তো ফুলের টোকাও দেয়নি বাপ -মা।
হতভম্ব রাজ কাঁদতেও ভুলে গেলো। লুম্বিনী বড় বড় চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আসিফ কড়া গলায় বললো,”আর একটা জিনিসও কিনে দিবো না তোমাদের দুইজনকে। তোমরা খুবই পচা। সাজগোজ সব বন্ধ। লেখাপড়ায় ফাঁকি দিলে এবারে লাঠি দিয়ে মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেবো।”
চেঁচামেচি শুনে তিতির, বুবুন,তুতুন ছুটে এসেছে। তিতির কিছু বললো না। বুবুন ভয়ে ভয়ে এসে রাজকে জড়িয়ে ধরলো। বুবুন-তুতুন মারাত্মক ভয় পায় বাপকে। বোন দুটো হাড় জ্বালানো দুষ্ট আর কুটনি বুড়ি হলেও ভাইবোনদের জন্য বুবুনের অগাধ ভালোবাসা।বড় ভাই বলে কথা। সে বোনদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে চাইলো।
রাজেশ্বরী তার রাগ ঝাড়লো নিরপরাধ বড় ভাইয়ের উপরে। বুবুনের পায়ে সে একটা লাথি লাগালো। এবারে আসিফ থাপ্পড় লাগালো কয়েকটা। লুম্বিনী ছুটে পালিয়ে গেলো। সাথে তুতুনও। তিতির আর বুবুন রাজেশ্বরীকে উদ্ধার করলো। সে তখন রাগে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। বুবুনের কোলে বসে সমানে তাকেই চড় থাপ্পড় দিচ্ছে। তিতির খুব জোরে মেয়েকে ধমক লাগালো। মার খেতে খেতেই বুবুন রাজকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে যেয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলো।
টানা দুই ঘন্টা চললো চিৎকার করে কান্না। রাতে খেলো না আসিফ, তিতির আর রাজ।।তিতির ভাত মাখিয়ে নিয়ে এসেছিলো। মেয়ে ভাতের থালা ফেলে দিয়ে মায়ের হাতে আবার পিটানি খেলো।
রাতে তুতুন বড় ভাইয়ের কাছে ঘুমাতে যায়। আজ ওখানে রাজ আছে। তিতির এসে তুতুনের খাটে শোয়ার পরে তুতুনের জানে পানি এলো। লুম্বিনী আজ একা খাটে। ময়না খালা নিজের থেকেই ওর ঘরের মেঝেতে শুয়েছেন।
অসম্ভব মন খারাপ লাগছে তিতিরের। মেয়ে দুটো লেখাপড়ায় ডাব্বা মারুক,সওয়া যায়, কিন্তু এমন জেদি,বেয়াদব হলো কেমন করে? এমনিতে নম্র-ভদ্র, আর সব শিশুদের মতো উচ্ছ্বল, কিন্তু আবদার পূরণে দেরি হলেই কান্নাকাটি, হৈচৈ, মেঝেতে গড়াগড়ি। আর চাওয়ার কোনো শেষ নেই ওদের। ফ্রক, সালোয়ার কামিজ, স্কার্ট, নিত্যনতুন নাইট ড্রেস, জুতা,স্যান্ডেল, সাজুগুজুর জিনিস, চকোলেট, রেস্টুরেন্টে যেয়ে খাওয়া। বায়নার সীমা নেই। এমন হলো কেন এরা? আসিফের মাত্রাতিরিক্ত আদরই কি একমাত্র কারণ?
ভোর রাতে বুবুন এসে জানালো, রাজের জ্বর এসেছে। একশো’র একটু কম। তিতির নড়লো না। বুবুনকে বললো,”অতো চিল্লালে জ্বর তো আসবেই।তার ওপর মারধোর তো ভালোই খেয়েছে। ভয়ের কোনো কারণ নেই। তুমি কি সারা রাত জেগে আছো? বুবুন,আর কতো জ্বালাবে তোমরা আমাকে? আমার পাশে শুয়ে ঘুমাও। আর তোমার বোনকে তাদের ঘরে দিয়ে আসো।”
বুবুন চলে গেলো বোনের কাছে। মায়ের কথা শুনলো না।
“এই ভাইয়া, আমার মাথায় অনেক ব্যথা।”
“ব্যথা তো হবেই। এতো কাঁদলে ব্যথা হবে না? ”
” আমি এই বাসায় আর থাকবো না। বাবা পচা,মা পচা।”
“বাবা-মা পচা না। উনারা আমাদের অনেক ভালোবাসেন।তোমাকেও। কিন্তু তুমি আর লুম্বিনী কথা শোনো না কেন? ”
“শীত লাগছে। গায়ে আরেকটা কাঁথা দিয়ে দাও।”
জ্বর বেড়েছে। ফজরের নামাজ পড়ে তিতির বেশ কিছুক্ষণ দোয়া দরুদ পড়ে,কোরান শরীফ পড়ে। আসিফ নামাজ পড়ে বাইরে হাঁটতে যায়।
বাবা বাসায় ফিরলে বুবুন আসিফকে রাজের জ্বরের কথা বললো। মেয়ের কপালে হাত রেখে আসিফ দেখলো বেশ জ্বর। মার খাওয়ার জন্য দুঃখে আর রাগে জ্বর এসেছে।
তিতির এসে ঠান্ডা গলায় রাজকে বললো,” দয়া করে উঠে এই রুটিটা খেয়ে নাও। তারপরে নাপা খেতে হবে।”
রাজ উত্তর দিলো না,উঠলোও না। পাশ ফিরে শুয়েছিলো,ওই ভাবেই পড়ে রইলো।
“রাজ, ওঠো। রুটি খাও।”
” খাবো না। বমি লাগছে।”
রাজ অল্প বমি করলো। গত সন্ধ্যায় নুডুলস খেয়েছিলো একটু,তারপর তো পেটে কিছুই পড়ে নি।
জ্বর বাড়ছে। তিতির সাপোজিটরি দিলো, মাথা ধুয়ে শরীর স্পন্জ করে দিলো,কাপড় পাল্টে দিলো, জ্বর সামান্য কমলো কিছুক্ষণের জন্য। তারপর বাড়তে শুরু করলো অস্বাভাবিক ভাবে, সেই সাথে বমি। পেটে কিছু নেই কিন্তু তীব্র বমি ভাব। মাথায় খুব ব্যথা।
“রাজ, ময়না পাখি,তাকাও। এই স্যুপটা একটু মুখে দাও। ”
রাজেশ্বরী ঘোলা চোখে তাকায়। হঠাৎ এই অবস্থা হলো কেন?
তিতিরের মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। সে আসিফকে বললো,” হসপিটালে নিয়ে যাই, চলো।”
আসিফেরও ভয় হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলো মার খেয়ে রাগে ক্ষোভে রাজের জ্বর এসেছে। কিন্তু এখন কেমন যেন লাগছে। তিনদিন আগে মেয়ে বলছিলো, মাথা ব্যথা খুব । তা লেখাপড়ার সময় উনাদের মাথাব্যথা, পেট ব্যথা লেগেই থাকে। তিতির পাত্তা না দিয়ে পড়াচ্ছিলো। রাজ বলেছিলো,”আজ সত্যি মাথা ব্যথা করছে।অনেক। সত্যি মা,সত্যি। “হতাশ তিতির বাধ্য হয়ে পড়ানো বন্ধ করেছিলো। তারপর থেকে তো ভালোই ছিলো মেয়ে,তবে কিছুই খেতে চাচ্ছিলো না, তার অতি পছন্দের চাইনিজ আইটেমও না।
বিকালে রাজেশ্বরীকে হাসপাতালে ভর্তি করলো আসিফ -তিতির। রাজের অসুস্থতার খবর শুনে দুপুরেই চলে এসেছিলেন নাজমুল -নিশাত। তাঁরা থেকে গেলেন তিতিরের বাকি তিন ছেলেমেয়েকে দেখাশোনার জন্য। রাজ ঘোরের মধ্যে ছিলো। নানা-নানি, দুই ভাই আর জমজের কাছ থেকে সে বিদায় নিতে পারলো না। বিদায় নিলো না তার মেন্টর ময়না খালা আর আমেনা বুবুর কাছ থেকেও।
দুই ডাক্তারের মেয়ে। আসিফ যে হাসপাতালে কাজ করে,সেখানেই রাজ ভর্তি। তাই ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেলো। ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, এক্স রে, মাথার সিটি স্ক্যান, কিছুই বাদ গেলো না। গতকাল এই সময়েই রাজ মার খেয়ে নানা রকম পাগলামি করছিলো।
রাত দুইটার দিকে রাজ শকে চলে গেলো। আসিফের বারবার মনে হচ্ছিল , ছুটে যেয়ে দুই মেয়ের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সোনার নূপুর কিনে আনে। সর্বোচ্চ চিকিৎসা হলো। পাঁচ দিনের মাথায় রাজকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলো। দশ দিনের মাথায় ডেঙ্গুতে অচেতন অবস্হাতেই অচেনা এক পৃথিবীতে চলে গেলো রাজ, আসিফ-তিতিরের রাজেশ্বরী। প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, এরপরে সারাক্ষণ টরটর করে কথা বলা রাজেশ্বরী আর কোনো কথা বলেনি। অনুশোচনা ও যন্ত্রণার ভারে নুয়ে পড়া বাবা-মা’কে একবারও চোখ মেলে দেখেনি।
স্তব্ধ হয়ে যাওয়া তিতির যখন মৃত মেয়েকে টিপ,লিপস্টিক, আই লাইনার, ফেস পাউডার,রুজ, রাজের সবচেয়ে পছন্দের পোশাক, নেইল পলিশ, গলার হার, দুই হাত ভরা চূড়ি, ছোট্ট দুটি পায়ে নূপুর পরিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে মেয়েকে সাজাচ্ছিলো, কারোর সাহস হয় নি বাধা দেওয়ার। কি সুন্দর লাগছিলো রাজকে। একটা ছোট্ট পরী ঘুমিয়ে আছে যেন।
তিতিরকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে সাজুনি বুড়ির সব সাজ খুলে ফেলা হলো, রিম্যুভার দিয়ে নেইল পলিশ উঠানো হলো, টিপ লিপস্টিক, আইলাইনার, মেক আপের সব চিহ্ন মুছে ফেলা হলো, গোসল করার সময় প্রতিদিন ভীষণ ঝামেলা করতো রাজ, এখন করলোনা।গোসলের সময় নিথর শুয়ে রইলো ক্লান্ত শান্ত মুখে, তারপরে সাদা কাপড় পরে চলে গেলো। যার সাথে মিলেমিশে মায়ের জঠরে সে বেড়ে উঠেছিলো, সেই লুম্বিনীকে নিঃসঙ্গ করে জোড়া ভেঙে নিষ্ঠুর ভাবে চলে গেলো রাজেশ্বরী। মায়ের বারবার মূর্ছা যাওয়া, বাবার পাগলের মতো আচরণ, বড় ভাইয়ের আকাশ পাতাল বিদীর্ণ করা কান্না, ছোট্ট তুতুনের কান্নাভেজা অবুঝ চেহারা, নানা-নানি – মামা -খালা-চাচা-ফুপুদের হাহাকার,আহাজারি কোনো কিছুই স্পর্শ করলো না আদুরে আর ভয়ংকর জেদি মেয়েটাকে।
চলবে।