#সংসার
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-১৪
রূপায়ন মাকে নিয়ে ঢাকা হৃদরোগ হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছে। ভেবেছিল একটু রাত হলেও চলে আসতে পারবে। কিন্তু এত দেরিতে ডাক্তার এসেছে। দেখাতে দেখাতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। এদিকে নন্দিতাদেবীর শরীরটা খুব দূর্বল। মাকে নিয়ে এতরাতে ঘণ্টাদুই জার্নি করে বাড়ি যাওয়ার সাহস পেল না।
রাতটা কোনমতে ছোট পিসির ফ্ল্যাটে থেকে যেতে বাধ্য হলো।
এইদিকে রূপায়ন মাকে নিয়ে বাড়ি থেকে ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে বের হতেই নিপা ফোন করে দুই বোনকে বাড়িতে ডেকে নিল। সৌরভকেও এক ফাঁকে ফোন দিয়ে বলল,
-‘বড়দাভাই, মা কেউ বাড়ি নেই। আজই সুযোগ। যা করার আজকের ভেতর করতে হবে।
রূপায়ন মাত্র ফোন দিয়ে জানাল৷ রাতে বাড়ি ফিরবে না। অনুপনার মনটা একটু খারাপ হলো বৈকি। তবে প্রকাশ করল না। মৃদু হেসে বলল,
-‘আগামীকাল সকাল সকাল বাড়ি চলে এসো। তোমাদের ছাড়া ভাল লাগে না।
নিপা দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
-‘শুধু বড়দাভাইয়ের সাথে ফোনে প্রেমালাপ করলেই হবে বৌদি? রাতের রান্নাটাও তো সারতে হবে৷
-‘ওরা আসবে না আজ। ছোট পিসির বাসায় থাকবে!
নিপা উত্তেজিত হয়ে বলল,
-‘সত্যিইইই…?
-‘হ্যাঁ।
নিপা উচ্ছ্বাস নিয়ে চলে গেল। অনুপমাও ফোন রেখে রান্নাঘরে চলে গেল। এতগুলো মানুষ বাড়িতে। অথচ কেউ ভুলেও রান্নার কাজে হেল্প করে না। সীমাটা আগে টুকিটাকি যা একটু করতো! এখন তো খাওয়ার সময় ছাড়া রুমের বাইরে বের হয় না। মায়ের শরীর ভাল থাকলে, টুকটুক করে সবজি, মাছ কেটেবেছে দেয়। তবে ননদরা ভুলেও একটা কাজে হাত লাগায় না। শুধু অর্ডার করে এটা খাব, ওটা খাব।
অনুপমা চাল ধুয়ে ভাত বসাতেই তিন ননদ রান্নাঘরে ডাইনিংয়ে এসে বসল।
দিপা, অনুপমাকে শুনিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,
-‘বড়দাভাইয়ের কপাটাই খারাপ। না পেল শ্বশুরবাড়ি আর না পেল কোন যৌতুক।
রুপা বলল,
-‘এই মেয়ের রান্নাটাও খুব একটা সুস্বাদু হয় না। কোনরকমে খাওয়া চলে। আর না কোন কাজ গুছিয়ে করতে পারে। শুধু রূপ দিয়েই বড়দাভাইকে কাবু করেছে।
-‘শুধু বড়দাভাই না কী! আর কাকে কাকে রূপ, যৌবন দিয়ে কাবু করেছে কে জানে!
পাশ থেকে নিপা বলল,
-‘তা বড়দাভাই তোমার খোঁজ পেল কীভাবে? সত্যি করে বলো তো বৌদি?’
মেইন দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। নিপা দরজা খুলে দিয়ে, বোনদের ইশারায় দেখাল, ‘এসে গেছে!’
সৌরভের সাথে দিবাকে দেখে, অনুপমার আতঙ্কে, ভয়ে, অন্তঃআত্মা কেঁপে উঠল। ছেলেটা অনুপমাকে দেখেই ছুটে এলো। আচমকা অনুপমার হাতদুটো চেপে ধরে বলল,
-‘এই অনুপমা তুমি এখানে কী করছো? তোমায় কত খুঁজেছি, জানো?
অনুপমা ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেল। মনপ্রাণে ঠাকুরকে ডাকছে। দিবা আর একটু এগিয়ে এলো। সামান্য ঝুঁকে অনুপমার সিঁথির দিকে জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে তাকাল। উন্মাদের মতো চিৎকার করে বলল,
-‘তুমি কার নামে সিঁদুর পরেছো অনুপমা? আমি তোমায় পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি। আর তুমি এখানে এসে ফূর্তি করছো?
নিপা বলল,
-‘বৌদিকে কীভাবে চিনেন দিবাদাদা?
-‘আরে রাখো তোমার বৌদি৷ অনুপমা শুধুই আমার হতে হতে না হওয়া বউ। তোমার দাদার অনেক আগেই ওর মোমের মতো নরম শরীর আমি ছুঁয়ে দিয়েছি৷ কী অস্বীকার করতে পারবে অনুপমা?
অনুপমা শুকনো ঢোক গিলল। সবাই কেমন ঘৃণাভরে অনুপমার দিকে তাকিয়ে আছে। অতিরিক্ত লজ্জায় ইচ্ছে করছে মাটির সাথে মিশে যেতে।
দিপা বলল,
-‘আমরাও তো বলি, এত সুন্দর মেয়েটা কী শুধু শুধু আমার বয়স্ক বড়দাভাইয়ের বউ হয়ে আসবে? চরিত্রের দোষ আছে দেখেই অল্প বয়সে বুড়ো নাগর ধরেছে। তা আপনাদের মাঝে ঠিক কী কী হয়েছিল, দিবা?
দিবা বিরক্ত হলো। বলল,
-‘আপনাকে বলব না কী? পাশাপাশি বাড়ির উঠতি ছেলেমেয়েদের ভেতর গভীর প্রেম হলে, ঠিক কী কী হয়, সম্পর্ক কতটা গভীর হয়। তা আপনারাই অনুমান করে নিন।
অনুপমার চোখ ফেটে নোনাজল জড়িয়ে পরছে। ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘এসব কী আবোলতাবোল বলছেন? আপনার লজ্জা লাগছে না। মিথ্যেকথা গুলো বানিয়ে বলতে?
-‘তুমি খুব ভাল করেই জানো অনুপমা? আমি একটাও মিথ্যে কথা বলিনি।
নিপা বলল,
-‘ছিঃ ছিঃ বৌদি তুমি এতটা নোংরা মানসিকতার? আমার বড়দাভাইকে এভাবে ঠকাতে পারলে?
-‘কে কাকে ঠকিয়েছে, সেইটা পরে দেখা যাবে! আগে তোরা বল, রূপায়নের অগোচরে এ কাকে বৌদির প্রেমিক বানিয়ে ,ধরে এনেছিস তোরা?
গোবিন্দ দরজায় দাঁড়িয়ে কথাটা বলতে বলতে ঘরে এলো। রূম্পাও গোবিন্দর পিছুপিছু এসে অনুপমার পাশে দাঁড়াল। গোবিন্দ, দিবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-‘আবার বল? বৌদির সাথে তোর ঠিক কী কী হয়েছে? প্রথম থেকে বল? আমরাও একটু শুনি?
দিবা দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। অনুপমা টাকার লোভে আমাকে রিজেক্ট করে, বড়ঘরের ছেলেকে ফুসলিয়ে বিয়ে করেছে।
গোবিন্দ, দিবার শার্টের কলার চেপে ধরল। বলল,
-‘তুই সেই বখাটে ছেলেটা না? গ্রামের মেয়েদের রাস্তাঘাটে বিরক্ত করিস। ওড়না টেনে ধরিস, সুযোগ পেলে জাপ্টে ধরিস। বৌদিকে তো তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করার হুমকিও দিয়েছিলি। ভাগ্যিস সেবার ডাকাতি কেইসে ফেঁসে তোর ছয়মাসের জেল হয়েছিল। তা এতদিন পর বৌদির খোঁজ পেলি কীভাবে?
সৌরভ শুকনো ঢোক গিলল। দিবা অস্থির হয়ে সৌরভকে বলল,
-‘আপনিই বলেছিলেন। এখানে এলে আমার অনুপমাকে নিয়ে যেতে পারব। এখন এত কথা ইচ্ছে কেন?
গোবিন্দ তীব্র কণ্ঠে বলল,
-‘ তুমি এই কাজটা কেন করেছো সৌরভ? রূপায়ন জানতে পারলে তোমার কী হাল করবে, একবার ভেবে দেখেছো? এই রকম একটা নেশাখোর ছেলেকে কোন সাহসে এই বাড়িতে ধরে এনেছো? বলো..?
রুপা বলল,
-‘সে কথার উত্তর তোমাকে দিতে হবে না কী গোবিন্দদা? তুমি এতরাতে এই বাড়িতে কেন এসেছো?
-‘না এলে তো তোমাদের আসল রূপটা ধরতেই পারতাম না। তোমরা নীচে নামতে নামতে কতটা নীচে নেমে গেছো! ছিঃ…
রূপায়ন শুধু নিজের রক্তজল করা টাকাই তোমাদের পেছনে ঢেলেছে। একটাকেও মানুষ বানাতে পারেনি।
দিপা বলল,
-‘এই..এই একদম মুখ সামলে কথা বলো! বৌদির জন্য তোমার এত দরদ উথলে উঠছে কেন? না কী তোমার সাথেও বৌদির কিছু-মিছু আছে?
-‘রূপায়ন শুনতে পাচ্ছিস? তোর ভাইবোনগুলো নামতে নামতে কতটা নীচে নেমে গেছে শুনেছিস? রাতদুপুরে তোর বউকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য কতবড় ষড়যন্ত্র করেছে সবাই মিলে! এই ভাইবোনদের কথা ভেবে তুই নিজের যৌবন, বিসর্জন দিয়েছিলি রূপায়ন? আরেহ্.. এই অমানুষ গুলো তুই বুড়ো হলে, তোকে বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতেও দুবার ভাববে না। এখনো সময় আছে বন্ধু। বৌদিকে নিয়ে যদি সুখে-শান্তিতে সংসার করার ইচ্ছে থাকে। তাহলে..
আর কিছু বলতে পারল না গোবিন্দ। ফোনের ওপাশে রূপায়নের অতিরিক্ত রাগে, দুঃখে দিশেহারা লাগছে। এই ভাইবোন গুলোর জন্য রূপায়ন কী করেনি? তারপরও রূপায়নের সুখ কেড়ে নেওয়ার জন্য একেকটা কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভাগ্যিস রূপায়ন রাতে বাড়ি ফিরতে পারবে না শুনে গোবিন্দ নিজ তাগিদে ওদের বাড়িতে এসেছিল। নাহলে যে আজ কী হতো! ভাবতেই রূপায়নের বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল। এই বন্ধ ঘরে একটুও মন টিকছে না। ইচ্ছে করছে একছুটে গিয়ে অনুপমাকে খুব যত্ন করে বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলতে।
রূপায়ন এতদিন অনুপমার অনুরোধে চুপ ছিল। এখন থেকে আর চুপ করে থাকবে না রূপায়ন। কার জায়গা কোথায়! খুব ভাল করেই বুঝিয়ে দিবে রূপায়ন। তার আগে সবাইকে কঠিন শিক্ষা দিতে হবে। ‘যোগ্যতার থেকেও বেশিকিছু পেয়ে গেলে, মানুষগুলো অমানুষ হয়ে যায়।’
রূম্পা, অনুপমাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। সবাই বেশ ঘাবড়ে গেছে। সত্যিই আজ একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। বড়দাভাই বাড়িতে এসে যে কী তাণ্ডব ঘটাবে। কে জানে!
গভীর রাত। অনুপমা এখনো ফুলে ফুলে শব্দহীন কাঁদছে। রূপায়ন ফোনের ওপাশে মরিয়া হয়ে বলল,
-‘কথা বলবে না লক্ষ্মীটি?
-‘(নিশ্চুপ)
-‘আমি তোমায় কথা দিলাম অনুপমা। এরপর থেকে যেখানেই যাব। সবসময় তোমায় সাথে নিয়ে যাব।
সারাটা রাত রূপায়ন কতকথা বলে গেল। অনুপমা ভুলেও একটা কথা বলল না। শুধু ফোনটা কানে চেপে ধরে, নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগল।
কাক ডাকা ভোরে, রূপায়ন মাকে নিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছাল। তারপর চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগল। সবাই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। ছুটে এলো বসার ঘরে। রূপায়ন হীম শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘অনুপমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে কার কী লাভ? বল? সবাই এক এক করে উত্তর দিবি?
এই নিপা তুই আগে বল? তোর মুখের ভাত কেড়ে খায় অনুপমা? দিপা তুই বল? তুই বেড়াতে এলে তোকে রেঁধেবেড়ে খাওয়ায় না আমার বউ? না আমি বাজার করি না? রুপা বল? তোরা বাপের বাড়ি থাকলে কী আমার বউ তোদের সাথে ঝগড়া করে? আর অরুপ? আমি বিয়ে করায় কী তোর খরচ বেড়ে গেছে? এখন কথা বলছিস না কেন তোরা? উত্তর দে?
শেষের কথাটা রূপায়ন এত জোরে বলল,
সবাই ভয় পেয়ে কেঁপে উঠল। রূপায়ন দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল। খানিকক্ষণ কী যে ভেবে বলল,
-‘অনুপমা?
অনুপমা দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। ভেজা চোখদুটো তুলে তাকাল। রূপায়ন ঘন ঘন শ্বাস ফেলে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
-‘আমার বউকে নিয়ে সবার সমস্যা তো? বেশ তোরাই থাক। আমিই আমার বউ নিয়ে চলে যাচ্ছি। অনুপমা ব্যাগ গুছিয়ে নাও যাও?
নন্দিতাদেবী আজ আর বড়ছেলেকে আটকাল না। রূপায়ন মাসখানেক বউ নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসুক। তিনিও দেখে নিবেন। কে এত বড় সংসারের ঘানি টানে! বাড়াবাড়ির ফল কখনো ভাল হয় না। এবার সবারই যদি একটু শিক্ষে হয়।
রূপায়ন, অনুপমার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। ঘরের ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে, অনেকক্ষণ অনুপমাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রইল। এভাবে কতক্ষণ কাটলো, কে জানে!
অনুপমা আস্তে করে বলল,
-‘ছাড়ো?
রূপায়ন আর একটু শক্ত করে চেপে ধরল। জেদী কণ্ঠে বলল,
-‘ছাড়ব না।
-‘ব্যথা পাচ্ছি।
রূপায়ন, অনুপমার কোমল হাতটা নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে বলল,
-‘তুমিও কাল সারারাত আমার সাথে একটাও কথা বলোনি। আমিও এখানে..খুব ব্যথা পেয়েছি।
অনুপমা ভেজা কণ্ঠে বলল,
-‘গোবিন্দদা কালরাতে না এলে! কী হতো? একবারও ভেবে দেখেছো?
-‘সেকথা ভাবলে এখনো আমার বুক ধড়ফড় করে অনুপমা। এই আটমাসে তুমি আমার কতটা জুড়ে বিচরণ করছো। তা বোধহয় তুমি নিজেও জানো না অনুপমা! তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবলেও আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমার শেষ বিকালে তুমি এসে, রংধনুর সাত রঙে রাঙালে। এখন তুমি বিহীন রঙহীন জীবন আমি ভাবতেও পারি না।
দুপুরবেলা, ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে, অনুপমার হাত ধরে, বাড়ি ছেড়ে চলে গেল রূপায়ন। সবাই চেয়ে চেয়ে দেখল। কেউ কিছু বলার বা আটকানোর সাহস পেল না। শুধু নন্দিতাদেবী আঁচলে মুখ গুঁজে অঝরে কাঁদতে লাগল। রূপায়ন মাকে বলেছিল,
-‘যাবে আমার সাথে?
সে তার স্বামীর ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে রাজি হলো না। অগত্যা রূপায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু অনুপমাকে সাথে নিয়ে চলে গেল।
বিকালে অফিস ছুটির পর অরুপ বাড়িতে এসে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল। সবাইকে উদ্দেশ্য করে, মাকে বলল,
-‘বড়দাভাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে মানে কী মা? এতবড় সংসার এখন চলবে কীভাবে?
(চলবে)