#সংসার
ধারাবাহিক গল্প
পর্ব ১৫
নাহিদ ফারজানা সোমা
এমন ভয়াবহ বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা , পরিবারের সদস্যদের এতো কঠিন টানপোড়েনের মধ্যে বুবুন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বিষ্ময়কর ভালো ফলাফল করলো। কখন বুবুন প্রিপারেশন নিলো, কখন পরীক্ষাগুলো দিলো, ভালো করে কেউ খেয়ালই করেনি আদনান আর ইরফান ছাড়া। খালু হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও বুবুনের পড়ালেখার খবর নিতো, উৎসাহ দিতো, এমনকি বুবুন যে দুই একটা কোচিং-এ পড়তো, সেখানে যেয়েও মাঝেমধ্যে খবর নিতো আদনান। কলেজের টিচারের সাথেও যোগাযোগ করতো। কারণ বুবুনের বাবা,মা, নানা,নানি,মামা,খালা একের পর এক দূর্বিষহ অবস্থার সামাল দিতে দিতে হতক্লান্ত। বুবুনসহ সবার বেঁচে বর্তে থাকাটাই সবার কাছে মুখ্য। ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিয়েছে বুঝদার বাপ মায়েরা। সন্তানের জন্য ওঁত পেতে আছে বিপদ। কতো পদের অসুখ, অ্যাকসিডেন্ট, মারামারি, গোলাগুলি, নষ্ট রাজনীতি, অপবিত্র শিক্ষাঙ্গন, মাদক, কতো প্রলোভন। বাংলাদেশের বুদ্ধিমান বাবা মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে আর স্বপ্ন দেখেনা। তারা বেঁচে থাকলেই আল্লাহর দরবারে হাজার কোটি শুকরিয়া। তারপরও বুবুনের রেজাল্টে বহুদিন পরে আনন্দের আলোড়ন উঠলো পরিবারটিতে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ,বায়োলজি সবটাতেই ফুল মার্কস পাওয়া কম কথা নয়৷ ইংরেজিতে চার নম্বর আর বাংলায় নয় নম্বরের জন্য পূর্ণ নম্বর পায়নি বুবুন। তথ্য প্রযুক্তিতেও শতভাগ নম্বর।
আসিফ আনন্দে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। নাজমুল সাহেব -নিশাত এই দৃশ্য দেখে চোখ মুছলেন। কতো শুকিয়ে গেছে তাঁদের আদরের বড় জামাই, আর বুবুনটাতো কঙ্কাল হয়ে গেছে। তিতির অনেকগুলো চুমা খেলো ছেলেকে। স্বাভাবিক জীবন থাকলে বুবুন এই বয়সে কিছুতেই মা’কে চুমু খেতে দিতো না, কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। মা-ছেলে দু’জনেই দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো অনেক। সবাই মহাখুশি। তবে নোমানের বড় ছেলে ইরফানের আনন্দ দেখার মতো। মনে হচ্ছে সে-ই যেনো এই রেজাল্ট করেছে। আসলেও ইরফানের অবদান কম নয়। সবসময় সে বড় ভাইকে সাপোর্ট দিয়ে এসেছে, বুবুনের পরীক্ষার সময় সে ভাইয়ের সাথেই দিনরাত কাটিয়েছে, নানারকম জোকস বলে হাসিয়েছে,গভীর রাতে চা বানিয়ে দিয়েছে, পরীক্ষার দিন সকালে ভাইয়ের ফাইল গুছিয়ে দিয়েছে, জামাকাপড় আয়রন করে দিয়েছে।
ভাইয়াকে নিয়ে এতো মাতামাতি তুতুনের খুব একটা পছন্দ হচ্ছে না। বড় ভাইয়াকে সে খুবই ভালোবাসে। ভাইয়া ভালো রেজাল্ট করেছে,ভালো কথা। তুতুনও কি এমন দুর্দান্ত রেজাল্ট করেনি? প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রমোশনের সময় কে থার্ড হয়েছিলো? কে অংকে নিরানব্বই পেয়েছিলো? ক্লাস টু থেকে থ্রীতে ওঠার সময়ও কি তুতুন ফিফথ হয়নি? এই হাফ ইয়ারলিতে অংকে নব্বই, ইংরেজিতে আটাশি পেয়েছে আরহাম সাহেব ওরফে তুতুন। সেটা নিয়ে এতো মাতামাতি হলোনা তো? তুতুনের একটা ব্যাপারই ভালো লাগছে, হিংসাও লাগছে কিছুটা,বাবা আজ রাতে সবাইকে র্যাডিসনে খেতে নিয়ে যাবে। আরও একটা ব্যাপার খুবই ভালো লাগছে, বাবা-মা – নানাভাই -বুবু সবাই আজ আগের মতো হাসছে, কলকল করে কথা বলছে। বহুদিন এই দৃশ্য দেখেনি তুতুন সোনা।
আজ রাতে সবাই থাকবে এই বাসায়। এটাও খুব আনন্দদায়ক।
রাত দেড়টাতেও কারোর ঘুম নাই। জমানো গল্পের বিশাল ভাণ্ডার। শুধু লুম্বিনী ঘুমিয়ে পড়েছে তিতিরদের ঘরে। ময়না খালা পাহারায় আছেন। লো ভলিউম দিয়ে টিভি দেখছেন।
তিতলী হঠাৎ বললো, ” একটা কথা তোমাদের বলা হয়নি। আমি আরিয়ান, লুম্বিনী, অরণ্য, অরণী এই চারটা নাম চেঞ্জ করতে চাই।বিষয়টা কিছুই না, তবু মন খুঁতখুঁত করে। সবাই বলে মুসলিম নাম রাখার জন্য। ”
নোমান বললো,”কে কে বলে, নামের লিষ্ট দে।”
“অনেকেই বলে। আমাদের তিন ভাইবোনের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলে। অরণ্যের স্কুলের ভাবিরা বলেন। ”
তমা হাসতে হাসতে বললো,” আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা,তুমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। ”
তিতলী দপ করে জ্বলে উঠলো, ” আমি ইঞ্জিনিয়ার, সেটা আমি ভুলে গেছি।তোমরাও ভুলে যাও। আমার কাজ এখন হাঁড়ি ঠেলা, ঘর পরিস্কার করা, বাচ্চা সামলানো। সেই বাচ্চাদের ক্ষতি তো হতে দিতে পারিনা। ইঞ্জিনিয়ার আমি নই, আমি হলাম ইঞ্জিনিয়ারের বৌ। ”
তমা দমবার পাত্রী নয়। সে বললো, ” তোমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়তে বলেছে কে? দুই বোনই ডাক্তারি -ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে হাত -পা গুটিয়ে ঘরে বসে আছো কেন?”
“কারণ আমাদের দুই বোনের তোমার মতো শ্বশুর শাশুড়ি নেই যে ছেলেপেলে মানুষ করে দিবে, তাদের খেয়াল রাখবে, বাসায় ফিরে বেড়ে রাখা খাবার পাবে। তুমি বাসায় থাকা আর না থাকা সমান। তুমি আরামসে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারছো,অফিস আদালত করতে পারছো, হিল্লিদিল্লি ঘুরতে পারছো আমার বাপ মা’র জন্য। অবশ্য তুমি যেমন, বাবা-মা না থাকলেও তুমি আয়াদের হাতে দুধের বাচ্চা ফেলে,বুয়াদের হাতে সংসার ছেড়ে দিব্যি দিনের পর দিন বাইরে থাকতে পারো। স্বামী বা বাচ্চাদের কি হলো না হলো, এগুলো নিয়ে তোমার মাথাব্যথা নেই। আমরা যে তোমার মতো এতো আদর্শ নারী না।”
তিতলী ক্ষেপেছে আজ। সবাই ঝগড়া থামাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। তমা কঠিন গলায় বললো,” যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। ”
“দেখাও এমন একজনকে। তুমি নিজের উদাহরণ আবার দিতে যেওনা। তুমি চুল বাঁধতে পারো, খুব ভালো, তা বলবো না, তবে রাঁধতে পারোনা মোটেই। ”
নাজমুল সাহেব বিষ্মিত গলায় মেয়েকে বললেন, ” তমা একদমই রাঁধতে পারে না, তাতো নয়। চাইনিজ ভেজিটেবল আর ফ্রায়েড রাইস পারে। ডিম মামলেট পারে।”
আদনান গলা পরিস্কার করে বললো,” আব্বা, এটা প্রতীকী কথা। তিতলী বুঝাতে চাচ্ছে ভাবি অফিস আদালত করে, কিছুটা বহির্মুখী। কিন্তু ঘরে-বাইরে সব কাজ একা সামলাতে পারে, এমন নয়। আমিও বলি,ভাবি ইনডাসট্রিয়াস, তবে ওনলি নিজের কাজে,নিজের ব্যাপারে। তিতলি বা আপা এখন জব করেনা দেখে তাদের এভাবে বলাটা ঠিক না। তারা যথেষ্ট কাজ করে। আম্মা হোম মেকার, উনি এখনো যে ভাবে সবার দেখাশোনা করেন, ভাবি-তিতলি-আপা তিনজন মিলেও তা পারবেনা।”
নিশাত বললেন, ” আজ আমার প্রথম নাতি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। এতো ভালো ভাবে। দোহাই লাগে, তোমরা আজকে হাসো, গল্প করো, রেষারেষি কোরোনা।”
তিতলী-তমা ফোঁস করে উঠতে যাচ্ছিলো, আসিফ তাড়াতাড়ি করে বললো,” তিতলী, আরিয়ান -লুম্বিনী -অরণ্য -অরণীর নাম এখন পাল্টালে কেমন লাগবে? বিশেষ করে আরিয়ান? ”
“দুলাভাই, এগুলো ওদের নিক নেম। এমনতো না,ওগুলো পাল্টাতে গেলে সার্টিফিকেট চেঞ্জ করতে হবে।”
“তুমি নতুন নাম ভেবেছো কিছু? ”
প্রবল উৎসাহের সাথে তিতলী বললো, ” লুম্বিনীর নাম নুজহাত, অরণী হলো নুসরাত, অরণ্যের নাম দিবো আজান, আরিয়ানের নাম আয়ান।”
তিতলীর ছেলেমানুষি ভাবভঙ্গিতে সবাই হেসে ফেললো। তুতুন হাসতে পারলোনা। তার দু’চোখ পানিতে ভরে উঠেছে। চার ভাইবোনের নাম পাল্টানো হচ্ছে, তুতুনের নাম সেই তালিকায় নেই।
নোমান হাসতে হাসতে বললো,” আমাদের যাদের মুসলিম নাম, মানে অন্য ধর্মের মনে হয়না আরকি, সেই সব নামের অর্থ জানিস? নাজমুল মানে কি? নিশাতের অর্থ কি? নোমান মানে কি? আদনান-আসিফ-ইরফান-আয়মান-আরহামের অর্থ কি? ”
ইরফান খুবই বুদ্ধিমান আর মজার একটা ছেলে। সে হাসতে হাসতে দুই ফুপুকে বললো, ” তিতির পাখি, তিতলী মনি, তোমাদের কি হবে? তোমাদের নাম পাল্টানো লাগবে না? ”
এইসব হাসি তামাশার মাঝে কোন সময় বুবুন উঠে গেছে,কেউ খেয়াল করেনি। নিঃশব্দে উঠে যেয়ে বুবুন শুয়ে আছে লুম্বিনীকে জড়িয়ে ধরে। বুকে জমে থাকা বরফের পাহাড় গলতে শুরু করেছে। পাহাড়ি ঝর্ণা বুবুনের দু’চোখে। ঝাপসা চোখে সে লুম্বিনীকে দেখছে। এই সেই লুম্বিনী! চেহারা পাল্টে গেছে অনেক। বোনটি ছিলো রাজেশ্বরীর অতি বিশ্বস্ত সহচর। যতো দুষ্টু বুদ্ধি বের হতো রাজেশ্বরীর মাথা থেকে। লুম্বিনী বোনকে ভক্তির সাথে অনুসরণ করতো। এই বাসাটা এখন কবরের মতো নিস্তব্ধ হয়ে থাকে, রাজ থাকা অবস্থায় এতো হৈ চৈ অন্য কোনো বাড়িতে হতো কিনা বুবুনের জানা নেই। গলা ফাটিয়ে দুই বোনের গানের শব্দে কাকও বারান্দার গ্রীলে বসতে ভয় পেতো। টিভিতে জোরে হিন্দি গান ছেড়ে উদ্দাম নৃত্য। পায়ে নূপুর থাকায় শব্দ আরও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠতো। তারপরে ছিলো ঝগড়া। দুই বোনের নিজেদের মাঝে ঝগড়া, অন্যদের সাথে ঝগড়া। চিল চিৎকার আশেপাশের দশ বাড়ি শুনতে পেতো। আর সেই সাথে কূটকাচালি,বুবুনের নামে। এবং অবশ্যই বুবুনের আড়ালে। বুবুন বোনদের হালচাল ভালোই বুঝতো, তুতুন আবার বোনদের উপরে গুপ্তচরগিরি করতো। আপুরা যখন বাবার দুইপাশে বসে কথা বলতো, খরগোশের মতো কান খাড়া করে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে তুতুন সব শোনার চেষ্টা করতো। তিন ভাইবোনের এই কার্যকলাপগুলো বুবুনের খুব ভালো লাগতো। বাবা অনেক সময় দুই মেয়ের কথা বিশ্বাস করে ফেলতেন। সত্যি বলতে কি, রাজ আর লুম্বিনী মনগড়া কথার পাশাপাশি সত্য কথাও বলতো। একবার ভীষণ বিপদে পড়েছিলো বুবুন। কুটনি বুড়িরা গোপনে বাবার কান ভাঙিয়েছিলো,
“বাবা, ও বাবা, শুধু অফিস করলেই হবে? বাসায় কি হচ্ছে খোঁজ খবর রাখতে হবেনা? মা তো কিছুই বুঝেনা। ভাইয়া সামনের বাসার মৌরি আপুর সাথে প্রেম করছে। অমন রাগ করে তাকিওনা বাবা, আমরা জেনেশুনে বলছি। রোজ বিকালে ভাইয়া ছাদে যায়, মৌরি আপুও যায়। ”
“আর কেউ যায়না? শুধু ওরা দু’জনেই ? ”
“আরও কেউ কেউ যায় কিন্তু ওরা সবার থেকে দূরে আলাদা দাঁড়িয়ে গল্প করে, ফিক ফিক করে হাসে। একদিন ছাদে কেউ ছিলোনা, ওইসময় ভাইয়া মৌরি আপুকে একটা বই দিলো,আর আপু ভাইয়াকে কি দিলো জানো বাবা? এত্তো বড় একটা গোলাপ ফুল। ”
“ছাদে কেউ ছিলোনা, তা তোমরা দেখলে কি করে? ”
আসিফের প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই ঘরে ঢুকেছিলো তুতুন, যথারীতি দরজার পাশেই সে কানখাড়া করে দাঁড়িয়ে ছিলো, ” আপুরা সবসময় ভাইয়াকে ফলো করে। ভাইয়া ছাদে গেলে দরজার পাল্লার একপাশে এই এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে দু’জনে,একটু পরপর উঁকি দেয়। ”
“তুমি কি করে জানলে বাবা? ”
উত্তর কি হওয়া উচিৎ, সেটা ভাবছিলো তুতুন, কিন্তু ওর ছোট্ট জান কাঁপিয়ে দিয়ে দুইদিক দিয়ে উড়ে এসেছিলো দুই বোন, আসিফ বাধা দেওয়ার আগেই গোটা কয়েক কিল, চড় হজম করতে হয়েছিলো ছোট্ট বাবু তুতুনকে। আসিফ কোলে তুলে নেওয়ার পরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে
বাচ্চাটা বলেছিলো,” ওরা আমাকে মেরে ফেলার পরে তুমি আমাকে কোলে নিতে এসেছো? আগে আসতে পারোনি? তুমি পচা বাবা।”
বড় ছেলেকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো আসিফ -তিতির, মৌরি সম্পর্কে। বিষয়টাতে কিছুটা সত্যতা থাকায় ঘাবড়ে গিয়েছিলো বুবুন। শান্ত গলায়, নরম ভাবে ছেলেকে অনেক কিছু বুঝিয়েছিলো বাবা-মা, তবে প্রচ্ছন্ন কিছু হুমকিও ছিলো সাথে। ওখানেই সদ্য কলেজে ওঠা বুবুনের প্রথম ভালো লাগার পরিসমাপ্তি। এতেও ক্ষান্ত দেয়নি কূটনি বুড়িরা। নানার বাড়ির কারোর জানতে বাকি ছিলোনা ঘটনাটা রাজ-লুম্বিনীর জন্য। খ্যাক খ্যাক করে হেসেছিলো ইরফান।
আজ ঐ দিনগুলোকে ভীষণ সুখের দিন মনে হয় বুবুনের। আজ রেজাল্ট জানার পরে বাবা-মা,তিন ভাইবোন গিয়েছিলো রাজের কাছে। তিতিরকে নেওয়া হয়না বললেই চলে, ধর্মে নাকি নিষেধ আছে, আর ওখানে গেলেই মা জ্ঞান হারায়। প্রচন্ড কান্নাকাটি করে। ফিরে আসতে চায়না। কবরটা বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রাখতে যায়। লুম্বিনীকেও নেওয়া হয়না। আজ যেয়ে লুম্বিনী পুরো সময় শান্ত ভাবে বসেছিলো। তুতুন ভাবছিলো কাজলা দিদির কথা। এতো ভালো ফল হবে বুবুন নিজেও ভাবতে পারেনি। ভাঙা গলায় বলেছিলো,” এই পাকনা বুড়ি, বাবার কাছে শুধু কথা লাগাতিস,আমি নাকি পড়িনা। তাহলে এতো ভালো করলাম কি করে, কূটনি? ”
এখন এই গভীর রাতে লুম্বিনীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে বুবুন রাজেশ্বরীর সাথে কাল্পনিক কথাবার্তা চালালো, মনে মনে।
“রাজ, বুঝতে পেরেছিস, আমি খুব ভালো রেজাল্ট করেছি?”
“হ্যাঁ ভাইয়া। তুমিতো সবসময়ই ভালো রেজাল্ট করেছো।”
” ডাক্তারি পড়বো,বুঝলি? তাহলে আর কোনো ভাইকে এতো কষ্ট পেতে হবেনা।”
“আমার মরে যাওয়ার জন্য ডাক্তাররাতো দায়ী না ভাইয়া। উনারা কতো চেষ্টা করেছেন আমার জন্য। ”
” তাহলে কি পড়বো, বলতো পাকনা বুড়ি? ”
“তুমি স্যুইপার হও ভাইয়া। আমাদের নোংরা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, নোংরা পলিটিক্স, নোংরা কাজকারবার সব পরিস্কার করে দাও।”
বুবুনের তন্দ্রা কেটে গেলো। ঘোরের মধ্যে সে একবার বুবুন হয়ে, একবার রাজেশ্বরী হয়ে কথা বলছিলো। এতো বাস্তব মনে হচ্ছিলো সবকিছু। মৃত্যুর পরে কি হয়? আত্মা দেখতে পায় সব? ছোট্ট রাজ কি প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারে, তাকে হারিয়ে পুরো সংসার কেমন অচল হয়ে গেছে ? বুবুনের ভীষণ ইচ্ছা করে রাজকে জীবনে একবার অন্ততঃ দেখতে, কোলে নিতে। মাঝেমধ্যে তীব্র ইচ্ছা হয়, রাজের কবর খুঁড়ে ওকে বের করে বুকে জড়িয়ে ধরতে। হোকনা সে ছোট্ট একটা কংকাল, হয়তো দেখা যাবে,লম্বা চুলগুলো তেমনি আছে, তীব্র দুর্গন্ধ বের হবে, কি এসে যায় তাতে !
আজ কি পূর্ণিমা ! চাঁদের নরম আলোয় ভেসে গেছে ঘর। ময়না খালা তাঁর ঘরে ঘুমাতে গেছেন। লুম্বিনী অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ফ্যামিলি লিভিং রুমে আড্ডার আসর ভাঙলো বোধহয়। সব ভাইরা এক ঘরে ঘুমাবে, কেউ বিছানায়, কেউ ফ্লোরিং করে। অরণী ঘুমাবে তিতলী আম্মু আর খালুর সাথে। নানাভাই, বুবু এক ঘরে। মামা মামি আরেক ঘরে। বাবা-মা এই এলো বলে। শুধু রাজ….., কষ্টে বুবুন দম নিতে পারেনা। লুম্বিনীকে আদর করে সে নিজের ঘরের দিকে রওনা হলো। রাজকে নিয়ে তার কবিতা লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে,
রাজেশ্বরী ! কেমন লাগেরে তোর নতুন আবাস?
কি বোকা আমি! নতুন কোথায়? সুদীর্ঘ চৌদ্দ মাস
বাস করছিস তোর সোঁদা মাটির ঘরে।
আমাদের কথা কি কখনো মনে পড়ে?
কিভাবে কাটে তোর সময়, রাজেশ্বরী?
তোর সাথে খেলা করে ফুলপরী,লালপরী,নীলপরী?
ওরা তোকে নিয়ে যায় নিজের বাসায়?
মা পরীরা জড়িয়ে ধরে তোকে গভীর ভালোবাসায়?
মেঘের ভেলায়, হাসি আর খেলায় কাটে বুঝি দিন তোর?
কার কাছে যাই, কার কাছে পাই তোর সামান্য খবর !
তোর ক্ষুধা পায়? গরম লাগে, কিংবা শীত? ভয়?
তুই কাঁদিস সোনা? এ জগতে আবার ফিরে আসতে ইচ্ছা হয়?
কিছুই জানিনা কেমন আছিস! কি যে করি!
একটাবার এসে সব কিছু জানিয়ে যা রাজেশ্বরী ।
চলবে।
#সংসার
পর্ব ১৬
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
ফুল স্কলারশিপ পেয়েও বিদেশের নামকরা ভার্সিটিতে ভর্তি না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে অবাক করে দিলো আরিয়ান। ওর বন্ধু বান্ধবরা বেশির ভাগই বাইরে পড়তে যেতে আগ্রহী। আদনান খেপে লাল। তার মন ভালো কিন্তু কথা খুব রূঢ়,
” তুমি কি পাগল? কোনো সুস্থ মানুষ এমন ডিসিশন নিতে পারেনা।”
” মাফ করবেন খালু। আমি আপনাদের সবাইকে ফেলে থাকতে পারবোনা।”
” তুমি দুধের শিশু নও। ইউ আর ম্যাচিওরড এনাফ। বাপ-মায়ের কোলে বসে ফিডার চোষার সময় অনেক আগেই পার হয়ে এসেছো। ওই ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ কেউ হারায়? বাংলাদেশে এডুকেশন সিস্টেম সম্পর্কে নিশ্চয় ধারণা আছে তোমার। আমাদের আমলে তাও কয়েকটা ইন্সটিটিউট ভালো ছিলো, এখন সবগুলোর ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। ডার্টি পলিটিক্স। ভিসি হলো সম্পূর্ণ পলিটিক্যাল একটা পোস্ট। বেশির ভাগ টিচারের মোরালিটি নেই, ছাত্র ছাত্রীদেরও নেই। কেনো নিজের ফিউচার নষ্ট করছো? ”
“ফিউচার আমরা দেখতে পাইনা খালু। আমরা কেউ জানিনা, ভবিষ্যতে আমাদের কার জন্য কি অপেক্ষা করছে।”
“বড় বড় বুলি একদম বন্ধ। এই দেশ মানুষ থাকার যোগ্য না। কি আছে এখানে? ”
” আমরা সবাই বিদেশ চলে গেলে দেশের কি হবে খালু? ”
” রাখো তোমার বস্তাপচা দেশ। এখানে মেধা, শ্রম, বুদ্ধি, সততার কোনো দাম নেই। তারপরও যদি বেশি দেশপ্রীতি থাকে, বেশতো, বাইরে পড়াশোনা সেরে এসে এখানে বিদ্যা প্রয়োগ করো। বাপ মালদার আছে, বছরে বছরে দেশে আসতে পারবে। ”
আসিফ দোলাচলে ভুগছে। বুবুন তার প্রাণ। তাকে দূরে পাঠাতে ইচ্ছা করেনা। আবার ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করলে মনে হয় বাইরে পাঠিয়ে দিলেই ভালো।
তিতির কান্নাকাটি করছে। বুবুন দেশে থেকে পড়ুক। বাইরে যাওয়ার দরকার নেই।
নিশাত বলেন,” শুধু নিজের কথা ভাবছিস? ছেলেটার ভবিষ্যৎ চিন্তা করবিনা? এমন সুযোগ কেউ হেলায় হারায়? ”
” আমার অতো জ্ঞানী ছেলের দরকার নেই, মা। ওরা শুধু আমার কাছে থাকুক, বেঁচে বর্তে থাকুক।”
“এটাতো মা স্বার্থপরের মতো কথা হলো। ছেলে মেয়েকে জন্ম দিয়েছো তুমি, কিন্তু তাই বলে তাদের জীবনের সবকিছু তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতে পারোনা। বাচ্চারা বড় হলে তাদের ছেড়ে দিতে হয়। না হলে আত্মবিশ্বাস পাবে কোথা থেকে? জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কোথা থেকে আসবে? স্বনির্ভর হবে কেমন করে ? সন্তান কি সারাজীবন মায়ের আঁচলের তলায় থাকতে পারে? তাকে ছাড়তেই হয়। তার ভালোর জন্য । ”
“আমি কিছুতেই বুবুনকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।”
আদনান মুখ ফস্কে বলে ফেললো,” রাজেশ্বরীকে ছেড়ে তো থাকতে পারছেন। আরিয়ানের সাথে দিনে চোদ্দবার কথা বলতে পারবেন, ভিডিও কলে ওকে দেখতে পাবেন, রাজেশ্বরীকে কোনো ভাবেই আর দেখতে পাবেননা। এই চরম সত্যটা জেনেও আপনি বেঁচে আছেন, আগের চেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছেন, আরও হবেন, একসময় রাজের কথা মনে হবে কিন্তু কোনো ফিলিংস হবেনা……. ”
” আদনান! ” তিতলী চেঁচিয়ে উঠলো।
“আরে, এটাই ফ্যাক্ট। আপা ছেলেকে বুকের মধ্যে গুঁজে রাখতে চাচ্ছেন, দেখা গেলো, অ্যাকসিডেন্ট বা ভার্সিটিতে মারামারি, এসবের জন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। তখন আপা উল্টো আফসোস করবেন, কেন তিনি বুবুনকে বিদেশে পাঠালেননা। ”
আসিফ ক্লান্ত গলায় বললো,” বুবুন যে সিদ্ধান্ত নিবে, সেটাই ফাইনাল। তবে সিদ্ধান্তটা ভালো করে বুঝে শুনে নাও।”
“আমি অনেক ভেবেছি বাবা। আমি দেশেই পড়বো।”
নাজমুল সাহেব হাসিমুখে বললেন, ” আলহামদুলিল্লাহ। আমি এটাই চাচ্ছিলাম। ”
লুম্বিনীর ভালোই উন্নতি হয়েছে। স্বাস্থ্য কিছুটা ভালো হয়েছে। এখন একটু কথা বলে, মাঝেমধ্যে হাসেও, সবচেয়ে বড় কথা, এতো ফাঁকিবাজ ছিলো দুই বোন, লুম্বিনী এখন পড়তে ভালোবাসে। স্কুলে তার জন্য একজন স্পেশাল কেয়ার গিভার আছেন, ভদ্রমহিলা খুবই ভালো এবং নিজের কাজে দক্ষ, তিনিও লুম্বিনীর উন্নতির কথা জানিয়েছেন। ও ক্লাসে মন দিয়ে লেখাপড়া শেখে, টিফিন শেয়ার করে, সহপাঠীদের সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলে। আসিফ-তিতির-বুবুন- লুম্বিনীর নানা-নানি, মামা – খালা সহ সব আত্মীয়, অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিবেশিরা, স্কুলের টিচার-স্টুডেন্ট,ময়না খালা, আমেনা সবার অবদান আছে লুম্বিনীর এই উন্নতিতে। সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট, নিউরোলজিস্টদের তো কথা ই নেই।
এদিকে তুতুনের বুকে তুষের আগুন। ভাইয়াকে নিয়ে সারা দুনিয়ার মাতামাতি। আপুর যত্নের সীমা পরিসীমা নেই। ছোট্ট তুতুনের কথা ভাবে কেউ? বাবা আছে হাসপাতালের কাজ নিয়ে, বাসায় ফিরে আপুকে সময় দেওয়া, ভাইয়ার সাথে আলোচনা। মা বেশির ভাগ সময় জায়নামাজে। জায়নামাজে নামাজ পড়ছে, ওখানেই শুয়ে শুয়ে কাঁদছে আর তসবি গুণছে, বাকি সময় আপুর পরিচর্যা। তুতুনের জন্য আছেটা কে তাহলে? মেরিনা আন্টির বাসায় এখন আগের মতো অতো সময় কাটানো হয়না। স্কুল,হোমওয়ার্ক, বাসায় স্যার আসেন একজন। সবাই সবার দিকে খেয়াল রাখে, তুতুন ভালো করে খেয়াল করে দেখেছে। মা’তো সারাক্ষণই কাঁদে, মনমরা হয়ে থাকে, বাবা এসে সবার আগে মায়ের তত্ত্ব তালাশ নেয়। খুবই লজ্জার কথা, বাবা সবার সামনে মায়ের মাথায় হাত বুলায়, এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখে, এমনকি কপালে চুমুও খায়। ভাইয়া মা’কে হাসানোর জন্য কতো ভাঁড়ামি করে। মা’কে সময় দেয়। গল্প করে। মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে। বাবা যদি মন খারাপ করে বসে থাকে, মা ছুটে যায়। বাবার হাত ধরে, মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দেয়, ভাইয়ার উপরে কোনো চাপ এলে ও কেমন ভাবে যেনো কাঁপতে থাকে, বাসায় তখন দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। মা ভাইয়ার মাথায় হাত বুলাতে থাকে, বাবা পায়ে তেল মালিশ করতে থাকে। আর আপুর কথা কি আর বলবে তুতুন? তুতুনের অসুখ বিসুখ নাই, তাই তার দামও নাই। উনারা সবাই দুঃখী, তুতুন একাই সুখী।এমনই ভাব সবার। নানাভাই-বুবু-মামা-খালারা-আংকেল -আন্টিরা সবাই ব্যস্ত থাকে আপুকে নিয়ে। ইরফান ভাইয়ারা সব ভাইয়ার ভক্ত। স্কুলে তুতুনের বেস্ট ফ্রেন্ডটাও মরে গেলো। ময়না খালার টানটাও মনে হয় ভাইয়ার দিকে বেশি।
অনেকদিন ধরেই মনে একটু একটু ক্ষোভ জমা হচ্ছিলো তুতুনের। এখন তার মনের আকাশ জলভরা ঘন কালো মেঘে ভরা।
রাতে তুতুন জানালো সে খাবেনা। সে খিদে সহ্য করতে পারেনা একদম, তাই বাসার সবাই রাত দশটা সাড়ে দশটায় খেতে বসলেও তুতুন খেতে বসে সাড়ে আটটায়, স্যার চলে যাওয়া মাত্র। তুতুন মায়ের হাতে খায়নি বহুদিন, বাবাও খাইয়ে দেননা। বুবু কাছে থাকলে বুবু অবশ্য নিজ হাতে খাইয়ে দেন। অন্য সময় ময়না খালা পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। খাওয়ার জন্য জোরাজোরি করেন। কই জাতীয় ভয়ংকর মাছ থাকলে কাঁটা বেছে দেন। মা এখন শুধু আপুকে পড়ায়। অথচ আগে মা ভাইয়া,দুই আপু,তুতুন বাবু সবাইকে পড়াতো। তুতুনকে কোলে বসিয়ে পড়াতো মা। আর খুব মজা করে পড়াতো। মা ছড়া আর রাইমস পড়াতো তুতুনকে কোলে নিয়ে, নেচে নেচে। মায়ের কাছে পড়তে বসা খুব আনন্দের বিষয় ছিলো চার ভাই বোনের কাছেই। এখন স্কুলের টিচার আর বাসার স্যারের কাছে বুঝতে হয়। সেদিন একটা অংক বোঝার জন্য তুতুন গিয়েছিলো বাবার কাছে। বাবা তখন আপুর সাথে কথা বলছিলো। তুতুনকে বললো, ” মায়ের কাছে যাও,বাবু।আমি একটু আমার মায়ের সাথে কথা বলি।” তুতুনের অতো মিষ্টি, ফোলাফোলা গাল ধরে টিপেও দিলোনা। তুতুন মায়ের কাছে যেয়ে দেখে, মা জায়নামাজে বসে আছে। দু’গাল বেয়ে পানি পড়ছে। তুতুনের কথা শুনে মা বললো,” আমার শরীরটা খারাপ লাগছে বাবা। ভাইয়ার কাছে যাও।” ভাইয়া তখন কম্পিউটারে ব্যস্ত। তুতুনের কান ধরে বললো,”একটু আগে স্যার গেলেন, উনার কাছ থেকে বুঝে নিতে পারিসনি ফাঁকিবাজ? এখন কাজ করছি। পরে বুঝাবো।” পরে যখন ভাইয়া বুঝাতে চাইলো, তখন তুতুনের চোখে রাজ্যের ঘুম।
ভাইয়াটা অবশ্য রাতে ঘুমানোর সময় মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।
তুতুন ময়না খালার পানের বাটা থেকে জর্দার কৌটাটা চুরি করে আনলো।সে জানে, জর্দা খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। মা এর আগে জর্দা দেওয়া পান খেয়ে বমি করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিলোনা। তুতুন মুঠো ভরে জর্দা খেলো। কৌটাটা জায়গামতো রেখে আসতে না আসতেই সারা পৃথিবী দুলতে শুরু করলো।
দুর্বল গলায় “মা” ডাক শুনে তিতির দৌড়ে এলো। তুতুন উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। তিতির ছুটে এসে তুতুনের মাথা কোলে তুলে নিলো। জর্দার কড়া গন্ধ। এরমধ্যে সবাই ছুটে এসেছে। আসিফ ছোঁ মেরে তুতুনকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলো। লুম্বিনী আর বুবুন কাঁদছে। আসিফ ছেলের মুখে আঙুল ঢুকিয়ে বমি করালো। ময়না খালা বিলাপ করে কাঁদতে থাকলো।
তুতুনের হুঁশ ফিরলো যখন, সে আবিষ্কার করলো তার মাথাটা বেশ ঠান্ডা।চুলগুলো ভেজা। মায়ের কোলে তার মাথা। মা ভীষণ কাঁদছে, তুতুনকে চুমু খাচ্ছে। তুতুনের পা দু’টো বাবার কোলে। বাবা পায়ে হাত বুলাচ্ছে, পায়ের তলায় চুমু খাচ্ছে আর বলছে, ” তুতুনের সাথে খুব অন্যায় করেছি আমরা। নিজেদের জ্বালা যন্ত্রণা নিয়ে এতো মশগুল ছিলাম যে ছোট্ট বাবাটার দিকে খেয়ালই করা হয়নি। ” ভাইয়া আর আপু তুতুনের পাশে বসে ভেউভেউ করে কাঁদছে। ময়না খালা টুলে বসে সুর করে বিলাপ করছে, “তুতুন সোনারে, ময়না পাখিটা, আমার কলিজা….”।
তুতুনকে চোখ মেলতে দেখে সবার সে কি আদর! মা- বাবাতো অনবরত চুমু দিয়েই যাচ্ছে, ভাইয়া -আপুও। আর সবার সেকি আহ্লাদ ভরা কথা।
মনে আর কোনো ক্ষোভ নেই তুতুনের। তার পা মাটিতে পড়তে পারছেনা। বাবা,মা, ভাইয়া কোল থেকে নামাচ্ছে না। ভিডিও কলে নানাভাই, বুবু কেঁদে কেঁদে অনেক আদরের কথা বলেছে, তিতলী আম্মু তো হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। ইরফান, আয়মান, অরণ্য, অরণী সবাই ভিডিও কলে দেখলো তুতুনকে, তাদের ভালোবাসার কথা জানালো, মামা -মামিও অনেক মায়াভরা কথা বললো তুতুনকে, আদর করে। সবাই কাল সকাল হলেই চলে আসবে। মেরিনা আন্টি,আংকেল,সূর্য ভাইয়া,সুপ্তি আপু সবাই এসে অনেক আদর করে গেলো।
দুর্বল লাগছে, কিন্তু তুতুনের মুখে উপচে পড়া হাসি। সেদিন সবাই এক ঘরে ঘুমালো তুতুনের সম্মানে, খাটে আড়াআড়ি করে। বুবুন,মা,তুতুন,বাবা, লুম্বিনী। নিজেকে ভারি সুখী আর নিরাপদ মনে হচ্ছিলো তুতুনের। ওরা সবাই একসাথে।
সবাই একসাথে? কিন্তু কাজলা দিদি? সেতো একদম একা ঘুমিয়ে আছে মাটির তলায়।
একই কথা ভাবছিলো বাকি চারজনও।
চলবে।