#সংসার
পর্ব ১৭
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
আদনান উৎফুল্ল গলায় বললো,”তিতলী ডিয়ার! আজ বিকাল পাঁচটার মধ্যে রেডি থেকো। আমি দুপুরেই চলে আসবো।”
আদনানের মুখ ঝলমল করছে।
তিতলী জিজ্ঞেস করলো, ” কোথায় যাবো?”
“সারপ্রাইজ ডার্লিং, বিরাট সারপ্রাইজ। ভেরি প্লিজ্যান্ট সারপ্রাইজ। তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা।”
“আহা! হিন্টস দাওনা একটু। আমরা ছাড়া আর কে কে যাচ্ছে? ”
“নো মোর কোয়েশ্চেন। তাহলেতো সারপ্রাইজের মজাই থাকলোনা।”
তিতলী আসলেই সারপ্রাইজড হলো। ভয়াবহ ভাবে হলো। অরণ্য -অরণীকে নিয়ে বিকেলে স্বামীর সাথে নিচে নেমে দেখলো, শ্বশুরের গাড়ি, দেবর আরিজের গাড়ি।
আদনান তার মা’কে জিজ্ঞেস করলো,” আফরা এখনো পৌঁছায়নি? ”
” এই পৌঁছালো বলে। দশ মিনিট অপেক্ষা করতে বললো। ”
চললো দশ মিনিটের জায়গায় প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা। সারপ্রাইজের টেনশন স্তিমিত হয়ে আসছিলো তিতলীর।
বোনের গাড়ি এসে পৌঁছালে বরযাত্রীর মতো গাড়িগুলো রওনা হলো। থামলো অভিজাত এলাকার এক অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে।
বারো তলায় লিফট থামলে সবাই নামলো। একটা ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। লাল ফিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদনানের অফিসের দুই কর্মচারী।
আদনান দরাজ গলায় বললো, ” আব্বু-আম্মু, একসাথে ফিতা কাটো।”
তিন হাজার স্কোয়্যার ফিটের দুইটা ফ্ল্যাটকে একসাথে করে ছয় হাজার স্কোয়্যার ফিটের বিশাল ফ্ল্যাট। আদনান কিনেছে। নতুন অ্যাপার্টমেন্ট। এতোদিন কাজ চলেছে। এখন সব ঝকঝকে পরিস্কার করে পরিবারের সদস্যদের জড় করা হয়েছে।
তিতলী গভীর বিস্ময়ের সাথে শুনলো, আদনান তার মায়ের সাথে আলোচনা করে কাজটা করেছে। দুই ভাই বোনকেও জানিয়েছে। সবকিছু তিতলীর শাশুড়ির পছন্দে কেনা। ফার্নিচারও উনি পছন্দ করে অর্ডার দিয়েছেন, ডেলিভারি হয়নি এখনো। একসাথে সবাই থাকবেন, অর্থায়ন শুধু মাত্র আদনানের।
রাগে শরীর কাঁপছিলো তিতলীর। আদনান বললো, ” এই মাসে বাড়িওয়ালাকে নোটিশ দিয়ে দিও,তিতলী। যতো তাড়াতাড়ি উঠে পড়া যায়।”
আদনানের মা বললেন, ” আমি আজ টু লেট টাঙিয়ে দিবো। ভাড়াটে এর মধ্যে আসুক আর না আসুক, আমি ফার্নিচার সেট হলেই এখানে উঠে আসবো।”
তিতলীর শ্বশুর বললেন, ” এতো কিছু হয়েছে, আমি কিছুই জানিনা? রিটায়ার করে আমি এতো ফেলনা হয়ে গিয়েছি যে তোমরা আমাকে কিছুই জানানো প্রয়োজন মনে করলেনা? ”
আদনান বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,” তোমাকে সারপ্রাইজ দিলাম আব্বু। তিতলীকেও।”
মতিউর সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন, ” তুই ফ্ল্যাট কিনলি, তিতলী তা জানেনা? এটাতো ক্রাইম রীতিমতো। তোর মা,ভাই, বোন, ভাইয়ের স্ত্রী, ভগ্নিপতি জানে, আর তোর নিজের স্ত্রী জানেনা? তোর তো ওকে সাথে নিয়ে ফ্ল্যাট পছন্দ করা উচিৎ ছিলো, ডেকোরেশন ওর মনের মতো হওয়া উচিৎ ছিলো। সবচেয়ে বড় কথা, ফ্ল্যাট কিনবি কীনা, কিনলে কোন এলাকায়, কত স্কোয়্যার ফিটের মধ্যে, এ ব্যাপারে তিতলীর সাথে কথা বলা,ওর অনুমতি আর পরামর্শ নেওয়া ছিলো ম্যান্ডাটরি। তোর বিবেক বলে কিছু নেই আদনান। ”
আফরা বললো,” কী বলো আব্বু! সবচেয়ে বড় অধিকার আম্মুর। যা হয়েছে , আম্মুর ইচ্ছাতে হয়েছে। আম্মুর জন্য ভাবিকে কোনো কষ্ট করতে হয়নি। একটা ফ্ল্যাট দেখেশুনে তৈরি করা কম ঝক্কির কথা? এই ফ্ল্যাটের সবকিছু আম্মু ঘুরে ঘুরে কিনেছে। দিনরাত এক করে। প্রত্যেক জিনিসের কোয়ালিটি অনেক হাই। ভাবি একেবারে রেডিমেড খাঁটি জিনিস পেয়েছে।”
এজন্যই আদনানের মা বাড়িতে সারাদিন থাকতেননা বললেই চলে। সারাজীবনই তিনি বহির্মুখী, মতিউর সাহেব তাই মাথা ঘামাননি। কিন্তু নাইমা এতো বড় একটা অন্যায় করলো! তিতলীকে কিছুই জানানোর দরকার মনে করলোনা? তাঁদের নিজেদের ফ্ল্যাট আছে। আরিজ আর তার বৌ রায়না খুবই হিসাবী টাকা পয়সার ব্যাপারে, তারা বছর খানিক আগে ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। ব্যাংকেও ভালো অ্যামাউন্ট জমা হয়েছে। তাহলে নাইমা বড় ছেলেকে দিয়ে সবার বাসের জন্য ফ্ল্যাট কেনালেন কেন? মতিউর সাহেবতো দেখেছেন, কতো হিসাব নিকাশ করে সংসার চালাতে হয় তিতলীকে। আদনান সংসার খরচ টিপে টিপে দেয় তার স্ত্রীকে। বলে, “একটু কষ্ট করো। কিছু সঞ্চয় করা দরকার। ” কষ্ট করার এই হলো প্রতিদান। ছয় হাজার স্কোয়্যার ফিটের বিশাল বাড়ি যার প্রতিটা ইঞ্চিতে আদনানের টাকা, যার প্রতিটা ইঞ্চি শাশুড়ির পছন্দে বানানো।
কোনটা কার ঘর,তাও শাশুড়ি ফিক্স করে রেখেছেন। তিতলী অরণ্য আর অরণীর হাত ধরে বললো,” চলো।”
“চলো মানে? কোথায় যাবে আমার ছেলেমেয়ে? মেজাজ এতো চড়া করে রেখেছো কেন? কোথায় সবাই মিলে আনন্দ করবো, তা না… ”
” তোমার জন্য আনন্দের ব্যাপার, আমার জন্য না।”
“কেন? ”
“বাড়িটা কার নামে করেছো? তোমার মায়ের নামে? ”
“না।আমার নামে। আর মায়ের নামে যদি করিই, তাতে ক্ষতি কোথায়? ”
“তুমি এই প্রাসাদ বানানোর ইচ্ছার কথা আমাকে আগে জানাওনি কেন? ফালতু এক্সকিউজ দিবেনা। আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য বলোনি,এই হাস্যকর কথা আর বলবেনা। ”
“তোমাকে বললে তুমি রাজি হতে? ”
” হতাম। আমাকে জানিয়ে, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা শুনে, আমার পছন্দকেও গুরুত্ব দিলে কেন রাজি হতামনা? তবে এটা ঠিক, তোমার ভাইবোনসহ যৌথ পরিবারে থাকতে আমি রাজি হতামনা।এখনো রাজি না।কখনোই রাজি হবোনা।”
” এই কারণেই তোমাকে জানাইনি। আমার বাপ,মা,ভাই, বোনদের নাম শুনলে তোমার গায়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে।”
” আব্বুর প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। উনি সাথে থাকলে আমি শক্তি পাই, অরণী-অরণ্য সুশিক্ষা পায়। তোমার মা আমার জীবনটাকে নানাভাবে রক্তাক্ত করেছেন। তবু তাঁর সাথে আমি থাকতে আপত্তি করবোনা কারণ তিনি তোমার মা। কিন্তু তোমার ভাইবোনের সাথে আমি কেন থাকতে যাবো? ছিলামতো একসময়। এখন তাদের বিয়েশাদি, চাকরি বাকরি হয়েছে, তাদের নিজেদের বাড়ি ঘর আছে, তাদের সাথে নিয়ে থাকতে হবে কেন? আমি কী আগের কথা সব ভুলে গিয়েছি? তারা বরাবর শুধু নিজেদেরটা বুঝেছে। তাদের সাথে আমি বাস করার কথা ভাবতেও পারিনা।”
আদনানের মা বললেন, ” তোমার মতো কিছু আলট্রামডার্ণ মেয়েরা শুধু নিজেদেরটা বুঝে। সবাইকে নিয়ে থাকার আনন্দ জানেই না। সেল্ফ সেন্টার্ড।”
মতিউর সাহেব স্ত্রীকে বললেন, “তুমি বুঝেছো একসাথে থাকার মাহাত্ম্য? ”
আদনান চেঁচিয়ে উঠলো,”এনাফ। এতো কমপ্লিকেটেড একেকজন। কতো আশা করে সবাইকে নিয়ে আসলাম, খুশি হওয়ার বদলে মুখ হাঁড়ি। আমার টাকায় কেনা ফ্ল্যাটে আমি যা ইচ্ছা করবো, তাতে কারোর বলার কিছু নেই। আমার ফ্ল্যাটে আমার বাপ-মা-ভাই-বোন থাকবে নাতো কী তোমার গুষ্ঠি থাকবে? ”
তিতলী কথা না বাড়িয়ে ছেলেমেয়েদের হাত ধরে দ্রুত বের হয়ে আসলো।ম্যাডামকে দেখে ড্রাইভার শশব্যস্ত হয়ে গাড়ির দরজা খুলছিলেন, তিতলী সেদিকে তাকালোওনা। সিএনজি ডেকে বাচ্চাদের নিয়ে উঠে পড়লো।
চলবে
#সংসার
পর্ব ১৮
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
নিশাত -নাজমুলের বাসায় এতো চিৎকার , হৈচৈ কখনো হয়নি। নাজমুল -নিশাত মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাটি করেন, নোমান-তমার লেগেই থাকে, ইরফান- আয়মানও অনেক উঁচু গলায় কথা বলে। কোন কিছুই আজকের ধারের কাছে নয়।
অরণ্য -অরণীর কান্না থামেনি এখনো। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে বাচ্চা দু”টি। মা’কে এমন অস্বাভাবিক ব্যবহার করতে কখনো দেখেনি তারা। সিএনজির মধ্যে তিতলী রাগে কাঁপছিলো। বাপের বাড়ির সামনে এসে যখন সিএনজি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছিলো,”কতো?”, ভয়ংকর চমকে মায়ের দিকে তাকিয়েছিলো বাচ্চারা। এ কেমন গলা মায়ের? মায়ের গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি এমনতো নয়।
বাসায় ঢুকে তিতলী হিস্টিরিয়ার রোগী হয়ে গেলো। দরজা খুলে দুলি “ছুডো আফা আইছুইন ” বলে সহর্ষে চিৎকার দিয়েছিলো, অরণ্য -অরণী ছুটে গিয়েছিলো নানা-নানির দরজায়, কে এসেছে দেখার জন্য বের হয়ে এসেছিলো ইরফান -আয়মান, তিতলী ডাইনিং চেয়ার ধরে জান্তব চিৎকার শুরু করলো। বাসার যে যেখানে ছিলো, ছুটে আসলো পড়িমরি করে। তিতলী তখন টেবিলে মাথা ঠুকছে। চোখের পানি, মুখের লালা মিলেমিশে একাকার। নিশাত জড়িয়ে ধরলেন তাকে। চারিদিকে “কী হয়েছে,কী হয়েছে ” রব।”তিতলী জবাব দিচ্ছেনা। শুধু চিৎকার , মাথা ঠোকা, হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি। নিশাত পেরে উঠছেননা ওর সাথে।নোমান দৌড়ে এলো মা-বোনের কাছে। অরণ্য -অরণী থরথর করে কাঁপছে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে নানাকে।
কী হয়েছে এই প্রশ্নের জবাব ছোট্ট অরণী-অরণ্যও দিতে পারছেনা। তমা ফোন দিয়েছে আদনানকে। আদনান রাগী গলায় তমাকে জানালো, সে আসছে কিছুক্ষণের মধ্যেই।
আদনান, তার বাবা-মা আর বোন আসার পরে তাদের সম্মিলিত কথায় একটু একটু করে পরিস্কার হলো সব।
আদনান চিৎকার করে বললো, ” কী শিক্ষা দিয়েছেন মেয়েকে? ইডিয়ট একটা।”
নিশাত অস্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় বললেন, ” আস্তে এবং ভদ্র ভাবে কথা বলো।”
আবার সবার চমকানোর পালা। দুই জামাই, এক বৌমা বিভিন্ন সময়ে অনেক বেয়াদবি করেছে বুঝে না বুঝে, কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ির কাছ থেকে সামান্য বকা কখনো খায়নি।
আদনান সামান্য থমকালো।কিন্তু রেগে গেলে ছেলেটার নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। সে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,” ভদ্র ভাবে কথা বলতে, ভদ্র হয়ে চলাফেরা করতে আপনার মেয়েকে শেখান। আমি ভদ্রই আছি। ”
“তোমার ভদ্রতার পরিচয় আগেও পেয়েছি আদনান। যতোক্ষণ এখানে আছো, শান্ত স্হির ভাবে বসো।বেয়াই সাহেব, যা ঘটেছে, তা সম্পর্কে আপনার মতামত কী? কাজটা কী আদনান ভালো করেছে? ”
মতিউর সাহেবের মুখ খোলার আগেই আদনানের মা বলে উঠলেন,”এটাকে কী আপনার অনুচিত মনে হচ্ছে বেয়ান? আজ যদি নোমান শুধুমাত্র আপনার সাথে পরামর্শ করে এমন গর্জিয়াস ফ্ল্যাট কিনতো, আপনার বুক ভরে যেতোনা? মনে হতোনা ছেলে আপনাকে কতোটা মূল্য দেয়? এমনতো নয় আদনান ফ্ল্যাট আমার নামে লিখে দিয়েছে। দিলেও কী অন্যায় হতো? বিয়ের পরে ছেলে মা’কে বাড়ি গাড়ি গয়না পাতি কিনে দিতে পারেনা? মায়ের সেই অধিকার হারিয়ে যায় বুঝি? ”
” আমার ছেলে যদি ফ্ল্যাট কিনতে চায়, যার নামেই হোক, সেটা ওপেন আলোচনার বিষয় হবে। তার বাবা আর তমার প্রেজেন্স হবে মাস্ট। আমার ছেলে যদি এই প্রপোজাল নিয়ে আসে, মা আসো, আমি আর তুমি গোপনে একটা ফ্ল্যাট তৈরি করি, বাড়ি রেডি হলে তমাকে আর বাবাকে সারপ্রাইজ দিবো, আমি তাহলে ভাবতাম ছেলে পাগল হয়ে গেছে। বাড়ি লুকিয়ে চুরিয়ে করার জিনিস না। একটা বাড়িতে সংশ্লিষ্ট সবার আনন্দ, উৎসাহ,মতামত মিলেমিশে থাকবে।”
“এমন যদি হতো, আদনান আর তিতলী গোপনে ফ্ল্যাট বানিয়ে পরে আমাদের নিয়ে যেয়ে সারপ্রাইজ দিতো, তাহলে কী সেটা ন্যায় হতো না অন্যায় হতো? আপনি কী বলেন? ”
” ন্যায় অন্যায় বিচার করবোনা। নোমান ফ্ল্যাট কিনতে চাইলে অতি অবশ্যই তমাকে জানাবে, ওর মতামত জানবে, আমাকে,ওর বাবাকে, তমার বাবা-মা’কে জানাবে পরামর্শের জন্য। বৌকে বা বাবা-মাকে একদম অন্ধকারে রেখে কেউ বাড়িঘর বানায়, এটা আমি প্রথম শুনলাম।”
আদনান খেঁকিয়ে উঠে বললো,” আপনার মেয়েকে জানাইনি। জানালে সে প্রথমেই বাগড়া দিতো। আমার বাপ মা ভাই বোন নিয়ে সে থাকতে রাজি না।”
“কেন রাজি হবে আদনান? পরিবারের সদস্যরা সবাই সবাইকে সাপোর্ট দিবে, মিলেমিশে থাকবে। তোমাদের বাড়িতে একতরফা তিতলী সাপোর্ট দিয়ে গেছে, বেতনের টাকা ঢেলেছে, রান্না করে তোমাদের খাইয়েছে, তোমাদের ঘর পর্যন্ত ঝাঁট দিয়েছে। তোমরা ওর জন্য কী করেছো? ওর প্রেগন্যান্সির সময় বেয়াই ছাড়া আর একজনও জানতে চেয়েছো ওর কী খেতে মন চায়? একবেলা কেউ রান্না করে ওকে খেতে দিয়েছো? কাজের মেয়ে না রাখার জন্য বেয়ান কতো ছলাকলা করেছেন। কাজের মেয়ে রাখবেননা, নিজে কিছু করবেননা শক্তি সামর্থ্য থাকা স্বত্বেও, প্রেগন্যান্ট বৌ অফিস করে এসে সবার খাবার রান্না করে, ঘর ঝাড়ু দেয়, আমার বেয়ান তখন টিভি দেখেন, তাঁর মেয়ে পড়ার টেবিলে বসে থাকে, আমার জামাই তখন রেস্ট নেয়, মোবাইলে গেমস খেলে, তারপরও তিতলী আপনাদের জান দিয়ে ভালোবাসবে কেমন করে আশা করেন? বাঁধা মানুষ রাখতে দিবেননা, তিতলীর অফিসের বেবী কেয়ার সেন্টারে বাচ্চা রাখতে দিবেননা, নিজেরা নাতি নাতনি নিয়ে আহলাদ করবেন কিন্তু তাদের দায়িত্ব নেবেননা, কেন তিতলী থাকবে আপনাদের সাথে? ”
আফরা বললো, “আপনিতো আন্টি নানু।আপনি কেন মানুষ করেননি অরণ্য -অরণীকে?”
” অরণ্য -অরণী -তাদের মা আমার কাছে থাকতোনা। থাকলে ভালো হতো।মেয়েটাকে চাকরি ছাড়তে হতোনা, এতো শারীরিক -মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হতোনা। তোমরা যে নীরবে আমার মেয়েটাকে এতো যন্ত্রণা দিতে, আমি জানতামনা।মেয়েটা জানাতোনা। জানালে তোমাদের কাছে কিছুতেই মেয়ে আর বাচ্চাদের রাখতামনা। ”
ওদিকে আরেকটা ঘরে বিমর্ষ মুখে বসে আছে ইরফান, আয়মান, অরণ্য, অরণী। ইরফান প্রথম থেকেই অরণ্য -অরণীকে আগলে রেখেছে, বুঝিয়ে শুনিয়ে ওদের কান্না থামিয়েছে, বড়দের মাঝেমধ্যে ঝগড়া করা ভালো_ এ জাতীয় তথ্য দিয়েছে, দুই ভাই তাদের ভিডিও গেমস অরণ্য -অরণীর হাতে তুলে দিয়েছে।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বিছানায় পা রেখে এসএসসি পরীক্ষার্থী ইরফান গভীর বিষন্নতায় ভাবছে, সুখ বলে পৃথিবীতে আসলে কী কিছু নেই ? কেন মানুষ মানুষকে আঘাত করে? তিতলীমনির সাথে যে ব্যবহার ছোটো ফুপা আর তার পরিবার করেছে, তা হজম হচ্ছেনা ইরফানের। তবে ছোটো ফুপা আর তিতলীমনির মধ্যে এতো গন্ডগোল এই প্রথম দেখলো ইরফান। ছোটো ফুপাকে দৈত্য মনে হচ্ছিল। তিতিরপাখিকেও খোঁচা মেরে মেরে অনেক কথা বলতো বড় ফুপা। ইরফান তখন ছোট্ট ছিলো, কিন্তু বুঝতো সব। আর বড় ফুপা যতোই ধীরস্থির হোক, তিতিরপাখির সাথে ডমিনেটিং এখনো। আর ইরফান নিজের বাপ-মায়ের কথা কী আর বলবে। মতবিরোধ, ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। দাদা-দীদাও নিজেদের মধ্যে কম ঝগড়া করেননা। আচ্ছা, ঝগড়াই যদি করবে, কী দরকার ছিলো ইরফানদের পৃথিবীতে নিয়ে আসার? ওরা কী বুঝেনা, ওদের ঝগড়া,রাগারাগির জন্য কতো খারাপ লাগে ইরফানদের? অনেক আগেই ডিসিশন নিয়ে ফেলেছে ইরফান, বিয়ে করবেনা সে। অন্য ভাইবোনদেরও নিষেধ করবে।
আয়মান গভীর বিষন্ন মুখে অরণ্যের পাশে বসে আছে। দু’চোখে গভীর বেদনা।
ইরফান ডাকলো ভাইকে, ” আয়মান।”
“হুম। ”
“চুপ করে আছো কেন? কী ভাবছো? ”
“ভাবছি, কোনোদিন বিয়ে করবোনা। ”
।চলবে।