#সংসার
পর্ব ২৩
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
“মা রে, ছাড় দেওয়া লজ্জার বা পরাজয়ের বিষয় নয়। কখনো কখনো ছাড় দিতে হয়।”
বাবার কথায় তিতলী মুখ গোঁজ করে বসে থাকে। আগামী সপ্তাহে শ্বশুর শাশুড়িসহ নতুন ফ্ল্যাটে উঠবে ওরা।
” তোর শাশুড়ি ডোমিনেটিং, তাঁর বিভিন্ন কাজ কারবারে কষ্ট পেয়েছিস, সবই জানি। এখন ম্যাচিউরিটির সাথে সব হ্যান্ডেল করবি। তোর প্রতি কোনো অবিচার করার সুযোগ দিবিনা। যেটা ন্যায়, সংসারের সবার জন্য জন্য যা সুবিধাজনক , তাই করবি। উনার অন্যায় কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নিবিনা। সেই সিদ্ধান্তে তাঁর ভুলটা কোথায়, পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দিবি তবে অবশ্যই ভদ্র ভাবে। আর অতীতের খারাপ কথা যতো ভাববি, ততো মনে রাগ, জেদ কাজ করবে। মন বিষাক্ত হয়ে উঠবে। মন বিষাক্ত মানে শরীরও বিষাক্ত। এতে লোকসান তো তোরই। পুরানো সব কথা ভুলে যা। দুনিয়ায় যে কেউ তোর প্রতি অন্যায় করলে প্রোটেস্ট করবি, উপযুক্ত সময়ে, ভদ্র কিন্তু দৃঢ় ভাবে। আর ছোটোখাটো সব জিনিস ধরতে নেই। আল্লাহ আমাদের দুনিয়ায় এমনি এমনি পাঠাননি। উদ্দেশ্য দিয়ে পাঠিয়েছেন। জীবনে সুন্দর সুন্দর অনেক কিছু করার আছে, ভাবার আছে। সেসব বাদ দিয়ে তুচ্ছ জিনিস দিয়ে মাথা ভরিয়ে রাখবি কেন? ”
নিশাতের কথার উত্তরে তিতলী বললো, ” শোনো মা, বলা সহজ, করা সহজ নয়। তুমি আর বাবা জীবনে সবসময় এই নীতি মেনে চলেছো? মোটেই না। এখনো একে অন্যকে আঘাত করে কথা বলো। মা, এখনো তোমার মনে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে আক্ষেপ। ”
“আমরা ভুল করেছি, এখনো ভুল করি। তাই বলে তোকেও ভুল করতে হবে? আমাদের সবারই উচিত শোধরানোর চেষ্টা করা।”
“করো চেষ্টা ? আমিতো নমুনা দেখিনা।”
“এখন থেকে করবো। যে কোনো মুহূর্ত থেকে ফ্রেশ লাইফ স্টার্ট করা যায়। ”
” তোমরা আগে ফ্রেশ স্টার্ট করো, তারপরে না হয় উপদেশ দাও।”
নাজমুল সাহেব ঠান্ডা গলায় বললেন, ” তিতলী, সংযত ভাবে কথা বলো।উচিৎ জবাব কিন্তু সুন্দর ভাবে দেওয়া যায়। আমাদের ভুল ত্রুটিকে ফলো না করে বরং এই শিক্ষা নাও যে, ঝগড়া-বিবাদ, মনে ঘৃণা পুষে রাখা সুফল বয়ে আনেনা। ”
তিতলী কথা বাড়ালোনা। শাশুড়ির প্রতি তার চরম বিতৃষ্ণা। আবার একসাথে বাস করতে হবে। প্রতিদিনই স্বার্থপর ননদ আর দেবর হাজির হবে, এটা-সেটা খাবারের বায়না ধরবে, আড্ডাবাজি করে নরক গুলজার করবে।
নিশাত বললেন, ” ওরা ওদের মধ্যে যা খুশি করুক, যা কথা বলুক, তা নিয়ে তুই মাথা একদম ঘামাবিনা। তোর কাছে যখন তখন আবদার করলে শান্তভাবে না করে দিস। ভাবি, চা দাও, ভাবি, পুডিং বানাও, ভাবী মোরগ পোলাও রান্না করো _ আগের মতো এসব আবদার ধরলে মিষ্টি করে বলে দিবি, আমি পারবোনা। কেন পারবিনা, সেই অজুহাত দেওয়ার দরকার নেই। হেল্পিং হ্যান্ডদের তুই কন্ট্রোল করবি, তারমানে এই নয় যে তারা তোর শাশুড়িকে অমান্য করবে। আমার কথা হলো, অন্যায়কে ভদ্র কিন্তু শক্ত ভাবে দমন করবি, কিন্তু নিজে অন্যায় করবিনা। আদনানকে জন্ম দিয়েছেন, লালন পালন করে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন তাঁরা, এখন আদনান যদি বাপ – মা নিয়ে একসাথে থাকতে চায়, তাহলে দোষের কিছু নেই , তিতলী। আমরা যদি সবাই বিবেক খাটিয়ে চলতাম, তাহলে এতো অশান্তি , নৈরাজ্য হতোনা। ”
“তোমরাতো আমার বাপ-মা। আমিও তোমাদের আমার কাছে রাখতে চাই। কিন্তু সেটাতো হবার নয়? ”
” কেন, তুই যদি আদনানকে বলিস আমাদের সাথে আমার বাবা-মাও থাকবে, ও কী না করবে? ”
” শোনো মা, এতো কথা ভালো লাগছেনা, ও যদি ভালোই হতো, তাহলে সারপ্রাইজ দেওয়ার সময় আমার বাপ-মা, ভাই বোনকেওতো সাথে নিতে পারতো। পারতো না? ”
“অবশ্যই পারতো।কিন্তু ঐ যে, সবার বিবেক বুদ্ধি সমান হয়না। ”
“একা বিবেক নিয়ে চলা যায়না।”
“খুব যায়।”
তমা বললো,” এখন কোন জবে জয়েন করো। তোমার শ্বশুর শাশুড়ি আর কিছু না করুন, নাতিদের নিরাপত্তা আর খাওয়া দাওয়ার দিকে তো লক্ষ্য রাখবেন। ”
তিতলীও ভেবেছে এটা নিয়ে। কিন্তু মন সায় দেয়না। অনেক বছর চাকরি না করায় অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে যেতে হবে, থাকতে হবে, এটা এখন ভালো লাগবে কীনা কে জানে! অরণ্য -অরণীকে ছাড়া একদম থাকতে পারেনা তিতলী। স্কুল টাইম ছাড়া মায়ের সাথে সেঁটে থাকে বাচ্চা দুটো। বলা ভালো, মা ই সেঁটে থাকে ছেলেমেয়ের সাথে।
আর অরণ্য -অরণীকে দাদির কাছে রাখার কথা ভাবতেই পারেনা তিতলী। ওদের নিয়ে হিন্দী সিনেমা বা সিরিয়াল দেখতে বসবেন, চানাচুর-চকলেট আর কোক ফান্টা দিয়ে পেট ভরিয়ে রাখবেন, মা-মেয়ে বসে বাচ্চাদের সামনে গলা ছেড়ে পরচর্চা করতে বসবেন, যখন ইচ্ছা রওনা হবেন মার্কেট, নইলে আত্মীয়দের বাড়ি। বাচ্চা দুটোকে বুয়ার আন্ডারে রেখে। কখনোবা সাথে নিয়ে, কিন্তু সব জায়গাতেই ছোটদের সামনে বড়দের বড়সুলভ আলাপ, বাচ্চাদের সামনে তাদের মা আর নানাবাড়ির নামে সমালোচনা।
শ্বশুর মানুষ হিসাবে ভালো হলেও খুব আলাভোলা। এতো বড় চাকরি করতেন, কাজ কারবার দেখে বোঝা যায়না। লুঙ্গি পরে এমন ভাবে মাঝেমধ্যে বসেন, অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ছোট্ট অরণী একদিন নয়, তিন তিন দিন আনন্দিত মুখে চিৎকার করে বলেছিলো, “হায়,হায়, দাদা তোমার…. দেখা যায়।” তিতলীর নিজের চোখেও পড়েছে কয়েকবার। সংকুচিত হয়ে আদনানকে বলেছিলো,”আব্বাকে কয়েকটা ট্রাউজার কিনে দাও। এখনতো সবাই ট্রাউজারই পরে।”
“আব্বা লুঙ্গি পরে থাকে তাতে তোমার সমস্যা কি? ”
“আব্বা সবসময় সামলাতে পারেননা।”
“সারাজীবন লুঙ্গি পরে সামলাতে পারলেন, এখন তুমি আসার পরে পারছেন না? আমাদের সব ব্যাপারে খুঁত ধরা তোমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তিতলী কয়েকটা পায়জামা শ্বশুরের জন্য নিজেই কিনে এনেছিলো। শ্বশুর রাজি হননি ট্রাউজার পরতে।
এমন কুচিন্তাও তিতলীর মনে হানা দিতো মাঝেমধ্যে, শ্বশুর তিতলীকে দেখানোর জন্যই এমন করছেন নাতো? নইলে কারোর চোখে পড়েনা, তিতলীর চোখে পড়ে কেন? এমন ভাবনায় নিজেই অনুতপ্ত হতো মেয়েটা। অরণ্য হলো। সাত আট মাস বয়স হতে দাদার সাথে দারুণ খাতির, দাদা তাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যান। দেড় বছর বয়সে বাচ্চাটা দাদার কাছে যাওয়া দূরের কথা, দাদাকে দেখলেই চিৎকার শুরু করে দিতো। আবারও সন্দেহ, আবার অনুশোচনা। অরণী জন্মালো, একটু বড় হলো এবং তিনবার সে দাদার গোপনাঙ্গ দেখতে পেয়ে উল্লসিত হল। তিতলীর সুদর করে বোঝানো ও নিষেধ করা স্বত্বেও গোপনে পরম আনন্দে কাজিন, বন্ধুবান্ধবদের কাছে সে তার বিরাট সাফল্যের ধারাবিবরণী দিতো। জোর করে আলাদা বাসা নিলো তিতলী। ছেলেমেয়েকে পক্ষীমাতার মতো আগলে রাখলো এতোগুলো বছর ধরে। শ্বশুরকে সে পছন্দ করে খুবই তাঁর বিভিন্ন মানবিক গুণাবলির জন্য , তিতলীর প্রতি প্রথম থেকেই তাঁর সুন্দর ব্যবহারের জন্য, কিন্তু এই বিষয়ে একটা খটকা থেকেই গেছে। গোলাপগুচ্ছে কাঁটার মতো।
কি আজব দুনিয়া! এসব চিন্তাও করতে হয়। না করেই বা কি উপায়? যেখানে আপন বাবা -ভাইয়ের কাছে শিশু, কিশোরীরা ধর্ষিত হয় দিনের পর দিন, সেখানে এসব দুশ্চিন্তা না করে উপায় কি? কি অধঃপতন মানুষের !
তিতলী উঠে দাঁড়ালো। বাবা-মায়ের বাসাও এই মুহূর্তে ভালো লাগছেনা। জামাইদের তাঁবেদার। সে নীরস গলায় বললো, ” বাবা-মা, এবারে তোমরা আমাদের বাসায় যেয়ে থাকো। তাহলে অরণ্য -অরণীকে নিয়ে আমার টেনশন হবেনা। এখনতো ওদের পেছনে দৌড়ানো লাগবেনা, শুধু খেয়ালটা রাখা। আমিও চাকরিতে ঢুকে পড়ি।”
নাজমুল সাহেব মায়াভরা গলায় বললেন, ” যাবো মা, অবশ্যই মাঝেমধ্যে যাবো। যেদিন বেশি দরকার পড়বে, ফোন করলেই চলে যাবো। মাঝে মধ্যেই যাবো।”
“সেই যাওয়ার কথা বলছিনা।পার্মানেন্টলি থাকার কথা বলছি।”
“সেটা কি সম্ভব, মা? ”
“কেন সম্ভব নয়? ”
“নিজের বাড়ি থাকতে মেয়ের বাড়ি কেন থাকবো? ইন ফ্যাক্ট, মেয়ে হোক, ছেলে হোক, নিজের বাড়ি থাকতে তাদের বাড়ি কেন থাকবো? ”
“আদনানের বাপ-মায়েরও বাড়ি আছে।তারা নিজেদের প্রাসাদ ফেলে ছেলের বাসায় কেন থাকবে? ”
নিশাত কঠিন গলায় বললেন ,” বারবার বলছি, ভদ্র ভাবে কথা বলো।আদনানের বাবা-মায়ের ইচ্ছা হয়েছে, উনারা ছেলের বাড়িতে উঠবেন।আমাদের তেমন ইচ্ছা হচ্ছেনা, তাই আমরা যাবোনা। ”
“তা যাবে কেন? ইরফান -আয়মানকে ফেলে যাওয়া যায় নাকি? ছেলে-বৌমাকে সন্তুষ্ট আর নিশ্চিন্ত রাখতে হবেনা? ছেলের দুই বাচ্চাকে মানুষ করেছো, বড় মেয়ের চার বাচ্চাকে মানুষ করেছো, আমার অরণ্য -অরণী কে? কি করেছো ওদের জন্য ? ”
“ছেলে আর বৌকে আলাদা করে সন্তুষ্ট করার, তোষামোদ করার কি আছে? আমরা কি তাদের উপরে নির্ভরশীল ? তিতিরের বাসায় যেয়ে কি আমরা বাচ্চাদের কেয়ার করেছি? ও আমাদের কাছাকাছি বাসা নিয়ে থাকতো,হাসপাতালে যাওয়ার সময় বাচ্চাদের দিয়ে যেতো। বুবুনের সময় আমাদের যে শক্তি সামর্থ্য, বয়স ছিলো, অরণ্য -অরণীর বেলায় আছে সেটা? ”
“আমি জব করতে চাই। তারজন্য আমার বাচ্চাদের একটা নিরাপদ আশ্রয় লাগবে।দয়া করে সেটা আমাকে দাও।”
“নিশ্চয় দিবো। আমরা মাসে এক সপ্তাহে তোর বাসায় থাকলাম। বাকি তিন সপ্তাহ তুই বাচ্চাদের নিয়ে এখানে থাকলি, শুক্র-শনিবারে বাসায় গেলি।”
“বাহ্! কি চমৎকার সল্যুশন। আমার ছেলেমেয়েকে আমিই পালবো। কারোর দরকার পড়েনি, পড়বেওনা।”
নিশাত বললেন, ” আদনান আর তুই আমাদের সামনে বসে আলোচনা কর। দু’জনে ভাগাভাগি করে বাচ্চাদের দায়িত্ব নে। আদনানকে এই দায়িত্ব নিতে হবে। তুইও চাকরি কর। ভোর থেকে রাত দশটা পর্যন্ততো কারোর চাকরি করার দরকার দেখিনা।”
রাগে তিতলীর শরীর কাঁপছিলো।বাবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন, সন্ধ্যায় অফিস থেকে কোনো আড্ডায় না যেয়ে পরিবারকে সময় দিতেন। মা ঘরেই থাকতেন,সব কাজ সুনিপুণ ভাবে করতেন। এই বাড়ির ছেলে নোমান, বৌ তমা, দুই জামাই আসিফ আর আদনান সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করে। বর্তমান জীবন এমন।এতো না খাটলে দুই তিনটা ফ্ল্যাট হবেনা, ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে দামী স্কুলে পড়তে পারবেনা, সবচেয়ে ভালো টিউটরদের কাছে বাচ্চাদের ঢোকানো যাবেনা, ও লেভেল-এ লেভেলের পরে বাচ্চাদের অ্যামেরিকা -কানাডা-অস্ট্রেলিয়া পাঠানো যাবেনা, অভিজাত হওয়া যাবেনা। আপা -দুলাভাই হাসপাতালে ডিউটি করতো, আপাকে চলে আসতে হতো দুপুরে, দুলাভাই রাত ১২ টায়, ১ টায়। নাজমুল সাহেব -নিশাত বড় জামাই আসিফকে যে সাপোর্ট দিয়েছেন, মেয়ে তিতিরের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পিরিয়ডে তার কণামাত্রও দেননি।আপা হাসপাতাল থেকে এসেই নাকে মুখে গুঁজে বাচ্চাদের দায়িত্ব নিয়ে নিতো, নাজমুল সাহেব ও নিশাতকে একটু রিলিফ দেওয়ার জন্য। দুলাভাইয়েরতো এই চিন্তা ছিলোনা। সংসারের জন্য টাকা দিয়ে দায়িত্ব শেষ। আর এই দায়িত্বটাই সমাজের সবার চোখে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
নাজমুল -নিশাত ভাবছিলেন, ছেলেমেয়ের প্রতি দায়িত্ব পালন অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু তাদের সংসার, নাতিপুতিদের প্রতি দায়িত্ব পালনও কি ফরজ? নিজেদের যত্ন করার, নিজেদের শখ -ইচ্ছা পূরণ করার সময় তাহলে কোথায়? মনের টানেই বুবুন, রাজ-লুম্বিনী,ইরফান,আয়মানের পিছনে যে শ্রম দিতে পেরেছিলেন, শারীরিক অসুস্থতা -বয়স এসবের কারণে তুতুন, অরণ্য, অরণীর জন্য তেমন কিছু করতে পারেননি। কেন প্রতিটা অফিসে খুব,খুব উন্নত মানের চাইল্ড কেয়ার সেন্টার থাকেনা?
#সংসার
পর্ব ২৪
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
“আমি তোমাদের সাথে বেড়াতে যাবোনা। মালদ্বীপ গেলে বন্ধুদের সাথে যাবো। তোমাদের সাথে দেশে বিদেশে কোথাও যেতে রাজি না আমি।”
কৈশোর উত্তীর্ণ হয়েছে কি হয়নি, ইরফানের এমন সোজা সাপটা কথায় মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল নোমান -তমা। তারপরে ফেটে পড়লো আক্রোশে।
“এতো বড় সাহস তোমার। স্কুল পার হওনি এখনো কিন্তু এতো বড়বড় বোলচাল। এই বয়সেই বন্ধু শিখে গেছো।ফ্যামিলি না, বন্ধু সব। অসভ্য ছেলে।”
” মা, আমি বেয়াদবি কখন করলাম? দেখো, কি শান্ত গলায় নরম ভাবে তোমাদের বেড়াতে যাওয়ার প্রপোজাল রিফিউজ করেছি। বন্ধুদের সাথে এখনই যাবো, তা বলিনি।গেলে ওদের সাথে।”
“কি কারণে? ” কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো নোমান, ” ফ্যামিলির থেকে তোমার কাছে ফ্রেন্ড বেশি? ”
“কম-বেশির ব্যাপার নয় বাবা। মানুষ আউটিং এ যায় রিল্যাক্স করার জন্য, ফ্যামিলির সাথে কোয়ালিটিফুল টাইম স্পেন্ড করার জন্য। তোমরা কি কর? ওখানে যেয়েও ঝগড়া, রীতিমতো ফাইটিং। সেই রাগ কখনো সখনো আমার আর আয়মানের ওপরে ঝাড়ো। তোমাদের সাথে বেড়াতে যাওয়া আতংকের নাম। ”
তমা চিৎকার করে বললো,”পাকা পাকা কথা ছেড়ে জিনিসপত্র গোছাও। ইঁচড়েপাকা। খেতে আমাদের মতো বকা, মার, তাও হাতে না, লাঠি দিয়ে,ঝাঁটা আর বেত দিয়ে, তখন বুঝতে, কতো সুখে আছো তোমরা। ”
“নানা-নানু এমন করতেন দেখেই তুমি এমন হয়েছো, মা। ”
“কি হয়েছি? ”
“শান্তির আশায় ছুটে বেড়াও, শান্তি মেলেনা। ছোটোবেলার ট্রমা পারমানেন্ট ছাপ রেখে গেছে। কথায় কথায় চিৎকার- হৈচৈ করো, আমাদের উপরে কথা নেই বার্তা নেই, রাগ মেটাও, বাবার সাথে ঝগড়া করো, অল্পেই কথা ধরো, আমার দাদা দাদিকে রেসপেক্ট করোনা, তিতির পাখি তিতলীমনিকে দেখতে পারোনা,বুয়াখালাদের সাথে রাফ ব্যবহার করো, বলতে গেলে প্রতিদিন শপিং করো, সব এই মেন্টাল ট্রমার জন্য ই।”
” ইরফান । ”
“কথা সত্যি বাবা। তোমারও মায়ের মতোই ঘটনা। ”
“আমাদের শৈশব,কৈশোর সবকিছু দারুণ কেটেছে।”
“না বাবা।তুমি বললেতো হবেনা। তোমাদের স্কুলে খেলার বিশাল মাঠ ছিলো, তোমরা খেলতে, তোমরা বন্ধুরা সরল,সোজা সাপ্টা ছিলে,তোমাদের বাসায় অনেক আত্মীয় বনধু আসতেন, তোমরাও অনেকের বাড়ি বেড়াতে যেতে, সব ঠিক আছে। কিন্তু তোমাদের সব আনন্দ ভ্যানিশড হয়ে যেতো দাদা-দাদির ঝগড়াঝাটিতে। তোমরা সাফারার। তোমরা জানো, একজন সন্তান কীসে কষ্ট পায়। তারপরও তোমরা নিজেদের চেঞ্জ করোনা। নিজেরা যে পরিস্থিতিতে ছিলে, আমাদেরকেও সেই পরিস্থিতিতে ফেলো। কেন? অকারণে অন্যের মন ভাঙার অধিকার, সে ছেলেমেয়ে হোক আর বাসার খালা হোক,কে দিয়েছে মানুষকে?”
“তুমিওতো কষ্ট দিচ্ছ আমাদের। ”
“নিউটনের সূত্র বাবা। প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।”
তমা চিৎকার করতে থাকলেও নোমান সরে গেলো। ইরফান ঠিক কথা বলেছে।
ঠাসঠাস করে চড়ের শব্দ। তমার মাথায় রক্ত উঠে গেছে।
ইরফানের কঠিন গলা শোনা গেলো,” আর একটাবার আমার গায়ে হাত তুলবেনা মা। জন্ম থেকে তোমাদের দু’জনের চিল্লাপাল্লা, ঝগড়া দেখতে দেখতে মন-মাথা সব নষ্ট হয়ে গেছে আমার। বাবা-মা হিসাবে ভালো হও, তারপরে ভালো সন্তানের আশা করো। ”
“এতো পয়সা খরচ করছি তোমাদের স্কুল, টিউটর, ভালোমন্দ খাওয়া,দেশ বিদেশ বেড়াতে যাওয়া,তোমাদের শখ মিটাতে, আর এতো কিছু দেওয়ার পরে কথা শুনতে হয় আমাকে? ”
“আমার আর আয়মানের কিছু লাগবেনা, একটু শান্তি লাগবে। আমাদের কিচ্ছু দিতে হবেনা তোমাকে, একটু শান্তি দাও। তা যদি না পারো, ওরফানেজে দিয়ে আসো।”
শেষ বিকেলে ছাদে চা খেতে খেতে তমা বললো, ” দেখেছো, তোমার ছেলে কি বেয়াদব হয়েছে? ”
“ওর সব কথা আমার ঠিক মনে হয়েছে তমা। ও বেয়াদবি করেনি। তোমার আর আমার উচিত নিজেদের পাল্টানো। বাচ্চা জন্ম দিলেই বাপ-মা হওয়া যায়না। তাদের শরীরের খোরাকের পাশাপাশি আত্মার খোরাক যোগাতে হয়। শুধু বিদেশে বেড়াতে নিয়ে যেয়ে, দামী জিনিসপত্র কিনে দিয়ে ওদের মনের খোরাক মিটানো যায়না। ”
“কি করবো তাহলে? চাকরি ছেড়ে দিই? ঘরে বসে বসে লেজ নাড়ি? তোমার বোনদের মতো? স্বামীর পয়সায় খাই? ”
“কিছু করা লাগবেনা। শুধু মেজাজ আর ভাষা ঠিক করো।”
“শোনো নোমান, আমি তোমার বোনদের মতো মুখে মধু অন্তরে বিষ হতে পারবোনা। আমার সবকিছু সামনাসামনি। ”
“আমার কোন্ বোনের অন্তরে বিষ ? ”
“তোমাদের পুরো গুষ্ঠিরই অন্তরে বিষ। বিশেষ করে তোমার পেয়ারের তিতির বেগম।চেহারা দেখলে মনে হবে ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারেনা, এদিকে পেটে পেটে শয়তানি বুদ্ধি। ”
এ কথা বহুবার বলেছে তমা, কিন্তু কেন সে তিতিরকে এতো খারাপ চোখে দেখছে, সেটার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কখনও।
যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে , সে গেছে বোনের বাড়ি। তিতলী ছোট্ট একটা খাবারের প্যাকেট খুললো, “আপা, দেখো।”
তিন পিস কেক। মাঝারি সাইজের।
তিতির কিছু বুঝতে পারলোনা। বোনকে জিজ্ঞেস করলো,”কি দেখবো? তিন পিস কেক আছে। ”
হাসতে হাসতে তিতলী বললো, “আমার দেবর ও জা পাঠিয়েছে। তারা বেশ বড় একটা কন্ট্র্যাক্ট পেয়েছে, সেই কোম্পানি থেকে একটা কেক পেয়েছে, কেকের পাঁচ টুকরা এ বাড়িতে এনেছে। দুই টুকরা বাবা-মায়ের জন্য, তিন টুকরা ভাই আর ভাস্তে ভাস্তি তিনজনের জন্য। টোটাল ফাইভ পিসেস।আমি আর বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ডরা বাদ।”
তিতলী খুব হাসছে। তিতিরের চোখে পানি চলে আসলো। এই সেই ছোট্ট পুতুলের মতো বোন যার জন্য তিতির স্কুলে টিফিন খেতে পারতোনা, কাগজে মুড়িয়ে এনে বোনটির মুখে পরম মমতায় তুলে দিতো, ভাইকে দিতো একটু, বাপ-মা’কে একটু একটু। কেউ না নিতে চাইলে কান্না। নোমান দুই বোনকে ভাগ না দিয়ে ভালো কিছু খেতে পারতোনা। তিতলীকে অনেক বড় পর্যন্ত মা নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন, বাবা পিঠে নিয়ে দৌড়াতেন। তিতলী যা খেতে ভালোবাসে, মা সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন সেগুলো রান্নার। আর সেই তিতলীর এই অবস্থা ? ওইরকম কেকের পিস এখনই লক্ষটা এনে হাজির করতে পারে তিতির তার বোনের জন্য। কিন্তু কেকতো বড় কথা নয়, বড় কথা হলো সম্মান।
তিতলী বোনকে গম্ভীর দেখে চপল গলায় বললো,” আমরা ঐ বাসা থেকে প্রথম যখন বের হয়ে বাসা ভাড়া নিই, তখন থেকে মাঝেমধ্যেই চলতো এমন ঘটনা। ধরো,ওই বাড়িতে ভালো রান্না হলো,আদনানকে জরুরি খবর দেওয়া হলো বাসায় দেখা করার জন্য। ও গেলে ওকে খাইয়ে দেওয়া হলো। ভালো-মন্দ কিছু রান্না হলে বা বাইরে থেকে কেনা হলে আমার আগের বাসায় তিনজনের খাদ্য পাঠানো হতো, আদনান আর তার পুত্র -কন্যার।”
তিতির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। মানুষ কেন এমন করে? কি সুখ পায়? শিক্ষিত শব্দটার প্রকৃত সংজ্ঞা কি?
তিতিরের একবার মনে হলো, তিতলীকে বলে কেকের টুকরো তিনটা ড্রাইভারকে দিয়ে আরিজ আর ওর বৌয়ের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিক। এই আরিজ আর তার বৌয়ের জন্য কি করেনি তিতলী? আরিজের মা যা করেননি, ভাবি হয়ে তিতলী সেটা করেছে। মহামারির সময় অদ্ভুত এক অসুখ হয়েছিলো আরিজের। বৌ প্রেগন্যান্ট বলে বাপের বাড়ি চলে গেলো।আরিজের বাবা-মা ঘরে ঢুকেননা, যদি এই ছোঁয়াচে রোগ তাঁদের হয়ে যায়? ছোট্ট অরণ্য-অরণী বা নিজেদের রিস্কের তোয়াক্কা না করে আদনান-তিতলী আর গৃহকর্মী সাজু দিনরাত এক করে আরিজের সেবা করেছে, পথ্য রান্না করেছে।এই তার প্রতিদান?
বোনকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিতলী বললো, “আমার উচিত হয়নি তোমাকে এগুলো বলা। স্যরি। এসবতো সব সংসারেই কম বেশি হয়। তুচ্ছ ব্যাপার। তোমাকে দেখে ইমোশনাল হয়ে বলে ফেললাম আর কি। অতোশত ভেবে চিন্তে পাঠায়নি। ”
তিতলীর শাশুড়ি, দেবর জা ননদের লজ্জা লাগলোনা বা লাগেনা এমন করতে, কিন্তু এই বেহায়াপনায়, এই মানসিক দৈন্যতায় তিতিরেরই লজ্জা লাগলো। তিতলীরও লাগে নিশ্চয়।
কেকের জন্য তুতুন মরিয়া।
“তিতলী আম্মু, তাড়াতাড়ি কেক দাও আমাকে।”
বাচ্চারা ছিলোনা এতোক্ষণ এখানে। খেলছিলো অন্য ঘরে।
তিতলী তুতুনকে জাপটে ধরে বললো, “আমার সোনা বাবার জন্য এখনই এত্তো বড় একটা কেক আনাবো। তিন পিস কেকে কি পাঁচ ভাইবোনের হবে? বড় একটা কেক এনে আরাম করে খেয়ো।”
“ঐ তিনটা কে খাবে? আমি একটা শুধু খাই?”
” বাবাই, তোমার পছন্দের ঘন দুধ চা করেছি। ঐটা খেতে থাকো, বড় কেকটা চলে আসবে ততোক্ষণে। বুবুন, বাবা, তাড়াতাড়ি সামনের সুইস থেকে তোদের পছন্দের কেক নিয়ে আয়তো সোনা। দুই কেজি নিস।”
বুবুন খালার কাছ থেকে টাকা নিয়ে রওনা হলো। সাথে তুতুন আর অরণ্যকে নিলো। বাসায় থাকলে বেড়ালের মতো এই তিন পিস কেক চোখ দিয়ে চাটতে থাকবে খাওয়াপাগল তুতুন।
“রাতে পোলাও করি আপা। বাচ্চারা সবাই পোলাও রোস্ট পছন্দ করে।নতুন রান্নার খালা দারুণ শামি কাবাব বানায়। পোলাও, রোস্ট, কাবাব, রূপচাঁদা ফ্রাই।আর কি করবো আপা? ”
“আর কিচ্ছু করতে হবেনা। ”
“আমার কোনো কষ্ট হবেনা আপা। খালাই সবকিছু করবে। আরও দুইটা মেয়ে আছে,ওরা হেল্প করবে। ”
“আমি তোর জন্য কলিজা আর শুঁটকি ভুনা নিয়ে আসছি। কেএফসির চিকেন এনেছি, সবার হয়েও থাকবে কয়েকটা। রুইমাছটা আমি নিজে ভুনা করেছি। ”
পরিমাণ দেখে ঠান্ডা গলায় তিতলী বললো,” কয়দিনে ফুরাবে এগুলো?”
“খাবি সবাই মিলে। কি এমন এনেছি? ”
“সবার জন্য কেন আনো? তোমার জন্য কে কি নিয়ে যায়? ”
“আমার কাজ আমি করবো, তোর কাজ তুই করবি। এক বাড়িতে কি শুধু বোন-ভগ্নিপতি আর বাচ্চাদের জন্য আনা যায়? তোর শ্বশুর শাশুড়ি থাকেন, দেবর ননদরা আসে, সবাইকে দিবি, খাবি। খালাদের দিবি।ওরা দেয়না বলে আমরা দিবোনা? তুই দুই কেজি কেকের অর্ডার দিলি কেন? এতো কেক খাবে কে? ”
“আদনানের ভাইবোনদের খেতে আসতে বলবো এখন। সব খাবার টেবিলে মেলে ধরবো। যার যতো খুশি খাক, নিয়ে যাক।এটাই আমার অপমানের উত্তর। ”
তিতির হাসলো মনে মনে। হায়রে পাগলি, তোর এই সঠিক উত্তর অনুধাবন
করার ক্ষমতা যদি এদের থাকতো, তাহলেতো ভালোই হতো। এদের চোখ,মন, মগজ সব পর্দা দিয়ে ঢাকা। স্বয়ং আল্লাহ হেদায়েত না করলে এরা এমনই থাকবে।
“বুঝলি আপা, একটা চাকরি বা ব্যবসা খুব দরকার। সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট হওয়া খুব দরকার। এদিকে বাচ্চা দুটাকে ফেলে কোথাও যেতে ইচ্ছা করেনা।ওদের দাদা-দাদির ওপরে ভরসা করতে পারিনা। হেল্পিং হ্যান্ডদের উপরে সবকিছু ছেড়ে দেওয়া যায়, বাচ্চা আর অসুস্হ বাপ-মা’কে ছাড়া যায়না। ”
“আদনান বাজারের টাকা ছাড়া তোকে হাতখরচ দেয়না? আগের মতো ঝামেলা করে? ”
“নাহ্। এখন আর কার্পণ্য নেই। হাতখরচ নিয়মিত দেয়। কিন্তু কারোর কাছ থেকে নিতে আমার একদম ভালো লাগেনা। আদনান আমাকে হাতখরচ দেয়, টাকাটা বিষের মতো লাগে। ”
“তা কেন? এটা তোর অধিকার। আর তুই বসে বসেতো দিন কাটাসনা। বাচ্চাদের স্বাস্থ্য, লেখাপড়া, আদব কায়দা, নিরাপত্তা সব তুই দেখিস। সংসারের বাজার সদাই, সবার দেখাশোনা, মেহমান তুই সামলাস।এগুলো কাজ না? এগুলোর পারিশ্রমিক নেই? ”
“এগুলোর পারিশ্রমিক সরকার থেকে দিলে ভালো হতো। নিজে উপার্জন করেছি বলে মনে হতো। এই হাতখরচ শব্দটার মধ্যে সম্মানের নামগন্ধ রাখেনি সমাজ, বরং অপমানের গন্ধ আছে। আপা, তোরও কিছু করা দরকার।কতো ভালো ডাক্তার তুই। বুবুনতো বড়ই হয়ে গেলো,লুম্বিনী আর তুতুনকে ময়না খালা আদরে যত্নেই রাখবে। বেশি না, তিন চার ঘন্টা চেম্বার কর। খবর পেলে তোর রোগীরা হুড়মুড় করে চলে আসবে।”
তিতির খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আসিফের কাছ থেকে সে আর হাতখরচ নেয়না, নেবেওনা কখনো এমন একটা ইচ্ছা আছে। তার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কাহিনী আছে। সে এসব আর ভাবতে চায়না, বোনের দুঃখ আরও বাড়িয়ে দিতে চায়না। তারও বারবার মনে হয় কিছু করা দরকার। কিন্তু বাচ্চাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আর আগাতে পারেনা। প্রতিদিন কতো দুঃসংবাদ। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একই পরিবারের এতোজনের মৃত্যু। শর্ট সার্কিট হয়ে অ্যাপার্টমেন্টে দাউদাউ আগুন। লিফটে দুর্ঘটনা। রাস্তাঘাটে কথাই নেই। সেই শৈশব,কৈশোর, তারুণ্যে বাপ-মা -ভাই-বোন ছাড়া একদিনও থাকতে পারতোনা তিতির, এখনতো মাসে দুইবার দেখা। ছেলেমেয়েদেরও একদিন ছেড়ে দিতে হবে। তখন ছেলেমেয়েদের সাথে হয়তো মাসে একবার বা বছরে একবার দেখা হবে। রাজের সাথেতো আর কখনোই কোথাও দেখা হবেনা। পরকালে পরিবারের সদস্যদের সাথে আবার দেখা হয়, এই কথায় তেমন ভরসা নেই তিতিরের। এমন কথার উল্লেখ সে অন্তত পায়নি।
মাঝেমধ্যে দম আটকে যায়, নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয়। বাসায় রাজের শেষ রাতটার কথা মনে হয় বারবার। গলায় যতোটুকু জোর আনা সম্ভব , তাই এনে চিৎকার করছিলো রাজ। তিতিরের কয়েকদফা ইচ্ছা হয়েছিলো মেয়েটাকে আচ্ছামতো মার দেয়। ভাগ্যিস দেয়নি। মারধোরের হাত নেই তিতিরের।
জমজদের একসাথে ফিডার বানিয়ে দিতো তিতির। হুবহু এক চেহারা, এক জামাকাপড়,, এক চুলের ছাঁট। কিন্তু কে রাজ, কে লুম্বিনী , পরিষ্কার বুঝা যেতো। রাজ শুয়ে শুয়ে ফিডার খাওয়ার সময়ও স্হির থাকতে পারতোনা, সমানে দুই পা আছড়াতো। চিৎ অবস্থা থেকে বারবার উপুড় হয়ে যেতো, তারপর আবার চিৎ হওয়ার জন্য যুদ্ধ করতো। উঠে বসার চেষ্টা করতো।হাঁটা শেখার পরে সে কি যন্ত্রণা! সে শুধু হাঁটবে আর হাঁটবে। উন্মাদের মতো দৌড়াবে। ধুমধাম পড়বে। গলা ফাটিয়ে কাঁদবে। লুম্বিনীকে মা,বাবা, ভাইয়া, নানা আর বুবু…. এই কয়জনের কোলে দেখলে পাগল হয়ে যেতো রাজেশ্বরী। হামলা চালাতো বোনের উপর। আর সারাদিন দুর্বোধ্য ভাষায় আপন মনে কথা বলতে থাকতো নিচু গলায়। লুম্বিনী অতো চঞ্চল ছিলোনা। রাজ, এতো নিষ্ঠুর কেমন করে হলি মা? একবারও ভাবলিনা, তোকে হারিয়ে কতো ব্যথা বুকে নিয়ে তোর মা’কে বেঁচে থাকতে হবে? আর কতো বছর, কে জানে? শেষ নিঃশ্বাস পড়ার সময়ও তোর মুখটা চোখে ভাসবে, রাজ।
চলবে।