#সংসার
পর্ব ২৫
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
তিতির স্বপ্ন দেখছিলো। তার ছেলেবেলার স্বপ্ন। সে যখন ফ্রক পরে প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়াতো, সেই মিষ্টি দিনগুলোর স্বপ্ন। বৌচি, কিৎকিৎ, দাড়িয়াবান্ধা, ফুলটোক্কা খেলার স্বপ্ন। রাতে বড় ঘরের এক খাটে ঘুমাতেন নাজমুল সাহেব, নিশাত আর ছোট্ট তিতলী।আরেক খাটে নোমান আর তিতির। সারাদিনের লাফালাফি, ঝাঁপাঝাপি, স্কুল, লেখাপড়া সব শেষ করে তিতির যখন বিছানায় গা এলাতো, আরামে তার চোখ জুড়ে ঘুম আসতো।ঐ সময়ে বাগান থেকে ভেসে আসতো মাধবীলতার মিষ্টি , হালকা
আর হাস্নাহেনার তীব্র ঘ্রাণ। ঠিক ঐ সময়টাতে আজহার ভাই রিক্সা নিয়ে তাদের বাড়ি ফিরতো একই গান গাইতে গাইতে, “কেউ কোনোদিন আমারেতো কথা দিলোনা, বিনি সূতার মালাখানি গাঁথা হইলোনা।” আচ্ছা , বিনি সূতার মালা কি? তিতির যে তাদের বাগানের মাধবীলতা ফুল দিয়ে মালা বানায়, ওটাই বিনিসূতার মালা? আজহার ভাই বিনিসূতার মালা বানাতে পারছেনা কেন? এই মালা বানানোতো আহামরি কষ্টের নয়?
ফুলের ঘ্রাণে, রাস্তা থেকে ভেসে আসা গানে, প্রিয় মানুষগুলোর কাছে শুয়ে অপার্থিব শান্তি আর নিরাপত্তা অনুভব করতো তিতির।
ঘুম ভাঙার পরে এক সমুদ্র বিষন্নতা গ্রাস করলো তিতিরকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কেউ ডাকেনি তাকে। বাইরে আবছা অন্ধকার। ঘরেও কেউ লাইট জ্বালায়নি।এই পরিবেশে কার না মন খারাপ হয়?
বুবুন ভার্সিটি থেকে ফিরে তুতুনকে নিয়ে গেছে তুতুনের বনধুর জন্মদিনের পার্টিতে। দামী এক রেস্টুরেন্টে পার্টি। কেন বাবা, বাসায় করলে কি হয়? বিশেষ করে বন্ধুরা যখন শিশু। এক বাচ্চার এতো জমকালো বার্থডে পার্টি দেখলে আরেক বাচ্চারও ইচ্ছা হবে তার জন্মদিন এমন গর্জিয়াস হোক।হয়েছেও তাই। ঘুরে ফিরে তুতুন বন্ধুদের জন্মদিনের দাওয়াত পায়। বড় বড় রেস্তোরাঁতে। বুবুন তুতুনের সাথে যায়। কিন্তু পার্টিতে ঢোকেনা। আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। বা কোনো চায়ের দোকানে বসে। পার্টি শেষে তুতুনকে নিয়ে আসে।
লুম্বিনীকে চেক আপের জন্য নিয়ে গেছে আসিফ।
ময়না খালা চা নিয়ে এলো। ” আম্মা, আবার কানতেছেন? ”
“সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ডাকেননি কেন? ”
“নামাজ পড়ছেন? ”
“না। কাজা পড়ে নিবো।”
“বসে বসে না কাঁইদা নামাজটা পড়ে ফেলতেন। সময় আছিলোতে। বিনা কারণে নামাজ কাজা করবেন ক্যান? ”
“চুপ করেন।ইদানিং কথা বেশি বলেন আপনি। আমার কথা বলতে বা শুনতে একদম ভালো লাগেনা, বুঝেছেন? নিজের কাজ করেন, যান।”
“আম্মা, আপনে আবার হাসপাতালে কাজকাম শুরু করেন। বাচ্চারা সব বড় হইয়া গেছে। আর আমিতো আছিই। চোখ মোছেন আম্মা। আপনের কষ্ট আমি বুঝি গো মা। কিন্তু কষ্ট বুকে নিয়া শুধু কাঁদলে হইবো? এতে কি কষ্ট কমে আপনের? ”
“অনেক কথা বলছেন। এখান থেকে যান। আমাকে একা থাকতে দেন।”
“আম্মা, আপনে জানেন আমি বিধবা, আমার এক পোলা সাগর, বাড়িতে থাকে, আমারে দেখেনা, এক মাইয়া রুজী, স্বামীর লগে থাকে। আর কিছু জানেন আমার ব্যাপারে?”
তিতির উত্তর না দিয়ে ঘাড় গোঁজ করে বসে রইলো। তার ব্যবহার গৃহকর্মীদের সাথে বরাবরই খুব মধুর, আর ময়না খালা তার পরিবারের সদস্যের মতো, কিন্তু আজ কিচ্ছু শুনতে ইচ্ছা করছেনা, কিছু ভালো লাগছেনা। ছেলেমেয়েগুলো বাসায় থাকলে তাও জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে কাঁদলে মন ভালো হতো।
ময়না খালা কাহিনি বলতে লাগলো।আর এক পর্যায়ে বড় বড় চোখ করে সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলো তিতির। এতো ঘটনার পরও মহিলা এতো হাসিখুশি, কাজ পাগল? হা হা করে হাসা, গলা ফাটিয়ে আমেনার সাথে ঝগড়া করা, ছুটা খালা আর ড্রাইভারদের উপরে অহেতুক মাতব্বরি করা, পান খেয়ে চব্বিশ ঘন্টা ঠোঁট লাল টুকটুক করে রাখা, নাটক আর সিনেমা পাগল মহিলাটার জীবন এতো ভয়াবহ ? ময়না খালা এই বাড়িতে ষোলো বছর ধরে আছে, রাজ-লুম্বিনি-তুতুনের জন্মের আগের থেকে, শাশুড়ি এনে দিয়েছিলেন, সেই মহিলার জীবন এতো দুঃখময়, এতো বছরে সেটা না জানার জন্য নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছা হলো তিতিরের।
ময়না খালার বয়স যখন চৌদ্দ, তখন তার বাবা খুন হন পরিবারের চোখের সামনে। রাম দায়ের কোপে শরীর থেকে মাথা আলাদা হয়ে গিয়েছিলো। বাবাকে খুব ভালোবাসতো ময়না খালা। রক্তাক্ত বাবার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সে। দুইদিন জ্ঞান ছিলোনা। তিন মাস পরে ঐ পিশাচটার সাথে বিয়ে বসলো মা। মায়ের পরকীয়ার জেরেই বাবাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে বেঘোরে। গ্রামের সবচেয়ে বড় আর প্রভাবশালী জোতদার আর মা মিলে নকশা করেছিলো বাবাকে মেরে ফেলার। কোনো বিচার আচার হলোনা।জোতদারের আগের দুই বৌ বাচ্চা ছিলো। মা ময়নাদের তিন ভাইবোনকে বাপ-ভাইদের ঘাড়ে ফেলে কোলের বাচ্চাটা নিয়ে জোতদারের বাড়ি উঠলো।বাচ্চাটা নাকি জোতদারেরই। ময়না, রাশু, শাবানা… এই তিন অসহায় ভাইবোন বড় অনাদরে বড় হতে লাগলো নানার বাড়িতে। মামিরা উঠতে বসতে মারধোর করে, মা তুলে গালিগালাজ করে, খেতে দেয়না ঠিক করে। মামারাও তাই। নানা-নানির শরীরে বল নেই , টাকার জোর নেই , তাই চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া তাদের কিছু করার নেই। মামাতো ভাইটা এক নম্বর লম্পট ছিলো। ময়না আর শাবানার হেনস্হার সীমা থাকতোনা। একদিন ছোট্ট হাতে বিশাল ভাতের হাঁড়ির ফ্যান গালতে যেয়ে হাত ফসকে সব ফ্যান আর ভাত পড়লো শাবানার দুই হাত আর শরীরে। ঐ অবস্থায় মেজ মামীর হাতে মার খেতে হলো তাকে। চিকিৎসা হিসাবে চুন লাগানো হলো। কয়েকদিন পরে শাবানার অবস্থার বেশি অবনতি হলে কবিরাজের কাছে নিয়ে গেলো মামারা।পনেরো দিনের মাথায় সব শেষ। মেয়ের লাশ দেখতে মা আসেনি। সে তখন জোতদারের আরেক ছেলের মা হয়েছে।
নানা-নানি একে একে মারা গেলেন। নানির লাশ দেখতে মা আসলো। তেমন শোকগ্রস্ত না। বাপ-মা-ভাই -বাচ্চা কারোর উপরে মায়ের টান নেই বললেই চলে। মা শুধু চিনে নিজের সুখ, টাকা,গয়না,জমি। নানিকে দেখতে মা এলো নিয়তির টানে, কারণ রাশু একটা রাম দা নিয়ে আশ মিটিয়ে কোপালো মা’কে, কেউ ওর কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলোনা, রাশু কোপাচ্ছিলো আর মাটিতে দাপাতে থাকা মা’কে বলছিলো, ” নাগরের সাথে বাড়ি ছাড়তি। কেউ তরে বাধা দিতোনা। আমাদের বাপজানরে মারলি ক্যা রে? ”
রাশুকে পুলিশ এসে নিয়ে গেলো। এতোদিন ঘাড় গুঁজে মামা-মামির অত্যাচারে জর্জরিত , একদম চুপচাপ ছেলেটা পুলিশের সামনে মামা-মামিদের দিকে থুথু ফেলে বললো, ” ময়না বু’রে যদি আর একফোঁটা কষ্ট দিস, কসম খোদার, আমি ঠিক এই ভাবে তোদেরও মাথা ধড় আলাদা করবো। ”
ভাই আর ফিরলোনা। দীর্ঘ কারাবন্দী থেকে দুই বছর আগে তার ফাঁসি কার্যকর হয়।
হতভম্ব তিতির ময়না খালাকে জিজ্ঞেস করে, ” দুই বছর আগেতো আপনি এখানেই ছিলেন। ”
” আরজেন দরকার আছে কইয়া সাতদিনের জন্য বাড়ি গেলামনা? আসলে রাশুরে শেষ দেখন দেখতে গেছিলাম। আমারে কইলো, বুবু, শাবানা পুড়ে মরলো, আমি ফাঁসিতে মরবো, তুমি তোমার যত্ন কইরো।তুমি শান্তিতে থাকলে আমার, শাবানার আর বাপজানের আত্মা শান্তি পাইবো। আমি কইলাম, পাগলা, তোদের ছাড়া আমি খুব সুখে আছি, এইটাই তোর ধারণা? ভাই আমার কইলো, আমার মাথায় হাত দিয়া শপথ করো বুবু, তুমি ঠিকমতো খাইবা, নিজের যত্ন লইবা। তুমি সুখে থাইকো বুবু, কানবানা। দুয়া করবা, পরকালে তুমি,আমি, শাবানা আর বাপজান যেনো একসাথে থাকতে পারি।”
“কখনো এসব কথা কেন বলেননি খালা? ”
“আম্মা,সুখের কথা কইতে হয় মা, দুখের কথা কইতে হয়না।”
“আপনার সুখের কথা বলেন।”
” আপনে যখন কন, ময়না খালা, আমারে ছাইড়া আপনি কোথাও কখনো যাইবেননা, তুতুন সোনা যখন কয়, ময়না খালা,আমি তোমারে ভীষণ ভালোবাসি, লুম্বিনী যখন ব্যারাম উঠলে আমারেও ডাকতে থাকে,জড়াইয়া ধরে, বুবুন আমার জ্বরজারি হইলে যখন নিজে মাথায় পানি ঢালে, এট্টু পরপর খোঁজ খবর করে, নিজেই ঔষধ পথ্যের তালাশ করে, তখন আমার অনেক সুখ হয় আম্মা।”
“আপনার ছেলেমেয়েরা? সাগর আর রুজী? ”
রাশুকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার দুই মাসের মধ্যে ময়নাকে এক বিপত্নীকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় মামা -মামি। এরমধ্যে মামাতো ভাইরাতো বটেই , বড় মামাও ভোগ করেছে ময়নাকে। ময়নার স্বামী রুহুল দিনমজুর ছিলো, ভয়ংকর রাগী। কথায় কথায় বৌকেতো বটেই , মা’কেও পেটায়। ছয় বছরের ছেলে সাগর আর তিন বছরের রুজীকে ময়না বুকে টেনে নেয়। বাপ-মা হারা সন্তানের কষ্ট তার মতো করে কে আর বুঝে? রুহুল রাতে নেশা করে আসতো। পান থেকে চুণ খসলে বেদম মারতো ময়নাকে। ভয়ে ছেলেমেয়েরা কেঁদে উঠলে তাদেরও মারতে যেতো। ছেলেমেয়ে দুটোকে এতো আদর করে, নিজে মার খেয়ে বাপের মার থেকে বাঁচিয়েও মন পেলোনা ময়না। ছেলেমেয়েদের কানে বিষ ঢালতো তাদের দাদি, ফুপু,নানি,খালা। বিয়ের কয়েকবছরের মাথায় এক ঘোর বর্ষার রাতে মাথায় বাজ পড়ে ময়নার স্বামী মরে গেলো। তাতে দুঃখ হয়নি মোটেও ময়নার। কিন্তু আয় উপার্জনের দরকার যে। মানুষের বাড়ি ধান ভানার কাজ করে, থানার রাস্তায় ইট সুড়কি ভেঙে, কাগজের ঠোঙা বানিয়ে, অর্ডার দেওয়া শাড়িতে চুমকি বসিয়ে, চেয়েচিন্তে একটা পুরানো সেলাই মেশিন যোগাড় করে ব্লাউজ, পেটিকোট, কামিজ,পায়জামা বানিয়ে,মোট কথা, যে কাজই হোক সেটাকে আঁকড়ে ধরে আয় উপার্জন করতো ময়না। কোনো ভাবে পেট চলতো পাঁচজনের। তারপরে কঠিন অসুখ হলো আর বাড়িতে তার দরও পড়ে গেলো। সাগর তখন লায়েক হচ্ছে, কাজকর্ম ছাড়া সবকিছু করে। রুজীর চালচলন, হাবভাবও সুবিধার না। গায়ে একটু জোর হলেই ময়না কাজের জন্য বের হয়ে পড়তো। শ্বশুর মারা গেলেন। সাগর আর শাশুড়ি ঘোষণা দিলেন, ময়না এখন তাদের কেউ হয়না। তার অন্ন,বস্ত্রের দায় এ বাড়ির না। একদিন অনেক গালিগালাজ করে ময়নাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো। রুজীরও তাতে কিছু এসে গেলোনা। তারপরে আসিফের এক পরিচিতের হাত ধরে ঢাকায় আসা, তিতিরদের বাড়িতে কাজ নেওয়া।
“ওরা আমারে মা মানতে পারে নাই, কিন্তু আমি ওদের ভালোবাসছি। আপনেরা এতো বেতন দেন, প্রথম থেইকায় ওদের আমি টাকা পাঠাইছি।শাশুড়ির ভালো চিকিৎসা করাইছি, সে আমার কাছে মাফ টাফ চাইয়া মরছে, পোলার ঘর ঠিকঠাক কইরা দিছি, দুই শতাংশ জমি কিন্যা দিছি, বৌটা ভালো, সে পোলারে মন্দ পথে যাইতে দেয়না, মাঠে কাজ করে সাগরে। এখন মা,মা করে, তাদের বাড়ি গিয়া কয়দিন থাকতে কয়, আমার মন টানেনা। রুজীরে দেইখা শুইনা ভালো পোলার সাথে বিয়া দিছি। শাড়ি গয়না দিছি।জামাইরে আংটি আর ঘড়ি দিছি। টাকার জন্য পোলা -মাইয়া ফোন দেয়, আমি বইলা দিছি, ওদের জন্য আমার করনের আর কিছু নাই। রাজ, আমার সোনার ময়না পাখি চইলা গেলো, আম্মা,শুধু আপনেরই কষ্ট ? চোখের সামনে সোনার পুতলা জন্মাইলো, চোখের সামনে দিয়াই চইলা গেলো। আমি নিজের বাপরে খুন হইতে দেখছি, মা’রে এখনো ঘিন্না করি,তারে খুন হইতে দেখছি, ছোটো বইনরে পুইড়া মরতে দেখছি, ভাইয়ের জিভ বের করা লাশ নিয়া আসছি জেলখানা থেকে, আমারে কেউ ভালোবাসেনাই কোনোদিন, তাওতো আমি বাঁইচা আছি, আমি কামকাজ করি, হাসি। ফাঁস নিয়া মরতে পারতাম, বিষ খাইতে পারতাম, করিনি। আল্লাহ জান দিছেন, আল্লাহ জান নিবেন। কষ্ট ভুইলা থাকার চেষ্টা করি আম্মা। যদ্দিন হায়াত রাখছে আল্লায়, তদ্দিন এট্টু সুখে বাঁচার চেষ্টা করি। আপনেও তাই করেন, আম্মা। মায়ের কষ্ট দেখলে পোলাপানরা বেশি কষ্ট পায়, মনের রোগে ধরে, তাদের মনে শান্তি স্বোয়াস্তি কিছুই থাকেনা। এক সন্তানের জন্য আপনে তিন সন্তানের ক্ষতি করতেছেনগো আম্মা। ”
তিতির চোখ মুছলো। নিজের দুঃখে বিভোর হয়ে থাকা অন্যায়। রাজের জন্য তার সীমাহীন কষ্ট অবশ্যই দুঃখবিলাস নয়, কিন্তু সেই কষ্টকে নিজের চেষ্টায় সহনীয় করতে হবে। প্রায়ই অসুস্থ থাকা বাবা-মায়ের তত্ত্ব তালাশ নিতে হবে ভালো করে। বুবুন-লুম্বিনী-তুতুনের স্বাস্থ্য, মন, লেখাপড়া, বিনোদনের যত্ন নিতে হবে। আসিফ হাসপাতালের কাজ ছাড়া অন্য সময় ঝিম মেরে থাকে। ওকে বেশি কোয়ালিটিফুল সময় দিতে হবে। নোমান-তিতলী, ভাইবোনদের বাচ্চাদের ভালো-মন্দের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।ময়না খালা,আমেনা ও তাঁদের মতো ভাগ্যতাড়িত মানুষ যাঁরা, তাঁদের স্হায়ী ভাবে স্বচ্ছল, সুখী, আত্মনির্ভরশীল করার চেষ্টা করতে হবে। এই যে ময়না খালা, আল্লাহ তাঁকে অতি দীর্ঘ আয়ু দিন দয়া করে, যখন কর্মশক্তি হারাবে, কিংবা স্ট্রোক করে বিছানায় পড়বে, কে তাকে দেখবে দিনের পর দিন? তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা করা উচিত নয়? কতো কাজ! ইচ্ছা করলে কতো কাজ করা যায় এক জীবনে !
বেঁচে থাকলে আরও কতো প্রিয়, কলিজার টুকরো মানুষদের চিরবিদায় জানাতে হবে! উফ্, ভাবা যায়না। কিন্তু এভাবেই আল্লাহ মানুষের ধৈর্য, আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা, তাঁর উপরে বান্দার বিশ্বাস ও আস্হা পরীক্ষা করেন। আগের সুখের স্মৃতিচারণ করে নয়, যখন যে পরিস্থিতি আসে, তখন সেই পরিস্থিতিকে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করাই জীবনের লক্ষ্য।
তিতির তার বড় খালাকে ফোন করলো। রাজের মৃত্যুর পর এই প্রথম। অথচ বড় খালা, ছোটো খালা, মামারা, চাচা-চাচিরা, ফুপু, কাজিনরা সবসময় খোঁজ খবর করেন তিতিরের, তার পরিবারের। ফোন করেন, বাসায় আসেন, দাওয়াত দেন, খাবার পাঠান। এখন থেকে তিতিরও তার মামা,খালা,চাচা,ফুপু, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আগের মতো সম্পর্ক রাখবে, বেড়াতে যাবে, আহলাদ করবে ছোট্ট বেলার মতো,, বাসায় নিয়ে আসবে।
বাঁচতে হবে তিতিরকে। বাঁচার চেষ্টা করতে হবে।
চলবে
#সংসার
২৬ তম পর্ব
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
অরণ্য স্কুলে যাবেনা।ওর নাকি পেট ব্যথা করছে। তিতলী বললো, “পেটব্যথা বাসায় যেমন করছে, স্কুলেও তেমনি করবে। তাহলে স্কুলে সমস্যা কোথায়? ”
“বা রে, স্কুলে পড়তে হয়, পিটি করতে হয়, ব্যথা আরও বেড়ে যাবেনা? ওখানে কি আর বিশ্রাম নেওয়া যাবে? ”
তিতলী পরিস্কার বুঝতে পারছে, অরণ্যের কোন পেট ব্যথা নেই। মুখে কাতর ভাব ফুটিয়ে তোলার সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও অভিনয় যথার্থ
হচ্ছেনা। ঘন ঘন পেট ব্যথার কথা বলে বহুৎ সুবিধা কামিয়েছে অরণ্য। গত সপ্তাহে পেটের আল্ট্রাসনো, স্টুল টেস্ট, ইউরিন টেষ্ট, ব্লাড টেষ্ট সব করিয়েছে তিতলী। সব নরমাল। তাছাড়া ব্লাড টেষ্টের আগে বাচ্চাটা নিজেই চিৎকার করে বলেছে, ” আমার কোন পেট ব্যথা নেই। স্কুলে না যাওয়ার জন্য বানিয়ে বলেছি।”
আদনানের মা এসে নাতিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ” লাগবেনা আজ স্কুল যাওয়া। আয়, তুই আমার ঘরে শুয়ে থাক।”
” স্কুল মিস করা যাবেনা মা।আপনিতো জানেনই, স্কুলে না যাওয়ার জন্য ও কতো ফন্দি ফিকির করে। গত সপ্তাহেইতো ডাক্তার বললেন কোন অসুবিধা নেই। ”
” একদিন স্কুল না গেলে কিছুই হবেনা।”
” মা,বিভিন্ন কারণে স্কুলে গ্যাপ পড়তে পারে। তাই কোন সমস্যা না থাকলে কোনোভাবেই গ্যাপ দেওয়া ঠিক না। অরণ্য -অরণী, রেডি হও।”
অরণ্য মুখ করুণ করে বললো, ” দীদান….. “,
দীদানও বললেন, ” তিতলী, আমি নিষেধ করছি। আমি যখন কথা দিয়েছি ও স্কুলে যাবেনা, তখম যাবেনা। ”
তিতলী দেখলো, আদনান ল্যাপটপের ভেতরে প্রায় ঢুকে পড়েছে। মা,স্ত্রী আর ছেলের কথা যেন শুনতেই পাচ্ছেনা।
তিতলী ঠান্ডা গলায় ডাকলো, ” আদনান। ”
আদনান আরও মনোযোগী হয়ে পড়লো।
তিতলী একটু উঁচু গলায় ডাকলো, “আদনান।”
“হ্যাঁ ? ডাকো? ”
“অরণ্য স্কুল যেতে চাচ্ছে না। মা সাপোর্ট দিচ্ছেন। অরণ্যের মিনিমাম শারীরিক সমসা নেই। এই মাসে যথেষ্ট কামাই হয়েছে। তুমি ল্যাপটপ থেকে মুখ তোলো এবং ছেলেকে বলো স্কুল বাদ দেওয়া যাবেনা।”
আদনান বললো, “অরণ্য , যাও বাবা, দেরি করোনা। ”
অরণ্যের দাদি হুংকার দিয়ে উঠলেন, “আমি নিষেধ করেছি আর তুই আমার কথার উপরে কথা বলিস৷! ”
“তুমি নিষেধ করেছো তাতো আমি জানিনা। তিতলী, থাক, আজ না হয় নাই গেলো।”
অরণী বললো, “ভাইয়া না গেলে আমিও যাবোনা “।
আদনানের মা উদার গলায় বললেন, ” যাসনা! আমরা বরং তোর বড় দাদির বাসা থেকে ঘুরে আসবো আজ।”
তিতলী বললো, ” বড় দাদির বাসায় আজ স্কুল ডে’তে যাওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব না। অরণীর ম্যাথ ক্লাস টেষ্ট আছে।”
অরণী সরু গলায় বললো, “একটা সিটি না দিলে কিচ্ছু হয়না। ভাইয়া যাবেনা আর আমি যাবো, এমন হবেনা।”
তিতলী দুই হাতে দুই বাচ্চাকে ধরলো। তারপরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলো ঘরে।সপাটে চড় লাগালো দু”জনের গালে। হিসহিসিয়ে বললো, “আর একদিন যদি আমার অবাধ্য হয়েছো, তবে দেখো কি করি। সোজা কোনো হোষ্টেলে দিয়ে দিবো এবং আমার সাথে তোমাদের কখনোই দেখা হবেনা, তোমাদের এই ঘরেই ঢুকতে দিবোনা। ”
কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চা দুটো স্কুল রওনা হলো। তিতলীও চলে গেলো ওদের সাথে। এই মুহূর্তে স্বামী -শাশুড়ির মুখ দর্শনের ইচ্ছা হচ্ছে না। তার পাগল পাগল লাগছে। সে গাড়ি নিয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়াবে নইলে বাবা-মা’কে দেখতে যাবে।মায়ের শরীর কিছুদিন যাবৎ ভালো যাচ্ছেনা।
এদিকে আদনানের মা ছেলের সামনে কেঁদে কেটে অস্হির। বৌ কথা না শুনে মেজাজ দেখিয়ে চলে গেলো, ছেলে কিছু বললোনা? বৌয়ের ভেড়া।
আদনান ফেসবুকে পোষ্ট দিলো, ” মা আর স্ত্রীর মাঝখানে আমি পিষ্ট। নারী নির্যাতন নয়, দেশে পুরুষ নির্যাতন বেশি হয়। বিয়ের পরে সবচেয়ে কষ্টকর পরিস্থিতিতে থাকে একজন পুরুষ। ”
তিতির পোষ্ট পড়ে হাসলো। দুর্বল ব্যক্তিত্বের পুরুষদের এইতো হবে। নারী নারীদের শত্রু হোক আর না হোক, একজন পুওর পারসোনালিটির পুরুষের জন্য ই কোন এক পক্ষ বেশি লাই পেয়ে যায়।
তিতলী অনেক করেছে আদনান আর তার পরিবারের জন্য। বিনিময়ে আদনান আর তার পরিবার কি করেছে? যতো পারে, নারকীয় যন্ত্রণা দিয়েছে। আদনানের মা হয় একজন নির্বোধ , নইলে অতি চালাক। অনেক নাটক করেন তিনি যা আদনানও বুঝে। সেক্ষেত্রে মা’কে সে সুন্দর করে বুঝাতে পারে। মায়ের অন্যায়গুলো আদনান বুঝতে পারেনা, এতোটা সরল সে নয়৷ কিন্তু মা’কে অশ্রদ্ধা না করে তাঁকে তাঁর ভুল সুন্দর করে ধরিয়ে দিতে একজন সন্তান পারেনা? নিশ্চয় পারে। তা না, বুঝেশুনেও অনেক ছেলে মায়ের পক্ষ নিয়ে বৌয়ের সাথে ঝগড়া করে।
উল্টোটাও আছে। নোমান-তমা। তমার মতো বেয়াদব , স্বার্থপর, বিবেচনাহীন, অশান্তিপ্রিয় মেয়ের সংখ্যা এখন নেহায়েত কম নয়। কিন্তু নোমান? তার কার্যক্রম কোন স্ট্যান্ডার্ডের ছিলো? নোমান নিজেকে বড় বুদ্ধিমান মনে করে। ভাবে, সে যেভাবে ভাবছে,কাজ করছে, কথা বলছে, সেটাই ঠিক। আদতে একদমই তা নয়। বিয়ের পরে নোমান তমা ছাড়া কিছু বুঝেনা।এতে নাজমুল সাহেব, নিশাত, তিতির-তিতলীও খুব খুশি। সবার ভালোবাসার সুযোগ নিয়েছে মাথামোটা তমা। সে যে মিথ্যাবাদীও, এটা মাথায়ও আনেনি পরিবারের কেউ। এ-তো অকল্পনীয়। দিনের শেষে নোমানের কানে নানা মন্ত্র দিতো তমা। শাশুড়ির নামে মিথ্যা বলতো।তার উপরে অত্যাচারের অলীক গল্প শোনাতো স্বামীকে। নোমান শুনতো আর ভিতরে ভিতরে ফুঁসতো। জন্ম থেকে চেনা বাপ-মা-বোনদের সে নতুন করে চিনলো বৌয়ের কাছ থেকে। আল্লাহ উপর থেকে সব দেখেন। তাই কয়েক বছর পরে তমার সব মিথ্যা সবার সামনে ধরা পড়লো। তাতে তমার চরিত্র পাল্টালোনা। তার আচরণ ও মানসিকতা খারাপ থেকে খারাপতর হতে লাগলো।
এখানে দায়ী কে? নোমান দায়ী নয় কোনোভাবে? কানপড়া কথাগুলো নিয়ে তমার সামনেই সরাসরি মা-বোন-বাপকে জিজ্ঞেস করতে পারতোনা যে তমার সাথে তার ফ্যামিলি মেম্বার এমন এমন আচরণ করে কীনা।তাহলে প্রথমেই তো চোর ধরা পড়তো। যখন তমার বহু কুকর্ম ধরা পড়লো, তখন নোমান কেন পারলোনা তমাকে কন্ট্রোলে আনতে? দরকার হয় তালাক দিতো! তাতে ইরফান -আয়মান গভীর গাড্ডায় পড়তো। ইরফান -আয়মান এখন কি সুখে আছে? নেই, একদমই নেই।
চলবে।