সংসার পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0
47

#সংসার
পর্ব ৪৫
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

যেদিন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় আসলো আসিফ, সেই রাতে বাচ্চারা ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে শুয়ে থাকা তিতিরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো সে, হাত রেখেছিলো স্ত্রীর মাথায়। তিতির উঠে বসেছিলো। তারপরে খুব নিচু, নরম গলায় বলেছিলো, ” আমি আর কখনো আমাকে স্পর্শ করতে দিবোনা, আসিফ। আমৃত্যু না। আমার মৃত্যুর পরে ধর্মীয় ভাবে এমনিই আমাকে ছুঁতে পারবেনা। মনে মনে হাসছো। আমার মতো কুরূপার কতো বড় দম্ভোক্তি ! আমাকে না ছুঁলে তোমার কিছু এসে যাবেনা। কিন্তু তোমার জৈবিক চাহিদা পূরণের মাধ্যম আমি হতে পারবোনা। তোমার যদি শারীরিক চাহিদা বেশি হয়, তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও। ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলে আইনসম্মত ভাবে বিয়ে করো। আমি কোনো কষ্ট পাবোনা, কোনো বাধা দিবোনা। ছেলেমেয়েরা যেন বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নেয়, তোমার সাথে তাদের এমনই ভালো সম্পর্ক থাকে, তোমার নতুন স্ত্রীর সাথেও তাদের ভালো সম্পর্ক থাকে, তার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো আমি। কিন্তু পাপের পথে আর ভুলেও পা রেখোনা।লুকোচুরি খেলোনা।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসিফ বলেছিলো, ” জানি, আমাকে ক্ষমা করা তোমার জন্য খুব কঠিন। কিন্তু তিতির, বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। মাঝখানে ট্র্যাপে পড়ে, এটাও সত্যি, শরীরী মোহে পড়ে তোমার থেকে দূরে ছিলাম, খারাপ ব্যবহার করেছিলাম, ঘৃণাও করেছিলাম।কিন্তু সেগুলো ছিলো সাময়িক ভিমরতি। তোমাকে আমি বরাবরই ভালোবেসেছি, আজীবন ভালোবাসবো। আর আমি ওয়াদা করছি, কখনোই আমি অন্য কোনো নারীকে জীবনে স্হান দিবোনা, দিতে পারবোনা। তোমাকে আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালোভাবে জীবন কেটে যাবে। আমি তোমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে স্পর্শ করবোনা, যদিও আমার সবসময় ইচ্ছা হবে তোমার মাথায় হাত বুলানোর, তোমাকে চুমু খাবার। বাই দ্য বাই, আবারও আমি ক্ষমা চাচ্ছি তিতির।আবারও বলছি, আই লাভ ইউ সো মাচ। সো মাচ।”

তারপরে দু’জন দু’দিকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। দু’জনেই একই চিন্তা করতে লাগলো, কিভাবে বুবুনকে স্বাভাবিক করা যায়।

বুবুন ভার্সিটি থেকে বেশ দূরে একটা বাসায় ভাড়া থাকে আরও তিন বাংলাদেশি ছাত্রের সাথে। ভার্সিটিতে হেঁটে আসা যাওয়া করে।রান্না চারজনে রুটিন অনুযায়ী করে। একটা রেস্তোরাঁতে পার্ট টাইম চাকরি করে। এতো কিছু করতে পারছে ভয়ংকর জেদের কারণে। পড়াশোনায় এতোটুকু ফাঁকি নেই। রাতে ক্লান্ত হয়ে যখন শোয়, তখন রাজেশ্বরীর কবরটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে।লুম্বিনী, তুতুন, ইরফান, আয়মান, অরণ্য, অরণীকে জাপটে ধরতে ইচ্ছা করে। শেষের কয়েক মাস তুতুনের সাথে ভীষণ দুর্ব্যবহার করতো, কান ধরে মুচড়ে দিতো, গাল মুচড়ে লাল করে দিতো, চড় লাগাতো তুলতুলে গালে বা পিঠে, এসব মনে করে কাঁদে বুবুন।
নানা-বুবু-মামা-তিতলী আম্মুর জন্য ভীষণ কষ্ট হয়। যদিও ভিডিও কলে কথা হয়, কিন্তু ছোঁয়া তো যায়না। ময়না খালা, আমেনা বুবু, আরও কতো মানুষ! কতো প্রিয়জন!

আর দুটো মুখ ভারি বিরক্ত করে। ঘুমাতে দেয়না। বড় বড় দীপ্তিময় দুটি চোখ, কালো ফ্রেমের চশমা, খাড়া নাক, দারুণ পুরুষালী চেহারা, পাঁচ ফিট নয় ইঞ্চির ছিপছিপে লম্বা শরীর, সবসময় ফিটফাট, স্যুটে যেমন অভিজাত, পাঞ্জাবী পায়জামাতেও সমান আকর্ষণীয়, মৃদুভাষী, দারুণ স্মার্ট। অপর মুখটি একটু চৌকো ধরণের, পাতলা খাটো চুল, ছোটো দুটো চোখ, পাপড়ি কম বলে কেমন মরা মরা, একটু চাপা নাক, চাপা শ্যামলা, মুখে বেশ দাগ, পাঁচ ফিট লম্বা, রোগা, লিকলিকে, নিরাভরণ, সাদামাটা শাড়ি নইলে সালোয়ার কামিজ। দূর থেকে আওয়াজ ভেসে আসে, “আ-রি-য়া-ন, বা-বু-ই, আমার বাবুই পাখি। বুবুন সোনা, চাঁদের কণা, আমার জান।” কেমন যেন আলাদা ঘ্রাণ তার শরীরে, আর কোথাও এই মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায়না। মা আট বছর বয়স পর্যন্ত বুবুনকে কোলে নিয়ে ঘুরেছে, চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত কোলে বসিয়ে রেখেছে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। লুম্বিনী -রাজেশ্বরী -তুতুনের আগমনে, রাজ্যের ব্যস্ততায়, অসুখে বিসুখে কোনো অবস্হায় কমেনি এই উদগ্র মাতৃস্নেহ। আরিয়ান নাম কবে বিলুপ্ত হয়েছে “বুবুন” নামের আড়ালে। আর বাবা নামের লোকটা? ছেলেবেলায় বুবুন বাবার কোলে, পিঠে, ঘাড়ে ঝুলে থাকতো যতোক্ষণ বাবা বাসায় থাকতো। বাবা বেড়াতে নিয়ে যেতো বুবুনকে কতো জায়গায়… দেশে বিদেশে। হাসপাতালের বাইরে বাবা তাদের চার ভাইবোন আর মায়ের সাথে সময় কাটাতো। বুবুন বাবার ভীষণ আদরের ছিলো। এছাড়া সে নিজের চোখে দেখেছে দুই জমজ আর তুতুনের ছেলেবেলায় বাবা-মা দু’জনেই কেমন নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। রাতে দফায় দফায় দুধ বানানো, খাওয়ানো, কোলে নিয়ে রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটা…. মারাত্মক। ঠিক এই ভাবে, এমনই কষ্ট করে বুবুনকেও মানুষ করেছে তারা, সন্তানদের প্রতি ভালোবাসায়,কর্তব্যে কোন গাফিলতি করেনি । তাহলে তাদের সাথে এমন আচরণ বুবুনের করা উচিৎ? পরকীয়ায় ডুবে থাকা বাবা তো বুবুন,লুম্বিনী, তুতুনকে কিচ্ছু বুঝতে দেয়নি, সন্তানদের প্রতি ভালোবাসায়, দায়িত্বে ঘাটতি পড়েনি এতোটুকু, ভুল বুঝেছে বাবা, ক্ষমা চেয়েছে বাবা, ক্ষমাপ্রার্থনা যে খুবই আন্তরিক ছিলো এতে কোন সন্দেহ নেই বুদ্ধিমান বুবুনের, তবু কেন এতো রাগ উঠে, শরীর মন জ্বলতে থাকে, কিছু একটা ভাঙতে ইচ্ছা করে, সারা পৃথিবীর উপরে রাগ হয়? মেয়েটা একটা চরম অশ্লীল কথা বলেছিলো আসিফ আর তার নিজেকে নিয়ে, ঐ বাক্যটা কাউকে বলতে পারেনি বুবুন।কি অশ্লীল ! কি অশ্লীল! বুবুনতো এমনও শুনেছে, “আমার পেটে তোমার বাবার সন্তান। তোমার বাবা,আমি, আমাদের সন্তান… এই নিয়েই হবে আমাদের ফ্যামিলি।” তখনও তো এতোটা কষ্ট লাগেনি বুবুনের, প্রাণপণে মুখের পেশি সে স্বাভাবিক রেখেছে, তারপরে পৃথিবীর সেই অশ্লীলতম বাক্য। পৃথিবীর উপরেই ঘেন্না চলে এসেছিলো বুবুনের আর সেই সাথে ভয়ংকর রাগ। অসহনীয় রাগ। মায়ের প্রতিও ঘৃণা। কেন? মা’তো পাপ করেনি? মা নিজেই ভিকটিম। তবু কেন মায়ের উপরে এতো ক্ষোভ, নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর পায়না বুবুন।

বুবুন ছাড়বেনা।নাজলী দুনিয়ার যেখানে থাকুক, তাকে কঠোরতম শাস্তি দিবে বুবুন।তিলে তিলে এবং বীভৎস ভাবে নাজলীকে খুন করবে আরিয়ান, এ বিষয়ে সে বদ্ধপরিকর।

ঐদিন স্বপ্ন দেখলো বুবুন, তাদের বাড়িতে জম্পেশ গেট টুগেদার হচ্ছে, নানা ভাই, বাবা আর মামা কি নিয়ে যেন গল্প করছে আর চা খাচ্ছে, খালু একটা হিন্দি ফিল্ম দেখছে, তিতলী আম্মু প্লেটে খাবার মাখিয়ে তুতুন, আয়মান, অরণ্য, অরণীকে খাইয়ে দিচ্ছে। লুম্বিনী বুবুর কোলে বসে কিসব যেন গল্প করছে, রাজের লম্বা চুলে বেণী করে দিচ্ছে মামি। ইরফান বুবুনকে সমানে টানছে, “উঠো না ভাইয়া, চলো, ছাদে ক্রিকেট খেলি।” এতো জীবন্ত স্বপ্ন। বুবুনের বেশ খানিকটা সময় লেগেছিলো ধাতস্থ হতে। তীব্র সুখানুভূতি। তারপর আস্তে আস্তে বাস্তবে চলে আসার পরে বালিশে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়লো বুবুন, আর মনে মনে ডাকতে লাগলো, ” মা, মা, মা। ”

পরের দিন বুবুন হারুন আংকেলের বাসায় দাওয়াত খেতে গেলো। বাবার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু হারুন আংকেল। প্যাথোলজিস্ট। মায়ের সাথেও দারুণ সম্পর্ক আংকেল -আন্টির। আন্টি দেশে স্কুলে চাকরি করতেন। উনাদের দুই মেয়ে, শর্মিলা আপা আর ঊর্মিলা আপা। আপারা স্বাবলম্বী, বিয়ে হয়ে গেছে
দু’জনের। একজন অস্ট্রেলিয়া, আরেকজন ফিনল্যান্ড থাকেন। বুবুন জানে, বেশিরভাগ আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত বাবার কেলেংকারির খবর না জানলেও হারুন আংকেল -আন্টি জানেন। মা জানিয়েছে। পরামর্শ চেয়েছে। বুবুন এখানে আসার পর থেকে আংকেল -আন্টি নিয়মিত খবর নেন। প্রথম দিন তাঁদের দেখে বুবুন ক্ষেপে লাল। কে বলেছে উনাদের ওর কানাডায় আসার ব্যাপারটা? ও তো হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া আর কোনো পরিচিতের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়না। নিশ্চয় এটা ঐ লোক আর মহিলার কাজ। ফোন করে বন্ধুদের জানিয়েছে , “আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রেখো,আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রেখো।” ন্যাকা। বুবুন নিজেই নিজেকে দেখে রাখতে পারে। আত্মমর্যাদাবোধহীন ঐ মহিলা আর লুম্বিনী -তুতুনকেও দেখে রাখতো বুবুন, মাথায় তুলে রাখতো,যদি মহিলা ঐ লোকের সাথে সম্পর্ক না রাখতো। ছি,ছি,ছি, এতো ঘটনার পরেও মহিলা ঐ লোকটার সাথে থাকে, ঐ লোকের অন্ন খায়, ঐ লোকের টাকায় সংসার চালায়, ঐ লোকটার সাথে এক টেবিলে খেতে বসে, এক বিছানায় ঘুমায়, একসাথে বেড়াতে যায়। ঘেন্না,ঘেন্না। লোকটার সাথে সম্পর্ক রেখে মহিলা নিদারুণ অবিচার করেছে বুবুন, লুম্বিনী, তুতুনের সাথে। বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা হয়ে মহিলা তাদেরকে একটা লুম্পেনের অভিভাবকত্বের কালো ছায়া হতে দূরে রাখতে পারতো।

তবে আংকেলের কঠিন ব্যক্তিত্ব আর আন্টির অপরিসীম মমতা বুবুনকে ফোঁস করতে দেয়নি। তাকে মাঝে মাঝে আসতে হয় এই বাড়িতে।মনটা যতো পাথর হয়ে যাক, তবু এই পাথর মন ভিন দেশে একটু খাঁটি মমতা আর আদরের জন্য খাঁ খাঁ করে।

খাওয়া শেষ হলে শুরু হলো আড্ডা। বহুকাল পরে শর্মিলা আপা, উর্মিলা আপা এসেছেন। এসেছে তাদের বাচ্চারাও।

বাচ্চারা খেলছে বাগানে। খোদ আংকেল আন্টির বেডরুমে চলছে আড্ডা। বুবুনের বুকের মধ্যে হু হু করছে। তারও একটা পরিবার ছিলো।বাবা,মা, ভাই, বোন, নানা,নানি, মামা,খালা,তাদের বাচ্চারা। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আর কখনো বাবা-মায়ের মুখ দেখা হবেনা, বাবা-মা বলে ডাকা হবেনা।

“কি ভাবছিস এতো পুচ্চি? বাসার কথা, বাপ-মায়ের কথা, তাইতো? খুব ঘেন্না বাবার উপরে? বাবাকে সাপোর্ট করার জন্য মায়ের উপরেও,তাইনা? ”

বুবুন অপ্রস্তুত হলো।আপাদের সামনে আন্টি কথাগুলো না তুললেও পারতেন।

ঊর্মিলা আপা বুবুনের কান ধরে বললো, “এই হাঁদারাম ! আসার পর থেকে ইয়েস, নো ছাড়া কথা বলছিসনা। মাথাটা এতো ঝুঁকিয়ে রাখিসনা, ঘাড় ব্যথা হয়ে যাবে। কথা বল, হাসাহাসি কর, বাঁদর। ”

রাশভারি আংকেল বললেন, ” বুবুন বাবা, আজ তোমাকে নিয়ে এসেছি কতোগুলো কথা বলবো বলে। ভারি লজ্জার কথা। কিন্তু তুমি তোমার বাবা-মায়ের ছেলে। তোমার বাবা-মা যেমন কারোর গোপন কথা অন্য কাউকে বলেনা, তুমিও নিশ্চয় তাই। শোনো বাবা, আমি হাসপাতালে এক লেডি ডক্টরের চক্করে পড়ে যাই। এভাবে একজনকে দোষারোপ করা ঠিক হবেনা, দুইজন দুইজনের চক্করে পড়ি। চক্কর, বুঝেছো বাবা? চক্কর। প্রেম নয়। বন্ধুরা কমপেয়ার করতো, কে বেশি হ্যান্ডসাম, ম্যানলি, তোমার বাবা না আমি? নিজেই বলি, আমি, তোমার বাবা দু’জনেই খুব হ্যান্ডসাম। স্টিল নাও। অসংখ্য মেয়ে এবং মহিলারা আমাদের উপর ক্রাশ খেতো। আর সেই আমি ঐ ডক্টরের চক্করে পড়লাম। আমি কখনোই মেয়েবাজ ছিলামনা। কিন্তু সাময়িক ভাবে আমার চরম অধঃ পতন হলো। আমরা পরস্পরকে বিয়ে করবো এমন সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের মধ্যে সবরকম সম্পর্ক ছিলো। তোমার আন্টিকে আমার তখন অতোটা ভালো লাগতোনা, অবৈধ সম্পর্কে জড়ালে যা হয়। কিন্তু শর্মি,ঊর্মির প্রতি আমার ভালোবাসা তিলমাত্র কমেনি। এদিকে ঐ মহিলা প্রায় প্রতিদিন আমার মানিব্যাগ থেকে প্রচুর টাকা খসায়। আমার কামাই ভালো ছিলো, পৈতৃক সম্পত্তি প্রচুর। আজ ডায়মন্ডের আংটি, কাল সোনার নেকলেস, পরশু দামি ঘড়ি,এইসব চলতো আর কি! তোমার বাবা জেনে ফেললো। আমাকে একটা ঘুষিও মেরেছিলো তোমার বাবা, রাগে। সোজা ঐ মহিলাকে থ্রেট করেছিলো। কিন্তু আমি তখন অন্ধ। মহিলা এদিকে আমার কোথায় কোন সম্পত্তি, কয়টা বাড়ি, কোন কোন জায়গায় জমি, সব জেনে নিয়েছে। আমি তোমার আন্টির কাছে দ্বিতীয় বিয়ের পারমিশন চাইলাম।এও বললাম, পারমিট না করলে কিভাবে তা আদায় করতে হয়, তা আমার জানা আছে। শর্মি,ঊর্মির সামনেই আমি প্রচণ্ড অশান্তি করতাম। এদিকে ঐ মহিলা আমাকে শর্ত দিলো, তাকে বিয়ে করতে হলে অবশ্যই ফার্স্ট ওয়াইফকে ডিভোর্স দিতে হবে, নতুন সংসারে আমার মেয়েদের রাখা যাবেনা, এতো বেশি খরচ তাদের পিছনে করা যাবেনা, আমাদের নতুন সংসার হবে, সন্তান হবে, মহিলাকে বিয়ের আগেই আমাকে গুলশানের ফ্ল্যাট লিখে দিতে হবে আর ইস্কাটনের বাড়িটা। বিয়ে উপলক্ষে কমপক্ষে পঁচিশ ভরি গোল্ডের অর্নামেন্ট দিতে হবে। আমার মোহ কিছুটা কাটলো।তোমার আন্টি জীবনে একটা শাড়ি আমার কাছে চায়নি, আর এই মহিলা বিয়ের আগেতো লক্ষ লক্ষ টাকা খসিয়েছে, আবার বিয়ের আগেই সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে। আমি একদিন একটানা ভাবলাম। শুরু থেকে শেষ। কিভাবে সে আমাকে অ্যাপ্রোচ করলো, বিয়ের আগেই সে কতো বোল্ডলি আমার সাথে মিশলো, অ্যান্ড সি ওয়াজ ভেরি ভেরি শেমলেস লাইক এ প্রফেশনাল প্রস্টিটিউট ইন বেড। সি ওয়াজ সো মাচ গ্রিডি। আমি রিয়েলাইজ করলাম কি ভয়ংকর পাপে আমি মজে আছি। আমার ক্যারেক্টার স্ট্রং নয়। স্ট্রং হলে বিবাহিত, সুখি, একজন বাবার অন্য মেয়েতে আকৃষ্ট হওয়ার কথা না। বিয়ে না করেই এতোবার ফিজিক্যাল রিলেশন সম্ভব না। আর কোথায় তোমার আন্টি আর কোথায় দ্যাট পুওর লেডি?আমি তোমার আন্টির কাছে পেয়েছি শান্তি,স্বস্তি, আশ্রয়, খাঁটি ভালোবাসা, দুঃখ-কষ্ট বা বিপদের সময় সাপোর্ট। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আর ঐ মহিলার কাছ থেকে আমি কি পাচ্ছি? যে মোহতে তার কাছে যেতাম, সেই মোহ কয়দিনের? আমার মোহভঙ্গ হলো। নিজের প্রতি লজ্জায়, ঘৃণায় আমি সুইসাইডের ডিসিশন নিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিলো ভেবে, আমার আত্মহত্যা নিয়ে কতো মুখরোচক আলোচনা হবে, আমার আসল চরিত্র, নারীলোভী চরিত্র সবাই জেনে যাবে, আমার স্ত্রী কতো কষ্ট, অপমান, অপবাদের শিকার হবে, আর আমার দুই মেয়ে? তাদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব অন্ধকারে ভরে যাবে। কিন্তু বেঁচে থাকাটা আমার কাছে দুর্বহ লজ্জা। যদিও হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানতোনা, কিন্তু সেটা আমার কাছে বড় বিষয় ছিলোনা। আমার বিবেক আমার সবচেয়ে বড় অ্যান্টিপার্টি হয়ে গেলো। আমি এক নারীলোভী লুচ্চা।বিবাহিত ও বাবা হওয়া স্বত্বেও আমি আমার কামনা বাসনা বিসর্জন দিতে পারিনি। নারীদেহের লোভে পড়েছি, কতোটা লুজ ক্যারেকটার আমার।আমি আমার বৌ-বাচ্চাকে ঠকিয়েছি। আমি আমার এতোদিনের শিক্ষা,ন্যায় নীতি সব বিসর্জন দিয়েছি। তখন আমি আলাদা ঘরে ঘুমাতাম। আমার কাছে অনেকগুলো স্লিপিং পিল ছিলো। বাড়ি অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পরে আমি গ্লাস আর স্লিপিং পিল হাতে নিলাম। শর্মি,উর্মি আর তোমার আন্টির জন্য ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছিলো। তারপরে কয়েকটা স্লিপিং পিল মুখে দিয়েছি, ঝড়ের মতো তোমার আন্টি এসে আমার হাত থেকে বোতল আর বাকি পিল ফেলে দিলো। আমাকে বললো, কেন আমি আত্মহত্যা করবো? আমি চাইলে সে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে, মেয়েদের নিয়ে আলাদা থাকবে। কিন্তু আমার মৃত্যু বেদনা সে আর বাচ্চারা কিছুতেই সহ্য করতে পারবেনা। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। তোমার বাবা-মা’কে খবর দিলো। আমি আমার নিজের প্রতি ঘৃণার কথা জানালাম।প্রবল অনুশোচনায় আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে , লজ্জায় আমি কারো দিকে তাকাতে পারছিনা, সব বললাম। এতো আত্মধিক্কার নিয়ে বাঁচা সম্ভব না। তোমার আন্টি বললো, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, নিজের কর্মকাণ্ডে অনুতাপের আগুনে জ্বলছি, এটাই আমার বড় শাস্তি। সে আরও বললো, মানুষই ভুল করে, যদিও কিছু কিছু ভুলকে শুধু ভুল বলা যায়না। সেগুলো অপরাধ। কিন্তু মানুষটা যদি তার অপরাধ সত্যি বুঝতে পারে, অনুতপ্ত হয়, রিপিটেশন না হয় অপরাধের , তাহলে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে হয়না। আর আমাকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে, তাই আমি যখন আমার অপরাধ বুঝতে পারছি, তখন আমাকে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি,আত্মগ্লানিতে আমি আমার ক্ষতি করতে পারি, তোমার আন্টি সেটা বুঝতে পেরেছিলো এবং সে আমাকে চোখে চোখে রাখতো বলেই সেদিন আমি বেঁচে গেছি। সে আমার দুই মেয়েকেও খুব সুন্দর করে ক্ষমা আর ভালোবাসার মাহাত্ম্য বুঝালো।দেরিতে হলেও আমার মায়েরা আমাকে ক্ষমা করে দিলো। ঐ মহিলা বহু গ্যাঞ্জাম করেছিলো। তোমার আন্টি আমাকে সব ধরণের মেন্টাল সাপোর্ট দিতো। আজ পর্যন্ত ঐ ব্যাপার নিয়ে আমাকে সে খোঁটা দেয়নি। আমরা চারজনেই এরপর হতে খুব হ্যাপিলি থেকেছি। আমরা চারজনই পরস্পরকে ভীষণ ভালোবাসি। মেয়েরা তাদের মা’কে একটু বেশি ভালোবাসে অবশ্য , তাতে আমার কোন হিংসা নেই।”

শর্মিলা,ঊর্মিলা জোরে হেসে ফেললো। দুই মেয়েই হাসতে হাসতে বললো, ” বাপি আসলে আবার শুনতে চাচ্ছে,আমরা বাপি আর মামনিকে সমান ভালোবাসি।আজকে বললে পাঁচশ বার বলা হবে, তাই না মা? ”

বুবুন হতভম্ব হয়ে শুনছিলো। আংকেল-আন্টির জীবনের উপর দিয়ে এতো বড় ঝড় গেছে সে কোনদিন টের পায়নি।আর মেয়েদের সামনে, বুবুনের সামনে যে এসব কথা এতো অবলীলায় বললেন আংকেল,আন্টিও হাসিমুখে শুনলেন যেন খুব মজার গল্প শুনছেন, এতে বুবুনের বিস্ময়ের সীমা ছিলোনা।

“কি ভাবছিস বাবা? আচ্ছা, ধর, ঐদিন তোর আংকেলের কিছু যদি হয়ে যেতো, তাহলে আমরা কী এখন খুব সুখে শান্তিতে থাকতাম? ভালোবাসার মানুষেরা ভুল করে বুঝতে পারলে তার হাত ধরা উচিত, তাকে ইজি করা উচিত। আমি তাই করেছিলাম, তোর মা তাই করেছে। ভালোবাসা থেকে,মায়া থেকে। তোর মায়ের কী নিজের অনুভূতিকে সম্মান করারও অধিকার নেই? তোর মা যদি ঐ দুঃসময়ে তোর বাবার পাশে না দাঁড়াতো, তাহলে তোর বাবা তোর আংকেলের মতোই একটা কিছু করতে যেতো।সেটা হতে দেবেনা বলেই তোর মা তোর বাবাকে ছাড়েনি, মেন্টাল সাপোর্ট দিচ্ছে। কিন্তু তুই এতো রিজিড হয়ে আছিস, এতে ওরা দু’জনেই ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। বুবুন, এখন যদি বলি, আসিফ ভাই আর নেই? সুইসাইড করেছেন?”

হৃৎপিণ্ডটা এতো জোরে লাফিয়ে উঠলো, বুবুনের মনে হলো ও আর নিঃশ্বাস নিতে পারবেনা। বাবা নেই ? “আমার বাবাই সোনা, বুবুন সোনা, আমার বড় বাবা,আমার লক্ষী ছেলে ” বলা বাবা নেই? “মন দিয়ে বুঝেশুনে পড়ালেখা করবে, সারাক্ষণ বইতে মুখ গুঁজে থাকবেনা, ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ খুব ইম্পরট্যান্ট, এতো রাত না জেগে সকালে ওঠার প্র্যাকটিস করো বাবা, চলো,বাপ-বেটা হাত ধরাধরি করে পার্কে হেঁটে আসি, বুবুন আমার হীরার টুকরো ছেলে” এসব বলা বাবা নেই? কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠিয়ে মাঠে নিয়ে যেয়ে নিজের হাতে বুবুনকে ড্রাইভিং শেখানো, পাহাড় সমান কাজ মাথায় নিয়েও অফিসার্স ক্লাবে বুবুনকে নিজে সাঁতার শেখানো বাবাটা নেই? মা যখন সুইসাইড অ্যাটেম্পটের জন্য মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছিলো, বুবুন মায়ের শোকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ভর্তি ছিলো হাসপাতালে, জ্ঞান ফিরলেই দেখতো, বাবা ঝুঁকে আছে বুবুনের উপরে, মাথায় হাত বুলাচ্ছে, খাওয়ানোর চেষ্টা করছে, যত্নের এতোটুকু ত্রুটি হচ্ছে না, রাজের মৃত্যুর পরে পুরো বাড়িকে এক হাতে সামলে রেখেছিলো বাবা এক সমুদ্র ব্যথা বুকে চেপে রেখে, সেই স্নেহময়, দীপ্তিময়, লম্বা, ছিপছিপে, দারুণ সুদর্শন বাবা নেই? এজন্য আজ এখানে নিয়ে এসেছেন আঙ্কেল-আন্টি? নিজেদের কাছে রেখে দুঃসংবাদ দিবেন।

বুবুন নিঃশ্বাস নিতে পারছিলোনা। সে হা করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলো। চারদিক কেমন অন্ধকার লাগছে। বুবুন একবার শুধু ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “বাবা “, তারপরে আর কিছু মনে নেই।

চলবে।

#সংসার
পর্ব ৪৬
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

সন্ধ্যা হওয়ার ঠিক আগ দিয়ে এতো মন খারাপ লাগে! নিশাত বারান্দায় চুপ করে বসেছিলেন। ইদানিং কিছু ভালো লাগেনা, কিছুই না। অতীতের সোনালি দিনগুলো বড্ড মনে পড়ে। শিশুকাল, বাল্যকাল, কিশোরী কাল, তরুণী কাল। হারিয়ে যাওয়া বাবা-মায়ের জন্য বড় বেশি কষ্ট হয়। পুরানো দিনগুলো যদি আবার ফিরে পাওয়া যেতো !

নাজমুল সাহেব চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন বিছানায়। যে লোক এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ দিতেননা, তিনি বেশ কিছুদিন হলো নামাজ কালাম ছেড়ে দিয়েছেন। কি অবাক কাণ্ড! নিশাত বারবার জিজ্ঞাসা করেন নামাজ বন্ধ করার কারণ কি, নাজমুল সাহেব নিস্পৃহ মুখে নিরুত্তর থাকেন।এতে আরও রাগ হয়ে যায় নিশাতের। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন নাজমুল সাহেব সূরা, দোয়া দরুদ ভুলে গিয়েছেন কিনা, তার জবাবও নাজমুল সাহেব দেননি। চুপ করে ছিলেন। অথচ নাজমুল সাহেব পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন নিয়মিত। সারাদিন চুপ করে শুয়ে থাকা, খাওয়ার সময় ডাইনিং এ যেয়ে অল্প কিছু খাওয়া আর প্রয়োজনে বাথরুম। সারাদিন কারোর সাথে কথা বলেননা বললেই চলে, এমনকি সাধের মেয়েরা বেড়াতে এলেও টুকটাক কথা বলে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকেন নাজমুল সাহেব।

তমা অস্ট্রেলিয়া থেকে এখন পর্যন্ত দেশে বেড়াতেও আসেনি, নোমান আর ইরফানও ওখানে ফিরে যায়নি। আয়মান প্রচণ্ড রাগী,জেদি হয়ে গেছে। তমার কোন কথা শোনেনা। বাপ-ভাইয়ার উপর ভীষণ রাগ। কেন ওরা তাকে ফেলে বাংলাদেশে চলে আসলো? আয়মানের জন্য খুবই কষ্ট হয় নিশাতের। নোমানকে বলেছেন ছোট ছেলেকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে। তমার সাথে ওখানকার এক বাংলাদেশি পুরুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চলছে। রাগে আর ঘৃণায় গা রিরি করে নিশাতের। নির্লজ্জ , শয়তান মেয়ে। পুরো পরিবারটাকে ছারখার করে ফেলেছে। নোমান, ইরফান, আয়মান সবার জীবন নষ্ট করে ফেলছে মেয়েটা। তিনি আর নাজমুল সাহেবও খুব ভেঙে পড়েছেন এই ঘটনায়। নিশাত মুখ ফুটে ছেলেকে বলেছেন তমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা। নোমান “হ্যাঁ , না ” কিছুই বলেনা। সকালে অফিস চলে যায়, ফেরে রাত দশটা এগারোটায়, অফিস শেষে বাসায় না এসে গাড়ি নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়, নইলে কলিগদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে আড্ডা দেয়, রাতে বাসায় ফিরে বাপ-মা-ছেলেকে এক পলক দেখে শুয়ে পড়ে। খেতে ডাকলে বেশির ভাগ সময় উত্তর আসে, “খেয়ে এসেছি। ” আসলেও খেয়ে আসে কিনা কে জানে! ইরফান লেখাপড়া, খাওয়া দাওয়া ঠিক করে করেনা। অল্পেই রেগে যায়। নিশাত তীক্ষ্ণ নজর রাখেন নাতির দিকে। কোনভাবে ছেলেটা যেন খারাপ পথে পা না বাড়ায়। নোমানের উপরে প্রচণ্ড রাগ হয় নিশাতের, তুমি ছেলে দেওয়ানা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো, তোমার ছেলেদের প্রতি অন্তত দায়িত্ব পালন করো, বাপ-মায়ের দেখাশোনা করা লাগবেনা।

তিতলীর শাশুড়ি প্যারালাইজড অবস্থায় আছেন। আদনান মায়ের জন্য তিনজন নার্স রেখেছে, শিফটিং ডিউটি। শ্বশুরের ছোঁকছোকানি আরও বেড়েছে। বাসায় কাজ করে দুইটা ছেলে আর একটা মেয়ে। সকালে তিতলী ছেলেমেয়েদের স্কুলে রেখে আপার বাসায় মেয়েটিকে নামিয়ে দেয়, রাতে আপার বাসা থেকে সবাইকে তুলে বাসায় ফিরে। আদনান অরণ্যকে নিয়ে ঘুমায়, অরণী আর নূরীকে নিয়ে তিতলী আরেক ঘরে থাকে। কেমন অস্বাভাবিক জীবন মেয়েটার। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নিশাত। আদনানকে কোন কুক্ষণে পছন্দ করেছিলো মেয়েটা ! বাপ-মা -ভাই-বোনকে অবশ্যই একজন পুরুষ জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে, কিন্তু বৌ বাচ্চার ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। তিতলী বলেছিলো, শ্বশুর শাশুড়ি নিজের বাসায় উঠুন, নার্স থাকবে, গ্রামের থেকে বিধবা ফুপু শাশুড়িকে নিয়ে আসা হবে। আদনান রাজি না। মায়ের এই অবস্থায় সে মায়ের থেকে দূরে থাকতে পারবেনা। আর বাবা যেমনই হোক, বাবা-ই। বাবার আর সবকিছু ভালো। একটু ছাড় না দিলে সংসার চলেনা। অন্য দুই ভাইবোন যাই করুক, প্রথম সন্তান হয়ে আদনান বাপ-মাকে দূরে রাখবেনা কখনো। এমন জামাইকে নিয়ে গর্বে বুক ভরে ওঠার কথা নিশাতের, এতো পিতৃমাতৃভক্ত দায়িত্বশীল ছেলে! কিন্তু নিশাতের এখন আদনানকে অসহ্য লাগে। তিতলীর আর বাচ্চাদের প্রতি দায়িত্ববোধ খুব কম আদনানের। একটা অস্বাভাবিক পরিবেশে রাত কাটাতে হয় তিতলী আর বাচ্চাদের। তিতলী ইদানিং প্রায়ই ডিভোর্সের কথা বলে। বাচ্চাদের সাথে নিয়ে সে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকবে। কিন্তু অরণ্য -অরণী তাদের বাবাকে খুবই ভালোবাসে। বাপ-মায়ের বিচ্ছেদে তাদের উপরে বেশ বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে তিতলীর আশংকা।

দুই ছেলেমেয়ে ডিভোর্সি হবে ভাবতেই নিশাতের বিষন্নতা আরও জেঁকে বসে।

নোমান -তিতলীর বদলে বরং তিতির একটু ভালো অবস্থায় আছে। আসিফের প্রতি ভয়ংকর রাগ থাকলেও বুক ভরা মমতাও আছে নিশাতের। প্রথম থেকেই আসিফকে মায়ের মতো ভালোবেসেছেন নিশাত। এতো কাণ্ডের পরও ভালোবাসা কমেনি। কেন যে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটালো ছেলেটা! দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নিশাত। একটা ছেলেমেয়েও সুখী হলোনা তাঁর।

একটাই ভালো ঘটনা ঘটেছে। বুবুন দেশে এসেছিলো চৌদ্দ দিনের জন্য। বাবার জন্য শোকে জ্ঞান হারিয়েছিলো বুবুন। জ্ঞান ফেরার পরে আঙ্কেল আন্টি ভিডিও কল দিলেন আসিফকে। উদভ্রান্ত বুবুন কান্নাভেজা আকুল গলায় ডাকলো, ” বাবা! ” আসিফ গাঢ় গলায় উত্তর দিলো, ” বাবা, আমার বুবুন বাবা। আমার রাজকুমার। ” প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাওয়ার পরে বুবুন আবার নিস্পৃহতার মুখোশ পরে ফেললো। ফোন কেটে দিলো। তবে মাসখানেক পরে দেশে আসলো বুবুন। নানা-নানি, খালা মামা, ভাইবোনদের সাথে স্বাভাবিক , তবে বাপ -মায়ের সাথে চুপচাপ , গম্ভীর।

নিশাতের কপালে এতো অস্বাভাবিকতা লেখা ছিলো !

নিশাত মাগরিবের নামাজ পড়ে উঠলেন। খরখরে গলায় নাজমুল সাহেবকে বললেন, “উঠে নাস্তাটা খেয়ে আমাকে ধন্য করো। কতো সুখ! দিনরাত আরাম করে শুয়ে থাকা। রেডিমেড খাবার খাওয়া। হাঁসের মতো গায়ের থেকে সব পানি ঝেড়ে ফেলে নিশ্চিন্ত। কোনও চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, দায়িত্ব নেই। সংসারের সব চিন্তা, সব দায়িত্ব একলা আমার।”

তিতির ঘরে ঢুকলো। তিতির কখন এসেছে টের পাননি নিশাত। এখন ওর মুখোমুখি পড়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।

তিতির শীতল গলায় মা’কে বললো, “তুমি সবসময় বাবার সাথে এমন করে কথা বলো কেন? ”

“কি করে তোমার বাবার সাথে কথা বলতে হবে? ”

“স্বাভাবিক এবং বলতে বাধ্য হচ্ছি, ভদ্র ভাবে বলতে হবে। যদি না পারো, তাহলে কথাই বলোনা।খারাপ ব্যবহারের থেকে কথা বন্ধ করে দেওয়া ভালো।”

“অনেক চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছো। তোমার বাপ একসময় যখন আমার সাথে দুর্ব্যবহার করতো, তখনতো কই এতো লম্বা, চওড়া বাক্য শুনিনি।”

” অতীতকে এতো টানো কেন? বর্তমান নিয়ে ভাবো। বাবা দুর্ব্যবহার করতো এটা সব সময় বলো, বাবার ভালো গুণগুলো দেখোনা? মা, শোনো, পৃথিবীতে তোমার সবচেয়ে বড় হিতাকাঙ্ক্ষী কিন্তু বাবা। বাবা তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছে মানি, কিন্তু অনেক ভালো কাজও করেছে যেগুলো বেশিরভাগ স্বামী করেনা। সেগুলো মনে রেখো।”

নিশাত উত্তপ্ত গলায় বললেন, ” আমার করণীয় তোমাকে ঠিক করতে হবেনা। নিজের সংসার নিয়ে ভাবো। স্বামী এমনি এমনি অন্য মেয়ের প্রতি ঝুঁকে না। তোমার এই বড় বড় বাতচিতের জন্য তোমার বড় ছেলেও তোমাকে পছন্দ করেনা।শুধু লম্বা লম্বা কথা। ”

তিতির চুপ করে গেলো। সপ্তাহে অন্ততঃ দুইবার সে আসে। বাজারঘাট, বাবা-মায়ের, নোমান -ইরফানের পছন্দের খাবার নিয়ে আসে। বাবা-মা’কে সময় দেয়, ভাইপোকে আদর করে, তার সাথে গল্প করে, লেখাপড়ার খবর নেয়। ইরফানও তিতিরপাখি আসলে মহা খুশি হয়ে ওঠে। তিতিরপাখি খুব পজিটিভ কথা বলে ইরফানের সাথে। ইরফানকে এতোটা বুঝে যেটা মা তো দূরের কথা, বাবা-দাদা এমনকি দাদিও বুঝেনা। চারদিকে তিতিরপাখির এতো নজর! নিজের সংসার -বাচ্চাকাচ্চা সামলানো, বোনপো-বোনঝির দেখাশোনা, ভাইপোর খেয়াল রাখা, বাবা-মায়ের ভালো মন্দের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা।

দাদি তিতিরপাখিকে কি বিশ্রী ভাবে বললো! ইরফানের হঠাৎ করে ভীষণ রাগ হলো। অশান্তি! কি যে অশান্তি তার জীবনে ! স্বার্থপর মা। তবে মা যেমনই হোক, দেখতে ইচ্ছা করে, কাছে পেতে ইচ্ছা করে। প্রায় মায়ের জন্য নীরবে ও গোপনে চোখের পানি ফেলে ইরফান। আয়মানের জন্য কলিজাটা সবসময় টনটন করে। কেউ বুঝে তার ব্যথা? দাদি তার দিকে খুবই খেয়াল রাখে , এ কথা ঠিক। কিন্তু ইদানিং দাদির মেজাজ খুব চড়া থাকে। কারণে অকারণে দাদার সাথে ঝগড়া, দাদা তিনদিন চুপ থাকে তো চতুর্থ দিনে হুংকার! এগুলো আর নিতে পারেনা ইরফান এখন। তিতিরপাখির কাছে থাকতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো, কিন্তু বেচারি এমনিতেই নিঃশ্বাস ফেলার সময় পায়না, তার উপরে আর চাপ দিতে মন চায়না ইরফানের।সবচেয়ে বড় কথা, বড় ফুপার মুখের দিকে তাকাতে পারেনা ইরফান। কি ঘটেছে তাকে কেউ না বললেও বুঝে ফেলেছে ইরফান।আর ভাইয়া তো এবার সব কথা শেয়ার করলো তার সাথে। বড়ফুপা ইরফানের বড় প্রিয় মানুষ । ফুপা কোলে নিয়ে ঘুরতো, আদর করতো, সেই ফুপা ইরফানের তিতিরপাখিকে এমন ভাবে ঠকিয়েছে! এটা কিছুতেই মানতে পারেনা ইরফান, আবার বড় ফুপাকে ঠিক ঘৃণাও করতে পারেনা।

চলবে।

#সংসার
ধারাবাহিক গল্প
পর্ব ৪৭
নাহিদ ফারজানা সোমা

তিতলীর শ্বশুর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মারা যেয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করে গেলেন। মিশ্র অনুভূতি তিতলীর। শ্বশুরের অনেক স্নেহ, সহানুভূতি সে পেয়েছে, কিন্তু ভদ্রলোকের খাসলতটা বড্ড খারাপ ছিলো। এটাও এক ধরণের মানসিক ব্যাধি ছিলোনা তো? সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলে তিনি কি এই নোংরা সমস্যা হতে মুক্তি পেতেন? যদি এটা মনের অসুখ হয়, তাহলে বেচারার সাথে অন্যায় করা হয়েছে। আর যদি স্বভাবটাই এমন হয়, তাহলে তাঁর মৃত্যু সবার জন্য রিলিফ, তাঁর নিজের জন্যও। আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করে দিন। তিতলী মনের থেকে দোয়া করে।

সবাই বিষ্ময়ে পাথর হয়ে গেলো যখন উকিল জানালেন,ঢাকার ফ্ল্যাট আর পূর্বাচলে কেনা একটা প্লট তিনি বধূমাতা তিতলীর নামে লিখে দিয়েছেন। অন্য দুই সন্তান শোক বাদ দিয়ে রাগে গর্জন করতে লাগলো। প্যারালাইজড শাশুড়ির মুখেও ক্ষোভের চিহ্ন। পূর্বাচলে তিনি যে প্লট কিনেছেন, সেটাই জানতোনা কেউ।

উকিল বললেন, ” উনি আমার বন্ধু মানুষ ছিলেন। আমার সাথে কিছু কথা শেয়ার করেছেন। উনি বড় বৌমাকে খুব পছন্দ করতেন। বড় ছেলে আর বৌমা খুব দায়িত্বশীল, নিঃস্বার্থ, এটা সবসময় বলতেন আমাকে।ভাবি,ছোটো ছেলে, ছোটো বৌমা, মেয়ে- জামাই, এরা স্বার্থপর, লোভী, এসব কথা অনেক শুনেছি উনার মুখে। বড় বৌমার নামে তিনি এসব প্রপার্টি লিখে দিয়েছেন কারণ তিনি ভয় পেতেন, আদনান মা-ভাই-বোনের প্ররোচণায় নিজের আর বৌ-বাচ্চার জন্য কিছুই রাখবেনা। ”

তিতলীর কষ্ট হচ্ছিলো ভীষণ। তিনি যা করতেন, তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এই বিকৃতিটা আসলে কোনো অসুখ ছিলোনাতো? চিকিৎসা করলে সুস্থ হয়ে যেতেন হয়তো। বছরখানিক তিতলী তাঁর সাথে কথা বলেনি, মুখের দিকেও তাকায়নি। ঐ মুখটার কথা ভাবলেই তার বমি আসতো। নিজের অজান্তেই শ্বশুরের মৃত্যু কামনা করতো।সত্যিই তিনি চলে গেলেন।চোখ মুছতে মুছতে তিতলী প্রতিজ্ঞা করলো, কোনো মানুষকেই প্রথম চোটে জাজ করা যাবেনা। যে সমস্যাই তার থাকুক, তাকে বুঝাতে হবে, সমস্যার উৎস বের করার চেষ্টা করতে হবে, বাড়াবাড়ি বুঝলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। মনের অসুখ আমাদের দেশে বড় অবহেলিত। তিতলী শাশুড়িকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে কোয়ালিটিফুল টাইম দিতে লাগলো। অরণ্য -অরণীর মনে যেন দাদা-দাদি, চাচা-ফুপু সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক ধারণা না থাকে, তিতলী তারজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো।

তিতলীর সংসারে স্হিতি এসেছে, কিন্তু নাজমুল -নিশাতের সংসারে তুমুল অশান্তি। তমা ফিরে এসেছে। যে লোকটার সাথে লিভ ইন সম্পর্কে ছিলো,সে তমাকে দীর্ঘদিন ভোগ করে আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলেছে। তমা আর তার মা ফিরে এসেছেন। নিশাত তমাকে ঘরে ঢুকতে দিলেননা। তমাকে সবচেয়ে ঘেন্না করে তার দুই ছেলে,বিশেষ করে বড়টা। ইরফান রীতিমতো তেড়ে গেলো মায়ের দিকে। ইংরেজিতে মা আর নানিকে যে বাক্যগুলো শোনালো, তা এতো অশ্লীল আর ভয়ংকর, নিশাত -নাজমুল কানে হাত দিলেন। এসব কথা কোত্থেকে শিখেছে ইরফান? ক্লাসমেট, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক? কোনো খারাপ দলের পাল্লায় পড়েনি তো? নাকি শিশুকাল হতে বাপ-মায়ের ঝগড়া, চিল্লাচিল্লি, অশান্তি, মায়ের অবৈধ সম্পর্ক তার ভেতরের নিষ্পাপ কিশোরটাকে ফ্রাঙ্কেসটাইনে পরিণত করেছে? বাবা-মা-দুই ছেলে ঘোর বিরোধী, কিন্তু তমা ফিরে আসায় নোমান অসম্ভব খুশি। নিশাত বলেছিলেন, “ও তোমাকে ভালোবেসে ফিরে আসেনি নোমান, ওখানে চাকরি বা নতুন বন্ধু কিছুই জুটাতে পারেনি বলে ফিরে এসেছে।”

” মা,ফিরে তো এসেছে। এটাই যথেষ্ট। প্রত্যেক সন্তান তার বাবা-মা দু’জনকেই পাশে চায়।ইরফান -আয়মানের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নেওয়া উচিৎ আমাদের, মা।”

” ইরফান,আয়মানই তো সবচে ঘৃণা করে ওকে। ও থাকলে ইরফান -আয়মানের চরম ক্ষতি হবে, উপকার হবেনা এক বিন্দু। ”

“মা, সব ব্যাপারে সবার ওপিনিয়ন নিয়ে আমি আর চলতে পারছিনা। আমার লাইফের সিদ্ধান্ত আমি নিবো। চৌদ্দ জনের মতামত জানার দরকার নেই আমার। ”

“চৌদ্দ জনের মধ্যে কি আমি আর তোমার বাবাও আছি? আমরা তো তোমার কোনো ব্যাপারে থাকতে চাইনি কিন্তু থাকতে বাধ্য হয়েছি।তোমার দুই ছেলে আমার হাতে মানুষ। আমাদের বিন্দু মাত্র না জানিয়ে বৌ-শাশুড়ির সাথে বিদেশে পাড়ি জমালে। প্রথমে তোমার বড় ছেলে ফিরে এলো, তারপরে এলে ছোটো ছেলেকে নিয়ে তুমি। তুমি সন্যাসী হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলে, এই বয়সে- এই শরীরে তাদেরকে আমরা দেখাশোনা করছি,মানুষ করছি। তুমিও খুব স্বার্থপর নোমান, তুমি আর তোমার বৌ মেড ফর ইচ আদার। যাই হোক, তুমি তাকে নিয়ে সংসার করতে চাইলে আলাদা বাড়ি দেখো, আমার বাড়িতে সে ঢুকতে পারবেনা।আর বাচ্চারা তোমাদের সাথে যেতে না চাইলে ওদের জোর করবেনা। তোমাদের সাথে থাকলে ওরা তোমাদের মতোই কুলাঙ্গার হবে।”

নোমান বিষন্ন হাসি হেসে বললো, ” আসিফ ভাই তমার মতোই কাজ করেছিলো, তমা তোমার কাছে অস্পৃশ্য, কিন্তু আসিফ ভাই কিন্তু শ্বশুর -শাশুড়ির নয়নমনি, তার আদর বা সম্মান কিছুই কমেনি তোমাদের কাছে। দারুণ বিচার তোমাদের। ”

নোমান -তমা আলাদা ফ্ল্যাট নিলো। ইরফান -আয়মান দাদা-দাদির কাছেই থেকে গেলো। এখন ওরা বাপ -মা কারোর মুখ দেখতে চায়না। নোমানও অভিমানে এই বাড়িতে আসেনা। আর এখানে তমার আসার উপরে কঠিন নিষেধাজ্ঞা আছে।

তিতিরের সংসার বড় বেশি স্হির। তিতির বুঝতে পারে সে মানসিক ভাবে ভয়ংকর অবসাদগ্রস্ত। বিষন্নতা সাংঘাতিক। দুই একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়েছিলো তিতির। কিন্তু মন খুলে সব ইতিহাস শুনাতে পারেনি সে। কিছু কথা পেটেই রেখে দিতে হয়েছিলো। স্বামীর নাম বলেছিলো বটে, কিন্তু সেই আসিফ যে দেশবিখ্যাত সার্জন আসিফ, তা বুঝতে দেয়নি। আসলে সাইকিয়াট্রিস্টদের সামনে অনেক কথাই বলেনি তিতির, রাজেশ্বরীর কথা বলতে পারেনি, রাজের কথা মনে হওয়ামাত্র ইদানিং হাত-পা অবশ হয়ে যায়, নিঃশ্বাস গলার কাছে আটকে থাকে, বুকটা ব্যথায় খুব বেশি রকম টনটন করতে থাকে। ডাক্তারদের সে বলতে পারেনি, বড় ছেলে তার সাথে কথা বলেনা, তার উপরে ছেলের ভীষণ রাগ, অশ্রদ্ধা। সে এটাও বলতে পারেনি, তার কোল ঘেঁষে থাকা সন্তানেরা সবাই তার থেকে দূরে দূরে থাকে। রাজ থাকে বাধ্য হয়ে, বাকি তিনজন স্বেচ্ছায়। লুম্বিনী, তুতুন কলেজে,স্কুলে থাকে, টিচারের কাছে পড়তে যায়, লেখাপড়া করে, মোবাইলে গেমস বা চ্যাটিং এ ডুবে থাকে। ছেলেমেয়েদের দামী ফোন কিনে দিয়েছে আসিফ, দিয়েছে আলাদা আলাদা ল্যাপটপ। নিষেধ করেছিলো তিতির, আসিফ বলেছিলো এটা যুগের দাবী। তাছাড়া লেখাপড়াতেও সুবিধা হয় এসব গ্যাজেট থাকলে। “এতো দামী জিনিস কেনার দরকার নেই “, তিতিরের এই কথার উত্তরে আসিফ বলেছে,” আমি কমদামি জিনিস কিনতে পারিনা।”বাবা এলে লুম্বিনী, তুতুন দৌড়ে বাবার কাছে যায়, শুরু হয় বাপ-ছেলে-মেয়ের ম্যারাথন আড্ডা। কতো বিষয় নিয়ে যে বাবা মজার মজার গল্প বলে। হয়তো হাসপাতাল থেকে আসতে আসতে ফোন করে বাচ্চাদের, ” গেট রেডি মাম্মা”, “গেট রেডি মাই লিটল পাপা, আমরা লা মেরিডিয়ানে যাবো। তোমাদের মা’কেও বলো।” মা তো যাবেনা, জানা কথা। মায়ের অতিরিক্ত চুপচাপ থাকা, উদাস উদাস ভাবভঙ্গি, অসময়ে ঘুমিয়ে পড়া মাঝেমধ্যে লুম্বিনীর কাছে বিরক্তিকর লাগে। এতো বিষন্নতা নেওয়া যায়না আসলে। লুম্বিনীরাওতো অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছে, ভাইয়ার জন্য মন খারাপ হয়, রাজের জন্য কান্না আসে, নানাভাই আর বুবুর অবস্থা দেখে কষ্ট হয়, মা যদি এরমধ্যে সারাক্ষণই দুঃখী চেহারা করে থাকে, লুম্বিনী আর তুতুন যাবে কোথায়? তাই হাসিখুশি, ছেলেমেয়েদের সাথে বন্ধুর মতো মেশা বাবার সঙ্গই বেশি পছন্দের লুম্বিনী -তুতুনের। আগেকার দিনগুলোর কথা বড্ড মনে পড়ে তিতিরের। বাবা-মা-তারা তিন ভাইবোন। আরও ছিলেন নানা-নানু,দাদা-দীদা, মামা-খালা-চাচা-ফুপুরা। কাজিনদের বিশাল দল।বন্ধু বান্ধব। লেখাপড়া,তারপরে সংসার।যদিও শ্বশুর বাড়ি আঘাত করতে সদা তৎপর থাকতো, তবুতো আসিফ ছিলো, ছিলো চারটা বিড়াল ছানা যারা মা বিড়ালকে সবসময় আঁকড়ে ধরে থাকতো। মা ছাড়া দুনিয়া ছিলো অন্ধকার। আজ তারা বড় হয়েছে, মা’কে আর দরকার নেই তাদের জীবনে।

কয়েক বছর আগে বাবা-মায়ের বাড়িতে গেলে সব দুঃখ, কষ্ট,হতাশা চলে যেতো। জানটা একটু ঠান্ডা হতো। এখন হয়না। বাবা চুপ চাপ বসে বা শুয়ে থাকে, নিস্পৃহ, নিরুত্তাপ। মা ভয়ানক খিটখিটে। প্রতি কথার প্যাঁচানো জবাব। ভাই বাড়িতে আছে কি নেই তাও টের পাওয়া যায়না। কোন সুখের গল্প নেই , হাসি নেই , আদর নেই। প্রায় প্রতিবারই অভিযোগ শুনতে হয় মায়ের মুখে, ” তোমার চেহারা-স্বাস্হ্যের তো বারোটা বেজে গেছে। সারাক্ষণ মুখ হাঁড়ির মতো করে রাখো কেন? এতোবড় ঠেকা খেয়েও শিক্ষা হলোনা? দু’দিন পরপর বাজার নিয়ে আসো কেন? আমাদের বাজার করার পয়সা নেই? বাক্স ভরে রান্না খাবার আনো কেন? কে খাবে এতো খাবার? প্রত্যেকবার নষ্ট হয়। দু’দিন পরপর প্রেশার দেখার দরকার নেই। আমাদের উপরে ডাক্তারি বিদ্যা না ফলিয়ে একটা চেম্বার টেম্বার কিছু করো। ” আরও কতো অভিযোগ, অনুযোগ। সাত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে তখন তিতির, দমবন্ধ হয়ে হাঁসফাঁস লাগে। এতো চেনা পরিবেশ, এতো চেনা মানুষগুলোকে কেমন অচেনা লাগে। নিশাত আপনমনে বলতে থাকেন, ” ছেলে খেল দেখালো, জামাই খেল দেখালো, নাতিরা খেল দেখাচ্ছে। আর কতো খেল দেখবো? এইসব সংসার টংসার আর ভালো লাগেনা।” নাজমুল সাহেব বলেন, ” তুমি নিজে উপার্জন করে যদি এতো বাজারঘাট, ওষুধ পত্র আনতে, তাহলে একটা কথা ছিলো।কিন্তু হাসব্যান্ডের টাকায় তুমি বাপের বাড়ির জন্য এতোকিছু কেনাকাটা কর, এটা আমাদের জন্য ইনসালটিং। এরকম করোনা। ”

শ্বশুর বাড়ির সবাইকে অকপট ভালোবাসা দিয়েছে তিতির। ভালোবাসা মেলেনি। রাজপুত্র ছেলের পাশে বেঁটে, শ্যাম বর্ণ, স্বল্পকেশী, চোখ ছোট, নাক বোঁচা, থালামুখি বৌকে কখনো সহ্য করতে পারেনি আসিফের পরিবার। তিতিরের সাথে খারাপ ব্যবহারের আরেকটা গুপ্ত কারণও আছে। যতোই অসুন্দর হোক, বড় ঘরের কোয়ালিফাইড মেয়ে। তাকে কোনভাবে মাথায় চড়ানো যাবেনা।

চলবে।