সংসার পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
19

#সংসার
ধারাবাহিক গল্প
পর্ব ৪৮
নাহিদ ফারজানা সোমা

“দেখুন, খুব স্ট্রিক্টলি আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, এরপর থেকে আপনি কাউকে সাথে নিয়ে আসবেন। এর আগেও বারবার বলেছি আপনাকে।আপনি কথা শুনছেননা। দেন, এখনই আপনার স্বামীর নম্বর দেন।আমি কথা বলবো।”

“উনার নাম্বার আমার মুখস্থ নেই যে।”

“স্ট্রেঞ্জ। আপনার মোবাইল থেকে উনার নম্বর বের করে আমাকে দেন।”

“মোবাইল আনিনি।”

সত্যিই তিতির মোবাইল সঙ্গে আনেনি।

“অদ্ভুত কাণ্ড। কার নম্বর মুখস্থ আছে, বলেন।”

“কারোর নম্বর না।”

“বাসার ঠিকানা আজকে আপনাকে স্পষ্ট করে বলতেই হবে।বলেন ঠিকানা।”

তিতির চুপ করে রইলো।এই প্রশ্নে সে সবসময় চুপ করে থাকে।

” আপনার স্বামীর নাম, ডেজিগনেশন, হাসপাতালের নাম বলেন। প্লিজ, বলেন।”

তিতির যথারীতি নীরব রইলো।

“আপনি কেন আমার সময় নষ্ট করছেন? এখানে আসেন কি সিনেমা করার জন্য? পুলিশ কল করবো আমি। ”

” আমার খুব ডিপ্রেসড লাগলে আপনার কাছে আসি।”

“আমার চোহারা দেখলে আপনার ডিপ্রেশন পালিয়ে যায়? আপনার ডিপ্রেশন থাকলে সেটা সারাতে হবেনা? শুধু ওষুধ খেলে হবে? শুধু ওষুধে আপনার কাজ হবেনা। সাইকোথেরাপি লাগবে। হসপিটালাইজেশন লাগতে পারে। সাথে কেন কাউকে আনেননা এতোবার বলার পরেও? তাঁদের সাথে আমাকে কথা বলতে হবে। ”

“আমাকেই যা বলার বলেন। কেন গার্জিয়ান লাগবে? আমার কথা শুনুন।আমাকে প্রশ্ন করুন। থেরাপি দেওয়ার হলে দিন।দ্বিতীয় ব্যক্তির কেন দরকার? আমার এমন কেউ নেই যে আমাকে বুঝবে। তাহলে তাকে সাথে আমি কেন আনবো? যদি কারেন্টের শক দিতে হয় দিন, আমার হয়ে তো দ্বিতীয় ব্যক্তি শক খাবেনা,তাইনা? কষ্ট আমার, বিষন্নতা আমার, আমার সাথে কথা বলুন।”

এই রোগীকে এতো কথা বলতে বা উত্তেজিত হতে ডাক্তার আগে দেখেননি।খুবই কোমল প্রকৃতির নারী।

“ওষুধগুলো খাচ্ছেন ঠিকমতো? ”

“খাচ্ছি।”

“কিভাবে বিশ্বাস করবো? ”

“কিভাবে বিশ্বাস করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।”

“আপনি একজন ডক্টর।চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন বাচ্চা মানুষ করতে। এখন আবার চিকিৎসা দেওয়া শুরু করুন। কাজে এনগেজড থাকুন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়াতে বের হন। হাসব্যান্ড -ওয়াইফ মিলে সুন্দর কোথাও ঘুরে আসুন। কতো লাকি আপনি, আপনার বাপ,মা,ভাই, বোন, স্বামী,সন্তান সবাই আছে……”

” ব্যাস, ব্যাস, চুপ করেন। আপনি আমাকে শুধু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট দেন। ”

“দিয়েছিতো।”

“আরও দেন, আরও দেন। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। জীবনটা দুর্বহ হয়ে যাচ্ছে। লাইফ ইজ নাথিং বাট ট্রিমেন্ডাস পেইন, আমার ক্ষেত্রে। ”

“এরজন্যই তো বলছি, আপনার ফ্যামিলি মেম্বারদের নিয়ে আমি-আপনি বসি। সল্যুশন নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে। আপনার শরীরের অবস্থা ক্রমশ ডিটোরিয়েট করছে। আপনার ভালো করে খাওয়া দাওয়া, আরামের ঘুম, মেডিটেশন, একটু হাঁটা চলা, প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে হাসি আনন্দে থাকা একান্ত দরকার। আপনি একা থাকবেননা, সবসময় পছন্দের কাজে এনগেজড থাকবেন,……. ”

“মন দিয়ে শুনুন, আমার কেউ নেই , কোনো ফ্যামিলি নেই। পৃথিবীতে আমি একদম একা।আমাকে মেডিসিন দেন যোন একটু শান্তি পাই, বুঝেছেন?”

দশ বছর আগে রাজের মৃত্যু তিতিরকে একবারে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলো। শুধু মৃত্যু শোক হলে হতো, তার সাথে ছিলো এবং এখনো আছে ভয়ংকর অনুশোচনা। ঠিক ঐ দিনই মেয়েকে মারতে হলো? মেয়ের জ্বর আসছে শুনেই যদি সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে ডেঙ্গু রোগী হিসাবে হাসপাতালে নেওয়া হতো, তাহলে রাজেশ্বরী মরতোনা, এই বিশ্বাস তিতিরের দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে। এই কলিকালে জ্বর আসলেই যে ডেঙ্গুর কথা মাথায় আসা উচিৎ। সেখানে ডাক্তার বাপ-মা উচিৎ চিন্তা মাথায় আনলোনা? মনে করলো, রাগে দুঃখে রাজের জ্বর এসেছে? ভোরেই যদি হাসপাতালে নেওয়া হতো !

তারপরে আসিফের প্রতারণা। প্রতারক স্বামীর সাথে সমঝোতা করে ঘর করা। শুধু বাচ্চাদের মুখ চেয়ে। শুধু আসিফের প্রতি মমতার জন্য। এতো মমতা ভালো নয়, একদম ভালো নয়।

বিশাল ধাক্কা দিলো বুবুন। কি অপরাধ ছিলো তিতিরের? সে শুধু তার চার সন্তানের ব্যাভিচারী বাবাকে মেনে নিয়েছিলো। তাদের মঙ্গলের জন্য। না মানলে লুম্বিনী আজ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেতোনা। বারবার এপিলেপ্সির অ্যাটাক হতো। হিস্টিরিয়া হতো। অসুস্থ জীবনই কাটাতে হতো মেয়েকে।এখন বাবার আদরে ভালোবাসায় খুব ভালো আছে লুম্বিনী। এতো ভালো আছে যে মায়ের থেকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এখন অনেক মাইল দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।বাবার কথামতো প্রতি সপ্তাহে ঢাকার সবচেয়ে দামী পার্লারে যায় লুম্বিনী। স্বয়ং মালিকের তত্ত্বাবধানে তার যত্ন নেওয়া হয়। সেই পরিমাণ টাকা খরচ করে আসিফ। লুম্বিনী সুন্দর ছিলোনা। কিন্তু বাবার উৎসাহে, বাবার উপদেশ মেনে সে এখন যথেষ্ট সুন্দর। বাবা তাকে বুঝিয়েছিলেন, উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যা নিয়মিত করলে পজিটিভ পরিবর্তন অবশ্যই সম্ভব, যে কোনো ব্যাপারে। সবচেয়ে অভিজ্ঞ নিউট্রিশনিস্টের কাছে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছে বাবা। সবচেয়ে দামি পার্লার। সবচেয়ে ভালো জিম। তিনমাস পরপর ফুলবডি চেকআপ। ছয়মাস পরপর থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে নিয়ে চিকিৎসা ও সৌন্দর্য চর্চা। প্রতি মাসে একবার সাইকোথেরাপিস্টের সাথে কাউন্সেলিং। সেই সাথে সীমাহীন আদর, যত্ন, মনোযোগ বাবার, ভাইদের, নানা-বুবুর, তিতলীমনির।ভীষণ সেলফ ডিপেন্ডেন্ট,সেলফ কনফিডেন্ট। সবটুকু কৃতিত্ব আসিফের।ছোটখাটো হলেও লুম্বিনীর পারফেক্ট ফিগার, উজ্জ্বল শ্যামা রং, চকচকে চামড়া, মাথাভরা রেশমি চুল, ঝকঝকে দাঁতের অনিন্দ্যসুন্দর হাসি। উঁচু এবড়োখেবড়ো দাঁত ঠিক করে দিয়েছেন অভিজ্ঞ ডেন্টিস্ট। মেয়ের স্কার্ট, সালোয়ার কামিজ নিজে পছন্দ করে কেনে আসিফ, মেয়ের পছন্দকেও গুরুত্ব দেয়। তিতির কৃতজ্ঞ আসিফের কাছে লুম্বিনীর জীবনকে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য। দেশের সবচেয়ে নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো সাবজেক্টে পড়ছে লুম্বিনী। পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো। গ্র্যাজুয়েশন শেষে তাকে আমেরিকা বা কানাডায় পাঠিয়ে দেবে তার বাবা। মেয়ে মাস্টার্স করবে, ডক্টরেট-পোস্ট ডক্টরেট করবে, মেয়েকে স্বপ্ন দেখায় বাবা। সত্যি অতুলনীয় কাজ করেছে আসিফ। সবাই বলে, মায়ের দায়িত্ব -বাবার দায়িত্ব একসাথে পালন করে আসিফ। তিতির স্বীকার করে সেটা। কিন্তু ওর যে মাথায় কোনো আইডিয়া আসেনা, গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করতে পারেনা বহুদিন।

তুতুনেরও ভীষণ যত্ন করে আসিফ। ওর খাওয়া,খেলা,বিনোদন সবদিকে বাবার তীক্ষ্ণ নজর। তুতুন পড়াশোনায় টপার। এ লেভেলে খুবই দক্ষতা দেখাচ্ছে সে। রাজপুত্রের মতো দেখতে তুতুন অনেক লম্বা হয়ে গেছে। ওর উপরে নাকি অনেক মেয়ে ক্রাশ খায়, ইয়ারমেটরাতো বটেই, ভার্সিটির অনেক আপুরাও। আয়মান হলো ইনফরমার। তুতুনটা আগের মতোই ছোট্ট বাবু, দু’চোখে রাজ্যের সারল্য।

তুতুন আর লুম্বিনী কি এতো ভালো থাকতে পারতো যদি বাবাকে পাশে না পেতো? বাবা-মা এক ছাদের তলায় থাকে, এক ঘরে থাকে, ঝগড়া করেনা, এতেই দুই ভাই বোন খুশি, নিরাপদ। সব মহিলা কি মনের দিক দিয়ে সমান শক্তিশালী হয়? বিশেষ করে এক সন্তানহারা মা, এক মৃগী রোগে আক্রান্ত মেয়ের মা, এক ছোট্ট পুত্রের শারীরিক ভাবে দুর্বল মা? হয়তো যেভাবেই হোক, তিতির তিন সন্তানকে খাইয়ে -পরিয়ে, মোটামুটি লেভেলের স্কুল কলেজে পড়িয়ে মানুষ করতে পারতো, তাতে কার কতোটা মঙ্গল হতো? বুবুন কেন এগুলো বুঝেনা?

#সংসার
পর্ব ৪৯
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

যে বুবুন বিদেশে পড়ার ঘোর বিপক্ষে ছিলো, সে দিব্যি কানাডায় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এ বিএসসি, এমএস দুটোই করে ফেললো। আরও পড়াশোনা করবে, রিসার্চ করবে। কানাডাতেই সেটল করবে বুবুন। ইতিমধ্যে ভালোবেসে ফেলেছে অজন্তাকে। অজন্তাই এই সফল সম্পর্কের উদ্যোক্তা। আরিয়ানের পেছনে নিষ্ঠার সাথে ঘুরে ঘুরে সে তার মন জয় করতে পেরেছে। অজন্তার বাবা-মা বাংলাদেশি,তবে বহু বছর হলো কানাডার সিটিজেন। অজন্তা-ইলোরা তাঁদের দুই কন্যা। স্কলার পরিবার। কাজেই আরিয়ান ওরফে বুবুনকেও স্কলার হতে হবে। দু’জনেই ব্যাচমেট। বুবুন খুব ভালো রেজাল্ট করলেও অজন্তাকে হারাতে পারেনা পরীক্ষায়।

সম্পর্কের শুরুতে অজন্তাকে তার সব কাহিনী বলেছে বুবুন। তার বাবার নারী কেলেংকারীর কথা, জেল খাটার কথা, মায়ের অযোগ্যতা ও দুর্বল ব্যক্তিত্বের কথা, নানা-বুবুর কথা, তার সফল হওয়ার পেছনে খালু আদনানের অবদানের কথা, তার কলিজার টুকরা লুম্বিনী -তুতুনের কথা, তার অন্য প্রিয় ভাইবোনদের, বিশেষত রাইট হ্যান্ড ইরফানের কথা, তার অনেক ভালোবাসার খালা তিতলীমনির কথা।

তিতলীমনি বুয়েটে কি দূর্দান্ত ছাত্রী ছিলো, ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে সে কতোটা দক্ষ, শ্বশুরবাড়িতে কতো অসুবিধাকে বোল্ডলি ফেস করেছে তিতলীমনি, দীর্ঘ গ্যাপের পরে আবার কি দুরন্ত ভাবে ক্যারিয়ার তৈরি করেছে, তিতলীমনি কি ভীষণ সুন্দর আর স্মার্ট, তার পারসোনালিটি কতো সুন্দর , গর্বের সাথে বর্ণনা করেছে বুবুন। মামার প্রতি ভালোবাসা আছে, তবে মামার ব্যক্তিত্ব বুবুনের পছন্দ না, মামি আত্মকেন্দ্রিক, স্বেচ্ছাচারী, একটু অন্যরকম হলেও মামির মধ্যে একটা অন্য রকম কনফিডেন্স, স্পিরিট আছে, তাই মামিকে খারাপ লাগেনা বুবুনের, এ কথাও জানা হয়ে গেছে অজন্তার। চাচা-ফুপুরা স্বার্থপর , ময়না খালা আত্মীয়ের চেয়ে বেশি, সব বলা হয়ে গেছে বুবুনের। রাজেশ্বরীর কথা বলতে যেয়ে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়েছে বুবুনের, গলা ভেঙে গেছে বারবার।

বুবুনের জীবন বৃত্তান্ত শুনে অজন্তা প্রশ্ন করেছে, মা’কে পছন্দ করেনা কেন বুবুন, মায়ের দোষটা কোথায়?

“ভালোবাসি, হাজার হোক মা’তো। কিন্তু পছন্দ করিনা, রেসপেক্ট করিনা। একজন ডক্টর, স্পিরিটলেস। পোষ্ট গ্রাজুয়েশন করলোনা। মেডিকেল অফিসার হয়ে দিন কাটালো। এই যুগে চার বাচ্চার জন্ম দিয়ে ওয়ার্থলেস হয়ে গেলো।সাত বাচ্চা নিয়েও একজন মেয়ে অনেক স্ট্রং হতে পারে, কিন্তু তিনি পারেননি। না ঘরকা, না ঘাটকা। আমাদেরতো নানা-বুবুই মানুষ করেছে বলতে গেলে, রাজ চলে গেলো, পাহাড় সমান বেদনা নিয়ে আমরা সবাই ঠিকই যে যেমন পারি জীবন সংগ্রামে নেমে পড়লাম, তিনি শয্যা নিলেন। আমার নানা-বুবু -মামা-তিতলীমনি -বাবা -মেরিনা আন্টি-মামী-ময়না খালা,নেইবাররা সবাই নিজেদের কাজকর্ম ম্যানেজ করে উনাকে সময় দেন, কিন্তু তাও শোককে বুকে নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়াতে পারেননা।হয় বিছানায়, নইলে জায়নামাজে পড়ে থাকেন। যেন দুনিয়াতে উনার বাপ-মা,স্বামী-সন্তান কেউ নেই। উনাকে নিয়ে সবাইকে এতো ব্যস্ত থাকতে হতো, তুতুনকে আমরা কেউ সময় দিতে পারতামনা। সেন্টিমেন্টাল ছোট্ট ভাইটা আমার একাকীত্ব সহ্য করতে না পেরে পানের জর্দা মুঠাভরে খেয়ে ফেলেছিলো যেন ওর দিকে সবাই অ্যাটেনশন দেয়। তারপরে তিনি চাকরি ছাড়লেন। রাজকে হারিয়ে তাঁর মন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে গেছে, বাসায় থেকে তিনি স্বামী, বাকি সন্তানদের দেখেশুনে রাখবেন। ভালোই দেখে শুনে রেখেছিলেন, গরম তেল পড়ে লুম্বিনীর মরণদশা হলো। আমার বাপ অন্য মেয়ের সাথে কঠিন প্রেম চালাতে লাগলো।ইনি এমন স্ত্রী , কিছু টেরই পেলেননা। যখন পেলেন, তখন খামখেয়ালিপনা।এই একবার মামলা করছেনতো পরক্ষণেই আবার মামলা তুলে নিচ্ছেন। কতো নাটক ! আমাকে অসভ্য মেয়েটা দারুণ নোংরা একটা কথা বলেছিলো। আমি তাকে বলেছিলামও। তাও তাঁর অপমান লাগেনি।আমার যে কি ভয়ংকর কষ্ট হয়েছিলো,তা উনি বুঝেও বুঝেননি। দিব্যি নিশ্চিন্ত জীবনের আশায় ঐ স্বামীকেই মেনে নিলেন, ছেলেমেয়েদের দোহাই দিয়ে। কেন, একা ছেলেমেয়ে মানুষ করার ক্ষমতা উনার ছিলোনা? ছিলো। কিন্তু উনি হলেন স্বর্ণলতা, অন্যকে অবলম্বন না করে একা বাঁচতে বা বাঁচাতে পারেননা। এইসব কেঁচো স্বভাবের মানুষকে আমার পছন্দ হয়না। এখনো সংসার চালাচ্ছে আমার বাবা।উপার্জনও করছে, লুম্বিনী -তুতুনের সব দেখাশোনাও করছে। উনি শুধু দুঃখী দুঃখী মুখ করে শুয়ে থাকেন।”

“উনারতো আরো বেশি করে কাজে এনগেজড হওয়ার কথা রাজেশ্বরীর শোক ভুলার জন্য।”

“উনি জাতে মাতাল,তালে ঠিক।”

“তবে আরিয়ান, তোমার বাবা এতো হ্যান্ডসাম, যে মেয়ে উনাকে দেখবে,সেই পাগল হয়ে যাবে। ”

“আমিও ভেবেছি এটা।আমার বাবাকে তুমি দেখেছো, মা’কে দেখোনি।বাবার মতো এতো হ্যান্ডসাম মানুষ কেন বিয়ে করলো মা’কে, এটা বিস্ময়।আর মা নিজেকে একটু গুছিয়ে গাছিয়ে রাখলেও হতো। সবসময়ই এলোমেলো, কোনো সাজগোজ নেই, রাজ চলে যাওয়ার পরেতো সন্ন্যাসীর মতো অবস্থা। এটাও ঠিক, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, এক আলাভোলা, সংসারের প্রতি দায়দায়িত্বহীন, সারাক্ষণ মরা মরা ভাব নিয়ে থাকা মহিলাকে নিয়ে ঘর সংসার চালিয়ে যাওয়া বাবার মতো হ্যান্ডসাম মানুষদের পক্ষে কঠিনই, বাবা যে ঐ নোংরা মেয়ের ফাঁদে পা রেখেছে, তারজন্য মায়ের দোষ আশিভাগ। অল্প বয়স ছিলো, বুঝিনি, এখন বুঝি।”

“আমার বাবা-মায়ের কাছে আংকেলের এই ভুলটা বলার দরকার নেই। ঘটনাতো বেশি মানুষ জানতে পারেনি, তাইনা? ”

“পরে যদি কোনভাবে জানতে পারেন? ”

“পাগল! কেউ জানবেনা।ঐ দেশে আমাদের কোনো আত্মীয় বন্ধুও নেই।”

অজন্তা তার বাপ-মা -বোনের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে বুবুনের। এমন রাজপুত্রের মতো দেখতে অতি মেধাবী পাত্রকে কার না পছন্দ হয়? ছেলের বাবা, বোন আর ভাই এসে দেখা করেছেন এখানে। এমন হ্যান্ডসাম বাবা, বাংলাদেশের দ্য গ্রেটেস্ট সার্জনকে অজন্তার শ্বশুর হিসাবে সবার পছন্দ। ছোটো ভাইবোন কি সুন্দর! কি গুণবান! ছেলের মা ও ডাক্তার।

আরিয়ানের ফিয়াঁসে আছে, তা প্রথম জানতে পারে ভাইবোনদের দল। আরিয়ানই জানায়। ভিডিও কলে আলাপ করিয়ে দেয় অজন্তার সঙ্গে। হবু ভাবীকে দেখে শুনে ভীষণ খুশি ইরফান, আয়মান, লুম্বিনী, আরহাম, অরণ্য, অরণীর দল। এরপরে বুবুন জানায় তার প্রাণের বুবুকে। অজন্তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। বুবুর আনন্দের সীমা থাকেনা। আনন্দের আতিশয্যে তিনি মোবাইল ধরিয়ে দেন নাজমুল সাহেবকে।নানাও মহাখুশি। তারপরে বুবুন জানায় তিতলীমনিকে।তিতলী মনি আর খালু মিলে যেন বাবাকে জানায়।বাবাকে সাধ্যমতো এড়িয়ে চললেও কি যেন একটা আছে বাবার মধ্যে, বুবুন এরজন্য ভয় পায়,একটু সমীহও করে বাবাকে।

বুবুন যে একজন মেয়েকে বিয়ে করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত, তা সবার শেষে জানলো বুবুনের গর্ভধারিণী। নিজের আর ভাইবোনের ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে। মা আর বোনের মুখে। তিতির স্তব্ধ হয়ে গেলো।আর কেন যেন ঝট করে মনে হলো সেই মেয়েটাকে যাকে বুবুন গোলাপ দিয়েছিলো,সেই দৃশ্য গোপনে গোগ্রাসে গিলছিলো ছোট্ট রাজ আর লুম্বিনী এবং ঘটনা যথারীতি কায়দা করে তুলে দিয়েছিলো বাপ-মায়ের কানে।

আসিফ, লুম্বিনী, তুতুন কানাডায় যেয়ে অজন্তাদের বাসায় দাওয়াত খেয়েছে, এতোবড় ঘটনা এতোদিনেও তিতিরকে জানায়নি ওরা।কি আশ্চর্য ! লুম্বিনী এ কথা শুনে বললো, ” আমরা ভাইয়ার কয়েকজন বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেয়েছিলাম, এরমধ্যে যে ওর ভবিষ্যৎ শ্বশুরবাড়িও ছিলো, তা তখন বুঝতাম কিভাবে? ”

“তারপর যখন জানলি অজন্তার সাথে বুবুনের সম্পর্ক, ভাইবোনেরা প্রায় কথা বলতিস অজন্তার সাথে, তখন একবারও মনে হয়নি মা’কে জানানোর কথা?”

“আমাদের গ্রুপটাতে শুধু ভাইবোনদের কথা হয়, সেই কথাগুলো বাইরে প্রকাশ নিষেধ। ভাইয়ার বিয়ের কথা ভাইয়া ই তোমাকে জানাবে। ”

তিতির ভগ্নিপতির দিকে তাকালো,” তোমাকে কি বলেছে বুবুন? ”

“ঐযে বললাম না আপা, বুবুন দুলাভাইকে অজন্তার ব্যাপারটা বলতে বলেছে।”

কলকল করে কথা বলছে সবাই , আনন্দে -খুশিতে, তিতির চুপ করে বসে রইলো।

“দুলাভাই, আপনিতো দেখেছেন অজন্তাকে, কেমন লেগেছে আপনার?”

“খুব ভালো মেয়ে।ফ্যামিলি এক্সিলেন্ট। ”

“বুবুন বলছিলো অজন্তার বাবা-মা তাড়াতাড়ি ওদের বিয়ে দিতে চান। সমস্যা
হলো দেশে তাঁরা বহুকাল আসেননি,এখানকার সব প্রপার্টি তাঁরা বিক্রি
করে দিয়েছেন বহুৎ আগে।আত্মীয় স্বজন বেশিরভাগ প্রবাসী। এখন ওঁদের চাওয়া, বিয়ে কানাডাতে হোক, ওখানে বিয়ে পড়ানো হবে, উনাদের সাইডের আত্মীয়রা থাকবেন প্রায় চার পাঁচশ, এখান থেকে আমরা যতোজন যাই, উনাদের আপত্তি নেই। শুধু সংখ্যা জানালে উনারা ঐভাবে থাকার ব্যবস্থা করবেন। বুবুন, অজন্তা আর অজন্তার ফ্যামিলি সময় সুযোগ মতো দেশে আসলে তখন আমরা বড় করে প্রোগ্রাম করবো।”

তিতলী ঝলমলে গলায় বললো, ” মেয়ে যে কি সুন্দর ! বাড়ির প্রথম ছেলের বৌ সুন্দর হলে পরের বৌগুলোও সুন্দর হবে।”

নিশাত বললেন, ” ডানাকাটা পরী।তবে আমার যাদুসোনাও তো কম যায়না। রাজপুত্রের জন্য তো রাজকন্যাই আসবে, তাইনা? ”

বুবুন কানাডায় যাওয়ার পর থেকে আসিফের পরিবারের সাথে আবার আসা যাওয়া শুরু হয়েছে।ননদ,ননাস, দেবর জা,ভাগ্নে ভাগ্নি প্রায় আসে এ বাড়িতে। তিতির তার স্বভাবজাত আন্তরিক আদর যত্ন করে, খাওয়ায়। তবে বড্ড চুপচাপ থাকে। আসিফ,লুম্বিনীর সাথে ওদের খুব ভাব। স্বামী বা ছেলেমেয়েদের সামনে ওরা এখন তিতিরকে নিয়ে খারাপ কথা বলেনা। তুতুন বরাবরই অতি সহজ সরল, সদানন্দ মানুষ। কাউকে নিয়ে তুতুনের অভিযোগ নেই কোন।

নিশাত যেই বললেন, ” রাজপুত্রের জন্য তো রাজকন্যা ই আসবে,তাইনা? “, তুতুনের সেজ ফুপু চট করে মধুর গলায় বললেন, ” সবসময় কি তাই হয়, খালাম্মা? ” ইঙ্গিত বুঝতে পারলো সবাই, তুতুন আর অরণ্য -অরণী ছাড়া। কিন্তু ঐ প্রসঙ্গে কেউ কোনো কথা বললোনা। সবার আগ্রহ এখন বুবুনের বিয়েকে ঘিরে। আসিফের কাছে কোনো আশা করেনা তিতির, কিন্তু বাবা-মা -তিতলী? সবচেয়ে বড় কথা লুম্বিনী? কানাডায় কে কে যাবে, সেই লিস্ট নিয়ে সে তখন ব্যস্ত।

নাজমুল সাহেব বললেন, “ছেলের মায়ের কোনো কথা শুনছিনা কেন? ”

তিতির স্বাভাবিক গলায় বললো, ” কি বলবো বাবা? তোমরা সবাই যেমন সিদ্ধান্ত নিবে, তেমনই হবে।আমার আলাদা কথা নেই। ”

লুম্বিনী ঝটকা দিয়ে তার সুন্দর চুলগুলো সরিয়ে বললো, ” আমাদের কোনো ব্যাপারে মায়ের কোন আগ্রহ বা মতামত নেই , নানাভাই। মা থাকে নামাজ কালাম, প্রকৃতি , ফুল, পাখি, নদী এসব নিয়ে। আমাদের কথা ভাবার, আমাদের কথা শোনার, আমাদের আনন্দের ভাগীদার হওয়ার, আমাদের আবদার পূরণ করার,আমাদের সাথে বেড়াতে যাবার কোনো ইচ্ছা মায়ের নেই। বাবা বহুকাল ধরেই বাবা-মা দু’জনেরই রোল প্লে করছেন। ”

চলবে।

#সংসার
পর্ব ৫০
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

“কেমন আছো বুবু? মুখটা শুকনা দেখাচ্ছে কেন? নানাভাই কোথায়? ”

খুশিতে নিশাতের চোখে পানি চলে আসলো। অজন্তা এমন ভাবে কথা বলছে যেন সাত জন্মের চেনা। দু’দিন পরপর ফোন করে হবু নানা শ্বশুর-নানি শাশুড়ির খবর নেয়। কখনো বুবুন সাথে থাকে, কখনো অজন্তা নিজের থেকেই ফোন করে। খুব আন্তরিক ভাবে সবার খবর নেয়।নিশাত তো এটুকুই চান, তিনি বা তাঁর স্বামী, ছেলেমেয়েরা কখনো চাননি বৌ এসে তাঁদের রান্না করে খাওয়াবে, ঘরের কাজ করবে, পা টিপে তাঁদের খেদমত করবে। তাঁদের চাওয়া ছিলো, তাঁরা বৌকে আপন করে নেবেন, ভালোবাসবেন, বৌও তাঁদের পর ভাববেনা, কাছে এসে মাঝেমধ্যে বসবে, তাঁদের সাথে গল্প করবে, তাঁদের বাবা-মা ডাকবে, তাঁদের সুখ -দুঃখে মেয়ের মতো পাশে দাঁড়াবে। তমার কাছ থেকে তাঁরা এসব পাননি। হবু নাতবৌটিকে খুবই ভালো মনে হচ্ছে।

“ও বুবু, তোমার নাতির মুখে সারাক্ষণ নানা-বুবু, লুম্বিনী -তুতুন, তিতলীমনি। আমাকে বিয়ের পরে পাত্তা দেবে তো? ”

“পাত্তা দেবেনা মানে? মাথায় তুলে রাখবে। ”

“বললেনাতো,মুখটা শুকনা কেন? ”

“কই শুকনো,সোনা? বাজার করে এলাম তো কেবল ! তাই কাহিল লাগছে।”

“কি বাজার করলে? ”

“এই পুঁই শাক, করলা, ঝিঙে, ঢ্যাঁড়স, কয়েকটা মুরগি। ”

“অনলাইন শপিং সিস্টেম আছে না? ”

“আছে সোনা। কিন্তু ওরা সবসময় ভালো জিনিস দেয়না। ”

” তুমি গেলে কেন? ইরফান কোথায়? ”

“ইরফানের জ্বর এসেছে। ”

“প্রতিদিনের বাজার তুমি করো? ”

“না,না। তিতির, মানে তোমার হবু শাশুড়ি, আমার বড় মেয়ে, সপ্তাহে দুইদিন অন্ততঃ আসে। মাছ, মাংস, শাকসবজি , মশলাপাতি, ফলমূল, বাপ-মা-ভাইপোরা যা পছন্দ করে সেসব, ওষুধপত্র সব কিনে নিয়ে আসে। এতো বকি, কাজ হয়না।মাসের শুরুতে মাস কাবারি বাজার করে দিয়ে যায়। ও আমার পাগল মেয়ে। হাজার বকলেও কানে নেয়না। যখন থেকে উপার্জন করা শুরু করেছে, তখন থেকেই এমন করে। ও একটু অন্য রকমের। সবার জন্য একটু বেশি মায়া, বেশি দায়িত্ববোধ। পাঁচদিন আগে এসেছিলো, এরপর আসেনি। শরীর খারাপ। বালিশ থেকে মাথা তুললে নাকি মাথা ঘুরছে।”

” উনি, মানে আমার শাশুড়ি মায়ের সাথে এখনো কথা হয়নি। ফোন করিনি ভয়ে। উনি নাকি খুব চুপচাপ। কথাবার্তা বলতে চাননা, ফোনে কথা বলতে চাননা।তাই সাহসে কুলায়নি। ”

” আগে চুপচাপ ছিলোনা, বুবুন যাওয়ার পরে একটু বেশি চুপ হয়ে গেছে।তাই বলে রাগী না।তুমি নিশ্চিন্তে ফোন করতে পারো। ”

“ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। অ্যাকসেপ্ট করেননি।”

“ও তো ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ কিছুই ব্যবহার করেনা, অনেকদিন হলো।”

“কি করে সময় কাটে উনার? ”

“আগে তো খুবই কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতো। চাকরি,ছেলেমেয়ে, স্বামী,আমরা, শ্বশুরবাড়ি, ওর মামা-খালা-চাচা -ফুপুরা। বনধু, প্রতিবেশী, কলিগ…. সবার সাথে খুব আসা যাওয়া ছিলো। কয়েক বছর হলো নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে।”

” কেন বুবু? একজন হাসিখুশি, সবাইকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসা মানুষ এমন হয়ে যাবে কেন? ”

” রাজের মৃত্যু , বুবুন পড়তে গেলো কানাডায়। খুব ছেলেমেয়েঅন্ত প্রাণ, তাই মন খারাপ থাকে।”

“আরিয়ানের সাথে ওর মায়ের সম্পর্কে খুব বেশি দূরত্ব। কেন, বুবু?”

নিশাত থমকে গেলেন, তারপরে বললেন, ” বুবুন আমাকে বলেছে, পারিবারিক সব কথা, স্ক্যান্ডাল ও তোমাকে জানিয়েছে।”

“আরিয়ান তোমাকে সত্যি কথাই বলেছে। বুবু, আরিয়ান পছন্দ করে খুব বোল্ড, সেল্ফ কনফিডেন্ট মহিলাদের, সেই সাথে ক্যারিয়ারিস্ট। সে নিজের মাকে জাজ করতে পারেনি। যে মানুষকে সন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়, স্বামীর পরকীয়া ও দ্বিতীয় বিয়ের ফয়সালা নিজের হাতে করতে হয়, থানা-পুলিশ করতে হয়, নিজের সন্তান যখন ঘৃণা করে তাকে ছেড়ে চলে যায় ও যোগাযোগ করেনা, সেই মহিলা এরপরও বাবা-মায়ের প্রতি সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করে, অভিমান আর অপমানে ভাইপোরা যেন ভুল পথে চলে না যায়, সেই চেষ্টা করে, ভালোবাসা-মমতায় তাদের আগলে রাখে, সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক সুস্হতা এবং তাদের একটা মানসম্মত জীবন দেওয়ার জন্য নিজের সম্মান, কষ্ট দূরে সরিয়ে রেখে সেই স্বামীর সাথে সংসার করে যেতে পারে, এতো অন্যায়ের পরেও ঘৃণার পাশাপাশি স্বামীকে আন্তরিক ভাবে ভালোবাসে, অত্যাচারী শ্বশুর বাড়ির সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করেনা, নিজের দায়িত্বটুকু নীরবে পালন করে যায়, সে স্ট্রং নয়? কোথায় তার অপরাধ? ”

নিশাত ভাঙা গলায় বললেন, “এগুলো আরিয়ানকে বুঝাও আপু। আমরা বুঝাতে বুঝাতে হাল ছেড়ে দিয়েছি।”

“আমিও এই কথাগুলো ওকে অনেক বলেছি। বলেছি, আরিয়ান, তোমার মা নিজের সুখ, হাই প্রোফাইলের জন্য তোমার বাবার সাথে ঘর করেননা। তিনি লুম্বিনীকে এপিলেপ্সি আর হিস্টেরিয়া থেকে, ডিপ্রেশন আর সোস্যাল হিউমিলিয়েশন থেকে বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাবাকে ছাড়া শোকে পাগল হয়ে যাওয়া তুতুনকে সিভিয়ার সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার হতে বাঁচানোর জন্য তিনি তোমার বাবার ঘর করছেন, তোমার বাবা যেন মানসিক চাপে সুইসাইড না করেন, তার জন্য তোমার মা আত্মাহুতি দিয়েছেন।তাছাড়াও প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব অনুভূতি , নিজস্ব ইচ্ছা থাকে। তিনি তাঁর স্বামীকে ভালোবাসতেন, প্রতারিত হওয়ার পরও ভালোবেসেছেন। মায়া কাটাতে পারেননি। তাঁর এই ফিলিংসটাকেও সবার মেনে নিতে হবে। এমনতো নয় যে স্বামী বারবার ব্যাভিচার করছে, তিনি বারবার মেনে নিচ্ছেন। একবারতো ক্ষমা করাই যায়, তাইনা বুবু? এমনও না, সারাক্ষণ তাঁরা ঝগড়াঝাটি করেন, বাচ্চাদের উপরে মানসিক চাপ পড়ে,কিন্তু সেটা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। পাস্টে একটা খারাপ ঘটনা ঘটেছিলো, তার রেশ ধরে রাখার দরকার কি? ”

“বলেছো বুবুনকে এই কথাগুলো?”

“অনেকবার। গতকাল লুম্বিনীকেও বলেছি। ওকে বললাম, মা এক কালে তোমাকে কোলে কোলে রাখতো? তোমরা দুই বোন দুষ্ট ছিলে, অনেক মা ই বাচ্চাদের যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যায়,মারধোর করে, তোমাদের মা তা করেছে? ময়না খালা ছুটি ছাটায় বাড়ি গেলে তখন তোমাদের মা নাকি ছুটি নিতেন নইলে তোমাদের নিজের অফিসে নিয়ে যেতেন? রাজ মারা যাওয়ার পরে তোমার মা তোমার জন্য কি কি করতেন, একটু মেমোরাইজ করতো? তোমার অসুস্থতা সারাতে কে বেশি শ্রম দিয়েছে, ভালো করে ভেবে দেখোতো।তুমি কি মায়ের কারণে পুড়ে গিয়েছিলে? তুমি পুড়ে যাওয়ার পরে মাসের পর মাস তোমার সেবা শুশ্রূষা কে করতো দিনরাত এক করে? তোমাদের চার ভাই বোনের বাল্যশিক্ষা কার হাতে? লুম্বিনীর কমপ্লেইন, মা অনেকদিন ধরে তাদের সাথে খেতে বসেনা, বেড়াতে যায়না, মার্কেট বা অন্য কোথাও যেতে মায়ের ইন্টারেস্ট নেই, ব্লা,ব্লা, ব্লা।আমি বললাম, ননদিনী , হাতে একটা দাঁড়িপাল্লা নাও, একটাতে রাখো মায়ের কাজগুলো, বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে যে যে কাজ মা তোমার আর তোমাদের ভাইবোনের জন্য করেছে।আরেক পাল্লায় মায়ের অপরাধগুলো দেখো।মা তোমাদের সাথে খেতে বসেনা, মা আদৌ খায় কিনা, খোঁজ নাও তোমরা? ”

” অজন্তা, বুবু, তুমি তাড়াতাড়ি আসো এ সংসারে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“তোমার বিরুদ্ধেও কমপ্লেইন আছে আমার। সারাক্ষণ নাকি খিটমিট করো, এমনকি তোমার মেয়ের সাথেও, খুব নাকি কথা শোনাও, তোমার কছ থেকে আশা করিনা এসব। ”

“কে বললো এগুলো? ”

“ইরফান। ”

“অজন্তা, আমি কি ভালো আছি? এক ছেলে, তার জীবন নষ্ট করে দিলো বৌটা। শুধু তার নয়, ইরফান আয়মানের জীবনও। ছেলে দুটো হোস্টাইল হয়ে যাচ্ছে ।দেখতে হয় আমাকেই। বড় মেয়ের সংসারের এই অবস্থা। তোমার নানাভাই আমার একটা কথা শুনেনা।”

” তারমধ্যেও ভালো ঘাকার চেষ্টা করো। কাল তোমার নাতিকে বললাম, এতো যে তিতলীমনি, তিতলীমনি করো, তিতলীমনি নিঃসন্দেহে খুব ভালো।কিন্তু তিতলীমনি তার ক্যারিয়ারের সেকেন্ড ইনিংসে সফল হওয়া দূরের কথা,শুরুই করতে পারতেননা যদি আমার শাশুড়ি অরণ্য -অরণীকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট না দিতেন। ঠিক না, বুবু? ”

“তাই। সবচেয়ে বড় কথা, আসিফ এই অবস্হানের ধারের কাছে আসতে পারতোনা, যদি আমার মেয়েটার অসীম ত্যাগ -তিতিক্ষা না থাকতো। আসিফের পোষ্ট গ্রাজুয়েশনের সময় চাকরি, বাচ্চা, সংসার, শ্বশুর শাশুড়ির যত্ন একহাতে সামলেছে আমার মেয়ে, আসিফের গায়ে আঁচ লাগতে দেয়নি। বেতনের পুরো টাকা সংসারে খরচ করতো মেয়ে। শাড়ি,গয়না কোনো কিছুর এতোটুকু চাহিদা ছিলোনা কখনো। বুবুনকে আমরা দিনের বেশিরভাগ সময় আমাদের কাছে রাখতাম অনেকটা আমাদের স্বার্থে। ওকে না দেখে আমরা কেউ থাকতে পারতামনা। ওর মা অফিস যেতো, আমরা গোসল করাতাম, খাইয়ে দিতাম বুবুনকে, ওর মা অফিস থেকে এসে বুবুনের দায়িত্ব নিতো।”

লুম্বিনী একটা প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য মায়ের একটা শাড়ি খুঁজছিলো। লুম্বিনীর নিজের অনেক শাড়ি আছে, বাবার দৌলতে হাতে টাকাও আছে অনেক। কিন্তু মায়ের ঐ ময়ূরকণ্ঠী দামী শাড়িটা তার খুবই পছন্দ। ঐ ডিজাইন অনেক আগেই উঠে গেছে, নইলে অমন ডিজাইনের তিন চারটা শাড়ি কিনে রাখতো লুম্বিনী। বাবা কিনেছিলেন মায়ের জন্য। অনেক দাম দিয়ে। মা নিজে তেমন কেনাকাটা করেনা, যদি বা নিজের জন্য কিছু কিনে, সুন্দর কিন্তু অল্পদামী। সব পার্টিতে তো আর কমদামী জিনিস পরা যায়না।

ময়ূরকণ্ঠী শাড়িটা টেনে বের করার সময় ঝুপঝুপ করে কয়েকটা ফাইল নিচে পড়লো।

সবিষ্ময়ে লুম্বিনী দেখলো, দুইজন সাইকিয়াট্রিস্টের ফাইল। দু’জনেই মায়ের অসুখ সম্পর্কে মোটামুটি একই কথা লিখেছেন, Apathy. বাবা প্রায় মেডিকেল টার্ম শেখান লুম্বিনী -তুতুনকে। এপ্যাথির অর্থ জানে লুম্বিনী। Lack of interest in everything. জীবনের কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই, আনন্দ নেই। Severe headache.মায়ের সারাক্ষণ নাকি প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকে। Virtigo, মায়ের মাথা ঘুরে। ডাক্তারের ডায়াগনোসিস হলো সিভিয়ার ডিপ্রেশন । মায়ের হিস্ট্রিতে কোথাও লেখা নেই যে তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলো, তার একটা সন্তান মারা গেছে, প্রথম সন্তান মা’কে পছন্দ করেনা, মায়ের চেহারা নিয়ে অনেক অকথা কুকথা হয়, শ্বশুরবাড়ি অনেক অত্যাচার করেছে। এগুলো কিছুই লেখা নেই। মা একই কথা বলেছেন ডাক্তারদের, তাঁর কিছু ভালো লাগেনা, কিছুই ভালো লাগেনা, কিচ্ছু ভালো লাগেনা। তাঁর ভীষণ মন খারাপ লাগে, চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর অসম্ভব মন খারাপ লাগে, তাঁর কোন পারিবারিক সমস্যা নেই, তাঁর কোনো ভয়ংকর ইতিহাস নেই। এমনিতেই খুব বিষন্নতায় ভুগেন, শরীর ভারি দুর্বল লাগে।

দুই সাইকিয়াট্রিস্ট উপদেশে মোটামুটি একই কথা লিখেছেন ইংরেজিতে,

নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাবেন। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের সাথে যোগাযোগ করুন।

দৈনিক আট ঘন্টা ঘুমাবেন।

একা থাকবেন না। যাদের সান্নিধ্যে ভালো লাগে, তাদের সাথে বেশি করে থাকুন।

হাসুন। হাসি না আসলেও জোর করে হাসুন।

নিয়মিত নামাজ পড়ুন। আল্লাহর উপরে পূর্ণ ভরসা রাখুন।

নিয়মিত মেডিটেশন করুন।

পরবর্তী ভিজিটের সময় অবশ্যই কাউকে সাথে নিয়ে আসবেন।

দুই ডাক্তারই কিছু টেস্ট দিয়েছেন, ব্রেইনের এম আর আই সহ। মা হাজার বলাতেও টেষ্ট করেননা এবং সাথে কাউকে নিয়ে আসেননা বারবার নির্দেশ দেওয়া স্বত্বেও, এটাও লেখা আছে ফাইলে। Patient is non co operative. দুই ডাক্তারের অভিমত। দু’জনেই কিছু ওষুধ দিয়েছেন। আরেকটা ফাইল দেখে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো লুম্বিনীর। কাছেই একটা হাসপাতালের আউটডোরের টিকেট। একটা ইসিজি রিপোর্ট। কমেন্টে লেখা, ” Abnormal ECG. Suggestive of ischemia with evidence of old MI.” মানে, মায়ের হৃৎপিণ্ডটা ব্লাড সাপ্লাই পাচ্ছেনা ভালোভাবে, আর এর আগে মায়ের একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। কবে?
আউটডোরের টিকিটে মা’কে আরজেন্টলি ইকো আর অ্যানজিওগ্রাম করতে বলা হয়েছে। হাসপাতালে অবিলম্বে ভর্তি হতে বলা হয়েছে। পাল্স অনিয়মিত, ব্লাড প্রেশার ২১০/১৩০।

লুম্বিনী মায়ের খোঁজে গেলো। ভাইয়ার রুমে ঘুমাচ্ছে মা।

চলবে।