#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ২৫
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[কপি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[শুধুমাত্র প্রাপ্ত মনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]
আরও একটা ব্যস্ত দিনকে বিদায় জানিয়ে সন্ধ্যা তিমিরে মুড়িয়ে গিয়েছে চারিপাশ। বাইরে বৃষ্টি নেই, তবে প্রবল বেগে হাওয়ার তান্ডব চলমান। ক্রীতিকের বাড়িটা ক্যালিফোর্নিয়া আর সানফ্রান্সিসকোর মাঝামাঝি শহরতলীতে হওয়ায় আশপাশের নির্জন পরিবেশ ছাপিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আগত ঝিরিঝিরি হাওয়ার তান্ডবটা বরাবর একটু বেশিই মনে হয়। কিন্তু আজ সন্ধ্যার ঝড়ো হাওয়াটা তার চেয়েও দিগুণ মনে হচ্ছে। হঠাৎ করেই কেন এই ঝড়ো হাওয়া কে জানে?
সারাদিন পরে মাত্রই ভার্সিটি থেকে বাড়িতে ফিরেছে ক্রীতিক। পরনে ইতালিয়ান দের মতো আঁটোসাটো ফর্মাল স্যুট। স্যুট গলিয়ে পুরুষালী শরীরের পেশিগুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান। হাতে সিলভার রঙের রোলেক্স ঘড়ি, মাথার চুল গুলো ব্যাকব্রাশ করে সেট করা। এই ক্রীতিককে দেখলে কেউ ভুলেও বলবে না, যে সে ছন্নছাড়া, বেপরোয়া, আর উদভ্রান্তের মতো বাইক রাইড করে। যার কাছে নিজ জীবনের দু’পয়সার মায়াটুকু নেই। ওর ভেতরের মায়া আসক্তি যেটুকুই আছে তা একমাত্র অরুকে ঘীরে।
হুহু বাতাসের মাঝেই ক্রীতিক গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে সোজা ঢুকে গিয়েছে বাসার মধ্যে। পাসওয়ার্ড টিপে হলরুমে পা রাখতেই একটা শুষ্ক ঢোক গিললো ক্রীতিক। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ছেয়ে আছে, কোনোরূপ মানুষের আওয়াজ নেই, একটা নিঃশ্বাসের শব্দও নেই। তাহলে অরু, অনু ওরা কোথায়? সকালেই তো ক্রীতিক অরুকে বাড়িতে দেখে গিয়েছে,তাহলে এখন কোথায়? অরুকি সত্যিই চলে গেলো?
মস্তিষ্কের ভেতর একের পর এক হা’মলা দিতে থাকা দানাবাঁধা অসহিষ্ণু প্রশ্নের উত্তর ভাবতে গিয়েই সুদর্শন তীক্ষ্ণ চোয়ালটা আরও আরও খানিকটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো ক্রীতিকের, দাঁত গিয়ে ঠেকলো দাঁতের সাথে। ও দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে সুইচবোর্ড চেপে হলরুমের আলো জ্বালালো। আলো জ্বালাতেই কিচেনের ওপাশ থেকে মিয়াঁও মিয়াঁও আওয়াজ করে গা ঢাকা দিলো ডোরা, ক্রীতিক ডোরার দিকে এক নজর দৃষ্টিপাত করে চেঁচিয়ে অরুর নাম করে ডেকে উঠল,
—অরুউউউ! অরুউউ! এক্ষুনি নিচে নাম, নয়তো আমি উপরে গেলে তোর খবর আছে।
নাহ দোতলার ঘর থেকে কোনোরূপ আওয়াজ ভেসে আসলো না, অরুও হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলোনা। রাগে ফোঁস ফাঁস করতে করতে এবার ক্রীতিক নিজেই সোজা দোতলায় গিয়ে অরুদের রুমে ঢুকে যায়। রুমে ঢোকা মাত্রই দুচোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো ক্রীতিক। যা ভেবেছিল তাই, অরু ওকে না জানিয়েই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে, রুমের মধ্যে এখন আর অরুর একটা সুতোও অবশিষ্ট নেই। থাকলে হয়তো সেটাকেও চুলের মতো বাক্সবন্ধি করে রাখতো ক্রীতিক। এই মূহুর্তে মস্তিষ্কের রাগ, জিদ,হিং’স্রতা সবকিছু ছাপিয়ে ভেতরটা তীব্র দহনে পু’ড়ছে খুব। অরু ক্রীতিককে না জানিয়েই চলে গেলো, কি করে পারলো এটা?
বেশ কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেলে বুকের ভেতরে অনেকটা অক্সিজেন মিশ্রিত বাতাস ভরে নিয়ে চোখ খোলে ক্রীতিক। চোখ খুলতেই আবারও সেই অজানা হাহাকার, অরু নেই, অরুর পায়ের নুপুরের রিনঝিন আওয়াজ নেই, অরুর শরীরের গন্ধ নেই, কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু নেই। এই মূহুর্তে পুরো বাড়িটাকেই মৃ’ত্যুপুরি ঠেকছে ক্রীতিকের নিকট, ওর কেন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে এখানে, শরীরের মাঝে কুন্ডলী পাকিয়ে ওঠা তীব্র অস্থিরতা দমাতে একেএকে কোর্ট, টাই, ঘড়ি সবকিছু খুলে মেঝেতে ছু’ড়ে মা’রে ক্রীতিক। আজ আবারও বহুদিন বাদে সেই পুরনো বিষন্নতা এসে হানা দিয়েছে মস্তিষ্কে, মনে হচ্ছে এমন দম বন্ধকর পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃ’ত্যুই শ্রেয়।
যেহেতু ক্রীতিক অনেক দিনের চলমান চিকিৎসার প্রভাবে আগের চেয়ে ভালো আছে, তাই আপাতত নিজেকে সামলে নিতে পারছে। তবুও এসব কু’চিন্তা ভাবনা গুলোকে দূরে ঠেলতে চায় ও। কিন্তু এই বদ্ধ রুমের ভেতরে এক ফোটা দম নেওয়ার উপায় নেই। তাহলে কি করা যায়?অতঃপর কিছু একটা ভেবে দ্রুত দোতলা থেকে নেমে আসে ক্রীতিক। নিচে গিয়ে বাইকের চাবি আর হেলমেট নিয়ে বেড়িয়ে পরে কোনো এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
*****************************************
ছোট মতো জীর্নশীর্ন কোনো ফ্ল্যাট নয়, অরুদের জন্য রেন্ট করা হয়েছে বিলাসবহুল এক এপার্টমেন্টাল ভবন। অরুদের এপার্টমেন্টটা ভবনের তিন তলায় অবস্থিত৷ আজমেরী শেখ হার্টের রোগী তাই খুব বেশি উপরে নেওয়া হয়নি বাসাটা। সন্ধ্যা থেকে সবকিছু গোছগাছ করতে করতে প্রায় রাত হয়ে গিয়েছে অনেক। ওরা তিনজন ছাড়াও আজমেরী শেখের নতুন এসিস্ট্যান্ট রাজ হাতে হাতে অনেকটা সাহায্য করেছে সব কিছুতে । ছেলেটা বাঙালি, দেখতে শুনতেও বাঙালিদের মতোই শ্যাম বর্নের। সভাব চরিত্র মোটেও গুরুগম্ভীর নয়, কথায় কথায় হাসে, অন্যকেও হাসায়। আজমেরী শেখের মতো বিচক্ষণ মহিলাও তার কথায় হাসতে বাধ্য হয়, রাজকে পেয়ে অনুও অনেকটা নিশ্চিন্ত, ছেলেটা মায়ের ভালোই খেয়াল রাখতে পারবে,সেটা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। রাজ প্রথমেই এসে যে কাজটা করেছে অরুকে নিক নেম দিয়ে দিয়েছে পিচ্চি পাখি। রাজের এমন লুতুপুতু ডাকে অরু বেশ বিভ্রান্ত, তাছাড়া সে পিচ্চিটা কোথায়? একটা বিবাহিত মেয়েকে পিচ্চি বলে,আশ্চর্য? অরু যখন হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে দাড়িয়ে থেকে রাজের কর্মকান্ড পরখ করছিল, তখনই ওর পাশে এসে দাঁড়ায় অনু, কাঁধের উপর কনুই ঠেকিয়ে বলে,
— ছেলেটা বেশ স্মার্ট, কি বলিস? আসার পর থেকেই কেমন সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে।
অরু মুখ ভেঙিয়ে বলে,
— স্মার্ট না ছাই আমাকে বলে কিনা পিচ্চি পাখি? তুইই বল আপা আমাকে কি পিচ্চি মনে হয়?
অনু অরুর মাথায় চাটি মে’রে বললো,
— বোকা মেয়ে, তুই আমাদের মধ্যে সবার ছোট তাই আদর করে পিচ্চি বলেছে, এতে গাল ফুলানোর কি আছে?
অরু অনুকে সরিয়ে দিয়ে বলে,
— ও তুই বুঝবি না আপা। মন ভালো নেই, দূরে যা।
— এখানে না বোঝার কি হলো? আজিব!
অনু আর কথা না বারিয়ে, ঠোঁট উল্টে বিড়বিড় করতে করতে কিচেনের দিকে চলে যায়। অনু যেতেই রাজ অরুর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,
— এই যে পিচ্চি পাখি দাঁড়িয়ে না থেকে একটু হেল্প করলেও তো পারো। একা হাতে এতোগুলা ওয়ালবোর্ড লাগানো যায়?
রাজের কথায় অরু তেঁতে উঠে মুখ ঝামটি দিয়ে রুমে যেতে যেতে বললো,
— পারবো না, করলে করুন না করলে ভাগুন।
অরু চলে যেতেই রাজ মুচকি হেঁসে বলে,
— হাউ কিউট।
.
রুমে এসে লাইট নিভিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো অরু, অরুর উদাস উদাস লাগছে খুব, কালকে তৈরি হওয়া বুকের মাঝের চিনচিন ব্যথাটা এখন তীব্রাকার রূপ ধারণ করেছে। ঘুমানোর আশায় চোখ দুটো বন্ধ করলেই একটা অসম্ভব সুদর্শন রাগী রাগী মুখ এসে হানা দিচ্ছে চোখের পাতায়।কি চায় সে? কেন ঘুমাতে দিচ্ছে না? কেনইবা বুকের বা পাশে তীব্র ব্যথার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে? ক্রীতিকের কথা ভাবতে গিয়েই অরুর অকস্মাৎ মনে পরে যায় ডোরার কথা। এখন অরু নেই, ক্রীতিক নির্ঘাত ডোরাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
— না না।
ডোরার কথা চিন্তা করে অরু শোয়া থেকে উঠে বসলো, মনেমনে ঠিক করলো, কাল ভার্সিটি হয়ে ক্রীতিকের বাড়িতে গিয়ে ডোরাকে যতদ্রুত সম্ভব নিয়ে আসতে হবে।
— কিন্তু রাতই বা কখন শেষ হবে? আর আগামীকালই বা কখন আসবে?
অস্ফুটে কথাটা উচ্চারণ করতেই আবারও চোখ মুখ বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো অরুর। বুকের ভেতর সেই এক তীক্ষ্ণ চিনচিন ব্যথা, অরুর কষ্ট হচ্ছে, অজানা কষ্ট, কিন্তু কার জন্য? বারবার মনে পরছে ক্রীতিকের মুখ থেকে উগড়ে আসা স্পষ্ট কথাগুলো,
—আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল কি জানিস? তোর প্রেমে পরা।
গুনেগুনে বারো বছরের বড় হয়েও ক্রীতিক অরুর প্রেমে পরেছে, কথাটা ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠছে অরুর হৃদয় মন সব কিছু । হাজার চেষ্টা করেও ক্রীতিকের কথা মাথা থেকে সরানো যাচ্ছে না। না চাইতেও ওই মুখটাই মনে পরছে বারবার। এ যেন মন মস্তিষ্কের এক তীব্র দোটানা। আর ভালো লাগছে না,এই উদাসীনতা, মনটা যে কি চাইছে নিজেও জানেনা অরু।
ওই জন্যই তো ক্রীতিককে না জানিয়ে চুপিচুপি চলে আসা, নয়তো ক্রীতিক সবার সামনে জিদের বসে কি না কি করে বসতো কে জানে?
ক্রীতিককে নিয়ে অহেতুক ভাবতে ভাবতেই অরুর চোখ যায়, রুমের পাশে টানা বারান্দার দিকে। অরু ভাবলো একবার বারান্দায় গিয়ে দাড়াবে, তাহলে যদি ভেতরের কষ্ট কষ্ট ভাবটা একটু কমে আসে। যেই ভাবা সেই কাজ, একটু খানি সস্থির আশায় এগিয়ে গিয়ে কাঁচ ঠেলে বারান্দায় গিয়ে দাড়িয়ে পরলো অরু, সঙ্গে সঙ্গে একরাশ দমকা হাওয়া এসে চোখেমুখে আঁচড়ে পরলো ওর। এই রুমের বারান্দাটা ভবনের একেবারে পেছন দিকে। পেছনের রাস্তাটাও নির্জন। সোডিয়ামের মৃদু আলো ব্যতিত খুব বেশি আলো এখানে নেই। মানুষ জনের আনাগোনাও তাই বেশ কম।যাকে বলে নিরিবিলি পরিবেশ। নিরিবিলি পরিবেশের সাথে আজ বাইরে তীব্র বাতাসের তান্ডব নৃত্য চলছে, কি জানি ক্রীতিক কি করছে? মনের মাঝে প্রশ্নটা উঁকি দিতেই অরু মিনমিনিয়ে বললো,
— কি আর করবে, হয় কানে হেডফোন গুঁজে ডার্ক রোমান্টিক অডিও বুক শুনছে, নয়তো বাইক নিয়ে রাইডে বেড়িয়েছে, বোরিং লোক একটা।
বিড়বিড়িয়ে কথাটা বলে, হাত দিয়ে বারান্দার কার্নিশে ভর করে মাথা নুয়িয়ে সোজা নিচের দিকে চাইলো অরু। নিচে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে উঠলো ওর। নিজেকে ভুল প্রমান করতে সোজা হয়ে দাড়িয়ে কয়েকবার চোখের পলক ছেড়ে পুনরায় নিচের দিকে তাকালো অরু।দেখলো, অরুর দৃষ্টি বরাবর বাইকে হেলান দিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে ক্রীতিক।
চুল গুলো অগোছালো। ফর্মাল শার্টের হাতাটাও গুটানো, গলায় টাই নেই, সামনের দিকের কয়েকটা বোতাম অবাধে খুলে রাখা যার ফলে ঢেউ খেলানো ফর্সা বক্ষদেশ স্পষ্ট দৃশ্যমান। ক্রীতিককে বড্ড এলোমেলো লাগছে।ঘোলাটে দৃষ্টিটাও কেমন বেসামাল, এতো দুর থেকেও ক্রীতিকের আহত দৃষ্টিতে বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো অরুর। কেন যেন মনে হচ্ছে ক্রীতিক আর কারোর জন্য নয়, বরং ওর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে এতো রাতে।অরুও আর বারান্দায় চুপ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারলো না।হুট করেই কি ভেবে যেন ওড়নাটা নিয়ে সবার আড়ালে ছুটে বেড়িয়ে গেলো এপার্টমেন্ট থেকে। মাথায় ভালোমতো ঘোমটা টেনে ছুটে এলো ক্রীতিকের কাছে। অরু নিচে নেমে এসেছে, তাও ক্রীতিক একই ভাবে তাকিয়ে আছে অরুর পানে, কোনো রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, বিরক্তি নেই, দু’চোখে যা আছে তা হলো একরাশ মাদকতা।
অরু সুতি থ্রীপিচ পরে আছে, মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। লম্বা সিল্কি চুলগুলো পুরোপুরি বাঁধনহারা। অরু ক্রীতিকের কাছে এগিয়ে আসতেই ক্রীতিক দু’হাতে ওর কোমড় আঁকড়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
— তোকে হুট করেই বউ বউ লাগছে জান।
ক্রীতিকের কথা স্পষ্ট নয়, মাথাটাও কেমন টলছে, মুখ দিয়ে অ্যা’লকোহলের বি’শ্রি গন্ধ বের হচ্ছে। অরু চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
— আপনি অ্যা’লকোহল খেয়ে বাইক রাইড করে এতোদূর চলে এসেছেন?
ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে,অরু পুনরায় বলে,
— যদি কিছু হয়ে যেত?
ক্রীতিক ওর কথায় তোয়াক্কা না করে নিভু নিভু চোখে বললো,
— তুই আমায় ছেড়ে কেন চলে এলি? এখন কি করে থাকবো আমি? একটু তো চোখের সামনেই দেখতাম, সেটাও তোর মায়ের সহ্য হলোনা?
অরুর কাছে ক্রীতিকের এই রূপ পুরোপুরি নতুন, ও কখনো ক্রীতিককে এমন নরম সুরে কথা বলতে শোনেনি, আজই প্রথমবার।ক্রীতিকের বলা প্রত্যেকটা কথা অরুর শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বুকের মাঝে জমতে থাকা সেই তীব্র চিনচিন ব্যথাটা হুট করেই কেমন উবে গিয়েছে, পাছে এসে ভর করেছে অজানা এক প্রশান্তি। কি নাম দেওয়া যায় এই প্রশান্তির? জানা নেই অরুর।
অরু চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ক্রীতিক অরুর ওড়নাতে নাক ঘষে দু’হাতে ওকে আরও খানিকটা কাছে টেনে বললো,
— হার্টবিট, ফিরে চল আমার সাথে, তুইতো আমার। তোকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হচ্ছে তো।বল যাবি?
ক্রীতিকের প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই অরুর কাছে। ও তো এখনো ক্রীতিককে নতুন রূপে আবিষ্কার করায় ব্যস্ত, এ কোন ক্রীতিককে দেখছে ও? অরু যখন ক্রীতিকের বাহুডোরে দাড়িয়েই ক্রীতিককে নিয়ে হাজারো চিন্তায় বিভোর, তখনই কানে ভেসে আসে অনুর গলার কর্কষ আওয়াজ, উপর থেকেই হাঁক পেরে পেরে ওকে ডাকছে অনু, বারবার বলছে,
— রাতের বেলা কোথায় গেলো মেয়েটা?
রুমে দাঁড়িয়ে অনু ডাকছে বুঝতে পেরে অরু নিজের মাথার ঘোমটাটা আরও ভালো করে টেনে নিয়ে ক্রীতিককে উদ্দেশ্য করে বলে,
— মোবাইল কোথায় আপনার?
— মোবাইল দিয়ে কি করবি?
— দরকার আছে দিন?
ক্রীতিক অরুর ওড়নাতে নাক ঘষতে ঘষতে বললো,
— পকেটে মনে হয়।
ক্রীতিক টলছে, তাই অরু নিজেই ওর পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কল দিলো প্রত্যয়ের নাম্বারে, প্রত্যয় ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই অরু এক নিঃশ্বাসে বললো,
— ওনাকে, না মানে ক্রীতিক ভাইয়াকে আমাদের বাসার সামনে থেকে নিয়ে যান, উনি ড্রাং’ক হয়ে আছেন।
প্রত্যয় চমকে গিয়ে বললো,
— কি বলছো কোথায় আছে ভাই?
অরু মিনমিনিয়ে বললো,
— আমাদের নতুন বাসার পেছনের রাস্তায়।
প্রত্যয় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— ওয়েট, আমি এক্ষুনি আসছি।
প্রত্যয় কল কাটার আগে অরু একটু আগ বাড়িয়ে বললো,
— ইয়ে ভাইয়া, আপাকে কিছু বলবেন না দয়া করে।
প্রত্যয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানায়,
— যদিও বা ক্রীতিক ভাই এসবে পরোয়া করেনা, তবুও তুমি যখন বলেছো তখন বলবো না।
অরু সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোন কেটে দিয়ে ক্রীতিককে বললো,
—- আপনি থাকুন, আমি আসছি। আপা তখন থেকে ডাকছে, দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ক্রীতিক এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলে,
— উহু কোথাও যাবিনা , তুই আমার সাথে ঘুমাবি এখন, ঠিক সেই রাতের মতো তোকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমাবো আমি।
ক্রীতিকের কথায় অরু মনেমনে বলে,
— আপনি সাভাবিক থাকলে এমন আচরণ করেন না কেন বলুন তো?এমন ব্যাবহার করলে তো আমি কবেই আপনার প্রেমে পরে যেতাম।
*****************************************
নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে ধরনীতে, ক্রীতিকের বাড়িটা যেমন পুরোপুরি নির্জন নিরিবিলি, ঘুম থেকে উঠলে মনেহয় মৃ’ত্যু পুরি।এখানে মোটেও তেমনটা নয়, সকাল সকাল বেশ ভালোই গাড়ি-ঘোড়া মানুষ জনের শোরগোল শোনা যায়।
নতুন পরিবেশ তাই খুব সকাল সকালই ঘুম ভেঙেছে অরুর, ঘুম ভেঙেছে কথাটা অবশ্য পুরোপুরি মিথ্যে। কালরাতে এক ফোটাও ঘুম হয়নি অরুর, সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিয়েছে, আর এখন ঘুম থেকে উঠেই রেডি হচ্ছে ভার্সিটিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
রেডি হয়ে বের হওয়ার সময় মায়ের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে ওকে, কোথায় যাচ্ছো,কখন ফিরবে, কতদূরে ভার্সিটি আরও কত কিই। প্রথমে তো সয়ং রাজকেই ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিলো কাঁধের মধ্যে। পরে অবশ্য কোনো মতে কথা কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছে অরু। এপার্টমেন্ট থেকে বেড়িয়ে মেট্রো ধরে সোজা ভার্সিটিতে যাওয়া যায়, কিন্তু আজকেতো মঙ্গলবার, ক্রীতিকের ক্লাস নেই। সেটা মনে করতেই অরু পিছুপা হাটে, আজ আর ভার্সিটিতে যাওয়ার ইচ্ছা নেই ওর। বরং উল্টো পথে গিয়ে ট্যাক্সি ধরে বেরিয়ে পরে ওর চেনা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
.
চেনা পরিচিত অত্যাধুনিক ডুপ্লেক্স বাড়িটার সামনে দাড়িয়ে আছে অরু। সকাল সকাল যে আত্নবিশ্বাস নিয়ে এখানে এসেছিল, বাড়ির মধ্যে ঢুকতে ঢুকতেই সেই আত্মবিশ্বাস কর্পূরের মতো কেমন হাওয়া হয়ে গিয়েছে। এই মূহুর্তে মুখগহ্বরে একটুও তরল অবশিষ্ট নেই শুষ্ক গলাটাকে ভেজানোর জন্য। ঠান্ডা আবহাওয়ার মাঝেও হাতের তালু কেমন ঘেমে উঠেছে, পা’দুটো কেমন ঝিনঝিন করছে। তবুও সকল চিন্তা, ভাবনা,ভয়’ডর কে পিছু হটিয়ে ঘরের দরজার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো অরু।
প্রথমে ভেতরে গিয়ে ক্রীতিককে কি বলবে, না বলবে, সেই কথাগুলো হাজার বার প্রাকটিস করে নিয়েছে দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই। অতঃপর পাসওয়ার্ট টিপে সোজা বাসার মধ্যে। হলরুমে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে চোখ দুটো কুঁচকে এলো অরুর। দেখলো বরাবরের মতো ঘরময় অন্ধকার করে কানে মস্তবড় হেডফোন লাগিয়ে, কাউচে আধশোয়া হয়ে বসে বাইক রাইডিং গেইম খেলছে ক্রীতিক। অরুকে না দেখেই ওপাশ থেকে তার গমগমে আওয়াজ ভেসে এলো,
— কি চাই?
অরু কাঁধে ঝুলানো চামড়ার ব্যাগটা হাত দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে বললো,
— ডোরাকে নিতে এসেছি।
তৎক্ষনাৎ কানের হেডফোন খুলে পেছনে তাকিয়ে, ক্রীতিক দাঁত কটমটিয়ে বললো,
— ডোরা কি তোর বাপের কেনা সম্পত্তি? যে চাইলেই নিয়ে যাবি।
অরু মিনমিনিয়ে বললো,
— ডোরা আমার মেয়ে, ও আমার সাথেই থাকবে।
ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
— আমাকে কি তোর বিড়াল মনে হয়? আমি কেন বিড়ালের বাচ্চা জন্ম দিতে যাবো শুনি?
অরু মাথা তুলে বললো,
— আপনাকে তো কিছু বলিনি।
— মুখে মুখে তর্ক করছিস? কাছে আয়।
দিনের বেলাতেও পুরো বাড়ি রাত হয়ে আছে, অরু একটা শুষ্ক ঢোক গিলে শুধালো,
— কাছে এলে কি করবেন?
— আমার যা খুশি তাই করবো, এখন চুপচাপ কাছে আসবি, নাকি আমি উঠে টেনে হিঁ’চড়ে, থা’প্পর দিয়ে কাছে টেনে আনবো সেটা তোর ইচ্ছা, ডিপেন্ডস অন ইউ।
এই বলে আবারও পেছনে ঘুরলো ক্রীতিক। অরুর অজানা এক বিশ্বাস ক্রীতিক ওকে কাছে গেলে কিছুই বলবে না, সেই বিশ্বাস থেকেই পা টিপে টিপে ক্রীতিকের কাছে এগিয়ে গেলো অরু। ও পাশে এসে দাঁড়াতেই ক্রীতিক পুনরায় হুকুম করলো,
— পাশে বস।
অরু তাই করলো, চুপচাপ ক্রীতিকের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে পাশে গিয়ে বসলো। অরু বসেছে কি বসেনি,তৎক্ষনাৎ ওর কোলের উপর মাথা দিয়ে সটান শুয়ে পরলো ক্রীতিক। ক্রীতিকের এমন অকস্মাৎ কান্ডে অরুর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলো। এতোক্ষণ ধরে ছোট্ট মেদহীন পেটটা শ্বাস-প্রশ্বাসের তালে তালে যে ওঠানামা করতো সেটাও পুরোপুরি বন্ধ। অরু এমন স্ট্যাচু হয়ে আছে দেখে ক্রীতিক চোখ খুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
— কিরে শ্বাস করছিস না কেন? ম’রে যাবি তো।
— কককরছি।
ক্রীতিক পুনরায় চোখ বন্ধ করে অরুর হাতটা মাথায় রেখে বললো,
— কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি, মাথাব্যাথা করছে, এখন ঘুমাবো, যতক্ষণ ঘুমাবো হাত যাতে মাথা থেকে না নড়ে।
ক্রীতিকের কথায় অরুর খুব বেশি অসস্থি হলোনা, ওর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অরু ঠোঁট টিপে হেঁসে মনেমনে বললো,
— কাল রাতে যা পাগলামি করেছেন তাতে মাথা ব্যাথা হওয়ারই কথা।
অরুর হাতের স্নিগ্ধ পরশে ক্রীতিক ঘুমের দেশে পারি জমাতে জমাতে হাস্কিস্বরে বললো,
— অরুউউ,
— হুম।
ক্রীতিক এবার উপর হয়ে শুয়ে বললো,
— তুই পুরোপুরি আমার হয়ে যা, বিলিভ মি আমি তোকে মাথায় করে রাখবো, একটুও বকবো না, একটুও মা’রবো না।
ক্রীতিকের করা অস্পষ্ট সীকারোক্তি আদৌও অরু শুনেছে কি শোনেনি কে জানে?
*****************************************
মায়ের মাথায় বিলি কেটে তেল মালিশ করে দিয়ে, মাকে ঘুম পারিয়ে মাত্রই রুমে এসেছে অনু। রুমে আসা মাত্রই অনু দেখতে পায় ভাইব্রেড মুডে থাকা ফোনটা সেই তখন থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। অনু এগিয়ে গিয়ে ফোন কানে তুলতেই প্রত্যয় অসহায় সুরে বললো,
— তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে অনু।
অনু মৃদু হেসে বললো,
— কি করে দেখবেন? এখন তো আর হসপিটালে যেতে হয়না, ক্যাফের জবটাও মায়ের ভয়ে ছেড়ে দিয়েছি, মা এসব একদম পছন্দ করেননা।
প্রত্যয় ত্যাক্ত হয়ে বললো,
— আমি তোমাকে দেখতে চাই ব্যাস, কিভাবে দেখা করবে সেটা আমি জানিনা।
অনু একটু ভেবে বললো,
— দেখি গ্রোসারীর কথা বলে বের হতে পারি কিনা, পারলে জানাবো আপনাকে। হয়তো সাথে করে অরুকেও ধরিয়ে দেবে মা।
প্রত্যয় হেঁসে জবাব দিল,
— নো প্রবলেম।
মনেমনে বললো,
— ভাইকে ম্যানেজ করে নিয়ে আসতে পারলে, অরু অটোমেটিক ম্যানেজ।
*****************************************
সারাদিন পার করে গোধূলি লগ্নে ঘুম ভাঙলো ক্রীতিকের। আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলতেই, চোখের সামনে ভেসে উঠলো, ঘুমন্ত এক মায়াপরীর স্নিগ্ধ মুখশ্রী। এটা অরু, ক্রীতিকের ব্যাক্তিগত অরু, যে এই মূহুর্তে ক্রীতিকের মাথাটা কোলে নিয়েই, কাউচে হেলান দিয়ে গুটিসুটি মে’রে ঘুমাচ্ছে। ওর নরম তুলতুলে হাতটা এখনো ক্রীতিকের চুলের ভাজেই নিবদ্ধ। আজকাল অরুর একটু একটু আ’ত্নসমপর্নে বেশ খুশি ক্রীতিক। অরুকে দেখতে দেখতেই ক্রীতিকের ঠোঁট দুটো প্রসারিত হলো আন্তরিকতা জড়ানো হাসিতে। পরক্ষনেই হাতের কব্জিতে এটে থাকা ঘড়িতে একনজর চোখ বুলিয়ে উঠে বসে ক্রীতিক। অন্যপাশ থেকে একটা পাতলা ফিনফিনে চাদর এনে অরুর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে সোজা চলে যায় দোতলায়।
.
অরুর যখন ঘুম ভাঙে তখন সন্ধ্যা প্রায়, কোনমতে ঘুমু ঘুমু চোখে উঠে বসে, চারিদিক পর্যবেক্ষন করে আঁতকে ওঠে অরু। দাঁত দিয়ে জিভ কে’টে তারাহুরো করে উঠতে উঠতে বলে,
— এই রে, আমার তো ফিরতে হবে, কখন ঘুমিয়ে পরলাম আমি?
উঠে দাড়িয়ে হাতের ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতেই অরুর চোখ যায় কিচেন কাউন্টারের দিকে, সেখানে বসে বসে কফি পান করছে ক্রীতিক। তার পড়নে লেদার জ্যাকেট, আর ব্ল্যাক ডেনিম, পাশের স্টুলে হেলমেট রাখা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাইক নিয়ে বের হবে ।
সেই সকালে এসে এমন সন্ধ্যা বাঁধিয়ে ফেলবে ভাবতে পারেনি অরু, এই মূহুর্তে মায়ের করা হাজারটা প্রশ্নের ভয়ে তটস্থ হয়ে গিয়েছে ও। তাই কোনো কিছু না ভেবেই দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে ক্রীতিকের জামা টেনে ধরে কাঁদো কাঁদো সুরে অরু বললো,
— সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে তো, বাসায় কিভাবে ফিরবো?
ক্রীতিক নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দেয়,
— ফিরতে হবে না,থেকে যা।
— মজা করবেন না, আমাকে যেতে হবে, মা আছে তো।
— আমার ম্যাচ আছে, প্রত্যয়কে কল দিয়ে আসতে বলেছি ও তোকে নিয়ে যাবে।
ক্রীতিক দিয়ে আসবেনা শুনে অরুর কি একটুও অভিমান হলোনা? হলোতো বটে। তবুও ও বাচ্চাদের মতো ক্রীতিকের জ্যাকেট টানতে টানতে বললো,
— কখন আসবে সে? আমাকে এক্ষুনি ফিরতে হবে।
ক্রীতিক এবার অরুকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বললো,
— কতবার বারণ করেছি আমার কাছে আসবি না, আমাকে ধরবি না, কথা শুনিস না কেন?
ক্রীতিকের কথায় অরুও তেতে উঠে ঝাঁজ নিয়ে বললো,
— কেন বারণ করেছেন?আমার শরীরে কি নোংরা লেগে আছে?
ক্রীতিক এবার উঠে দাড়িয়ে অরুর দিকে এগোতে এগোতে বললো,
— তোর শরীরে কি লেগে আছে সেটা কেবল আমিই জানি।
ক্রীতিকের হটাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে যাওয়া গলার আওয়াজে খানিকটা ভরকে গেলো অরু। মাথা উঁচু করে একনজর ক্রীতিকের দৃষ্টি পরখ করে, ওর এগিয়ে আসার তালে তালে পেছাতে পেছাতে শুষ্ক ঢোক গিলে অরু শুধায়,
— ককি লেগে আছে?
ক্রীতিক বাঁকা হেসে বললো,
— এভাবে পিছিয়ে যাচ্ছিস কেন?
অরু কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিল,
—আপনি এগুচ্ছেন তাই, ভ’য় করছে।
—নিজের স্বামীকে এতোটা ভয় পেলে হবে?
ক্রীতিকের মুখে “স্বামী” শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে অরুর পিঠ গিয়ে ঠেকলো কাঁচের দেওয়ালে।
ক্রীতিক ধীর পায়ে অরুর খুব কাছে এগিয়ে এসে ওকে একটানে ঘুরিয়ে দিলো, অরু এখনো কাচের দেওয়ালের সাথে সিঁটিয়ে আছে। তীব্র হৃদস্পন্দনের তালে ক্রমাগত ওঠানামা করছে ওর ছোট্ট নারীদেহটা, ক্রীতিক একহাতে অরুর রেশমের মতো লম্বা চুল গুলো পিঠ থেকে সরিয়ে ঘাড়ের পাশে রেখে দিলো, অন্যহাত দিয়ে একটানে খুলে ফেললো, পিঠের উপর ফুল বানিয়ে বাঁধা টপস এর লম্বা ফিতেটা। হঠাৎ করেই ফিতে খুলে ফেলার দরুন জামার গলাটা একেবারে ঢিলে হয়ে গিয়েছে। অরুর হাত পা অজানা লাবডুডের দরুন অবশ হয়ে আছে, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বলে, মুখ ফুটে কথা বলার বাক শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই ওর মাঝে।
শরীরের তোরনে তোরনে কুন্ডলী পাকিয়ে ওঠা নারীসত্ত্বার কাছে হেরে গিয়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে কাচের দেওয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে অরু। ক্রীতিক ঘোর লাগা চোখে অরুর ফর্সা কামুক পৃষ্ঠদেশে তাকিয়ে একটা শুষ্ক ঢোক গিললো, অতপর এক হাতদিয়ে ওর বাহু চেপে ধরে, মুখ বাড়িয়ে দিলো পিঠের মাঝ বরাবর। তবে ঠোঁট দিয়ে ঘাড় স্পর্শ করার আগেই ওদের মাঝে ধূমকেতুর হলকার মতো হটাৎ জ্বলে ওঠা অবাধ্য অনুভূতিকে শিথিল করে দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে প্রত্যয়।
— ভাই, অরুকে আম…….
প্রত্যয় ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে চুল দিয়ে অরুর পিঠটা ঢেকে দিলো ক্রীতিক। অতঃপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর গলায় বললো,
— তুমি গাড়িতে ওয়েট করো, আমি অরুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
প্রত্যয় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলে, ক্রীতিক আবারও অরুর জামার ফিতেয় হাত দেয়। এবার অরু সংকুচিত হয়ে পিছিয়ে গিয়ে বললো,
— কি করছেন।
ক্রীতিক জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— কিচ্ছু করবো না, পেছনে ঘোর ফিতেটা লাগিয়ে দিই, তোর না লেট হয়ে যাচ্ছে?
অরু এবার হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে পেছনে ঘুরে দাড়ায়, ক্রীতিক আলতো হাতে ফিতেটা লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,
— রাতে বারান্দায় আসবি, আমি নিচে ওয়েট করবো।
অরুর আপাতত হ্যা না কিছু বলার মতো অবস্থা নেই। গোল গোল গাল দুটো র’ক্তরাঙা হয়ে মনে হচ্ছে এক্ষুনি ফেটে পরবে। কান দুটো উষ্ণতার শিখরে পৌছে গিয়েছে সেই কখন। মুখ তুলে আর ক্রীতিকের চোখের দিকে চাওয়ার সাহস হলোনা ওর। কোনো মতে ব্যাগটা হাতরে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। তারপর সোজা গাড়ির মধ্যে।
অরু বেরিয়ে যেতেই ডোরা ক্রীতিকের পায়ের কাছে এসে মিয়াঁও মিয়াঁও লাগিয়ে দিয়েছে। ক্রীতিক ডোরাকে দেখে উপহাস করে হেঁসে বললো,
— তোর মালকিন তো তোকে না নিয়েই চলে গেলো। শেইম অন ইউ ডোরা।হাহ!
চলবে………
#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ২৬
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]
সানফ্রান্সিসকো মূল শহরে রাতকে রাত মনে হয়না মোটেই। রাস্তার দু’ধারে ক্যাফে,নাইট ক্লাব,বিলবোর্ড, মার্ট সবখানে স্থানীয় মানুষজন, ফরেইনার,টুরিস্ট দের আনাগোনায় জমজমাট এই যায়গাটা। ক্রীতিকের শহরতলীর মতো রাতের নিকোশ কালো আধার মোটেই ছুতে পারেনা এই ব্যস্ত নগরীকে। মনুষ্য সজ্জিত ঝিকঝিক করে ওঠা স্ফটিকের লাইট আর হ্যাজাকের আলোয় এখানকার দিন আর রাত দু’টোই সমান।
খুব বেশি রাত যে হয়েছে এমনটা ও নয়, ঘড়ির কাটায় বেজেছে আটটা কি সারে আটটা। তবুও ঘরে ফেরার চিন্তায় ঘাম ছুটে যাচ্ছে অরুর। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শুষ্ক অধরযুগল বারবার ভিজিয়ে নিচ্ছে জিভ দ্বারা। ক্রীতিকের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতেই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে, তারউপর এখন আবার আকাশে গুড়গুড়িয়ে মেঘ ডাকছে। ওদিকে মা নিশ্চয়ই রে’গে বো’ম হয়ে আছে,ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার প্রশ্ন ছু’ড়ে মা’রবে কে জানে?
তখন একসঙ্গে এতোগুলা মিথ্যে কথা কি করে বলবে অরু? ক্রীতিকের বাড়িতে গিয়েছিল সেটাই বা কিভাবে বলবে?মা আর ক্রীতিকের সম্পর্ক তো অতোটাও সাভাবিক নয়। অরু যখন হাজারো চিন্তায় মশগুল হয়ে চুপচাপ বসে আছে, তখনই নিরবতা ভেঙে পাশ থেকে প্রত্যয় বলে,
— এসে গিয়েছি।
প্রত্যয়ের কথায় ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যায় অরুর। গাড়ির জানালা দিয়ে একঝলক উঁকি দিয়ে নিজের সল্প চেনা লাক্সারিয়াস এপার্টমেন্টাল ভবনটার দিকে তাকিয়ে,পুনরায় চোখ ঘুরিয়ে প্রত্যয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় অরু। এগিয়ে গিয়ে গেইট খুলে লিফ্টের সামনে গিয়ে দেখতে পায়, লিফট এখনো ছাব্বিশ তলায় আটকে আছে। ব্যতিগ্রস্থ অরু মনেমনে ভাবলো,
— আমিতো কেবল তিন তলায় যাবো, এই লিফটের জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে বরং সিড়ি দিয়ে এক দৌড়ে চলে যাওয়াটাই উত্তম।
ভাবনার সাথে কাজের মিল রেখে অরু দ্রুত উঠে গেলো সিঁড়ি বেয়ে, তবে সিঁড়ির মাঝবরাবর আসতেই ঘটলো বিপত্তি, তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে কারও শরীরের সাথে ধাক্কা লেগে প্রায় পরেই যাচ্ছিল অরু,তার আগেই ওকে দু’হাতে দিয়ে সামলে নেয় লোকটা, অস্ফুটেই মুখ দিয়ে বলে,
— ঠিক আছো,পিচ্চি পাখি?
চেনা পরিচিত পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে, পরে যাওয়ার ভয়ে খিঁচিয়ে রাখা চোখ দুটো অকস্মাৎ খুলে গেলো অরুর, তাকিয়ে দেখলো ওর মায়ের নিউ এ্যাসিসট্যান্ট রাজ ওকে সামলে রেখেছে। রাজকে দেখা মাত্রই কেমন মেজাজ চড়াও হয়ে গেলো অরুর, সেই সাথে রাজের দেওয়া অসহ্য নিক নেম, ও কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে কাটকাট গলায় বললো,
— আমি ঠিক আছি, ধন্যবাদ। কিন্তু আপনি এখানে রাতের বেলা কি করছেন? ধান্দা কি সেটা বলুন?
রাজ সম্মোহনী হাসি দিয়ে বললো,
— কোনো ধান্দা নেই ম্যাডাম,এই পুরো ভবনের বেশির ভাগ এপার্টমেন্ট গুলোই বাঙালিদের। সেই সাথে দুইতলার কর্নারেরটা আমাদের। আব্বু,আম্মুকে নিয়ে ছোটবেলা থেকে এই ফ্ল্যাটেই থাকি আমি। সে হিসেবে বলতে গেলে, আমার আপনাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ, ধান্দা কি?
ছেলেটা হেঁসে হেঁসে কথা বলে ঠিকই, কিন্তু কথার মাথায় খোঁচা দিতে একচুলও ছাড় দেয়না,বড্ড শেয়ানা। রাজের কথায় অরু চোখ মুখ কুঁচকে অবিশ্বাসের সুরে বললো,
— কিহ!
রাজ পুনরায় ঠোঁট গলিয়ে হেঁসে বললো,
— ইয়েস ম্যাডাম, ফ্রম নাও অন, উই আর নেইবর। হ্যাপি নেইবর হুড।
অরুর চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ, কপালটা সেই কখন থেকে কুঁচকে আছে,মনেমনে ভাবছে,
—নেইবর হুড না ছাই, এখন থেকে এই কার্টুনটাকে সারাক্ষণই সহ্য করতে হবে। কি দেখে যে এই ভবনেই উঠেছিল মা, কে জানে?
— এই যে পিচ্চি পাখি,কিছু ভাবছো?
রাজের কথায় অরু না বোধক মাথা নাড়িয়ে, সিড়ি ডিঙিয়ে উপরে যেতে বিরক্তির সুরে বললো,
—আপনার ঢংগী ডাক শোনার সময় নেই। তাড়া আছে আমার। অযথা কথা না পেঁচিয়ে যে কাজে যাচ্ছিলেন সেখানে যানতো,আজাইরা।
অরু চলে যেতেই রাজ আরেকদফা হেঁসে বললো,
— রাগ দেখালেও কিউট লাগে।
.
একরকম দৌড়াতে দৌড়াতেই হন্তদন্ত হয়ে বাসার ভেতর প্রবেশ করলো অরু, অনু তখনো ড্রয়িং এ বসা ছিল। অরু ভেতরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে কালবিলম্ব না করে অনুকে শুধালো,
— আপা, মা কোথায় রে?
অনু অবাক হয়ে বললো,
— মা তো সেই বিকেল থেকে ঘুমাচ্ছে, কিন্তু তুই এমন করে হাঁপাচ্ছিস কেন?
অনুর কথায় অরু সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে, মনেমনে বললো,
— যাক এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম, নয়তো মা যেই বিচক্ষণ ঠিক কোনো না কোনো ভাবে ধরে ফেলতো আমি ভার্সিটিতে নয় অন্য কোথাও গিয়েছিলাম।
অরুকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে, অনু ভ্রু কুঁচকে বললো,
— তোর কি হয়েছে বলতো? আজকাল হুটহাট স্ট্যাচু হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাস।কাহিনি কি সত্যি করে বল?
অরু হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো,
— আরে দূর কোনো কাহিনি নেই, দেরি হয়ে গিয়েছে তাই ভয়ে ছিলাম আর কি, যাই একটু পানি খাই।
নিজের বেড়ে যাওয়া শ্বাসপ্রশ্বাস কে খানিকটা সামাল দিতে অরু ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে পানি পান করছিল, তখনই ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে অনু বলে ওঠে,
— অরু তোর জামার ফিতেয় এমন গিট্টু মা’রা কেন?এখন এটা বলিস না যে, জামার ফিতেয় এমন গিট্টু মে’রে তুই সারা ভার্সিটি ঘুরে বেরিয়েছিস।
কথা শেষ করে অট্টহাসিতে ফেটে পরে অনু। এদিকে অরু অবুঝের মতো নিজের পেছনে হাত দিতেই মনে পরে যায় এটা ক্রীতিকের কাজ। তখন ক্রীতিকই ওর জামার ফিতেটা টান মে’রে খুলে ফেলেছিল, তারপর নিজেই বেধে দিয়েছিলো। কিন্তু এই ভাবে গিট্টু মে’রে জামার ফিতা কে লাগায়?লজ্জা,সংকোচ, বিরক্তি তিনের সংমিশ্রণে অরুর চোখ মুখ বুঁজে এসেছে। তখনকার কথা মনে পরলে এখনো শরীরটা কেমন কম্পিত হয়ে উঠছে অজানা শিহরণে। ওদিকে একটা ফিতে বাঁধতে না পারার অযোগ্যতায় ক্রীতিকের উপর রাগও লাগছে খুব।
অনু সেই কখন থেকে একাধারে দাঁত কেলিয়ে যাচ্ছে। অরু নিজের মূর্খতা এড়াতে কোনোমতে অনুকে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে যায়, অরু মাথা নুয়িয়ে চলে যাচ্ছে দেখে অনু টিপ্পনী কেটে বললো,
— এই যে পিচ্চি পাখি, পরের বার ফিতে না বাঁধতে পারলে, আমাকে বলিস কেমন,আমি লাগিয়ে দেবো, তবুও এমন গিট্টু মে’রে মান সম্মান খোয়াস না।
অরু পেছনে ঘুরে নাক সিকোয় তুলে বললো,
— আপা তুইও?
অরুর অসহায় বাক্যে অনু আবারও ভেতরের কষ্ট করে আটকে রাখা হাসিটা উগরে দিলো।
অরুর আর কিইবা করবে, ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে মিনমিনিয়ে বলে,
— তুই ভুল ভাবছিস আপা, এটা আমার নয়, প্রফেসর জেকে’র কাজ।
*****************************************
সাইন্সল্যাবের সবচেয়ে আধুনিক আর ব্যয়বহুল রুমে বসে, মাইক্রোস্কোপ মেশিনে চোখ লাগিয়ে কিছু একটা তরল জাতীয় পদার্থ সুক্ষ্ম নজরে পর্যবেক্ষন করছে নিখিল। সামনে থাকা তরল পদার্থের দিকে এতোটাই গভীর মনোযোগ যে বারবার অজান্তেই নিজের দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরছে সে। নিখিল বরাবরই ছাত্র হিসেবে একশো তে একশো। নিজের মধ্যে থাকা হাজারটা খারাপ অভ্যেস কিংবা খারাপ চর্চা কোনোকিছুই ওর পিছুটান হয়ে দাঁড়ায়নি ওর মেধাবী মস্তিষ্কের কারনে। শুধু মাত্র তুখোড় মেধাবী হওয়ার দরুন সবকিছু ঢাকা পরে গিয়েছে লোক চক্ষুর আড়ালে, অরুর মতো সহজ সরল মেয়েরাই তার ভুক্তভোগী। নিখিল একটা দুটো নয়, একসাথে অনেকগুলো গার্লফ্রেন্ড রেখে অভ্যস্ত, মেয়েদের প্রতি ওর অন্যরকম নেশা, যার ফলে কোনো মেয়েকেই না করতে পারেনা ও। আশ্চর্যের বিষয় হলো ওর বেশিরভাগ গার্লফ্রেন্ডই টিনএজ। অরুর বয়সই কিংবা তার চেয়ে একটু কমবেশি।
তবে নিজের কাজের বেলাতে বরাবরই নিখিলের পুরোপুরি ভিন্নরূপ লক্ষ্যনীয়। কাজের ক্ষেত্রে নিখিলের থেকে মনোযোগী আর ডেডিকেটেড মানুষ বোধহয় দুটো নেই। ওই জন্যইতো মেয়েরা নিখিলের প্রতি এতোটা আকর্ষন অনুভব করে। যদিও বা নিখিলের অনেক বেশি নারীআ’সক্তি, তবে সেটা এই সাইন্সল্যাবের বাইরে গিয়ে, কারন কাজের ক্ষেত্রে কখনো কম্প্রোমাইজ করেনা নিখিল।
এই যেমন এই মূহুর্তে নিখিলের পাশে সেই কখন থেকে ওরই আফ্রিকান ফ্রেন্ড লিও দাঁড়িয়ে আছে, সেটা গভীর মনোযোগী নিখিলের দৃষ্টিগত হয়নি এখন পর্যন্ত । কি করে হবে নিখিল তো সেই কখন থেকে একধ্যানে মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষন করে চলেছে, কিন্তু যখন মনে হলো কেউ ওর পাশে দাঁড়িয়ে তখনই দ্রুত হাতে কিছু একটা লুকিয়ে ফেললো নিখিল। লিও খানিকটা অবাক হয়ে শুধালো,
— কি লুকালে তুমি? কি আছে ওই বোতলে, দেখি?
নিখিল আড়ালে শুষ্ক ঢোক গিলে, না জানার ভান করে বললো,
— কই কিছুনা তো, মনে হয় ভুল দেখেছো তুমি।
— মোটেই না, কাঁচের বোতলে তরল জাতীয় কিছু, আমি স্পষ্ট দেখেছি।
নিখিল এবার এগিয়ে এসে লিওর ঘাড়ের উপর হাত দিয়ে বললো,
— বুঝেছি সকাল থেকে না খেয়ে সারাদিন ল্যাবে পরে আছো তাই চোখে ভুলভাল দেখছো, আমিও খাইনি কিছু, চলো ক্যন্টিনে গিয়ে লাঞ্চ করে আসি, আমার ট্রিট।
ট্রিটের কথা শুনতেই খাদক লিও একগাল হেঁসে বললো,
— ওকে ব্রো লেটস গো।
নিখিলও লিওর সাথে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো,যাওয়ার আগে খুব সাবধানে চোখ ঘুরিয়ে ,লুকিয়ে রাখা কাচের ছোট্ট বোতলটাকে আরও একবার পরখ করে নিলো সে।
*****************************************
রাত জেগে অপেক্ষার প্রহর গোনার মতো ধৈর্যের কাজ আর বোধ হয় কিছুতে নেই,তা গত দুদিনে হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে অরু। সেদিন ক্রীতিক বলেছিল বারান্দায় অপেক্ষা করতে,সে আসবে। অরু না চাইতেও মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে গিয়ে অপেক্ষাতো করেছিল ঠিকই, তবে নির্দয় ক্রীতিক তার কথা রাখেনি।
এদিকে দুদিন ধরে ক্রীতিককে না দেখতে পেয়ে বুকের ভেতরের সুপ্ত চিনচিন ব্যথাটা কেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে অরুর। আজকাল খেতে, ঘুমাতে, কথা বলতে কিংবা ভার্সিটি যেতে কোনোকিছুই ভালোলাগেনা ওর। সারাদিন দরজা আটকে শুয়ে বসে দিন কাটায় । নয়তো ওয়াশরুমে গিয়ে সারাদিন শাওয়ার ছেড়ে ভিজতে থাকে।
এখন তো মাঝেমধ্যেই বারান্দা গলিয়ে চোখ দুটো হাতরে বেরায় কংক্রিটের ভবনের পেছন থেকে চলে যাওয়া নির্জন রাস্তায়,কেবল বুকের মাঝে অদম্য এক আসক্তি সেদিনের মতো হুট করে দেখা হলেও তো হতে পারে। রগচটা, ছন্নছাড়া, বেপরোয়া মানুষটা ওর জন্য আবারও একইভাবে দাড়িয়ে অপেক্ষায় থাকলেও তো থাকতে পারে। কিন্তু না, পরপর দুইদিন অরুর ভাবনা মিথ্যে প্রমানিত হলো। ক্রীতিক আর এমুখো হলো না।মনেমনে আশাহত হয়ে অরু ভাবতে লাগলো,
— আমি আসলেই একটা বোকা, জায়ান ক্রীতিকের মতো মানুষ একদিন দাঁড়িয়েছে বলে প্রতিদিন এসে দাড়িয়ে থাকবে, এটা ভাবাও ভুল, চড়ম ভুল। আর না আমি এতোটা গুরুত্বপূর্ণ কেউ। আমি সব সময় একটু বেশিই আশা করি।ধ্যাত!
গত দুদিন মন মস্তিষ্কের দোটানায় পরে নির্ঘুম রাত পার করে দেওয়ার পর। আজ একটু তাড়াতাড়ি করেই ঘুমাতে গেলো অরু। অযথা, অপারগ ভাবনাদের মাথা থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। গত দুদিন ধরে না ঘুমানোর দরুন বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝরঝরিয়ে ক্লান্তি নেমে এলো শরীরে, চোখের পাতা ভার হয়ে এলো অজস্র ঘুমে।
তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ দুটো কেবলই বুঁজে যাবে, তখনই দরজায় সশব্দে কড়া নাড়লো অনু। এমন হঠাৎ আওয়াজে আচমকা লাফিয়ে উঠে বসলো অরু, তন্দ্রা ভাবটা কেটে যেতেই, বুঝতে পারলো বাইরে থেকে আপা ডাকছে ওকে, অরু এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই অনু নিজের ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো,
— প্রত্যয় সাহেব,কিছু বলবে তোকে, হয়তো ভার্সিটির বিষয়ে, দেখতো কি বলে, আমাকে মা ডাকছে আমি এক্ষুনি আসছি।
যদিও অনুর কথার আগামাথা কিছুই অরুর বুঝে আসলো না, প্রত্যয় আবার কি বলবে এতো রাতে?তবুও হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে ফোন কানে ধরলো অরু, এপাশ থেকে হ্যালো বলতেই প্রত্যয় বললো,
— ভাই কনফারেন্সে আছে কথা বলো।
ক্রীতিকের কথা শোনা মাত্রই অরুর পিলে চমকে গেলো। এতোক্ষণ স্থীর থাকা হাতটা হুট করেই কাঁপতে শুরু করলো, হৃদয়ের সুপ্ত চিনচিন ব্যথাটা মূহুর্তেই দিগুণ হয়ে উঠলো। অরু দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে রুমের দরজাটা সপাটে লাগিয়ে দিয়ে, চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলো ওপাশের প্রতিক্রিয়া শোনার জন্য। তৎক্ষনাৎ বিপরীত পাশ থেকে ভেসে এলো, সুপরিচিত চমৎকার সেই পুরুষালি কন্ঠস্বর,
— বারান্দায় আয়।
অরুর মনে হলো কতগুলো দিন পর এই রাগি রাগি আওয়াজটা আবারও শুনতে পেলো ও। “হ্যা” বা “না” কোনোকিছু না বলেই ফোন কানে নিয়ে অরু ছুটে গেলো বারান্দায়। বারান্দার কার্নিশে ভর করে নিচের দিকে অবলোকন করতেই দেখতে পেলো সেই সুদর্শন, গম্ভীর, নির্দয় মানুষটাকে, যাকে একনজর দেখার জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষার প্রহর গুনছিল হৃদয়টা, চোখ দুটো হয়ে উঠেছিল অসহায় আর বেসামাল, অথচ এখন এই মূহুর্তে তার চোখে চোখ পরতেই কেমন ক’র্তন করা ডগার ন্যায় নেতিয়ে পরেছে অরু। লজ্জা আর সংকোচে মুড়িয়ে গিয়েছে পুরোটা শরীর।
ক্রীতিকের ওই ভাসা ভাসা কামুক চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার শক্তি নেই অরুর। তাই ও চোখ ঘুড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বারবার, তখনই ক্রীতিক পুনরায় বলে ওঠে,
— নিচে আয়। তোকে দেখবো।
অরু ক্রীতিকের পানে সচকিত দৃষ্টিপাত করে বললো,
— কি বলছেন? এতো রাতে নিচে কিভাবে আসবো? মা আপা দুজনেই জেগে আছে।
ক্রীতিক ভাবলেশহীন কন্ঠে জবাব দিল,
— আমি এতোকিছু জানিনা, হয় তুই নিচে আসবি, নয়তো আমি উপরে আসছি।
— নাহ!
একটু আওয়াজ করেই চেঁচিয়ে উঠলো অরু, অতঃপর দরজার দিকে একবার উঁকি দিয়ে আবারও ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
— কেন এমন করছেন? মা জানলে বি’পদ হয়ে যাবে।
— তোর লিগ্যাল গার্জিয়ান কে?
অরু নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিল,
— আআপনি।
ক্রীতিক এবার নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
— তাহলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে আয়, যদি এক মিনিটও লেইট করিস, তাহলে আজকেই তোকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো। কেউ আটকাতে পারবেনা। কারণ প্রতিদিন ভার্সিটি শেষ করে, নিজের বউয়ের মুখ দেখার জন্য এতোদূর রাইড করে আসতে ভালোলাগেনা আমার।
অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,
— আসছি, একটু অপেক্ষা করুন। মা আর আপাকে ম্যানেজ করে আসতে একটু সময় লাগবে।
মূহুর্তেই গলার আওয়াজ পরিবর্তন করে, ক্রীতিক হাস্কিস্বরে বললো,
— দ্রুত আয়।
.
পাঁচ মিনিটের মাথায় না এলেও, দশমিনিটের মাথায় ঠিকই নেমে এলো অরু, মাথায় আজকেও সেদিনের মতো ঘোমটা টানা তার। ক্রীতিক বাইকে হেলান দিয়ে অরুর দিকেই তাকিয়ে আছে, অরু এগিয়ে আসতেই মাথার অবিন্যস্ত চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে ক্রীতিক বলে,
— পাঁচ মিনিট লেইট।
অরু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— এভাবে কেন বলছেন, কত কষ্টে লুকিয়ে চুরিয়ে বের হয়েছি আপনি তা জানেন?
— কতদিন লুকোবি এভাবে?
অরু মাথা নত রেখে ছোট্ট করে বললো,
— জানিনা।
ক্রীতিক অরুর হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে শুধালো,
— আমাকে মিস করিসনি?
অরু জবাব দিলো না।
ক্রীতিক এবার ওর দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
— দেখতো পছন্দ হয় কিনা?
অরু প্যাকেটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে শুধালো,
— কি আছে এতে?
— খুলে দেখ।
ক্রীতিকের কথা মতো প্যাকেটটা খুলতেই বেড়িয়ে এলো একটা অ্যাপেল খচিত ব্র্যান্ডের লেটেস্ট মোবাইল ফোন। ফোনটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখেই অরুর চক্ষু চড়কগাছ। ও তৎক্ষনাৎ অবাক হয়ে ক্রীতিককে বললো,
— এতো দামি ফোন আমাকে কেন দিচ্ছেন? আমি এটা নিতে পারবো না।
ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে কপাল কুচঁকে বললো,
— এটা তোর মায়ের রেডিমেড কোম্পানির টাকায় কেনা নয়। তোর স্বামীর উপার্জনের টাকায় কেনা। নিতে পারবি না মানে?
অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,
— এভাবে কেন বলছেন?
ক্রীতিক নিজেকে খানিকটা শান্ত করে, নরম সুরে বললো,
— আর বলবো না, কাছে আয়।
ক্রীতিক অরুর প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করলো না,বরং নিজ হাত দিয়ে অরুকে অনেকটা কাছে টেনে নিয়ে এলো।
গভীর রাত, চারিদিক নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে, আবছা আলোয় অরুর সুন্দর, কোমল মুখশ্রীটা নিস্প্রভ চোখে পরখ করছে ক্রীতিক। দূরত্ব খুব একটা নয়, তবুও ওর কোমড় চেপে ধরে আরও খানিকটা দূরত্ব ঘুচিয়ে নিলো ক্রীতিক। অরু এবার পুরোপুরি ক্রীতিকের বাঁধনে।পশ্চিম আকাশে গুড়গুড়িয়ে মেঘ ডাকছে, মেঘ ভেঁজা দমকা বাতাসে চারিদিক মুখরিত। শেষ রাতে বোধ বৃষ্টি নামবে, ক্রীতিক আর অরুর মাঝে সেই তখন থেকে নিরবতা বিরাজমান। দুজনার মাঝে যে শব্দটুকু হচ্ছে সেটা কেবলই হৃদস্পন্দনের গতিবেগ। ক্রীতিক আলতো হাতে অরুর গালে হাত ছুয়িয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
— আই মিসড ইউ,হার্টবিট।
এতোক্ষণের নিরবতা ভেঙে হঠাৎ ক্রীতিকের এমন সীকারোক্তিতে কেঁপে উঠলো অরু, শরীরের সাথে সাথে সেই কম্পন ছড়িয়ে পরলো সমগ্র মুখমন্ডলে। অরুর তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে শুষ্ক ঢোক গিললো ক্রীতিক। ভাবতে লাগলো কি করবে ও এখন?নিজের অদম্য ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেবে নাকি অরুর কথা ভাববে। ক্রীতিক নিশ্চুপ হয়ে আছে দেখে অরু নিজেকে ক্রীতিকের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
— রাত বেড়েছে, আমি এখন আসছি।
কথা শেষ করে অরু দু’কদম পা বাড়াতেই পেছন থেকে ওর ওড়না টেনে ধরে ক্রীতিক। অরু ঘাড় ঘুরিয়ে শুধালো,
— ওড়না কেন টেনে ধরেছেন?
ক্রীতিক অরুর ওড়নাটা হাতে পেঁচিয়ে ওকে নিজের দিকে টানতে টানতে বললো,
— কাছে আয় বলছি।
অরু না চাইতেও পুনরায় ক্রীতিকের কাছাকাছি এলে , ক্রীতিক একটানে ওকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে হাস্কিস্বরে বললো,
— হার্টবিট, রাইট নাও, আমি এমন কিছু করবো যেটা তোর পছন্দ নাও হতে পারে।বাট আই কান্ট কন্ট্রোল মাই সেলফ,বি পেশেন্ট ওকে?
ক্রীতিকের কথায় অরু আমতাআমতা করে বললো,
— ককি করবেন?
ক্রীতিক আর জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না, একহাত অরুর ঘাড়ের পেছনে দিয়ে, ওকে নিজের দিকে টেনে এনে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট ছোঁয়ালো অরুর তুলতুলে নরম গোলাপি অধরে। ক্রীতিকের সাথে সাথে অরুও এবার অকস্মাৎ দুচোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। দু’হাত দিয়ে খামচে ধরলো ক্রীতিকের শার্ট। ভেতরের দীর্ঘশ্বাস ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ক্রীতিকের ঠোঁটের স্পর্শে ধূমকেতুর হলকার মতো শিহরণ ছড়িয়ে পরছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অনুভূতি শক্তি তুঙ্গে, যার দরুন ভালোমন্দ কিছুই অনুভব করতে পারছে না অরু। খানিকবাদে ক্রীতিক ঠোঁটের দূরত্ব বাড়িয়ে, একঝলক অরুর মুখটা পরখ করে নিলো, বিরক্তির লেশমাত্র নেই ওর মুখে চোখে। যা আছে তা কেবলই ভ’য়াতুর অনুভূতি। অরুর মুখভঙ্গিমা আর মৌনতার দৃশ্য দেখে, একটুখানি তীর্যক হেসে, দিগুণ আগ্রহ নিয়ে অরুর তুলতুলে অধর গুলোকে পুনরায় ওষ্ঠাগত করে নেয় ক্রীতিক। এবার আর রয়েসয়ে নয়, অনেকটা গভীর ভাবেই মিলিত হয় দুইজোড়া অধর। কোনো এক অজানা কারন বশত অরুর বুজে থাকা চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে অশ্রুশিক্ত নোনাজল। যা টুপটাপ করে গিয়ে সযত্নে ঠাই নিচ্ছে ক্রীতিকের শার্টের উপর। ক্রীতিকের চুম্বনের গতিবেগের তালে তাল মিলিয়ে অরুর ছোট্ট ছোট্ট হাতের বাধন শক্ত হয়ে উঠেছে দিগুণ। ওর খা’মচে ধরা হাতের টানে ক্রীতিকের শার্টের বোতাম গুলো বোধহয় এবার ছিড়েই চলে আসবে। মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজনায় হৃ’দপিন্ড তখন ফে’টে পরার উপক্রম, শরীরের সবটুকু ভার পরে আছে ক্রীতিকের দখলে, এলোমেলো ঝড়ো বাতাসের তান্ডবে অরুর মাথায় তুলে রাখা ঘোমটাটা খুলে গিয়েছে সেই কখন। ভেতরের উথাল পাথাল অনুভূতিতে অরুর প্রান যায় যায়, তবুও একচুলও ছাড় দিচ্ছে না ক্রীতিক। পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কংক্রিটের ভবন থেকে অস্পষ্ট সুরে তখনও ভেসে আসছে বেসামাল দুটো গানের লাইন,
“বাতাসে গুন গুন,এসেছে ফাগুন
বুঝিনি তোমার, শুধু ছোঁয়ায়
এতো যে আগুন…………”
*****************************************
—আদা, রসুন,কাঁচামরিচ,পেয়াজ, লবন,ঢেঁড়স, মূলা,ফুলকপি,বাঁধাকপি চাল,ডাল,তেল। উফফ এতো গ্রোসারী দিয়ে কি করবে তুমি অনু? তোমাদের বাসায় কি বিয়ে লেগেছে?
প্রত্যয়ের কথায় অনু মানে লাগার মতো মুখ গোমড়া করে বললো,
— এভাবে কেন বলছেন, আপনার জন্যই তো এতো বড় ফর্দ বানালাম।
— আমার জন্য মানে?
— আপনার সাথে বের হতে গেলেতো হাতে একটু সময় নিয়ে বের হতে হতো, তাই মাকে বলেছি অনেক কিছু কিনতে হবে।
প্রত্যয় ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— বুঝলাম, তারপর আঙুলের ইশারা করে পেছনে অরুর পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে থাকা রাজ কে দেখিয়ে বললো, কিন্তু ওটাকে কেন নিয়ে এসেছো?
অনু মুখ কালো করে বললো,
— মা জোর করে ধরিয়ে দিয়েছে।
.
— কাজকর্ম তো সব চামচাদের মতো আপনার নাম রাজ কে রেখেছে শুনি?
— তুমি তো পিচ্চি, তাহলে এতো ঝাঁজ কোথা থেকে আসে শুনি?
রাজের কথায় অরু তেতে উঠে বললো,
— আমাকে কোন দিক দিয়ে পিচ্চি মনে হয়, আশ্চর্য?
— পিচ্চি নয়তো কি? দেখো এখানে সাইজে সবার থেকে ছোট তুমি। আমার তো মনে হয় তোমার বিয়ের উপযুক্ত ছেলে পাওয়াই মুশকিল হয়ে যাবে।
অরু বিরক্তিতে ভেংচি কেটে বললো,
— আমার বিয়ে নিয়ে আপনার মাথাটা না ঘামালেও চলবে, আমার স্বামী আপনার থেকে লম্বা আর সুদর্শনই হবে, তাই আপাতত নিজের টা নিয়ে ভাবুন।
কথা শেষ করে অরু মুখ ঝামটি দিয়ে অন্য দিকে ঘুরতেই দেখলো, ক্রীতিক এসে বাইক থামিয়েছে ওদের সামনে। কোনোরূপ বাইকার জ্যাকেট বিংবা ফর্মাল স্টাইলে নয়, একটা ব্ল্যাক স্কিনি টিশার্ট আর ওভারে সাইজ ডেনিম পরে আছে, পায়ে নাইক খচিত স্নিকার্স।চোখে কালোরঙা রোদ চশমা। হেলমেট খুলে এদিকেই আসছে। ক্রীতিককে দেখে অরু ছুটে গিয়ে অনুর ওড়না টেনে ধরে বললো,
— এ্যাই আপা, উনি এখানে কি করছেন?
অনু একবার ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে প্রত্যয়কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— হ্যা তাইতো, প্রত্যয় সাহেব, ক্রীতিক ভাইয়াকে কেন ডেকেছেন?
প্রত্যয় কাট কাট গলায় বললো,
— আমিতো ভেবেছিলাম অরু একা আসবে, আমরা কোথাও সময় কাটাতে গেলে অরুর কি হতো? তাই ভাবলাম ভাইতো ফ্রি আছে…
প্রত্যয়ের কথা শেষ হবার আগেই ক্রীতিক সেখানে হাজির হয়, ক্রীতিক আসা মাত্রই অরু কাচুমাচু হয়ে অনুর পেছনে দাঁড়িয়ে পরে। সবাইকে পিছু হটিয়ে ক্রীতিক সবার আগে অরুর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
— কি ব্যাপার, তুই ওড়নার পেছনে দাঁড়িয়ে মোচড়ামুচড়ি করছিস কেন?কি সমস্যা?
অরু সটান দাড়িয়ে বললো,
— ককই নাতো।
ক্রীতিক প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— তোমরা কোথাও যাবে বলেছিলে?
প্রত্যয় হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, ক্রীতিক আবারও বলে,
— ইউ ক্যান গো নাও,সময় হলে কল দিও আমি আসেপাশেই থাকবো।
অনু এবার একটু আগ বাড়িয়ে ক্রীতিকের উদ্দেশ্যে বললো,
— ইয়ে ভাইয়া, অরুর একটু খেয়াল রাখবেন আমরা তাড়াতাড়ি চলে আসবো।
ক্রীতিক অরুর দিকে তাকালো, যে এই মূহুর্তে মাথা নিচু করে ক্রমাগত আঙুলে ওড়না পেচিয়ে যাচ্ছে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছোট্ট করে জবাব দিল,
— রাখবো।
অনু আর প্রত্যয় চলে গেলে রাজ এগিয়ে এসে অরুকে বললো,
— এই যে পিচ্চি, চলো এবার বাজার গুলো করে ফেলি।
রাজের পিচ্চি সম্মোধনে অরু আঁতকে উঠে ক্রীতিকের দিকে চাইলো। ক্রীতিক এগিয়ে এসে বললো,
— এক্সকিউজ মি,কি বললে ওকে তুমি?
রাজ ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রথমে ক্রীতিকের মুখের দিকে চাইলো, সামনাসামনি না দেখলেও জেকে গ্রুপের হেড অফিসের গভর্নিং বডির মেম্বারদের মধ্যে সর্বশীর্ষে এই সুদর্শন লোকের ছবি দেখেছে রাজ, তারমানে মালিক পক্ষের কেউ হবে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎ ক্রীতিককে সালাম ঠুকলো সে।
— হ্যালো স্যার। নাইচ টু মিট ইউ স্যার।
ক্রীতিক তো প্রথমে চেয়েছিল কয়েকটা পাঞ্চ বসিয়ে দিবে ছেলেটার নাক বরাবর, কিন্তু এখন এভাবে সম্মান জানানো তে, ও নিজেই বিব্রত হয়ে পরেছে। কিছু উপায়ন্তর না পেয়ে অরুর হাত থেকে ছো মে’রে বাজারের লিস্টটা নিয়ে, রাজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
— বাজার গুলো সেরে আসুন আমরা ওয়েট করছি।
— ওকে স্যার।
তরিৎ গতিতে হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে, সুপারশপের দিকে চলে যায় রাজ।
রাজ চলে যেতেই অরুর হাত চেপে ধরলো ক্রীতিক, খানিকটা নিজের কাছে টেনে এনে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
—- এমন চোরের মতো বিহেভ কেন করছিস?
তাকা আমার দিকে।
অরু এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— পারবোনা।
— কেন পারবিনা? তাকা বলছি,নয়তো ধরে একটা আ’ছাড় মা’রবো।
অরু তেতে উঠে বললো,
— পারবোনা বলেছি তো, আমার বুঝি লজ্জা লাগেনা?
অরুর না তাকানোর কারন বুঝতে পেরে ক্রীতিক ঠোঁট টিপে হাসি সংবরণ করে বললো,
— আচ্ছা তাকাতে হবেনা, চল।
— কোথায় যাবো?
ক্রীতিক হেলমেট পরে আরেকটা অরুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— বাইকে ওঠ বলছি।
ক্রীতিকের কথায়, অরু নাকোচ করে বললো,
— দেখেছেন চারিদিকে কেমন মেঘ করেছে? একটু পরেই বৃষ্টি নামবে, এর মাঝে আপা চলে এলে আবার ঝামেলা হবে। আমি যাবোনা কোথাও।
— তুই উঠবি নাকি আমি নামবো?
ক্রীতিকের ধা’রালো কথার কাঠিন্যতায় খানিকটা ভ’য় পেয়েই বাইকে উঠে বসলো অরু, অতঃপর আর্জি জানিয়ে বললো,
— তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবেন কিন্তু।
— ধরে বস।
অরু অবাক হয়ে বললো,
— ধরলাম তো।
ক্রীতিক অন্যদিকে ইশারা করে বললো,
— ওইদিকে দেখ?
অরু ক্রীতিকের দৃষ্টি অনুসরণ করে চাইলে দেখতে পায়, ওদের থেকে খানিকটা দূরত্বে আরেকটা বাইকার কাপল সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে,পেছনের মেয়েটা ছেলেটার কোমড় দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বসেছে, তাদের দুজনার মধ্যে সেন্টিমিটার দূরত্বটুকুও অবশিষ্ট নেই।
অরু সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
— আমি ওভাবে ধরতে পারবো না, আপনি আমার বড় তো।
ক্রীতিক অরুর কথা না শোনার ভান করে, ওয়ার্নিং ছাড়াই বাইক স্টার্ট দেয়, তৎক্ষনাৎ ক্রীতিকের পিঠের উপর হুম’ড়ি খেয়ে পরে অরু, অজান্তেই হাত দিয়ে খামচে ধরে ক্রীতিকের টিশার্ট। ক্রীতিক একটু হেঁসে অরুর খামচে ধরা হাতটা সাভাবিক করে নিজের মেদহীন পেটের উপর রেখে দেয়। তারপর হিসহিসিয়ে বলে,
— নাও পার্ফেক্ট।
বাইক চলছে, তবে অরু আর ক্রীতিকের থেকে নিজেকে সরায়নি, উল্টে সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে নিজের মাথাটা এলিয়ে দিয়েছে ক্রীতিকের পিঠের উপর। এখন ওদের মাঝেও সেন্টিমিটার দূরত্ব অবশিষ্ট নেই আর। পুরুষালি পৃষ্ঠদেশে ধনুকের মতো বাঁকানো নারীদেহটা নিঃসংকোচে সিঁটিয়ে আছে, যার ফলে দুজনার মাঝেই ঢেউ খেলে যাচ্ছে, একটা ভেজা নরম, সুপ্ত অনুভূতির জোয়ার।
*****************************************
অরু যা বলেছিল তাই হলো, কিছুদূর যেতেই মাঝরাস্তায় ঝুম বর্ষনে আটকে পড়লে ওরা। নিজেদের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে কোনোমতে দৌড়ে গিয়ে একটা ইকোপার্কের মস্তবড় গাছের নিচে ঠায় নিলো দুজন। অরুর পরনে টকটকে লাল রঙা চুড়িদার, যা এই মূহুর্তে ভিজে গিয়ে শরীরের সাথে চুপসে লেগে আছে, তাও গায়ের ওড়নাটা দিয়ে বৃষ্টি আড়াল করে দাড়িয়ে আছে অরু, ক্রীতিক এগিয়ে এসে নিজেও অরুর ওড়নার মধ্যে ঠায় নিলো। অরু এবার একটু ভালো করে ক্রীতিকের মাথার উপর ওড়নাটা ছড়িয়ে দিয়ে বললো,
— আপনাকে আজকাল বড্ড আপন মনে হয়।
ক্রীতিক ঘোর লাগা দৃষ্টিতে অরুর ভেজা মুখমন্ডল পরখ করে বললো,
— আমি বরাবরই তোর আপন ছিলাম তুই বুঝতে পারিস নি।সেটা তোর ব্যর্থতা।
অরু অবাক চোখে ক্রীতিকের দিকে তাকায়, বোঝার চেষ্টা করে ক্রীতিক আদতে কি বুঝিয়েছে। ক্রীতিক অবশ্য বোঝানোর মতো পরিস্থিতিতে নেই, ওর চোখ আটকে আছে অরুর কোমল, ফিনফিনে, র’ক্তরাঙা ঠোঁট জোড়ায়, মানুষ একবার কোনোকিছু পেয়ে গেলে সেটা বারবার পেতে চায়, ক্রীতিকও তার উর্ধে নয়, ও এই মূহুর্তে অরুর ঠোঁটের দখলদারি পেতে চায়। ঠিক কাল রাতের মতো।পরম আবেশে ডুবে যেতে চায় অরুর ঠোঁটের ভাঁজে।
শুধু চায় বললে ভুল হবে, অরুর খুব কাছে গিয়ে, সেটা নেওয়ার জন্য উদ্যত ও হলো বটে, ক্রীতিকের পরবর্তী পদক্ষেপ আঁচ করতে পেরে অরু লজ্জা পেয়ে দ্রুত পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়।কিন্তু এতেও ক্রীতিক পিছ’পা হলো না, বরং একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে অরুর লম্বা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো ওর গলার খাঁজে। চোখ বন্ধ করে, প্রিয় নারীর ভেজা শরীর থেকে শুষে নিতে লাগলো প্রতিটি বারি কনা। ক্রীতিকের এতোটা কাছে আসা,এতোটা গভীর আলিঙ্গন খুব বেশিক্ষন সহ্য করতে পারলো না অষ্টাদশী অরু, লজ্জায় সংকুচিত হয়ে, তরিৎ গতিতে ঘুরে মুখ লুকালো ক্রীতিকেরই বুকের মাঝখানে। অরু কাঁপছে, ওর শরীরের তীব্র কাঁপুনিতে ক্রীতিকের মাঝে হঠাৎ করে তৈরি হওয়া অদম্য সুপ্ত পুরুষালী চাহিদা গুলো মূহুর্তেই হারিয়ে গেলো, ও আস্তে করে অরুর পিঠে হাত রেখে নরম সুরে বললো,
— ইটস ওকে বেইবি।
অরু এবার মাথা তুলে বললো,
— আপনি সত্যিই আমার প্রেমে পরেছেন? কবে পরলেন, বলুন না?
ক্রীতিক অরুর গালে নিজের খরখরে পুরুষালী হাত ছুয়িয়ে বললো,
— এতোগুলা বছর পর এই প্রশ্ন করছিস। কি উত্তর দিবো আমি?
ক্রীতিকের প্রতিউত্তরের গভীরতা আঁচ করতে পেরে অরু আবারও দু’হাতে শক্ত করে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো।আজ বোধ হয় অরুও প্রেমে পরেছে, কোনোরূপ মোহ কিংবা ক্ষনিকের ভালো লাগা নয়,বরং সত্যিকারের প্রেমে।
চলবে….