#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৫৪
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য)
(হিরোর ট’ক্সিসিটিতে যারা বিরক্ত, তাদের জন্য রেড এলার্ট।🚫)
গভীর রাতে সানফ্রান্সিসকোর রাস্তা ঘাট কিছুটা ফাঁকা। তবে শহরের অলিগলিতে মাতাল মানুষের অভাব নেই। কেউ অফিস কলিগদের সাথে লেট নাইট পার্টি করে বাড়ি ফিরছে, তো কেউ বন্ধু বান্ধবদের সাথে। কেউ বা প্রচন্ড নেশায় বুদ হয়ে রাস্তার মাঝেই শুয়ে পরেছে নির্দ্বিধায়।ওয়েল, আমেরিকাতে এটা নতুন কিংবা আশ্চর্যের কিছুই নয়।
এই মাতালদের ভীড়ে আজ এক নতুন মাতাল যোগ হয়েছে,নাম তার সায়র আহমেদ। সে হলো ফরেইনার মাতাল।
সায়র আমেরিকান সিটিজেন বহু বছর ধরে, কিন্তু ক্রীতিক, অর্ণব, এলিসার মতো উদভ্রান্ত আর অনেকটা উগ্র টাইপ থ্রীলিং বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিশেও ওর স্বভাব চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি একটুও। হতে পারে ওদের সাথে মিলে অনেক উল্টো পাল্টা কাজে সঙ্গ দিয়েছে সায়র, কিন্তু এসব কাজে সবসময়ই সায়র থাকতো পেছনের সারিতে, আর সবার সামনে ক্রীতিক। ছেলেটার জন্মই হয়েছে বোধ হয় সবার সাথে বেয়াদবি করার জন্য।রিডিকিউলাস।
এককথায় ক্রীতিকের সাথে তুলনা করতে গেলে সায়র হলো শুদ্ধ পুরুষ, সরলতার প্রতীমা যাকে বলে। নিজের বউকে চুমু খাওয়ার কথা কল্পনা করলেও আ’তঙ্কে শরীরের লোমকূপ সব দাড়িয়ে যায় তার।কিন্তু আজ নিজেকে বরাবরই শুদ্ধ পুরুষ খেতাবে ভূষিত করা এই সায়রের দু’মগ বিয়ার খেয়েই নেশা ধরে গিয়েছে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন দুলছে, ওর মনে হচ্ছে ও মেঘের মতো হাওয়ায় ভেসে ভেসেই বাড়ি ফিরছে,কি আশ্চর্য চমৎকার এই অনুভূতি।
একপর্যায়ে ভাসতে ভাসতেই ঘরের দুয়ারে পা রাখলো সায়র। সায়র যখন বাড়িতে ফেরে, তখন নীলিমা কোমড়ে ওড়না গুঁজে ঘরের কাজ করায় ভীষণ ব্যস্ত, সে একদিকে ঘরদোর ভ্যাকিউম করছে,অন্যদিকে একটু পরপর দৌড়ে গিয়ে দক্ষ হাতে কড়াইয়ে স্প্যাচুলা নাড়ছে। নীলিমার কর্মকান্ডে হয়তো কেউ কল্পনা ও করতে পারবে না যে এই মেয়েকে সায়র বিয়ের আসর থেকে তুলে এনে জোর করে বিয়ে করেছে। মাত্র দু’মাস যেতে না যেতেই কেমন পাঁকা ঘরনি হয়ে উঠেছে সে। আচ্ছা, নীলিমাকে কি আসলেই জোর করে বিয়ে করা হয়েছিল? নাকি অন্যকিছু?
কাজের ফাঁকে হঠাৎ সায়রকে দেখতে পেয়ে নীলিমা তরিঘরি করে এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
— দেখুন না,সন্ধ্যা হতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, রাতের রান্না বসাতে একদম মনে নেই।
— থাক, মঙ্গলগ্রহ থেকে খেয়ে এসেছি।
অস্ফুটেই কথাটা বেরিয়ে এলো, টালমাটাল সায়রের মুখ ফস্কে।
সায়রের এহেন অদ্ভুত কথার মানে বুঝতে না পেরে নীলিমা দরজার দিকে এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
— কি বললেন?
নীলিমার কথার প্রত্যুত্তরে,কিছুই জবাব দিলো না সায়র, উল্টো ওকে সুক্ষ্ম চোখে পরখ করে আঙুলের কর গুনতে গুনতে বিড়বিড়ালো,
—- একটা বউ, দুইটা বউ, তিনটা,চারটা…..
হাআআ,দশটা বউ!!
চোখ দুটো বড়বড় করে মুখের উপর একহাত চেপে ধরে বিস্ময়কর কন্ঠে কথাটা বললো সায়র।
সায়রের কথার আগামাথা কিছুই বোধগম্য নয় নীলিমার, এতো রাতে এ কিসব মশকরা বুঝতে পারছেনা ও, তাই সায়রের উপর কিছুটা চটে গিয়ে নীলিমা ঝাঁজিয়ে বলে উঠলো ,
— কি বলছেন এসব আবোল তাবোল?আর দশটা বউই বা কোথায় পেলেন?শুট থেকে তো আসেন নি,তাহলে কোথা থেকে এসেছেন সত্যি করে বলুন?
সায়র একটু দম নিয়ে ভাবলো, অতঃপর আঙুল উচিয়ে সিলিং এর দিকে দেখিয়ে বললো,
— জুপিটার থেকে। মাত্রই তো স্পেসশীপে ল্যান্ড করলাম।
সায়রের কথায় নীলিমা ঠোঁট টিপে হাসি সংবরণ করে বললো,
— তারমানে আপনি বলতে চাইছেন, আপনি এতোক্ষণ মহাকাশে ছিলেন তাইতো?
সায়র তৎক্ষনাৎ ঠোঁট উল্টে জোরে জোরে হ্যা বোধক মাথা নাড়ালো।
— তা মহাকাশে মদ কোথায় পেলেন?
সায়র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আর বলোনা, মাঝ আকাশে এলিয়েন গুলো হকারী করছিল,খুবই দরিদ্র ওরা,দেখে মায়া হলো, তাই কিছু মদ দিয়ে দুটো টাকা কিনেছিলাম।
নীলিমা ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সায়রের প্রত্যুত্তর শুনে, ওকে আরেকটু বাজিয়ে দেখলে মন্দ হয়না সেই ভেবে এবার আরও দিগুণ উৎসাহ নিয়ে কৌতুক কন্ঠে নীলিমা শুধালো,
— তা এখন আপনি কোথায় আছেন?
সায়র ঢুলতে ঢুলতে হলের কাউচের উপর গিয়ে বসে পরে বললো,
— কোথায় আবার চাঁদে, অর্ণবের বাচ্চাটা কি জোরে জোরে স্পেসশীপ চালায়, মাথাটা ঘুরে গেলো আমার, এমনিতেই মদ খেয়েছি, তারউপর যদি নেশা ধরে যায় তাহলে কি হবে বলোতো? আমিতো ভুলভাল বকতে শুরু করবো তখন।
নীলিমা সায়রের দিকে এগিয়ে গিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
— আচ্ছা আপনি যদি চাঁদেই থেকে থাকেন, তাহলে বলুন তো আমি কে?
সায়র তৎক্ষনাৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে নাকটা সিকোয় তুলে নীলিমার দিকে দৃষ্টিপাত করে গম্ভীর গলায় বললো,
— তুমি আবার কে? চাঁদের সেই ডা’ইনী বুড়িটা না? কাজকম্ম বাদ দিয়ে যে সারাক্ষণ সুতো কাঁটে?
—- কিহ! আমি ডা’ইনী বুড়ি?
সায়রের কথায় খেঁকিয়ে উঠলো নীলিমা।
সায়র দিন দুনিয়ার হুঁশ হারিয়ে পুনরায়, চোখমুখ কুঁচকে বললো,
—- হ্যা ডা’ইনীই তো, কি বিচ্ছিরি দেখতে তুমি ওয়াক!
বমির ভান করতে গিয়ে, অবশেষে সত্যি সত্যিই বমি করে নীলিমার সর্বাঙ্গ ভাসিয়ে দিলো সায়র।
*************************************************
নীলিমা সব সময় একটু বেশিই পাষাণ, সায়রের মতো সফ্টহার্টেড লাভিডাভি, হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল ছেলের সঙ্গেও তার ভাব জমেনা খুব একটা। হয়তো নীলিমা পারেই না সেভাবে ভাব জমাতে, নিঃসংকোচে মুখ ফুটে ভালোবাসি শব্দ আওড়াতে।
নীলিমার ভাষ্যমতে ভালোবাসা এতো ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়ানোর কি আছে? দু’চোখ দেখলেই তো পড়ে ফেলা যায়, আদতে কে তোমায় ভালোবাসে, আর কেইবা ঘৃ’ণা করে। অথচ সায়রের নিকট চোখের ওই কঠিন ভাষাগুলো পড়া অসাধ্য সাধনের মতোই দূর্লভ। কারণ সায়রের দৃষ্টিকোন এতোটাও জটিল নয়, যতটা জটিল ভাবে নীলিমা নিজেকে উপস্থাপন করে। তবুও দিন শেষে সায়রের মতো এমন একটা উষ্ণ হৃদয়ের ছেলেই কিনা এইব পাষাণ মেয়েটার প্রেমে পরতে গেলো, কি অদ্ভুত! ছেলেটা এ জীবনে বউয়ের আদর সোহাগ তো দূরে থাক, বউয়ের মুখ থেকে একটু আধটু মিষ্টি মাখোমাখো কথা শুনতে পাবে কিনা, সেটাই এখন দুশ্চিন্তার বিষয়।
কিন্তু কথায় আছেনা, মানুষের ভাবনা যেখানে এসে শেষ হয়, উপরওয়ালার সুক্ষ্ম ভাবনাগুলো সেখান থেকেই শুরু হয়। আজ তেমন কিছুই হলো, সবসময় সব পরিস্থিতিতে নীলিমা সায়রকে উপেক্ষা করে গেলেও, আজ গেলোনা, বরং সায়রকে বসিয়ে রেখে নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে, ওকেও সুন্দর করে পরিস্কার দিলো।অতঃপর টেনেটুনে সায়রকে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো বেডরুমে। সায়র অচেতন নয়, তবে ওর দৃশ্য কিছুটা ঝাপসা, তবুও ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নীলিমার পান পাতার মতোন ঢলঢলে আদুরে মুখটা, এই মূহুর্তে ওর ডাগর চোখ দুটো ওর ঝাপসা চোখেই নিবদ্ধ রয়েছে।
সায়র সেই কতক্ষণ ধরে ধ্যানমগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে নীলিমা নির্লিপ্ত কণ্ঠে শুধালো,
— তাকিয়ে আছেন কেন এভাবে? আমিতো ডা’ইনী বুড়ি।
নীলিমার কন্ঠে ক্ষোভ অভিমান দুটোই প্রকাশ পেলো, সায়র তাতে পাত্তা না দিয়ে বোকার মতো হেঁসে বললো,
— চুমু খাবো বলে, জেকে বলেছে মাল খেলে চুমু খাওয়া খুব ইজি।
সায়রের কথায় নীলিমা নাক মুখ কুঁচকে বললো,
—- যেমন আপনি, তেমন আপনার বন্ধুরা,কি শিক্ষা, ছ্যাহ!
সায়র চোখ ছোট ছোট করে নীলিমার হাত টেনে ওকে কাছে এনে বললো,
— আসোনা একটা চুমু খাই, নইলে আমি ওদের মুখ দেখাবো কি করে বলোতো?
—- মাস্ক পড়ে থাকবেন ব্যাস তাহলেই আর মুখ দেখাতে হবে না, এখন ঘুমানতো।
নীলিমার কথার প্রত্যুত্তরে সায়র নেশালো গলায় আবদারের সুরে বললো,
—- সেদিনের মতো ড্রেস খুলে আমার সাথে ঘুমাবে প্লিইইইজ, এক্সুয়ালি,এক্সুয়ালি আই ওয়াজ এনজয়েড ইট,কি সুন্দর তুমি।
সায়রের মাতাল মাতাল অস্পষ্ট কথা শুনে শুষ্ক ঢোক গিললো নীলিমা, কি ভেবে যেন সায়রের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলো হুট করেই, আজ প্রথমবার ওর নিজের হৃদয়টাও কেমন যেন সায়রের জন্য উথাল পাথাল করছে, মন বলছে এটাই ভবিতব্য, আজ কিংবা কাল সায়রের কাছে আবেদনময়ী নারী রূপে নিজেকে উপস্থাপন করতেই হবে। এ যে সায়রের কঠোর অধিকার,তাতে কি করেই বা বাঁধা দেবে নীলিমা? যার দরুন একটু আগের সেই জিদি নারী সত্তাটা সায়রের পুরুষ সত্তার কাছে হার মেনে মাথা নত করে ফেলেছে মূহুর্তেই।
নীলিমা ভবঘুরে হয়ে কি যেন ভাবছে তখন থেকে, সায়র সেই মূহুর্তটারই ফায়দা নিলো, ওকে একটানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আস্তে আস্তে ঠোঁট ডোবালো নীলিমার তুলতুলে নরম র’ক্তরাঙা অধর যুগলের ভাঁজে।
সায়রের প্রথম স্পর্শে অকস্মাৎ কেঁপে উঠল নীলিমা, অথচ সায়রের স্পর্শগুলো কতটা নরম আর স্বস্তিদায়ক তা বলে বোঝানোর নয়, এটা ছিল একটা সুন্দর প্যাসোনেট চুমু যার ফলরূপ নীলিমার হৃদয় মন সবকিছু ক্রমশ নাড়িয়ে দিচ্ছে উত্তাল সমুদ্রের মতো বেসামাল ঢেউ। ক্ষণে ক্ষণে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে অযাচিত বন্য চাহিদারা।সায়র নীলিমার হাতে হাত রেখে আধশোয়া হয়ে আছে, আর নীলিমা ওর উপরে,গভীর চুম্বনে একটা ভেজা নরম অনুভূতিতে আবিষ্ট হয়ে নীলিমাও কেমন যেন নেতিয়ে পরলো, নিজের অজান্তেই হাত নিয়ে রাখলো সায়রের কাঁধের উপর, ঠিক সেই সময় সায়র চেতনা হারিয়ে বিড়বিড় করতে করতে আস্তে করে ঢলে পরলো নীলিমার বুকের উপর।
, অসহ্য রকম বিরক্তিকর একটা পরিস্থিতিতে পরে অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ খুললো নীলিমা, ও এখনো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সায়র অস্পষ্ট আওয়াজে বলছে,
— তুমি অনেক সুন্দর রাগীনি, তুমি অনেক বেশি সুন্দর, আই ওয়ান্না টাচ ইউ, কিস ইউ, ইভেন …..
এটুকু বলেই পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পরে রইলো সায়র,
এদিকে সায়রের কথায় প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে নীলিমার।ও এক ধাক্কায় সায়রকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে দাঁত কটমটিয়ে বললো,
—- মাতাল একটা।
*************************************************
কাল সারারাত ক্রীতিককে ফোনে না পেয়ে আজ সকাল সকাল ডাক্তার সমেত বাড়ি বয়ে এসে ক্রীতিককে চেকআপ করিয়েছে প্রত্যয়, ডাক্তার বলেছে ক্রীতিকের শরীর এখনো অনেকটা দূর্বল, এ্যা’ক্সিডেন্টের ধকল কাটিয়ে উঠতে আরও কিছুটা সময় লাগবে, তার উপর কালকে একটু বেশিই প্রেশার দিয়ে ফেলেছে নিজের অসুস্থ শরীরটাকে, যার দরুন এই মূহুর্তে হাতে স্যালাইন লাগিয়ে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ক্রীতিক। ওর একহাতে আইপ্যাড আর কানে হেডফোন,এভাবে বসে বসে কি শুনছে কে জানে?
ক্রীতিকের থেকে হাত কয়েক দূরে স্টাডি টেবিলে বসে তখন থেকে ল্যাপটপে কি যেন টাইপ করছে অরু। আসলে আজ বহুদিন বাদে আবারও লিখতে বসেছে ও, লিখালিখিটা মূলত এমনই, হৃদয় থেকে শব্দগুচ্ছ উগরে না বেরোলে একটা অক্ষরও লেখার শক্তি নেই। অরুও পারেনি এতোগুলা দিন বসে থেকেও কোনো একটা বাক্য সাজাতে, কারণ মনের ব্যথা আর মস্তিষ্কের হয়রানি ওকে লিখতে দেয়নি, কোনো এক অজানা শক্তিবলে আঙুল গুলোকে করে দিয়েছিলো অসার আর অপারগ। বহুদিনের সেই অপারগ শক্তিবলকে হটিয়ে, আজ আবারও শান্ত মস্তিষ্কে মনদিয়ে লিখছে অরু।
অফিসে কাজ আছে বলে প্রত্যয় অনেক আগেই চলে গিয়েছে, যদিও ক্রীতিক নিজেই নিজের কাজ করতে পারে, তবুও প্রত্যয় যাওয়ার আগে অরুকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে, এছাড়া ক্রীতিকের কথামতো কালকের ঘটনার জের ধরে অরুকেও প্রাথমিক চিকিৎসা আর কিছু ওষুধ পত্র লিখে দিয়ে গিয়েছেন ডাক্তার।
ক্রীতিকের স্যালাইন শেষ পর্যায়ে, অরু তখনও সচকিত হয়ে একধ্যানে টাইপ করছিল, এমন সময় ভাইব্রেট আওয়াজ তুলে কম্পিত হয়ে বেজে উঠলো ক্রীতিকের ফোন, মোবাইল ফোনটা তখন অরুর কাছেই ছিল, কারণ অনুর সাথে কথা শেষ করে আর ক্রীতিককে ফেরত দেওয়া হয়নি ফোনটা, এখানেই রেখে দিয়েছিলো মনের ভুলে। তাই এই মূহুর্তে ল্যাপটপের দিক থেকে চোখ সরিয়ে চেয়ার ছেড়ে মোবাইল হাতে ক্রীতিকের কাছে এগিয়ে গেলো ও, ক্রীতিকের দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—- ক্লাব থেকে কল এসেছে।
ক্রীতিক কানের হেডফোন খুলে একনজর মোবাইলে চোখ বোলালো, অতঃপর কলটা কেটে দিয়ে সেটাকে অযত্নে ছুড়ে মা’রলো বিছানার এককোনে।
— কি হলো?
অরুর প্রশ্নে ক্রীতিক ওর পানে চেয়ে শান্ত স্বরে বললো,
— কিছুই হইনি বেইবি।
—- তাহলে ফোনটা এভাবে ছুড়ে ফেললেন কেন?
ক্রীতিক অরুকে কাছে টেনে এনে নিজের পাশে বসিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললো,
—- যে রাইডিং এর কারনে আমার হার্টবিট এতোটা ব্যথা পেয়েছে, যে রাইডিং আমাদের এভাবে আলাদা করে দিয়েছে, সেই রাইডিং আমি পুনরায় কন্টিনিউ করবো ভেবেছিস? ইভেন আই হেইট বাইক। আজ থেকে আমার একটাই অবসেশন, আর সেটা হলি তুই।
এতোক্ষণ ধরে ক্রীতিকের কথাগুলো মনোযোগী হয়ে চুপচাপ শুনলেও,এই মূহুর্তে চট করে উঠে দাড়িয়েছে অরু।
অরুকে উঠে যেতে দেখে ক্রীতিক গভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
— হোয়াট হ্যাপেন বেইবি?
অরু দ্রুত হাতে স্যালাইন খুলতে খুলতে বললো,
— স্যালাইন শেষ হয়ে র’ক্ত উঠে এসেছে, তবুও চুপ করে আছেন, বলি আপনার কি অনুভূতি শক্তি নেই নাকি?
স্যালাইন খোলা হয়ে গেলে, ক্রীতিক অরুকে হ্যাঁচকা টানে নিজের বুকের উপর ফেলে দিয়ে বললো,
—- কে বলেছে নেই?কাছে আয় দেখাচ্ছি,
অরু মুখ ভার করে বললো,
— থাক আর দেখাতে হবে না, হাতে লাগবে আপনার।
—- নো ওয়ে।
কথাটা বলেই অরুকে ধা’ক্কা মে’রে বিছানায় ফেলে দিয়ে ওর উপর উঠে বসলো ক্রীতিক, দু’হাতে অরুর নরম কব্জি দুটো চেপে ধরে হাস্কিস্বরে বললো,
—-কাল আমার কতটা কষ্ট হয়েছে সে খবর রাখিস তুই? সারারাত একটুও ঘুমাতে পারিনি, তাও নিজেকে বারবার বুঝিয়েছি, আমার পিচ্চি বউটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে ছিল,এই ঘুমন্ত পরীটাকে কি করে জাগাতাম আমি? আমিতো নির্দয় মানব তবুও এই নি’ষ্ঠুরতম কাজটা করতে পারিনি আমি,ফলে রাতের মতো ছাড় দিয়েছি তোকে। সকাল বেলা যে কিছু করবো তাও সহ্য হলোনা তোর উজবুক দুলাভাইয়ের,কোথা থেকে যেন উড়ে এসে স্যালাইন ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো, আর এখন তুই ও বাহানা দেখাচ্ছিস? কি সাহস তোর অরু? ভয় করছে না আমাকে?
মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে অরু লাজুক হেসে জবাব দিলো,
— না করছে না, আপনার সবরকম রূপ দেখেই অভস্ত্য আমি।
—- বেইবি লুক এট মি,
ক্রীতিকের ডাকে ওর চোখে চোখ রাখলো অরু, তৎক্ষনাৎ হৃদয়ে ঝড় বইতে শুরু করে অরুর, ওলট পালট হয়ে যায় আবেগের সমুদ্র, কি ভ’য়ানক আকর্ষন ওই ভাসমান চোখ দুটোতে, অরু আজও বুঝতে পারেনা কি আছে ওই দু’চোখে? যা অরুকে এভাবে নিস্তেজ করে ছাড়ে, হৃদয়ের কূল ভে’ঙেচুড়ে প্লাবিত করে দেয় মূহুর্তেই। আজ সকল সংকোচ উপেক্ষা করে অরু প্রশ্নটা করেই বসলো ক্রীতিককে, তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে শুধালো,
—- কি আছে আপনার দু’চোখে বলুন না?
হাতে ক্যানোলা থাকার দরুন ব্যস্ত হাতে অরুর শরীরের সম্ভ্রমটুকু টেনে ছিঁড়তে ছিঁড়তে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে জবাব দিলো,
—- অবসেশন, আই থিংক আনহেলদি অবসেশন।
নিজের জামার নড়বড়ে হাল দেখে অরু অসহায়ের মতো করে বললো,
—- কি করছেন, আমার পছন্দের জামা এটা।
ক্রীতিক উদভ্রান্তদের মতো অরুর কপালে চুমু খেয়ে জবাব দেয়,
— আবার কিনে দেবো বেইবি, একটা নয় দশটা কিনে দেবো, তাও এখন চুপ করে থাক, না না কি যেন বলছি? জাস্ট কন্টিনিউ ইট।
ক্রীতিকের কথা মতো অরু পুনরায় শুধালো,
—- আর?
অবসেশনের বাইরে গিয়ে অরুর প্রশ্নের সঠিক উত্তর বোধ হয় ক্রীতিকেরও অজানা, দুনিয়াতে এতো সুন্দরী আর আকর্ষনীয় মেয়ে থাকতে কেন ও অরুর জন্যই শুধু এতো পাগলামি করে, কে জানে? অজানা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলো ক্রীতিক, বরং এক সমুদ্র ভালোবাসায় হারিয়ে যাওয়ার প্রয়াশে মুখ বাড়িয়ে দিলো অরুর তুলতুলে নরম উন্মুক্ত গলার ভাঁজে। তবে ওর অধর জুগল অরুকে স্পর্শ করার আগেই অরুর গলায় অনেক গুলো কালচে ক্ষত দেখতে পেয়ে ভীষণ ব্যতিগ্রস্থতায় কপাল টা কুঁচকে এলো ক্রীতিকের।
ও সেগুলোতে তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে অকস্মাৎ শক্ত হাতে গলাটা চে’পে ধরলো অরুর। ক্রীতিকের স্পর্শ বরাবরই তীব্র বেদনাদায়ক, কিন্তু কোনটা ভালোবাসার স্পর্শ আর কোনটা ক্ষো’ভের সেটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে অরু।যার দরুন, অসহনীয় ভালোবাসার স্পর্শের মাঝে হুট করেই এমন রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় কিছুটা আ’তঙ্কিত হয়ে ক্রীতিকের চোখের দিকে চাইলো অরু, দেখলো একটু আগের সেই কামুক চোখদুটো কখন যে উধাও হয়ে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ক্রীতিকের হাতের বাঁধনটা এতোই দৃঢ় যে অরুর দম আটকে আসছে,চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে আপনাআপনি, তবুও বহু কসরত করে ক্রীতিকের আ’গুনের হালকার মতো চোখের দিকে চেয়ে অস্পষ্ট আওয়াজে অরু শুধালো,
— কি হয়েছে, লাগছে তো আমার।
অরুর কথায় পাত্তা দিলোনা ক্রীতিক, মুখের পেশীগুলো শক্তকরে অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বললো,
—- গত দু’মাস ধরে তোকে স্পর্শ করিনি আমি, তাহলে এগুলো কি? কে করেছে তোর শরীরে পার্পল মার্ক? আমার জিনিসে কে হাত দিয়েছে?
শেষ কথাতে ধমকে উঠলো ক্রীতিক, অরু নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না কোন দাগের কথা বলছে ক্রীতিক? তাছাড়া কেমন করেই বা এলো এই দাগ? অরুর মাথাটা কাজ করছে না, এদিকে ছাফছাফ উত্তর দিতে না পারলে ক্রীতিক নির্ঘাত মে’রে ফেলবে ওকে, সেই ভয়ে অরু আমতাআমতা করে বললো,
—- আপনি কাল কথা দিয়েছিলেন আআমাকে আর মা’রবেন না, আ…
— এইইই চুপ, রাখ তোর কমিটমেন্ট, আগে জবাব দে, আমার জিনিস কে এভাবে স্পর্শ করেছে? নয়তো আজ তোর শরীরের কোনো যায়গা বাদ রাখবো না আমি অরু, র’ক্তা’ক্ত করে ফেলবো একদম , এর থেকেও বেশি জঘন্য অবস্থা হবে তোর।
কথা বলতে বলতে অরুকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বসিয়ে দিলো ক্রীতিক। ক্রীতিকের সেই টানে অরুর মনে হলো বাহু থেকে ওর হাতটাই ভে’ঙে চলে আসবে, কোনোমতে কম্ফোর্টারের ভাঁজে নিজেকে আড়াল করে অরু ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে হেচঁকি তুলে বললো,
— বিশ্বাস করুন, আমি জানিনা কি ভাবে হলো এসব।
এই মূহুর্তে ক্রীতিকের মেজাজ চড়ে আছে সপ্তম আসমানে,সেই সাথে উগ্রতা ছড়িয়ে পরেছে চোখে মুখে এমনকি সমগ্র শরীর জুড়ে, ও পারলে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো অরুকে, ওর জিনিসকে কেউ এতোটা গভীর ভাবে স্পর্শ করেছে আর অরু কিনা সেটা এরিয়ে যাচ্ছে? কত বড় কলিজা ওর।
মাত্রাতিরিক্ত চড়াও মেজাজের ফলসরূপ এবার অরুর চো’য়ালটা শ’ক্ত হা’তে চেপে ধরলো ক্রীতিক, সেভাবেই অরুর মুখের সামনে মুখ এনে কঠিন গলায় বলে উঠলো ,
—- জানিস না মানে? তোকে কেউ এভাবে স্পর্শ করলো আর তুই জানিসই না? কার সাথে শুয়েছিস সত্যি করে বল? দাগগুলো তো তরতাজা মনে হচ্ছে, অমিতের সাথে নয়তো?
অরু তৎক্ষনাৎ আ’তঙ্কি’ত হয়ে এদিক ওদিক জোরে জোরে মাথা নাড়ালো।
তবে তা দৃষ্টিগোচর হলোনা ক্রীতিকের তার আগেই ওর চোখ গিয়ে ঠেকল স্টাডি টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপের দিকে, যেখানে অরুর বহুকষ্টের লেখাগুলো এখনো ফ্রন্টপেজে ভাসছে, ক্রীতিক সেদিকে তাকিয়ে দাঁত দিয়ে দাঁত পিষে বললো,
—- আমি জানতাম এই অমিতের প্রতি তোর ভীষণ দূর্বলতা।
—- কি বলছেন এসব পা’গল লোক?
এতোক্ষণ নিজেই ভীষণ দ্বিধাদন্দের মধ্যে থাকায় অরু খুব একটা খেয়াল করতে পারেনি ক্রীতিকের কর্মকান্ড, কিন্তু যেই মূহুর্তে মনে পরে গেলো এটা আসলে রেজার কাজ, সেদিন ধ’স্তাধস্তি’র সময় রেজা অসংখ্যবার অরুর কলার টেনে ধরেছিল, যার প্রেক্ষিতে নখের আঁচড় বসে এমন কালচে হয়ে গিয়েছে কলার বোন গুলো, ঠিক তখনই চেচিয়ে উঠলো অরু।
তবে অরুর চেঁচানোতে খুব একটা যায় আসলো না ক্রীতিকের, ও রাগের বশবর্তী হয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে অরুর ল্যাপটপটা তুলে নিয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আছাড় মা’রলো মেঝেতে , প্রথমবারে খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ার দরুন, ক্রীতিক পুনরায় সেটা হাতে তুলে নিয়ে এবার জানালা দিয়ে বাইরে ফেলতে উদ্যত হয়।
চোখের সামনে নিজের স্বপ্ন, এতোগুলো দিন ধরে জমানো লেখা সব এভাবে নিজের স্বামীর হাতে ধ্বং’স হয়ে যেতে দেখে বিছানা ছেড়ে ছুটে এসে ক্রীতিককে আটকালো অরু, পেছন দিক থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—- থামো প্লিজ, ওটা ফেলোনা, আমি তোমাকে সব খুলে বলছি, তাও ওটা ফেলোনা দয়া করে, এখানে অমিতের কোনো যোগসূত্র নেই, লেখালিখি আমার ছোটবেলার স্বপ্ন।
ক্রীতিক থামলো, ল্যাপটপটা বাইরে না ফেলে ছুড়ে মা’রলো টেবিলের উপর।
অরুর” তুমিতে” কাজ হয়েছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ও। এরপর সেভাবেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে একে একে রেজার ঘটনা সব খুলে বললো ক্রীতিককে, ক্রীতিক শুধু দু’হাত মুঠি বদ্ধ করে সবটা চুপচাপ শুনে গেলো, অতঃপর ঘুরে দাঁড়িয়ে অরুকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে গমগমে আওয়াজে শুধালো,
—- আর কোথায় টাচ করেছে বা’স্টা’র্ডটা?
ক্রীতিকের কথার জবাবে অরু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে না সূচক মাথা নাড়ালে, ক্রীতিক কি ভেবে যেন নিজের শার্টটা খুলে অরুর উন্মুক্ত শরীরটা ঢেকে দেয়,পরমূহুর্তেই নিজে একটা হুডি পরে সিগারেট আর ওয়ালেট নিয়ে গটগটিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে, যেতে যেতে অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
— ফ্রেশ হয়ে রেস্ট কর, তোকে টায়ার্ড লাগছে।
ক্রীতিকের কথায় জবাব দিলোনা অরু, উল্টো রাগে ক্ষো’ভে ফোসফাস করতে করতে ক্রীতিক বেড়িয়ে যেতেই ধাপ করে লাগিয়ে দিলো বেডরুমের বিশাল দরজাটা।
***********************************************
সে বেলা সেভাবেই কেটে গেল, সকাল পেরিয়ে দুপুর হলো, দুপুর পেরিয়ে বিকেল ,এক পর্যায়ে বিকেল পেরিয়ে আঁধারের চাদর মুড়ি দিয়ে রাত নেমে এলো সুবিশাল ধরনী জুড়ে, তখনও অরু যেন অস্তিত্বহীন, সারাদিনেও একটিবার দরজা খোলে নি ও। আর নাতো খোঁজ নিয়েছে ক্রীতিকের, ওদিকে ক্রীতিকও কেন যেন আগ বাড়িয়ে ঘাটায়নি অরুকে,আর ঘাটাবেই বা কেন? ও কি তার যোগ্যতা রাখে আদৌও? তাছাড়া অরু দরজা খুললে কিইবা জবাব দেবে ও? এইতো সকালেই, শুধু শুধু মেয়েটাকে কথার আ’ঘাতে ছি’ন্নভি’ন্ন করে দিয়েছে ক্রীতিক। ওর মাত্রাতিরিক্ত পসেসিভনেস, অবসেশন, টক্সিসিটি এসব অরুকে কষ্ট দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ক্রীতিক সেটা ভালোকরেই জানে, তবুও কেন যেন রাগ উঠলে নিজেকে সংযত করতে পারেনা ক্রীতিক, অরুর বেলায় তো মোটেই না, তখন বারবার মনে হতে থাকে এই শরীর এই আত্মা সব আমার, সব। ওর সাথে যা ইচ্ছে তাই করতে পারি আমি, আমাকে বাঁধা দেওয়ার অধিকার কেউ রাখেনা, সয়ং অরু নিজেও না।
অথচ রাগ পরে গেলে সে সব ঘটনার জন্য ভীষণ অনুশোচনায় হৃদয়টা হাহাকার করে ওঠে ক্রীতিকের, বারবার মনে হয়, একটু একটু করে ভালোবাসার বীজ বপন শেষে ছোট্ট চারাগাছ থেকে বেড়ে ওঠা ফুলের মতো পবিত্র আত্মাটাকে কি করে এতোটা আ’ঘাত করলাম আমি? আমার মতো একটা লাগামহীন ছন্নছাড়া ছেলেকে ভালোবেসে অরুও তো আজ অবধি কম য’ন্ত্রনা সহ্য করেনি, শুধু মাত্র আমার টানে ইউ এস এ পর্যন্ত চলে এসেছে মেয়েটা, আর আমি? হিজিবিজি ভাবতে ভাবতেই ভীষণ ক্ষো’ভে চিৎকার করে উঠলো ক্রীতিক,
—- আআআআহ ফা’কড মাই এ্যারোগেন্সী।
এখন নিশ্চয়ই অরু ক্রীতিকের কোনো কথা শুনবে না? হ্যা, ক্রীতিক পারে অরুকে জোর জবরদস্তি করতে কিন্তু সকালের ঘটনার পরে সেটাকি আদৌও উচিৎ হবে? সেই ভেবেই নিজেকে সারাটাদিন গুটিয়ে রেখেছে ক্রীতিক, দুপুরের সময় অরুর পছন্দের বিরিয়ানি অর্ডার করে সেটাকে ড্রোনের সাহায্যে জানালা দিয়ে অরুর রুমে পাঠিয়েছে, তাও ওকে এই টুকু বিরক্ত করেনি ক্রীতিক। খাবারের সাথে দিয়ে দিয়েছে ছোট্ট একটা চিরকুট, যাতে লেখা,
—- আ’ম সরি হার্টবিট, আর এমন হবে না, জীবনেও হবেনা, একটু রুমে এলাউ কর, তোকে অনেক আদর করবো।
সাথে দুঃখী দুঃখী একটা ইমোজি। তবে এই চিরকুট ফিরকুটে আজ আর মন টললো না অরুর। ও খাবারটা রেখে দিয়ে চিরকুটটা পুনরায় ফেরত পাঠিয়ে দেয় ড্রোনের সাথে , ড্রোনটা চিরকুট সমেত ফিরে আসায় ক্রীতিক ভেবেছিলো অরু হয়তো কিছু লিখে পাঠিয়েছে, তাই তাড়াহুড়ো করে ব্যাকইয়ার্ড থেকে ড্রোনটা কুড়িয়ে চিরকুট খুলে ক্রীতিক দেখতে পায়, ওর সরিটা কেটেকুটে সেখানে কতগুলো রাগি ইমোজি এঁকে দিয়েছে অরু।
অগত্যাই বউয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাটা, নদীতে বহমান উল্টো স্রোতের মতোই বিফলে চলে গেলো জায়ান ক্রীতিকের।
*************************************************
অন্ধকারের মাঝে হাই পাওয়ারই চশমা দিয়েও খালি চোখে চারিদিকের কোনোকিছুই দেখার উপায় নেই, অথচ এই নিকোশ আধারের মাঝেও সায়রের দুঃখী দুঃখী মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অর্ণব। খানিকবাদে বাদেই ফোঁসফাস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে সে। ঘটনাটা এক কিংবা দু’মিনিট ধরে চলমান নয়, সেই যে পাহাড়ের চূড়ায় এসে তিনজন মিলে বসেছে তখন থেকেই চারিদিকে নিরবতা বিরাজমান, ফাঁকে ফাঁকে সায়রের দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ ভেসে এলেও ক্রীতিক নিরবে স্মোক করছে শুধু , এদের দুঃখী দুঃখী ব্যথাতুর চিত্তের মাঝে পরে অর্ণবের নিজেকে এলিয়েন মনে হচ্ছে, যার আদতে কোনো দুঃখ কষ্ট বলে কিছুই নেই।
অথচ এলিসার প্রেগন্যান্সি মুড সুইং এর খপ্পরে পরে প্রতিদিন কি মা’রটাই না হজম করে ছেলেটা, সে কথা না হয় অজানাই থাক। আপাতত সায়রের এই দীর্ঘশ্বাস মেনে নেওয়া যাচ্ছে না মোটেই, ওকে থামাতে হবে, তাই কিছুটা বিরক্ত হয়ে অর্ণব বলে ওঠে,
—- কি হয়েছে বলতো? এভাবে নিঃশ্বাস নিতে থাকলে তো হায়াত ফুরাবার আগেই ম’রে যাবি তুই?
তৎক্ষনাৎ সায়র খেঁকিয়ে উঠে বললো,
—- তোদের মতো হা’ড়বজ্জাত বন্ধু থাকার চেয়ে ম’রে যাওয়া অনেক ভালো, শালা কি খাইয়ে পাঠালি কাল রাতে? কিছুই মনে নেই, সকালে উঠে দেখি বউ আমার রেগে বো’ম হয়ে আছে।
অর্ণব কপাল কুঁচকে বললো,
— চুমু কি খেয়েছিলি নাকি খাসনি? রাগটা করেছে কেন সেটা নিশ্চয়ই জানিস?
সায়র মুখ কাচুমাচু করে বললো,
—- আমার কিছুই মনে নেই, আর নীলিমা তো কথাই বলছে না,ব্রেকফাস্টে পো’ড়া রুটি খেতে দিয়েছে,তাও একটা।
সায়রের কথার পাছে অর্ণব মিনমিনিয়ে অসহায় সুরে বললো,
— তোর বউতো তাও খেতে দেয়, আমার বউ তো সকালে উঠেই ক্যারাটে প্র্যাকটিস করতে বেরিয়ে যায়।
— কিছু বললি?
অর্ণব না সূচক মাথা নাড়ালো, বললো,
— শোন, তুই আজ গিয়ে নীলিমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবি, যে আদৌও তুই কিছু করেছিস নাকি করিসনি। যদি না করিস, তাহলে নতুন প্ল্যান বানাবো আমরা।যার নাম হবে মিশন ফুলসজ্জা ।
অর্ণবের কথায় সায়র হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
—- তুই এখানে কি করিস? তোর না বাড়িতে বউ এসেছে? তাও তোর আমাদের সাথে আড্ডা দিতে মন চাইলো? স্ট্রেঞ্জ!
ক্রীতিক মুখ দিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া ছেড়ে বললো,
—- বউ রাগ করেছে।
তৎক্ষনাৎ নির্বিকার গলায় অর্ণব বলে উঠলো,
—- তো রাগ ভাঙালেই তো হয়, তাছাড়া অরু একটা সফ্টি, ও তোর উপর কতক্ষণই বা রাগ দেখাবে? বেশি হলে একঘন্টা।
—- সারাদিন,
অর্ণবের মুখের উপর কথাটা বলে সায়রের মতো করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ক্রীতিক।
অর্ণব বুদ্ধিমানদের মতো মাথা দুলিয়ে বললো,
—- বুঝেছি জটিল সমস্যা, তুই একটা কাজ কর, তুই বরং অরুকে কোনো একটা সারপ্রাইজ দিয়ে দে, দেখবি রাগ ফাগ সব উধাও।
অর্ণবের কথায় ক্রীতিক ওর পানে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে, অর্ণব পুনরায় বলে,
—- এই ধর, ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে নিয়ে গেলি, ফুল দিয়ে প্রপোজ করছি, কিংবা কোনো রয়েল প্যালেসে নিয়ে গিয়ে ওকে একটু বেহালার সুর শোনালি, সেই বেহালার তালে তোরা দুজন বল নাচ করলি, তোদের পায়ের কাছে জমা হয়ে থাকবে অসংখ্য রঙিন বেলুন, মাথার উপর থেকে ঝড়ে পরবে টকটকে লাল গোলাপের পাপ…..
অর্ণব কথা শেষ করার আগেই ক্রীতিক ওকে ঠাস করে থামিয়ে দিয়ে বললো,
—- হয়েছে থাম, আমি এসব পারিনা, এগুলো আমার ডিকশনারিতেই নেই, ইভেন আজ পর্যন্ত আমি অরুকে নিয়ে কোনোদিন শপিং এ অবধি যাইনি, যখন যা প্রয়োজন সব অনলাইনে অর্ডার করেছি, বিয়েটা পর্যন্ত করেছি কোনোমতে, সেখানে তুই কিসব বুদ্ধি দিচ্ছিস? এসব আমার দ্বারা হবেনা।
কথা শেষ করে ক্রীতিক উঠে দাড়িয়ে, ওদেরকে রেখেই চলে যায়, অর্ণব পেছনে ঘুরে ক্রীতিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে শুধায়,
—- আরেহ কোথায় যাচ্ছিস?
ক্রীতিক যেতে যেতে জবাব দেয়,
— বউয়ের রাগ ভাঙাতে।
ক্রীতিক চলে গেলে সায়র অর্ণবকে বলে,
—ওদের হঠাৎ কি হলো বলতো?
অর্ণব মোবাইলে কিছু একটা চেইক করতে করতে জবাব দেয়,
—- জানিনা, তবে অরুর মামাতো ভাই রেজা এবার শেষ, ছেলেটা একটু বেশিই ধূর্ত।
সায়রের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পরলো, ও তৎক্ষনাৎ উদ্বিগ্ন গলায় শুধালো,
—- শেষ মানে?
অর্ণব কপট হেসে বললো,
—- কুল সায়র, কাল ইন্টারনেটে এমনিই দেখতে পাবি, এতো হাইপার হওয়ার কিছুই নেই।
*************************************************
গভীর রাতে ঘুমের মাঝে অরুর যখন মনে হতে থাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে একটা খরখরে উষ্ণ হাত অবাধে বিচরণ করছে ওর সমস্ত পৃষ্ঠদেশে ,ঠিক তখনই লাফিয়ে উঠে বসলো অরু, এদিক ওদিক চোখ বোলাতে গিয়ে ড্রীম লাইটের হলদে আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলো ক্রীতিক বসে আছে ওর মুখোমুখি হয়ে। তারমানে একটু আগের হাতটা ক্রীতিকেরই ছিল,ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই অরু রেখেমেগে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ক্রীতিক বলে ওঠে,
—- ব্যথা করছে হার্টবিট।
ক্রীতিকের কথায় রাগঢাগ ভুলে গিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো অরু, মনেমনে ভাবলো, সত্যিই তো আজ ক্রীতিক একটা অষুধও খায়নি, কি করেই বা খাবে? অষুধ তো সব বেডরুমে ছিল, আর অরুতো রাগের চোটে দরজাই খোলেনি বেডরুমের। ক্রীতিকের ব্যথার কথা শুনে অনুশোচনা হতে লাগলো অরুর মনে, ও তৎক্ষনাৎ ক্রীতিকের বাজ কাট সূচালো চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে করুন স্বরে বলে ওঠে,
—- মাথায় কি বেশি ব্যথা করছে?
ক্রীতিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে অরুর হাতটা নিজ বুকের বাম পাশে রেখে শান্ত স্বরে বললো,
— এখানে ব্যথা করছে , তুই ইগনোর করলে আমার হৃদয়টা ব্যথা করে অরু, খুব ব্যথা করে।
চলবে……..
#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৫৫
#লেখনীতে_suraiya_rafa
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)
মেঘলা আকাশ, বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে প্রবল বেগে,মাথার উপরের পাইনগাছ গুলো অন্ধকারের মাঝে উথাল-পাথাল হয়ে উড়ছে, যেন কোনো বিদঘুটে জন্তুজানোয়ার।ঘুনাক্ষরেও ভুলবশত সেদিকে একবার চোখ চলে গেলে মনে হয়, এখনই ছুটে এসে বিশাল হা তুলে থাবা বসাবে ঘাড়ে, শুষে নেবে শরীরের শেষ র’ক্তবিন্দু।
দেখলেই কেমন ভয়ে শীড় দাঁড়া বেয়ে নেমে আসে হীমধরা শীতল স্রোত। এমন একটা গা ছমছমে পরিবেশেও নিদারুণ ভঙ্গিমায় ব্যালকনিতে বসে আছে নীলিমা। ওর কোন হেলদোল নেই এই দমকা বাতাসে, যেন এক নির্জীব আত্না, খুলে রাখা রেসমের মতো চুলগুলোও সেভাবেই উড়ছে এলোমেলো হয়ে।
নীলিমাকে উদাসীন দেখাচ্ছে, সেই সন্ধ্যা থেকেই কি যেন অযাচিত ভাবনায় বুদ হয়ে আছে মেয়েটা,মনের মাঝে চলছে হাজারো জটিল সমীকরণ, যা ওর একান্ত নিজের। সমীকরণের সমাধান যে নীলিমার অজানা, তেমনটা নয়। ও তো স্রেফ নিজের যোগ্যতা আর অপরিনামদর্শীতা নিয়ে দ্বিধাদন্দের মধ্যে আটকে আছে, তবুও আজ মন বলছে এবার একটা সমাধান প্রয়োজন,সত্যিই প্রয়োজন।
সায়রের মতো এমন একটা সজীব হৃদয়ের পুরুষের সাথে ঘর বাঁধতে হলে আরও আগে প্রয়োজন।
সায়রের নাম নিতে না নিতেই রুমে এসে হাজির হলো সায়র, কাঁধে তার ছোট্ট ব্যাগপ্যাক, মনে হয় শুট ছিল আজ। সায়রের উপস্থিতি টের পেয়ে নীলিমা পেছনে ঘাড় ঘোরালে সায়র একটা ক্লান্ত মাখা হাসি নিক্ষেপ করলো নীলিমার পানে, নীলিমা সেভাবেই নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু , সায়র ব্যালকনির দিকে দু’কদম এগিয়ে এসে নীলিমাকে বললো,
— রান্না করেছো কিছু? নাকি আমি করবো?
ওয়েল, সায়রের এই কথাটা নীলিমার কাছে নতুন কিছু নয়, কারন গত দু’মাসে নীলিমা হাতে গোনা কয়েকদিন রান্না করলেও, বেশির ভাগ সময়ই রান্নাবান্নাটা সায়র নিজেই করে , যখন সময়ের অভাবে করতে পারেনা, তখন বাইরে থেকে খাবার অর্ডার দিয়ে দেয়। তবুও রান্নাবান্নার জন্য নীলিমাকে হুকুম করেনা কখনো।
সায়রের কথার পাছে নীলিমা জানালো,
—- করেছি, ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার বাড়ছি।
পরিবেশটা কিঞ্চিৎ অসহনীয় আর দমবন্ধকর, কেমন যেন গুমোট ভাব প্রকাশ পাচ্ছে নীলিমার আচার আচরণে, এ যেন তীব্র ঝড়ের পূর্বাভাস, অবশ্য বাইরেও ঝড়ো হাওয়া বইছে খুব। তাই বেশি কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে জলদি ওয়াশরুমে ঢুকে যায় সায়র।
আর যখন বেরিয়ে আসে তখন দেখতে পায় ডাইনিং এ খাবার বেড়ে অপেক্ষা করছে নীলিমা।
মখমলের মতো নরম বাথ টাওয়ালটা গলায় ঝুলিয়ে সায়র এগিয়ে গিয়ে খেতে বসলো চুপচাপ, সবকিছু এখনো আগের ন্যায় থমথমে, নীলিমা কেমন যেন আজকে একটু বেশিই চুপচাপ। চুলফুল খুলে অমন বারান্দায় বসেছিল, পাইন গাছের পেত্নী ভর করলো কিনা সেটাও ভাবনার বিষয়, সায়র ভাবলো কিছুক্ষণ, অতঃপর নিরবতা ভেঙে আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো ,
—- বলছি যে নীলিমা, কোম্পানি থেকে আমাকে বড় একটা এপার্টমেন্টে ওঠার জন্য বলা হচ্ছে, আমার ম্যানেজার ও সেখানে সর্বক্ষন কর্মরত থাকবে, তুমি যদি বলো তো এই এ্যাপার্টমেন্টটা আমরা শীঘ্রই ছেড়ে দেবো।
নীলিমা খেতে খেতে গভীর কন্ঠে বললো,
— কেন, এই বাসাটায় কি সমস্যা? এখানেও তো আপনার ম্যানেজার আসে প্রয়োজন হলেই।
সায়র একটু ভেবেচিন্তে শান্তস্বরে জবাব দিলো,
— আই নো, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে , এবার আমাদের এই বাসাটা থেকে অন্য কোথাও মুভ করা দরকার, একটা প্রোপার গোছানো সংসার প্রয়োজন আমাদের, ইউ নো হোয়াট আই মিন। নয়তো..
থেমে গেলো সায়র, নীলিমা বেশ শান্ত স্বরে শুধালো,
— নয়তো কি?
— নয়তো আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছে না কিছুতেই,আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা দূরত্ব থেকে যাচ্ছে, যেটা ঘুচিয়ে ফেলা খুব প্রয়োজন নীলিমা, আমি তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই আর পাঁচটা কাপলের মতো গুছিয়ে সংসার করতে চাই, বাচ্চাকাচ্চা জন্ম….
আবারও মাঝপথে কথা আটকে গেলো সায়রের। নীলিমা কিছুই বলছে না,মাথা নিচু করে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে শুধু । নীলিমার নীরবতা সায়রকে পীড়া দেয়, অজানা অধিকারবোধে ফুঁসে ওঠে হৃদয়টা, তবুও নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখে গভীর কন্ঠে সায়র বলে,
— হতে পারে আমার এই পুরাতন এপার্টমেন্টটাই সেই দূরত্বের একমাত্র কারন,নয়তো এখনো সংসার সংসার ফিলটা পাচ্ছি না কেন? কেনইবা কাছে থেকেও তুমি এতো দূরে?
এবার একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো মনে হচ্ছে, সায়রের কথায় কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না করেই টেবিল ছেড়ে উঠে যায় নীলিমা, ওর থমথমে চেহারা সুরতে রাগ স্পষ্ট। নীলিমাকে চলে যেতে দেখে সায়র ওকে আবারও পিছু ডেকে বলে,
— সত্যি করে বলো তো, তুমি এখনো আমার উপর রাগ করে আছো তাইনা? জোর করে বিয়ে করেছি বলে?
—- না নেই,
— কি নেই?
— আমি আপনার উপর রাগ করে নেই।
নীলিমার সোজাসাপটা উত্তর, নীলিমার উত্তর শুনে সায়র একটু স্বস্তিতে চোখ বুজলো, পরক্ষণেই চট করে চোখ খুলে নীলিমাকে ডেকে বলে উঠলো,
— নীলিমা!লাস্ট কোশ্চেন?
এবার দাড়িয়ে পরলো নীলিমা, আস্তে করে পেছনে তাকিয়ে শুধালো,
—কি?
— কাল রাতে আমি কি কিছু…? না মানে তোমার সাথে কোনো অভদ্রতা?
সঙ্গে সঙ্গে কঠিন জবাব ভেসে এলো নীলিমার দিক থেকে,
— হ্যা করেছেনই তো, চরম অভদ্রতা করেছেন।যা নয়, তাই বলে গালি দিয়েছেন আমাকে ,ডা’ইনী বুড়ি, কু’টনী বুড়ি, পিশাচিনী, আরও কত কিই।
নীলিমার কথা শুনে সায়র আহাম্মক হয়ে গেলো, শেষমেশ কিনা মাল খেয়ে নিজের বউকে এভাবে গা’লিগালাজ করেছে ও, ছিহ! সব দোষ এই হা’রামি বন্ধুগুলোর।শালা বুদ্ধি দেওয়ার নাম করে একেবারে ফাঁ’সির আ’সামি বানিয়ে ছেড়ে দিলো?
সায়র অসহায়ের মতো করে ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে দেখে,নীলিমা এবার হনহনিয়ে রুমের দিকে চলে গেলো। নীলিমা রেগেমেগে চলে যাচ্ছে,ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পেছন থেকে হাঁক ছেড়ে ডাকলো সায়র,
— নীলিমা, নীলিমা শোনো একটু, আমি আসলে ওভাবে মিন করতে চাইনি, বিশ্বাস করো কাল রাতে যা করেছি, যা বলেছি, সে সব কিছুই আমি মনের ভুলে করেছি, আই সয়ার একটা কথাও আমার মনের কথা ছিলনা।
সায়রের কথায় পেছনে ঘুরে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো নীলিমা, বললো,
— তার মানে আপনি বলতে চাইছেন কাল আপনি আমাকে ভুল করে চুমু খেয়েছেন? আর যে ওই যে আদুরে কথাগুলো, সেগুলোও সব মিথ্যে ছিল?
এবার যেন আকাশ ভেঙে পরলো সায়র, ওর মাথার মধ্যের ঘিলু সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, তার মানে কি ও কাল নীলিমাকে চুমু খেতে পেরেছিল? নাকি নীলিমা ওকে নিয়ে ঠাট্টা করছে? মনের মাঝের হাজারো কনফিউশান দূর করার উদ্দেশ্যে ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে সায়র অস্ফুটে বললো,
— ইয়ে মানে সত্যিই কি চুমু খেয়েছিলাম?
বুকের উপর দু’হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে, নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয় নীলিমা,
—হ্যা, খেয়েছিলেন।
নীলিমার কথায় বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেলো সায়রের, এতোক্ষণে ভেতরটা কেমন শান্তি শান্তি লাগছে, মনে থাকুক বা না-ই থাকুক, চুমু যে খেয়েছিল এটাই বড় কথা, সেই ভেবে উৎফুল্লতায় কুলকুলিয়ে হেঁসে উঠে সায়র বললো,
—- বিশ্বাস করো নীলিমা কাল যা করেছি, যা বলেছি, সব মন থেকে করেছি, সব।
সায়রের কথায় আচমকা চোখ মুখ কুঁচকে গেলো নীলিমার,যেন বিয়ে বাড়ির পঞ্চ ব্যাঞ্জনের মাঝে হুট করেই কাঁচা করল্লা মুখে পুরে দেওয়া হয়েছে ওর। মুখটাকে সেভাবেই রেখে খেঁকিয়ে উঠে নীলিমা বললো,
— কি বললেন, আপনি যা বলেছেন সব মন থেকে বলেছেন?
সায়র মুচকি হেসে উপুর নিচ মাথা ঝাকালে, নীলিমা দ্বিগুণ রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠলো তৎক্ষনাৎ ,
—- তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আমি আসলেই একটা ডাইনী বুড়ি?
হকচকিয়ে উঠলো সায়র, জলদি হাসি থামিয়ে বললো,
— এমা সেটা কখন বললাম?
নীলিমা ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
— এই যে এখন বললেন। আপনি কাল রাতে যা বলেছেন সব আপনার মনের কথা।
এরপর আর সায়রের প্রত্যুত্তরের জন্য এক মূহুর্ত ও অপেক্ষা করলো না নীলিমা, ঠাস করে ওর মুখের উপরেই লাগিয়ে দিলো দরজাটা।
এদিকে নিজের কথায় নিজেই বোকা বনে গেলো সায়র, মনেমনে চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিজের গালে নিজেই থাপ্পড় বসালো সজোরে, তারপর চোখ খুলে অসহায় সুরে নীলিমাকে ডেকে বললো,
— বউ আমার, বিশ্বাস করো কাল রাতে একটুও নিজের মাঝে ছিলাম না আমি, আর নাতো হুঁশে থেকে কোনোকিছু করেছি।কাল যা যা বলেছি , যা যা করেছি, এমনকি যদি চুমুও খেয়ে থাকি তাহলে সেটার জন্যও আমি খুবই দুঃখীত, তোমাকে হার্ট করা আমার উদ্দেশ্য নয় রাগিনী, আমিতো তোমাকে ভালোবাসার জন্য নিয়ে এসেছি, দুঃখ দিতে যাবো কেন বলো? সবাই তো বিয়ের আগে প্রেমে পরে, আমরা না-হয় বিয়ের পরেই প্রেম করবো, তুমি সময় নাও, আমি অপেক্ষারত। আমাদের গল্পটা হবে লাভ আফটার ম্যারেজ।ইজন’ট ইট বিউটিফুল?
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তখনও উদগ্রীব হয়ে নিজেকে নির্দোষ আর শুদ্ধ পুরুষ প্রমান করায় ব্যস্ত সায়র। আজ যে করেই হোক নীলিমাকে বোঝাতেই হবে, যে তার একমাত্র স্বামী হলো সরলতার প্রতীমা, আগাগোড়া একজন শুদ্ধ পুরুষ। সে মাল খেয়ে এসে অনুমতি ব্যাতীত বউকে চুমু খেয়ে ফেলেছে, এটা মোটেও শুদ্ধ পুরুষের কাজ নয়, তাই ভুলটুকু স্বীকার করে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করাটা জরুরি।
তবে নীলিমার বোধ হয় এতো বেশি শুদ্ধতায় কিঞ্চিৎ আপত্তি রয়েছে, তাই তো নিজের শুদ্ধ স্বামীকে খানিকটা অশুদ্ধ বানানোর পায়তারা করে একটা খোলামেলা নাইট ড্রেস পরে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে খানিকটা আবেদনময়ী রূপে দাঁড়িয়ে পাতলা অধর জুগলে গাঢ় লিপস্টিক লাগাতে লাগাতেই নীলিমা বলে,
—- এই নাইটড্রেসটা জামা কাপড়ের প্যাকেটে পেয়েছি, সাইজটা আমারই, কে কিনলো বলুন তো?
নীলিমার কথার কোনোরূপ জবাব দিলো না সায়র, বরং গভীর চোখে ওর ধনুকের মতো বাঁকানো নারী শরীরটা একঝলক পরখ করে শুষ্ক ঢোক গিললো শুধু ।
— কি দেখেছেন অমন করে?
সায়রের চোখদুটো চিকচিক করছে, ও কিছু বুঝে উঠতে না পেরে মনের আকাঙ্ক্ষাকে সর্বেসর্বা প্রশ্রয় দিয়ে ফট করেই বলে উঠলো,
—- আজকে একটু অশুদ্ধ হতে চাই নীলিমা,উহুম একটু নয় অনেকটা অশুদ্ধ।
*************************************************
বাইরে বাতাসের তান্ডব, শেষ রাতে বোধ হয় ঝড় উঠবে। সায়রদের এপার্টমেন্টের চাইতেও ক্রীতিকের এই নির্জন শহরতলীর বাড়িতে বাতাসের বেগ দিগুণ । তবে থাই লাগানো বিশাল জানালা ভেদ করে সেই প্রকান্ড ঝড়ো হাওয়া প্রবেশ করতে পারেনা অরু ক্রীতিকের মাস্টার বেডরুম অবধি। ভেতরে যা প্রবেশ করে তা হলো প্রতিধ্বনিত বাতাসের শাঁই শাঁই আওয়াজ।আওয়াজটা ভ’য়ানক, কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে,হুট করে যে কেউ শুনলে নির্ঘাত আঁতকে উঠবে।
কিন্তু হঠাৎ বইতে থাকা তীব্র ঝড়ো বাতাসের শাঁই শাঁই আওয়াজে আঁতকে উঠল না অরু, এমনকি চমকালোও না খুব একটা। কারণ এর থেকে বড় চমক তো ওর সামনেই বসে আছে, যার নাম জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। মানুষটা আস্ত একটা চমক,প্রতি সেকেন্ড অন্তর অন্তরই সে চমকে দেয় অরুকে, এই যেমন মাত্রই নিজের খোলস ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসে, একেবারে বাধ্য স্বামীর মতো বউয়ের কাছে নিজের অসহায়ত্ব স্বীকার করে নিলো,কোনোকিছু না ভেবেই হদিস দিয়ে দিলো নিজ হৃদয়ের অসহনীয় পীড়ার, এ পীড়া যে নতুন নয়,তবে মুখ ফুটে প্রকাশ করাটা ছিল পুরোপুরি নতুন এক অধ্যায়, এই যে জায়ান ক্রীতিক নিজের অসহায়ত্ব অরুর সামনে তুলে ধরলো, নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করে দিলো, এটা কি চারটে খানি কথা? বোধ হয় না।
কিন্তু অরুও তো ক্রীতিকেরই বাঁকা পাঁজরের হাড়, এমন ঘাড় ত্যাড়া পুরুষের পাঁজর থেকে সৃষ্টি হওয়া নারী ও তো কম যায়না,তাইতো ক্রীতিকের এমন আবেগাপ্লুত কথাকেও একেবারে সোজাসাপ্টা অগ্রাহ্য করলো অরু, নিজের চূড়ায় উঠে থাকা রাগটাকে এক বিন্দুও না দমিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে সোজা হাঁটা দিলো পাশের বেডরুমের উদ্দেশ্যে, যেখানে আগে, ও আর অনু ঘুমাতো।
অরুর কোমল চেহারায় কাঠিন্যের ছাপ স্পষ্ট, আজ বেজায় চটেছে সে, তারউপর রুম থেকে অবধি চলে যাচ্ছে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্রীতিক নিজেও এগিয়ে গেলো অরুর পিছু পিছু, ওকে আটকানোর চেষ্টা করে বললো,
— বেইবি, কোথায় যাচ্ছিস? ব্যথা করছে তো।
অরু পিছু ফিরলো না, হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো করিডোর ধরে, অরু থামছে না দেখে ক্রীতিক এবার দ্রুত কদমে এগিয়ে অরুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, অতঃপর গেস্ট রুমের দরজাটা সশব্দে লক করে দিয়ে বললো,
— কোথায় যাচ্ছিস?
অরু গাল ফুলিয়ে জবাব দিলো,
— ঘুমাতে।
ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে দাঁতে দাঁত চাপলো,মাথাটা সামান্য নুয়িয়ে অরুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
— সাহস তো কমনা, আমার সাথে ঘুমাবি না, সেটা আবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করছিস? তোকে অনুমতি দিয়েছি আমি অন্য রুমে ঘুমানোর?
ক্রীতিকের ডমিনেটিং কথায় অরুর মেজাজটা আরও বেশি বিগড়ে যায়, ও তৎক্ষনাৎ দু’হাতে ক্রীতিকের চওড়া বুকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সামনে থেকে, তারপর গটগটিয়ে হেটে চলে গেলো ছাঁদ বারান্দার দিকে।
বাইরে ঝড়ো হাওয়ার তোড় বেড়েছে বৈকি কমেনি, তবে এই মূহুর্তে অরুর চড়াও মেজাজের কাছে এসব ঝড়ো হাওয়া টাওয়া কিছুই পাত্তা পেলোনা। অরু চলে যাচ্ছে দেখে ক্রীতিক আবারও এগিয়ে এসে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে, পেছন থেকেই এক নাগাড়ে অরুর মাথায়, খোলা চুলে, পিঠে সবখানে শব্দ করে চুমু খেতে খেতে অরুকে মানানোর চেষ্টা করে বললো,
— বেইবি, বেইবি আই ডিডন’ট মিন ইট, ইউ নো না, হাউ মাচ আই লাভ ইউ। তাহলে কেন বুঝতে চাইছিস না? কেন এভাবে অবহেলা করে হার্ট করছিস আমাকে? তুই শুধু একবার বল, তুই যা বলবি আমি তাই করবো, তাও প্লিজ আমার সাথে একটু কথা বল। প্লিজ হার্টবিট, আই কান্ট টলারেট দিস পেইন এনি মোর।
ক্রীতিকের চোখে মুখে ভীষন অসহায়ত্ব,হাতে এখনো ক্যানোলা লাগানো , তাই খুব শক্ত করে ধরতে পারেনি অরুকে,যার দরুন অরু একঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো ক্রীতিকের বাঁধন থেকে। নিজেকে ছাড়িয়ে ক্রীতিকের থেকে দূরত্ব বাড়াতে চুপচাপ এগিয়ে গেলো পুলের দিকে।
তবুও ক্রীতিক কিছু বললো না,বরং নতুন উদ্যমে এগিয়ে গিয়ে পুনরায় জড়িয়ে ধরলো অরুকে, এবার একটু কৌশল খাটিয়েই অরুকে জব্দ করেছে সে, একহাত রেখেছে অরুর কোমড়ে, অন্যহাত গলা আর বুকের মাঝখানে, এবার আর নড়াচড়া করতে পারছে না অরু, যার ফলরূপ ক্রীতিকের হাতের মধ্যে থেকেই একপ্রকার ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে ও, বলিষ্ঠ দেহের ক্রীতিকের হাতের মধ্যে থেকে চিংড়ি মাছের মতোই লাফাচ্ছে অরু, ওদের ধস্তাধস্তিতে ক্রীতিকের ক্যানোলা লাগানো হাত থেকে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বেড়িয়ে আসে একপর্যায়ে , তবুও ক্রীতিক এইটুকুনি ছাড়ছে না অরুকে, বারবার শান্ত স্বরে বোঝানোর চেষ্টা করছে শুধু ,
— বেইবি প্লিজ, বলেছি তো আর হবেনা, দেখ আমি সরি বলছি।আ’ম এক্সট্রেমলি সরি,তাও তুই কথা বল প্লিজ,আমার থেকে নিজেকে এভাবে বারবার আলাদা করিস না, এতে আমি রেগে যাই, তোর দূরত্ব সহ্য হয়না আমার। বোঝার চেষ্টা কর একটু।
ক্রীতিকের কথা শেষ হতে না হতেই ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে পা ফসকে আচানক পানিতে পরে গেলো ওরা দুজন। পানিতে হাবুডুবু খেয়ে অরু তাড়াহুড়ো পুল থেকে উঠতে গেলে স্কার্ট সমেত একটা পা টেনে ধরে আবারও অরুকে পুলের মাঝে ছু’ড়ে মা’রে ক্রীতিক, আকস্মিক কাহিনিতে আপনা আপনি কয়েক ঢোক পানি খেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা তুললো ক্রদনরত অরু।
ঠান্ডা পানিতে ভিজে একাকার হয়ে গমরঙা ত্বকে লালচে বর্ণ ধারন করেছে ওর, কৃষ্ণচূড়ার ন্যায় রাঙা কপোল বেয়ে অবাধে গড়িয়ে পরছে তপ্ত নোনাজল, যা চোখ এড়ালো না স্বয়ং ক্রীতিকেরও,নিজের কর্মকান্ডে ব্যতিগ্রস্থ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুকে একটানে কাছে নিয়ে এসে ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ক্রীতিক শুধালো,
— ব্যথা লেগেছে?
পরমূহুর্তেই কান্নার বাঁধ ভেঙে গেলো অরুর,কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই অনেকটা শব্দ করে কেঁদে উঠলো ও, কাঁদতে কাঁদতে ক্রীতিকের বুকে ইচ্ছে মতো কি’ল ঘু’ষি ছেড়ে অভিমানি কন্ঠে চেঁচিয়ে বললো,
— তুই একটা পঁ’চা স্বামী, তোর সাথে কোনো কথা নেই আমার,থাকতে পারেও না, তুই সবসময় আমাকে বকিস, কথায় কথায় গায়ে হাত তুলিস, তোর দেওয়া হাজারটা ভালোবাসার ক্ষত আমার শরীরে, তাও আমি সবকিছু সহ্য করি, চুপচাপ মেনে নিই, কারন আমি জানি যে আমি তোর দূর্বলতা, তুই আমাকে না পেলে উন্মাদ হয়ে যাবি,থাকতে পারবি না আমায় ছাড়া, তাই বলে তুই আমার ভালোবাসায় এভাবে আঙুল তুলবি, এভাবে?
তোর মতো একরোখা, অবাধ্য, বদ মেজাজী মানুষকে ভালোবেসে কিই না সহ্য করেছি আমি? কথার আ’ঘাত, শারীরিক য’ন্ত্রনা, মানসিক যন্ত্র’না,আরও কত কিই তার ইয়াত্তা নেই।তাহলে তুই কিভাবে আমার সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললি, কিভাবে বল?
শেষ কথাতে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠে ক্রীতিকের বাহুতে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো অরু। ও এতো জোরেই কামড়ে ধরেছে যে ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে রেখেছে ক্রীতিক,তবুও অরুকে সরায়নি নিজের থেকে, আর না তো অরুর এতো এতো অভিযোগের পাছে একটা টু শব্দ করেছে।
নিজ দাঁতের শক্তি পরে এলে, ক্রীতিকের ভেজা টিশার্টটা টেনে ধরে অরু আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—- সত্যি করে বলুন তো, ভালোবাসা আর অবসেশন এক না তাই না? তার মানে কি আপনিও আমাকে ব্যবহার করছেন? যখন আমার বাহ্যিক সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে তখন….
—জাস্ট শাট ইউর ফাকিং মাউথ অরু!
অরুর কথা শেষ হওয়ার আগেই গর্জে উঠলো ক্রীতিক,ওর কথায় নিজের অজান্তেই কপালের রগ ফুলে উঠে কখন যে শান্ত মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগের পারদ ছড়িয়ে পরেছে তা টের পায়নি ক্রীতিক নিজেও।
এদিকে ক্রীতিকের ধমকে কম্পিত হয়ে উঠেছে অরুর শরীর, ক্রীতিক এতোটা ভ’য়ানক টোনেই ধমক দিয়ে উঠেছে, যে অরু এবার কান্নাকাটি ভুলে গিয়ে মূহুর্তেই ক্রীতিকের অগ্নিদৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে শুষ্ক একটা ঢোক গিলে, পুলের মধ্যেই পিছু হাটতে শুরু করলো। অরু খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, যে অযথাই একটা ঘুমন্ত সিংহকে জাগ্রত করেছে ও। এবার অরুর কপালে দুঃখ আছে, বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকা দরকার, অরু তা ছাড়িয়ে গিয়েছে, ক্রীতিকের হাত থেকে সেই কখন থেকে র’ক্ত ঝড়ছে তাতে অবধি নজর নেই ওর, চোখ মুখ খিঁচে যা মন চায় তাই বলে গিয়েছে ক্রীতিককে। বলতে বলতে শেষ পর্যায়ে এসে মুখ ফসকে যেটা বললো, সেটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাগের চোটে গুমোট হয়ে উঠেছে ক্রীতিকের চোখ মুখের ভঙ্গিমা।
— কি বললি তুই? আবার বল?
ক্রীতিকের গুরুগম্ভীর পুরুষালী প্রতিটি কথার ভাঁজে ভাঁজে উপচে পরছে কতৃত্ব আর কঠিন শাসন।
অরু তাতে ভড়কালো,জিভ দিয়ে শুষ্ক অধর ভিজিয়ে ক্রীতিকের ইস্পাতের ন্যায় কঠিন মুখমন্ডলের দিকে আড় চোখে চেয়ে রইলো শুধু।
অরুকে অনুসরণ করে ক্রীতিক সামনে এগোতে এগোতে চোখ মুখের আদলে আরও খানিকটা কাঠিন্যতা ফুটিয়ে তীর্যক কন্ঠে বললো,
—- কতটা ভালোবাসিস তুই আমাকে? কতদিন ধরেই বা ভালোবাসিস? তোর প্রতি আমার আসক্তি সম্পর্কে কতটুকুই বা ধারণা রাখিস তুই? তুই কি আদৌও জানিস তোর জন্যই যে আমি এমন?
অরু কিছুই বলছে না, শুধু চুপচাপ ভয়ে ভয়ে পেছনে পা ফেলছে, আর ক্রীতিক ওকে অনুসরন করে সামনে এগোচ্ছে।যার দরুন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বারবার সুইমিং পুলটা চক্কর দিচ্ছে ওরা দুজন। অরু চুপ করে আছে দেখে ক্রীতিক আচমকা ওকে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে টেনে এনে ওর কোমড়টা শক্ত করে চেপে ধরে কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বললো,
—- তুই যখন এগারো বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলি তখন থেকে তোর প্রতি আসক্ত আমি। এই রূপ, এই যৌবন কোথায় ছিল তখন? আমাকে বোঝার মতো মনটাও তো তৈরি হয়নি তখনও।
ক্রীতিকের কথা শুনে সচকিত হয়ে নুয়িয়ে রাখা মাথাটা অকস্মাৎ তুলে ওর চোখে চোখ রাখলো অরু।
ক্রীতিক তীর্যক হেসে বললো,
— আই নো, ইটস নট ফেয়ার। কিন্তু কি করবো বলতো? নারী জাতির উপর এক আকাশসম ঘৃণা আর অভিমানের উর্ধে গিয়ে তোকে আমার ভালো লেগেছিল, মনে হয়েছিল তোর হৃদয়টা পেজা তুলোর মতোন নরম আর উষ্ণ। আমার কঠিন বরফের মতো শীতল, নির্জীব হৃদয়ে একটু খানি উষ্ণতার ছোঁয়া দিতেই উপর ওয়ালা বোধহয় তোকে আমার নিকট পাঠিয়েছিল সেদিন। সেই উষ্ণতা, সেই ছোট্ট হাতের স্পর্শ আজও আমাকে পুলকিত করে অরু, ঠিক সেদিনের মতোই চমকে দেয় বারবার , নিজের অজান্তেই সেদিন আমার বুকে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তুই। ব্যাস, তখন থেকেই শুরু হয়ে গেলো হৃদয়ে তোলপাড়, তিরতির করে ভেঙে গেলো দাম্ভিকতার পাহাড়, সেদিন আমিও বোধ করেছিলাম, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য মায়ার বাঁধনের বড্ড প্রয়োজন, আর তুই হলি আমার সমগ্র জীবনের একমাত্র মায়াপরী। সেদিনের পর থেকেই নিজের স্ট্যাটাস,পাসোর্নালিটি,বয়স, সম্পর্কের সমীকরণ সবকিছুর মাথা খেয়ে তোর প্রতি অবসেসট হয়ে গিয়েছিলাম আমি। চোখ বুঝলে কিংবা চোখ খুললে, দিন রাত শুধু তোকেই দেখতাম, তুই আমার মাথা থেকেই বের হতিস না। আমি জানতাম এটা ঠিক নয়, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে , তাও আমি সারাক্ষণ তোকেই চাইতাম।
শুধুমাত্র নিজের অবাধ্য চিন্তাচেতনা, আর বেপরোয়া ইচ্ছে গুলোর হাত থেকে তোকে বাঁচিয়ে রাখবো বলে, নিজেই সরে এসেছিলাম তোর কাছ থেকে, বাড়িয়েছিলাম হাজার মাইলের দূরত্ব, দু’জনার মাঝে টেনে দিয়েছিলাম তিক্ততার এক মহা প্রাচীর, একাকী বিষন্ন জীবনে কতটা যন্ত্রনায় দিন রাত অতিবাহিত করেছি সে হদিস রাখিস তুই? অথচ কোনোকিছু না যেনেই, আমার ভোগ করা যন্ত্রনার একাংশ ও সহ্য না করেই আজ এখন এই যায়গায় দাঁড়িয়ে কি সুন্দর আমার ভালোবাসায় নিজের ছোট্ট আঙুলটা তাক করে ফেললি অরু? আমার থেকেও বেশি ভালোবাসিস তুই? আন্সার মি?
অরুর মুখে কথা নেই,কিইবা বলবে ও? জেনে শুনেই তো ভালোবাসার মহাসমুদ্রে ঝাপ দিয়েছে ও, ক্রীতিকের মতো করে অন্য কেউ ভালোবাসতে পারবে না বলেই তো ক্রীতিকের প্রেমে পরতে বাধ্য হয়েছে অরু, নতুন করে মনকে বোঝানোর তো কিছু নেই।এই মানুষটার হাতে নিজের ভালোবাসার গল্পের শিরোনাম উপসংহার সবই তো লেখা শেষ বহু আগেই। অরু জানে ক্রীতিক যেমন অতিরিক্ত ভালোবাসা দেয়, কষ্টটাও তেমন অতিরিক্তই দেয়, তাও অরুর জায়ান ক্রীতিককেই চাই, মুখে একশোবার না বললেও, মনেমনে হাজার বার হ্যা বলে বসে আছে ও। এ যেন জেনেশুনে বি’ষপান।
নিজের শক্ত হাতের বাঁধন ঠিলে করলো ক্রীতিক, আস্তে করে অরুর কোমড় ছেড়ে দিতেই ভ্রম থেকে বেরিয়ে এসে ক্রীতিকের দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অরু, যেন ও বলতে চাইছে,
— কি ব্যাপার ছেড়ে দিলেন কেন? এতোক্ষণ এতো জোরাজুরি করলেন, আর এখন এভাবে ছেড়ে দিচ্ছেন? ধরে রাখুন না আমাকে।
কিন্তু তার একটা কথাও উচ্চারণ করতে পারলো না অরু, আত্মসম্মানেরও তো একটা ব্যাপার আছে। অরু নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে আছে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ক্রীতিকের বুক চিড়ে, কিছুক্ষন চোখ বুজে নিজেকে খানিকটা সংযত করে শান্ত স্বরে ক্রীতিক বলে,
— আই নো, মাই অবসেশন ইজ আনহেলদি, রাগের সময় যা খুশি তাই করি আমি,নিজের অজান্তেই তোকে অনেক অনেক কষ্ট দিই, আমি মানি, সব দোষ আমার। আমি অনেকটা বেপরোয়া, আর ছন্নছাড়া তাও মানি, কিন্তু তুই শুধু একটাবার আমার হয়ে থেকে যা অরু, ট্রাস্ট মি, আমি ভালোবাসতেও জানি।
ক্রীতিকের শেষ কথাগুলোতে ঠিক কিই পরিমাণ জাদু ছিল, তা বোধ হয় অরু বলে বোঝাতে পারবে না। ক্রীতিকের মতো পিছুটান বিহীন মানুষও যে এতো কাতর হয়ে কাউকে থেকে যেতে বলতে পারে, সেটা অরু আজকেই প্রথম আবিষ্কার করলো, আর ও এটাও জানে যে ক্রীতিক এই কথাগুলো আজ প্রথম বারই বলেছে,অথচ প্রথম বারেই কি সুন্দর হৃদয় নাড়িয়ে দিলো।ক্রীতিকের কথার পাছে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অরু বলে,
—- ফিরে যাওয়ার জন্য আসিনি তো,তাছাড়া ফিরে গেলে তোমাকে কোথায় পাবো আমি? তোমার অতিরিক্ত ভালোবাসার অ’গ্নিস্ফুলিঙ্গে নিজেকে দ’গ্ধ করা যে এখনো বাকি।
বাইরে বিজলি চমকাচ্ছে, ক্ষনে ক্ষনে বিজলির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে সুইমিং পুলের নীল বর্ণের টলটলে স্বচ্ছ পানি, বাতাসটাও বেড়েছে দিগুণ, বাইরের এহেন বৈরী আবহাওয়া দৃষ্টিগোচর হতেই ক্রীতিক অরুকে উদ্দেশ্য করে অনুভূতিহীন কন্ঠে বলে,
—- আমার স্পর্শ খারাপ লাগলে, আমি আর তোকে টাচ্ করবো না কখনো, আর না তো তোকে কোনোকিছুর জন্য জোরজবরদ’স্তি করবো, শুধু আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ঘুনাক্ষরেও মুখে আনবি না, ব্যাস এটুকুই চাওয়া। ওয়েদার খারাপ জলদি রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ কর, নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।
কথা শেষ করে পুল থেকে ওঠার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে পা বাড়ায় ক্রীতিক, তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে অরু ডেকে বলে,
— কে বলেছে আপনার স্পর্শ আমার খারাপ লাগে?
অরুর কথায় ক্রীতিক পেছনে ঘাড় ঘোরালে, অরু এগিয়ে এসে লাফ দিয়ে ক্রীতিকের কোলে উঠে পরে।
অরুর দুই উরুতে হাত রেখে ওকে সামলে নিয়ে, ক্রীতিক গম্ভীর মুখে বললো,
— এখন আবার কি চাই?
— আপনার স্পর্শ। কতদিন হয়ে গেলো আপনি আমাকে একটু আদর করেন না।
ক্রীতিক শুষ্ক ঢোক গিললো, ঢোক গেলার সময় ওর এ্যাডামস এ্যাপেলটা কি আকষর্নীয় ভাবে ওঠা নামা করলো,যা দেখে চোখ দুটো আচানক নেশায় বুদ হয়ে গেলো অরুর, অগত্যাই অরু নিজের খেইর হারিয়ে হাত বাড়িয়ে আলতো হাতে স্পর্শ করলো ক্রীতিকের গলাটা। অরুর গভীর চাহনী পড়ে ফেলতে খুব একটা সময় লাগলো না ক্রীতিকের,ও একটানে অরুর হাতটা নিজের গলা থেকে সরিয়ে বাঁকা হেসে শুধালো,
— যা বলছিস, আর যা করছিস, তা কি সজ্ঞানে ভেবে চিন্তে করছিস? আমার ভালোবাসা যে য’ন্ত্রনাদ্বায়ক সেটা ভুলে গেলি?
অরু আস্তে আস্তে নিজের চাহনি উপরে তুলে ক্রীতিকের চোখে চোখ রেখে বলে,
— এতোকিছু বুঝিনা, আমি আপনাকে চাই, জেনে শুনে আপনার বি’ষাক্ত ভালোবাসা গ্রহন করেছি আমি, যন্ত্রনা তো সহ্য করতেই হবে,তাছাড়া আজকে নতুন তো কিছু নয়।
প্রথমে গাল, এরপর কানের লতিতে আলতো স্পর্শ করে নিজের হাতটা অরুর চুলের ভাঁজে প্রবেশ করায় ক্রীতিক, অরুর লম্বা চুল গুলোকে মুঠি বদ্ধ করে মুখটা নিয়ে আসে নিজের মুখের খুব কাছে,অতঃপর সেভাবেই ধরে রেখে হিসহিসিয়ে ক্রীতিক বলে,
—- আজ আমি একটু বেশিই রেগে আছি অরু, সহ্য করতে পারবি না আমায়। আর না তো আমি তোকে কষ্ট দিতে চাইছি।
ক্রীতিকের বলা কথা গুলো চুপচাপ শুনে গেলো অরু, অতঃপর কোনোকিছুর ইঙ্গিত না দিয়েই চোখের পলকে ক্রীতিকের সিগারেটে পো’ড়া বাদামি ঠোঁটে নিজের ওষ্ঠাধর চেপে ধরে কয়েক সেকেন্ড।
আবেগের বশবর্তী হয়ে স্বামীর রাগ ভাঙানোর আশায় ওই একটা ছোট্ট চুমুই যথেষ্ট ছিল এই মূহুর্তে ক্রীতিককে ব্লাডিবিস্ট বানিয়ে দিতে,
ক্রীতিকের থেকে নিজের ঠোঁটের কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্ব বাড়িয়ে মাথাটা নিচু করে অরু বলে,
—- আর কখনো আপনার উপর রাগ করবো না আমি, আর নাতো আপনাকে এভাবে জ্বালাতন করবো।আপনি কতো অসুস্থ বলুন তো।আমি সত্যিই একটা ইমম্যাচিউর,সব ভুলে যাই আমি।
ক্রীতিক প্রথমে চুপচাপ অরুর কথা শুনে গেলো, পরক্ষনেই বাঁজপাখির মতো আ’ক্রমণ বসালো ওর ফিনফিনে কোমল ওষ্ঠাধরে, অরুর দম ফেলার ফুরসত নেই, অথচ ক্রীতিক ছাড়লো তো নাই, উল্টো ঠোঁটের কাজ অবহ্যত রেখেই হিসহিসিয়ে বললো,
—- একশো বার করবি, যত ইচ্ছে তত রাগ করবি আমার উপর, দিন শেষে তোর সব রাগ ভাঙানোর দ্বায়িত্ব শুধু আমার, তোর রাগ ভাঙাতে যা করতে হয় তাই করবো আমি,দরকার পরলে সারাদিন সারারাত তোর পিছু পিছু ঘুরবো,কোনো সমস্যা নেই তাতে ।ইউ হ্যাভ প্রোপার রাইট টু বি এ্যাঙ্গরি উইথ মি বেইবি। এ্যান্ড আই হ্যাভ প্রোপার রাইট টু পানিশ ইউ হার্ড।
শেষ কথাতে তীর্যক হাসির রেখা ফুটে ওঠে ক্রীতিকের ভেজা অধরের কোনে,
অরু তৎক্ষনাৎ নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়ে, ক্রীতিকের পানে ভ’য়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
— আবারও মা’রবেন?
এবার আর জবাব দিলো না ক্রীতিক, অরুকে বাচ্চাদের মতো কোলে নিয়েই পুল থেকে উঠে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো করিডোর আর ছাঁদ বারান্দার মাঝখানে রাখা কাউচের দিকে, সেখানে অরুকে ছু’ড়ে ফেলে দিয়ে নিজের হাতের ক্যানোলা খুলতে উদ্যত হলে অরু হকচকিয়ে উঠে বললো,
—- ওটা খুলবেন না প্লিজ। এমনিতেই অনেকটা জখম হয়েছে, আর না।
ক্রীতিক চোখ ছোট ছোট করে অরুর আগাগোড়া পর্যবেক্ষন করে হাস্কিস্বরে বললো,
— দেন ইউ হ্যাভ টু হেল্প মি বেইবি।
কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্থ হলো অরু, মিয়িয়ে যাওয়া গলায় শুধালো,
— ক..কি হেল্প?
ক্রীতিক অরুর কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে একই স্বরে বললো,
— জাস্ট আনবাটন মাই শার্ট।
*************************************************
— আমাদের গল্পের ইষ্টিকুটুম হলেন আপনি সায়র, আমি নই।
স্বামী স্ত্রীর একান্ত ঘনিষ্ঠতম মূহুর্ত পার করে সায়র যখন নীলিমার বুকে মাথা ঠেকিয়ে পরম আবেশে চোখ বুজেছিল মাত্র কয়েকসেকেন্ড, ঠিক তখনই কথা ছোড়ে নীলিমা।নীলিমার কথায় তন্দ্রা ছুটে যায় সায়রের, মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে নীলিমার গলায় থুতনি ঠেকিয়ে ভ্রু কুঁচকে সায়র বলে ওঠে ,
— মানে? আমি এতো কঠিন বাংলা বুঝিনা নীলিমা, একটু বুঝিয়ে বলবে?
সায়রের কথার পাছে নীলিমা রহস্যময়ী হাসি উপহার দিয়ে বলে,
—- আপনাদের সবার ধারণা ভুল সায়র, আপনি আমাকে বিয়ে করতে জোর করেন নি, আর নাতো আপনি আমাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনেছেন।
নীলিমার কথা শুনে সায়র এবার ধরফরিয়ে উঠে বসে, অবাক কন্ঠে বলে,
— কি বলছো এসব? আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি তোমাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনেছি বলে তোমার আব্বাজান আমার দিকে ব’ন্দুক অবধি তাক করেছিলেন।
নীলিমা নিঃশব্দে হাসলো, ওর হাসিটা ছিল ব্ল্যাকহোলের মতোই রহস্যেঘেরা, কিংবা মোনালিসার হাসির থেকেও বেশি অদ্ভুত। মুখের হাসিটা ধরে রেখেই নীলিমা বলে,
— শুরু থেকে শেষ অবধি সবকিছুই সাজানো ছিল সায়র।
সায়র শুষ্ক একটা ঢোক গিলে বললো,
— একটু খুলে বলবে প্লিজ?
নীলিমা হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়, পরক্ষণেই বলে,
—- আচ্ছা আপনার একটুও অদ্ভুত লাগেনি, কথা নেই বার্তা নেই হুট করেই আমার বিয়ে কি করে ঠিক হয়ে গেলো? কিংবা আমাদের বিয়ের পরে আব্বাজান আমাদের কেন খুজলো না? আচ্ছা বাদ দিন আমিই বলছি, আসলে আমি আর আব্বাজান চাইতাম কোনোভাবে আপনি আমাকে বিয়েটা করুন, কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে ছিলনা, শুনলাম আপনিও অনু আপার বিয়ের পরেই চলে যাবেন, তাই বুদ্ধি করে নিজের বিয়ের নাটক টা সাজিয়েছিলাম,পরে নিজেই অন্য ফোন দিয়ে আপনাকে আমার বিয়ের খবরটা দিয়েছি, যাতে আপনি এসে আমাকে নিয়ে যান। আর জোর করে বিয়ে করে নেন।
সায়র স্তম্ভিত কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— এতোটা নাটক কেন করেছিলে নীলিমা? আমিতো তোমাকে শুরু থেকেই পছন্দ করতাম, আর তোমার যদি আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছেই থাকে, তাহলে শুধু শুধু আমাকে ইগনোরই বা করেছিলে কেন?
নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— একটা একটা করে বলি?
সায়র বুঝদারদের মতো মাথা ঝাকালো।
নীলিমা বললো,
— প্রথমত মানুষ বিপরীতমূখী জিনিসে আকর্ষিত হয় বেশী, আপনার মতো সুপুরুষদের ক্ষেত্রে এই জিনিসটা একটু বেশিই দেখা যায়, তাইতো আমি ছিলাম আপনার সম্পূর্ণ বিপরীত। যার ফল দেখুন, আপনি খুব দ্রুতই আমার প্রতি আকর্ষন অনুভব করেছেন।তবে বিয়ের পরেও আপনার সাথে স্বাভাবিক না হতে পারার কারণ একটাই ছিল।আর তা হলো, অনুশোচনা।নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যে অবলম্বন করেছিলাম আমি, আপনার মতো মানুষকে ব্যবহার করেছি শুধু মাত্র নিজের স্বার্থ হাসিলের আশায়, এসব ভাবতে গেলেই তীব্র অনুশোচনা আর অ’পরাধ বোধে মাথাটা হেট হয়ে যেতো আমার।
— বিয়েটা কেন করেছিলে?
নীলিমার কথার মাঝেই প্রশ্ন করে সায়র,
প্রত্যুত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নীলিমা বলে,
—- একটা শয়তানের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য, মা মা’রা যাওয়ার সময় চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে অভাবে পরে আমাদের বাড়িটা বন্ধক রেখেছিলেন আব্বা। বাড়িটা যার কাছে বন্ধক রাখা হয়েছিল, সে হলেন আমাদের পুরান ঢাকার প্রভাবশালী জনৈক ব্যক্তি। টাকার গরমে যা নয় তাই করে বেড়ান তিনি, দিনদুপুরে মেয়েদের তুলে এনে সম্ভ্রম হানি করেন,এছাড়া লুটপাট, মা’রামারি হানাহানি এসব তো তার নিত্যদিনের কারবার।
কিন্তু বলেনা যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়, আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো,
বাড়ি বন্ধক দেওয়ার কয়েক মাসের মাথাতেই ঋণের বোঝা দিগুণ হয়ে গেল, প্রতিমাসে এতো মোটা অংকের সুদ দিতে গিয়ে আব্বা হিমসিম খেতে শুরু করলেন, একপর্যায়ে ঋণের বোঝা ভারী হয়ে এলে নির্দয় লোকটা সুযোগ বুঝে এক সাথে সব টাকা দাবি করে বসে, না দিতে পারলে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে সেই হুমকি ও ঢুকিয়ে দিয়ে যান আব্বাজানের চিন্তিত মস্তিষ্কে।
— ইটস টুয়েন্টি টুয়েন্টি ফোর নীলিমা, এরকম লোক এখনো এক্সিস্ট করে? আমিতো ভাবতেই পারছি না।
কপালে দু’হাত ঠেকিয়ে, দুশ্চিন্তা গ্রস্থ কন্ঠে কথাটা বললো সায়র, সায়রের কথার পাছে নীলিমা বলে,
—- করে, বাংলাদেশে এর থেকেও বহুগুন খারাপ লোক এক্সিস্ট করে সায়র।
— তারপর কি হলো?
নীলিমা নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
— তারপর আর কি, যা হওয়ার তাই হয়েছে, আব্বাজানের কাকুতি মিনতিতে লোকটা আমাকে তুলে নেয়নি ঠিকই, তবে একটু বড় হতেই, পুরো মহল্লায় ঘোষণা করে দিয়েছে সে আমাকে বিয়ে করবে, এমনকি আব্বাকেও হু’মকি দিয়ে রেখেছে, তার সাথে বিয়ে না দিলে আমাকে সমাজে মুখ দেখানোর অবস্থাতেই রাখবে না।
জানেন, সে সময় এমন একটা কু’প্রস্তাবকেও চুপচাপ মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই ছিল না আব্বাজানের হাতে, নয়তো কোনোদিন দেখা যেত সুস্থ মানুষ ভার্সিটি গিয়েছি,আর ফিরে এসেছি লা’শ হয়ে। নিজের মেয়েকে হারানোর ভয়ে আব্বাজান সর্বদা তটস্থ ছিলেন, তাই তিনি লোকটাকে অনুরোধ করেন আমাকে যাতে পড়তে দেওয়া হয়, বিয়ে আমার তার সাথেই হবে। লোকটা আব্বাজানের কথায় রাজি হলেও চারিদিকে ততদিনে জানাজানি হয়ে যায় যে, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।যার দরুন লোকটার ভয়ে বিয়ের প্রস্তাব তো দূরে থাক, আমার চোখে চোখ তুলে পর্যন্ত কেউ তাকাতো না অবধি।
এভাবেই দিন যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে নিজেকে বলির পাঁঠা ভাবতে শুরু করি আমি, কারন আমার ভবিষ্যতে বলে আর কিছু নেই,ঠিক এমন একটা দম বন্ধকর জীবনের মাঝপথে আটকে গিয়ে আমি যখন ছটফট করতে করতে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই ইষ্টিকুটুম রূপে আমার জীবনে পদচারণ ঘটান স্বয়ং আপনি। ততোদিনে মনে মনে আপনার মতোই কাউকে খুজছিলাম আমি সায়র, উপর ওয়ালারা কাছে দিনরাত প্রার্থনা করে বলেছিলাম, যাতে আমার জীবনে এমন কেউ আসে, যে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে দূর বহুদুরে, অনেক অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে সযত্নে নিজের আস্তিনে লুকিয়ে রাখবে সে আমায়। দেখুন সত্যি সত্যিই তাই হলো, আমার প্রার্থনা কবুল হলো। আপনি আমায় বাঁচালেন, আমার জীবনে ইষ্টকুটুম রূপে এসে আমার রক্ষাকবজ হয়ে গেলেন।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো নীলিমা। সায়র দ্রুত হস্তে নীলিমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— কাঁদছো কেন বউ? আমি আছি তো, তোমার ইষ্টিকুটুম। এরপর কোন ভুড়িওয়ালা আমার বউকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় দেখবো আমি, ব্যাটাকে চোখের সামনে পেলে যদি ওর গোঁফ টেনে না ছিঁড়েছি তো আমার নামও সায়র আহমেদ নয়।
সায়রের কথায় ফিক হেসে দিলো নীলিমা, নীলিমা হাসছে দেখে হাতের বাঁধন দৃঢ় করে নীলিমাকে নিজের চওড়া বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে মিশিয়ে নিয়ে ওর ঘাড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে সায়র বললো,
— আজ রাতে আর শুদ্ধ হতে ইচ্ছে করছে না বউ, একদমই করছে না।
চলবে…..