সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-৪+৫

0
16

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্ব_৪
#লেখনীতে_suraiya_rafa।

ভে’ঙে গু’ড়িয়ে যাওয়া আশাহীন হৃদয়ের ছটফটানি আর তীব্র য’ন্ত্রনা নিয়ে,যা হোক কেবলই ঘরের দুয়ারে পা রেখেছিল অরু।ঠিক তখনই অনাকাঙ্ক্ষিত চ’ড়ে’র আ’ঘা’তে নিস্তব্ধ হয়ে আটকে যায় ওর পা দুটো, পাঁচ আঙুলের শক্ত ছাপ লেগে যায় নরম তুলতুলে আদুরে গালে।র’ক্ত জমে ফর্সা গালটা মূহুর্তেই ধারন করে কালচে বেগুনী রঙ।

গালটা বড্ড জ্বা’লা করছে, তবে সেদিকে হুশ নেই অরুর।মাথার মধ্যে কুন্ডলী পাকাঁনো হাজারো চিন্তাদের পাছে ফেলে দিয়ে শুধু একটা প্রশ্নই বারবার উগরে দিচ্ছে ওর মস্তিস্কটা
— কি করেছি আমি??

অরু যে এতোটা ব্যাথা পেয়েছে, নিজ গালে হাত দিয়ে ছলছলে নয়নে এভাবে বোকাদের মতো তাকিয়ে আছে,তার কোনোটাতেই আপাতত ধ্যান নেই অনুর। রা’গের তোপে এখনো শরীরটা রিরি করছে ওর। ইচ্ছে তো করছে অন্য গালে আরও একটা চ”ড় বসিয়ে দিতে।
অনু রা’গে ফোসফাস করছে দেখে, অরু কেঁ’দেই ফেললো, ঠোঁট উল্টে অস্পষ্ট সুরে বললো,
–কি করেছি আমি? এভাবে মা’র’লি কেন? পৃথিবীতে কি মা’র খাওয়ার জন্যই জন্ম হয়েছে আমার?

অনু দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
–আমি ছাড়া আর কে মা’রে তোকে?

অরু বলতে চাইলো, কে আবার?এবাড়ির ছোট কর্তা।দেশে থাকতে তো সকাল সন্ধ্যা গা’য়ে হা’ত তুলতো,।যদিও সে বহু অতীতের কথা সে কারনে অরু সেসব ভাবতে চায়না,তাই মুখ ফুটে বললো,

–অযথা কারন ছাড়া কেন মা’রবি আমাকে?? কই কখনো তো কারন ছাড়া ভালোবাসিস না, সারাক্ষণ ঝা’ড়ির উপর রাখিস, আমিকি তোর সৎ বোন আপা??

অনুর রা’গের অ’ঙ্গারে যেন একটু একটু ঘি ঢালছে এই মেয়ে, ক্রমশ মেজাজ খারাপটা বেড়েই যাচ্ছে, অনু কিরমিরিয়ে বললো,
,– এমদম পাঁকামি করবি না অরু, আচ্ছা তোর কি মায়ের জন্য আদৌ কোনো চিন্তা আছে বলতো আমায়? নেই তাইনা?

–এভাবে কেন বলছিস আপা?

–বলছি কারণ তুই একটা হাঁদারাম, আর আমি কিনা তোর উপর ভরসা করে এতোবড় একটা দায়িত্ব দিয়েছি।

–কি করেছি,প্লিজ খুলে বলবি,
চেঁচিয়ে ওঠে অরু।

অনু এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে ল্যাপটপ টা এনে ওর হাতে তুলে দেয়,
–নিজের চোখেই দেখে নে।

ল্যাপটপের ফ্রন্ট স্ক্রীনে ইমেইলের ইনবক্স ভাসছে সেই সাথে কতগুলো নতুন মেইল সব গুলোই আমেরিকা থেকে এসেছে, যা দেখে অরুর কান্নাভেজা চোখ দুটো খুশিতে চিকচিক করে ওঠে, ও কাঁ’দতে কাঁ’দতে বলে,
–আপা কোম্পানি থেকে মেইল এসেছে, ওরা মাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ইউএসএ নিয়ে যাবে । এটাতো খুশির খবর।

অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে,রাগ মিশ্রিত গলায় বলে,
— হ্যা এটা খুশির খবর কিন্তু এই মেইলটা আরও একমাস আগে এসেছে,ওরা ভিসা টিকিট সব পাঠিয়ে দিয়েছিলো, এই সপ্তাহেই ফ্লাইট।আজ কৌতুহল বসত আমি যদি মেইলের ইনবক্স না চেক করতাম তাহলে এই টিকিট আর ভিসা আমাদের কোনো কাজেই আসতো না, কারন গত একটা বছর ধরে তুই শুধু রোবটের মতো মেইলই পাঠিয়ে গেছিস,কখনো ইনবক্স কিংবা আদারবক্স চেক করেও দেখিস নি। যদি আমি এটা আরও এক সপ্তাহ পরে চেক করতাম তাহলে আমাদের মায়ের চিকিৎসার কি হতো, বল আমাকেএএ??

অনুর রু’ষ্ট চিৎ’কার শুনে কেঁপে ওঠে অরু।
ওর এই মূহুর্তে কিছু বলার নেই। প্রথম প্রথম কয়েকমাস ইনবক্স চেক করেও কোন লাভ হয়নি,তাই ও ধরেই নিয়েছিল এই ইমেইলের কোনরূপ প্রতিক্রিয়া আর আসবে না, অতএব প্রতিদিন ইনবক্স দেখে দেখে আশাতীত হওয়ার কোন মানেই হয়না, এতে ক’ষ্টটা দিগুণ হয়ে হৃদয়ে জেঁকে বসে। কিন্তু সকল চিন্তা ভাবনার উর্ধে গিয়ে এমন কিছু হবে সেটা অরু কল্পনাতেও ভাবেনি। ও আরও একবার সচকিত চোখে ল্যাপটপের মেইলটায় চোখ বোলালো, সকল নিয়ম নীতি হলফ করার শেষে একেবারে নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,
মি. প্রতয় এহসান
সি এফ ও, অফ
জে.কে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি।
অরু নামটা দ্বিতীয় বার আওরায়
–প্রত্যয় এহসান,ইনি কে আপা?
অনু ঠোঁট উল্টে বলে,
–হবে হয়তো কোম্পানির দায়িত্বরত কেউ।

অরু একেএকে সবগুলো টিকেট চেক করলো, তার মধ্যে অরোরা শেখ নামের ওও একটা টিকেট রয়েছে।
অনু পাশে এসে বলে,
–আমি বুঝলাম না অরু তোর জন্যওও টিকিট পাঠানো হয়েছে, তুই অবশ্য না গেলেও হতো।

অরু আশ্চর্য হয়ে পেছনে চাইলো,
–কি বলছিস আপা?? তোরা অতদূর চলে যাবি, আর আমি এই ফাঁকা ক্রীতিক কুঞ্জে একা একা থাকবো?? ভুতেরা আমাকে আস্ত রাখবে বলে তোর মনে হয়??তুই এটা বলতে পারলি?আমি নির্ঘাত তোর সৎ বোন।

–হয়েছে, ড্রামা বন্ধ কর, আমি কেন বলছি সেটা শুধু আমিই জানি।

–কেন বলছিস??

–যতই উন্নত চিকিৎসা হোকনা কেন, মায়ের কাছাকাছি সবসময়ই আমাকে থাকতে হবেরে, তাহলে বিদেশের বাড়ি তোকে আমি কার কাছে রেখে যাবো বল? তারউপর ক্রীতিক ভাইয়া মানুষটা সুবিধার না।

অরু মৃদু হেসে অনুকে আস্বাস দিয়ে বলে, –আমি কি আর ছোট আছিরে আপা? আমি ঠিক সব পরিস্থিতি ম্যানেজ করে নেবো তুই দেখিস, তাছাড়া এতোগুলো বছর পর তিনি নিশ্চয়ই আগের মতো নেই, হতে পারে এতোদিনে বিয়েশাদি করে আমাদের জন্য বিদেশিনী ভাবি রেডি করে রেখেছে।

অনু অরুকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে আলতো চুমু খেয়ে বলে,
–সরি সোনা। জানিস আমার অনেক খুশি লেগেছিল যখন মেইল গুলো দেখছিলাম, কিন্তু রা’গটা তখনই হয়,যখন ভাবলাম এই মেইল একসপ্তাহ পর পেলে আমাদের টিকেট ক্যান্সেল হয়ে যেতো,আমাদের মাকে আরও ভুগতে হতো।

অরু মুখ কালো করে,মাথা নুইয়ে বলে,
–তুই না আপা,আমিই সরি,আমিই তো খামখেয়ালি করে কিছুই চেক করতাম না। আমাকে ক্ষমা করে দে প্লিজ।

–হ্যা দেবো, তবে একটা শর্ত আছে।

–কি শর্ত?
–এখন এই মূহুর্তে আমার সাথে মার্কেটে যাবি, অনেক প্রয়োজনীয় শপিং করতে হবে, এই সপ্তাহেই ফ্লাইট।

অরু নিজের হাতের বাঁধন শক্ত করে, অনুর গলা জড়িয়ে ধরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলে, –আপা!! আই লাভ শপিং, কতদিন নতুন জিনিসের গন্ধ পাইনা।
তারপর আনমনেই বলে,
–এবার আমি নিখিল ভাইকে ঠিক খুজে বের করবো।
***************************************
আজ রোববার, প্রতিদিনের মতো আজও পরন্ত বিকেলে তীর্যক সূর্য কীরন হানা দিয়েছে খোলা আঙিনার ন্যায় মহলের বিস্তার ছাঁদ জুড়ে। বসন্তের দক্ষিণা বাতাসে পতপত করে উড়ছে রশিতে শুকাতে দেওয়া সারিসারি জামাকাপড়। সেগুলোই নিতে এসেছে অরু। তবে ছাঁদে পা রাখতেই মনটা কেমন উদাসীন হয়ে গেলো ওর।পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে পরলো শ্যাওলা পরা চ্যাপ্টা রেলিংএর উপর। বসার দরুন হাটু অবধি খোলা চুল গুলো ধুলো ময়লা জমা মেঝেতে গিয়ে ঠেকলো। গোধূলী বেলার মেঘ ভেজা বাতাসের তালে তালে হাঁপড়ে একটা চাঁপা নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো ওর বুক চিড়ে।
আজমেরী শেখকে ইতিমধ্যে এমারজেন্সি ফ্লাইটে তুলে দিয়ে এসেছে ওরা দু’বোন,ওদের ফ্লাইট রাতে। আর কয়েক মূহুর্ত মাত্র তারপর এই মহল, বাগান বিলাশে ঘেরা বিশাল বাড়ি, বাড়ির পেছনের সুপারি বাগান, সামনের বিশাল গেইট সব কিছু মানবশূন্য হয়ে পরবে। প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় বান্ধবী, আর সব চেয়ে প্রিয় নিখিল ভাই,সবাইকে ছেড়ে বহুদূরে পারি জমাবে অরু।অচেনা দেশে, সব অচেনা মানুষের ভীরে সাদামাটা বাঙালী অরুর জন্য কি অপেক্ষা করছে কে জানে?
কেবল ভরসা একটাই মায়ের সুস্থতা, আর মন গহীনের অযাচিত এক অদম্য ইচ্ছা,নিখিল ভাইকে খুঁজে বের করা। অরু জানে কাজটা এতোটাও সহজ নয়, তবে ও চেষ্টা করবে।পৃথিবীটা তো গোলকার,তার উপর একই দেশে থাকবে ওরা, ইন্টারনেটের যুগে অতোটাও কষ্টকর হবে না ব্যাপারটা,ভাবতেই বিষন্ন মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো অরুর।

— আমি আসছি নিখিল ভাই। ঠিক খুঁজে বের করে নেবো আপনাকে।

অরুর দিবাস্বপ্নতে টান পরে নিচ থেকে অনুর বাঁজ খাই আওয়াজে,
— কিরে অরু হাওয়া হয়ে গেলি নাকি, নিচে নাম নয়তো আমি ব্যাগ গুছিয়ে এয়ারপোর্ট চললাম।
*************************************
টাইম ফ্লাইস, ইয়েস ইট ইজ……
এই যেমন চব্বিশ ঘন্টা আগেও অরু পুরান ঢাকার নাম করা বাড়ি ক্রীতিক কুঞ্জের ছাঁদের কোনে দাড়িয়ে ঝিরঝির হাওয়া খাচ্ছিলো। আর এখন এই মূহুর্তে মোটা পশমি লেদার জ্যাকেট পরেও হু হু বাতাসে থরথর করে শীতে কাঁপছে।
এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে উঠে কাঁপাকাঁপি একটু কমেছে দু’বোনের তবে লম্বা জার্নিতে বড্ড কাহিল হয়ে গিয়েছে শরীরটা। অনুর চেয়েও অরুর অবস্থা বেগতিক কারণ পুরো ফ্লাইটে কিচ্ছু খেতে পারেনি ও।অরুর যে মা’রা’ত্মক রকমের ফ্লাইট ফো’বিয়া আছে, সেটা এই প্রথমবারই জানলো অনু। ভাগ্যিস কোম্পানি থেকে গাড়ি পাঠিয়ে ওদেরকে পিক করা হয়েছে নয়তো এই অচেনা শহরে অরুকে নিয়ে নির্ঘাত বিপ’দে পরতে হতো অনুর।

অনু অরুকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করলেও, অরুর মনে অন্য কিছু চলছিল, ওও ভাবছে, তিথি আর নিলীমার কথা, সেদিন অযাচিত কিছু কথা মুখ ফুটে বলে দেবার পর আর মুখোমুখি হয়নি ওদের। নিজের আত্মগ্লানিই ওকে আটকে রেখেছিল,যাদের সামনে সবসময় নিজের নির্ভীক ব্যাক্তিত্বটা ধারণ করে এসেছে সবসময় তারাই কিনা ওকে নিচু চোখে দেখবে, ফ্র’ট ভাববে এসব ভাবতেই লজ্জায় চোখ মুখ বুজে আসে অরুর।যার যের ধরে এতো দূর চলে এসেছে তবুও নিজের বান্ধবীদের একটাবার জানায়নি পর্যন্ত বরং অরুর মনে হচ্ছিলো দেশ ছেড়ে চলে গেলেই ভালো হবে,তিথি আর নিলীমার মুখোমুখি হতে হবেনা আর। ও বেঁচে যাবে।
********************************
সানফ্রান্সিসকোর শহুরে পরিবেশ ছাড়িয়ে আরও প্রায় ঘন্টা খানিক গাড়ি চললো। নির্জন হাইওয়ে রাস্তায় মাঝেমধ্যে দু’একটা প্রাইভেট কার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না ওদের, কিছুদূর পর পর রাস্তার কোল ঘেঁষে দু’একটা ওয়ালমার্ট আর ম্যাক ডোনাল্টস এর ক্যাফেটেরিয়া দেখা গেলো।তবে সেগুলো ও জনমানবশূন্য। এছাড়া রাস্তার দু’পাশে যা চোখে পরে তা হলো উঁচু নিচু পাহাড় আর সারিসারি উইল্ডমিল।
তবে চারিদিকের পরিবেশ প্রান জুড়িয়ে দেবার মতোই সুন্দর। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা গুলো পরিষ্কার তকতকে দেখে মনে হচ্ছে আজই পিচ ঢালা হয়েছে এতে। অথচ বাংলাদেশ হলে মানুষের গিজগিজ আর ময়লা আবর্জনায় রাস্তার মুখ খানা পর্যন্ত দেখার উপায় নেই।
যেতে যেতেই অরু বোধ করলো, এদেশের মানুষ যতটা শৌখিন ঠিক ততটাই পরিশ্রমী।

আসলে এখানে অরুর কোন দোষ নেই, প্রথম পরিচিতিতে মানুষের ভালো দিক গুলোই বেশি নজরে আসে।
*************************************
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একটা ছোটমোটো ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে গিয়ে থামলো গাড়িটা, এতোক্ষন সব কিছু ঠিকঠাক লাগলেও হুট করেই নার্ভাস লাগতে শুরু করেছে অরুর, হাত পা গুলো যেন অবস হয়ে এসেছে, সেই সাথে ব’মিব’মি ভাব। মনে হচ্ছে কিছু একটা গলায় আঁটকে আছে। কিছুক্ষন বাড়িটার দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলো ও। ততক্ষণে অনু নেমে ওপাশ থেকে বারবার তাড়া দিচ্ছে।

— কি হলো নাম, তোকে রেখে আমি হসপিটালে যাবো, ইমার্জেন্সী কল এসেছে।

গাড়ির সাউন্ড প্রুভ কাঁচ গলিয়ে সে কথা অরুর কানে গেলোনা, ও আস্তে ধীরে সময় নিয়ে নামলো। বাইরে প্রচন্ত বাতাস আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম।

অরু নামলে, ড্রাইভার মতো লোকটা একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললো,
–দিস ইজ হাউজ পাসওয়ার্ড।

অরু মাথা কাত করে কার্ডটা নিলো।
অনু এগিয়ে এসে অরুকে বললো,
–তারাতারি চল জমে যাবো নইলে।

অরু এখনো নিশ্চুপ, শুধু উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
কিন্তু অনুর আর বাড়ির ভেতরে ঢোকা হলো না, তার আগেই ওর ফোনটা বেজে ওঠে, ফোন রিসিভ করে অনু কি কি বললো সেসব কিছুই কানে যায়নি অরুর।
তবে তার পরপরই ওর শরীর জমে হীম হয়ে গিয়েছে। বাইরের খারাপ ওয়েদার এই শীতলতার কাছে কিছুই নয়। কারন এবার ওর শরীর নয় বরং ক’লিজা জমে এসেছে। একটু আগে ফোনে কথা শেষ করে, অনু এসে জানায়,

— আমাকে এক্ষুনি হসপিটালে যেতে হবে অরু, অনেক ফর্মালিটিস বাকি,আর সব কাগজ পত্র আমার ব্যাগে, এগুলো না পূরন করলে ওরা মাকে ভর্তি করাতে পারবে না,মায়ের শরীর আরও খা’রাপ হয়ে যাবে। তুই পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম কর, আমি যত তারাতাড়ি সম্ভব চলে আসবো।

অরু চমকায়, হকচকিয়ে বলে,
— নানা আমি একা একা ভেতরে যেতে পারবো না, যদি কেউ থাকে, তার চেয়ে বরং আমি তোর সাথে যাবো।

— পাগলামি করিস না অরু,বাইরের অবস্থা দেখেছিস?? আমি সিওর রাত হলে ঝ’ড় আসবে, তাছাড়া তুইনা বলেছিস,আমার কথা শুনবি।
অরু ঠোঁট উল্টে কাঁদও কাঁদও হয়ে বলে,
— আমার ভ’য় করছে আপা, যদি ভেতরে কেউ থাকে??
— আমি যতদূর জানি কেউ বাড়িতে নেই, নয়তো ড্রাইভার পাসওয়ার্ড দিতোনা, আর যদি থেকেও থাকে তুই নিজের পরিচয় দিবি,কোনো বোকামি করিস না, কেমন??

অরু ঘার কাত করে সায় জানালো।

— অনু পুনরায় গাড়িতে উঠে পরে, যেতে যেতে বলে সাবধানে থাকবি, প্রয়োজন হলে ফোন করবি।
— কিভাবে ফোন করবো আমার কাছেতো সীম কার্ডই নেই। মাথা নিচু করে বিরবিরিয়ে কথাটা বললো অরু।

অচেনা দেশ,অচেনা শহর, অচেনা একটা বাড়ি,এখন আপাও চলে গেলো, এর চেয়ে অসহায় বোধ হয় এই আঠারো বছরের জীবনে আর কোনোদিন লাগেনি অরুর।
চারিদিকের অবস্থা বেগতিক, আকাশটা কালও মেঘে ঢেকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে, এখানে আর দাড়িয়ে থাকার উপায় নেই, তাইতো দুরুদুরু বুকে ফ্রেন্স গেটটা খুলে ফ্রন্ট ইয়ার্ড থেকে পা টিপে টিপে সদরদরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অরু, তারপর কার্ডে টুকে দেওয়া পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজা খোলে ও। আশ্চর্য হলেও সত্যি পাসওয়ার্ডটা ছিল খুবই কঠিন। কে এতো বুদ্ধি খাঁটিয়ে কৌশলী পাসওয়ার্ড সেট করেছে সেটাই আপাতত ভাবছে অরু। তবে ওর ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা তার আগেই সদর দরজা খুলে গেলো।

ভেতরে প্রবেশ করে চারিদিকে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো অরু,কেউ নেই বাড়িতে। লোকালয় ছাড়িয়ে অনেকটা নির্জন পরিবেশে ছোট্ট একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। নিচ তলার পুরোটা জুড়ে বিশাল হল রুম, তার একপাশে আধুনিক ধাঁচের কিচেন কাউন্টার, কাউন্টারের সামনে সেট করা দুটো বারস্টুল কিচেন আর হলের মাঝে কোন দেওয়াল নেই,বরং কিচেন কাউন্টারের সামনেই গোলাকার ডাইনিং। হলে রুমের ঠিক অন্যমাথায় কিছু আধুনিক কারুকাজ করা নড়ম সোফা আর ডিভান। ডিভানের উপর এবরো থেবরো হয়ে পরে আছে একটা কুমড়ো সাইজের কালো রঙের হেলমেট।তারসামনে বিশাল মনিটর।
–টিভি হবে হয়তো, কিন্তু এতো বড় টিভি কে দেখে ভাই? ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো অরুর।

সামনের দিকে ভালো করে পর্বেক্ষন করে পেছনে চাইলো ও, দেখলো দক্ষিণ দিকের দেওয়ালটা পুরোটাই কাঁচের।
অরু ঠোঁট উল্টে মিনমিনিয়ে বললো,
— বোরিং, প্রয়োজনের বাইরে কোনো জিনিসই নেই, এতো সুন্দর বাড়িটা আমার হলে আমি মন ভরে সাজাতাম।

আপাতত আর কিছুই দেখার ইচ্ছে নেই ওর, শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। বাড়িতে কেউ নেই ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই কাঁচুমাচু ভাবটা কমে গিয়ে ঝরঝরয়ি দিগুণ ক্লান্তি নেমে এসেছে শরীর জুড়ে, কাঁচের চকচকে সিরি বেয়ে উপরে উঠে কোনমতে ভারি জামাকাপড় পাল্টে, প্লাজো আর টিশার্ট গায়ে চড়িয়ে, শরীরটাকে ছেড়ে দিলো নরম বিছানা আর কম্ফোর্টারের ভাজে।
*************************************
অরু, এই অরু, অরুউউউ
সুন্দর ভেলভেটের ন্যায় নড়ম বিছানার মধ্যে থেকেই নরেচরে উঠলো ঘুম কাতুরে অরু।

–অরুউউ,
অনেক দুর থেকে আপার আওয়াজ ভেসে আসছে, মনে হয় সকাল হয়েছে তাইতো প্রতিদিনের মতোই এতো ডাকাডাকি।
কিন্তু আজ ঘুমটা বড্ড ভারী লাগছে, চোখ খোলাই যাচ্ছে না, এতো নরম কেন লাগছে বিছানাটা।মনে হচ্ছে শরীরটা টানছে নিজের দিকে।
অনু আবারও ডাকে শব্দ করে,
–অরু ওওওঠ!!
ঘুমের মাঝেই অরু বলে ওঠে,
–ঘুমাতে দে না আপা, এই বিছানাটা অনেক নরম আর এই কুশনের এর গন্ধটা চন্দন কাঠের মতো, এই বলে কুশনে নাক ডুবিয়ে আবারও লম্বা শ্বাস টানে অরু।

এদিকে অরুর কান্ডে অনুর লজ্জায় জা’ন যায় যায় অবস্থা। ও চোখ খিচে অস্পষ্ট সুরে বলে,
–অরুউউ ওঠ, এটা তোর রুম নয়, আর না তুই বাংলাদেশে আছিস।আমরা আজ সন্ধায়ই আমেরিকা এসেছি ভুলে গেছিস, আর এই মূহুর্তে তুই অন্য কারও রুমে ঘুমিয়ে আছিস।

অনুর শেষ কথাটা একেবারে ছক্কা লাগার মতোই অরুর মস্তিস্কে গিয়ে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে ধরফরিয়ে উঠে বসলো অরু, মুখের কোনে জমে যাওয়া লালাটুকু মুছে শুষ্ক ঢোক গিলে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
–কি বলিস আপা কার রুমে আমি?

অনু আড় চোখে দরজার দিকে দেখালো, অরু ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকেই চাইলো,দেখলো ফুল স্লিভ সাদা টিশার্ট আর আর ব্ল্যাক ট্রাউজার পরিহিত লম্বা মতো লোক, অরু এক পলকেই এই সুদর্শন পরিচিত মুখটা ধরতে পেরেছে, এটা অন্য কেউ নয় সয়ং জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।
অরুর মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে, কি করেছে ও এটা? কার বিছানায় এতোক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছে??
এই মূহুর্তে দরজার বাইরে থেকে ওর দিকেই অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটা, নিস্প্রভ,শীতল চাউনি, কিন্তু বরফ কেঁ’টে ফেলার মতোই ধা’রালো তার তীক্ষ্ণতা চোখ দুটোতে। কি আছে ওই চোখে? রাগ, বিরক্তি, কৌতূহল নাকি অন্য কিছু?? ধরতে পারলো না অরু, পাছে শুধু আস্তে করে ভয়ার্ত ঢোক গিললো।

— তারাতারি চল আমাদের রুম অন্য পাশে, অনু তাড়া দিতেই অরু তরিঘরি করে উঠে অনুর পেছন পেছন চলে যায়, যাওয়ার সময় খুব সতর্কে আরও একবার পেছনে তাকায় ও,
পেছনে তাকাতেই, হুটকরে চোখাচোখি হয়ে যায় ওই রহস্যে ঘেরা চোখ দুটোর সাথে। সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়টা কেঁপে ওঠে ওর, করিডোরের মাঝ বরাবর পকেটে হাত গুঁজে দাড়িয়ে এখনো একই ভাবে তাকিয়ে আছে ক্রীতিক।

অরু আর তাকানোর সাহস পেলোনা, দাঁত দিয়ে নখ কা’ম’ড়াতে কা’ম’ড়াতে দ্রুত অন্য রুমে ঢুকে পরলো ও।
ওরা চলে গেলে ক্রীতিক ও নিজের রুমে পা বাড়ায়, রুমে ঢুকতেই ফ্লোরে পরে থাকা মেয়েদের কাপড় চোপড়ে পা আটকে যায় ওর। সেগুলো একপ্রকার ইগনোর করেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ও, কুশনটা এখনো অরুর লালায় ভিজে আছে, তারঠিক পাশে সুতোর মতো আঁটকে আছে একটা লম্বা চুল।
ক্রীতিক চুলটা হাতে তুলে ধরে, সাভাবিকের চেয়েও বেশ লম্বা চুলটা।
খানিকক্ষণ ওটাকে উল্টে পাল্টে নিয়ে ভ্রুকুটি করে ক্রীতিক বলে,
–এতো বড় কবে হয়ে গেলো??
চলবে……

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি
#পর্ব_৫
#লেখনীতে_suraiya_rafa
প্রাপ্ত মনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য।

নবদিগন্তের সূচনা হয়েছে ধরনীতে। তবে আজকের সূচনাটা বেশ অন্যরকম, পাখির কিঁচিরমিচির, ভোরের নরম রোদ, কাঁচের জানালার ফাঁক গলিয়ে সূর্যের ম্যাজিক্যাল আলোছায়া, কিংবা অনুর গলা ছেড়ে বাঁজখাই চিৎকার সব কিছুই অনুপস্থিত আজ।
ফোনে সকাল নয়টার এলার্ম বেজে যাচ্ছে অনর্গল। অরু চোখ মেলে সটান হয়ে শুয়ে শুভ্র সিলিংএর পানে চেয়ে আছে, আজ আর এলার্ম ওর ঘুম ভাঙাতে পারেনি।ওরা পৃথিবীর উল্টো দিকে আছে সে হিসেবে বাংলাদেশে এখন সন্ধারাত। রাত দিনের এই তারতম্যের কারনেই সারারাত এপাশ ওপাশ করে নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছে অরু। তারউপর রাতের ওই ঘটনা, কথা নেই বার্তা নেই একেবারে সিং’হের গু’হায় গিয়ে হাজিরা দিয়ে এসেছে। কি সাংঘা’তিক, ভাবলে এখনো পিলে চমকে ওঠে অরুর।
.
সকাল নয়টা বেজে পয়ত্রিশ। অনু একটু আগেই রেডি হয়ে বেরিয়ে গিয়েছে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। বলেছে কি একটা জরুরি কাজ আছে তাই সকাল সকাল যাচ্ছে। বয়সের তুলনায় অনুর মধ্যে ম্যাচিউরিটি ভাবটা অনেক বেশি, দায়িত্ব জ্ঞানের দিক দিয়ে সবসময় সচেতন সে। আসলে বাস্তবতা যার দরজায় বেশি হা’না দেয়, সেই ততবেশি ম্যাচিউর হয়,এখানে বয়সের কোন হাত নেই।
অরু তখনও শুয়েই ছিল,উদাসীন হয়ে কি জানি কি ভাবছিল।তখনই নিচ থেকে এক অপরিচিত কন্ঠস্বর কানে ভেসে এলো ওর। গলার আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে পুরুষ মানুষ।লোকটা নিচ থেকেই হাক পেরে পেরে ডেকে চলেছে তখন থেকে।
— জেকে, জেকেএএ, আমি জানি তুই রুমে আছিস নিচে নাম এক্ষুনি, নইলে কিন্তু আমিই উপরে চলে আসবো।ইম্পর্টেন্ট কথা আছে ইয়ার!!
লোকটা আবারও ডাকতে যাবে,তখনই উপর থেকে ভেসে আসা মেয়েলী রিনরিনে কন্ঠস্বর সুনে,হকচকিয়ে গেলো সে।
–এই বাসায় মেয়ে কোত্থেকে এলো? ভুল এড্রেসে আসিনিতো?

অরু রুম থেকে বেরিয়ে দোতলার করিডোরে দাড়িয়ে মালকিনের মতো করে গলায় আত্নবিশ্বাস জমিয়ে বললো,
–এখানে জেকে বলে কেউ থাকেনা ভুল বাসায় নক করেছেন।আ….
অরুর কথা মাঝ পথেই আটকে গেলো,কারন ততক্ষণে পাশের রুম থেকে ক্রীতিক ওও বেরিয়ে এসেছে,লম্বায় অরুর চেয়ে দিগুণ ক্রীতিক, ওর মুখভঙ্গিমা দেখতে হলে অরুকে মাথা উঁচিয়ে চাইতে হয়, এই মূহুর্তে অরু সেভাবেই তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের মুখের দিকে, অনুভূতিহীন টকটকে ফর্সা মুখ, ফর্সা মুখশ্রী জুড়ে দু’দিন ক্লীন সেভ না করা খর দাড়িগুলো মাথা চাড়া দিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে আছে বলে তীক্ষ্ণ চোয়ালটা ব্লে’ডের মতোই ধা’রালো মনে হচ্ছে, লম্বা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে কপাল ছুয়ে আছে আর পেছন দিক থেকে ঘার, সেই সাথে এটে আছে গোলাকার দুটো ভাসা ভাসা চোখ। প্রথম দর্শনে একত্রিশ বছরের ক্রীতিক কে অরুর চোখে গ্রীক গডের মতোই সুদর্শন ঠেকলো।

–গো ব্যাক টু ইউর রুম।

পাশ থেকে আসা,একটা গমগমে আওয়াজে অরুর ধ্যান ভেঙে গেলো।বেকুবের মতো পাশে তাকিয়ে উল্টে আবার প্রশ্ন করলো,
–অ্যা??

ব্যাপারটা এমন যে, আমাকে বলছেন? কারন ক্রীতিকের দৃষ্টি এখনো একই ভাবে সামনের দিকেই স্থীর।
— গো ব্যাক টু ইউর রুম।

শাস্ত, নিস্প্রভ কন্ঠস্বর, তবে কথার মাঝেই আটকে আছে কঠোর আদেশ।

ক্রীতিকের এক্সপ্রেশন, বাচনভঙ্গিমা,কিছুই মাথায় ঢুকলো না অরুর, ও উল্টে বাঁচালের মতো বলতে শুরু করলো,
— আরে আমি কেন রুমে যাবো? দেখতে পাচ্ছেন না , কথা নেই বার্তা নেই অন্যের বাসায় ঢুকে লোকটা জেকে জেকে বলে চেচাচ্ছে, ওটাকে আগে বিদায় করতে হবে।

— রুমে যেতে বলেছি তোকে।
এবার কাঠকাঠ স্পষ্ট বাংলায় অরুর মুখের দিকে তাকিয়েই কথাটা বললো ক্রীতিক।

অরু ভয়ার্ত ঢোক গিললো, এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো ওও আট বছর আগের ক্রীতিকের সামনে দাড়িয়ে আছে। তারপরেই ওর ডানপিটে মস্তিস্কটা সচকিত হয়ে উঠলো ওর, মনেমনে ভাবলো,
–উনি যা বলবে সেটাই আমাকে শুনতে হবে নাকি আশ্চর্য, আমিকি এখনো ছোট আছি যে ওনাকে ভ’য় পাবো হুহ।
মনেমনেই নিজেকে মিস.সাহসী অফ দা ইয়ার এওয়ার্ডটা ছুড়ে মা’রলো অরু।

— কি হলো কথা কানে যায়নি??

— যাবোনা। এ যেন অরুর স্বঘোষিত স্নায়ু যু’দ্ধ।
ক্রীতিক নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে মেজাজ সংবরণ করলো, তারপর রুষ্ট কন্ঠে বললো,
— মুখে মুখে ত’র্ক আমার একদম পছন্দ নয় অরু।

“অরু”. ক্রীতিকের ঘুমঘুম হাস্কি গলায় নিজের ছোট্ট নামটা শুনে আরও একবার বক্ষপিঞ্জরে কিছু একটা শক্ত টান অনুভব করলো অরু।কেন যেন মনে হলো অরু নামটাও অনেক ভারী আর কঠিন। পৃথিবীর ইতিহাসে এই নামের অস্তিত্ব কোন কালেই ছিলোনা,পৃথিবীর সব থেকে আনকমন নাম এটা।
কিন্তু সেসবে মাথা ঘামিয়ে দমলো না অরুর আত্নঅ’হংকা’রী মন, বরং নতুন উদ্যমে ক্রীতিকের কথার কাঠকাঠ জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিলো সে। যাকে বলে এক বলেই ছক্কা হাঁকানো।
ঠিক তখনই আগমন ঘটে নিচতলার তৃতীয় ব্যাক্তির।
— কিরে, দেখছিস তখন থেকে ডাকছি তবুও পকেটে হাত গুজে খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছিস? আমাকে কি তোর মানুষ মনে হয়না?

লোকটা এগিয়ে আসতেই ক্রীতিক অরুর সামনে এসে ওকে আড়াল করে দাড়ায়। চম্বা চওড়া,গ্রীক গড সেইপ ওয়ালা বডির অধিকারী ক্রীতিকের পেছন থেকে রোগা অরুকে তো দুরে থাক ওর ছায়াটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
অতঃপর ক্রীতিক বলে,
— কি চাই??

— চাই মানে??আমেরিকান সুপার মডেল সায়র আহমেদ কি তোর ভিক্ষারী মনে হয়??

— না, তবে ছ্যাঁচরা মনে হচ্ছে।

— কিহ!

–তোরা সবকটা মিলে আবারও আমার হাউজ পাসওয়ার্ড হ্যা’ক করেছিস তাইনা।

সায়র মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বললো,
— এছাড়া উপায় কি?? নক করলে তো জীবনেও দরজা খুলিস না,ফোন ধরিস না, এসএমএস সিন করিস না, হুটহাট উধাও হয়ে যাস। কোন দিন দেখবো একা একা এই ভু’তুরে বাড়িতে ম’রে পরে আছিস।আমার সন্দেহ হচ্ছে জেকে তুই আসলেই মানুষ তো? নাকি ভ্যা’ম্পায়ার টাইপ কিছু? সত্যি করে বল?

— তোর ইচ্ছা, যা খুশি একটা ভেবে নে।

সায়র বিরক্তিতে চোখমুখ খিঁচে একনাগারে অভিযোগের লিস্ট উগরে দিচ্ছে।
এদিকে ক্রীতিকের পেছনে এখনো ঠায় দাড়িয়ে আছে অরু, দৌড়ে রুমে চলে যাওয়ার উপায় নেই, কারন ক্রীতিক ওর কব্জিটা শ’ক্ত করে চে’পে ধরে রেখেছে, মুখ দিয়ে কিছু বলবে,তার সুযোগ হচ্ছে না, কারন সায়রের মুখ ননস্টপ চলছে।
একটানা, একনাগাড়ে টানা দশমিনিট ধরে ননস্টপ কথা বলে তবেই ক্ষান্ত হলো সায়র।

দশ মিনিট? হ্যা দশ মিনিটই হবে, ক্রীতিক তো চুপচাপ ঘরির দিকেই তাকিয়ে ছিল।
পেছন থেকে অরু নিজের হাত ছাড়ানোর কসরত করে যাচ্ছে। কিন্তু ক্রীতিকের শ’ক্ত বাধনের কাছে সেই চেষ্টা পিপীলিকার সমতূল্য।

ওর পেছনে একটা ছায়া নড়াচড়া করছে দেখতে পেয়েই সায়র উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
— তোর পেছনে ওটা কি জেকে?? তোর ছায়া এতো ছোট হয়ে গেলো কি করে, আর এমন নরছেই বা কেন?তোকে সত্যি সত্যি ভু’তে ধরলো নাকি?
দাড়া সবাইকে কল করে এক্ষুনি আসতে বলছি।

সায়র একটা মানুষ’ ক ‘বললে কলিকাতা বুঝে ফেলে। দেখা গেলো সত্যি সত্যি তিল থেকে তাল বানিয়ে ক্রীতিক কে প্র’টেস্ট বাই ঘোস্ট বানিয়ে ছাড়বে। তারপর শুরু হবে ওকে নিয়ে বেহুদা গবেষণা।
তাই সকল রহস্যের ইতি টেনে নিজের চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে অরুর হাতটা ছেড়ে দিলো, ক্রীতিক।

সায়র সচকিত নজরে ওর পেছনে চাইলো, দেখলো স্কার্ট আর টিশার্ট পরা গোলগাল গড়নের পিচ্চি একটা মেয়ে,বিশাল লম্বা লম্বা সিল্কি চুলগুলো দুই পাশে ঝুটি করে বুকের সামনে ফেলে রেখেছে, একে কি বলা যায় কেশবতী? নাকি এলোকেশী?
সে যাই হোক মেয়েটার চেয়ারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট, ফর্সা আদুরে মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে, কপালেও বিরক্তির ভাজ।
লাল লাল গাল দুটো দেখেই মনে হচ্ছে একটু টেনে দেই, সেই আশাতেই হাত বাড়িয়েছিল সায়র, পিচ্চিটার গাল টেনে দেবে বলে।

কিন্তু সে আশাতে একবালতি জল ঢেলে অরুকে একপ্রকার ধা’ক্কা মে’রে রুমের ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে ঠা’স করে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো ক্রীতিক। সায়র উদ্বেগ প্রকাশ করে বললো,
— এভাবে কেন ধা’ক্কা মা’রলি মেয়েটাকে? ওর নিশ্চয়ই লেগেছে, দেখেই মনে হচ্ছে তুলোর মতো শরীর।

ক্রীতিক দাঁত চেপে, ঘারের রগ ফুলিয়ে বলে,
–লাগুক, লাগার জন্যেই মে’রেছি। আর ওর শরীর তুলোর মতো নাকি লোহার মতো সেই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।

— এভাবে বলছিস কেন, পিচ্চি মানুষ তাই বলেছি। বাই দা ওয়ে কে ও??

— নো ওয়ান।
এই বলে সিরি ডিঙিয়ে ধাপধাপ করে নিচে নেমে যায় ক্রীতিক।
সায়র ক্রীতিকের পেছন পেছন নামতে নামতে বলে, –
–বাই এনি চান্স তুই কি এই পিচ্চি মেয়েটার সাথে কিছু…… কথা শেষ করতে পারলো না সায়র তার আগেই ওর মুখ বরাবর একটা কুশন ছু’ড়ে মা’রে ক্রীতিক,
–মুখে লাগাম টান। তুই জানিস, আই ফা’কিং হে’ইট ওয়েম্যানস।
— তাহলে মেয়েটা কে?দেখে তো মনে হচ্ছে বাঙালি।
ক্রীতিক আরামছে ডিভানে বসে পরলো, তারপর টি টেবিলে দু’পা তুলে দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে মনিটরে ভিডিও গেইম শুরু করতে করতে বললো,
— বললাম তো নো ওয়ান, ট্রিট হার লাইক এ সার্ভেন্ট।
সায়র বুঝলো ক্রীতিক মেয়েটার ব্যাপারে কথা বলতে চাইছে না।

ওদিকে মি.জায়ান ক্রীতিকের বলা প্রত্যেকটা কথা স্পষ্ট ভাবে কানে পৌঁছালো অরুর। ঢোক গেলার মতো করেই প্রত্যেকটা অ’পমানজনক কথ গিলে নিলো অরু।মায়ের জন্য আপা কতকিছু করছে আর ও এতোটুকু সহ্য করতে পারবে না, তা কি করে হয়??
একটু আগে লাগা ধা’ক্কাটা বেশ জোরেই ছিলো, অসমান দেওয়ালে লেগে কনুইয়ের কাছটা ছিঁ’ড়ে গিয়ে র’ক্ত বের হচ্ছে। র’ক্ত বের হয়ে টিশার্টের হাতাটাও চ্যাটচ্যাটে হয়ে গিয়েছে।
ক্রীতিকের কথা গায়ে না মেখে, পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওয়াশরুমের ট্যাপ ছেড়ে র’ক্তা’ক্ত যায়গাটা ধুয়ে নিলো অরু।
তারপর সামান্য এনটিসেফটিক আর অন-টাইম ব্যা’ন্ডেজ ওও লাগিয়ে নিলো।
অরু বুঝে গিয়েছে এখন থেকে ঠিক এভাবেই নিজের ক্ষ’ত নিজেকেই সারাতে হবে ওকে। যা হয়ে যাক আপাকে কিচ্ছুটি বলা যাবে না।
************************************
সায়র কাউচে শুয়ে ফোন টিপছে, আর ক্রীতিক মনিটরে বাইক রাইড খেলছে,হঠাৎ করে কি মনে করে শোয়া থেকে উঠে বসে সায়র,চিন্তা গ্রস্থদের মতো কপালে ভাজ রেখে বলে,
— এলিসার বাবা জে’ল থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে।
ক্রীতিকের দৃষ্টি মনিটরেই আটকে আছে এখনো, ও চুইঙ্গাম চিবুতে চিবুতে বললো,
–আই নো।
–এবার নিশ্চয়ই খারাপ কিছু হবে এলিসার সাথে।
— তুই আছিস কি করতে??
সায়র দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
—এবার আরও বেশি সতর্ক থাকতে, এবার শুধুমাত্র এলিসা নয়, আমরা চারজনই টার্গেট।

ক্রীতিক খেলাটা পজ করে, দোতলায় অরুর ঘরটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো, তারপর বিরবির করে বললো,
–ইফ হি ডেয়ার টু টাচ, আই সয়ার আই উ’ইল কি’ল হী’ম।
সায়র তাজ্জব বনে গিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো
— কি বলছিস বিরবিরিয়ে কাকে মা’র’বি তুই??

ক্রীতিক ওর ভ’য়ানক শীতল চাউনি নিক্ষেপ করলো সায়রের দিকে, বাঁজপাখির নজরের মতোই তীক্ষ্ণ সে চাউনি। ওর চোখ জোড়াই যেন একটা জীবন্ত থ্রে”ড, ঠোঁটের কোনে ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে খুব আস্তে আস্তে জবাব দিল ক্রীতিক
— এলিসার বাবাকে।
**************************************
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে, এখনো ফেরেনি অনু, অবশ্য ফেরার কথাও না, বলেই গিয়েছে ফিরতে সন্ধ্যা হবে, হঠাৎ করে বিদেশের মাটিতে পা রেখেই ওর আপার এতো ব্যাস্ততা ধরতে পারলো না অরু। এদিকে সারাদিন না খেয়ে থেকে শরীরটা কাহিল হয়ে গিয়েছে ওর। নিচে গিয়ে কিছু একটা খেতে হবে নয়তো, না খেয়ে প্রেশার ফল করে অ’সুস্থ হয়ে গেলে বিদেশের মাটিতে কে দেখবে ওকে?
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। অরু দরজাটা সাবধানে একটু ঢিলে করে উঁকি দিলো বাইরে।
তৎক্ষনাৎ নিচ থেকে সকালের পুরুষালী কন্ঠটা আবারও ভেসে এলো কানে,
— এই যে এলোকেশী, খেতে এসো।

অরু দু’পা সামনে বাড়িয়ে করিডোর দিয়ে নিচে চাইলো,দেখলো, এপ্রোন পরে হাতে ফ্রাইং প্যান নিয়ে ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে সায়র।
ফর্সা মুখশ্রীতে সেই সাবলীল হাসি বেশ ভালোই মানিয়েছে। ঠিক তার অন্য পাসে ডাইনিং এ বসে চুপচাপ কাঁটাচামচ দিয়ে কিছু খাচ্ছে ক্রীতিক, ওর ভাবভঙ্গি এমন যেন ওর আশেপাশে কোনো মানুষই নেই, সব গরু ছাগল।

অরু এবার নিচে নেমে এলো। সায়র নিজের সাবলীল হাসিটা মুখে ঝুলিয়ে রেখেই ওর দিকে খাবারের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
—বসে পড়ো।
অরু প্লেটের দিকে উঁকি দিতেই ওর চোখমুখ বিরক্তিতে কুঁচকে এলো, দুপুরের খাবারে এসব ঘাসপাতা কে খায়??সাথে একটুকরো মাংস ভাজা,স্টেক হবে হয়তো আর একটু খানি ম্যাসট পটেটো।
— ব্যাস এটুকুই লাঞ্চ??
গোলগোল অসহায় চোখ করে ওদের দুজনার দিকে তাকালো অরু।

সায়র একবার অরুর দিকে আরেকবার ক্রীতিকের দিকে তাকাচ্ছে।

ক্রীতিক খেতে খেতে বললো,
—দেখতে তো এইটুকুনি, এতো খাবার রাখিস কোথায়???
খুব রাগ হলো অরুর,আমেরিকা এসেছে বলে এইসব ঘাসপাতা খেয়ে বাঁচতে হবে??
তাছাড়া ভাত নেই, ডাল নেই, তরকারি নেই এটা কেমন দুপুরের খাবার। ছ্যাহ। মনেমনে আমেরিকান গ্রীন কার্ডধারী বাঙালিদের হাজারটা তি’রস্কা’র জানালো অরু।দেশে থাকেনা বলে দেশের ঐতিহ্যটাও ম্যাস পটেটোর সাথেই ভর্তা বানিয়ে খেয়ে ফেলেছে এরা।
তারপর আলগোছে নিজের লম্বা চুলগুলো হাত খোঁপা করে,ওরনাটা কোমরে পেঁচিয়ে এগিয়ে গেলো রান্না ঘরের দিকে। কেবিনেট আর ফ্রীজ হাতরে, হাতের কাছে, চাল ডাল যা পেলো, সব কিছু একসাথে মাখিয়ে চুলায় বসিয়ে দিলো, কয়েক মিনিটের মধ্যেই খিচুরীর মো মো গন্ধে সুবাসিত হয়ে উঠলো চারদিক।
সায়র নিজের প্লেট সরিয়ে রেখে, রান্না ঘরের দিকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে।
ওর কান্ডে ক্রীতিক ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— কি হলো খাচ্ছিস না কেন?? খেয়ে বিদায় হ।

সায়র দাঁত কেলিয়ে বললো,
— খিচুড়ি, কতদিন পর বাঙালি খানা, লোভ সামলাতে পারছিনা।

ক্রীতিক আবারও নিজের খাওয়ায় মন দিলো।
একটু পর এক প্লেট খিচুড়ি এনে সায়রের সামনে রাখলো অরু।
গড়ম খিচুড়ির গন্ধে ক্ষিদেয় পেট গুড়গুড়িয়ে উঠলো ওর।
অরু,বললো,
—খেয়ে বলুন তো কেমন হয়েছে।

গড়ম খিচুড়ি মুখে নিয়েই আবেশে চোখ বুঁজে এলো সায়রের, ওর মুখের এক্সপ্রেশন দেখলেই বোঝা যায় ও খাবারটা ঠিক কতটা পছন্দ করেছে।
খাবার গিলে নিয়ে, তৃপ্তমাখা হাসি দিয়ে সায়র ক্রীতিককে বললো,
— তোর বোন ফাটাফাটি রান্না করে দোস্ত। এরকম রান্না খেতে পারলে আমি যখন তখন তোকে শালা বানিয়ে ফেলবো, ড্যাম শিওর।

নিজের হাত মু’ষ্টিবদ্ধ করে অ’গ্নি দৃষ্টিতে অরুর ক্লান্ত মুখশ্রীটা পরখ করলো ক্রীতিক, তারপর একটা তাছ্যিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—ও আমার বোন নয়, ও আমার বোন হতেই পারেনা।
— মানে??
সায়রের মুখে কৌতুহল স্পষ্ট।
— ও আমার বাপের দ্বিতীয় বউয়ের আগের পক্ষ।
ক্রীতিকের এতো বি’শ্রী অপ’মানজনক সম্মোধনেও একটু ওও টললো না অরু, বরং মৃদু হেসে সায়রের উদ্দেশ্যে বললো,
—জি উনি ঠিকই বলেছেন, আমি ওনার আপন কিংবা সৎ কোন টাইপ বোনই নই। আমার নাম অরোরা শেখ।
ক্রীতিকের কথা সায়র ওও খুব একটা গায়ে মাখলো না,ওও অরুর কথার জবাবে একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে জানায়,
—আমি সায়র আহমেদ, কিন্তু বাংলাদেশি নই ইন্ডিয়ান,আমার হোম টাউন দার্জিলিংএ।

দার্জিলিং নামটা শুনতেই আগ্রহের প্রবনতা বানভাসী হলো অরুর, দার্জিলিং আর কাশ্মীর ওর পছন্দের লিস্টে সবার আগে, জীবনে একবার হলেও যায়গা গুলোতে যেতে চায় অরু, পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা মেঘ,বৃষ্টি, বরফ,ঝড়না, সব কিছু নিজ হাতে ছুয়ে দেখতে চায়।
নিজের মন গহীনে লুকোনো ইচ্ছার খানিকটা পর্দা খুলে যাওয়ার দরুন অরু বললো, —জানেন দার্জিলিং এ ঘুরতে যাওয়া আমার অনেক দিনের সপ্ন।
— তাই কোথায় ঘুরতে চাও দার্জিলিং এ,আর কার সাথে যাবে??
— আ….
অরুর মুখ থেকে কথার বহর বের হতে না হতেই, সশব্দে হাতের কাঁ’টাচামচ টা ছু’রে ফেলে উঠে দাড়িয়ে পরলো ক্রীতিক, কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে অরুর মুখোমুখি দাড়িয়ে বললো,
–আই হে’ইট বাঙালি ফুড,ইভেন এভরিথিং।সো নেক্সট টাইম আমার বাসায় এসব চিপ রান্না, চিপ আলোচনা কোনোটাই করার সাহস করবি না।আই ওয়া’র্ন ইউ।

অরু স’ঙ্কিত হয়ে দু পা পিছিয়ে গেলো,চোখের সামনে কি ঘটছে কেন ঘটছে বুঝে উঠতে একটু টাইম লাগলো, ক্রীতিক বারবার ওকে অপ’মান করছে, ভে’ঙে ফেলতে চাইছে কিন্তু কেন?? বয়সে ওর থেকে অনেক বড় বলে??

তবে,অরুও তো চুপ মে’রে যাবার মেয়ে নয়,
ক্রীতিকের সুক্ষ অ’পমানের জবাবে, অরু পাল্টা তী’র ছু’ড়লো,বললো,
–আমি যতদূর জানি আপনি নিজেও খাঁটি বাঙালি, তার উপর নাম করা রাজনৈতিক বংশের ছেলে।
ব্যাস এতটুকু বলারই ফুসরত পেলো অরু, এরপরই টেবিলে রাখা স্টেক কাঁ’টার সিলভার রঙের ছু’ড়ি’টা ওর গলায় চেঁ’পে ধরে ক্রীতিক।

–হোয়াট’স রং জেকে,কি করছিস এটা?

ক্রীতিকের কান্ডে সায়র হকচকিয়ে উঠে কিছু বলতে যাবে,তার আগেই ওকে হাতের ইশারাতে থামিয়ে দিলো ক্রীতিক, দাঁত দিয়ে দাঁত পি’ষে ফেলে বললো,
—আমাদের মধ্যে কথা বলতে আসিস না সায়র।
ও যেভাবে “আমাদের”কথাটা উচ্চারণ করলো, মনে হচ্ছে স্বামী স্ত্রী তাদের স্টুপিড সাংসারিক ঝ’গড়া করছে,আর ওই তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে আগ বারিয়ে তাদের ঝগড়া থামাতে এসেছে,
কিন্তু ব্যাপারটা তো তেমন নয়, সায়র একদিনেই বুঝে গিয়েছে ক্রীতিক মেয়েটাকে অসম্ভব অপছন্দ করে। তাহলে কে রেখে গেলো মেয়েটাকে এখানে? এই জ’মের হাতে, এখন না হয় সায়র আছে, কিন্তু রাত বিরাতে হুট করে জেকে রেগে গেলে, তখন কি হবে??
সায়র ভাবতে ভাবতে সটান বসে পরলো।

ক্রীতিক এখনো একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে,
ভয়ে নিজের জামা নিজে শ’ক্ত করে চে’পে ধরে রেখেছে অরু। চোখ দুটোপানিতে ছলছল করছে এই গড়িয়ে পরলো বলে।

— মুখে মুখে ত’র্ক আমার একদম পছন্দ নয়,এখন থেকে আমি যা বলবো তুই সেটাই করবি, আমার সামনে মোটেই ফা’কিং তে’জ দেখাতে আসবি না,নয়তো তোর তে’জ গলিয়ে দিতে আমার এক সেকেন্ড ও সময় লাগবে না।মাইন্ড ইট।

ক্ষী’প্ত’তা সুস্পষ্ট ওর দু’চোখে,সেই সাথে মুখের কথা গুলো চ’পেটাঘা’তের মতোই শ’ক্তিশালী।
তবুও কতো নির্বিঘ্নে কথাগুলো বলে,রুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো ক্রীতিক।

ক্রীতিক চলে যেতেই অরুর চোখের জলের বাধ ভে’ঙে যায়, অসহায়ের মতো নিজের চোখের জলকে থামাতে বারবার চোখ মুছছে অরু। অভিমানী কা’ন্নায় নাকের ডগাটা লাল হয়ে গিয়েছে।
সায়র এগিয়ে গিয়ে, নিজের রুমালটা অরুর দিকে এগিয়ে দিলো।
— মুখটা মুছে নাও অরু।

অরু নিলোনা, বরং দৌড়ে হল রুম ছেড়ে দোতলার ছাঁদ বারান্দায় চলে গেলো। বড্ড আত্মসম্মানে লেগেছে ওর। একজন অপরিচিত মানুষের সামনে এতোটা অ’পমানিত এর আগে কখনো হয়নি ওও। ক্রীতিক কেন ওকে দু’চোখে দেখতে পারেনা, কেন ওর উপর সবসময় ক্ষী’প্র হয়ে থাকে তা আজও ধরতে পারেনা অরু।

এদিকে সায়র নিজেও ক্রীতিকের কান্ডে বির’ক্ত। কোন এক অজানা কারনে অ-স্বাভাবিক রা’গ ওর। কখনো কি কারনে রেগে যায় সেটা কেবল ওই যানে, আর একবার রেগে গেলেতো কথায়ই নেই, এমন সব ভ’য়াভহ কাজ করে যেগুলো স্বভাবিক মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়।এতো র’গচটা স্বভাব নিয়ে ক্রীতিক যে কি করে কলেজের প্রফেসর ভেবে পায়না সায়র।

—কিন্তু অরুতো রেগে যাওয়ার মতো কিছুই করেনি।এতো ছোট একটা মেয়ের সাথে , এতো বা’জে ব্যাবহার করার কি মানে আছে, আশ্চর্য।
আনমনেই বলে ওঠে সায়র।
************************************
সন্ধ্যায় ক্রীতিককে বিদায় জানিয়ে চলে যায় সায়র, আজ রবিবার ছিল বলেই এসেছিল, প্রত্যেক সপ্তাহের ছুটির দিনে, এলিসা,সায়র নয়তো অর্নব কেউ না কেউ ক্রীতিকের সাথে দেখা করতে এই জনমানবহীন নিরব স্টেটে আসে। নয়তো মাসের পর মাস গেলেও ক্রীতিকের কোন খোজ মেলেনা,না কোন সোশ্যাল মিডিয়া, না কোন ইন্টারনেট, না কোন ফেস টু ফেস আলাপ।অনেকটা অস্বাভাবিক লাইফস্টাইলই বলা চলে ওর, সাভাবিক মানুষ এভাবে একাএকা থাকলে দ’মব’ন্ধ হয়ে মা’রা যাবে নিশ্চিত। প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে ও শুধু একটা কাজই করে, সেটা বাইক রাইডিং।

ক্রীতিক সায়রকে এগিয়ে দিতে গেইটের কাছে এলে,সায়র গাড়িতে উঠতে উঠতে বললো, —প্লিজ ভাই মেয়েটাকে আ’ঘা’ত করিসনা।বড্ড মিষ্টি মেয়েটা, তুই ওকে রাখতে না চাইলে বলিস,আমি আমার বাসায় নিয়ে পুতুল বানিয়ে সাজিয়ে রাখবো ওকে,তবুও ওকে ট’র্চা’র করিস না।আই রিকোয়েস্ট ইউ।

সায়রের কথায়, জিভ দিয়ে গাল ঠেলে একটা তীর্যক আর রহস্যময় হাসি দিয়ে, ক্রীতিক বলে,
— আর ইউ ফা”কিং কি’ডিং মি? নিজের হা’র্টবিট কে কেউ আ’ঘা’ত করে?

–উমম!কিছু বললি??

— নাথিং, তুই যা, আর দয়াকরে প্রত্যেক উইকেন্ডে তিনজন মিলে আমাকে জ্বা’লানোটা বন্ধ কর।

সায়র নিজের ছাঁদ খোলা বিএমডব্লিউতে নিয়ে উল্টো পথে যেতে যেতে পেছনে না ঘুরেই হাত নাড়িয়ে বললো, সি ইউ ইন নেক্সট উইকেন্ড। বায় বায়।
***********************************
সন্ধার দিকে অনুও ফিরে আসে। রুমে গিয়ে পরনের মোটা কোর্ট খুলে, চারিদিকে খুঁজতে শুরু করে অরুকে।কিন্তু কোথাও অরু নেই।
ও ডাকতে ডাকতে করিডোরের অন্য মাথায় গিয়ে দেখলো অরু চুপচাপ ছাঁদ বাড়ান্দার মেঝেতে বসে আছে। হাত দুটো দিয়ে রেখেছে ঠান্ডা রেলিংএ তার উপর চিবুক।

কাঁচ ঠেলে বারান্দায় পা রাখতেই হুহু বাতাসে হাড় হীম হয়ে এলো অনুর, এই ঠান্ডার মধ্যে অরু কি’করে বারান্দায় বসে আছে বুঝে উঠতে পারলোনা অনু।তটস্থ গতিতে অরুকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসলো ও। অরুর ফর্সা মুখ ঠান্ডায় নীল বর্ণ ধারন করেছে, মুখটা শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে আছে।

— ঠিক আছিস বোন? দুপুরে খেয়েছিস?

অনুর উদ্বিগ্ন প্রশ্নে সচকিত হয়ে উঠলো অরু,শরীরের ক্লান্তি টুকু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, মুখে প্রসস্ত হাসি ঝুলিয়ে বললো,
—খেয়েছি আপা, ভেতরে হাসফাস লাগছিল তাই বাইরে এসে একটু বসলাম, তুই খেয়েছিস, আর মা কেমন আছে? আমি দেখতে যাবো মাকে।
— অনু সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, মা আই সিউ তে আছেরে অরু, এখন গেলেও কাছে যেতে পারবি না, তারচেয়ে বরং কেভিনে শিফট করুক তখন না হয় যাবি।
— তোর কষ্ট হচ্ছে আপা তাইনা?

— নারে, ক্রীতিক ভাইয়া আগেভাগেই কোম্পানিকে সতর্ক করে রেখেছিল, তাই তারাই সব ঝামেলা সামলেছে, আমিতো শুধু মায়ের কাছে কাছে ছিলাম।

দু’বোন আরও অনেক সুখ দুঃখের আলাপ করছিল, তখনই নিচ থেকে কলিংবেল বেজে ওঠে। অনু বলে,
–তুই দাঁড়া আমি গিয়ে দেখছি।
একটু পর কতগুলো প্যাকেট নিয়ে ভেতরে আসে অনু।
অরু, কৌতুহল নিয়ে শুধায়,
—এগুলো কি আপা।
— মনেতো হচ্ছে বিরিয়ানির প্যাকেট।
বিরিয়ানির নাম শুনতেই সারাদিন না খাওয়া অরুর পেট গুড়গুড়িয়ে ওঠে,
— কি বলিস আপা তুই অর্ডার করেছিস??
অনু এদিক ওদিক না বোধক মাথা নারায়।
— তাহলে?
অনু প্যাকেট গুলো টেবিলে রেখে বললো, তুই দাড়া আমি ক্রীতিক ভাইয়াকে একবার জিজ্ঞেস করে আসি।
অনু ক্রীতিকের রুমে নক করে ঢুকলো, দরজাটা খোলাই ছিল। ক্রীতিক ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল তখন।
অনু একটু ইতস্তত হয়ে গলায় বলে,
—ইয়ে মানে ভাইয়া, আপনি কি কোন খাবার অর্ডার করেছিলেন।

ক্রীতিক সজোরে এদিক ওদিক মাথা নাড়ায় যার উত্তর না।

অনু নিরাশ হয়ে যেতে যেতে বললো,
,—তাহলে মনে হয়, ভুল করে।

— ইয়ে অনু।
পিছু ডাকে ক্রীতিক।
অনু ফিরে তাকায়,
— আমার মনে হয় তোরা ফার্স্টটাইম এসেছিস তো তাই কোম্পানি তোদের ওয়েলকাম গিফট হিসেবে খাবার গুলো পাঠিয়েছে।আফটার অল তোরা চেয়ারওয়েম্যানের মেয়ে।
অনু, শুনে খুশি হয়ে গেলো, উপর থেকে অরুকে ডেকে বললো,
— খা অরু এগুলো কোম্পানি থেকে পাঠিয়েছে আমাদের জন্য।
অরুও আর অপেক্ষা করলো না, সারাদিনের অভুক্ত পেটটাকে আসকারা দিতে বসে পরলো পেট পুজো করতে।
খুশি মন নিয়ে অনু চলে যেতেই ক্রীতিক আবারও নিজের কাজে মন দিলো।
চলবে………