সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-৯+১০

0
12

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ০৯
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa

ভোর হতে না হতেই গোল্ডেন গেইট ব্রীজ দিয়ে ছুটছে গাড়ির বহর। কেবল গাড়িই নয় ফরেইনার টুরিস্ট থেকে শুরু করে স্থানীয় পথচারী, সবাই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা চালাচ্ছে আপন গতিতে। সানফ্রান্সিসকোর ছোট্ট শহরতলী ছাড়িয়ে মূল শহরে পা রাখলেই কেবল মনে হয় যান্ত্রিক গাড়ি ছাড়া মানুষ পায়ে হেটেও পথ চলে। এছাড়া যায়গাটা টুরিজম এরিয়া হওয়ায় সর্বক্ষনই লোকে লোকারন্য হয়ে থাকে।

ছাঁদ খোলা মার্সিডিজে বসে দিকভ্রান্তের মতোই এদিক ওদিক তাকিয়ে, মানুষ দেখছে অরু। যেন হাজার বছর পরে এই প্রানীকূলের দেখা পেলো সে। আর এমনটা হবে নাই’বা কেন?গত একমাস ধরে ওই নির্জন, শুনশান বাড়িতে থেকে থেকে বিরক্তি ধরে গিয়েছে ওর। ঘরকুনো হওয়ার দরুন টিকতে পেরেছে বৈকি অন্য কেউ হলে আলবাত পাগল বনে যেত।
তবে অরুও এই মূহুর্তে পা’গলের মতোই উদ্ভট চাহনি ফেলে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। যেন পৃথিবীর মাটিতে আজই ওর প্রথম দিন।
অরুর কাহিনি দেখে ক্রীতিক হুট করে গাড়ির বাটনে প্রেস করে ছাঁদটা তুলে দিলো।
ক্রীতিকের এমন কান্ডে অরু মুখ কালো করে ওর পানে চাইলো।
সুন্দর ফর্সা চেহারার সাথে এটে থাকা তীক্ষ্ণ চোয়ালটা শ’ক্ত হয়ে আছে বরাবরের মতোই, চোখের সৌন্দর্যে সামিল হয়ে আছে কালোরঙা চৌকো রোদচশমাটা। রাস্তার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকা থেকে শুরু করে একহাত দিয়ে ড্রাইভ করা প্রত্যেকটা কাজেই উপচে পরছে নজর কারা আভিজাত্য আর পুরুষত্ব। এই পুরুষের প্রতি যে কেউ এক দেখায় ফিদা হতে বাধ্য, তবে তার আচার আচরণ এমন অ’মানবিক কেন? ভাবছে অরু। কারন এই বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের সাথে ভেতরের মানুষটার যে কোনোরূপ মিলই খুজে পায়না ও।

— আমাকে দেখা বন্ধ কর, আমি ডিসট্রাক্ট হচ্ছি।

তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিজের হাতের দিকে চাইলো অরু। সফেদ রঙা ব্যা’ন্ডেজ হাতে নিয়েই আজ প্রথম দিন ভার্সিটিতে যাচ্ছে ও। আর এই ব্যান্ডেজ করা ক্ষ’তটা অন্য কারও নয় বরং ওর পাশের মানুষটার দ্বারাই তৈরি।

যদিও ক্রীতিক সবসময় গোমড়া মুখেই থাকে তবুও রাতের সেই ভ’য়ানক, কোল্ডহার্ট আর অ’গ্নিদৃষ্টিরত ক্রীতিকের সাথে এখন কার ক্রীতিকের দিন রাত তফাৎ।
আজ প্রথম দিন তাই ক্রীতিকের সাথেই যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে অরু,কারণ ক্রীতিক ওই একই ভার্সিটির প্রফেসর। তবে ক্রীতিক এটাও সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে আজই ফার্স্ট আর আজই লাস্ট এরপর আর ও কখনো অরুকে নিয়ে যেতে পারবে না। তার বদলে অরুর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে একটা ছোট্ট সাইজের প্যাডেল বাইক বা সাইকেল।

সফেদ ব্যা’ন্ডেজটা নখ দিয়ে খুঁটতে খুঁটতেই অরু যখন নানান অযাচিত চিন্তায় বিভোর , ঠিক তখনই আপন সুরে বেজে উঠলো ওর মুঠো ফোনটা। কোন এক কারণে অনেকটা তরিঘরি করেই ফোনটা কানে তুললো অরু,ওপাশের ব্যাক্তিকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই অরু বললো,
— হ্যালো নিলীমা, অবশেষে ফোন করলি তুই, জানিস কাল সারারাত তোকে ফোনে কতবার ট্রাই করেছি, একবারও কল তুলিস নি তুই।

অরু যতটা উচ্ছ্বাস নিয়ে কথাগুলো বললো, নিলীমার কন্ঠস্বর ছিলো ততটাই নির্জীব আর ক্লান্ত ও বললো,
— আমি বুঝতে পারিনি এটা তুই, তাছাড়া কাল সারারাত হসপিটালে ছিলাম ফোন হাতের কাছে ছিলোনা।

অরু জিজ্ঞেস করে,
— কেন কি হয়েছে? তুই ঠিক আছিস??

— হ্যা’রে আমি ঠিকই আছি, কিন্তু তিথি।

তিথি নামটা শোনা মাত্রই অরুর মনে পরে যায় সেদিনের তিথির করা অজস্র অ’পমানের কথা, পাছে এসে ভর করে তিথির প্রতি একরাশ ঘৃ’ণা আর বির’ক্তি। তবুও কথা আগাতে জিভ দিয়ে সামান্য ঠোঁট ভিজিয়ে অরু শুধায়,
— কি হয়েছে?

নিলীমা কাঁ’দো কাঁ’দো গলায় বলে,
—জানিনা অরু, হুট করে আমাদের তিথির মতো চঞ্চল হাসি খুশি মেয়েটার সাথেই এরকমটা কেন হলো।

— কি হয়েছে সেটাতো বল?

— মাত্র একদিনে ওর সাথে অনেক কিছু হয়েছে অরু, কিছু তুচ্ছ কারনে ভার্সিটি তিথির ছাত্রত্ব বাতিল করে দিয়েছে, আর ঠিক সেদিনই হুট করে ওর বাবার এতোবড় পজিশনের জবটাও চলে গিয়েছে, একদিনের ব্যাবধানে ওর ক্যারিয়ার ওর বাবার ক্যারিয়ার সব শেষ হয়ে গিয়েছে, তাহলে ওর মনের অবস্থাটা একটাবার ভাব।আর সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার হলো তিথির বাবা জেকে গ্রুপের মার্কেটিং ডিমার্টমেন্টের কর্মকর্তা ছিলেন, বহু বছরের ক্যারিয়ার হুট করেই শেষ। বলতে বলতে অনেকটা কা’ন্নাই করে দেয় নিলীমা।

— তাহলে হসপিটালে কেন ছিলি?

—- এতো গুলো শকট একসাথে নিতে পারেন নি তিথির আম্মু,এসব ঘটনায় কাল রাতে হুট করেই উনি স্টো’ক করে বসেন ,তাই সেখানেই ছিলাম সারারাত ।

কথাগুলো শুনে অরুরও খারাপ লেগেছে, কিন্তু ওর তো এখানে কিছুই করার নেই, তাই অরু চাঁপা নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল ,
— আন্টি এখন কেমন আছেন?

— হুম, আগের চেয়ে বেটার।এখন বল তোর খবর কি অরু?

নিলীমাকে তৎক্ষনাৎ থামিয়ে দিয়ে অরু বলে,
— আমার কথা পরে বলবো ক্ষন,তার আগে তুই আমাকে বল নিখিল ভাই কোন ভার্সিটিতে এডমিশন হয়েছে নিলীমা?

অরুর মুখ থেকে কথাটা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে আকস্মিক ব্রেক কষলো ক্রীতিক।
হঠাৎ করে এমন হওয়াতে কম্পিত হয়ে উঠলো অরুর বক্ষপিঞ্জর। সামনের দিকে হুমরি খেয়ে পরতে পরতেও যেন বেঁচে গেলো ও। আ’তংকে চোখ দুটো বড়বড় করে ঘুরে তাকালো ক্রীতিকের পানে। তখনও মোবাইল ফোনটা অরুর কানেই ছিল।
তবে খুব বেশিক্ষণ সেটা আর কানে স্থীর রইলো না, অরু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফোনটাকে অরুর কান থেকে ছি’নিয়ে নিয়ে সেটাকে সজোরে মাঝরাস্তায় ছু’ড়ে মা’রে ক্রীতিক। কয়েক মূহুর্তের মধ্যে সুন্দর চকচকে হ্যালো কিটি কাভার দিয়ে মোড়ানো ফোনটা পরিনত হয় ধ্বংসাবশেষ এ।

নিজের শখের ফোনের এমন করুন দশা দেখে আঁত’কে উঠলো অরু, হিং’স্র বা’ঘিনীর ন্যায় দৃষ্টিপাত করলো ক্রীতিকের পানে। তবে মুখ দিয়ে কিছু বলার অবকাশ দিলোনা ক্রীতিক,
বরং তার আগেই গাড়ির দরজা খুলে গ’র্জে উঠে বললো
—গেট আউট।

অরু চমকে উঠে বললো,
— কি বলছেন, এই মাঝ রাস্তায় কোথায় নামবো আমি??
— গেট আউট,
ক্রীতিক একই বাক্য পুনরায় উচ্চারণ করে,একপ্রকার হাত ধরে ঠেলেই মাঝরাস্তায় নামিয়ে দিলো অরুকে। তারপর ওয়ালেট থেকে একটা একশো ডলারের নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—সামনেই বাস স্টপেজ, নেক্সট বাস সোজা ভার্সিটির সামনে গিয়ে থামবে।গো এহেইড।

অরু বেচারি না পারতে টাকা’টা হাতে নিলো।

ক্রীতিক তৎক্ষনাৎ ঠা’স করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
যাওয়ার আগে নিজের শরীরের কালো রঙের কোর্টটা খুলে জানালা দিয়ে ছু’ড়ে মা’রে অরুর মুখের উপর।
কোর্টটাকে উল্টে পাল্টে দেখে ক্রীতিকের গাড়ির দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অরু।
ক্রীতিক যেতে যেতে লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে বলে,
—হাতে নিয়ে সং এর মতো দাড়িয়ে থাকার জন্য দেয়নি, গায়ে পরতে দিয়েছি।

ব্যাস এইটুকুই তারপর শাঁই শাঁই করে হাজারো অচেনা গাড়ির ভিরে হারিয়ে গেলো একমাত্র চেনা মার্সিডিজটা।
অজ্ঞাত অরু ভাবলেশহীন চোখে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ , মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন খেলে গেলো ওর, ক্রীতিক কি আদৌও মানুষের কাতারে পরে?
*****************************************
মনের মাঝে একরাশ হতাশা আর ক’ষ্ট নিয়ে কোন মতে ভার্সিটিতে এসেছে অরু। শীত নিবারক হিসেবে গায়ে জড়িয়ে রেখেছে ক্রীতিকের ব্র্যান্ডেট ব্ল্যাক কোর্ট।
গেইট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে ঢুকতে অরু ভাবছে,
এভাবে ভে’ঙে পরলে চলবে না,যত যাই হোক পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতেই হবে তাকে। তবে সে ভাবনারা বেশিদূর এগোতে পারলোনা। নিজেকে নিজেই মোটিভেশন দিতে দিতে কখন যে হাজারও অচেনা অপরিচিত মুখের ভীরে কাঙ্খিত, পরিচিত,শ্যাম পুরুষের মুখ খানা চোখের সামনে চলে এলো, সে কথা ঠাওর করতে পারলো না অরু। ঠিক আগের মতোই ক্যাম্পাসের প্রসস্থ সিঁড়িতে আসন পেতে কানে হেড ফোন লাগিয়ে বই পড়ছে সে।হঠাৎ করেই কি জানি কি হয়ে গেলো, ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তুলে জোয়ার আসার মতোই বানভাসি হলো মনের নদী,মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এলো খুব পরিচিত সেই চেনা নাম,
— নিখিল ভাই?

চারিদিকে কে আছে কে নেই কিছুই আর চোখে পরলো না অরুর,বরং নিস্পলক হয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো সেই চেনা মুখের মানুষটির দিকে। তবে পুরো পুরি কাছে যাওয়া হলোনা,তার আগেই নিখিলের কাছে পৌঁছে গেলো ভিনদেশী দুজন সুন্দরী আগন্তুক রমনী। কয়েকমূহুর্তের মধ্যেই তাদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন নিখিল। তাই অরুর আর সেদিকে পা বাড়ানোর সাহস হলোনা, বরং দূর থেকেই নিখিলের হাস্যোজ্জল মুখের পানে চেয়ে শুধালো,
— আপনি ভালো আছেন নিখিল ভাই?

অরুর থেকে কয়েক মিটার দূরত্বে দাড়িয়ে এই পুরো ব্যাপারটা দু’হাত মু’ঠিবদ্ধ করে স্ক্যান করে নিলো আরেকজন। তবে সেটা অন্য কেউ নয়,অরুতে ভীষন ভাবে আসক্ত এক ছ’ন্নছাড়া পুরুষ মি.জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।

অরু বাসে আসলেও অরুর পরেই ভার্সিটিতে প্রবেশ করেছে ক্রীতিক,কারণ ও গাড়ি নিয়ে বাসের পেছন পেছনই এসেছে। তারপর ক্যাম্পাসে ঢুকতেই এই কাহিনি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই মূহুর্তে ক্রীতিকের চোখে মুখে কোন গম্ভীরতার লেসমাত্র নেই। বরং ঠোঁটের কোনে আটকে আছে একটা রহস্য জনক কপট বাঁকা হাসি। কপট হাসিটা ধরে রেখেই ক্রীতিক অস্ফুটে বলে,
— আমার বোকা পাখি। সত্যিটা জানলে কতোই না ক’ষ্ট হবে তোর জান।বাট আ’ম ওকে উইথ দ্যাট। কজ তুই শুধু আমার।
*****************************************
অরু আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল কে জানে? প্রথম দিন ভার্সিটিতে আসার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর থেকেই একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে পেছনে। প্রথমে ক্রীতিকের মতো ব’দমেজাজি লোকের সাথে বের হতে হলো, অতঃপর রাস্তায় বিশাল অ’ঘটন, একটু আগে নিখিল ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েও হলোনা, আর এখন ক্লাস থেকেই বের করে দিলো ক্রীতিক ওকে।

এখন অবশ্য দোষটা ক্রীতিকের নয় অরুরই বেশি ছিলো। ক্লাসের মধ্যে বাইরে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে নিখিল ভাইকে খুজতে গিয়েই বেজেছে বিপত্তি। ভরা ক্লাসে সবার সামনে ক্রীতিক এক রাম ধ’মক দিয়ে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছে অরুকে। কিন্তু অরু এটা ভেবে পায়না, বাংলা ডিপার্টমেন্ট থেকে এসে ইকোনমিকস কে নেয়??

কেনইবা ক্রীতিক বেছে বেছে এই বিদঘু’টে সাবজেক্টেই ভর্তি করালো ওকে? এটা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ফরেইনার স্টুডেন্টদের অভাব নেই এখানে,সেই সাথে সাবজেক্টেরও।তাহলে ইকোনমিকসই কেন???

এখন তো তিনদিন অন্তর অন্তর মাইক্রোকোনমিক্স ক্লাসে ক্রীতিকের মুখোমুখি হতে হবে, সাথে হাজারটা ফ্রী অ’পমান তো আছেই।
ক্লাসের বিপরীত করিডোরের মাঝখানে, উঁচু থেকে শুরু করে সবুজ ঘাস অবধি বিছানো সিঁড়িতে বসে বসে অরুর মনের সাথে মস্তিস্ক যখন বিশাল দ্বন্দে লিপ্ত ঠিক তখনই ল্যাপটপ ব্যাগ হাতে আগমন ঘটে নিখিলের।
— অরোরা না?

পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে হকচকিয়ে পেছনে চাইলো অরু। দেখলো গালের মাঝে টোল পরা হাসি মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছে নিখিল ভাই। এতোদূর এসে, বিদেশের মাটিতে নিখিল ভাইকে দেখতে পেয়ে অরুর ভীষণ আনন্দ হলো। ও বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে দু’কদম এগিয়ে গেলো নিখিলের কাছে, তবে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারলো না আগের মতো জড়তাটা রয়েই গিয়েছে।
এবার নিখিলই প্রশ্ন করলো প্রথমে,
— অরোরা তুমি হঠাৎ এখানে? জানো ওই যে দেখছো তিনতলার ল্যাব ওখান থেকে তোমাকে দেখেই ছুটে এসেছি আমি।বারবার মনে হচ্ছিলো আমি ঠিক দেখছি তো?

মাত্রাতিরিক্ত খুশিতে অরুর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, তবুও খানিকটা কষ্ট করে মিনমিনিয়ে জবাব দিলো,
— জ্বি আমি এখানে, ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্ট ফার্স্ট ইয়ার।

সঙ্গে সঙ্গে আবারও প্রশ্ন করে নিখিল,
— আচ্ছা অরোরা,তিথি কেমন আছে? ওর ফোন কেন বন্ধ বলতে পারবে??

তিথিকে নিয়ে নিখিলের এতোবেশি কৌতুহল আর উদ্বেগ দেখে ফাটা বেলুনের মতোই চুপসে গেলো অরুর হাস্যোজ্জল মুখটা।

অন্যদিকে,ক্লাসের বিশাল থাই লাগানো জানালার ফাঁক দিয়ে এক পলক ওদের দিকে চাইলো ক্রীতিক, অতঃপর অর্নব কে কল করে নরম সুরে, একদম সফ্ট টোন যাকে বলে, সেভাবেই বললো,
— আমাদের ভার্সিটির সি’সিটিভি কন্ট্রোল সিস্টেমটা হ্যা’ক করতে হবে দোস্ত। বেশি না ওয়ানলি ফর ফাইভ মিনিটস।
*****************************************
তিথি সম্মন্ধে কথা বলতে মোটেই আগ্রহী নয় অরু। কেন যেন ভেতর থেকেই আসছে না কোন কথা, কি বলবে তাহলে ও??
কিন্তু নিখিল দ্বিতীয়বার আবারও একই প্রশ্ন করলো ওকে,
— কি হলো অরোরা, জানো তিথি সম্মন্ধে কিছু?
অরুর মন বলছে, আমি এতদূর কিভাবে আসলাম, কেন আসলাম, সেসব কথা আপনার একটা বারও জানতে ইচ্ছা করলো না নিখিল ভাই? তাছাড়া আপনি হঠাৎ তিথিকে নিয়েই বা কেন এতো আগ্রহী?
— হ্যালো,অরোরা, কি ভাবছো এতো?

নিখিল হাত নাড়িয়ে ইশারা করতেই সম্বিত ফিরে পেলো অরু। এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ফোন চলে আসে নিখিলের।
ওপাশ থেকে কি বললো, কে জানে, নিখিল আর এক মূহুর্তের জন্যও দাঁড়ালো না ওখানে বরং দ্রুত পায়ে ছুটতে লাগলো তিনতলার ল্যাব রুমের উদ্দেশ্যে।
অযাচিত অরু পেছন থেকেই প্রশ্ন ছুড়লো,
— কি হয়েছে নিখিল ভাই, এনিথিং রং?

নিখিল যেতে যেতে জবাব দিলো
— সাম হাউ ক্যা’মিক্যা’ল পরে গিয়ে আমার সব রিচার্জ রিপোর্ট গুলো পু’ড়ে গিয়েছে।

এমন দু’র্ঘটনার কথা শুনে অজান্তেই মুখে হাত চলে গেলো অরুর। বিরবিরিয়ে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন ছুড়লো,
— আজ হচ্ছেটা কি এসব?

ক্লাস শেষে অরুকে এভাবে থ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কাছে এগিয়ে আসে উজ্জ্বল শ্যাম বর্নের মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত একটি মেয়ে। কারও উপস্থিতি টের পেয়ে অরু পেছনে চাইলে মেয়েটা হাত বাড়িয়ে বলে,
—হ্যালো আ’ম সায়নী, সায়নী মুখার্জি। আ’ম ফ্রম ইন্ডিয়া।

দুর দেশে হাজারো সাদা চামড়া ওয়ালা বিদেশি মানুষের ভীরে প্রতিবেশি দেশের কাউকে দেখতে পাওয়াটা পাশের বাড়ির প্রতিবেশির মুখ দেখতে পাওয়ার মতোই অনেকটা। অরুরও সে-রকমই ঠেকলো, ও জলদি সায়নীর হাতে হাত মিলিয়ে বললো,
— আমি অরোরা শেখ, আই মিন অরু।

— অরু? হাউ সুইট।
তারপর আঙুল দিয়ে ইশারা করে সায়নী বলে চলো ক্যান্টিনে যাই, তোমাকে ভার্সিটি ক্যান্টিনের সবচেয়ে বেস্ট খাবারটা টেস্ট করাবো আজ, লেটস গো।
অরু সম্মোহনী হাসি দিয়ে বললো,
— আচ্ছা চলো।
নরম ঘাসের আস্তরণ মাড়িয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা দুজন, যেতে যেতে সায়নী শুধায়,
— আচ্ছা আজ জেকে স্যার তোমাকে ওভাবে বক’লো কেন বলোতো? উনি সাধারণত কারোর সাথেই আনপ্রফেশনাল আচরণ করেন না এটলিস্ট আমিতো দেখিনি।

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
— কি জানি।
তবে মনে মনে বললো,
—তোমার জেকে স্যারের বকু’নি খেয়ে আমার অভ্যেস আছে।

সায়নী প্রতিউত্তরে উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
— জানো? জেকে স্যার ইজ আ ভেরি গুড রাইডার। ভার্সিটিতে তাকে যতোটা কুল লাগে, বাইক রাইডার জেকে স্যারকে ঠিক ততটাই ডেস্পারেট আর ড্যাসিং মনে হয়। যেন আস্ত একটা চকোলেট বয়।

অরু জানতো যে ক্রীতিক একজন রাইডার তবে সেটা মনিটরের ভিডিও গেইমে। কিন্তু বাস্তবেও যে ক্রীতিক বাইক রাইডিং করে সেটা ওর অজানাই ছিল।তাই চকিতে বলে,
— কি বলছো তুমি? আমিতো জানতাম না।

সায়নী হাত দিয়ে মাঁছি তাড়ানোর মতো করে বললো,
— আরে তুমি কি করে জানবে? নতুন এসেছো না।দাঁড়াও আমার কাছে টিকেট আছে।
এই বলে ব্যাগ থেকে দুইটা টিকেট বের করে একটা অরুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সায়নী বললো,
— আগামী কাল ভার্সিটির হান্ড্রেড ইয়ার সিরিমনি, তাই কোন ক্লাস নেই, সারাদিন কোন না কোন প্রোগ্রাম হবে। তারপরের দিনই জেকে স্যারের রাইডিং ম্যাচ, টিকেটটা রাখো আমি তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো, কেমন?

অরু হ্যা না কিছুই বললো না, সায়নী বলার অপেক্ষাও করলো না , অনেকটা অধিকার খাটিয়েই ওর ব্যাগে টিকেটটা ঢুকিয়ে দিলো।
*****************************************
এদেশে সন্ধা হওয়ার জন্য খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন পরে না, বিকেল চারটার পরে এমনিতেই সূর্যের হদিস পাওয়া বাহুল্য।
আধারের কালচে আস্তরনে গোধূলির ম’রা রোদ টুকু ঢেকে গিয়েছে বহু আগেই।
আবছা আঁধারের মাঝেই ভার্সিটির গেইট দিয়ে ধীরগতিতে বের হয়েছে অরু।
ওদিকে গেইটের বাইরে গাড়িতে হেলান দিয়ে সটান দাড়িয়ে আছে ক্রীতিক।
আপাতত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অরুর গতিবেগ গননা করাটাই ওর মোক্ষম কাজ মনে হচ্ছে।
অরু যখন একদম সামনে এসে দাঁড়ায়, ঠিক তখনই ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে ক্রীতিক বললো,
— হোয়াই সো লেট?

অরু জবাব দেয়না, উল্টে অবিশ্বাসের নজরে ক্রীতিকের মুখশ্রী পরখ করে মনে মনে বলে,
— এই গো’মড়া মুখো লোকটা,এতো মেয়েদের ক্রাশ? সব মেয়েরা রাইডার রাইডার করে নাঁচে। কি এমন রাইড করেন উনি?

অরুর এমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করা দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে বললো,
— হোয়াট??

অরু লাফিয়ে উঠে দূরত্ব বাড়ালো।

—কি হলো দূরে সরে কেন গেলি? কাছে আয়।

— ক..কাছে কেন আসবো?

ক্রীতিকের নির্লিপ্ত জবাব,
— আমি আসতে বলেছি তাই আসবি, আয় বলছি।
প্রতিউত্তরে অরু কিছু বলবে তখনই গেইটের কাছে আগমন ঘটে দা ক্রাশ বয় নিখিলের।
হাতে সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে। অরুকে দেখা মাত্রই নিখিল আন্তরিক হেসে বললো,
— আরে অরোরা, বাসায় যাবে নাকি? চলো তোমায় এগিয়ে দিচ্ছি আমি।

অরু তো খুশিতে বাকরুদ্ধ, এ যেন মেঘ না চাইতে জল। ও ক্রীতিকের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
— ইয়ে.. ভ..ভ..ভাইয়া।আসলে।

— কি?
তী’রের ছিলার মতো একটা ভ্রু উঁচিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করে ক্রীতিক।

অরু বলতে ভ’য় পাচ্ছে ক্রীতিককে, তবে এই মূহুর্তে নিখিলের সাথে বাড়ি যাওয়ার মতো এতো বড় সুযোগটাও হাত ছাড়া করতে চাইছে না মোটেই, তাই বুকের মাঝে অনেকটা সাহস জুগিয়ে বললো,
— আ..আমি নিখিল ভাইয়ের সাথে যেতে চাই।

—ইয়াহ সিওর।

একেবারে একবলে ছক্কা হাঁকানোর মতোই ভেতরটা ইয়াহু বলে চেঁচিয়ে উঠলো অরুর। খুশিতে এখানেই লাফাতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর।কিন্তু সেটা বড্ড বেমানান দেখায়,তাই চুপচাপ গিয়ে সাইকেলের পেছনে উঠে পরলো ও।

ক্রীতিক সেদিকে অনুভূতি শূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাড়িয়ে আছে, হাত দিয়ে এমন ভাবে নিজের লং হেয়ার গুলোকে ব্যাক ব্রাশ করছে যেন কিছুই হয়নি।এভরিথিং ইজ অল রাইট।

সাইকেল চলতে শুরু করলেই ক্রীতিক মাটির দিকে তাকিয়ে গুনতে শুরু করলো,
— ফাইব, ফোর, থ্রী, টু,ওয়ান এন্ড জিরো।

সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার মাঝখানে ঝনঝন করে কিছু একটা পরার শব্দ হলো। তৎক্ষনাৎ ওর ঠোঁটে খেলে গেলো অদ্ভুত সেই ক্রুর হাসি।

হুট করেই সাইকেলের টায়ার কিকরে পা’ঞ্চার হয়ে গেলো বুঝে উঠতে পারলো না নিখিল,অবশ্য এই মূহুর্তে সে বোঝার মতো অবস্থাতেও নেই, হাত পা ছিলে ছুলে যা-তা অবস্থা হয়ে গিয়েছে।
অরু নিজেও অনেকটা ব্যা’থা পেয়েছে। ক্রীতিক দ্রুত এগিয়ে এসে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে শুধালো,
— আর ইউ অল রাইট মি. নিখিল?

প্রতিউত্তরে নিখিল আদৌও জবাব দিলো কি দেয়নি, তার জন্য একমূহুর্ত ও অপেক্ষা না করে, ক্রীতিক দ্রুত অরুকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
— ওকে বায়, দেন।

অরুকে কোলে তুলতেই অরু, অবাক হয়ে জোরে জোরে বললো,
–আরে আরে নিখিল ভাই পরে আছে আর আপনি আমাকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন?

ক্রীতিক হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়,
— হ্যা, কারন আমি তোর নিখিল ভাইয়ের প্রতি একটুও ইন্টারেস্টেড না, আমি যার প্রতি ইন্টারেস্টেড তাকে সাথে করেই নিয়ে যাচ্ছি।

— কি বললেন? কার প্রতি আগ্রহী?

ক্রীতিক দু’হাতে আগলে রাখা অরুর দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে বললো,
— বিলিভ মি অরু, তুই আর একটাও বাড়তি কথা বললে, আমি তোকে এখানেই ফেলে চলে যাবো। আর তুই ভালো করেই জানিস আমি যেটা বলি সেটাই করে ছাড়ি। কারণ তোর পেছনে ওয়েস্ট করার মতো বেহুদা টাইম আমার নেই।সো মুখে ফুলস্টপ টান।

ক্রীতিকের কথার পাছে অরুও আর কথা বাড়ানোর সাহস পায়না, মুখে দাড়ি,কমা,ফুলস্টপ সবকিছু টেনে দিয়ে, মাথা এলিয়ে পরে থাকে ক্রীতিকের প্রসস্থ বাহুডোরে।
চলবে…….

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্ব_১০
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
প্রাপ্ত মনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য।

ফকফকে পরিস্কার আকাশ আর রোদ্রজ্জল দিনের আগমনী বার্তা নিয়ে,সূচনা হয়েছে আরও একটি সুন্দর সকালের। আজকের আবহাওয়াটা প্রান জুড়ানোর মতোই সুন্দর ,চারিদিকে তাকালেই কেমন মন ভালো হয়ে যায়। কুসুম গরম সূর্য কীরণ আর ভোরের বাতাস গায়ে মাখাতে আজ বহুদিন বাদে ফ্রন্ট ইয়ার্ডের বেঞ্চিতে এসে বসেছে ক্রীতিক।দু’হাতে মুঠি বদ্ধ হয়ে আছে,কফির কাপ আর আইপ্যাড। তবে আপাতত আইপ্যাডে চোখ নেই ওর, বরং দুচোখ নিষ্পলক বিচরন করছে চারিদিকের সবুজে ঘেরা অরন্যে।
.
কোনোদিন দেশে ফিরবে না বলে, বছর তিনেক আগেই ছোটমোটো এই অত্যাধুনিক ডুপ্লেক্স বাড়িটা কিনেছিল ক্রীতিক। তখন কি আর ও জানতো?যে তিন বছরের মাথায় এসে ওর অষ্টাদশী পিচ্চি এলোকেশী এই বাড়িতেই প্রথমে পা রাখবে,দিনরাত যাপন করবে।জানলে হয়তো বাড়িটাকে মনমতো ঢেলে সাজাতে পারতো। অরুর তো আবার হ্যালো কিটি খুব পছন্দ,বাড়িটা হ্যালো কিটি থীমে তৈরি করলে কেমন হতো? কথাটি ভাবতেই এক মনে হেসে ওঠে ক্রীতিক।
ঠিক তখনই ওর আজগুবি ভাবনার সুতো ছিড়ে যায় সামনের ফ্রেঞ্চ গেইট থেকে আসা কলিং বেলের টিংটং আওয়াজে। কে এসেছে দেখার জন্য ক্রীতিক উঁকি দিতে যাবে, তারআগেই মেইন ডোর খুলে বেড়িয়ে আসে অরু। তারপর ফ্রন্ট ইয়ার্ড পেরিয়ে সোজা এগিয়ে যায় গেইটের কাছে। অরুর পড়নে ছিল হোয়াইট পিঙ্ক কম্বিনেশনে সিল্কের পাজামা,রেশমের মতো হাটু অবধি লম্বা চুল গুলো ছিল পুরো পুরি বাঁধন হারা।
অরুর পরনে নিজের কিনে দেওয়া পাজামা সেট দেখে ক্রীতিকের বেশ ভালো লাগলো। এই প্রথম ক্রীতিক কারোর জন্য কিছু নিজের হাতে কিনেছে,অরু আজ আবার সেটা পরেছেও। ভালো লাগারই কথা।

এইতো কালকেরই ঘটনা, সন্ধ্যা বেলা ভার্সিটি থেকে ফিরে,একাই খু’ড়িয়ে খু’ড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমেছিল অরু। তবে গাড়ি থেকে নামতেই খুব বড়সড় একটা ঝটকা খেয়ে অগত্যাই বিস্ময়ে আপনা আপনি দু’ঠোঁট আলাদা হয়ে গিয়েছিল ওর ।এই বাড়ির গ্যারেজে এখনো আসা হয়ে ওঠেনি অরুর আজকেই প্রথম ছিল। তাই ক্রীতিকের যে এতো এতো রাইডিং বাইকের কালেকশন আছে সেটাও ওর অজানাই ছিল।
পুরো গ্যারেজে চার চাকা বলতে একটা মার্সিডিজই রয়েছে কেবল। বাকি সব নামি-দামি ব্র্যান্ডেড বাইক কালেকশন। অরু মনেমনে ভাবলো এটাকে কোনো বাইকের শোরুম বললে মন্দ হবেনা বৈকি।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে অরু যখন অবিশ্বাসের নজরে ক্রীতিকের পানে চাইলো, ক্রীতিকের মুখ ভঙ্গি তখন খুবই সাভাবিক, ও নিজ হাতের আঙুলে চাবির রিংটা ঘুরাতে ঘুরাতে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
—গাড়িতে একটা প্যাকেট আছে নিয়ে যাস।

অরু,ভ্রুকুটি করে শুধায়,
— কার প্যাকেট, আমার?

ক্রীতিক না ঘুরেই জবাব দিলো
— তো কার??

— কিন্তু, আমার জন্য হঠাৎ??

ক্রীতিক হাটার গতি থামিয়ে, প্রথমে নাক টেনে বুক ভরে বাতাস নেয়, অতঃপর বলে,
— তুই ঘুমালে যে অ’র্ধন’গ্ন হয়ে থাকিস সেটা আদৌও জানিস?

— কিহ!
লজ্জা আর বি’রক্তির চ’রম সীমানায় গিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করলো অরু।

ক্রীতিক আবারও স্ব স্থানে দাড়িয়ে থেকেই বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে বললো,
— আমিতো জানি,আর তাছাড়া আমার আমানতের খেয়ানত করার কোন অধিকার তো তোর নেই,তাই ঢেকে রাখার ব্যাবস্থা করেছি মাত্র,সময় হলে নিজের জিনিস নিজে ঠিক বুঝে নেবো,তখন আর তোকে জ্বালাতে আসবো না, নিজের হাত দিয়েই ঢাকবো সবটা।আর দরকার পরলে…. বাক্যটা কেন যেন শেষ করলোটা ক্রীতিক, বরং তারাহুরো করে অরুর সামনে থেকে চলে গেলো।

আমানত, খেয়ানত,কিংবা ক্রীতিকের ঘোরানো প্যাঁচানো কথা কোনোটাই তখন আর মাথায় ঢোকেনি অরুর। ও তো স্রেফ উপহারটুকু গ্রহন করেছে। এক টা দুটো নয়, পুরো দশ কালারের দশটা পাজামা সেট ছিল প্যাকেটে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল পাজামা গুলো খুব দামি, গায়ে চড়ালেই কেমন চোখ ভার হয়ে ঘুম চলে আসে।

কালকের কথা আজও মনে করে মুখের কোনে আঙুল ঠেকিয়ে ঠোঁট কামড়ে একমনে হাসছে ক্রীতিক। আশ্চর্য।
মনে মনে ভাবছে,
— সত্যি যদি দিশেহারা হয়ে কাল কিছু করে বসতাম? অধিকার খাটাতে গিয়ে দূরত্বের প্রাচীর ভে’ঙে ফেলতাম?তাহলে কি খুব বেশি বারাবারি হয়ে যেত???
ওদিকে অরু নিজের কোলের মধ্যে ছোট্ট বিড়াল ছানা ডোরা কে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে গেইট খুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো চেনা পরিচিত সেই সুদর্শন মুখখানা,তবে এই মুখটা অরুর থেকে বেশি অনুর পরিচিত।

অরু একপলকে উপর থেকে নিচ পরখ করে নিলে তার। একগুচ্ছ শুভ্র রঙা টিউলিপ হাতে নিয়ে ফর্মাল গেটআপে দাড়িয়ে আছে প্রত্যয়। চোখে অপরিবর্তিত চিকন ফ্রেমের চশমা, দেখে তো মনে হয় পাওয়ার আছে। প্রায় কয়েক মিনিট বিনাবাক্যে অতিবাহিত হয়ে যায়,তবুও অরুর ধ্যান ভাঙলো না,তাই অরুর দিবাস্বপ্নকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে হাত নাড়িয়ে ডেকে উঠল প্রত্যয়,
— হ্যালো!

তৎক্ষনাৎ ধ্যান ভেঙে গেলো অরুর, সচকিত হয়ে বললো,
—-হ্যা!! আপার কাছে এসেছেন তাইনা?
আপা বাসাতেই আছে, আসুন আসুন।

প্রত্যয় গেইট দিয়ে ভেতরে যেতে যেতে বললো,
— এ্যাকচুয়াল্যি আমি,অনুর কাছে নয়,ক্রীতিক ভাইয়ের কাছে এসেছি, কিছু ফাইলে আর্জেন্ট সিগনেচার লাগতো। ওহ ওইতো ভাই।

হাত কয়েক দুরে কালো রঙা বেঞ্চিটাকে আঙুল উঁচিয়ে দেখালো প্রত্যয়। তারপর অরুকে রেখেই এগিয়ে গেলো সেদিকে।
অন্যদিকে অরু, দৌড়ে গিয়ে অনুকে বাইরে নিয়ে এলো।
অরুর টানাটানিতে অনেকটা হন্তদন্ত হয়েই বেরিয়ে এলো অনু। একটা লং কুর্তি আর লেগিংস পরিহিত অনু তাকিয়ে আছে প্রত্যয়ের পানে।ওদিকে কাজের ফাঁকে প্রত্যয়ের ওও চোখ সরেনি ঘুমু ঘুমু অনুর মায়াবী মুখশ্রী থেকে।
অরু টানাটানি করছে দেখে, অনু বিরক্ত হয়ে বললো,
— উফফ ছাড়না অরু। ক্রীতিক ভাইয়া বসে আছে, তার সামনে তুই যদি এমন বাচ্চামো করিস। কি বলবে বলতো?

—আরে কিচ্ছু বলবে না আয় তো তুই।
অরুর একহাতে তখনও ঘাপটি মেরে বসে আছে বিড়ালের বাচ্চা ডোরা।

অনু সামনে এগোতে এগোতে ভাবছে সেদিন রাতের কথা। সেদিন বৃষ্টির অজুহাতটা তো নিছকই বাহানা ছিল। কারণ সেদিন হসপিটাল থেকে বের হতেই দেখা মেলে ছাতা হাতে দাড়িয়ে থাকা প্রত্যয়ের।
প্রত্যয়কে দেখে অবাকের চরম সীমানায় গিয়ে অনু তখন শুধালো,
—আপনি এখানে?

প্রত্যয় মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিল,
—- আপনার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি।

আর তারপর?? বৃষ্টি ভেজা মনোমুগ্ধকর একটা সিম্পল কফি ডেট। একজন আরেকজনের পরিচয় তো দূরে থাক নামটুকু পর্যন্ত জানতো না, তবুও মন গহীনে কোথাও ঘণ্টী বেজেছিল দুজনারই। অনুর মনে হয়েছিল,যে মানুষটা এতোবার করে সাহায্য করেছে তার সাথে এককাপ কফি তো পান করাই যায়।পরিচয় দিয়ে কি আসে যায়???

তবে আজ এই মূহুর্তে প্রত্যয়ের কর্মকান্ড দেখে মনে হচ্ছে, সে পরিচয় দিতেই একে বারে আঁটঘাঁট বেধে সকাল সকাল বাড়ি বয়ে এসেছে।
বাড়ির ফ্রন্ট ইয়ার্ডটা নরম সবুজ ঘাস, আর বিভিন্ন সৌন্দর্য বর্ধক গাছ গাছালি দিয়ে ভরা, সেই গাছেরই ফাঁক ফোকর গলিয়ে আলো ছড়াচ্ছে একটু একটু সূর্য কীরণ। আর সেই আলোছায়ার মাঝেই মুখো মুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যয় ও অনু। অনুর পেছনে অরু আর ডোরা। অন্যদিকে ওদের থেকে খানিকটা দুরে এখনো আইপ্যাডে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে ক্রীতিক।

প্রত্যয় নিজের হাতে থাকা টিউলিপ গুচ্ছ এগিয়ে দিয়ে বললো,
— শুভ সকাল মিস. অনন্যা শেখ, আমি প্রত্যয় এহসান” সি এফ ও” অফ জেকে গ্রুপ।

অরু হকচকিয়ে অনুর দিকে এগিয়ে এসে মিনমিনিয়ে বললো,
— আপা উনিই প্রত্যয় এহসান, উনিই মনে হয় আমাদের জন্য ভিসা টিকেটের সব ব্যাবস্থা করেছিলেন।
প্রত্যয় চোখ সরিয়ে অরুর দিকে তাকিয়ে বললো,
— হ্যা ঠিক বলেছো তুমি।

অনু কথা ঘুরিয়ে বললো,
— তাহলে আপনি আমাকে চিনতেন তাইতো?

প্রত্যয় মৃদু হেসে জানায়,
— কিছুটা।
অনু সহসা হেসে টিউলিপ ফুল গুলোকে গ্রহন করে বলে,
— ধন্যবাদ।

—ওয়েলকাম।

প্রত্যয়ের ঘোর লাগানো চোখ দুটো ছিলো তখনও অনুর নিস্প্রভ চোখে নিবদ্ধ।
ওদিকে ক্রীতিকের চোখ দুটো অরুর চোখে, একই ঘোর, একই কামুকতা, ক্রীতিকের চোখে খানিকটা বেশিই হবে। ক্রীতিকের সেই ঘোর লাগা চোখে চোখ পরতেই,কেঁপে উঠলো অরু, হুট করেই কেন যেন শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ দাড়িয়ে গেলো। সেই সাথে তলপেটের মধ্যে অনুভব হলো অজানা এক গুরগুরানি। এটা মোটেই খিদের পূর্বাভাস নয়, তাহলে এটা কেমন অনুভূতি?? আগেতো কখনো হয়নি এমন। সামান্য চাহনিতেও কারও এতো জোর থাকে? চোখের চাউনি দিয়ে, পুরো ঝ’ড় বইয়ে তু’লকালাম বাধিয়ে দিলো শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তবুও সবটা গতানুগতিক উপেক্ষা করে গেলো অরু, পেছন থেকে অনুদের চোখে চোখে কথা আদান-প্রদানের মাঝে বাম হাত ঢুকিয়ে দিয়ে অরু বলে উঠলো,
—এ্যাই আপা, অনেক তো হয়েছে তোদের আলাপ পরিচয়, এখন চল ক্ষিদে পেয়েছে, আমাকে আবার খেয়ে ভার্সিটি যেতে হবে, তাছাড়া তুই তো হসপিটালে মায়ের কাছে যাবি।

অরুর কথায় সম্বিত ফিরে পেলো অনু, সেই সাথে অজানা একরাশ লজ্জারা প্রজাপতির ন্যায় ঘিরে ধরলো ওকে। ও তারাহুরো করে ভেতরে যেতে যেতে বললো,
—খাবার দিচ্ছি দ্রুত আয়।

পরিবেশটা থমথমে আর অসাভাবিক, প্রত্যয়ের নিজেরও কেমন লজ্জা লজ্জা পাঁচ্ছে। তাই পরিস্থিতি সাভাবিক করতে প্রত্যয় অরুর কোলে ঝিমুতে থাকা ডোরাকে দেখিয়ে বললো,
— ব..বিড়াল কোথায় পেলে? না মানে আগেতো ছিলোনা।

অরু ডোরার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে বলে,
— কাল রাতে ব্যাক ইয়ার্ডে কুড়িয়ে পেয়েছি ঠান্ডায় কাঁপছিল, তারপর ঘরে নিয়ে এসেছি আর তারপর….

প্রত্যায় জিজ্ঞাসু হয়ে শুধালো,
—তারপর?
অরু ক্রীতিকের দিকে দাঁত কটমটিয়ে তাকিয়ে বললো,
— কিছুনা।

—বাই দা ওয়ে, নাইস ক্যাট।

অরু প্রত্যয়ের কথায় বাঁধ সেধে বলে,
— ও ক্যাট না, ও আমার বাচ্চা ডোরা।

— মাথা খারাপ, আমি কেন বিড়ালের বাচ্চা জন্ম দিতে যাবো? পেছন থেকে ভেসে আসা ক্রীতিকের অযাচিত বাক্যে অরু, প্রত্যয় দুজনই বোকা বনে গেলো।

অরু মুখে ভেংচি কেঁ’টে মিনমিনিয়ে বললো,
— আপনার বাচ্চা কেউ বলবেও না, ভালোবাসা,দরদ বলতে কিছু আছে নাকি হৃদয়ে? থাকলে আমাকে আর ডোরাকে অমন মাঝরাতে বাইরে বের করে দিতে পারতেন না।

ওর ভাবনার মাঝেই ক্রীতিক ওদের কাছে এগিয়ে এসে, আই প্যাডটা অরুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— অরু এটা নিয়ে ভেতরে যা, আমার প্রত্যয়ের সাথে কিছু পার্সোনাল কথা আছে।

অরু ঠোঁট উল্টে ভেতরে যেতে আইপ্যাডটা খুলে দেখতে লাগলো।
আর প্রথমেই যেটা সামনে আসলো সেটা অডিও বুক। হা’ন্টিং এডলিন।

বইয়ের নামটা দেখেই চোখ মুখ কুঁচকে গেলো অরুর। মিনমিনিয়ে বললো,
— উনি হা’ন্টিং এডলিনের মতো ডার্ক রোমান্টিক বই পড়েন? ইউউ!! তারমানে কি উনিও ওইসব বেপরোয়া হিরোদের মতো অতিরিক্ত রোমান্টিক?? হায়হায় ওনাকে সামলাতে তো ওনার বউয়ের বারোটা তেরোটা বেজে যাবে।
পরক্ষণেই নিজের মাথায় নিজেই চাটি মে’রে দাঁত দিয়ে জিভ কেঁ’টে অরু বলে,
—ছিহ!কি সব ভাবছি আমি। তওবা তওবা।

*****************************************
ইউনিভার্সিটিতে আজ হান্ড্রেড ইয়ার সিরিমনি, মানে শতবর্ষপূর্তি উদযা্পন হচ্ছে। আজ কোন ডিপার্টমেন্টেরই কোন ক্লাস নেই। সব কিছু জানাই ছিল অরুর।তবুও একবুক আশা নিয়ে ভার্সিটিতে এসেছিল ও।আকাঙ্খা একটাই নিখিল ভাইয়ের একটা নজর দেখা পাওয়া,ঠিক আগের মতোই।কিন্তু সেটা আর হয়নি, সিনিয়রদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে,নিখিল ভাই আজ আর ভার্সিটিতে আসেনি। আসেনি বললে ভুল হবে,আসতে পারেনি,গতকাল সব রিপোর্ট ন’ষ্ট হয়ে যাওয়ায় আজ আবারও সেগুলো নতুন করে রেডি করতে হচ্ছে তাকে। নয়তো সামনের সেমিস্টারে পুরো দমে ফে’ইল। অরু অসহায়ের মতো মনম’রা হয়ে বললো,
— নিখিল ভাইয়ের মতো ভালো মানুষের সাথে,এমন খারা’প কাজটা কে করলো ??

সে যাই হোক, নিখিল ভাই যেহেতু আসেনি অরু চিন্তা করলো ওও বাড়িতে ফিরে যাবে, কাল সারারাত বাইরে বের করে রেখেছে ক্রীতিক ওকে,তাই ঘুমটাও চোখে তাজা। না ঘুমানোর দরুন কেমন ঝিঁমুনি চলে আসছে দুচোখে। চারিদিক ঝাপসা লাগছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি পরে যাবো মাথা ঘুরে। অরু আর বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকলো না হাটা ধরলো বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে, তবে দু’কদম এগোতেই পথ আটকায় সায়নী,
ওর হাতটা শক্ত করে ধরে উচ্ছ্বাসিত মুখে বলে,
— এ্যাই অরু,কোথায় যাচ্ছো?? গ্যালারীতে বাস্কেট বল খেলা হচ্ছে,বিশাল টূর্নামেন্ট তারাতাড়ি চলো।

যদিও অরুর এসবে বিন্দু পরিমাণ আগ্রহ নেই, তবুও অগত্যাই যেতে হলো সায়নীর সাথে। যেতে যেতে সায়নী জানালো
— সবাই এই ম্যাচ দেখার জন্য গত একমাস ধরে বসে আছে, আর তুমি বাড়ি যাচ্ছো? এই ভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র ভার্সেস পাশের ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্ররা।

সায়নীর উচ্ছ্বাসে জোয়ার দিতে অরু নরম সুরে বললো,
— ওহ তাই নাকি?

গোলাকার বিশাল গ্যালারীতে গিয়ে সায়নী সিটে বসতে বসতে বললো,
— হুম, তার চেয়েও বড় কথা কি জানো?জেকে স্যারও এই ভার্সিটির সিনিয়র ছিলেন। আর স্যারও আজ ম্যাচে খেলবেন।

তৎক্ষনাৎ সায়নীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে চাইলো অরু। দেখতে পেলো শুধু ক্রীতিক একা নয়, সায়র আর অর্নব ওও আছে। তাছাড়া ওদের পাশের গ্যালারীতেই বসে বসে নিজের প্রিয় বন্ধুদের চিয়ারআপ করে যাচ্ছে এলিসা,সাথে ক্যাথলিনও।
চেনা পরিচিত সবাইকে একঝলক দেখে নিয়ে অরু মনে মনে বললো,
—তারমানে ওনারা সবাই এই ভার্সিটিরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
— অরু,কি ভাবছো খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে তো।
সায়নীর কথায় এবার সত্যি সত্যি খেলা দেখায় মন দিলো অরু।
*****************************************
তখন খেলার প্রথম হাফ শেষ হয়েছে মাত্র, সবার মুখেই বিজয়ের হাসি লেগে আছে, কারন প্রথম হাফেই বাজিমাত করে দিয়েছে ক্রীতিকেরা। প্রতিপক্ষ টীম বাকি অর্ধেক সময়ে এই রেকর্ড ভা’ঙতে পারবে কিনা সন্দেহ। এখন দশ মিনিটের বিরতি।
বিরতি পেয়ে সবাই যে যার মতো এক নম্বর, দুই নম্বর সারতে চলে গেলো। কেউ কেউ গিয়ে দাঁড়ালো স্ব টীমের মানুষের কাছে, বাকি অর্ধেক খেলার জন্য পরামর্শেরও তো একটা ব্যাপার আছে।
শুধু মাত্র ক্রীতিক সবাইকে ছাড়িয়ে উঠে এলো জনসমাগম পূর্ন গ্যালারী। ক্রীতিক গ্যালারীতে উঠতেই সবাই একযোগে চিল্লিয়ে উঠলো।

তবে কোন কিছু শোনা, কিংবা দেখার চেষ্টা না করেই ও সোজা গিয়ে বসে পরলো অরুর পাশে। অতঃপর একটান দিয়ে অরুর গলায় পেচানো স্কার্ফটা টেনে নিয়ে তোয়ালের মতো করে নিজের চুল আর কপালের ঘাম মুছতে লাগলো নির্বিগ্নে।

বিস্ময়ে বি’পর্যয়ে হা হয়ে আছে পুরো গ্যালারী ভর্তি মানুষ। যেন এখানে কোন বাস্কেট বল ম্যাচ না বরং রোমান্টিক সিনেমার শুটিং হচ্ছে। অর্নব সায়র ওরাও খানিকটা অবাক। সায়র যতটুকু জানে মেয়েটা ক্রীতিকের দু-চোখের বি’ষ। তাহলে গ্যালারী ভর্তি মানুষের সামনে ক্রীতিক এসব করছেটা কি?
ওদিকে অরু পারছেনা লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে। মানে সকলের ক্রাশ বয় রাইডার জেকে স্যার এই মূহুর্তে পুরো ক্যাম্পাসের সামনে ওর শরীরের ওড়না দিয়ে নিজের মুখমন্ডলের ঘাম মুছছে,এমন কাহিনীতে চারিদিকের জোড়া জোড়া চোখের দিকে তাকিয়ে অরুর আর্তনাদ করে বলতে ইচ্ছে করলো,
—বিশ্বাস করো আমি কিছু জানিনা, এই লোকটা পা’গল, মাথায় সমস্যা আছে তাইতো হুটহাট এমন করে আমাকে ফাঁ’সায়।

ওর ভেতরের কা’ন্নাকা’টিকে দু’পয়সা পাত্তা না দিয়ে গমগমে আওয়াজে ক্রীতিক বলে,
—-পানিটা দে।

অরু এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
— আমারটা খাবেন?

—এখানে আর কেউ আছে?

অরু দ্রুত এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে ব্যাগ থেকে বের করে মাম পট টা এগিয়ে দেয়।
ক্রীতিক এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পানি শেষ করে আবারও নেমে যায় গ্যালারী থেকে।

ক্রীতিক চলে গেলে অরু নিজের ওড়নাটা ঠিকঠাক করতে ব্যাস্ত হয়ে পরে, ওড়নার একাংশ ক্রীতিকের ঘামে ভিজে আছে, সেখান থেকে খুব সুন্দর একটা চন্দন কাঠ জাতীয় ঘ্রান আসছে। ঘ্রানটা কিসের ভালোভাবে বোঝার জন্য অরু ওড়নাতে নাক ছোঁয়ালো। হ্যা যা ভেবেছিলো তাই স্যান্ডালউড পারফিউমের একটা মাতাল করা সুবাস।গন্ধটা নাকে লাগতেই অজানা শিহরণে শরীর ছেয়ে গেলো অরুর।
তখনই অপর পাশ থেকে কর্কশ আওয়াজ ভেসে এলো সায়নীর,
—তুমি জেকে স্যারকে চেনো?

—নাহ,না..মানে..হ্যা..মানে।

অরু চোরের মতো মুখ কাচুমাচু করছে।দেখে সায়নী বললো,
—কি না মানে হ্যা মানে করছো? চিনে থাকলে বলো?
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে,
— উনি আমার ভ..ভাই হয়,মানে স্টেপ ব্রাদার।

সায়নী বোধ হয় অরুর জবাবে খুশিই হলো,তাই ওর হাত জড়িয়ে ধরে বললো,
— ইটস ওকে অরু, আগে বলবে না এ কথা, আমি আরও ভাবলাম কি না কি।

*****************************************
খাওয়া দাওয়া হই’হুল্লোরে সারাদিনটা ভালোই চলে গিয়েছে , সবার সাথে অরুও আজ বেশ ভালোই আনন্দ করেছে, এতোগুলো দিন পর আজকেই প্রথম অরুর মনে হয়েছে যে ও আসলেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তবে বিপত্তি ঘটেছে বিকেল নাগাদ।

ক্যাম্পাসে রাতে কনসার্ট আর পার্টি থাকলেও অরু সেসবে একদম অভ্যস্ত না, তাই ও সায়নীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। অরু শুধু একা নয়,অনেকেই যাচ্ছে আসছে। করিডোরে শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভীর। তাই ও ঠিক করলো বাইরের দিক থেকে তারাহুরো করে বেরিয়ে যাবে,কিন্তু হঠাৎই ওর মনে হলো ও ভীরের মাঝে নিখিল ভাইকে দেখলো,নিখিল কে দেখা মাত্র অরু আনমনে বললো,
—আশ্চর্য নিখিল ভাই সারাদিনে ভার্সিটি এলেন না, আর এখন এই সন্ধ্যা বেলা এলেন? আর সাথে ওটা কে?

অরু দূর থেকেই আরেকটু ভালো ভাবে পরখ করে ওদেরকে দেখলো,হাজারো ভীরের মাঝে এক বিদেশিনীর কোমরে হাত রেখে তার সাথে হাসাহাসি করতে করতে এদিকেই এগিয়ে আসছে নিখিল ভাই, দেখলে মনে হবে তারা জনম জনমের প্রেমিকযুগল।

তবে এখন আর অরুর থেকে খুব বেশি দূরে নেই ওরা বরং অনেক কাছে।
হুট করেই তখন, অরুর কি হলো কে জানে? চক্রাকার ঘুরতে থাকা বলয়ের মতোই ঘুরছিল ওর মাথাটা। চোখের সামনে সুবিশাল ক্যাম্পাসটাকে মনে হচ্ছিলো মহাবিশ্বের সবথেকে অন্ধকারতম ব্ল্যাক হোল। ক্ষনিকের মধ্যে মানুষের গিজগিজ,হাসাহাসি, কথার বহর, সব কিছু ছাপিয়ে কর্ণকূহরে বেজে উঠলো ঝিনননন ধরা এক বিরক্তি কর আওয়াজ। আর তারপর হুট করেই মাথা ঘুরে ওখানেই অচেতন হয়ে পরলো ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বাঙালি মেয়ে অরু। দীঘল কালো নজরকাড়া ফ্রেঞ্চ বিনুনিটা তখন মাটি ছুঁই ছুঁই প্রায়।
তবে মাটি আর ছুঁতে পারলো না,তার আগেই ওকে শক্ত বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো নিখিল।

জনসম্মুখে হুট করে এমন একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় এহ মূহুর্তেই মোটামুটি ক্যাম্পাসের সবাই অরু আর নিখিল কে ঘিরে ধরেছে। সবার চোখের দৃষ্টিই আবর্তিত হয়ে আছে অজানা কৌতুহল দ্বারা। সবার মুখেই একটাই প্রশ্ন
— কি হলো মেয়েটার।

নিখিল যখন অরুকে কোলে তুলে কেবল দাঁড়িয়েছে ঠিক সেই মূহুর্তে ভীরের মধ্যে থেকে কেউ বলে উঠলো,
—ডোন্ট টাচ হার।

ভেলভেট মেঘের ন্যায় স্মুথ কন্ঠস্বর, তবে প্রতিটি শব্দতেই উপচে পড়ছে অগাধ কতৃত্ব,যেন ওর কোন একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসকে অন্যকেউ হাত দিয়ে ছুঁয়েছে।

অজ্ঞাত কন্ঠস্বর শুনে ভীরের মাঝে উঁকি দিলো নিখিল, তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে শি’কারী বাঁজপাখির ন্যায় নিখিলের হাত থেকে ছো মে’রে অরুকে নিয়ে গেলো ক্রীতিক।

নিখিল কিছু বুঝে উঠতে পারলো না, তাই অবাক দৃষ্টিপাত করলো ক্রীতিকের পানে,
তবে ক্রীতিকের দৃষ্টি ছিল গভীর আর অ’গ্নিস্ফু’লিং এর মতোই জ্বলজ্বলে,যেন চোখদুটো দিয়েই ভ’স্ম করে দেবে নিখিল কে।

ক্রীতিকের মুখের উপর কথা বলাতো দুরে থাক, ওর চোখের দিকেই কয়েক সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকতে পারলো না নিখিল। অজান্তেই শুষ্ক ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে নিলো নিচে।
*****************************************
ভার্সিটিতে ইমারজেন্সি ট্রিটমেন্টের জন্য যে ক্লিনিক থাকে। তারই একটা কেভিনের ছোট্ট করিডোরে দাড়িয়ে আছে ক্রীতিক। পড়নে কনুই অবধি হাতা গুটানো সফেদ শার্ট আর ব্ল্যাক ডেনিম। মাথার লম্বা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে পর আছে কপালে, ফর্সা মুখটা জি’দের তোপে টকটকে লাল হয়ে আছে।এই মূহুর্তে ওকে উদভ্রান্তের মতোই ছ’ন্নছাড়া লাগছে।

ক্রীতিক যখন করিডোরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বুকের উপর দু’হাত ভাজ করে নিস্প্রভ চোখে কেভিনের দিকে তাকিয়ে ছিল ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে সায়র, ক্রীতিকের মুখোমুখি দাড়িয়ে উদ্বীগ্ন হয়ে প্রশ্ন ছু’ড়ে বলে,
— কি হয়েছে অরুর?

—-, ঘুম আর খাওয়া দাওয়ার অনিয়মের জন্য প্রেশার ফল করে সে’ন্সলেস হয়ে গিয়েছে।
ক্রীতিকের নির্লিপ্ত জবাব।

সায়র ওর দিকে তি’রস্কার করে হাসলো,তারপর তাচ্ছিল্যের ধ্বনিতে বললো,
—সিরিয়াসলি জেকে? মাত্র এই কয়দিনে মেয়েটাকে ট’র্চা’র করে করে আধম’রা বানিয়ে ফেললি?তোর অ’ত্যাচা’রের মাত্রা এতোই বেশি ছিল যে মেয়েটা ক্যাম্পাসের মধ্যে সে’ন্সলেস হয়ে গিয়েছে, ভাব তুই কতটা জ’ঘন্য। আচ্ছা এই পিচ্চি মেয়েটার সাথে তোর কিসের এতো শ’ত্রু’তা বলতো আমায়?তাছাড়া যেভাবেই হোক না কেন ও তো তোর বোন নাকি??

সায়র কথাটা বলতে বাকি, শ’ক্ত থা’বায় সায়রের কলারটা চেঁ’পে ধরতে দেরি হলোনা ক্রীতিকের।

বোন কথাটা শোনা মাত্রই দ’গ্ধ গলিত লাভা যেন হিরহির করে ছড়িয়ে পরলো ক্রীতিকের মাথার মধ্যে। ও করিডোরের বিপরীত দেওয়ালে সায়রকে চেপে ধরে দাঁত দিয়ে দাঁত পি’ষে বললো,
— খবরদার সায়র ওকে আমার বোন বলবি না, ও আমার বোন নয়। নিজ বোনের যায়গায় ওর চেহারাটা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনা।
আমার কাছে ও পৃথিবীর সবার থেকে ইম্পর্টেন্ট। ও আমার কি, সেটা আমি নিজেও জানিনা, তবে এটুকু জানি, বাকিটা জীবন ওকে ছাড়া আমি দম নিতেও ভুলে যাবো।

সায়র চোখ বড়বড় করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের বিভ’ৎস মুখের পানে।

ঠিক তখনই অন্যদিক থেকে আগমন ঘটে নিখিলের।

ক্রীতিক একপলক নিখিলের দিকে তাকিয়ে, সায়রকে বললো,
— ওটাকে এক্ষুনি বিদেয় কর।

সায়র সামনের দিকে যাচ্ছে ঠিকই তবে ওর মনে চলছে অন্য কিছু, আজ সায়র উপলব্ধি করলো ওর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল,ক্রীতিক অরুকে সবচেয়ে বেশি অ’পছন্দ নয় বরং উ’ন্মাদের মতো পছন্দ করে। এই পছন্দ কে কি নাম দেওয়া যায়?শুধুই আসক্তি? নাকি সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি?

চলবে…..