সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-১৯+২০

0
341

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১৯

(৪২)

রুমাইসার শিয়রের কাছে একটি চেয়ারে বসে আছে স্মরণ। কপালে আংগুল ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুমাইসার অচেতন মুখের দিকে। প্রায় ঘন্টা খানেক সময় কেঁটে গেছে অথচ এখনো রুমাইসার জ্ঞান ফেরেনি। স্মরণ আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করলো তারপর উঠে জালার পাশে এসে দাঁড়াল। বাহিরে নিখুঁত আধার। মেঘমুক্ত আকাশে গুটিকয়েক তারা টিমটিম করে জ্বলছে। খোলা জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্মরণ প্রশস্ত শ্বাস ছাড়লো। মাঝে মাঝে অতি বুদ্ধিমান লোকেরাও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে স্মরণ বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিৎ। সে চাইলেই পারে রুমাইসাকে এখান থেকে নিয়ে চলে যেতে কিন্তু সে তা করবে না। কেনো করবে সে এসব মেয়েটা তো তার কেউ নয়, তবে কেনোই বা সে এতটা চিন্তিত হচ্ছে। এমন হাজারো ভাবনা মাথায় নিয়ে জানালার কাছ থেকে ফিরে এসে পুনোরায় রুমাইসার শিয়রের কাছে গিয়ে বসলো সে।

“মিস রুমাইসা আমি জানি না আপনি কেনো বার বার আমার কাছে ছুটে আসছেন, তবে যে কারণেই আসুন না কেনো আমি পারি না আপনাকে নিয়ে চলে যেতে। আমায় ক্ষমা করবেন আপনাকে বার বার ফিরিয়ে দিচ্ছি বলে।”
বলেই রুমাইসার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

দূরের কোনো এক গাছের ডালে বসে হুতুম পেঁচা অনবরত ডাকছে। ছাতিম ফুলের গন্ধে চারপাশ ভারি হয়ে উঠেছে। স্মরণ পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরলো। রোজ রাতে ছাতিম ফুলের তীব্র গন্ধের অত্যাচার আর নেয়া যাচ্ছে না। প্রচন্ড বিরক্তিতে সে বসা থেকে উঠে পড়লো। রুমাইসাকে ভেতরে রেখে ঘর থেকে বেড়িয়ে সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

“কে? কে ওখানে?”
কাছারিঘরের সামনে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে গলা ছেড়ে বলল স্মরণ।

“ডাক্তার সাহাব আমি, রমিজ।”

“রমিজ সাহেব? এত রাতে আপনি এখানে কি করছেন, বাড়ি যান নি?”

“জ্যা গেছিলাম ডাক্তার সাহাব, কিন্তু আবার আইতে হইছে।”

স্মরণ এবার আর কথা বাড়ালো না। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর তাকালো। এখন আর তার বুঝতে বাকি রইলো না রুমাইসা এতটা পথ একা একা কি করে এসেছে।

“রমিজ সাহেব উপরে উঠে আসুন কথা আছে আপনার সঙ্গে।”

“ডাক্তার সাহাব আমার কোনো দোষ নাই, আমি ইচ্ছা কইরা কিছু করি নাই।”

“আপনাকে উপরে উঠে আসতে বলেছি।”

রমিজ স্মরণের গম্ভীরস্বর শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। সে ভাবে নি স্মরণ এতে এতটা রেগে যাবে।

“কি হলো রমিজ সাহেব।”

“আইতাছি।”

রমিজ ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। স্মরণ বারান্দার কার্নিশে ভর দিয়ে চেহারায় কঠিনতার ভাব ফুটিয়ে এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কপালের একপাশের সুরু রগ গুলো ধীরেধীরে ফুলে উঠছে, রমিজ সেটা লক্ষ্য করে ভয়ে ফাঁকা ঢোক গিললো। তারপর কিছুটা ইতস্ততভাবে বলল,

“ডাক্তার সাহাব বিশ্বাস করেন আমি তারে আনতে চাই নাই এইহানে।”

স্মরণ তখনো নিশ্চুপে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো। রমিজ হাল্কা কেঁশে আরো দুপা এগিয়ে স্মরণের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল, তারপর আবার আমতা আমতা করে বলল,

“মা মরা মাইয়াটা সারা জীবন সৎ মায়ের লাথিঝাঁটা খাইয়া বড় হইছে, এতটুকু সুখ পায় না কোনো দিন। করিম চাচা তারে বড় যত্ন কইরা বড় করতে চাইছিলো কিন্তু আল্লাহ তো মাইয়াডার কপালে ভালো কিছু লেইখা রাখে নাই। বাপ ডার অসুখ হইয়া গেলো এর মাঝেই আইলো মামা মামী। হুনছি মামাতো ভাইর লগে বিয়া আগেই ঠিক করা আছিলো কিন্তু মাইয়া চাইছে পড়াশুনা কইরা পড়ে বিয়া করে কিন্তু কে হুনে কার কথা সবাই মিলা ধইরা বাইন্দা মাইডারে বিয়া দিতাছে।”

স্মরণ চুপচাপ রমিজের কথা শ্রবণ করে গেলো নিজে কিছুই বলল না।

“আইজ কাল আবার নতুন কথা হুনতাছি কি জানেন ডাক্তার সাহাব। অবশ্যই কথা খান এখনো কেউ জানে না।”
রমিজের কথার ধরণ আর গলার স্বর শুনে স্মরণ তার দিকে ভ্রুকুটি করে তাকালো। তারপর বলল,

“কি শুনেছেন আপনি?”

“লোকে বলাবলি করতাছে ওই মহিলার লগে নাকি রুমাইসার মামার অবৈধ সম্পর্ক আছে।”

“মানে?”
সন্দিহান দৃষ্টিতে বলল স্মরণ।

“আরে করিম চাচার বউ। মানে রুমাইসার সৎ মা আর মামার মধ্যে নাকি কিছু চলতাছে। আবুল চাচার বউ নাকি দেখছে তারগোরে এক লগে কলপাড়ে গোসল করতে। ছি, ছি, ছি, কি দিন আইলো। করিম চাচার মতো ভালা মানুষডার লগে ওই বজ্জাত মহিলা এমন কামডা করতে পারলো?”

“এসব কথা করিম সাহেব জানেন?”

“এইসব কথা কি তারে কওন যায় ডাক্তার সাহাব? মানুষডা তো এমনি হার্টের রুগী, আপনেই তো তার চিকিৎসা করাইলেন। মানুষডার এই অবস্থায় কথা খান হুনলে কি আর বাঁচতে পারবো?”

সব কথা শুনে স্মরণের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। সে রমিজকে নিচে যেতে বলে নিজে আরো কিছুটা সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। রুমাইসার প্রতি তার বড্ড মায়া হচ্ছে। মেয়েটা সত্যি খুব অসহায়। আপন লোকদের কাছে বারবার প্রতারিত হওয়ার মতো ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে।

(৪৩)

সারা বাড়ি খুজেও যখন রুমাইসাকে কোথাও পাওয়া গেলো না তখন নিলুফার বেগম হতাশ ভঙ্গিতে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। বিয়ের দিন সকালে বিয়ে বাড়ি থেকে বউ উদাও এই কথা যেনো বাতাসের আগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মনোয়ারা বেগম ঘরের সামনে সিঁড়িতে বসে পান চিবাচ্ছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না বাড়িতে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তিনি দিব্যি আয়েশ করে পান সাজিয়ে সেটা মুখে তুলে চিবুতে লাগলেন। নিলুফার বেগম পাশে বসে বিলাপ জুড়ে দিয়েছেন। মনোয়ারা বেগম এতে একটু বেশি বিরক্ত হলেন আর বললেন,

“তুমি এমনি বিলাপ জুইড়া দিলা ক্যান বউ? মাইয়া তো আর তোমার যায় নাই তুমি কান্দো ক্যান?”

“আপনি এটা কোনো কথা কইলেন আম্মা? আপনের নাতনীর আইজ বিয়া আর তারে সকাল থেইকা পাওন যাইতাছে না বুঝতে পারতাছেন আমাদের মান সম্মান এখন কই গিয়া দাঁড়াইবো।”

“তুমি নিজেই কি আমাগো মান সম্মান বাড়াইতাছো। ”

“আপনে কি কইতে চাইতাছেন আম্মা?”

“আমি কি কইতে চাই হেইডা তুমি ঠিকই বুঝতে পারছো। আমার নাতনীডারে তো সারা জীবনে সুখ দিলা না, মাইয়াডারে জ্বালাইয়া মারছো আর এখন খুব দরদ উতলাই পড়তাছে।”

“শুনেন আম্মা আপনের নাতনী আইজ আমার যে সর্বনাশ করছে তার জন্য আমি তারে ছাইড়া কথা কমু না। তার মা মইরা শান্তি হয় নাই আমার ঘাড়ে আপদ তুলা দিয়া গেছে।”

বউ শ্বাশুড়ির বাকবিতণ্ডা দেখতে আশেপাশের অনেকেই এসে ভিড় করছে করিম সাহেবের বাড়িতে। বাড়ি ভর্তি আত্নীয় স্বজন আর গ্রামের মানুষদের সামনে করিম সাহেব মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কখনো ভাবতে পারে নি রুমাইসা এমন একটা কান্ড ঘটাবে। গ্রামের কয়েকজন মহিলা এসে নিলুফার বেগমকে শান্তনা দেবার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ নানান রকমের কটূক্তি করছেন। বেশিরভাগ মানুষ নিলুফারকে দোষ দিচ্ছেন, তবে সেসব কথা নিলুফার কানে তুলছেন না। তিনি রুমাইসাকে কয়েকগাদা গালাগালি করে আবার বিলাপ জুড়ে দিলেন।

বসার ঘরে শেহ্ওয়ার কপালে হাত ঠেকিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। মুখে কোনো কথা নেই। মাঝে মাঝে তার বাবা আজমল আহমেদ এটা ওটা বলে সারাঘরে পায়চারী করছেন। নীলা জামান নিশ্চুপে বসে আছেন। আজমল সাহেব কিছুসময় পায়চারি করে শেহ্ওয়ারের পাশে এসে বসলেন। বললেন,

“তুই কিছু বলছিস না কেনো, এভাবে চুপ করে বসে থাকলে তো রুমাইসাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না? ”

“খোজার কি আর কোনো দরকার আছে বাবা?”
গম্ভীরস্বরে উত্তর দিলো শেহ্ওয়ার।

” কি বলতে চাইছিস তুই।”

“ওকে আর খুঁজে লাভ নেই। মেয়েটা আমার কাছ থেকে বরাবরই পালাতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি সেটা বুঝতে চাই নি।”

“এসব কথার কোনো আগা মাথা আমি বুঝতে পারছি না শেহ্ওয়ার। তুই কি বলতে চাইছিস ক্লিয়ার করে বল।”

” দেখো বাবা রুমাইসা শুরু থেকেই বিয়েটা করতে চায় নি বরং আমরাই জোর করে তাকে,,,।”

” তাহলে এখন বুঝতে পারছিস তো জোর করে কিছু করা যায় না।”
নীলা জামান শেহ্ওয়ারকে কড়া গলায় কথাটা বললে শেহ্ওয়ার তার অধরযুগল কিঞ্চিৎ প্রশস্ত করে বলল,

“তুমি তো এটাই চেয়েছিলে তাই না মা?”

“তোরা সকলে মিলে মেয়েটার উপর যা করছিলি সেটা কি খুব ভালো কিছু ছিলো।”

“বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।”

“সেটা কি কয়েক মাস পর করা যেতো না? মেয়েটার সামনে পরীক্ষা এই কথাটা কেউ একটা বার ভেবেছিলো। যত পেরেছিস নিজেদের সিদ্ধান্ত মেয়েটার উপর চাপিয়ে দিয়েছিস। কি হলো শেষে?”

“তুমি চুপ করো তো। ছেলেটার এমনি মন মেজাজ ভালো নেই তার মাঝে তুমি এসব কথা কেনো বলছো।”

নীলা জামান মুখে আর কোনো কথা বললেন না, তবে কড়া দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালেন। আজমল আহমেদ স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নিলেন, হয় তো নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা থেকেই চোখ সরিয়ে ফেললেন।

চলবে,,,,।

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২০

(৪৪)

ঘুম ভেঙে নিজেকে চার দেয়ালে আবদ্ধ একটা ঘরে আবিষ্কার করলো রুমাইসা। ঘুম ঘুম চোখে একবার চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিলো, ঘুমের রেশ তখনো কাটেনি বলে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলো না সে কোথায় আছে। একটু পর যখন সে বুঝতে পারলো জায়গাটা তার সম্পূর্ণ অপরিচিত তখনি সে ত্বরিতগতিতে শোয়া থেকে উঠে বসলো। চার দিকে আরো একবার চোখ বুলিয়ে দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

“আমি এখানে কি করে এলাম!”
বলে রুমাইসা পুরো কক্ষটা আরেকবার অবলোকন করলো। তার মাথায় কিছু কাজ করছে না, ভেবে পাচ্ছে না সে কি করে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে।

রুমাইসা অবাক হয়ে চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখলো। তার যতদূর মনে পড়ে সে চেয়ারম্যান বাড়ির কাছারিঘরে থাকার কথা কিন্তু গতরাতে কাছারিঘরে যা কিছু তার চোখে পড়েছিলো সে সবের কিছুই এই ঘরটায় নেই। অবাক হয়ে পুরো ঘরটা আবারো অবলোকন করতে করতে একটা জায়গায় এসে রুমাইসার চোখ আটকে গেলো। দেয়ালের একস্থান দখল করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড একটা আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি নজরে এলে অন্তঃকরণ হতে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, মনে পড়ে যায় গতরাতে ঘটে যাওয়া প্রতিটা কথা।হলুদের সাজে মাঝরাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিলো সে।ছুটে গিয়েছিলো চেয়ারম্যান বাড়ির কাছারিঘরের দোরগোড়ায়। তারপর কি হলো? মনে করেই রুমাইসার চোখ বেয়ে টপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। পড়নে সবুজ পাড় হলুদ শাড়ি, গা ভর্তি কাঁচা ফুলের গহনা, হাতে মেহেদি, কপাল আর গালের দুইপাশে হলুদ লেপ্টে শুকিয়ে আছে, চুল গুলো এলোমেলো হয়ে একপাশে পড়ে আছে, নিজের এমন প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রুমাইসা। জীবন তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে ভাবতেই ভেতরটা হু হু করে উঠলো।

বাহিরে সোনালি রোদ ঝলমল করছে, পর্দার আড়াল হতে জানাল ফাঁকে উঁকি দেয়া একটুকরো সোনালি রোদ এসে রুমাইসার পায়ের কাছে লম্বালম্বি হয়ে পড়েছে। রুমাইসা আয়নার পাশ থেকে সরে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। দুই হাতে পর্দা সরিয়ে জানালার কবাট উন্মক্ত করতেই তার চোখের সামনে ভেসে এলো পুষ্প মণ্ডিত একটি উদ্যান। ফুলে ফুলে ভরা একটুকরো স্বর্গ যেনো রুমাইসার চোখে এসে ধরা দিলো। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মাথায় অন্য চিন্তা এসে ভর করলো।

“আমি কোথায় আছি? আর এই জায়গাটাই বা কোথায়। আচ্ছা আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে?”
নিজের মনে মনে এসব প্রশ্ন আওড়াতে থাকলো রুমাইসা আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শেহ্ওয়ারের মুখটা তার চোখে ভেসে উঠলো।

“তার মানে উনিই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।”

“উনি টুনি কেউ আপনাকে এখানে নিয়ে আসে নি মিস রুমাইসা।”

পেছন থেকে স্মরণের কন্ঠস্বর কানে বাজতেই চমকে উঠলো রুমাইসা। সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে তাকালো। স্মরণ তার চেয়ে দুহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। সে আশ্চর্য হয়ে চারপাশে দেখে স্মরণের দিকে তাকালো।

“কি ভাবছেন এখানে কি করে এলেন?”

রুমাইসা সহসা কিছু বলতে পারলো না, নিশ্চুপে মাথানত করলো। স্মরণ কয়েক পা এগিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

“রাতের শেষ প্রহরের খানিকক্ষণ আগে আপনাকে সঙ্গে করে নিশ্চিন্দপুর গ্রাম ছেড়েছিলাম, অবশ্য তখন আপনি অচেতন অবস্থায় ছিলেন। এ ব্যাপারে মি.রমিজ কিছুটা সাহায্য করেছিলেন।”

রুমাইসা এবার চোখ তুলে তাকালো স্মরণের দিকে। তার চোখ দুটো ভিজে উঠেছে ইতিমধ্যে। এই মানুষটা যে শেষ পর্যন্ত তাকে সাহায্য করবে এমনটা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি সে। কৃতজ্ঞতায় রুমাইসার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

“মিস রুমাইসা আপনাকে নিয়ে আমি বেশি দূর পর্যন্ত আসতে পারি নি। আপাতত আপনার এলাকাতেই আছি এখনো।”

“মানে আমরা এখনো নিশ্চিন্দপুর আছি?”

“আপনি বোধহয় আমার প্রথম কথাটা মন দিয়ে শুনেন নি।”

স্মরণের কথায় এক করম লজ্জা পেলো রুমাইসা। সত্যি সে স্মরণের কথা মন দিয়ে শুনে নি। তার মনে এখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সকাল সকাল যখন বাড়ির সকলে জানবে সে ঘরে নেই তখন কি হবে? বিয়ের আগের দিন রাতে বউ পালিয়েছে এ কথা এতক্ষণে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নানান মানুষ তাকে নিয়ে নানান কথা বলছে, এই নিয়ে তার বাবাকে ছোট হতে হবে গ্রামবাসীর কাছে। আচ্ছা এত অপমান কি তার বাবা সহ্য করতে পারবে? ভেবেই রুমাইসার অন্তঃকরণ প্রচন্ড যন্ত্রণা হতে লাগলো। বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ভেতরটা গুড়িয়ে যেতে চাইলো।

“কি ভাবছেন?”

“লোকে আমার বাবাকে খারাপ খারাপ কথা বলবে তাই না।”
ভাবলেশহীন ভাবে বলল রুমাইসা।

“এটা আপনার এখন নয় গতকাল রাতেই ভাবা উচিৎ ছিলো।”

“কিন্তু তারা যে আমার বাবাকে ঠকাচ্ছে তার বেলায় তাদের কেউ কিছু বলবে না?”

স্মরণ ভ্রুকুটি করে তাকালো রুমাইসার দিকে। রুমাইসা অন্যমনষ্ক হয়ে ভুল করে কথাটা বলে ফেলেছে বুঝতে পেরে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। স্মরণ বুঝতে পেরেছে রুমাইসা ঠিক কি বলতে চেয়েছে, গতকাল রাতেই সে সব রমিজের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলো তাই আর এ ব্যাপারে কোনো কথা বাড়ায় নি সে।

“এই নিন এই ব্যাগটাতে আপনার কিছু জামা কাপড় আছে। ওগুলো ছেড়ে এগুলো পড়ে নিন। আর হ্যাঁ আজ রাতের ট্রেনে আমরা ঢাকায় যাচ্ছি আপাতত আজকের দিনটা এই ঘরের মধ্যেই কাটাতে হবে আপনার।”

রুমাইসা চুপচাপ মেনে নিলো স্মরণের কথা। স্মরণ কিছুটা সময় রুমাইসাকে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো। এই কয়দিনে মেয়েটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে গভীর ভাবে, ক্র জানে কত রাত ঠিক করে ঘুমোয় নি।

“মিস রুমাইসা একটু পর রমিজ সাহেব এখানে আসবেন।”

রুমাইসা মুখে কিছু না বলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো। স্মরণ এবার জানালার কাছ থেকে সরে এসে রুমাইসার সামনে দাঁড়াল। তারপর বলল,

” সামনে আপনার এক্সাম। তাই বই এবং স্কুল থেকে আপনার কাগজ পত্র সব তুলে আনার ব্যাবস্থা করেছি।”

“কিন্তু স্কুল থেকে কাগজপত্র তুলতে গেলে তো সবাই,,,।”

“ওটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না সে সব আমি দেখে নিয়েছি। এবার যান চেইঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি একবার হাসপাতাল ভিজিট করে আসি। আজকে এখানে আমার শেষ দিন তাই কিছু কাজ আছে সেগুলো সেরে আসছি।”
বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো স্মরণ। রুমাইসা ক্ষানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে পড়ে ওয়াশরুমের দিলে চলে গেলো।

(৪৫)

দুপুরের পর রমিজ শুভ্রনগর এসে উপস্থিত হলো। প্রায় আধ ঘন্টা যাবত সে স্মরণের চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে তার দেখা পেলো। স্মরণ রমিজকে ইশারা করে চেম্বারে আসতে বললো। রমিজ চেম্বারে ডুকলে স্মরণ তাকে চেয়ারে বসতে বলে নিজেই উঠে আলমারির কাছে গেলো। সেখান থেকে কয়েকটা খাম বের করে ফিরে এসে নিজের স্থান দখল করে বসলো তারপর বলল,

“ওখানে কি অবস্থা? আর যা যা বলেছিস সব করতে পেরেছেন তো রমিজ সাহেব।”

“জ্বী ডাক্তার সাহাব সব কাম কইরা আইছি। স্কুলে গিয়া হেডমাস্টারের লগে সব কথা কইয়া আইছি। উনি কথা দিছেন এই ব্যাপারে তিনি কাউরে কিছু জানতে দিবো না। ”
বলেই রমিজ স্মরণের দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিলো। স্মরণ ফাইলটা এক নজর দেখে বলল,

“মিস রুমাইসাকে এখানে এসেই পরীক্ষাটা দিতে হবে, আর কিছু করার নেই। উনার বই গুলো নিয়ে এসেছেন তো।”

“হ, আনছি। বাহিরে রাইখা আইছি।”

“ভালো করেছেন। আর ওই দিকের কি অবস্থা?”

“খবর খুব একটা ভালা না ডাক্তার সাহাব। রুমাইসার মামা খুব ঝামেলা করতাছে যেই কইরাই হোক বিয়া দেওনের কথা কইতে হুনছি।”

“মানে? মিস রুমাইসা তো নেই কি করে বিয়ে হবে?”

“কি কইরা আর হইবো এখন করিম চাচার ছোড মাইয়া রিমা আছে না তার লগে বিয়ার কথা কইতাছে ওই মহিলা।”

“হাউ স্ট্রেঞ্জ, রিমা তো বেশ ছোট ওর সাথে বিয়ে এটা কি করে ভাবছেন তারা। করিম সাহেব কিছু বলছেন না কেনো?”

“উনি আর কি কইবো অসুস্থ মানুষ। তয় উনি রুমাইসারে নিয়া চিন্তায় আছে। বিয়ার যত কিছু আছে সব ওই মহিলাই করতাছে। উনিই কইতাছে রিমারে ওই পোলার লগে বিয়া দিতো।”

“শেহ্ওয়ার কিছু বলছেন না এ ব্যাপারে? উনি একটা বাচ্চা মেয়েকে কি করে বিয়ে করতে পারেন?”

“ওই পোলা এখনো কিছুই জানে না, হে বের হইছে রুমাইসারে খুঁজত।”

স্মরণ সব কিছু জেনে আর তেমন কিছুই বলল না। একটা মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে অন্য মেয়েটা নিজেই বিপদে পড়লো। এই মুহূর্তে আর কি বা করার আছে তার।

চলবে,,,,।