#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_28
পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত শব্দটাই বোধহয় ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। কত প্রতারণা, ছলনার গল্প মিশে থাকে এই একটা শব্দতে। কঠিন এই শব্দটাকে আরোও প্রগাঢ় করে তুলতে আপন মানুষগুলোই যথেষ্ট। কত সহজেই মানুষ বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে নেয়! মুখোশের আড়ালের নিকৃষ্ট মানুষগুলোকে পরিচিতি দিতেই হয়তো এই শব্দের সৃষ্টি। সাঁকোর দু’ধারে দুই সাম্রাজ্যের মানুষের ঘোড়া বেঁধে রাখা হয়েছে। সাঁকোর পানিতে ভেসে থাকা লাশগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই এখন। ভেসে গেছে বোধহয় প্রবল স্রোতের টানে। সাঁকোর ঠিক মাঝ বরাবর বিস্মিত, শীতল ভঙিমায় মাইরার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে বেগম। আতঙ্কিত দৃষ্টি মাইরার। ভয়ের তাড়নায় মৃদু কাঁপছে তার শরীর। আকস্মাৎ ধরা পড়াতে শিথিল হয়ে এসেছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো। কিছুটা দূরেই বেগমের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সুলতান। তার ভঙ্গিমা বোঝা বড় দায়। কী শীতল তার অভিব্যক্তি! অথচ এই মানুষটাই যে কতটা হিং’স্র হয়ে উঠতে পারে তার ধারনা কি রাখে বেগম? মাইরাকে দেখে বুঝি কথা বলতে ভুলেছে বেগম। মাইরা! তার বোন তাকে হ’ত্যা করতে চায়! মস্তিষ্কের চারপাশ হাতরেও সে খুঁজে পেল না তাকে মা’রতে চাওয়ার কারন। শুধুমাত্র তার ক্ষতি করতে মহল থেকে নথিপত্র গায়েব করা থেকে শুরু করে শত্রুর সাথে হাত মেলানো সবকিছুই করেছে মাইরা। কিন্তু কেন? কী এমন ক্ষতি করেছে সে মাইরার! কাচুমাচু হয়ে মাইরা কিছু বলতে নিবে। থামিয়ে দিলো বেগম। গলার খাদ স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। অন্তত নরম গলায় বলে উঠলো,
“কেন? কী কারনে মাইরা?”
কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না মাইরা। হুট করে এভাবে সরাসরি ধরা পড়ে যাবে তা সে আন্দাজও করতে পারেনি। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলারও কোনো উপায় রাখেনি সুলতান। তার সমস্ত অপকর্ম সম্পর্কে অবগত সে। দাঁত কিড়মিড় করে উঠলো মাইরা। এই পুরুষটা অত্যধিক বিচক্ষণ! চাল চালতে যেন ওস্তাদ! দারিয়া যখন তাকে বার্তাবাহক মারফত জানিয়েছিল সুলতান শাহজাইন তার বশে চলে এসেছে পুরোপুরি, তখনই সন্দেহ হয়েছিল তার। সুলতান তো এতো সহজে কাবু হবার লোক নয়। তাও আবার পরনারীতে! এ তো একেবারে অসম্ভব! এমন হলে যখন তার সাথে বিবাহের আলাপ আলোচনা চলছিল তখনই গলে পড়তে পারতো সে। তখন তো এলিজাও ছিলো না। এমনকি কেউ জানতোও না এলিজা বেঁচে আছে। দারিয়া বোকা মেয়েটা সুলতানের অভিনয়ে গলে গিয়ে সব বলে দিয়েছে। অকর্মণ্য কোথাকার! নিজেতো ফেঁসেছে সাথে তাকেও ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এখন পথ একটাই। এখন এলিজার সাথে আবেগি খেল খেলা ছাড়া উপায় নেই। এলিজাই পারবে তাকে এই সুলতানের আক্রোশ থেকে বাঁচাতে। সে কিছুটা সময় নিলো কথা সাজিয়ে নিতে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো, “আমার ভুল হয়ে গেছে আপু। ক্ষমা করে দে।”
“ক্ষমা চাইছিস? কোন কারনে আমাকে হ’ত্যা করতে চাস মাইরা? তোর বড় কোনো ক্ষতি করেছি আমি?”
ধরে এলো বেগমের কন্ঠ। নিজের বোন তাকে হ’ত্যা করতে চায় এ সত্য যে সে কিছুতেই মানতে পারছে না। বিষাক্ত একটা রাত কাটাতে না কাটাতেই এমন সত্য সামনে এসে ধরা দিলো! কখনো সুলতানের নিষ্ঠুর অভিনয় তো কখনো মাইরার কঠিন সত্য। এতোকিছু সহ্য করবে কীভাবে সে? এগিয়ে এলো সুলতান। আলতো করে হাত রাখলো বেগমের কাঁধে। দু’জন চোখ ধাঁধানো সুন্দরী নারী মুখোমুখি। দু’জনের রূপ থেকে শুরু করে শরীরের গড়ন, বাচনভঙ্গি এমনকি চোখের হালকা বাদামি বর্ণটাও একই রকম মিল কিন্তু চরিত্রের মাঝে কী আকাশ-পাতাল তফাত! একজনের প্রতি রয়েছে সুলতানের ভয়ঙ্কর ভালোবাসা অন্যজনের প্রতি শুধুই ঘৃণা। মাইরা অশ্রুভেজা কন্ঠে আবারো কিছু বলতে চাইল। পূর্বেই সুলতান বলে উঠলো, “ও ছোট থেকেই তোমাকে সহ্য করতে পারে না। এক কথায় যাকে বলে হিংসা। তোমার পিতা তোমাকে অধিক ভালোবাসতো মাইরার তুলনায়। হয়তো আম্মার অভাব দূর করতেই তার এই আচরণ ছিলো। তোমাকে সবসময় নিজের কাছাকাছি রাখতো আর মাইরা থাকতো তার আম্মার কাছে। পিতার কাছে যাবার সুযোগ খুব একটা পায়নি ও। যা থেকে মাইরার মনে ধীরে ধীরে তোমার জন্য ঘৃণার জন্ম হতে থাকে। এরপর তোমার পিতা তার সাম্রাজ্য তুলে দিতে চাইল তোমার হাতে। মূলত এটাই সবচেয়ে বড় কারণ তোমাকে হ’ত্যা করতে চাওয়ার। সাম্রাজ্য চাই ওর। তখন থেকেই পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ও। তারপর যখন আমাদের মহলে এলো তখন তোমার সুখ দেখে ওর সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেছে। ওর মতে ছোট থেকে সবসময় সবার ভালোবাসা তুমিই পেয়ে এসেছো আর ও অবহেলা। যদিও এটা সত্য নয় তবুও এই মেয়ে এটা মানে। তাই তোমাকেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাই যেন সমস্ত ভালোবাসা ও একা পায়। এমনকি ও জেনেশুনেই বিবাহতে সম্মতি দিয়েছিলো তোমার সুখ নিজে ভোগ করবে বলে। কিন্তু পরে অবস্থা বেগতিক দেখে খুব নিখুঁত অভিনয় করেছিলো যেন সে এই বিবাহে রাজিই নয়।”
“ওনার কথা বিশ্বাস করিস না আপু। উনি মিথ্যা কথা বলছে। তোকে এসব বুঝিয়ে আমাকে হ’ত্যা করতে চাইছে।” চিৎকার করে উঠলো মাইরা।
অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো সুলতান। পুনরায় নরম কন্ঠে বলল, “এগুলো সব সত্যি এলি। তোমাকে মানতে হবে সত্যিটা। আমি মিথ্যা কথা বললেও মাইরার লেখা পত্র তো মিথ্যা কথা বলবে না। দারিয়াকে পাঠানো ওর পত্রগুলোই সাক্ষী দেবে ওর বিরুদ্ধে। সেখানে পরিষ্কার লেখা আছে আমার বলা কথাগুলো।”
“এই লোকটা আমাকে ফাঁসাতে চাইছে আপু। এই লোকটার আসল রূপ তুই জানিস না। তোর মনে আছে বিবাহের পর একদিন তুই সাধারনের বেশে সাম্রাজ্য ঘুরতে বেরিয়েছিলি তখন কিছু বখাটে ছেলেপেলে তোকে আজেবাজে কথা বলেছিলো?”
ভ্রু কুচকাল বেগম। বলল, “সে তো অনেক বছর আগের কথা। এখন কেন এসব বলছিস?”
“সেই ছেলেগুলোর আর কোনো খোঁজ পেয়েছিলি?”
“না, ওদের শাস্তি দেওয়ার জন্য সৈনিক পাঠিয়ে খুঁজেছিলাম আমি। কিন্তু ওরা কোথায় যেন চলে গেছিল তাই পায়নি কাউকেই। এতোদিনে তো সব ভুলেও গেছি আমি। তুই কেন এগুলো বলছিস এখন?”
“পাবি কীভাবে? এই সুলতান ওদের সবাইকে মে’রে ফেলেছে। শুধু ঐ ছেলেগুলো নয় এখনো পর্যন্ত যতগুলো মানুষ তোর দিকে খারাপ নজরে তাকিয়েছে, তোর বিরুদ্ধে কিছু বলেছে সবাইকে এই লোক গায়েব করে দিয়েছে। তার এই নির্দয় রূপ সে সবসময় লুকিয়ে রাখে তোর থেকে। তোর সামনে যতটা ভোলাভালা সেজে থাকে তোর আড়ালে ততটাই হিং’স্র এই মানুষটা। আমাকেও মে’রে ফেলবে। আমাকে বাঁচা আপু।”
আৎকে উঠলো বেগম। হতবাক নয়নে তাকালো সুলতানের দিকে। কী মায়া এই চেহারায়! তার সাথে যখন কথা বলে কী শান্ত আর ভালোবাসা মিশ্রিত তার প্রতিটা বাক্য! সে কীভাবে হিং’স্র হতে পারে? এতোগুলো দিনেও সে কখনো সুলতানের কোনোরকম হিং’স্রতা দেখেনি। দারিয়াকে হ’ত্যা করা প্রয়োজন ছিলো তাই করেছে। এতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু ঐ ছেলেগুলোর তো মৃত্যুর শাস্তি পাওয়ার মতো দোষ ছিলো না। মাইরা কি মিথ্যা কথা বলছে?
মাইরা পুনরায় বলল, “বিশ্বাস না হলে মহলে ফিরে পরিক্ষা করে নিস। কিছুদিন আগে যে জিদান নামক ছেলেটাকে বন্দি করেছিস। গিয়ে দেখিস সে বেঁচে আছে কি-না। আমি নিশ্চিত এই লোকটা তাকেও মে’রে ফেলেছে।”
এতোগুলো কড়া অভিযোগ দেওয়ার পরেও নীরব, নিশ্চুপ সুলতান। ভাবখানা এমন যেন কিছুই হয়নি। শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো বেগম। অভিযোগগুলো সত্যি হলে তো সুলতান অবশ্যই উত্তেজিত হয়ে পড়তো। এভাবে অন্তত শান্ত থাকতে পারতো না। হুট করে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল বেগমের। মাইরার দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, “অনেক হয়েছে তোর মিথ্যাচার। আর নয়। একেতো নিজে এতবড় অন্যায় করছিস আবার এখন আমার সংসার ভাঙার খোরাক জোগাচ্ছিস? তোর সাম্রাজ্য চাই তো? ঠিক আছে, আমি কথা বলবো আব্বার সাথে। পেয়ে যাবি তুই সাম্রাজ্য। এখন দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। আর কোনোদিন তোকে দেখতে চাই না আমি। বোন হবার যোগ্যই নোস তুই। সম্পর্কের মাঝে হিংসা বিদ্বেষ, প্রতারণা ঢুকে পড়লে সেই সম্পর্ক কখনোই টিকিয়ে রাখা যায় না। চলে যা তুই।”
“তোমার বোন বলেই কি ছেড়ে দিচ্ছ তাকে? ও যে আবার তোমাকে হ’ত্যা করার পরিকল্পনা করবে না তার নিশ্চয়তা কী? এখন একটু কেঁদে কেটে ক্ষমা চাইল আর তুমিও গলে গিয়ে মাফ করে দিলে! অথচ এই বোনই তোমাকে হ’ত্যা করতে কী না কী করেছে!” গম্ভীর কন্ঠ সুলতানের।
“আমার ছোট বোন ও। কী শাস্তি দিতে বলছেন আপনি? তাছাড়া ওর লাগবে সাম্রাজ্য। সেটা পেয়ে গেলে আবার কেন আমাকে হ’ত্যা করতে চাইবে? আর কিছুই করবে না। আমি কথা বলবো বললাম তো আব্বার সাথে।”
বেগমের কাতর কন্ঠকে উপেক্ষা করলো সুলতান। বদলে গেল তার মুখভঙ্গি। আচমকা তেড়ে গিয়ে তলোয়ার চেপে ধরলো মাইরার গলায়। হিসহিসিয়ে বলে উঠলো, “কিন্তু ওর শাস্তি মৃত্যু। আমাদের জীবনের দুটো বছর বিষাদে রেঙেছে শুধু ওর চক্রান্তের কারনে। সেদিন যদি সত্যিই তোমাকে হত্যা করতে সক্ষম হতো তাহলে কী হতো আমার? আজ ওকে ছেড়ে দিলে আবারো তোমাকে মা’রতে চাইবে ও।”
কথা বলতে বলতেই তলোয়ারে খানিকটা চাপ প্রয়োগ করলো সে। ততক্ষণাৎ গলা চিরে রক্ত ঝরতে শুরু করলো। ঘাবড়ে গেল মাইরা। গলা লম্বা করে চোখ বড়বড় করে দেখলো তলোয়ার। ভীত হয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “আপু বাঁচা আমাকে।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে আসলো বেগম। পেছন থেকে সুলতানের বাহু টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করলো। উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “করছেন টা কী? ছেড়ে দিন ওকে। ওর কিছু হলে আমার আম্মা কখনোই ক্ষমা করবে না আমাকে। সে এমনিতেই আমাকে ভালোবাসতে দু’বার ভাবে। এরপর আমার কারনে মাইরার ক্ষতি হলে কখনোই আমাকে ভালোবাসবে না সে।”
ছেড়ে দিলো সুলতান। সরে আসলো মাইরার থেকে। বেগমের দু’বাহু চেপে ধরলো সহসাই। চিৎকার করে বলে উঠলো, “কী প্রয়োজন তার ভালোবাসার? আমি আছি তো তোমাকে ভালোবাসার জন্য। আর কারোর প্রয়োজন নেই। আমি একাই যথেষ্ট তোমাকে ভালোবাসার জন্য। তুমি কি ভাবছো তার মেয়ে তার কোলের কাছে থেকে এতোগুলো ষড়যন্ত্র করলো আর সে কিছুই জানতো না? মাছুম নয় সে। তার ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার।”
“কিন্তু আমি আম্মার ভালোবাসাও চাই। ছেড়ে দিন ওকে।”
রাগে সজোরে তলোয়ার ছুড়ে ফেলল সুলতান। হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো রাগ দমাতে। কয়েকবার বড়বড় শ্বাস ফেলে আবারো অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মাইরার দিকে। পারলে যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিতো তাকে। বেগমের আড়ালেই গলার রক্ত ছুঁয়ে ক্রুর হাসলো মাইরা। জিতে যাওয়ার হাসি। দৃষ্টিতে হিং’স্রতা। দু’নয়ন কঠিন করে বলে দিচ্ছে সুযোগ পেলে আবারো সে হ’ত্যার পরিকল্পনা সাজাবে। কাঁদো কাঁদো হয়ে আল্লাদি গলায় বলল, “তুই আমাকে মাফ করেছিস তো আপু?”
“হ্যাঁ, চলে যা তুই। তোর চেহারা দেখতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
কথা শেষ করতে না করতেই তার হাত টেনে ধরলো সুলতান। গম্ভীর স্বরে বলল, “তাহলে শাস্তি দেবে না তুমি?”
তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো বেগম। তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বদলে তার অন্য হাত টেনে নিজের মাথায় চেপে ধরলো। ধরা গলায় বলল, “আমার মাথা ছুঁয়ে কথা দিন ওকে মা’রবেন না আপনি।”
“কী করছো এসব? ছাড়ো।”
হাত টেনে নামিয়ে নিতে চাইল সুলতান। ভিজে উঠলো বেগমের নয়নজোরা। সে উপলব্ধি করতে পারছে সুলতান মরিয়া হয়ে উঠেছে মাইরাকে শাস্তি দিতে কিন্তু এতে তার পিতা-মাতা মৃ’ত্যু সমান কষ্ট পাবে। নেত্র গড়িয়ে দু’ফোঁটা পানি পড়তেই আৎকে উঠলো সুলতান। সহসা তার মাথা টেনে নিজের বক্ষে চেপে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে উত্তেজিত স্বরে বলল, “কাঁদে না পাখি। দেখো, তলোয়ার ফেলে দিয়েছি। কথা দিচ্ছি ওকে মা’রবো না আমি।”
তার বুকের ওপরের পোশাক খামচে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বেগম। কিছুতেই এই অশ্রু যেন বাঁধ মানছে না। এই অশ্রু মাইরাকে বাঁচাতে নয় বরং বোনের করা বিশ্বাসঘাতকতা অশ্রু ঝরাতে বাধ্য করছে তাকে। অবিরত কান্নাতে ঘাবড়ে যাচ্ছে সুলতান। অসহায় হয়েছে তার মুখভঙ্গি। সে আরো শক্ত করে বেগমের মাথা চেপে ধরলো নিজের বুকের সাথে। আহত গলায় বলল, “কাঁদছ কেন? এই তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি মাইরার শরীরে একটা আঁচড়ও কাটবো না আমি।”
দু’হাতের আজলা ভরে পরম আদরে তুলে ধরলো বেগমের মুখটা। ক্রন্দনরত দুই চোখের পাতায় চুমু এঁকে বলল, “উঁহু, আর কাঁদে না। দেখি তাকাও আমার দিকে।”
ছলছল নয়নে মুখ তুলল বেগম। সুলতানের চোখে চোখ রাখতেই কান্না থেমে গেল তার। এক মুহুর্তেই কেমন ঘাবড়ে গেছে মানুষটা। কে বলে সে হিং’স্র? তাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে দুষ্টু হাসলো সুলতান। মাইরার দিকে এক নজর দেখে নিয়ে বেগমের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “গলা জড়িয়ে ধরো তো একটু।”
“কিহ! কেন?” বিস্ফোরক দৃষ্টিতে শুধাল বেগম।
“আরে ধরোই না। তারপর তো দেখবে।”
কিছু না ভেবেই গলা জড়িয়ে ধরে বেগম। ততক্ষণাৎ তাকে শূন্যে ভাসিয়ে তুলল সুলতান। কোলে তুলে হাঁটতে লাগলো ঘোড়ার দিকে। বেগম বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “কী হচ্ছে এসব?”
“ভালোবাসা।” সহজ, সরল স্বীকারোক্তি সুলতানের।
তাকে ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে নিজেও চড়ে বসলো। লাগাম টেনে ধরে ঘোড়া ছোটালো সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্যে। এবার আর ছটফট করছে না বেগম। প্রতারণার অনিলে স্তব্ধ তার হৃদয়। ভালোবাসার মানুষটার শরীরের উষ্ণতাও কাবু করতে পারছে না তাকে। একধ্যানে সামনের দিকে চেয়ে আছে সে। মাইরা এখনো সাঁকোর মাঝ বরাবর মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে বেগম দৃষ্টির আড়াল হবার। কিন্তু তাকে চমকে গিয়ে ঘোড়া সাঁকোর মাঝ বরাবর আসতেই নিজের বাহু উচিয়ে বেগমের দৃষ্টি আড়াল করলো সুলতান। ঘোড়ার গতি খুবই অল্প। মাইরাকে পেরিয়ে গিয়ে সুলতান আবারো ফিরে তাকালো তার দিকে। বেগমের দৃষ্টির আড়ালে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে বাঁকা হাসলো সে। বড্ড রহস্যময় সেই হাসি। ঘাবড়ে গেল মাইরা। সুলতান তো এলিজাকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছে। তাহলে আবার এভাবে তাকাচ্ছে কেন? এলিজাকে ছুঁয়ে কথা দেওয়ার পরেও কি সে ওয়াদা ভঙ্গ করবে? মে’রে ফেলবে তাকে! পরক্ষণেই নিজ মনে হেসে উঠলো সে। ওয়াদা ভঙ্গ করে তাকে হ’ত্যা করলে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করবে সুলতান। সে জানে না এলিজার জেদ কতটা দৃঢ়। ওয়াদা ভঙ্গ করলে এক নিমেষেই তার সঙ্গ ছেড়ে দেবে এলিজা। তীব্রভাবে ঘৃণা করবে সুলতানকে। আর এমনটা ঘটলে সুলতান জিন্দা লাশ হয়ে যাবে। এলিজার ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে তো সুলতান?
ততক্ষণে সাঁকোর সামনে চলে এসেছে মাহতাবের ঘোড়া। তার সাথেই পেছনে বসে আছে বণিক। দূর থেকেই সুলতানের দৃষ্টি লক্ষ করলো তারা। ক্ষণিকেই মাহতাব বুঝে নিলো সুলতানের চাহনি। সুলতানের দৃষ্টি তার দিকে পড়তেই ডানে-বামে মাথা নাড়ালো মাহতাব। হয়তো কিছু একটা করতে নিষেধ করছে সে। উশখুশ করছে বেগম। সুলতানের হাত চোখের পাশ থেকে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, “এমনভাবে চেপে ধরেছেন কিছু দেখতেই পাচ্ছি না আমি। ঘোড়ার খুড়ের শব্দ শুনলাম মনে হলো। মাহতাব চলে এসেছে বোধহয়। দেখি হাত সরান। দেখতে দেন আমাকে।”
“কে আসলো না আসলো তোমার দেখার দরকার নেই। আমাকে দেখো তুমি। মাহতাব আসেনি এখনো। আমার হাত সরিয়ে মাহতাবকে দেখবে না কি বণিককে দেখবে?”
“কাউকেই দেখবো না আমি। চোখটাও ঢেকে রাখুন হাত দিয়ে। শুধু শুধু এটুকু দেখতে দিয়ে কী হবে? অসহ্য।”
বেগমের ঝাঁঝালো স্বরেও মুচকি হাসলো সুলতান। সত্যি সত্যিই নিজের হাত দিয়ে ঢেকে দিলো বেগমের চোখদুটো। কানের কাছে সামান্য ঝুঁকে এসে নেশালো স্বরে বলল, “চাইলে আমাকে দেখতে পারো তুমি। দেখতে দেখতে নেশা হয়ে গেলে দুয়েকটা চুমুও দিতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না।”
হাল ছেড়ে দিয়ে চুপ করে রইল বেগম। অযথা কথা বলে এভাবে অত্যাচার সহ্য করার কোনো মানে হয়না। তার চোখ থেকে হাত না সরিয়েই সুলতান পেছনে ফিরে মাহতাবকে কিছু একটা ইশারা করলো। অতঃপর ঘোড়া ছোটালো জোর গতিতে। বেগমকে আঁকড়ে ধরে ছুটে চলল অরণ্যের মাঝ দিয়ে। সাঁকোর মাঝ বরাবর থেমে গেল মাহতাবের ঘোড়া। মাইরার দিকে চেয়ে কোমর থেকে খুলে নিলো নিজের তলোয়ার। ঘোড়া থেকে নামতে নামতে বণিককে উদ্দেশ্য করে খুবই শান্ত স্বরে বলল, “এখন যা ঘটবে তা যদি কোনোভাবে সুলতানার কান অব্দি যায় তাহলে সেদিনই হবে তোমার জীবনের শেষ দিন। সামনের মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছ? এই মেয়েটা সুলতানাকে মা’রার চেষ্টা করেছে এমনকি এখনো মা’রতে চায় তাকে। তার জন্য নিশ্চয়ই তোমার মনে মায়ার সঞ্চার হবে না? শুনেছি, সুলতানাকে ভালোবাসো তুমি। তাই আবারো বলছি, সত্যবাদি যুধিষ্ঠির হতে যেও না।”
অন্যদিকে প্রধান ফটকের সামনে এসে ঘোড়া থামতেই নেমে পড়লো বেগম। এক পলকও সুলতানের দিকে না তাকিয়ে ছুটে গেল মহলের ভেতরে। উল্টোদিকের অনিলে উড়তে থাকা তার নীল গাউনের দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকলো সুলতান। কী হলো এটা? প্রধান দ্বার পেরিয়ে তার দিকে দৌড়ে এলো ওয়াসিফা সুলতান। আবেগি গলায় বলল, “শাহজাইন!”
সমস্ত সৈনিক মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলো তাকে। ঘোড়া থেকে নেমে সে এগিয়ে গেল মায়ের দিকে। আলতো হেসে সালাম প্রদান করে বলল, “কেমন আছেন আম্মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ বাজান। তুমি কেমন আছো? কী হয়েছিল তোমার?”
“আল্লাহ রেখেছে ভালোই। উমার প্রতারণা করে সবাইকে মেরে আমাকে বন্দি করেছিলো। এখন সব ঠিক আছে। দ্রুতই উমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। তানহা, তোহফা, জারনাব ওরা কোথায়?”
“জারনাব মনে হয় ওর পিতার কাছে। তোমার কন্যা ঘুমাচ্ছে নিজ কামরায়। আর তানহার বিবাহের জন্য পাত্র দেখেছি তাই নারাজ হয়ে দ্বার আটকে বসে আছে। তুমি একটু বুঝিয়ে বলোতো ওকে। বিবাহের বয়স হয়েছে, বিবাহ তো দিতেই হবে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না আম্মা। আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো। হতে পারে ওর নিজস্ব কোনো পছন্দ আছে। সেটাও তো আগে জানতে হবে আমাদের। আব্বাজান কোথায়?”
“তার কি আর ঠিক ঠিকানা আছে? না জানি কোথায় কোথায় ঘুরছে। তুমি একা আসলে যে? মাহতাব! মাহতাবকেও কি ওরা?” আতঙ্ক ধরা দিলো ওয়াসিফা সুলতানের মুখশ্রীতে।
আশ্বস্ত করলো সুলতান, “মাহতাব ঠিক আছে। আসছে পেছনে। একটু ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তবে গুরুতর কিছু নয়।”
কথা বলতে বলতেই মহলে পৌঁছে গেছে তারা। সুলতান হন্তদন্ত হয়ে এগোতে নিলে ডেকে উঠলো ওয়াসিফা সুলতান, “মাত্রই আসলে আবার হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটলে? সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করো।”
“আগুন নেভাতে যাচ্ছি আম্মা। দেখা সাক্ষাৎ পরেও করা যাবে।”
“আগুন! সে কী! কোথায় আগুন লাগলো?”
“আপনার বৌমার মাথায়। দপদপ করে দাবানল জ্বলছে।”
ছেলের কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে চোখ রাঙিয়ে তাকালো ওয়াসিফা সুলতান। বিড়বিড়িয়ে বলল, “এ আর নতুন কী? সবসময় তো লেগেই থাকে। এলিজা কাল গেল আর আজই তুমি চলে আসলে তাহলে বোঝো আগুনের শক্তি কতটা”
জিদানের কারাগারের দিকে ছুটছিল বেগম। জিদান ঠিক আছে না কি আগে দেখতে হবে। কিন্তু তার মন কিছুতেই মানছে না সুলতান এমন করতে পারে বলে। বারবার মন বলছে মাইরা মিথ্যা কথা বেলছে। আকস্মাৎ পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো সুলতান। রাগান্বিত হলো বেগম। বিরক্ত কন্ঠে বলল, “আবার কী চাই?”
“তোমাকে। মানে গোসল করতে হবে, চলো। গোসল করে দ্রুত পোশাক বদলে নাও। হাত-পায়ে ওষুধ লাগাতে হবে তোমার। তাছাড়া ক্ষুধাও লেগেছে খুব।”
“পায়ে! পায়ে আবার কী হয়েছে?”
বেগম নিজের পায়ের দিকে লক্ষ করতেই দেখতে পেল সামান্য কেঁটে গিয়েছে। হয়তো সেদিন ইটে বেঁধে পড়ে যাওয়ার সময় এটা হয়েছে। সে নরম গলায় বলল, “ঠিক আছে। পরে লাগিয়ে নেবো। এখন আমার একটু কাজ আছে। আপনি যান তো এখান থেকে। বিরক্ত লাগছে আমার।”
“কিন্তু আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে।”
“তো খেয়ে নিন। নিষেধ করেছে কে?”
ঝুঁকে এলো সুলতান। ধীর স্বরে বলল, “আমি আমার বেগমের হাতে খাবো।”
এক ঝটকায় সরে দাঁড়ালো বেগম। আশেপাশের সমস্ত সেবক-সেবিকা মাথা নিচু করে আছে। বড্ড রাগ হলো তার। এই লোক সমস্ত কাণ্ডজ্ঞান চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে না কি। কোথায় কী বলতে হয় সব ভুলে যাচ্ছে। সে ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো, “সবার সামনে এভাবে নষ্টামি করতে লজ্জা করে না আপনার? সুলতানই যদি এমন নষ্ট হয় তাহলে বাকিরা কী হবে?”
“কী আবার হবে? সবাই আমার মতো স্ত্রীর প্রেমে নষ্ট হোক সমস্যা কোথায়? এ তো গর্বের বিষয়। আমি কালকেই ঢাক পিটিয়ে পুরো সাম্রাজ্যে ঘোষণা করে দেবো ‘স্ত্রীর প্রেমে সবচেয়ে বেশি নষ্ট হতে পারবে যে পুরুষ তাকে আমার পক্ষ থেকে একটা দালান উপহার দেওয়া হবে’।”
সমস্ত সেবক-সেবিকা মাথা নিচু করে ঠোট চেপে হাসছে। শুধুমাত্র ভয়ের কারনে শব্দ করে হাসতে পারছে না তারা। বেগমকে দাঁত কিড়মিড় করতে দেখে সুলতান পুনরায় বলল, “তোমার যদি খুব করে আমার কোলে উঠতে ইচ্ছা করে তাহলে যেখানে যাচ্ছিলে সেখানেই যাও। আর যদি নষ্টামি করতে নিষেধ করো তাহলে আমার সাথে চলো। গোসল করে ওষুধ লাগিয়ে তারপর আমাকে খাইয়ে দেবে।”
আশেপাশের এত এত সেবক-সেবিকার মাঝে সুলতানের এহেন আচরণে প্রচন্ড লজ্জায় পড়তে হলো বেগমকে। কারোর চোখে চোখ মেলাতে পারছে না সে। সুলতানও নাছোড়বান্দা হয়ে জেদ ধরে আছে। অগত্যা গন্তব্য বদলে সুলতানের সাথেই যেতে হলো তাকে। এতো লোকজনের সামনে সত্যি সত্যিই যদি কোলে তুলে নেয় তাহলে তার নাক কাঁটা যাবে একদম ভালো মতো। তাই সুলতানের কথাই মেনে নিতে হলো তাকে। ভুলে গেল কারাগারে যাওয়ার কথা। ভুলল জিদানের কথাও।
বেশ কিছুটা সময় বাদে মাহতাব এসেছে মহলে। সাথে আছে বণিক। আপাতত মহলেই থাকবে সে সুরক্ষার কারনে। সেবক-সেবিকাকে তার কামরা ঠিক করে দিতে বলেই জারনাবের খোঁজে ছুটলো মাহতাব। ক্লান্ত দেহ বলছে আছে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করতে অথচ অবুঝ তৃষ্ণার্ত হৃদয় বলছে আগে প্রিয়তমাকে দেখতে। জারনাবের কামরায় পৌঁছানোর পূর্বেই চিন্তিত মুখে তার দিকে এগিয়ে এলো জারনাব। থমকে গেল মাহতাবের দিকে চেয়ে। সুদর্শন পুরুষটার এ কি হাল করেছে জানো’য়ারগুলো। রক্ত জমাট বেঁধে আছে কিছু কিছু স্থানে। ক্ষতবিক্ষত স্থানগুলোতে শুকনো রক্ত লেগে আছে এখনো। পাগড়ির ঠিক ঠিকানা নেই।চুলগুলো উস্কশুষ্ক। ক্লান্ত চেহারায় হাসলো মাহতাব। চোখে মায়ার পাহাড়। অজস্র আবেগ ঢেলে ডেকে উঠলো সে।
“জুঁই।”
তার এই ক্ষতবিক্ষত দেহ আর ব্যথিত দৃষ্টি সহ্য করতে পারলো না জারনাব। সে এমনিতেই এসব সহ্য করতে পারে না। নরম মনের মানুষ হবার কারনে ক্লান্ত কন্ঠের ডাকটা তাকে আরোও ব্যথিত করলো। মনে পড়ে গেল সাহাদের ক্ষতবিক্ষত শরীরটার কথা। সাহাদের তখন কেমন কষ্ট হয়েছিল ভাবতেই ছলছল করে উঠলো নয়নজোরা। মাহতাবের দিকে দুপা এগিয়ে গিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় শুধাল, “খুব যন্ত্রণা করছে?”
কেন যেন তার এই ছলছল নয়নটাও বড্ড ভালো লাগলো মাহতাবের নিকট। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “কাঁদছ কেন? আমার কথা একবারও মনে পড়েছে একদিনে?”
“অনেকবার মনে পড়েছে আজমাইন।”
“তাই? আজ আমি এসেছি কোথায় খুশি হবে তা না তুমি কাঁদছ? আমি তো ভেবেছি আমাকে ভুলেই গেছো তুমি?”
“ভুলিনি। কাউকে ভুলতে পারি না আমি। তাইতো ভালো থাকতে পারি না।”
“মানে?” অবাক হয়ে শুধাল মাহতাব।
“জোভিয়া, তুমি, সুলতান সবাইকেই মনে পড়েছে খুব। আমিতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম জোভিয়ার যে রাগ। না জানি কী করে বসে।”
মনোক্ষুন্ন হলো মাহতাব। খানিক রাগান্বিত স্বরেই বলল, “বেগমের জন্য সুলতান আছেন। তোমার এতো চিন্তা করতে হবে না।”
“রেগে যাচ্ছ কেন?” হতবাক হয়ে শুধাল জারনাব।
আরো রাগ বাড়লো মাহতাবের। আবার বলছে রেগে যাচ্ছ কেন? আশ্চর্য! সে এতোদিন পরে ফিরলো কোথায় তার কথা চিন্তা করবে তা না পুরো বংশের কথা চিন্তা করছিল সে। এই বোকা মেয়েটা কখনোই তার ভালোবাসা বুঝবে না। দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো, “আমি রাগলে তোমার কী? তুমি চিন্তা করো সবার কথা। একা চিন্তা করতে কষ্ট হলে আরো দুই তিনজন পাঠিয়ে দিচ্ছি। একসাথে বসে চিন্তা করো। তাহলে সুবিধা হবে। পুরো সাম্রাজ্যের মানুষের কথা চিন্তা করতে পারবে।”
আর কিছু বলার সুযোগই পেলো না জারনাব। তাকে হতভম্ব করে দিয়ে হনহনিয়ে চলে যেতে ধরলো মাহতাব। হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো সে। অতঃপর পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, “রাগ করো আর যায় করো গোসল করে খেয়ে নাও আগে। আমি কাউকে বলে ওষুধের ব্যবস্থা করছি। ইশ কী অবস্থা হয়েছে শরীরের!”
আর পেছনে ফিরলো না মাহতাব। তবে হাওয়ার মতোই রাগ বিলীন হলো তার। অধর প্রসারিত হলো অজানা কারনে। মেয়েটা কী দ্রুতই তার অভিব্যক্তি বদলে দিতে পারে! শীঘ্রই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করবে সে। এভাবে আর কতদিন? বয়স তো কারোরই কম হলো না। জুঁই যে এতোগুলো দিনেও একা আছে, তার জীবনে কেউ আসেনি এই তো ঢের। সে এবার সাজিয়ে তুলবে নিজের জীবনটাকে।
গভীর রাত। মহলের প্রতিটা প্রাণী বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। বেগম আর সুলতানের কাছে আসেনি। তোহফার কামরায় ঢুকে দ্বার এটেছে। পাহাড়ারত সৈনিকদের কড়কড়িভাবে বলে দিয়েছে কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। তবুও সুলতান কয়েকবার গিয়ে ডাকাডাকি করেও আশানুরূপ ফল পায়নি। বেগমের এক কথা সে তোহফার কাছে ঘুমাবে। সুলতানকে উল্টো ঝাঁঝালো গলায় বলে দিয়েছে ছোঁয়াছুঁয়ির প্রয়োজন হলে সে যেন দারিয়ার কাছে যায়। যন্ত্রণায় পড়েছে সুলতান। মেয়েও নিজের আম্মাকে পেয়ে খুব খুশি। মেয়ে বড় হচ্ছে। তার সামনে বেশিকিছু বলাও যায় না। বারবার ডেকেও হতাশ হতে হয়েছে তাকে। মহলের কোনো এক বন্ধ কামরায় দাউদাউ করে জ্বলছে বণিকের দেওয়া নীল গাউনটা। আগুনে পুড়ে তার আর কোনো অস্তিত্বই বাকি নেই। সুন্দর গাউনটা পরিণত হয়েছে কালো ছাঁইয়ে। আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি বোধহয় তবুও শান্তি পেলো না। হন্তদন্ত হয়ে পোড়া ছাইয়ের মধ্যে পানি ঢেলে দিলো সে। হাসলো পৈশাচিকভাবে। নিকষ আঁধারের মাঝে সেই হাসি বড়ই ভয়ঙ্কর দেখালো।
চলবে………..
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_29
ভোররাতে উদম শরীরে উপুর হয়ে শুয়ে আছে সুলতান।তখন বেগম কামড়ে ধরাতে দাঁত দেবে পিঠ কেটে গেছে। রাত নামতেই অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তাতে। পোশাকের সাথে ঘর্ষণের ফলে আরো বেশি ব্যথা করছিল। কোমর পর্যন্ত চাদর টেনে খোলা পিঠ নিয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। এখনো ফজরের আজান হয়নি। এই অসময়ে খোলা পিঠে কারোর নরম হাতের ছোঁয়াতে তন্দ্রা ছুটলো তার। উদম পিঠে খুব আলতোভাবে খেলা করছে হাতটা। ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রতিটি লোমকূপ। ঠান্ডা স্পর্শে খানিক নড়েচড়ে উঠলো সুলতান। তবুও থামলো না সেই হাতের অবাধ বিচরণ। কিছুক্ষণ যেতেই পুরোপুরি তন্দ্রা কেঁটে গেল সুলতানের। আচমকা চোখ মেলে পাশ থেকে তলোয়ার নিয়ে চেপে ধরলো অজ্ঞাত ব্যক্তির গলায়। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বেগম। গলা থেকে তলোয়ার সরিয়ে দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করলো সে। সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার ফেলে দিলো সুলতান। হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “ওহ তুমি!”
“আর কে আসে?”
“আমার বেগম।”
বলতে বলতে আলগোছে পালঙ্কে শরীর এলিয়ে দিলো সুলতান। ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি তার। ঘুম ঘুম দৃষ্টিতে মাত্রই হাত বাড়িয়ে বেগমকে ছুঁতে যাবে অমনি চেঁচিয়ে উঠলো বেগম। যেন বিজলির ঝটকা লাগছে তার শরীরে। আৎকে উঠে বসে পড়লো সুলতান। ঘুম যেন হাওয়ায় বেগে পালালো। সে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “এভাবে চিৎকার করছো কেন? মনে হচ্ছে পরপুরুষ ছুচ্ছে!”
“উঠে বসুন। উঠুন বলছি।”
তার হাত ধরে বলিষ্ঠ দেহটা টেনে উঠানোর প্রচেষ্টা চালালো বেগম। সুলতান নিজেই উঠে বসলো। আচমকা মেজাজটা ভীষণ বিগড়ে গেল তার। ছুঁতে দেবে না তো এই ভোররাতে এসেছে কেন এ কামরায়? মশা মা’রতে? অসহ্য রাগ ঘিরে ধরলো তাকে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে সে কিছু বলবে তখনই বেগম উত্তেজিত স্বরে হতাশ হয়ে বলে উঠলো, “এতো কষ্ট করে ওষুধ লাগিয়ে দিলাম। সব পালঙ্কে মাখিয়ে দিলেন।”
পালঙ্কের দিকে নজর দিলো সুলতান। অবাক কন্ঠে শুধাল, “মানে!”
“পিঠে ওষুধ লাগাচ্ছিলাম। হুট করে উঠে তলোয়ার চেপে ধরলেন। আবার কিছু না শুনেই সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন। সবটা ওষুধ বোধহয় মুছেই গেছে। এতো ছটফট করেন কেন আপনি?”
স্বস্তির শ্বাস ফেলল সুলতান। বেগমকে টেনে নিজের কাছে সরিয়ে এনে বলল, “আগে বলবে তো। আমি ভাবলাম ছুঁতে দেবে না বলে চিল্লাচ্ছো। মেজাজ এমন চড়ে গিয়েছিল যে এখনি ঠাটিয়ে একটা লাগাতাম।”
“কেন? দারিয়ার কথা খুব মনে……….”
মুখে হাত চেপে কথা বন্ধ করে দিলো সুলতান। ঠোঁট চোখা করে ‘শশ’ শব্দ করলো। রেগেমেগে বলল, “এই নামটা আর নেবে না। ভালো লাগে না আমার। আমি তোমাকে ছুঁতে চাই। শুধুই তোমাকে। অন্য কাউকে নয়। তাই এই নামটা বারবার বলে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলবে না। এখন কথা না বলে বুকে আসো তো। ঘুমাই একটু শান্তিতে।”
মুখ থেকে টেনে তার হাত সরিয়ে দিলো বেগম। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো সুলতানের দিকে। অভিমান ভরা গোমড়া মুখটা বড্ড নেশালো ঠেকল তার নিকট। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা পুরুষের কী এত সৌন্দর্য মানায়? তৈলাক্ত মুখটাতে যেন পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য ঢেলে দেওয়া হয়েছে। বিরক্ত হয়ে পড়লো সুলতান। তাড়া দিয়ে বলল, “কী হলো? আসো।”
“এতো অধৈর্য হচ্ছেন কেন?” মিটমিটিয়ে হাসছে বেগম। সুলতানের উদ্বিগ্নতা তার ভালো লাগছে।
“অধৈর্য হবো না? রাতে যা করেছো তুমি।” নারাজ স্বর সুলতানের।
“কিন্তু এখন আমি আপনার বুকে শুয়ে পড়লে সবটুকু ওষুধ পালঙ্কে লেগে যাবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। ব্যথা তো সারবেই না উল্টো সারাদি কামরায় বন্ধ হয়ে বসে থাকা লাগবে।”
“নিজে কামড়ে আবার নিজেই ওষুধ লাগাচ্ছো?” ভ্রু কুচকাল সুলতান।
“নিজে বুঝি সাধু? থাপ্পড় মে’রে মে’রে গালটা শেষ করে দিয়েছেন আমার। তার বেলা?”
“তোমার দোষেই।”
“আমিও আপনার দোষেই কামড়েছি। কে বলেছিলো আমাকে কাঁধে তুলতে?”
“আমার বেগম, আমার মর্জি। কাঁধে তুলব না কি মাথায় তুলব একান্ত আমার ব্যপার।”
“আচ্ছা? নিজের বেলা ষোলো আনা আর আমার বেলা এক আনাও না?”
চোখ-মুখ কুচকে নিলো সুলতান। ভোররাতে এমন সুন্দরী নারী তার কামরায় ঝগড়া করতে এসেছে? কী আশ্চর্য! সে অধৈর্য হয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো, “ঝগড়া পরে করো। এখন বুকে আসো। আমার বুকে ব্যথা করছে বেগমকে কাছে না পেয়ে পেয়ে। ওষুধ মুছে গেলে যাক। পরে আবার লাগিয়ে নেব। ব্যথা না সারলে সারাদিন দ্বার আটকে কামরায় বসে থাকবো তবুও আমার বুক এখন তার সম্রাজ্ঞীকে চায়।”
“সারাদিন কামরায় বসে থাকবেন? বাইরে যাবেন না?”
“না।”
“আমি কিন্তু আপনার সাথে কামরায় বসে থাকতে পারবো না।”
রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো সুলতান। বলল, “তো আমি কি তোমাকে বসে থাকতে বলেছি? তুমি মহলে যা ইচ্ছা করে বেড়াবে। মাঝে মাঝে কামরায় এসে আমাকে সঙ্গ দিয়ে যাবে। ব্যাস!”
“আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আবরার জাওয়াদ মহলেই আছে। বাইরে বাইরে ঘুরলে তার সাথে দেখা হতেই পারে। চোখাচোখি হবে, কথা হবে। আর আপনাকে তো কামরায় থাকতে হবে। ঠিক আছে, মাঝে মাঝে এসে সঙ্গ দিয়ে যাবো। নিন, শুয়ে পড়ুন। বুকে শুতে আমার কোনো সমস্যা নেই।”
ছিটকে দূরে সরে গেল সুলতান। আকস্মাৎ কাঁপতে শুরু করেছে তার শরীর। দৃষ্টিতে শূন্যতা। চোখদুটো লাল হতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠলো বেগম। সে তো এমনিই মজা করছিল। সামান্য কথাতে সুলতানের এমন অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া আশা করেনি সে। তাকে হতভম্ব করে দিয়ে সুলতান কাঁপতে কাঁপতে হিসহিসিয়ে বলল, “কোথাও যাবে না তুমি।”
“কিন্তু কেন? আর আপনি এমন করছেন কেন?”
“কী বলেছি শুনতে পাওনি? কোথাও যাবে না তুমি। কোথাও না মানে কোথাও না।” চিৎকার করে বলল সুলতান।
ভয়ে সামান্য কেঁপে উঠলো বেগম। পিছিয়ে গেল খানিকটা। প্রচন্ড রাগ হলো তার। সামান্য কারনে এমন ব্যবহার! চেঁচামেচি করার মতো তো কিছু বলেনি সে। জেদ চেপে বসলো মাথায়। একরোখা কন্ঠে বলল, “যাবোই আমি। আপনি নিষেধ করলেও যাবো।”
“এলি।” ক্রোধান্বিত হয়ে চিৎকার করে হাত ওঠালো সুলতান। আতঙ্কে খিচে চোখ বন্ধ করে নিলো বেগম। কিন্তু বেগমের মুখের চেয়ে খানিকটা দূরত্ব রেখেই থেমে গেল হাতটা। আঘাত না পেয়ে চোখ মেলল বেগম। হাত থেমে যেতে দেখে ক্রোধে ফেটে পড়লো যেন সে।
“মারবেন আমাকে? তাহলে মারছেন না কেন? মারুন।” এখনো জেদ প্রকাশ পাচ্ছে তার কন্ঠে।
কিছুই বললো না সুলতান। হাত নামিয়ে মাথা নত করে বসে থাকলো চুপচাপ। এক নিমেষেই অপরাধবোধ ফুটে উঠেছে তার মুখশ্রীতে। বেগম পুনরায় বলল, “কী হলো মারুন? থেমে গেলেন কেন?”
মাথা নিচু রেখেই দু’হাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে সুলতান। থমথমে গলায় বলল, “ঠিক আছে, যাও। বাঁধা দিচ্ছি না আমি।”
হনহন করে দ্বারের দিকে এগিয়ে গেল বেগম। ধরাম করে দ্বার আটকানোর শব্দে হতাশার তপ্ত শ্বাস ফেলল সুলতান। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠলো। আজকাল এমন কেন হচ্ছে তার সাথে? না চাইতেও ক্রোধের বশীভূত হচ্ছে বারংবার। যার জন্য এতোকিছু তাকেও কষ্ট দিয়ে ফেলল সে। মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব রেগে গেছে। অভিমান করেছে? না কি তাকে মানসিক অসুস্থ ভাবছে? অভিমানে মুখ ফেরালে তবুও মান ভাঙিয়ে নেবে কিন্তু মানসিক অসুস্থ ভেবে দূরে চলে গেলে বাঁচতে পারবে না সে। কেন তার বারবার মনে হয় এলি দূরে চলে যাবে তাকে ছেড়ে। কেন এই ক্রোধ জায়গা পায় তার হৃদয়ে? দুই বছরের বিশাল শূন্যস্থানটাই কি দায়ী এসবের জন্য?
তার ভাবনার মাঝেই একটি নারী শরীর আছড়ে পড়লো তার বুকে। তাল সামলাতে না পেরে সে হেলে পড়লো পালঙ্কে। রজনীগন্ধার ঘ্রাণে চোখদুটো বন্ধ করে নিলো সাথে সাথেই। লম্বা চুলগুলো এসে বাড়ি খাচ্ছে চোখে-মুখে। সমস্ত ভাবনা ভুলল সে। নারী শরীরটা আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভুল হয়ে গেছে পাখি। জানিনা হুট করে কেন রেগে যাচ্ছি আমি।”
“আমি বুঝতে পেরেছি সুলতান। এতো চিন্তা করতে হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে আবার।”
“আমি ভেবেছি তুমি রাগ করে বেরিয়ে গেছো কামরা ছেড়ে।”
“কষ্ট হচ্ছিল তাহলে চলে যেতে বললেন কেন? আজকাল আমাকে একদম ভালোবাসছেন না আপনি।” অভিমানী কন্ঠ বেগমের।
হাসলো সুলতান। প্রশান্তির হাসি। শক্ত করলো বাহুবন্ধন। বেগমকে লজ্জা দিতেই হয়তো বলে উঠলো, “ঠিকই তো। একদমই ভালোবাসা হচ্ছে না আমার বেগমকে। এখন তো বেশি বেশি ভালোবাসা উচিত। সাম্রাজ্যের জন্য একটা শেহজাদাও তো আনতে হবে।”
“বেশরম।” উদম বুকে আলতো কামড় বসালো বেগম।
বেশ খানিকটা সময় হলো সূর্যের কিরণ ছড়িয়েছে রামান সাম্রাজ্যের আনাচে-কানাচে। সকলে শান্তির ঘুম ছেড়ে নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত। সুলতান এখনো উপুড় হয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। পালঙ্কের পাশে বসে তার খোলা চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বেগম। গাঢ় চোখে দেখে নিলো ওষুধ লাগানো স্থানটুকু। ডাকতে ইচ্ছে করলো না মোটেও। মানুষটা নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চয় খুব ক্লান্ত। তাছাড়া যতক্ষণ ঘুমাবে ততক্ষণ ওষুধটাও ভালো কাজ করতে পারবে। উঠে দাঁড়ালো সে। সুলতানকে আরো একবার দেখে নিয়ে আলগোছে দ্বার খুলে বেরিয়ে গেল। বেরোতেই নিজের শাশুড়িকে দেখে খানিকটা ইতস্ততবোধ করলো সে। রাতে তোহফার কামরায় ঘুমাতে দেখেছিল তার শাশুড়ি আর সকালে বেরোচ্ছে এই কামরা থেকে। অকারণেই একরাশ লজ্জা ভর করলো চোখে-মুখে। মাথা নুইয়ে নিলো নিমেষেই। তবে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করলো না ওয়াসিফা সুলতান। খুবই স্বাভাবিক তার দৃষ্টিভঙ্গি। যেন সে আগে থেকেই অবগত এমন কিছুই হবে। পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই ডেকে উঠলেন তিনি, “শাহজাইন ঘুমাচ্ছে?”
“জি, আম্মা।”
“ঠিক আছে।”
“কোনো প্রয়োজন ছিল কি?”
“হ্যাঁ। যুদ্ধের ব্যপারে কিছু কথা ছিলো। তুমি সুযোগ পেলে বলে রেখো। আমার মনে হয় উমার রামান সাম্রাজ্য আক্রমণ করার পূর্বে আমাদের পার্শ্ব সাম্রাজ্য আক্রমণ করা উচিত। এতে করে বাড়তি প্রস্তুতি নেবার সুযোগ পাবে না উমার। এমনিতেও পরিস্থিতি যতটুকু এগিয়েছে তাতে আজ হোক কাল হোক যুদ্ধ বাঁধবেই। উমারের বিশ্বাসঘাতকতার সমাধান একমাত্র যুদ্ধ দ্বারাই সম্ভব।”
“আমিও সেটাই ভাবছি। উমার যে কোনো সময় আক্রমণ করে বসবে। কিন্তু আপনার ছেলেকে তো আজকাল কিছুই বলা যাচ্ছে না। খামোখা ত্যানত্যান করে উঠছে।”
ভ্রু কুচকালেন ওয়াসিফা সুলতান। খানিকটা অবাক স্বরেই বলল, “তোমার উপর ত্যানত্যান করে! সত্যি কথা বলছো?”
“আপনার কি মনে হয় আমি মিথ্যা কথা বলছি?”
“তাহলে তো এখন শাহজাইনের আরেকটা বিবাহ দেওয়া উচিত। তখন আর ত্যানত্যান করবে না।”
শাশুড়ির এহেন কথাতে না চাইতেও মুখটা হাঁ হয়ে গেল বেগমের। কিছুক্ষণ সেভাবেই চেয়ে থেকে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে হনহনিয়ে চলে গেল সে। ‘শাহজাইনের আবার বিবাহ দেওয়া উচিত’ দুনিয়ার সবচেয়ে অপছন্দনীয় আর বিশ্রি বাক্যটাই বোধহয় এটা। তোহফাকে দৌড়ে আসতে দেখে থেমে গেল সে। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে হাসি ফুটিয়ে তুলল অধরে। ঝুঁকে পড়ে তোহফাকে কোলে তুলে শুধাল, “নামাজ পড়েছিলে আম্মু?”
ছোট ছোট সফেদ দাঁতগুলো বের করে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালো তোহফা। বেগম পুনরায় বলল, “সবসময় এভাবে মাথা ঝাঁকাবে না, কথা বলার চেষ্টা করবে।”
আদুরেভাবে তার গলা জড়িয়ে ধরলো তোহফা। কাঁধে মুখ ঠেকিয়ে চুপ করে রইল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বেগম পুনরায় বলল, “আমার আম্মুটার কি রাগ হয়েছে?”
আবারো ডানে-বামে মাথা দুলালো তোহফা। তাকে কোলে নিয়েই জারনাবের কামরার দিকে গেল বেগম। দ্বারে কড়া নেড়ে বলল, “বুবু, আছো?”
ততক্ষণাৎ ছুটে এসে দ্বার খুলে দিলো জারনাব। এক গাল হেসে বলল, “ঘুম ভেঙে গেছে?”
“হুম, কী করছো?”
“বসেই। কোনো কাজ নেই এভাবে বসে বসে আর ভালো লাগছে না।”
“কেন? ফাইজা কোথায়?”
“ওকে একটু বিশ্রাম নিতে পাঠিয়েছি। বেচারি বেশ কদিন যাবত কেমন মিইয়ে থাকে। সামান্যতে ভয় পায়। আগের মতো সাজগোজ করে না। আমি খেয়াল করে দেখেছি সবসময় ভীত মুখে থাকে ও।”
চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো বেগমের কপালে। হঠাৎ করে ভয় পাওয়ার মতো কী হয়েছে? ফাইজার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। সে আগ্রহী কন্ঠে শুধাল, “তুমি জানতে চাওনি ওর সমস্যা?”
“অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। কিছুই বলে না। আরো ভয়ে মিইয়ে পড়ে। আগে তো এমন ছিলো না মেয়েটা।”
“তুমি চিন্তা করো না বুবু। আমি খোঁজ নিচ্ছি। তোমাকে না বললেও হাফসাকে নিশ্চয়ই নিজের সমস্যা বলবে। আমি হাফসাকে দিয়েই জিজ্ঞেস করাবো।”
খানিকটা নিশ্চিত হলো জারনাব। তোহফাকে টেনে নিজের কোলে তুলে বেগমকে বলল, “পার্শ্ব সাম্রাজ্যে অনেক ঝামেলা হয়েছিল শুনলাম। যুদ্ধও নাকি বাঁধবে। সাবধানে থেকো।”
“যুদ্ধ তো বাঁধবেই বুবু।”
“কিন্তু তুমি বণিককে মহলে আনতে গেলে কেন? শুধু শুধু ঝামেলা বাড়াচ্ছো। সেদিন যখন বণিক তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলো তখন তুমি সুলতানের চেহারাটা দেখেছিলে? কালবৈশাখী ঝড় উঠেছিলো যেন। দু’দুটো বছর তুমি মৃত জেনেও ঐ মানুষটা একজন সুলতান হবার পরেও তোমাকে ভালোবেসে একা কাটিয়ে দিলো। তোমার প্রতি তার আবেগ, ভালোবাসা ঠিক কতটুকু এটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না? আবার বণিকও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। এবার তো খুনোখুনি বেঁধে যাবে মহলে।”
হাসলো বেগম। তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “কিছুই হবে না বুবু। সুলতান একেবারেই অমন নয়। তুমিই বলো, সাহায্যকারীকে কি শত্রুর কাছে ফেলে আসা যায়? তাছাড়া আমি চেষ্টা করবো বণিকের থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখার।”
“তুমি যায় বলো জোভিয়া। আমার কিন্তু খুব চিন্তা হচ্ছে। তোমার মাথাও হুটহাট গরম হয়ে যায়। অনেকদিন পর একসাথে হবার সুযোগ পেয়েছো। এমন কিছু করো না যেটাতে আবার দুজনের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়।”
“আরেহ চিন্তা করো না তো। কিছু হবে না।”
বলতে বলতে জারনাবকে জড়িয়ে ধরলো বেগম। চিন্তা ফেলে জারনাব নিজেও আগলে নিলো বোনকে। তোহফা দু’জনের মাঝে পড়ে খুশিতে শব্দহীনভাবে হেসে উঠলো। দু’জন দু’দিক দিয়ে জড়িয়ে ধরাতে তার খুব ভালো লাগছে।
“জুঁই।”
আকস্মাৎ মাহতাবের কন্ঠে সরে আসলো বেগম। কপাল কুচকে তাকালো দ্বারের দিকে। হুট করে কামরায় ঢুকে বেগমকে দেখে অবাক হয়েছে মাহতাব নিজেও। খানিক অস্বস্তিতে পড়লো সে। কিন্তু জারনাব বোকার মতো শুধাল, “কী হয়েছে আজমাইন? কোনো দরকারে এসেছো?”
সমানে মাথা চুলকাচ্ছে মাহতাব। একেতো এখানে বেগম আছে সে কথা সে জানতো না। তার উপর জারনাব ভুলভাল প্রশ্ন করে ঘেঁটে দিচ্ছে। সে আমতা আমতা করে বলল, “না মানে এমনিই তোমার সাথে কথা বলতে এলাম।”
“কী কথা?” সরল মনে শুধাল জারনাব।
এবার আর সহ্য করতে পারলো না বেগম। কটমট করে তাকালো নিজের বোনের দিকে। শুধুমাত্র এসব কারনেই কোনো ছেলে এতোগুলো দিনের ভেতরে তাকে ভালোবাসি কথাটা বলতে পারেনি। সে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো, “তোকে ভালোবাসার কথা জানাতে এসেছে মাথামোটা।”
“কিছু বললে জোভিয়া?”
“নাহ, কিছুই বলিনি। আচ্ছা আমি যাই। দেখি সুলতান উঠে পড়েছে না কি।”
দাঁত কেলিয়ে কথা বলতে বলতে তোহফাকে কোলে নিতে চাইল সে। কিন্তু তোহফা মাহতাবের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বসে আছে। সে মাহতাবের কোলে উঠবে। মাহতাব নিজেও মুচকি হেসে তাকে কোলে তুলে নিলো। বিরক্ত হলো বেগম। তোহফা এখানে থাকলে মাহতাব কিছুই বলতে পারবে না। সে চাচ্ছে তাদের সুযোগ করে দিতে। বুবু আবার কাউকে ভালোবেসে নিজেকে সাজিয়ে তুলুক। কিন্তু তোহফা কিছুতেই এলো না। জারনাব বিরক্ত কন্ঠে বলল, “আহ! থাক না তোহফা। শুধু শুধু জোর করছো কেন?”
মাহতাব নিজেও বলল, “থাক আমার কাছে। অনেকদিন পর ছোট শেহজাদির সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে। পরে দিয়ে আসবো আমি।”
হাল ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল বেগম। কামরায় ফিরে সুলতানকে না পেয়ে কপালে নিখুঁত ভাঁজ পড়লো। এই মানুষটাকে নিয়ে পারা যায় না। কোথায় ভাবলো একটু ঘুমাক তাহলে ওষুধটা ভালোভাবে কাজ করবে তা না উঠে পড়েছে সে। আবার এখন কোথায় গেছে? মাহতাব তো বুবুর কামরায়। সুলতানকে খোঁজার উদ্দেশ্যে হন্তদন্ত হয়ে কামরা থেকে বেরোবে এমন সময় নজর আটকালো মেঝেতে। সামান্য ঝুঁকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মেঝেতে। ধবধবে সফেদ মেঝেতে কালো কিছু একটা লেগে আছে। এমন লাগছে যেন কয়লা পড়ছিল এখানে। তারপর মোছার চেষ্টা করার ফলে সেটা মেঝেতে ছড়িয়ে গেছে। ভালোভাবে লক্ষ করলেই কেবল সেটা নজরে আসছে। আশ্চর্য এ কামরায় তো শুধু সে আর সুলতান ব্যতীত কারোর আসার কথা নয়! এই দাগ কোথা থেকে এলো? কী পড়েছিলো এখানে? এমন সময় দ্বার ঠেলে প্রবেশ করলো সুলতান। হাসিমুখে এগিয়ে এসে শুধাল, “কী খুঁজছো এলি?”
মাথা তুলে তার দিকে তকালো বেগম। চিন্তিত কন্ঠে মেঝেতে ইশারা করে বলল, “এটা কীসের দাগ?”
স্বাভাবিকভাবেই মেঝেতে দৃষ্টি ফেলল সুলতান। তবে কালচে দাগটা বোধহয় সে আশা করেনি। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মুহুর্তেই। দৃষ্টি চঞ্চল। হাসিমুখ গায়েব হলেও চিন্তার রেখা ফুটে উঠতে দিলো না সে। যথাসম্ভব শান্ত ভঙিমায় বলল, “ওসব কিছু না। মেঝে পরিষ্কার সময় হয়তো কিছু লেগে গিয়েছে।”
“উঁহু, এতোদিন তো কিছু লাগেনি। নিশ্চয়ই কেউ এখানে কিছু পুড়িয়েছিলো।”
চকিতে তাকালো সুলতান। ঘাবড়ে গেল অত্যধিক। হন্তদন্ত হয়ে বেগমের হাত টেনে ধরে বলল, “এসব বাদ দিয়ে চলো তো। ক্ষুধা লেগেছে।”
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো বেগম। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে একবার সুলতানকে দেখে নিয়ে কামরার এদিক-ওদিক খোঁজ করলো কিছু একটার। না পেয়ে আবারো সুলতানের কাছে এসে সন্দেহপ্রবন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “আমার গাউন কোথায়? নীল গাউনটা তাড়াহুড়োর মাঝে এখানেই ফেলে গিয়েছিলাম আমি।”
“আমি কীভাবে জানবো? আশ্চর্য!” ঝাঁঝালো স্বরে কথাটা বললেও থতমত খেয়েছে সে। স্পষ্ট তার চেহারা বলে দিচ্ছে এই প্রশ্ন তাকে বিব্রত করেছে।
আচমকা তার একদম কাছে এগিয়ে এলো বেগম। চোখে চোখ রেখে থমথমে কন্ঠে বলল, “মিথ্যা বলছেন আমার কাছে? আপনি কি জানেন আপনার দৃষ্টি আপনাকে মিথ্যা বলতে বাঁধা দিচ্ছে। সে স্পষ্ট বলে দিচ্ছে এই দাগের কারন সম্পর্কে আপনি অবগত। এমনকি এই দাগটা আপনার দ্বারাই সৃষ্ট। কী পুড়িয়েছেন এখানে? আমার গাউন?”
“হ্যাঁ পুড়িয়ে দিয়েছি আমি। বেশ করেছি পুড়িয়েছি। কেন তুমি পরবে ওর দেওয়া পোশাক? একদম পরবে না।” চিৎকার করে উঠলো সুলতান।
আকস্মাৎ চিৎকার ভয়ে খানিক কেঁপে ওঠার সাথে সাথে হতবাকও হলো বেগম। ব্যাকুল স্বরে বলল, “ওটা উপহার ছিলো।”
“উপহার ছিলো কিন্তু পরপুরুষের দেওয়া উপহার ছিলো।” অত্যধিক কঠোর হলো সুলতানের কন্ঠ। শক্ত তার মুখভঙ্গি।
“আপনি কবে এতো নিষ্ঠুর হয়ে গেলেন সুলতান?” স্বর কাঁপছে বেগমের। যেন এর চেয়ে কঠিন বাক্য সে আগে কখনোই বলেনি। একরাশ বিস্ময় তার দৃষ্টিতে।
“যেদিন থেকে তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে কাবু করতে পেরেছে। সেদিন নিষ্ঠুর হয়েছি আমি যেদিন পাহাড়ের চূড়ায় পুড়ে কয়লা হওয়া ধ্বংসস্তূপের মাঝে খুঁজতে হয়েছে তোমার শরীরের অবশিষ্টাংশ। সেদিন কী অবস্থা হয়েছিল আমার জানো তুমি? পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। উন্মাদের মতো পোড়া কয়লার মাঝে খুঁজেছি তোমাকে। এই যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছো তুমি? নিজের ভালোবাসাকে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের মাঝে খুঁজতে কতটা যন্ত্রণা সেদিন বুঝেছিলাম আমি। তোমাকে হারিয়ে উন্মাদ হয়েছিলাম আমি। এতিম হয়েছিল আমার কন্যা। দুটো বছর কী বেদনায় কাটিয়েছি সেটা নিশ্চয়ই জানো তুমি? তুমিহীন প্রতিটি মুহুর্ত আমাকে জ্বালিয়ে অঙ্গার করেছে। নির্দয় বানিয়েছে। তোমাকে কেড়ে নেওয়ার এই নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র আমাকে হিং’স্র করেছে। আমি নিতে পারছি না এই দূরত্বের ভার। তোমাকে হারিয়ে ফেলার সমস্ত পথের অস্তিত্ব আমি মিশিয়ে দেবো। মুছে দেবো দূরত্বের সমীকরণ।” উত্তেজিত স্বরে একটানে কথা শেষ করে হাঁপাচ্ছে সুলতান। কাঁপছে তার হাতদুটো।
শূন্য দৃষ্টিতে তার মুখের পানে চেয়ে আছে বেগম। আচমকা নিজেকে ধাতস্থ করে গম্ভীর কন্ঠে বলল, “এতক্ষন কোথায় ছিলেন আপনি?”
“তানহার কামরায় গিয়েছিলাম। বিবাহের ব্যপারে ওর সাথে কথা বলতে। আম্মা বলেছিলো কথা বলে দেখতে। রাজি করানো যায় কি-না।”
“তো রাজি হয়েছে তানহা?”
“না। ভাবার জন্য কিছুটা সময় নিয়েছে। ভেবে জানাবে।”
“তানহার কামরা থেকে কথা বলে আসছেন অথচ আপনার শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। যুদ্ধ করতে হয়েছে না কি কথা বলার সময়?”
ঘাবড়ে গেল সুলতান। সবকিছু কীভাবে বুঝে যাচ্ছে বেগম। তার চোখে-মুখে কি অপরাধের বিবরণ লিখে রাখা আছে। তবুও নিজেকে সংবরণ করে বিরক্ত কন্ঠে বলল, “তুমি এতো জেরা করছো কেন হঠাৎ?”
“কারন আপনি বদলে গেছেন। পুরোপুরি বদলে গেছেন। আপনার মাঝে আমি খুঁজে পাচ্ছি না আমার আগের সুলতানকে।”
“হয়তো পরিবর্তন এসেছে আমার মাঝে। কিন্তু আমি কোনো অন্যায় কাজ করিনি তুমি বিশ্বাস করো। আমি ভুলে যায়নি নিজের দায়িত্ব। এতো সন্দেহ করো না এলি। তোমার সন্দেহভাজন দৃষ্টি আমাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।” করুন শোনালো সুলতানের কন্ঠ।
তার কথা বোধহয় বেগমের কর্ণগহ্বর পর্যন্ত পৌঁছালো না। সে ছুটে বেরিয়ে গেল কামরা ছেড়ে। পেছন পেছন ছুটে আসলো সুলতান। ভীত স্বরে চেঁচিয়ে বলল, “কোথায় যাচ্ছ এলি? দাঁড়াও। আস্তে যাও। এভাবে ছুটতে থাকলে পড়ে যাবে তুমি।”
শুনলো না বেগম। সে দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে কারাগারের দিকে। জিদানের সাথে কী করেছে সুলতান সেই আশঙ্কায় বদলেছে তার মুখভঙ্গি। মনে প্রাণে চাইছে সুলতান যেন জিদানকে অন্তত হত্যা না করে। দুয়েক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া আসামীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে সে কী করে মেনে নেবে? কেন সুলতান এসব করে দেয়াল তুলছে তাদের মাঝে। সে কীভাবে আবারও দূরত্ব বেছে নেবে? পেছন থেকে বারবার ডাকছে সুলতান, “ওদিকে কেন যাচ্ছ? থামো। আমার কথা শোনো। যেও না ওদিকে। কেন এমন অবুঝের মতো আচরণ করছো? আমার কথাটা একবার শোনো।”
এবারও শুনলো না বেগম। সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল। একরাশ বিস্ময় নিয়ে মাথা নিচু করে আছে সৈনিকগুলো। সৈনিকদের পেরিয়ে সোজা জিদানের কারাগারের সামনে এসে দাঁড়ালো বেগম। কারাগারের মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা রক্ত থমকে দিলো তাকে। শূন্য হলো দৃষ্টিভঙ্গি। আশঙ্কা সত্যি হওয়াতে বেসামাল হয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল সে। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো, “আপনি অপরাধী সুলতান।”
হঠাৎ করে বেগম চলে আসাতে চমকে গেছে সৈনিকগুলো। তারা মোটেও আশা করেনি বেগম এ সময় হুট করে কারাগারে চলে আসবে। সকলে করুন চোখে তাকালো বেগমের পেছনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুলতানের দিকে। নিজের সাফাই গাওয়ার আর কিছুই খুঁজে পেল না সুলতান। সব শেষ। হাত গলিয়ে পড়ে গেল তলোয়ার। শিথিল হয়ে এলো তার মস্তিষ্ক। ততক্ষণে খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে সেখানে ছুটে এসেছে মাহতাব। বেগমকে কারাগারের সামনে দেখে ঘাবড়ে গেল হঠাৎই। মুহুর্তেই যেন বদলে গেছে সুন্দর পরিবেশ।হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক ধরা দিচ্ছে সুলতানের দৃষ্টিতে। কিন্তু কিছুই করতে পারলো না মাহতাব। সে আসার পূর্বেই যা হবার হয়ে গেছে। বেগম দেখে ফেলেছে সুলতানের নিষ্ঠুরতা। নিষ্পলক দৃষ্টিতে শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই তার। তীব্র বিষাদের গন্ধ এসে নাকে ঠেকল। হাতের বাইরে চলে গেছে পরিস্থিতি। সমস্ত পথ যখন বন্ধ তখনই সে হতাশার স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো, “এমনটা না হলেও পারতো।”
চলবে………