#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_37
সোনালি সকালের দ্বারে দ্বারে শুভ্র অনিল। নীল-সাদার আচ্ছাদনে ছেয়েছে গগণ। সকাল সকাল মহল জেগে উঠেছে নতুন উদ্যমে। সকলে নিজ নিজ কর্মে নেমে পড়লেও ঘুম ভাঙেনি বেগমের। শিয়রে বসে গালে হাত দিয়ে ভাবুক দৃষ্টিতে ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে আছে তোহফা। আবার চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে সুলতানের দিকে। কিয়ৎ দূরেই আরামদায়ক কেদারায় মাথা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে সুলতান। চোখদুটো লাল, চুলগুলো উষ্কো শুষ্ক। সারারাত ঘুম হয়নি। ক্লান্ত লাগছে বড্ড। সন্ধ্যার পূর্বেই মাহতাব তোহফাকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু রাত থেকেই বেগমের ধুম জ্বর। হুঁশ পাচ্ছে না। তোহফা তার পাশেই ঘুমিয়েছিল আর সুলতান কখনো কেদারায় তো কখনো শিয়রে বসে মাথায় পানি দিয়েছে। আশেপাশে ঘেঁষতে দেয়নি কোনো সেবিকাকে। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না কাউকে। রাতে মারজিয়া সুলতান ওষুধ দিয়ে গেছে সেবিকা সমেত এসে। আর আসেনি এদিকটা। জ্বরের ঘোরে বেগম প্রলাপ বকে আম্মা, আম্মা। রাগে কিড়মিড় করে ওঠে সুলতান। শাশুড়ি নামক মহিলাকে আগুনে ঝলসে দিতে পারলে বড় শান্তি পেত সে। নির্দয়, নিষ্ঠুর! বিড়বিড়ায় সে। চিন্তায় নাজেহাল অবস্থা। এখনো কমেনি জ্বর। সামান্য কমছে তো আবার বেড়ে দ্বিগুণ হচ্ছে। জ্বরের ঘোরে বুলি আওড়াচ্ছে আবল তাবল। এদিকে মাহতাব জানিয়েছে যুদ্ধের প্রস্তুতি প্রায় হয়ে এসছে। এভাবে আর দেরি করা যাবে না। আজই বেরোতে হবে তাদের। উমার নতুন পরিকল্পনা করার পূর্বেই আক্রমণ করতে হবে। নিজ সাম্রাজ্য আর সাম্রাজ্যের মানুষের শান্তি রক্ষার্থে অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয় সুলতানদের। এই বাঁধা ধরা কঠিন জীবন বড্ড বিষাক্ত ঠেকল সুলতানের দিকট। দায়িত্ব ঘেরা এই জীবনে ক্লান্তির অবসান ঘটিয়ে হাজির হয়েছিল এলি, শেহজাদি এলিজা। তার কঠিন জীবনের কাঁটাবনে জন্ম নেওয়া মোলায়েম ফুল। যে নিখুঁত আবেশে নিংড়ে নিতে পারে তার সমস্ত ক্লান্তি, হিং’স্রতা, রাগ। ছোট্ট ছোট্ট হাতে মায়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছে তোহফা। কখনো মুখ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে অধর ছোঁয়াচ্ছে গালে,মুখে। কেদারা ছেড়ে উঠে এলো সুলতান। বেগমের অসুস্থ, কাতর মুখের দিকে তাকালেই বিশ্রি অনুভূতি ঘিরে ধরলো আষ্টেপিষ্টে। রাগে হিসহিসিয়ে উঠলো আচমকাই। কী ওষুধ দিয়েছে যে জ্বরই কমছে না? ইচ্ছা করে ভুলভাল ওষুধ দেয়নি তো? না না, কী ভাবছে এসব। এত সাহস কেউ দেখাবে না। তোহফাকে কোলে তুলে বসলো শিয়রে। কপাল-গলায় হাত রেখে পরিক্ষা করলো জ্বর কমেছে কি-না। নাহ, কমেনি। একটুও কমেনি। কপালে ভাঁজ পড়লো চিন্তার। কেন কমছে না? কখন উঠবে এলি? যাওয়ার আগে কি একবার কথা বলে যেতে পারবে না? যদি আর না ফেরা হয়! আর কখনো না বলা হয় রত্ন তুমি, আমার জীবনের অমূল্য রত্ন। তোহফার কপালে আলতো করে অধর ছুঁয়ে দিয়ে ডাকলো, “আম্মাজান।”
মায়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা তুলে তাকালো তোহফা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে হাসলো হঠাৎই। অধর প্রসারিত করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সুলতান। আদুরে স্বরে শুধায়, “খেয়েছো?”
চোখদুটো খানিক ছোট ছোট করলো তোহফা। ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো খায়নি সে। অপলক চাইল সুলতান। তার কন্যা অবিকল মায়ের প্রতিচ্ছবি। মুচকি হেসে বলল, “আম্মু অসুস্থ। বিরক্ত করবে না ঠিক আছে? শান্ত বাচ্চার মতো আম্মুর কাছে কাছে থাকবে। কেউ ডাকলে একা একা বাইরে যাবে না। নানু ছাড়া কেউ কিছু দিলে খাবে না। আর আমি খুব তাড়াতাড়ি আসব তোমাদের নিয়ে যেতে।”
ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকা ব্যতীত কিছুই বলতে পারে না তোহফা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুলতান। মেয়ের কন্ঠ শোনার আকুলতা ধরা দিলো দৃষ্টিভঙ্গিতে। কোল থেকে আস্তে করে মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে দ্বার খুলে দেয়। মাহতাবকে ডেকে তার কাছে তোহফাকে দিয়ে বলে, “খেয়ে নাও তোমরা। বেরোতে হবে আমাদের।”
গম্ভীর সেই কন্ঠের মাঝে আকাশসম অসহায়ত্ব খুঁজে পেল মাহতাব। অসুস্থ স্ত্রীকে ফেলে যেতে হচ্ছে তাই হয়তো। ঘাটলো না সে। চুপচাপ তোহফাকে নিয়ে বিদায় নিলো। দ্বার বন্ধ করে বাইরে এসে কয়েক পা এগোতে দেখা মিলল মারজিয়া সুলতানের। কয়েকজন সেবিকা সমেত এদিকেই আসছে সে। সেবিকাদের হাতে বিশাল বিশাল থালা ভর্তি খাবার ঢেকে রাখা। মারজিয়া সুলতান ইতস্তত কন্ঠে শুধায়, “জ্বর কমেছে এলিজার? তোমাদের খাবার নিয়ে এলাম।”
“কমেনি। কী ওষুধ এনে দিয়েছেন যে কমছেই না? ইচ্ছে করে ভুল ওষুধ দেননি তো?”
“শাহজাইন!”
“চিৎকার করবেন না।”
“আমি এলিজার মা। আমি ভুল ওষুধ দেব!”
“মা? তাই নাকি? মনে তো হয় না।”
“তুমি বেশি বেশি করছো এখন।”
“আমি বরবরই বেশি বেশি করি। যা হোক, চলে যাচ্ছি আমি। খেয়াল রাখবেন এলির। এবার অন্তত মা হওয়ার চেষ্টা করুন।”
“তুমি চলে যাচ্ছ? এলিজা উঠে যখন চিল্লাচিল্লি করবে তোমাকে না পেয়ে তখন কী হবে?”
“এলি ছোট নয় যে চিল্লাচিল্লি করবে। নিজের মেয়ের সম্পর্কে এতটুকু ধারনাও নেই আপনার। হাহ!”
জবাব দেয় না মারজিয়া সুলতান। পেছনে সেবিকারা আছে। তারা শুনতে পাচ্ছে সব কথা। তাই কথা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলো সে। সুলতান একবার সেবিকাদের দিকে চেয়ে অধর প্রসারিত করলো জোরপূর্বক। কন্ঠের গম্ভীরতা ঠেলে দিয়ে অমায়িক হেসে অত্যন্ত ধীর স্বরে বলল, “আমি নেই বলে যেন অবহেলা না হয় আমার বেগমের। মায়ের মতো যথাযথ যত্ন নিয়ে সারিয়ে তুলবেন। এলি অসুস্থ তাই তোহফার খেয়াল রাখবেন আশা করি। আমার শত্রুদের আমি নিজেই চিনি না। কে কখন আঘাত হানবে বলা মুশকিল। আমার মেয়েটাকে তো আল্লাহ বিপদে পড়লে চিৎকার করার সুযোগটাও দেয়নি। দেখেশুনে রাখবেন। এই মহলে আমার গুপ্তচর আছে। খবরাখবর পাবো আমি প্রতি মুহুর্তের। তাই সাবধান, অবহেলা করার চেষ্টা করবেন না। নয়তো……..”
বাক্য সম্পূর্ণ করে না সে। রাগান্বিত হয় মারজিয়া সুলতান। আদেশ করছে তাকে! হুমকি দিচ্ছে! ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো, “নয়তো, নয়তো কী?”
“জিন্দা জ্বালিয়ে দেব।”
হিসহিসিয়ে ওঠে সুলতান। হীম ধরা সেই কন্ঠ। চকিতে ফিরে মারজিয়া সুলতান। না চাইতেও শুকনো ঢোঁক গিলল পাংশুটে মুখে। মাইরা তাকে বলেছিল সুলতানের এসব বেপরোয়া স্বভাবের ব্যপারে। কিন্তু তা বলে শাশুড়িকে হ’ ত্যার হুমকি? হজম হলো না তার। শুকনো গলায় বলল, “এলিজা খুঁজবে তোমাকে।”
“বলবেন আমি জরুরি কাজে গেছি। আর খুব শীঘ্রই আসব ওকে নিয়ে যেতে। তারপরেও যদি জেদ করে তবে সামলাবেন। আপনি না ওর মা? সামলাতে পারবেন না?”
“পারবো না কেন? পারবো। তবুও……”
কথা সম্পূর্ণ করা হলো না আর। পূর্বেই সুলতান শক্ত কন্ঠে বলে ওঠে, “আপনি ভালোবাসা দিলে ও সব ভুলে যাবে।”
নীরব, নিশ্চুপ মারজিয়া সুলতান। শব্দভাণ্ডার হাতরেও পেল না বলার মতো কিছু। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সেবিকাদের ইশারা করলো খাবারগুলো কামরায় দিয়ে আসতে। সেবিকারা মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে একে একে খাবারগুলো রেখে আসে ভেতরে। রাশভারি কন্ঠে সুলতান জানায়, “এক পাত্র পানি আর বড় একটা পরিষ্কার, নরম কাপড় লাগবে।”
মারজিয়া সুলতান ইশারা করতেই সেবিকারা ততক্ষণাৎ সবকিছু এনে কামরায় দিয়ে আসে। অন্য কেউ হলে হয়তো একটা ধন্যবাদ অন্তত দিতো। তবে সুলতান তা করলো না বরং কঠিনভাবে মারজিয়া সুলতানকে উপেক্ষা করে কামরায় ঢুকে দ্বার আটকে দেয়।মারজিয়া সুলতান রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাইল সেদিকে।অপমানিত হলো খানিক। তবে কিছু করার নেই। সেবিকাদের যাওয়ার আদেশ দিয়ে নিজে কামরার দিকে চলে যায়। বেগম তখনও জ্বরের ঘোরে বন্ধ চোখে একরাশ আশা নিয়ে বিড়বিড়িয়ে ডাকছে, “আম্মা, আম্মা, আম্মা।”
এই ডাক ব্যথিত করে সুলতানকে। অসহায় হয় তার মুখভঙ্গি। সে চায় না তার ভালোবাসা ব্যতীত অন্য কারোর ভালোবাসার জন্য এলি উদ্গ্রীব হোক, সে ব্যতীত অন্য কারোর ভালোবাসায় সুখ খুঁজে পাক। তবুও যেন এই মুহুর্তে তার হৃদয় মানতে নারাজ। মন চাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত মায়ের ভালোবাসা এনে দিতে এই নারীর শিয়রে। জ্বরের ঘোরের এই প্রলাপ যে বড্ড কষ্টদায়ক। বেহুঁশ হয়েও সে মাকে খোঁজে তাহলে হুঁশে থাকতে কতটা খোঁজে? মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে শাশুড়ি নামক মহিলার ধর থেকে মাথাটাই আলাদা করে দিতে। এতে এলি কয়েকদিন হয়তো কাঁদবে মায়ের মৃ’ত্যুশোকে কিন্তু সারাজীবন তো আর মায়ের ভালোবাসার অভাবে তড়পাতে হবে না। আফসোস! এতোটা নিচে নামার সাধ্য তার নেই। হতাশার তপ্ত শ্বাস ফেলে পানিতে কাপড়টা ভিজিয়ে রেখে পালঙ্কে উঠে বসে। ধীরে সুস্থে বেগমের কোমর চেপে নিজের দিকে টেনে আনে। উত্তপ্ত, অসাড় শরীরটা টেনে নিজের কোলে তুলে বসায়। শক্ত বুকে মাথাটা ঠেকিয়ে দিতেই আবেশে আরোও মিশে যায় বেগম। শরীর এতটাই উত্তপ্ত যেন তার উষ্ণতায় গলে যাবে সুলতান নিজেও। পিঠের কাছে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো আলগোছে হাতে পেঁচিয়ে খোঁপা করে দেয়। মাথায় পানি দেওয়ার পর চুল শুকানোর জন্য খুলে রাখা হয়েছিল। খোঁপা করার মতো এই অভিনব কঠিন কাজটা অবশ্য তাকে বাধ্য হয়েই শিখতে হয়েছিল। কোনো এক স্নিগ্ধ ভোরে জেদ ধরেছিল বেগম খোঁপা করা তাকে শিখতে হবে। সেদিন রাত-দিন চেষ্টা করার পর অবশেষে সফল হয়েছিল সে। নারীর চুলে খোঁপা করার দৃশ্য যেমন মুগ্ধকর ঠিক ততটাই কঠিন সঠিক নির্দেশনায় খোঁপা করা।
“বড্ড কঠিন।” তপ্ত শ্বাস ফেলে সুলতান।
অতিরিক্ত উষ্ণতায় ধ্যান ফিরল। অসাড়, উত্তপ্ত শরীরটা আকড়ে ধরে কাঁধে চুম্বন করে বসে হঠাৎই। কম্পিত হয় বেহুঁশ শরীর। অধর যেন জ্বলে যাবার জোগাড়। শরীরটা মুছে দিতে হবে। বাম হাতে বেগমকে নিজের শরীরের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে। ডান হাত বাড়িয়ে পানির পাত্রের মধ্যে থেকে কাপড়টা তুলে চিপে নেয় ভালো করে। আগে মুখটা মুছে নিয়ে গাউনের বাইরে দৃশ্যমান অঙ্গগুলো মুছে দেয় যত্ন করে। হাত, গলা, কাঁধ, বুকের উপরিভাগ পানির স্পর্শে কিঞ্চিত শীতল হলো বোধহয়। পেটের কাছে চেপে ধরা তার হাতটা তখনও আগুনের আভাস পাচ্ছে। কাপড়টা আবার ভিজিয়ে রাখে পাত্রে। ডানদিকে সামান্য ঝুঁকে গাউনের নিচের অংশ হাতে তুলে ধরে। বেগমের শরীরটা নিজের সাথে ভর দিয়ে রেখে দু’হাতে উচিয়ে ধরলো গাউন। সফেদ পেট চোখের সামনে দৃশ্যমান হতেই ঘুণ ধরলো তার দৃঢ়তায়। জেগে উঠলো পুরুষালি অনুভূতি। দ্রুত চোখ সরিয়ে খিচে বন্ধ করে বড়বড় শ্বাস টানলো। নিজের অনুভূতি দমানোর বৃথা প্রয়াস মোটেই সফল হলো না। সাহস হলো না গাউন খুলে শরীর মোছার। এক ঝটকায় গাউন ছেড়ে শুকনো ঢোঁক গিলল। বুকের অভ্যন্তরে ঢিপ ঢিপ শব্দ শুনতে পেলো। সিদ্ধান্ত নিলো গাউন খুলবে না। এভাবেই গাউনের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খুব তাড়াতাড়ি করে মুছে দেবে। কিন্তু সেটাও ঝুঁকিপূর্ণ তার জন্য। তবুও করতে হবে। কিছুই করার নেই। তখন একবার অবশ্য ভেবেছিল সেবিকাদের বলবে মুছে দিতে কিন্তু সেই যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো তার অতিরিক্ত জ্বলন। সেবিকারা কেন স্পর্শ করবে তার সম্পদ? সেবিকারা স্পর্শ করলে এতক্ষণে নির্ঘাত সে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। কাপড় চিপে কাঁপা কাঁপা হাতটা গাউনের ভেতর ঢুকিয়ে দিতেই শীতল স্পর্শে কুঁকড়ে যাচ্ছে বেগম। উষ্ণতার খোঁজে আঁকড়ে ধরছে তাকে। এবার করুন দশা সুলতানের। দিক্বিদিক ভুলে অজস্র চুম্বনে ভরিয়ে তুলল খোলা কাঁধ, গলা। নিজ হাতে বেঁধে দেওয়া চুলগুলো একটানে খুলে হাত গলিয়ে দেয়। হুঁশ হারিয়ে আরো গভীরে যাবার পূর্বেই সজোরে ধমকে উঠলো যেন তার অন্তর আত্মা।
“অসুস্থ বেগমের উপর পুরুষত্ব খাটাতে লজ্জা করছে না তোর? চরিত্রহীন সুলতান!”
চকিতে ফেরে সুলতান। এতক্ষণে ধ্যান ফিরল যেন। ব্যস্ত হয়ে বেগমকে পালঙ্কে শুইয়ে উঠে দাঁড়ালো। এসব কী করছিল সে? নাহ, ঠিক করেনি। ভুলও তো করেনি। চরিত্রহীনের কী হয়েছে? এলি তার, শুধুই তার। সুস্থও তার, অসুস্থ অবস্থায়ও তার। সে যা ইচ্ছা তা করতে পারে। লজ্জা! একটুও লজ্জা করছে না। বরং পুরুষত্ব খাটাতে না পারলেই লজ্জা পেত। সমস্ত ধ্যান ধারণা ভুলে সাহস জুগিয়ে অবিশ্বাস্য এক কাজ করে বসলো। চোখ বন্ধ করে এক ঝটকায় গাউন সরিয়ে পুরো শরীর মুছে ফেলে বিজলির বেগে। বেকায়দায় পড়লো মনের ভেতরের অনুভূতি নামক শয়তানটাকে নিয়ে। বারংবার উস্কে দিচ্ছে চোখ খুলে দৃষ্টি রাখতে নিজ সম্পদে। উঁহু, এই প্ররোচনায় কিছুতেই পড়বে না সে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যস্ত হাতে করে গেল নিজের কাজ। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে ধৈর্য হারালো যেন। চোখ মেলে তাকালো ধীরে ধীরে।
অমনি রাগান্বিত কন্ঠে কেউ যেন জাহির করলো, “আরেকটু ধৈর্য ধারণ করতে পারলি না? শেষ তোর সাধুগিরি?”
বিরক্ত হয় সুলতান। সেই কন্ঠকে পাত্তা না দিয়ে একধ্যানে চেয়ে রইল বেগমের দিকে। নেশা ধরছে দৃষ্টি জুরে। বালিশের ওপাশে হাত রেখে ঝুঁকে আসে সে।
“নিজের বেগমের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে কুনজর দিচ্ছিস?”
অতিরিক্ত রাগে কিড়মিড় করে উঠলো সুলতান। ইচ্ছে করলো নিজের অন্তর আত্মাকে এখনি গলা টিপে শ্বাসরোধ করে মে’রে ফেলতে। ভালো কাজে বাঁধা দিয়ে বারবার অনুভূতি নষ্ট করছে তার। যত্তসব! রাগান্বিত আর ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো, “বিবাহের পর থেকেই তো কুনজরে দেখছি। সুনজরে দেখতে থাকলে আর আব্বু হতে পারতাম না। সুনজরে শুধু ক্যাবলার মতো দেখেই যাওয়া লাগতো। কুনজরে আব্বা হতে পারলে কুনজরই সই।”
“নির্লজ্জ, চরিত্রহীন।”
পাত্তা দিলো না সুলতান। একেবারে উপেক্ষা করে ঝুঁকে এসে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলল বেগমকে। দু’হাতে উত্তপ্ত মুখটা ধরে অধরের স্পর্শ এঁকেছে পুরো মুখে। মনের খায়েশ মিটিয়ে আবারো চুল বেঁধে সবকিছু ঠিকঠাক করে দেয়। চলে যেতে হবে। আচমকাই মনটা খারাপ হলো ভীষণ। বেগমের কানের কাছে এগিয়ে এসে ধীর স্বরে ডাকে, “এলি।”
সাড়া পাবে না জেনেও বারংবার, পুনরায় আওড়ায়, “এলি, এলি, আমার বাঘিনী।”
মাথায়, কপালে পরম আদরে হাত বুলিয়ে বিষাদঘন কন্ঠে জাহির করে, “যদি ফিরে আসতে না পারি তবে খেয়াল রেখো নিজের।”
“বাকিটা জীবন সম্রাজ্ঞীর বেশে আমার হয়েই থেকো। যদি আর না ফেরা হয় তবুও আমি চাই না কেউ পূরণ করুক আমার শূন্যস্থান। স্থানটা শূন্যই রেখো এলি। কোনো এক ভরা পূর্ণিমায় বসন্তের অনিলে মিশে স্থানটা পূর্ণ করবো আবার।”
আর কথা বাড়ালো না। এবার তাকে সুলতানের দায়িত্ব নেভাতে হবে। বাঁচাতে হবে নিজ সাম্রাজ্যকে। প্রেয়সীর অসুস্থতা, মায়া, ভালোবাসার টান সবকিছুই উপেক্ষা করে ছুটল একজন দায়িত্ববান সুলতানের ন্যায়। সঙ্গী হলো মাহতাব। অবাক হয়ে চেয়ে আছে সে। শাশুড়িকে সহ্য করতে পারে না তবুও আসার আগে আবারো বেগম আর তোহফার দায়িত্ব বুঝে দিয়ে এসেছে তার নিকট। তবে কি বিশ্বাস করা যায় তাকে? জঙ্গলের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে তাদের ঘোড়া। সুলতান স্বাভাবিক কন্ঠে শুধাল, “কী ভাবছো মাহতাব?”
দৃষ্টি নুইয়ে নিলো মাহতাব। আড়ষ্টতা ঠেলে শুধায়, “না মানে……।”
“বলো।”
“সুলতানা আর শেহজাদির দায়িত্ব কি উনি ঠিকভাবে পালন করবেন?”
“ওহ এই কথা। ওনার ভরসায় রেখে আসিনি আমি। সুলতান ইহসান ইতিমধ্যে রওনা করেছেন। চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। পত্র পাঠিয়েছিল আমাকে। আর সে তার মেয়ে-নাতনিকে অত্যন্ত ভালোবাসে। আশা করি, ভালো থাকবে ওরা।”
রামান সাম্রাজ্যের বিশাল শূন্য উদ্যানে হাঁটছে দু’জন সুন্দরী নারী। সাথে শ’খানেক সৈনিক। একজনের শরীরে রাজকীয় পোশাক অন্যজন খুবই সাধারণ। আনমনে হেঁটে চলেছে তানহা ও জারনাব। জোভিয়া ছাড়া মহলে একা একা বিরক্ত হয়ে পড়েছিল জারনাব। হঠাৎ তানহা বলল বাইরে থেকে ঘুরে আসা যাক। অমনি দু’জন বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু ওয়াসিফা সুলতান সৈনিক ব্যতীত আসতে দেয়নি তাদের। শ’খানেক সৈনিক পাঠিয়েছে সাথে করে। যার দরুন কেউই ঘুরতে আসার আসল মজাটা উপভোগ করতে পারছে না। চোখমুখ কুঁচকে কখনো সৈনিকদের দেখছে তো আবার মুখ ফুলিয়ে একে অন্যের দিকে চেয়ে আছে। সবুজ গাউন পরেছে তানহা। মাথায় মূল্যবান পাথরের তাজ। জারনাব বরাবরের মতোই সাধারণ গাউনের উপর হিজাব করেছে। সুলতানের জন্মের বারো বছর পরে তানহার জন্ম। বিশাল পার্থক্য তাদের বয়সের। তবুও আত্মার দূরত্ব খুবই কম। আশপাশের সৌন্দর্য দেখছিলো জারনাব হঠাৎ হাতে কারোর সূক্ষ্ম খোঁচা পেয়ে অবাক চোখে তাকালো তানহার দিকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে কিছু বলার পূর্বেই তানহা ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, “দৌড়াতে পারেন আপনি?”
“না। কেন?” অবাক স্বর জারনাবের।
“দৌড়ে সৈনিকদের রেখে চলে যাব। এভাবে শ’খানেক সৈনিক নিয়ে ঘুরে মজা নেই। আমার হাত ধরুন। বললেই দৌড়ানো শুরু করবেন। সৈনিকরা আমার পেছনে দৌড়ানোর সাহস করবে না।”
“কিহ! দৌড়ে পালিয়ে যাব আমরা? তোমার মাথা ঠিক আছে?”
বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইল জারনাব। শেষমেশ দৌড়াতে হবে এখন! তানহার মুখভঙ্গি খুবই স্বাভাবিক। যেন সে এমন অবিশ্বাস্য কাজগুলো আগেও বহুবার করেছে। দৃষ্টিতে স্পষ্ট চঞ্চলতা। ভাবনার মাঝেই তানহা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। হতবাক জারনাব অবগত ছিলো না তানহার এমন চঞ্চল সভাবের ব্যপারে। তানহার কথায় সত্যি হলো। পেছনে দৌড়ে আসছে না সৈনিকরা। শুধু উচ্চস্বরে চেঁচাচ্ছে, “ওদিকে যাবেন না শেহজাদি। চারদিকে এখন বিপদ।”
কে শোনে কার কথা। দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই তারা। হাঁপিয়ে উঠেছে জারনাব। তবুও থামছে না তানহা। সৈনিকদের ফেলে অনেকটা দূরে চলে এসেছে তারা। ডেকে ওঠে জারনাব, “দাঁড়াও তানহা। হাঁপ লেগে গেছে তো। আর কতদূর যাবে?”
“আরেকটু।” দৌড়াতে দৌড়াতে বলল তানহা।
আকস্মাৎ ঘোড়ার পায়ের শব্দে থামতে বাধ্য হলো। দুটো ঘোড়া এসে ঠিক তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে পড়লো। সুলতান অবাক হয়ে বলল, “তানহা! দোড়াচ্ছিস কেন তোরা?”
মাহতাব তো হাঁ করে চেয়ে আছে জারনাবের দিকে। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল জারনাব। তানহা আমতা আমতা করে, “আসলে এমনিই।”
“এমনিই কী? বল? আবার পালাচ্ছিলি মহল ছেড়ে?”
“না ভাই। ঘুরতে এসেছিলাম আমরা।”
“তো? দৌড়ানোর কী হয়েছে?”
“আম্মা সৈনিক পাঠিয়েছিল। ঘুরে মজা পাচ্ছিলাম না তাই।”
মস্তক নুইয়ে বলল তানহা। আড়চোখে তাকালো মাহতাবের দিকে। কিন্তু জারনাবের দিকে নিক্ষেপ করা সেই ভালোবাসার দৃষ্টি দেখে ততক্ষণাৎ অন্যদিকে তাকালো। প্রথম যখন মাহতাব এই সাম্রাজ্যের সৈনিক হলো তখনই সে ভালোবেসেছিল তাকে। বলা হয়নি জড়তার কারনে। ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারে এই পুরুষের মনে বহু আগে থেকেই অন্য কারোর বাস। নিজের অনুভূতি নিজের মনেই কবর দেওয়ার চেষ্টায় আছে সে। ধমকে উঠলেন সুলতান, “তোর এই পালাই পালাই স্বভাবের জন্য কবে যেন বিপদে পড়ে যাস তুই। ঘোড়ায় উঠে বস। মহলে চল। যুদ্ধে যেতে হবে আমাদের। তোরা কেউ বাইরে থাকতে পারবি না এখন। চল চল।”
“কিন্তু ভাই…….”
“চুপচাপ উঠে বস। আর মাহতাব তুমি জারনাবকে নিয়ে এসো। দেখো, সাবধানে। পড়ে টরে গেলে এলি আবার আমার কান মাথা চিবিয়ে খাবে।”
ফিক করে হেসে ওঠে মাহতাব। গোমড়া মুখে জারনাব তানহার দিকে তাকালো। ইতিমধ্যে তানহা অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। যেই দৃষ্টির অর্থ হয়তো: ঘুরতে একদিন না একদিন যাবোই আমরা। তানহা দক্ষ হওয়ায় সুলতানের হাতকে ভরসা করে সহজেই ঘোড়ায় উঠে বসে। তাকে নিয়ে মহলের দিকে ঘোড়া ছোটালো সুলতান। বিপত্তি বাঁধলো জারনাবকে নিয়ে। সে তো ঘোড়ায় উঠতে জানে না। মুচকি হেসে নেমে এলো মাহতাব। সম্মোহনী কন্ঠে বলল, “আমি উঠিয়ে দেই?”
“কীভাবে?”
“কোলে তুলে।”
শব্দ করে হাসতে শুরু করেছে মাহতাব। রেগে গেল জারনাব। কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “দিনকে দিন বখে যাচ্ছ তুমি।”
“আচ্ছা তাই নাকি? তা কীভাবে উঠবেন আপনি? বলুন, আমিও শুনি। এছাড়া তো আর কোনো উপায় দেখছি না।”
“হেঁটেই চলে যেতে পারবো আমি। এমনিও খুব বেশি দূর নয় মহল।”
“ঠিক আছে। চলো, আমিও হাঁটব।”
“কিন্তু ঘোড়া…..”
“ঘোড়া এখানে বেঁধে রেখে যাচ্ছি। মহলে গিয়ে সৈনিক পাঠিয়ে দেব নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
সামনেই একটা গাছের সাথে ঘোড়া বেঁধে দিলো মাহতাব। কতদিন পর একসাথে হাঁটবে তারা এই সুযোগ কিছুতেই ছাড়বে না সে। মহলমুখো হাঁটতে হাঁটতে জারনাব শুধায়, “আজই তোমরা যুদ্ধে যাবে আজমাইন?”
“হ্যাঁ জুঁই। একটু পরেই রওনা হবো আমরা।”
আকস্মাৎ কালো মেঘ ছেয়ে যায় নারীর সুন্দর মুখশ্রীতে। যুদ্ধকে বড্ড ভয় পায় সে। এই যুদ্ধ নামক মৃ’ত্যুকুপেই সে চিরতরে হারিয়ে বসেছে সাহাদকে। আজমাইনও যুদ্ধে যাবে! কেন? কেন আবার এই প্রাণঘাতী খেলা শুরু হলো? কেন হারিয়ে যায় প্রিয় মুখগুলো? ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে, “তুমি যেও না আজমাইন।”
খানিক অবাক হলো মাহতাব। শুধাল, “কেন?”
“যুদ্ধ ভালো না। সবাইকে কেড়ে নেয়। তোমাকেও কেড়ে নেবে। যেও না তুমি, যেও না।”
চকিতে ফিরল মাহতাব। জারনাব ভয় পাচ্ছে দেখেও কেন যেন খুশি হলো সে। উচ্ছাসিত হলো হৃদয়। ভয় পাচ্ছে জুঁই! তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়! সে গুরুত্বপূর্ণ এই নারীর জীবনে। জারনাব পুনরায় কাতর কন্ঠে আওড়ায়, “যেও না আজমাইন। তুমিও হারিয়ে যাবে সাহাদের মতো।”
এগিয়ে আসে মাহতাব। একহাতে হিজাবে ঢাকা মুখটা তুলে বলল, “আমার কিছু হবে না জুঁই। আমি ফিরবো। অবশ্যই ফিরবো তোমার কাছে।”
“কিন্তু আজমাইন…….”
“হুশশ।”
ঠোঁটে আঙুল চেপে কথা বন্ধ করে দেয় মাহতাব। তৃপ্তিভরা কন্ঠে বলে, “তুমি যদি চাও আমি ফিরে আসি তবে আমি ফিরবো। ফিরবোই। সমস্ত বাঁধা ছিন্ন করে ফিরবো আমি।”
ছলছল করছে জারনাবের আঁখিজোড়া। সে কিছুতেই ভরসা পাচ্ছে না। সাহাদও তো বলেছিল সে ফিরবে। কই? ফেরেনি তো। হ্যাঁ কথা রেখেছিল সে। লাশ হয়ে ফিরেছিল তার কাছে। সে আর চায় না। আর কোনো লাশ সে চায় না। কেন যাবে আজমাইন? প্রিয়তমার চোখের পানিতে গলল না বীরের হৃদয়। যুদ্ধই তার আসল ঠিকানা। সবকিছুর উর্ধে গিয়ে সে একজন সৈনিক। বড় নিষ্ঠুর হয়ে উঠলো মাহতাব। আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে আশ্বস্ত করে বলল, “বোঝার চেষ্টা করো জুঁই। সৈনিক প্রধানের জীবনে এটাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, বড় পরিক্ষা। যেতে হবে আমাকে। অবুঝ হয়ো না।”
“সাহাদ ফিরে আসেনি। তুমি ফিরে আসবে তো আজমাইন?”
বারংবার উচ্চারিত সাহাদ নামটা কঠিনভাবে উপেক্ষা করলো মাহতাব। আবেশি কন্ঠে আওড়ায়, “তুমি যখন চেয়েছো এখন তো, না ফিরে আর উপায় নেই আমার। আমি আসবো জুঁই। ভয় পেয়ো না।”
ভরদুপুরে লক্ষাধিক সৈনিক সমেত ভূমি কাঁপিয়ে পার্শ্ব সাম্রাজ্যের দিকে এগোচ্ছে সুলতান। তার থেকে কয়েক কদম পেছোনেই মাহতাব। বীরের ন্যায় সুলতানের আদেশের অপেক্ষায় সে। তাদেরকে অনুসরণ করেছে লক্ষ লক্ষ বীর সৈনিক। ঢাল-তলোয়ার, তির-ধনুক সবই আজ সঙ্গী তাদের। লক্ষ লক্ষ ঘোড়ার পায়ে পায়ে কম্পিত হয় ভূমি। অশনি বার্তা নিয়ে মেঘে ঢেকেছে গগণ। সুলতানের রাজকীয় পোশাকের স্থানে জায়গা পেয়েছে যুদ্ধের শক্ত পোশাক। বুকে লোহার বর্ম। তার দৃষ্টি আজ কোথাও নেই বেগম। কোথাও না। সবটা জুড়ে শুধু খু’নের নেশা। কত প্রাণ ঝরে পড়বে তার হিসেবও কেউ রাখবে না। চালাকি করেছে উমার। দুই সাম্রাজ্যের সংযোগকারী সরোবর ভেঙে মিশিয়ে দিয়েছে পানির সাথে। বাধ্য হয়ে তাই পাহাড়ের দুর্গম রাস্তা বেছে নিতে হয়েছে তাদের। ভেসে আসে মাহতাবের চিন্তিত কন্ঠ, “পাহাড়ের রাস্তা আমাদের জন্য অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ হবে মহামান্য। উমার ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে। ওদিক দিয়ে প্রবেশ করলে যুদ্ধে মৃ’ত্যুর হার কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। পাহাড়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা অসম্ভব। আমরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসবো।”
“আমাদের নিকট আর কোনো উপায় নেই মাহতাব। এটাই এখন একমাত্র রাস্তা ঐ সাম্রাজ্যে প্রবেশ করার। ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে।” হীম শীতল তার কন্ঠ। যেন এই কন্ঠেই মিশেছে হাজার দায়িত্ব।
পার্শ্ব সাম্রাজ্যে প্রবেশ করার ঠিক আগ মুহূর্তেই থামতে হয় তাদের। সম্মুখের কোনো দৃশ্যে হিং’স্র হয় সুলতান। রাগে গর্জে ওঠে সে, “ওরা এই সাম্রাজ্যে কী করছে মাহতাব?”
চলবে……….
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_38
অম্বরে নীলচে রাশি। সুউচ্চ পর্বতের চূড়ায় উড়ছে যুদ্ধের কালো নিশান। পাহাড়ের খোলা প্রান্তরে ঢাল-তলোয়ারের ঝনঝন শব্দে ভারী হয়েছে পরিবেশ। আতঙ্কে কাঁপছে যেন ভূমি। লক্ষ লক্ষ সৈন্য দায়িত্ব নেভাতে নেমে অচিরেই দিচ্ছে নিজের প্রাণ। সবুজ চূড়ার ছোট্ট ছোট্ট ঘাসগুলো পায়ে মাড়িয়ে ফ্যাকাশে বর্ণ পেয়েছে। ছিটে আছে বীরের তাজা রক্ত। গম্ভীর প্রকৃতি ছাপিয়ে যাচ্ছে কখনো হিং’স্র গর্জনে তো আবার কখনো মৃত্যুর তিক্ত আর্তনাদে। রামান সাম্রাজ্য আর পার্শ্ব সাম্রাজ্যের এই কঠিন যুদ্ধে আতঙ্কিত সাধারণ সাম্রাজ্যবাসী। লড়ছে মাহতাব, লড়ছে সুলতান, লড়ছে সমস্ত সৈন্যবাহিনী। তবুও যেন ফুরায় না যুদ্ধ, থামে না নিষ্ঠুর হ’ত্যলীলা। একদিন নয় দু’দিন নয়। পুরো সাতদিন ধরে লড়ছে তারা। শুকনো খাবার খেয়ে কোনো রকম বেঁচে আছে। অথচ সৈন্য যেন কমার বদলে বেড়েই যাচ্ছে। কিছুতেই এই যুদ্ধের সুরহা হয় না।
কোনো পক্ষই রাজি নয় একচুল ছাড় দিতে। আপোসের নিশান ওড়ে না কোথাও। একহাতে ঢাল অন্যহাতে ধারাল ভারি তলোয়ার নিয়ে বিরতিহীন লড়ছে মাহতাব। হাতে-মুখে ময়লা লেগেছে। কাঁধ পর্যন্ত চুলগুলোও যেন উষ্কো-শুষ্ক। দয়া মায়াহীন দৃঢ়তার সাথে একের পর এক সৈন্যের শরীরে গেঁথে দিচ্ছে তলোয়ার। সুদক্ষ তার হাতজোড়া। পিপড়ের মতো ময়দানে হুরহুরিয়ে প্রবেশ করছে আরো শত শত সৈন্য। ভরে উঠছে ময়দান। রামান সাম্রাজ্যের তুলনায় পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সৈন্য সংখ্যা অনেকটা বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর একমাত্র কারন দক্ষিণী সাম্রাজ্য। হ্যাঁ, দক্ষিণী সাম্রাজ্যের সুলতান সাথ দিচ্ছে উমারের। সে প্রায় লক্ষাধিক সৈন্য প্রেরণ করেছে পার্শ্ব সাম্রাজ্যের হয়ে লড়তে। এতে করে সংখ্যায় কম পড়ছে রামান সাম্রাজ্যের সৈন্যরা। সাতদিন পূর্বে যখন তারা পাহাড় দিয়ে পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সীমানায় পা রাখে তখনই চমকে গিয়েছিল দক্ষিণী সাম্রাজ্যের সৈন্যদের দেখে। তাদের গাড়ো সবুজ পোশাক পরিচয় দেয় তাদের। সুলতান হতবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল, “ওরা এখানে কী করছে মাহতাব?”
অথচ মাহতাবের নিকট ছিল না কোনো উত্তর। কীভাবে উত্তর দেবে? সে তো নিজেই চমকে গিয়েছিল দক্ষিণী সাম্রাজ্যের সৈন্যদের এখানে দেখে। তারা ভাবতেও পারেনি দক্ষিণী সুলতান এমন কিছু করবে। উমারের সাথ দিয়ে বিরোধিতা করছে তাদের। সংখ্যা বৃদ্ধির কারনে শক্তিশালী হয়েছে পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সৈন্যদল। বল পেয়েছে উমার। এই অতিরিক্ত সৈন্য হজম করতে হচ্ছে রামান সাম্রাজ্যের সৈনিকদের। তাদের পক্ষে পাহাড়ে লড়াই করা যতটা কঠিন হচ্ছে তার চেয়ে বেশি গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে গেছে এই অতিরিক্ত সৈন্য। এভাবে চলতে থাকলে পরাজয় নিশ্চিত। তবুও লড়তে হবে। শেষ শ্বাস পর্যন্ত লড়তে হবে। বাঁচাতে হবে নিজ সাম্রাজ্য। জয় পাবে না জেনেও এক প্রকার বাধ্য হয়েই লড়তে হচ্ছে। সুলতানের হাতে তার পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া শক্তিশালী তরবারি ‘যাহীর’। যার এক আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে তাজা প্রাণ। যাহীর নামক এই তরবারি যেন তাকে ভরসা জোগায়। শক্তিশালী করে তোলে কয়েকগুণ। এই তরবারি সে শুধুমাত্র যুদ্ধের সময়ই ব্যবহার করে। বিশেষ এই তরবারি তার নিকট বিশ্বস্ত বন্ধুর মতোই মূল্যবান। যাহীর যেন তার বিজয়ের অপর নাম। চোখের পলকে লাশ ফেলছে শত শত। দৃষ্টিতে নেই হিং’স্রতা। শান্ত হয়ে লড়ার তার এই প্রচেষ্টায় হয়তো টিকিয়ে রেখেছে তাদের। লড়তে লড়তে ঢাল সম্মুখে ধরে তার দিকে এগিয়ে আসছে মাহতাব। ঘামে চুপচুপে শরীর। ক্লান্ত দেহের দৃঢ়তা যেন আকাশচুম্বি।
হাঁপাতে হাঁপাতে খানিকটা উচ্চস্বরে বলল, “আমাদের আপোসের পতাকা উড়িয়ে দেওয়া উচিত। এত সৈন্যের মাঝে আমরা বড় নগণ্য। ইতিমধ্যে আমাদের সৈন্য কমে এসেছে। যারা বাকি আছে তাদের প্রাণটাও যাবে যদি এখনি আপোস না করি। দক্ষিণী সুলতান এভাবে শত্রুতা করবে তা ভাবনার বাহিরে ছিল।”
তাকালেন না সুলতান। শান্ত ভঙ্গিমায় তরবারি চালাতে থাকলেন নিজের মতো। দক্ষ হাতের কাছে পরাজিত হচ্ছে সাধারণ সৈনিকেরা। বীরের ন্যায় রক্ত মাখা তরবারি দিয়ে আবারো প্রহার করে শান্ত গলায় বলল, “হার মেনে নিচ্ছ মাহতাব? সাতটাদিন লড়ছো আর আজ বলছো আপোস করতে! হাসালে।”
“কিন্তু মহামান্য…….”
“আমরা লড়বো এবং শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়বো। নিজের দায়িত্বে মনোযোগ দাও। সুলতান শাহজাইনের পুরো জীবনীতে কোথাও আপোস শব্দটার স্থান নেই। দক্ষিণী সুলতানকে এর মূল্য চোকাতে হবে। কঠিনভাবে চোকাতে হবে। আপোসের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। হয় লড়ো নয় ম’রো।”
হতাশ হতে দেখা যায় না মাহতাবকে। যেন সে জানতো এই উত্তরই আসবে অপরপাশ থেকে। কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে আবারো তলোয়ার চালায় সে। দৃষ্টিতে জয়ের তীব্র নেশা। আকস্মাৎ হুংকার ছেড়ে বলে ওঠে, “ম’রবি, তোরা আজ ম’রবি। জয় পেলেও প্রাণ পাবি না।”
সন্তুষ্ট হলো বোধহয় সুলতান। কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজ কমলো খানিক। অজান্তেই অধর প্রসারিত হলো কিছুটা। শক্ত হাতে একের পর এক সৈন্য হ’ত্যা করতে করতে উমারের দিকে এগোচ্ছে সে। উমারের হাতে তলোয়ার থাকলেও সে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সুলতানের নিকট প্রেরণ করেছে তার হাজারটা সৈন্য অথচ নিজে আসছে না। দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে না কি ভয় পাচ্ছে সুলতান শাহজাইনের সামনে দাঁড়াতে? তাচ্ছিল্য হাসে সুলতান। সুলতানকে নিজের দিকে এগোতে দেখে দপদপ করে জ্বলে ওঠে যেন। ব্যস্ত হয়ে নিজের সেনা প্রধানকে বলে উঠলো, “যাও। শেষ করে দাও সুলতান শাহজাইনকে। এক ফোঁটা রক্ত যতক্ষণ ওর শরীরে থাকবে ততক্ষণ প্রহার করবে। আমার বোনের মৃ’ত্যুর বদলা নিয়ে তবেই আজ শান্ত হতে পারবো আমি। যাও, দ্রুত যাও।”
শ্রবণগোচর হলো সুলতানের। তরবারির তাল ঠিক রেখে ক্লান্ত মুখে সামান্য হাসলো। চিৎকার করে গলা উচিয়ে বলল, “বিশ্বাসঘাতকতা বীরের পরিচয় নয় উমার। এখনো সময় আছে। সুধরে যা।”
ততক্ষণাৎ তেতে উঠলো বুঝি উমার। তলোয়ার শক্ত করে মুঠোয় ধরে হিং’স্র স্বরে জানান দিলো, “তোর বীরত্ব দেখতেই তো এতো আয়োজন শাহজাইন। কেমন লাগছে বল?”
“খুব মজা। মধুর মতো স্বাদ।”
অতিরিক্ত রাগে হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে কয়েক পা এগিয়ে আসে উমার। ময়দান কাঁপিয়ে হেসে ওঠে সুলতান। বিদ্রুপ করে বলল, “রেগে গেলি নাকি উমার? প্রতিশোধ নিবি না বোনের মৃ’ত্যুর? আয়, আমার সাথে লড়ে প্রতিশোধ নে। কাপুরুষ! দূরে দাঁড়িয়ে প্রতিশোধ নিলে তোর বোনের আত্মা কষ্ট পাবে। আয় বাচ্চা, আমার সামনে আয়।”
দাঁড়িয়ে রইল উমার। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠলো, “ছল করছিস? বীর সুলতান শাহজাইন ছল করছে যুদ্ধে জেতার জন্য?”
“যুদ্ধে সবকিছু জায়েজ।”
অধর বিকৃত করে বাঁকা হাসে উমার। সেদিকে নজর দেওয়ার সময় নেই সুলতানের নিকট। তরবারির কোপেই দৃষ্টি আবদ্ধ তার। শান্ত শরীরে রাগের বিক্ষিপ্ত তরঙ্গ শিরদাঁড়া বেয়ে নামে উমারের কন্ঠে।
“তোর বেগমের শরীরটা কিন্তু জব্বর আকর্ষণীয়। আবেদনময়ী শরীরের প্রতিটা ভাঁজ। দেখলেই জিহ্বায় পানি চলে আসে।”
চমকে ওঠে মাহতাবসহ সমস্ত রামান সৈন্য। একেতো তাদের সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে এই বিদঘুটে, বিশ্রি মন্তব্য। তার উপর সুলতান যদি এবার রেগেমেগে কোনো ভুল পদক্ষেপ নিয়ে বসে তাহলেই শেষ তারা। পরাজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। অথচ নীরব, নিশ্চুপ সুলতান। যেন কিছু শুনতেই পায়নি সে। গা ছাড়া ভাবভঙ্গি। উমার খানিক অবাক হলেও আশা হারায় না। সে জানে শাহজাইন তার বেগমকে ঠিক ততটা ভালোবাসে যতটা ভালোবাসলে পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে যাওয়া যায়। ভুলে যাওয়া যায় নিজের হাতে সাজানো বিশাল সাম্রাজ্যকে। ধন-দৌলত, দায়িত্ব কর্তব্য সবকিছুই উর্ধে সেই ভালোবাসার টান। সে এতটা নিশ্চিত হয়েছে দারিয়ার মৃ’ত্যুর পরে। তার বোন দারিয়া অনন্য সুন্দরী। যার রূপের মোহে পড়েনি এমন কোনো পুরুষ বোধহয় শাহজাইনই প্রথম। পড়েছিল দক্ষিণী সাম্রাজ্যের সুলতানও। তাইতো দারিয়ার মৃ’ত্যুর প্রতিশোধ নিতে এত সৈন্য প্রেরণ করেছে সে। এসবকিছুই সে করেছে দারিয়ার জন্য তার জন্য নয়। অথচ এই শাহজাইন কি-না সেই লাবণ্যময়ী সুন্দরীকে পায়ে ঠেলল বেগমের ভালোবাসায়! শুধু কি তাই? শেষ পর্যন্ত মে’রেও ফেলল তার বোনটাকে। শুধুমাত্র এলিজা সুলতান কষ্ট পেয়েছিল বলে? তার বোনটা জীবনের প্রথম কিছু চেয়েছিল তার নিকট। অন্ধের মতো ভালোবেসেছিল শাহজাইনকে। আর এই শাহজাইন তারই বুকে তলোয়ার চালিয়ে দিলো! চোখদুটো বন্ধ করলো সে। অনুভব করলো দারিয়ার সেই নিথর শরীরটা। ছাড়বে না সে। কিছুতেই ছাড়বে না। শাহজাইনের পর হ’ত্যা করবে এলিজাকেও। নিঃশেষ করে দেবে শাহজাইনের ভালোবাসা। ধপ করে চোখ খুলে রসিয়ে রসিয়ে বলল, “সত্যিই কী রূপ! কী শরীর! একটা বাচ্চা হবার পরেও এভাবে নিজের শরীর, রূপ নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে তোর বেগম? বেশি আদর দিস নাকি? একরাত আমার কাছেও পাঠা। আদর করে আরো সুন্দরী করে দেবো।”
নির্জীব জড়বস্তুর ন্যায় তরবারি চালাচ্ছে সুলতান। শুনেও যেন শুনছে না তিক্ত বাক্যগুলো। এত এত সৈন্যের মাঝে এই ভরা ময়দানে নিজের বেগমের অসম্মান বুঝি অসাড় করে দিচ্ছে তার হাতদুটো। ভারি হয়েছে উঠেছে তরবারি। তবুও শান্ত ভঙ্গিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। হুরমুর করে সব ফেলে এগিয়ে এলো মাহতাব। উত্তেজিত গলায় বলল, “এসব কথায় কান দিবেন না মহামান্য। ও আপনাকে আজেবাজে বলে চেতিয়ে তুলতে চাইছে।”
“আমি জানি মাহতাব।”
“আপনার একটা ভুল পদক্ষেপ ধংস করে দেবে আমাদের।”
“জানি।”
আবারো বলল উমার, “দিবি নাকি? একরাত। শুধু একরাত।”
অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাহতাব। তলোয়ারের এক কোপে মাথাটা নামিয়ে দিতে পারলে শান্তি মিলতো তার। কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে এমন একটা পদক্ষেপ নেহাতই বোকামি হবে। এতকিছুর পরেও সুলতানকে নীরবে শান্ত হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দেখে সস্তি পেল। বিড়বিড়িয়ে বলল, “আমিতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। বেগমের ব্যপারে সবসময়ই বেপরোয়া সুলতান। নাজানি এই পরিস্থিতিতে রাগের মাথায় কোনো ভুল করে বসে।”
মুখের কথা মুখেই রইল। বিজলির বেগে তেড়ে যায় সুলতান। রাগে ফোঁস ফোঁস করে। গর্জন করে হিং’স্রভাবে। তরবারির গতি দ্বিগুণ করে লাশ ফেলে অগণিত। গগণ কাঁপিয়ে চিৎকার করে, “আজ তোকে জাহান্নাম দেখিয়ে দেবো বেজ’ন্মা।”
হতভম্ব মাহতাব ছুটে গিয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরলো ততক্ষণাৎ। সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ধরে থামাতে চাইল সুলতানকে। তাকে ঠেলে নিয়ে এগোচ্ছে সুলতান। এক পলকেই বদলে গেছে তার ভাবাবেগ। সে যেন হিং’স্রতার চরমে পৌঁছেছে আজ। হাজার সিংহের শক্তি পেয়েছে বুঝি শরীরে। মাহতাব একা পেরে উঠছে না দেখে আরো কয়েকজন সৈন্য দৌড়ে এলো। সকলে মিলে টেনে পেছনে নেওয়ার চেষ্টা করছে সুলতানকে।
বারবার, লাগাতার আওড়াচ্ছে, “আপনি ভুল করছেন। এভাবে করলে ধংস হয়ে যাবো আমরা।”
কোনো কথাই গ্রাহ্য করছে না সুলতান। আহত সিংহের ন্যায় ছুটছে কেবল উমারের দিকে। নিজের তলোয়ার শক্ত করে ধরে রহস্যময় হাসছে উমার। উদ্দেশ্য সুলতান কাছে আসলেই তলোয়ারটা গেঁথে দেবে গলায় মাঝ দিয়ে। পেছনেই তার সেনা প্রধান লোহার শেকল হাতে ওঁৎ পেতে আছে। সমস্ত জল্পনা কল্পনায় পানি ঢেলে সুলতানকে টেনে সরিয়ে নিলো সৈন্যরা।
হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে উঠলো মাহতাব, “কী করতে যাচ্ছেন আপনি? একবার ভেবেছেন নিজের সাম্রাজ্যের কথা? এতগুলো সৈনিকের কথা? যারা নিজ সাম্রাজ্যের জন্য, আপনার জন্য প্রাণ দিচ্ছে অনায়াসে? মূল্য নেই তাদের কোনো?”
থামলো সুলতান। পা দিয়ে মাটিতে লাথি লাগায় সর্বশক্তিতে। তাদের দিকে আগত পার্শ্ব সৈনিকের গলায় তরবারি চালিয়ে দেয় তখনই। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে উঠলো, “সব জেনেও আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না মাহতাব। ওর জিভ কেটে কুকুর দিয়ে না খাওয়ালে শান্তি পাবো না আমি।”
“শান্ত হন মহামান্য।”
আরো দু’জন পার্শ্ব সৈনিক ঢলে পড়ে তরবারির আঘাতে। গলায় গাঁথা তরবারি আরো গেঁথে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সুলতান, “আআহহ! নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না আমি। কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।”
তার হাত চলছে অবিশ্বাস্য গতিতে। হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে প্রহার করে চলেছে সর্বশক্তি দিয়ে। দক্ষ হাতে হিং’স্রতার পরশ। চারপাশে শুধু লাশ আর লাশ। আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে সে নিজেও। তলোয়ারের আঁচড়ে মুখের একপাশের চামড়া চিরে রক্ত ঝরছে। তবুও পরোয়া নেই তার। থামছে না কিছুতেই। লাশের যেন বন্যা বইছে। চোখে যেন এবার ধোঁয়াশা দেখতে শুরু করেছে উমার। এমনটা অন্তত আশা করেনি সে। হুট করে ঘুমন্ত সিংহ জেগে ওঠার মতোই ভয়ঙ্কর অনুভূতি হলো তার। রাগান্বিত দৃষ্টিতে উমারকে পর্যবেক্ষণ করলো মাহতাব। উপহাসের কন্ঠে বলল, “বোকামি করলি উমার। সিংহ যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে ততক্ষণই জঙ্গলে তোর মতো চোর ছ্যাচড়রা নিরাপদে থাকে।”
“ছাড়ব না তোদের।” চিৎকার করে উমার।
আমলেই নিলো না মাহতাব। ঢাল-তলোয়ারের গতিবিধি ঠিক রেখে আবারো বলল, “মূর্খ! তোকে সুলতানের আসনে কোন বল’দ বসিয়েছিল? তার কানের গোড়ায় আগে সপাটে একটা দেওয়া উচিত।”
অথচ উমার আবারো সেই একই কাজ করতে নিলো। সুলতানকে রাগিয়ে তুলে বিজয় হাসিল করায় তার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধর প্রসারিত করে বিকৃত ভঙ্গিমায় বলল, “তোর বেগমের যে শরীর তাতে শুধু আমার কেন যে কোনো পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে…………।”
তাকে মাঝপথে থামিয়ে আকস্মাৎ সুলতান বলে উঠলো, “দারিয়া।”
“কী বললি?”
“শেহজাদি দারিয়া। তুই ভুলে গেলে সমস্যা নেই আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। তোর বোন আমার সাথে বেশ কদিন যাবত একটা সম্পর্কে ছিল। প্রনয়ের সম্পর্ক। আমার দিক থেকে সবটা অভিনয় হলেও ওর দিক থেকে একদম খাঁটি ছিল। একসাথে, একান্তে সময় কাটিয়েছি আমরা।”
“কী বলতে চাস তুই শাহজাইন?”
“তেমন কিছু না। দারিয়া অনেক খোলামেলা আচরন করতো আমার সাথে। আর হাজার হোক পুরুষ তো আমিও। আবেদনময়ী নারীর সংস্পর্শে কতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখা যায় বল?”
“চুপ। মিথ্যে কথা বলছিস তুই। আমার মৃ’ত বোনকে তুই অসম্মান করিস কোন সাহসে? এমন কিছুই হয়নি। বানিয়ে বানিয়ে বলছিস তুই।”
বাঁকা হাসে সুলতান। থেমে নেই হাত। ব্যাঙ্গাত্বক কন্ঠে বলল, “এমনিতে আমারও ইচ্ছা ছিলো না মৃ’ত ব্যক্তিকে নিয়ে বলার। তুই বাধ্য করলি। যাকগে, সেসব কথা থাক। তোর বোনের শরীরের প্রতিটা গোপন অঙ্গের নিখুঁত বিবরণ দিতে পারবো আমি। দেবো নাকি?”
“শাহজাইন! এত নোংরা তুই?”
“এরচেয়েও বেশি নোংরা আমি। শুনবি নাকি উমার?”
দু’জন সৈন্য ছুটে আসে উমারের দিকে। ধীর গলায় কিছু একটা বলল যা শ্রবণগোচর হলো না কারোর। উমারের ঠোঁটের কোনায় ফুটে উঠেছে শয়তানি হাসি। চোখদুটো চকচক করে উঠলো। ভ্রু কুচকাল সুলতান। হঠাৎ করে কি হীরা জহরত পেয়ে গেছে? হাসছে উমার। আশপাশ কাঁপিয়ে হাসছে। সকলে অবাক হয়ে চেয়ে আছে তার দিকেই। অবাক হয়েছে উমারের সেনা প্রধানও। হুট করে কী এমন শুনলো যে এত খুশি হয়ে গেল? ভাবনার অবসান ঘটিয়ে উমার বলতে শুরু করলো, “তোর জন্য একটা অতি আকর্ষণীয় উপহার এনেছি শাহজাইন। আমি নিশ্চিত তুই খুবই খুশি হবি উপহারটা দেখলে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবি। আমি ভাবছি কেমন অনুভূতি হবে তোর? আনন্দে শ্বাস নিতে ভুলে যাবি? নাকি খুশি খুশি মনে নিজের জীবনটা আমাকে উপহার দিয়ে দিবি?”
“মানে!” উমারের হঠাৎ পরিবর্তনে বিস্মিত সুলতান।
“উপহারটা খুবই খাস। তবে না চাইতেও তোর একটা উপকার করে ফেলেছি আমি।”
কিছুক্ষণ থেমেই উচ্চস্বরে বলল, “সামনে নিয়ে আয় ওকে। দেখুক শাহজাইন প্রাণ ভরে।”
বলতে না বলতেই পার্শ্ব সেনারা কাউকে টানতে টানতে সামনে নিয়ে আসে। হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় ছটফট করছে সে। টলমল চোখে চেয়ে আছে সুলতানের দিকে। সুলতানের থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড় করিয়ে গলায় ধরে রাখে ধারাল তলোয়ার। তাক করা হয়েছ সহস্র তীরের ফলা। বদলে গেল যুদ্ধের পরিবেশ। আপনা আপনি থেমে গেছে রামান সৈন্যদের তলোয়ার। হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে সেদিকে। মাহতাব একবার সেদিকে তাকিয়েই ততক্ষণাৎ দৃষ্টি ঘুরিয়ে সুলতানের দিকে চাইল। তরবারি হাতে তেড়ে যেতে নিলো সুলতান।
“উঁহু, তুই আর এক পা এগোলে ওর গলায় ধরে রাখা তলোয়ার রক্তে রেঙে উঠবে। শরীরে বিধবে শত শত তীরের ফলা।” সতর্ক করলো উমার।
থমকে দাঁড়িয়েছে সুলতান। দৃষ্টিতে কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, “কী চাস তুই? যুদ্ধে জয়?”
“সেটা তো আমি পাবোই। চেয়ে দেখ, তোর সেনারা কেমন যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে।”
আশেপাশে তাকালো না সুলতান। পুনরায় শুধাল, “তবে কী চাস? ওকে ছেড়ে দে। তুই যা চাস আমি সব করতে রাজি।”
“তোর মৃ’ত্যু চাই আমি। আমার বোনের কবরের পাশে শোয়াতে চাই তোকে। যদি তুই চাস ও বেঁচে থাকুক তবে তরবারি ফেলে এগিয়ে আয়। খবরদার ওর কাছে আসবি না। ডানদিকে দেখ একটা কাঠের গুঁড়ি আছে ওটাতে মাথা রাখ যেন আমার সৈনিকের সুবিধা হয় তোর মাথা কাঁটতে।”
“আর যদি না যাই?”
“ভেবে দেখ। নিজের জীবন চাস নাকি সাম্রাজ্যবাসীর। তুই ম’রলে সমস্ত যুদ্ধ আমি বন্ধ করে দেবো কথা দিলাম।”
“বিশ্বাস করি না তোকে।”
“আর কোনো পথও নেই তোর নিকট।”
ঘন্টাখানেকের বিশাল বাকবিতণ্ডা শেষে ফয়সালা হলো সুলতান যাবে। তবে তার জীবনের বিপরীতে ছেড়ে দিতে হবে তার অতি প্রিয় একটা প্রাণ। শেষ করতে হবে যুদ্ধ। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে উমার। ইতিমধ্যে রামান সেনাদের চলে যাওয়ার হুকুম দিয়ে দিয়েছে সে। সবকিছুর বিনিময়ে শুধু চায় সুলতানের প্রাণ। অবশেষে তার বোনের আত্মা শান্তি পাবে। সুলতান তরবারি ফেলে দিয়েছে। এগোতে নিলে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মাহতাব। আশ্বস্ত করলো সুলতান, “সবাইকে নিয়ে ফিরে যাও মাহতাব। খেয়াল রেখো সকলের।”
উত্তরীয় সাম্রাজ্যের মহলের বাগানে অজানা কষ্টে হাঁসফাঁস করছে বেগম। বুক ফেটে কান্না আসছে অযথায়। একেতো সুস্থ হয়ে পর্যন্ত সে নিজের পাশে পায়নি সুলতানকে। মায়ের কাছে শুনেছে কোনো কাজের জন্য তাকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে চলে গেছে সে। সুলতান কীভাবে এমন করতে পারে? কবে এত নিষ্ঠুর হলো? এতগুলো দিন কি একবারও মনে পড়ছে না তার কথা? কেন তাকে নিতে আসছে না সুলতান? অভিমান নয় কষ্ট হলো বড্ড বেশি। দু’হাতে গাউন উচিয়ে ধরে দিক্বিদিক ভুলে ছুটল নিজের কামরার দিকে। উপলব্ধি হলো না হুট করে কেন এত বেশি কষ্ট হচ্ছে? পালঙ্কে বসে চাদর খামচে কেঁদে উঠলো বিনা কারনেই। ধরা গলায় আওড়ালো, “আসুন না সুলতান। আমাকে নিয়ে চলুন আপনার সাথে। এখানে একদম ভালো নেই আমি।”
চলবে……..