সম্রাজ্ঞী পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0
222

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_52

মাটিতে পড়ে পা আঁকড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে মামা। রক্তে রেঙে উঠেছে জঙ্গলের মাটি। চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে ভয়ে। ব্যথায়, যন্ত্রণায় গগণবিদারি আর্তনাদ করছে সে। অথচ কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই সুলতানের। এটা বুঝি খুব স্বাভাবিক ঘটনা তার নিকট। আর্তনাদ যেন কর্ণগহ্বরে পৌঁছাচ্ছেই না। নির্বিকার ভঙিমায় নিজের মাথার বিশালাকার পাগড়ি খুলে মামার অক্ষত পা’টাতে বেঁধে দিয়ে পাগড়ির অপর প্রান্ত নিজের হাতের সাথে শক্ত করে পেঁচিয়ে রাখে। ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে তাদের থেকে কিছুটা দূরে। সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আৎকে ওঠে মামা। বিস্মিত হয়ে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,

“কককী করছো? ছেড়ে দাও আমাকে।”

পা থামিয়ে কিছুটা বিরক্তির চাহনি নিয়ে পেছনে ঘুরলো সুলতান। কিন্তু কিছু না বলেই পুনরায় ঘোড়ার দিকে হাঁটতে লাগলো। তবে এবার পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। হাতে বেঁধে রাখা পাগড়ি টানটানে হলো। পাগড়ির অপর প্রান্তে থাকা মামার পা মাটি থেকে সামান্য শূন্যে উঠলো। অসীম শক্তির অধিকারী সুলতানের বলিষ্ঠ শরীর সহজেই নাড়িয়ে তোলে মামাকে। আরোও কয়েক পা সামনে আগাতেই পাগড়ির বাঁধন মজবুত হয়। মাটিতে ছেছড়াতে লাগলো মামা। জঙ্গলের মাটিতে পড়ে থাকা ডাল-পাতার উপর টেনে হিচড়ে সুলতানের পেছনে চলেছে মামা। দু’হাতে মাটি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে আতঙ্কিত গলায় বলল,

“দোহাই লাগে তোমার! খুলে দাও বাঁধন।”

“ছাড়ো আমাকে!”

সুলতান পায়ের গতি আরোও বাড়িয়ে তুলল। মামার গোটা শরীরটাকে হিরহির করে টানতে টানতে ঘোড়ার কাছে এগিয়ে আসে। মাটির সাথে ঘর্ষণের ফলে ডাল-পালা, কাঁটা সবকিছু পিঠে বিধছে ফলার মতোন। কষ্টে আকুতি-মিনতি করেও লাভ হচ্ছে না। অবশেষে উপায় না পেয়ে সুলতানকে আবেগপ্রবণ করে তুলতে চায় মামা। ভেজা গলায় আবেগি স্বরে বলল,

“পাষাণ হয়ে গেছো তুমি। কতবার তোমাকে এই কোলে তুলে আদর করেছি। একমাত্র ভাগ্নে হিসেবে কম তো সোহাগ করিনি তোমাকে। আজ আমার একটামাত্র ভুলের কারনে সবকিছুই মূল্যহীন হয়ে গেছে তোমার নিকট?”

তার এতো আবেগি বাক্য কানেই তুলছে না সুলতান। উপেক্ষা করে সহাস্যে উঠে বসে ঘোড়ার পিঠে। চতুর মামা পুনরায় চেষ্টা চালায়,

“এ কথা যদি তোমার আম্মা জানতে পারে তখন সে কতটা কষ্ট পাবে ভেবেছো? আমার প্রতি তোমার এই নিষ্ঠুরতা ভেঙে দেবে তোমার আম্মাকে।”

আম্মার প্রসঙ্গ উঠতে থামলো সুলতান। ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচে তাকালো শান্ত দৃষ্টিতে। বরাবরই রাগান্বিত অবস্থাতেও তার এই শান্ত ভঙ্গিমা আতঙ্ক ধরায় প্রতিপক্ষের কলিজায়। গমগমে স্বরে জাহির করে,

“জানি আমি। আম্মা কষ্ট পাবে। ভীষণ কষ্ট পাবে নিজের ভাইকে পঙ্গু হতে দেখে। মানসিকভাবে ভেঙে পরবে সে। কিন্তু আমার বেগমের অসহায়ত্বের সময় তার এই মমতা জাগেনি। এলির এতবড় ক্ষতি করার পরেও নিজের ভাই বলে অবলীলায় ছেড়ে দিয়েছে তোকে। আমি খুব অবাক হই আম্মার এই একপক্ষীয় মমতা দেখে। সে আমার আম্মা। তাই তাকে আমি সরাসরি শাস্তি দিতে পারি না। নিজের ভাইয়ের এই চির পঙ্গুত্বই হবে তার শাস্তি। তার মানসিক অশান্তির কারন।”

হতভম্ব হলো মামা। তার আবেগি বাক্য যে উল্টো তার উপরেই ভারি হয়ে পরবে সেকথা ভাবতেও পারেনি।
আচমকা ঘোড়া তাড়িয়ে ছুটতে আরম্ভ করে সুলতান। হাতে তখনও পাগড়ির এক প্রান্ত চেপে ধরে আছে শক্ত করে। তীব্র বেগে শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে মামার। চলন্ত ঘোড়ার গতির সাথে সাথে মাটিতে উল্টে-পাল্টে পড়ছে সে। আঁচড় লাগছে ডালপালার। মাটির সাথে তুখোড় সংঘর্ষে পোশাক ছিড়ে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, শরীর চিরে রক্তাক্ত হচ্ছে। চোখেমুখে ভয়ানক কষ্ট ছড়িয়ে পড়লো। চতুর্দিক হাহাকার করে উঠলো তার কঠিন দুর্দশার খবর পেয়ে। জখম পা’টাতে সুলতান এতোটাই বাজেভাবে প্রহার করেছে যে তা এখন কোনোমতে শরীরের সাথে ঝুলে রয়েছে। যেকোনো সময় এই তুমুল টানাহ্যাঁচড়ার মাঝে ছিঁড়ে পড়বে শরীর থেকে। চিরতরে পঙ্গু হবে মামা। পঙ্গু হবার আশঙ্কায় ভয়ানক চিৎকারে কেঁদে উঠলো মামা,

“থামো, থামো শাহজাইন। খুলে দাও বাঁধন।”

“এতবড় শাস্তি দিও না আমাকে। ছেড়ে দাও। দয়া করো মামার উপর।”

“প্রয়োজনে কারাগারে নিক্ষেপ করো তবুও আমাকে এমন ভয়ঙ্কর শাস্তি দিও না।”

“আর সহ্য হয় না এই যন্ত্রণা। তুমি যা চাও সব করবো আমি। ঘোড়া থামাও।”

পিঠের ভেতর খেজুর কাঁটা ঢুকতে ব্যথাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। তারা জঙ্গলের এমন এক স্থান অতিক্রম করছে যেখানে অহরহ খেজুর গাছের সারি। কাঁটায় ভরপুর সেই ভূমি। মামার গগণবিদারি চিৎকারে কর্ণপাত করে না সুলতান। বরং ঘোড়া তাড়িয়ে সেই স্থান অতিক্রম করলো। আকুতি করে মামা,

“ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও দয়া করে। রহম করো।”

“থামো।”

কিছু সময়ের ব্যবধানে শরীরের রক্তে মাটি ভিজতে শুরু করলো। রক্তপাত বেড়ে গেলেও মায়া হলো না সুলতানের। সে যেন নিষ্ঠুরতার চরমে পৌঁছেছে। মামার বারংবার করা মিনতি নিমেষেই পায়ে ঠেলে এগিয়ে যায় নিজ মহলের দিকে।

হুট করে সুলতানের মহল ছেড়ে বেরোনোর সংবাদে ভয় ধরেছে ওয়াসিফা সুলতানের হৃদয়ে। পুত্র যে তার ভয়ঙ্কর রেগে আছে তা বুঝতে আর বাকি নেই। এলিজার অবস্থা দেখে মাথা বিগড়ে যাবারই কথা। কিন্তু এসময় কোথায় গেছে? পুত্রের হিংস্রতা, ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবগত সে। তবে কি সবকিছু জেনে গেছে শাহজাইন? আতঙ্কিত গলায় সুলতান শাহজিলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

“তুমি তো নজর রাখতে পারতে। এইতো এলো। এখনি আবার কোথায় চলে গেল?”

“আমি কেন খোঁজ রাখতে যাবো? ভুল তুমি আর তোমার ভাই করেছো। আমাকে মাঝে টানবে না খবরদার।”

ঝাঁঝালো উত্তর সুলতান শাহজিলের। দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে ওয়াসিফা সুলতান। এই স্বার্থপর লোকটা কখনোই তার সঙ্গ দেইনি। অতীতেও সবসময় তাকে মাঝপথে দিশেহারা অবস্থায় ফেলে গেছে। অথচ সে তার জন্য গোটা এই সাম্রাজ্যের ভার নিজের কাঁধে নিয়েছে। এমনকি শুধুমাত্র এই লোকটার কথাতে ভয়ঙ্কর এক খুনীকে হত্যা করার বদলে কাল কুঠুরিতে লুকিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে সকলের অগোচরে। ঘৃণিত খুনির প্রতি এতো দরদ! অথচ তাকে সবসময় উপেক্ষা করে আসছে। রাগান্বিত স্বরে জাহির করে,

“এবার আমার সঙ্গ না দিলে কিছুতেই আপনাকে ছাড়বো না আমি। পুত্রের সম্মুখে লাঞ্ছিত হবার চেয়ে মৃত্যু ভালো।”

“যা ইচ্ছা করো। কে বলেছিলো এলিজার সাথে অমন দুর্ব্যবহার করতে? মেয়েটা এই সাম্রাজ্যে এসেছে পর্যন্ত ক্ষতি তো করেনি কারোর। বিনিময়ে তার অসহায়, দূর্বল সময়ে তুমি তাকে কটূক্তি করেছো।”

সামান্য রাগ নিয়েই বলল সুলতান শাহজিল। নিজের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে ওয়াসিফা সুলতান,

“কিন্তু ও তো বলেছিলো শাহজাইন মৃত। মিথ্যা কেন বলেছিলো? শুধু আমি কেন, এই মহলের প্রতিটা মানুষ ভেবেছিলো শাহজাইনকে এলিজাই হত্যা করেছে। একজন মা হিসেবে পুত্রের খুনিকে এমনি এমনিই ছেড়ে দেওয়া যায়? তুমি বলো? এখানে আমার দোষটা কোথায়? আমি কি জানতাম শাহজাইন বেঁচে আছে? ফিরে আসবে!”

“তাহলে তোমার ভাইও তো এলিজার সন্তানকে হত্যা করেছে। তাকে কেন খোঁজার চেষ্টা করলে না তুমি? একবার উচ্চারণ করলে না ভাইকে শাস্তি দেবার কথা।”

“ওটা, ওটা আসলে….
তখন আমার মাথা ঠিক ছিলো না। এলিজার প্রতি মন বিষিয়ে ছিলো তাই আমলে নেইনি ওর যন্ত্রণা।”

“তুমি যাই বলো ওয়াসিফা। বরাবরই এলিজার উপর অন্যায় করেছো তুমি। তাই তোমার এই ঘটনার মধ্যে আমি নেই। শাহজাইন যদি জেনে গিয়েই থাকে তবে সে যা বলবে আমি মেনে নেব।”

হতভম্ব হয়ে স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে ওয়াসিফা সুলতান। অবশেষে সমস্ত পথ হারিয়ে শান্ত অথচ রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে,
“তবে এটাই তোমার অন্তিম সিদ্ধান্ত?”

“হ্যাঁ।”

অগ্রাহ্য করে দ্বারের দিকে এগোচ্ছে সুলতান শাহজিল। সেসময় ওয়াসিফা সুলতান পুনরায় গম্ভীর স্বরে বলল,
“তাহলে কাল কুঠুরির কয়েদির মৃত্যু দেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। যাকে তুমি এত বছর সকলের আড়ালে বাঁচিয়ে রেখেছো।”

“ওয়াসিফা!” রাগে গর্জে ওঠে সুলতান শাহজিল।

“অমন একটা ঘৃণিত খুনিকে তুমি বাঁচিয়ে রাখতে পারো কিন্তু নিজের বেগমকে বিপদে ঠেলে দাও!”

“খবরদার! ওকে খুনি বলবে না। সে খুনি নয়। সাম্রাজ্যের জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিতেও সে কখনো পিছপা হয়নি।”

“তাহলে এখন কী করছে? তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে সে একজন রোগী? ভয়ঙ্কর রোগী! যার কিনা মানুষের রক্ত খাওয়ার নেশা জাগে। যখন তার হুঁশ হারিয়ে সে রোগের বশবর্তী হয় তখন পিশাচ হয়ে ওঠে সে, পিশাচ! আপন-পর কাউকে চিনতে পারে না। ঠিক-ভুলের বিচার করতে পারে না। মহলের সবাই জানে ঘটে যাওয়া সমস্ত হত্যাকাণ্ড সেই গুপ্ত শত্রু ঘটাচ্ছে। অথচ তুমিও ভালো করে জানো গুপ্ত শত্রু শুধু ফয়েজ আর হাফসার খুন করেছে। তোহফার ওষুধে বিষ মিশিয়েছে, শাহজাইনকে হত্যার চেষ্টা করেছে। এছাড়াও বাগানে, মহলের পেছনে যেই ভয়াবহ খুনগুলো হয়েছে সেগুলো কাল কুঠুরির কয়েদিই করেছে। রক্তের নেশায় কারাগার থেকে পালিয়ে হত্যা করেছে সৈনিকদের। তাদের রক্ত পান করে নিজের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। তুমি বুঝতে কেন পারো না সে আর স্বাভাবিক নেই? এখন তার বেঁচে থাকা সকলের জন্য হুমকি।”

“চুপ করো ওয়াসিফা, চুপ করো। সে আর যাই হোক বিশ্বাসঘাতক নয়। কতকিছু করেছে এই সাম্রাজ্যের জন্য? তারও বেচে থাকার অধিকার আছে। দুর্ভাগ্যবশত এমন ভয়নক রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। আমি মানছি বাগানের আর মহলের পেছনের হত্যাগুলো সেই করেছে। তবে ইচ্ছাকৃত নয়। রোগের বশবর্তী হয়ে। সেসময় তার হুঁশ থাকে না।”

হঠাৎ মহলের বাইরের তীব্র চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভরে উঠলো কামরা। অবাক হয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসে তারা। মহলের সকলেই একে একে মহল ছেড়ে প্রধান ফটকের সম্মুখে জরো হতে থাকে। সুলতান এসেছে ঘোড়ায় চেপে। তবে এটা তাদের বিস্ময়ের কারন নয়। তীব্র চিৎকার-চেঁচামেচির আসল কারন হলো মামা হাদিদ। ফটকের সম্মুখে বিশাল প্রাঙ্গণ। যতদূর চোখ যায় শুধু বালু আর বালু। সেই প্রাঙ্গনেই ঘোড়া তাড়িয়ে বৃত্তাকারে ঘুরছে সুলতান। তার হাতের পাগড়ির অপর প্রান্তে ঝুলে আছে মামার ক্ষতবিক্ষত দেহ। পুরো শরীরে শুধু আঁচড়ের চিহ্ন। জানা নেই কতদূর থেকে তাকে এভাবে টানতে টানতে এনেছে সুলতান। বালুর মাঝে ঘর্ষণে ঘর্ষণে রক্তাক্ত দেহখানা বালু দিয়ে ভরে উঠেছে। একাধারে কেদেকেটে মুক্তি চেয়ে যাচ্ছে মামা। সুলতানের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রাঙ্গণের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে ঘোড়াটা। বারবার একই স্থানে ঘুরতে ঘুরতে আকস্মাৎ মামার জখম পা’খানা ছিড়ে পরে শরীর থেকে। আচমকা এমন ভয়াবহ কান্ডে চোখ বন্ধ করে নেয় উপস্থিত সকলে। আতঙ্কিত গলায় চিৎকার করে ওঠে ওয়াসিফা সুলতান,

“থামো, ঘোড়া থামাও।”

চোখ বড়বড় করে হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে সকলে। অথচ কেউ সুলতানের উপরে একটা শব্দও উচ্চারণ করার সাহস পাচ্ছে না। কিই বা বলবে? এটাই মামার প্রাপ্য! ফটক ঠেলে দৌড়ে যায় ওয়াসিফা সুলতান। চিৎকার করে ডাকে,

“দাঁড়াও শাহজাইন। কসম আমার! ঘোড়া থামাও। ম’রে যাবে তোমার মামা।”

আম্মার কসম! বড় নিষ্ঠুর আবেগ! থেমে যায় সুলতান। হাতের মুঠো থেকে মুক্ত করে দেয় পাগড়ি। মামাকে বালুর মাঝে ফেলে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে। মামার দিকে চেয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
“চির পঙ্গু হয়ে থাকবি বাকিটা জীবন। আর পা হারিয়ে তড়পাবি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।”

ওয়াসিফা সুলতান সেদিকে দৌড়ে যেতে নিলে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সুলতান। ভ্রু কুঁচকে বলল,

“ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন আম্মা?”

“পাগল হয়ে গেছো তুমি? সে তোমার মামা।” চিৎকার করে ওঠে ওয়াসিফা সুলতান।

“সে আমার সন্তানের হত্যাকারী। যে আমার বেগমের শরীরে প্রহার করেছে তাকে আমার মামা সম্বোধন করে অযথায় অপমানিত করবেন না আমাকে।”

“সবকিছুর একটা সীমা আছে শাহজাইন। সরে দাঁড়াও।”

“ভালোবাসার কোনো সীমা নেই আম্মা। ঘৃণারও সীমা থাকা উচিত নয়।”

কিছুক্ষণ থেমে শান্ত গলায় আবারো আওড়ালো,
“আমার বেগমের সাথে যারা দুর্ব্যবহার করে তাদের প্রতি আমি আজও সীমাহীন ঘৃণা ব্যতীত কোনো শব্দ খুঁজে পাইনি।”

বিস্মিত ওয়াসিফা সুলতান আরোও কিছু বলার পূর্বেই সুলতান শান্ত ভঙ্গিমা ধরে রেখেই ভ্রু কুচকে পুনরায় আওড়ায়,
“এলি এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হওয়া সত্ত্বেও তার চিকিৎসা চলে কিনা ছোট্ট ঐ কামরাতে! আশ্চর্য চিকিৎসা ব্যবস্থা এই মহলের! তাই না আম্মা?”

এবার ভয়ে ঢোঁক গিলল ওয়াসিফা সুলতান। শাহজাইন কি সব জেনে গেছে? নাকি সন্দেহ করছে তাকে? উত্তরের অপেক্ষা করে না সুলতান। এলির হয়তো ঘুম ভেঙে গেছে এতক্ষণে। তাছাড়া আম্মার প্রতি তার হৃদয়ে যেই বিতৃষ্ণা জেগেছে তার জের ধরে হয়তো এখানে থাকলে খারাপ ব্যবহার করে ফেলতে পারে সে। যা সে কখনোই চায় না। তাই দ্রুত ফটক পেরিয়ে নিজ কামরার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো। পেছন থেকে বিচক্ষণ ওয়াসিফা সুলতান ঠিকই ধরতে পারলো শাহজাইন সব জানলেও তার করা ব্যবহারের কথা জানে না। শুধুমাত্র হাদিদকে শাস্তি না দেওয়ায় আর এলিজাকে ঐ কামরায় চিকিৎসারত দেখে সন্দেহ থেকেই এগুলো বলেছে।

“একদম ঠিক হয়েছে এই শয়তানটার সাথে।”

কটমট করে বলা জারনাবের এই বাক্য ভরকে যায় মাহতাব। হতবাক হয়ে শুধায়,
“কী ঠিক হয়েছে?”

“উচিত কাজ করে সুলতান।”

আবারো বলল জারনাব। মাহতাবও তাল মিলিয়ে পুনরায় শুধাল,
“কী উচিত করেছে?”

“ঐযে, ঐ লোকটা আস্ত শয়তান। আমার বোনকে কিনা আঘাত করে। জাহিল লোক!”

আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মামাকে। চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠলো,
“ঠিক হয়েছে। ম’রে যাক শয়তানটা।”

“ইশ জুঁই! নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছ তুমি!”

দুষ্টুমির স্বর মাহতাবের। জারনাবের নজর এতোক্ষন ফটকের বাইরে থাকলেও এখন চোখ ছোটছোট করে ঘুরে তাকালো মাহতাবের দিকে। বিরক্তির চাহনি ফেলে শুধাল,
“তুমি উপহাস করছো আমাকে?”

“নাহ।”

বিজলীর বেগে ডানে-বামে মাথা নাড়ালো মাহতাব। জারনাব আবারো বলল,

“করছো না?”

“একদমই না।”

গুরুতর ভঙ্গিতে কথাখানা বললেও অধরকোনে মিষ্টি হাসি মাহতাবের। ধরতে পেরে রেগেমেগে মহলের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলো জারনাব। পেছনে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও দায়িত্বের খাতিরে ইচ্ছাটাকে মাটি চাঁপা দিয়ে সৈনিকদের সাথে ফটকের বাইরে বেরিয়ে যায় মাহতাব। জারনাব যখন রেগে আগুন হয়ে জোর পায়ে মহলের দিকে যাচ্ছিলো তখনই হুট করে পা পিছলে পড়ে যেতে নিলো। পুরোপুরি না পড়ে গেলেও হাত পাথরে লেগে ছুলে যায় খানিকটা। নিচে বসে ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করলো সহসাই

“আহ!”

ততক্ষণাৎ পেছনে ফিরে তাকালো মাহতাব। সৈনিকদের ফেলে ফটক ঠেলে ছুটে আসে জারনাবের দিকে। চেহারায় চিন্তার অনাবিল রেখা। হন্তদন্ত হয়ে হাতটা ধরে আতঙ্কিত গলায় শুধাল,
“কীভাবে পড়লে? কোথায় লেগেছে দেখি?”

বিস্মিত জারনাব জবান ভুলেছে যেন। হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে থাকে চিন্তিত পুরুষটার দিকে। এ কেমন মায়া আজমাইনের! কেন অনুভূতি সৃষ্টি করছে তার ভাঙা হৃদয়ে? বিচলিত মাহতাব পুনরায় শুধায়,
“বলছো না কেন?”

জারনাবকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে মৃদুস্বরে ধমকে উঠলো আচমকাই,

“বলো।”

কেঁপে ওঠে জারনাব। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিজের অপর হাতটা বাড়িয়ে ধরে মাহতাবের দিকে। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আওড়ালো,

“এখানে।”

হাতটা চোখের সামনে ধরে মুখ শুকিয়ে আসে মাহতাবের। বেশ খানিকটা ছুলে গেছে। রক্তও বেরোচ্ছে। মুখের সামনে এনে আস্তে আস্তে কয়েকবার ফু দিয়ে বলল,

“জ্বলছে?”

“উঁহু।” একধ্যানে চেয়েই উত্তর দেয় জারনাব।

ক্ষতস্থানের চারপাশে আলতো করে আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলো মাহতাব। তখনই আবার পেছনে ফিরে সেবিকাদের উদ্দেশ্যে তাড়া দিয়ে বলে,

“দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করো মহলে গিয়ে।”

“লাগবে না আজমাইন।” বিরোধিতা করলো জারনাব।

বিরক্ত হলো মাহতাব। রাগান্বিত স্বরে বলল,
“তুমি কি আমার চেয়ে বেশি জানো লাগবে কিনা? ওষুধ লাগাতে হবে এখানে। ভেতরে চলো।”

“পরে লাগিয়ে নেব।”

“এখন লাগাবে তুমি। বুঝতে পেরেছো আমার কথা?”

“না, লাগাবো না।” জেদ ধরে বসে জারনাব।

“জুঁই।”

“তখন তো খুব মজা নিচ্ছিলে? উপহাস করছিলে আমাকে। আর এখন এসেছো দরদ দেখাতে? তোমার কথা শুনবো কেন আমি?”

“শুনতে হবে তোমাকে।”

“কেন শুনব?” অভিমানী স্বর জারনাবের।

“আমি বলছি তাই।” একরোখা জবাব মাহতাবের।

কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বলল,

“ভেতরে চলো।”

“যাবো না। তোমার কথাতে চলবো নাকি সবসময়? যাবোই না আমি। বকলেও যাবো না এখন।”

জেদ ধরে বসে রইল জারনাব। কেন যাবে সে? সবসময় ওর কথায় কেন চলবে? উপহাস করবে আবার রেগে রেগে কথা বলবে! আবার যখন ইচ্ছা দরদ দেখাবে! চাই না এমন দরদ!

“চলো।” কঠোর স্বর মাহতাবের।

জারনাবের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে চোখদুটো ছোট হয়ে এলো। ভ্রু উচিয়ে জারনাবকে পর্যবেক্ষণ করতেই ধরতে পারে অভিমান করেছে এই নারী!

“ঠিক আছে, যেতে হবে না।”

বলতে বলতে আচমকা বসে পড়লো জারনাবের পাশেই। চমকে উঠে সামান্য পিছিয়ে যায় জারনাব।
বিস্মিত হয়ে বলল,
“কী করছো আজমাইন? সবাই দেখছে।”

“দেখলে কী?”

“কী ভাববে সবাই?”

“কী ভাববে? আমিতো শুধু বসেছি তোমার পাশে।”

মুহুর্তেই ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যান্য সেবিকাদের উদ্দেশ্য করে বলে,
“যাও, মহল থেকে ওষুধ নিয়ে এসো। আমরা আজ অনশনে বসেছি। এখানে বসেই সব করবো। যাও যাও, দ্রুত নিয়ে এসো।”

হতভম্ব জারনাব কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না যেন। ফিসফিসিয়ে বলল,
“করছো টা কী? জ্বীনে আছর করেছে?”

“হ্যাঁ, ভয়ানক জ্বীন। নারী জ্বীন তো। সুন্দর পুরুষ দেখে চেপে বসেছে।”

অতঃপর আবারো সেবিকাদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমার জন্য খাবারও নিয়ে আসো। এখানেই খাবো আজ। বসেছি যে আর উঠাউঠি নেই আজ।”

হাঁক ছেড়ে সৈনিকদের বলল,
“ফটকের সামনে থেকে ঐ জাহিলের অসাড় দেহটা দূরে কোথাও ছুড়ে ফেলো। এসব দেখতে ভালো লাগছে না এখন।”

কটমট করে তাকিয়ে থাকে ওয়াসিফা সুলতান। বড্ড সাহস বেড়েছে এটার। শাহজাইন প্রশ্রয় দিতে দিতে একদম মাথায় উঠিয়ে ফেলেছে। তার ভাইয়ের ক্ষতবিক্ষত দেহ সামনে রেখে তামাশা করছে এই সৈনিক প্রধান! এতোবড় সাহস! এসময় শাহজাইনের ভয়ে সে কিছু করতে পারছে না তাই বলে কী যা ইচ্ছা করবে এই ছেলে? সৈনিক, সেবক-সেবিকা সকলেই হতবাক হয়ে চেয়ে আছে তাদের দিকে। সামনে ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে এমন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ একমাত্র সৈনিক প্রধানের দ্বারাই সম্ভব!

কামরায় পৌঁছে বেগমকে হেলেদুলে পালঙ্ক ছেড়ে উঠতে দেখে দৌড়ে যায় সুলতান। নিভু নিভু দৃষ্টিতে সুলতানকে দেখতেই উঠে দাঁড়ানোর সমস্ত প্রচেষ্টা থেমে যায় বেগমর। শরীরের ভর ছেড়ে দেয় আচমকাই। মেঝেতে আছড়ে পরার পূর্বেই ছুটে এসে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে নিলো সুলতান। বুকের সাথে হাত চেপে আধো আধো স্বরে আওড়ালো,

“সুলতান।”

“কী করছো এলি? এমন কেউ করে?” বিচলিত হয়ে শুধাল সুলতান।

“আমি করি।”

“যদি পড়ে যেতে? আমি যদি ধরতে না পারতাম?”

“আমি জানতাম আপনি ধরবেন।”

“মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তোমার। এমন আর কখনো করবে না। কেমন? আমি তো কোনো কারনবশত নাও ধরতে পারতাম।”

“ধরবেন আপনি।”

সুলতানের আরো কাছে সরে আসে বেগম। মুখ গুঁজে দেয় বলিষ্ঠ শরীরে। ত্রিভুবন যেন উচ্ছাসে খলবলিয়ে ওঠে এমন মধুর দৃশ্যে!

“ঠিক আছে, ধরবো। কথা দিলাম।”

“ধরবেন?”

“হুম ধরবো। এই শরীরে নিশ্বাস যতদিন আছে ততদিন ধরবো।”

চলবে………..

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_53

“আমায় ক্ষমা করো।”

নিজ কামরায় তানহার আকস্মাৎ আগমনে তীক্ষ্ম হয় বেগমের দৃষ্টি। সুলতান মহলে এসেছে বেশ কদিন হয়েছে। শুনেছে মামাকে শাস্তিও দিয়েছে সে। কিন্তু কী শাস্তি তা জানার সুযোগ হয়নি। বলেনি সুলতান। সে আসার পর তানহা বা ওয়াসিফা সুলতান কেউ আসেনি বেগমের সামনে। আজ হঠাৎ তানহাকে দেখে কিঞ্চিত বিরক্ত গলায় বলল,

“তুমি! এখানে কেন এসেছো?”

“ভুল করে ফেলেছি আমি। মারাত্মক ভুল।”

তার দিকে একপ্রকার ছুটে আসে তানহা। মেঝেতে বসে বেগমের পা চেপে ধরে অনুনয়ের স্বরে বলল,

“তুমিতো জানো আমার ভাই ছাড়া আমাকে ভালোবাসার কেউ নেই। একমাত্র ভাই ছাড়া পিতা-মাতা কারোর আদর-সোহাগ পাইনি আমি। সেই ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদে মাথা ঠিক ছিলো না আমার। উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম আমি।”

তানহার চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরা অশ্রুর ফোটা বেগমের পা ছুঁতেই অস্বস্তিতে পড়লো সে। এই কদিনে পূর্বের তুলনায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। দ্রুত বল প্রয়োগ করে পা ছাড়িয়ে নিলো। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

“এখন আমার নিকট কী চাও তুমি? বিনা অনুমতিতে কামরায় প্রবেশ করার অধিকার দিয়েছি বলেই তার অপব্যবহার করো না যখন তখন।”

“মাফ করে দাও আমাকে।”

“তুমিতো আমার মৃত্যু কামনা করেছিলে। তবে কেন আজ এসে মাফ চাইছো? সুলতানের ভয়ে?”

হুট করে এভাবে তানহার পরিবর্তনে অবাক হয়েছে বটে বেগম। মেঝেতে বসা তানহার দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে রইল। তানহা কিছু বলার পূর্বে আবারো বলল,

“ভয় পেয়ো না। সুলতানকে আমি জানাবো না তোমাদের দুর্ব্যবহারের নমুনা। কেননা নিজের আম্মা আর বোনের এমন দুর্বিষহ রূপ আমার সুলতানের হৃদয় ভাঙবে। আর তা আমি কখনোই চাই না।”

ঠোঁট চেপে কান্না দমন করার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে তানহা। ভাই! ভাইকে কেন ভয় পাবে? মৃত্যুর ভয় সে করে না। বরং লজ্জিত সে। ভাইয়ের অবর্তমানে তার স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করায় নিজের মন ধিক্কার জানাচ্ছে তাকে। লজ্জায় আর সংকোচবোধ থেকে এখনো পর্যন্ত ভাইয়ের সামনে যায়নি সে। কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে তার সামনে? তার তো জানা ছিলো না ভাই বেঁচে আছে। সেও আর সকলের মতোই ভেবেছিলো বেগমই সুলতানকে হত্যা করেছে। সেসময় তার অমন প্রতিক্রিয়া কি স্বাভাবিক ছিলো না? আড়চোখে একবার দেখলো বেগম। মেয়েটাকে এভাবে কান্না করতে দেখে মোটেও ভালো লাগলো না। সে তো জানে মেয়েটার মন তার আম্মার মতো কলুষিত নয়। বরং সময় আর পরিস্থিতির অবনতিতে পথভ্রষ্ট হয়েছিলো সে। অল্প বয়সে মহলের এসব তিক্ততা দেখে দেখে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে মেয়েটা। ঝুঁকে এসে তানহার বাহু চেপে বলল,

“ওঠো।”

“ক্ষমা করে দাও আমাকে। আমার করা ঘৃণ্য ব্যবহার আমাকেই কুরে কুরে খাচ্ছে।”

লজ্জিত চেহারাতে যে দৃশ্যমান কষ্ট আর অনুতাপ দেখা যাচ্ছে তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। পুনরায় হাতজোড় করে ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল,
“আমি আজ চলে যাবো। কিন্তু তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবো না। সত্যিই ভীষণ লজ্জিত আমি।”

“কোথায় যাবে?” হতবাক হয়ে শুধাল বেগম।

“অস্ত্রবিদ্যার প্রশিক্ষণ এখনো বাকি রয়েছে আমার। তা সম্পূর্ণ করতে কিছু মাসের জন্য সাম্রাজ্য ত্যাগ করতে হবে আমাকে।”

থেমে থেমে কথাগুলো বলেই আবারো কান্না আরম্ভ করলো তানহা। উদ্বিগ্ন হয়ে বেগম দ্রুত হাতে তার দুই চোখ মুছে দিলো। নির্লিপ্ত কন্ঠে আওড়ায়,

“হয়েছে, কান্না থামাও। যাওয়ার আগে এভাবে কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলে গেলে সাম্রাজ্যবাসীর নিকট বিদায় নেবে কীভাবে?”

“আগে বলো আমাকে মাফ করেছো তুমি।”

কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তানহার ক্রন্দনরত মুখের দিকে চেয়ে রইল বেগম। অতঃপর তানহার ইদের আমেজ ফিরিয়ে দিতেই বুঝি আওড়ালো,

“তোমার উপর রাগ নেই আমার। সুলতানের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে মিথ্যাচার করেছিলাম আমি। তবে তা বাধ্য হয়ে। সুলতানকে জীবিত রাখতে এটা প্রয়োজন ছিলো। তোমার অমন ব্যবহার সেসময় পরিস্থিতি অনুসারে হয়তো কাম্য ছিলো। তাই অনেক আগেই তোমাকে মাফ করে দিয়েছি আমি।”

হঠাৎই তাকে খুব জোরে জড়িয়ে ধরলো তানহা। ভেজা অথচ খুশির কন্ঠে বলল,
“তুমি খুব ভালো। রামান সাম্রাজ্যের যোগ্য সম্রাজ্ঞী।”

মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো বেগম। চিন্তিত গলায় বলল,
“সাবধানে যেও। শত্রুর পরবর্তী পদক্ষেপ কারোর জানা নেই। দোয়া করি, সঠিক বিদ্যার দীক্ষা নিয়ে একজন সাহসী যোদ্ধা রূপে ফিরে এসো।”

“ইনশাআল্লাহ্!”

কথোপকথন শেষে চলে যেতে ধরলো তানহা। পেছন থেকে পুনরায় ডাকে বেগম,

“আর হ্যাঁ, যাওয়ার আগে তোমার ভাইয়ের সাথে দেখা করে যেও।”

“অবশ্যই।”

তানহা প্রস্থান করার পরপরই আরোও একটা নারীমূর্তি এসে থামলো দ্বারে। উচ্চস্বরে আওয়াজ দিলো,
“জোভিয়া।”

“বুবু, ভেতরে এসো।”

তোহফাকে কোলে নিয়ে ভেতরে আসে জারনাব। সরল গলায় বলল,
“তানহা এসেছিলো দেখলাম। তোমাকে কিছু বলেছে নাকি আবার?”

“না।”

“বললে সোজা এবার সুলতানকে বলে দেবে। আমার বোনটাকে একা পেয়ে সবাই খুব পেয়ে বসেছিলো।”

আচমকা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো জারনাব। বুবুর এসব আজব ব্যবহার, সরল মানুষটার আচমকা উত্তপ্ত দৃষ্টি আর হুট করে হওয়া অসীম রাগ দেখে আর অবাক হয় না বেগম। মহলে আসার পর থেকেই বুবুর এই পরিবর্তন নজরে আসছে। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। তাই ধীর স্বরেই বলল,
“তানহা অনুতপ্ত। তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি আমি।”

“ক্ষমা! কিন্তু কেন? ওদের কোনো ক্ষমা নেই। তোমার দুর্দিনে কী রূপটাই না দেখিয়েছে মা-মেয়ে।”

ক্ষোভে ফেটে পড়ছে জারনাব। বোনকে অতিরিক্ত ভালোবাসার কারনেই হয়তো তার এই ক্রোধ। প্রসঙ্গ বদলাতে চাইল বেগম। তোহফাকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলল,
“থাক না বুবু। বাদ দাও ওসব কথা। সুলতানের আম্মা বরাবরই প্রচন্ড স্বার্থপর। সে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারের জন্য যা ইচ্ছে করতে পারে। কিন্তু তানহা অমন নয়। সে যথেষ্ট নম্র আর ভদ্র।”

“দেখো। তোমার যা ভালো মনে হয়।”

মুখে একথা বললেও আক্রোশ মেটেনি জারনাবের চেহারা থেকে। তখনই তোহফা চোখ ছোট ছোট করে ভারি চতুর স্বরে শুধায়,
“তোমার খুব রাগ হয়েছে খালামণি?”

“কই? নাতো।” দ্রুত উত্তর জারনাবের।

“আসো আদর দিয়ে দেই। দেখবে তোমার রাগ একদম নাই হয়ে গেছে।”

মেয়ের বিজ্ঞ ব্যক্তির ন্যায় কথাবার্তা শুনে ফিক করে হেসে দেয় বেগম। তাকে এগিয়ে ধরে বুবুর দিকে। বলল,
“দাও দাও। রাগ নাই করে দাও তো আম্মু।”

খালামণির গালে চুম্বন করে মায়ের কোলে ফিরে আসে তোহফা। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে চেয়ে থেকে আচমকা নিচে নামার জন্য ঠেলতে শুরু করে। হন্তদন্ত হয়ে আওড়ায়,
“ছাড়ো। খালামণির সাথে চলে যাবো আমি।”

“কেন আম্মু? আমার কাছে থাকবে না তুমি?” ভ্রু কুচকাল বেগম।

“থাকবো। পরে লুকিয়ে তোমার কাছে আসবো। ঠিক আছে?” ফিসফিসিয়ে বলল তোহফা।

বেগম তার চেয়ে দ্বিগুণ ফিসফিসিয়ে বলল,
“লুকিয়ে কেন? কীসের ভয় আমার শেহজাদির?”

“আব্বু চলে আসবে।”

“আব্বু আসলে কী হয়েছে আম্মু? আব্বু তো তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”

“আব্বুর সাথে দেখাও করবো না, কথাও বলবো না। বকে দিয়েছে আমাকে।”

তোহফার মুখ ফোলানো দেখে হাসি পেলেও নিজেকে সংযত করে বেগম। গুরুতর ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

“কিহ! সুলতানের এতোবড় সাহস! আমার শেহজাদিকে বকে দিয়েছে। তাহলেতো শাস্তি দেওয়া উচিত আব্বুকে।”

সুলতান নিজেকে নতুন করে আবারো তৈরি করছে সুলতানের বেশে। এই কদিন এসেছে যাবত আর সময় পাইনি সে। তাকে সঙ্গ দিচ্ছে মাহতাব। বারবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও বলতে পারছে না। বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। তাকে ইতস্তত করতে দেখে সুলতান নিজেই শুধাল,

“কিছু বলবে মাহতাব?”

“উমমম, না। আপনি তৈরি হয়ে নিন। আমি আপনার আর সুলতানার শরবতের ব্যবস্থা করছি।”

দ্রুত কামরা ত্যাগ করে মাহতাব। বলতে পারলো না আরোও একটা দুঃসংবাদ। সহ্য করতে পারবে না সুলতান আর সম্রাজ্ঞী। বেগম আর কখনো মা হতে পারবে না। সে হারিয়েছে তার গর্ভধারণের ক্ষমতা। একথা জেনেই আরোও চটেছে ওয়াসিফা সুলতান। তবে এখন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না সুলতানের ভয়ে। হয়তো এবার সে নীরবে জোর পরিকল্পনা করছে। সেই পরিকল্পনা আবার সুলতানের দ্বিতীয় বিবাহ নয়তো? অন্যদিকে মহলে কানাঘুষো শুরু হয়েছে সৈনিক প্রধান আর বেগমের বোনের প্রনয়ের সম্পর্কের। মাহতাব এ কথাতে কিছু মনে না করলেও জারনাব বেশ প্রভাবিত হচ্ছে। সে আজকাল দূরে দূরে থাকছে মাহতাবের থেকে। আজ কদিন যাবত তো তার সামনেই আসে না। সবকিছু সহ্য করে নিলেও এই দহন সইতে পারে না মাহতাব। একই মহলে থেকে এমন লুকোচুরি ক্ষতবিক্ষত করে তার হৃদয়কে। অবুঝ জারনাব অনুভব করতে পারে না সেই কষ্ট।

মাহতাব চলে যাওয়ার কিয়ৎক্ষণ বাদে বেগমের আগমন ঘটে সেই কামরায়। দ্বারে দাঁড়িয়ে মায়াবী স্বরে ডাকলো,

“সুলতান।”

চমকে পেছনে ফিরলো সুলতান,
“এলি! তুমি কেন একা একা হেঁটে আসতে গেলে? তোমাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে এখানে এসেছিলাম যেন তোমার ঘুম না ভাঙে। আর তুমি কিনা হেটে হেটে এখানে চলে এসেছো? ভুলে গেছো তুমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ নও।”

“আস্তে আস্তে সুলতান। এতো উদ্বিগ্ন হবেন না। ঠিক আছি আমি। ঘুমও পুরো হয়েছে।”

“কীভাবে উদ্বিগ্ন হব না এলি? কতবার বলেছি কটাদিন বিশ্রাম করো। কিন্তু তুমিতো আমার কোনো কথাই শুনছো না আজকাল।”

“আর কত বিশ্রাম করবো? অনেক তো হলো।”

“পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে বিশ্রাম করতেই হবে। চলো এক্ষুনি আমার সাথে।”

এগিয়ে এসে বেগমের হাত ধরে বসলো সুলতান। সযত্নে তাকে নিজের সাথে আগলে ধরে হাঁটতে লাগলো নিজেদের কামরার দিকে। এমন সময় বেগম গোমড়া মুখে বলল,

“সবসময় জোরজবরদস্তি করা আপনার স্বভাবে পরিণত হয়েছে।”

“সুন্দরী সম্রাজ্ঞী যেই অপবাদই দিক। সেটাই মেনে নিতে প্রস্তুত সুলতান শাহজাইন শাহ।”

“দিনকে দিন বখে যাচ্ছেন।”

“আর?”

“আর মনে পড়ছে না। মনে পড়লে বলব পরে।”

“মানে তুমি যখন ইচ্ছা আমাকে অপবাদ দেবে?”

“হ্যাঁ।”

“ছিহ! সুলতানের উপর সেচ্ছাচারিতা! এ কেমন অনাচার চলছে এই মহলে?”

“তোহফা রেগে আছে আপনার উপর।”

“জানি আমি। আম্মাজানের সমস্ত রাগ আজই ভাঙিয়ে দেবো এভাবে।” চুটকি বাজিয়ে দেখালো সুলতান।

মৃদুস্বরে হাসে বেগম। রসিকতার স্বরে বলল,
“দেখা যাবে। আমাদের কামরাতেই আছে সে।”

সেখানে গিয়ে দেখা গেল তোহফা নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুলতান। এতো রাগ তার আম্মাজানের! আফসোসের স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“নিজের আম্মুর মতো হয়েছে।”

“কী বললেন?” ভ্রু কুচকে শুধায় বেগম।

আকস্মাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলো সুলতান। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে বড্ড গুরুতর হয়ে বলল,
“আমাকে পার্শ্ব সাম্রাজ্যের ভাঙা মহলে কেন ফেলে এসেছিলে এলি?”

“একটাবারও আমাকে দেখতে যাওনি তুমি।”

বলতে বলতে তার নির্বাক চোখে ব্যথা ফুটে উঠলো। পুনরায় নিষ্প্রাণ স্বরে শুধাল,
“আমাকে দেখার ইচ্ছে হয়নি তোমার?”

বলতে বলতে গলা শুকিয়ে এলো। ঢোক গিলে ভিজিয়ে নিলো। পুনরায় কিছু বলার আগেই বেগম বলে গম্ভীর হয়ে বলে উঠলো,
“আমাকে বিশ্বাস করেন তো আপনি?”

“নিজের চেয়েও বেশি।”

সন্তুষ্টির হাসি হাসে বেগম। গাম্ভীর্যতা ছেড়ে এক ছুটে জাপটে ধরলো সুলতানকে। দু’হাতের মধুর আলিঙ্গনে বেঁধে নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আওড়ালো,

“আমার সুলতান, আমি ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে।”

“এলি।” আবেগি স্বর সুলতানের।

“হুঁ?”

মুখ তুলে তাকাতেই কপালে গভীর চুম্বন করলো সুলতান। বড় মায়ার স্বরে শুধাল,

“আমার উত্তর?”

“আপনাকে এই সাম্রাজ্যে আনলে বাঁচাতে পারতাম কিনা সেই ভয়ে ওখানে রেখে চিকিৎসা করিয়েছি। সকলের নিকট আপনাকে মৃত ঘোষণা করেছি শত্রুর আক্রোশ থেকে আপনার অস্তিত্ব মিটিয়ে দিতে। সেদিন ঐ অযাচিত আক্রমণের পরে আমার মনে হয়েছিল শত্রু আমাদের পরিচিত কেউ। নয়তো ঐ মূহূর্তে আমরা ওখানে একা আছি তা জানার কথা নয়। মহলেই শত্রু লুকিয়ে আছে এই সন্দেহ থেকে আপনার সুরক্ষায় উত্তরীয় সাম্রাজ্যের সেনা নিযুক্ত করেছি। আমি নিজেও বুকে পাথর চেপে দিন কাটিয়ে গেছি। এই ভয়ে যে যদি আমি আপনাকে দেখতে গেলে সে খবর কোনোভাবে শত্রু জেনে যায়। আর আমার অচেতন সুলতান তো তার প্রহার ঠেকাতেও পারবে না। প্রতিটা দিন ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছি এই বুঝি শত্রু জেনে গেলো আপনার অবস্থান, আপনার অস্তিত্ব।”

সব শুনে সস্তির শ্বাস ফেলল সুলতান। হঠাৎ পোড়া পোড়া গন্ধে ভরে উঠলো কামরা। দু’জন তড়িঘড়ি করে চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করতেই পেয়ে গেল আগুনের সন্ধান। আগুনের দহনে দপ দপ করে জ্বলছে বিশাল জানালার রাজকীয় পর্দাখানা। মৃদু বাতাসে আগুন সমেত কামরার দিকে উড়ছে জলন্ত পর্দা। কিছুক্ষণ বাদেই পোড়া পর্দা বাঁধন ছিন্ন করে ধপ করে মেঝেতে আছড়ে পড়লো। ততক্ষণাৎ আগুন নিভে গেলেও নিভলো না সুলতান আর বেগমের বিস্ময়। বিস্মিত নয়নে চেয়ে থাকে তারা। কিয়ৎ ক্ষণ যেন বাক্য হারালো। নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকা ব্যতীত কোনো হেলদোল পর্যবেক্ষণ করা গেলো না তাদের। দিনের বেলায় কোথাও কোনো লন্ঠন, মোম কিছুই নেই। তবুও আগুন? তাও জানালার পর্দায়! যেখানে আগুনের ছিটেফোঁটা থাকার কথা নয়। এই আগুনের উৎস কী? এ যে ইচ্ছাকৃত ঘটানো দুর্ঘটনা তা বোঝার বাকি থাকে না। ইতিমধ্যে রাগে-ক্ষোভে, ভয়ে হাত-পা কাঁপছে বেগমের। হতভম্ব সুলতান দ্রুত বেগমকে একটানে নিজের কাছে টেনে আনলো। বুকের সাথে শক্ত করে আগলে নিয়ে অভয় দিয়ে বলল,

“শান্ত হও এলি।”

“সুলতান, শত্রু এখনো এই মহলেই আছে।”

“অসুস্থ তুমি। এভাবে উত্তেজিত হয়ো না।”

“কিন্তু সুলতান?”

“সব ঠিক হয়ে যাবে এলি। দেখি, এসো তো। পালঙ্কে বসো। বিশ্রাম করো।”

তখনই বেগম সব ভুলে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো,
“এই মহল সুরক্ষিত নয়। যখন তখন শত্রু যা ইচ্ছা করতে পারে। এখানে আমি আমার মেয়েকে রাখবো না কিছুতেই।”

অবাক হলো সুলতান। কিঞ্চিত উচ্চস্বরে বলল,
“কী বলছো এলি? তোহফা কোথায় যাবে এখন?”

“হাজার সৈনিক সাথে দিয়ে তানহার সাথে তোহফাকে পাঠিয়ে দিন। এমনিতেও তোহফার অস্ত্রবিদ্যা শেখার সময় হয়ে এসেছে। ঝামেলা মিটে গেলে দু’জন ফিরে আসবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তানহার কাছে তোহফা সুরক্ষিত থাকবে।”

বলতে দেরি অমনি তড়িঘড়ি করে কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত বন্দবস্ত হয়ে গেল। সুলতানের হুকুমের উপর কারোর কথা বলার অবকাশ নেই। তোহফাকে সাথে করে হাজার সৈনিক ছুটিয়ে মহল ত্যাগ করলো তানহা।
অথচ কী আশ্চর্য! বিপদ যেন পিছু ছাড়ছেই না। শত্রুর আনাগোনা বেড়ে গেল। তাইতো রাত নামার পূর্বেই এক নাবিক রুদ্ধশ্বাসে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে মহলের দিকে। ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলে,

“কে কোথায় আছো? শাহ নদীতে শেহজাদির ক্ষতবিক্ষত লাশ ভাসছে। সবাই মহলে খবর দাও। তাড়াতাড়ি নদীর পাড়ে চলো।”

চলবে……..

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_54

নিজ কামরায় বেশ অনেকটা সময় ধরেই রাজকীয় কেদারায় থম মেরে বসে আছে জারনাব। বড় নির্লিপ্ত ওর ভঙিমা। চোখের কার্ণিশে অশ্রুর কণা। সুন্দর মুখাবয়ব ভয়ঙ্করভাবে লাল হয়ে আছে। হিজাবের বাঁধনটাও আজ এলোমেলো। সম্মুখের বিশাল দর্পণে ভেসে উঠেছে ওর বিধ্বস্ত মুখশ্রী। আকস্মাৎ উন্মাদের ন্যায় ছুটে গেল পালঙ্কের পাশে। বিভ্রান্ত পথিকের মতোই পালঙ্কের নিচ হাতরে সজোরে টেনে আনলো কাঠের বাক্সটা। তালা তুলে কাপড়গুলো ছুড়ে ফেলল কামরার চতুর্দিকে। বেরিয়ে এলো সাহাদের ব্যবহৃত আতরের শিশি। চোখ চিকচিক করে উঠলো জারনাবের। এ যেন লক্ষ বছর পুরোনো গুপ্তধন পেয়েছে সে। খানিক সময় নিয়ে একধ্যানে চেয়ে রইল শিশিটার দিকে। ফুরিয়ে গেছে আতরটা। তবুও শিশি খুলে নাকের কাছে ধরে ঘ্রাণ নিলো ও। প্রাণ জুড়িয়ে আসে সেই ঘ্রাণে। সাহাদের শরীরের মিষ্টি সুবাসে শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ করে সে অনুভব করলো সেই অনুভূতি।

শিশি উপুর করে হিজাবের সাথে মাখতে গিয়ে বুঝলো এক ফোঁটা আতরও আর অবশিষ্ট নেই। রাগে-দুঃখে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল শিশিখানা। আচমকাই সে যেন ক্ষোভ আর আক্রোশে ফেটে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর পুনরায় হন্তদন্ত হয়ে মেঝে থেকে তুলে নিলো শিশিখানা। বুকের মাঝে চেপে ধরে ভীত হয়ে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,

“দুঃখিত আমি।”

থেমে থেকে পুনরায় আতঙ্কিত হয়ে শুধাল,
“আপনি রাগ করেননি তো?”

জারনাব যেন শুনতে পেলো কারোর গায়েবি কন্ঠস্বর,
“কী করে রাগ করি বউ? ভালোবাসি যে!”

ততক্ষণাৎ ধোঁয়ার ন্যায় মিটে গেল জারনাবের যত রাগ-ক্ষোভ। আক্রোশ মিলিয়ে মুখখানাতে স্থান পেল একরাশ লজ্জা। সেই গায়েবি কন্ঠস্বর যেন পুনরায় বলে উঠলো,
“আমার কাছে আসবে না তুমি? আমি যে বহুদিন ধরে তোমার অপেক্ষায় আছি।”

“না না, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবো আপনার কাছে।”

দ্বারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে এসবই পর্যবেক্ষণ করছে মাহতাব। জারনাবের এমন পাগলাটে আচরণে হতভম্ব হয়েছে সে। কই? সে তো এখানে জুঁই ব্যতীত আর কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে কার সাথে কথা বলছে জুঁই? একলা একাই প্রলাপ করছে সে। জারনাবের কাছে এগিয়ে আসে সে। সামনে এসে নীরবে বসে পড়লো মেঝেতে। জারনাবের ঠিক পাশেই। নিজেকে সংবরণ করে মুচকি হেসে শুধাল,

“কার সাথে কথা বলছো জুঁই?”

মৃদু কেঁপে উঠলো জারনাব। চকিতে ফিরে তাকালো। কিন্তু কোনো এক কারনে মাহতাবকে দেখতেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। সাহাদকে আশা করেছিলো সে। ক্ষুব্ধ হয়ে ধাক্কা মেরে বসলো মাহতাবের বুকে। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে বলল,

“কেন এসেছো? কেন এসেছো এখানে?”

মেঝেতে হেলে পড়তেই হাত ঠেকিয়ে নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে নিয়ন্ত্রণ করে মাহতাব। নির্বাক, নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো জারনাবের দিকে। এখনো রাগে গজগজ করছে সেই রমনী। পুনরায় বিধ্বংসী কন্ঠে বলল,
“তোমার কারনে চলে গেল সাহাদ।”

হতভম্ব মাহতাব এবার নিজের বিস্ময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কৌতূহলী হয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলে বসলো,

“সাহাদ তো মৃত। সে কী করে আসবে?”

রাগে অগ্নি শর্মা জারনাব দ্বিগুণ চিৎকার করে জানালো,
“এসেছিলো সাহাদ। জানো না তুমি কিছু। চলে যাও আমার কামরা ছেড়ে।”

আজ কেন যেন সহ্য হলো না মাহতাবের। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করলো। মৃত মানুষকে বারবার কেন স্বরণ করতে হবে? সাহাদের উদ্দেশ্যে কপট রাগ দেখিয়ে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
“ভাগ্যিস আগেই মরে গেছিস। নয়তো আমার হাতেই মরতে হতো একদিন।”

অথচ জারনাবের দিকে ফিরে পানির পাত্র এগিয়ে দিয়ে কী শান্ত স্বরেই না বলে বসলো,
“পানি খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।”

পাত্রখানা ছুড়ে ফেলে দিলো জারনাব। পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার হলো মেঝে। ভিজে গেল জারনাব নিজেও। এবার রাগ সংবরণ করতে ব্যর্থ হলো মাহতাব। অসহনীয় রাগে হিতাহিতবোধশূন্য হলো যেন। শক্ত হাতে জারনাবের দুই বাহু চেপে ঝুঁকে এলো নিকটে। চোখে চোখ রেখে কঠিন কন্ঠে জানতে চাইল,

“পাগল হয়ে গেছো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, পাগল হয়ে গেছি। তুমি মেরে ফেলো আমাকে। আমি সাহাদের কাছে চলে যেতে চাই।”

তার জেদি কন্ঠকে ছাপিয়ে শোনা যায় বীরের পুরুষালি হীম ধরানো কন্ঠ,
“কোথাও যাবে না তুমি। সারাজীবন আমার কাছে থাকতে হবে তোমাকে।”

জারনাবের বিস্মিত দৃষ্টিতে উপেক্ষা করে পুনরায় আওড়ালো,
“তুমি চাইলেও আমার কাছে ফিরতে হবে। না চাইলেও ফিরতে হবে। কেবল মৃত্যু ব্যতীত তামাম পৃথিবীর কারোর সাহস নেই তোমাকে ছিনিয়ে নেওয়ার।”

আজমাইন যে এমন কিছু বলতে পারে তা আগেই উপলব্ধি করেছিলো জারনাব। আজমাইনের প্রনয়ের দৃষ্টি, ভালোবাসায় ঘেরা আঁকার-ইঙ্গিত, যন্ত সবকিছুই লক্ষ করেছে সে। তাইতো হীম শীতল গলায় নির্লিপ্ত হয়ে বলে উঠলো,

“তবে মৃত্যুই হোক সেই সমাধান।”

“জুঁই! খবরদার সেই দুঃসাহস দেখিও না। নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

“এমনিতেই তোমার মতো খারাপ কেউ নেই আজমাইন। ভীষণ খারাপ তুমি।”

রমনীর ছলছল নয়ন নিমেষেই বরফ হয়ে পড়লো বীরের তীব্র রাগের কাছে। মুহূর্তেই গলে তরল হলো যেন সমস্ত রাগ-ক্ষোভ। এতোক্ষন যে হাত শক্ত করে চেপে ধরেছিল জারনাবের দুই বাহু সেই হাতদুটো আলগা হয়ে এলো আলগোছে। নিভে গেল মাহতাবের যত আক্রোশ।
চিন্তিত দৃষ্টিতে চেয়ে অনুতাপের গলায় বলল,

“আমি দুঃখিত জুঁই। ব্যথা পেয়েছো?”

সেসময় বদলে গেল জারনাবের মুখশ্রী। চোখ মুছে ধরা গলায় আওড়ায়,
“আমাকে একটু একা থাকতে দেবে আজমাইন? আমি ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। কিছুক্ষণ নিরালায় বসে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে চাই।”

“সিদ্ধান্ত! কীসের সিদ্ধান্ত?”

“পরে ভেবে জানাবো তোমাকে। এখন দয়া করে আমাকে একা থাকতে দাও।”

অনুনয় করছে জারনাব। মাহতাব তবুও দ্বিধায় ভুগে বলল,
“কিন্তু জুঁই,,,,।”

“চলে যাও আজমাইন।”

বড় কাতর সেই চাহনি, সেই কন্ঠ! তন্মধ্যে মাহতাব উপলব্ধি করে জারনাব ভয়ানক কোনো সমস্যায় রয়েছে। হতে পারে তা মানসিক সমস্যা। যার দরুন জারনাবের সুন্দর মুখখানাতে অবিরাম চিন্তার রেশ স্পষ্ট। তার ভেতর সে এই সময় এমন ব্যবহার করে বসলো! কাজটা একেবারেই উচিত করেনি সে। পরে মন মেজাজ ঠিক হলে ক্ষমা চেয়ে নেবে এই ভেবে উচ্চারণ করলো,

“ঠিক আছে। বিশ্রাম করো তুমি। উঠে বসো। পানি খেয়ে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করো। পরে আসবো আমি।”

সাম্রাজ্যবাসীর বিশাল ভীর ঠেলে শাহ নদীর তীরে এসে পৌঁছালো সুলতান। হাজার সৈন্য সাথে নিয়ে তীরে এসে থামতেই প্রজারা একত্রে সম্মান প্রদর্শন করে পিছিয়ে গেল। চতুর্দিক থেকে তাকে ঘিরে রেখেছে সৈন্যরা। লাশটা কিছুক্ষণ পূর্বেই তীরে এনে রাখা হয়েছে। সফেদ চাদর বিছিয়ে আগাগোড়া ঢেকে দিয়েছে। দীর্ঘক্ষণ ধরে পানিতে ভাসার কারনে ফ্যাকাসে হয়েছে দেহখানা। উদ্বিগ্ন হয়ে দ্রুত এগিয়ে আসে সুলতান। দৃষ্টিতে কিঞ্চিত ভয়ের রেশ। লাশের মুখের উপর থেকে চাদর সরানোর পূর্বে আরো একবার শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসা গলাটা ঢোক গিলে ভিজিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কাঁপা কাঁপা হাতে একটানে সরিয়ে দিলো চাদরখানা। শেহজাদির সফেদ, শুশ্রি চেহারায় বেশ কিছু জায়গায় নখের আঁচড়ের দাগ। রাজকীয় গাউনটা ছিঁড়ে ফেটে গেছে। হয়তো বাঁচার চেষ্টা করেছিলো। ধস্তাধস্তির কারনে এই চিহ্ন। সবচেয়ে বেদনাদায়ক আঁচড়টা তার গলায় কাঁটা হয়েছে। ধারালো কিছু দিয়ে গলা চিরে দিয়েছে হত্যাকারী। লাশের মুখ দেখে ভয়ের রেশ কেঁটে যায় সুলতানের। দৃষ্টির শঙ্কা কেঁটে গিয়ে চিন্তা দেখা দিলো। তানহা আর তোহফা অক্ষত ভেবে সস্তির শ্বাস ফেলল। অতঃপর অবাক হয়ে বলল,

“মাইরা!”

শেহজাদি মাইরার মৃতদেহ পুনরায় ঢেকে দেওয়া হয়। সুলতান উচ্চস্বরে সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলল,
“লাশ মহলে নেওয়ার ব্যবস্থা করো।”

ভয় কেঁটে গেলেও চিন্তা রয়েই গেল সুলতানের। শেহজাদি মাইরাকে তো সে বন্দি করে রেখেছিলো। তাকে কীভাবে কেউ হত্যা করতে পারে? আবার লাশটা এই নদীতে ফেলে গেছে! খুনির উদ্দেশ্য কী? খুনিতো তার পরিবার আর তার ক্ষতি চায়। তবে তার চরম শত্রুকে কেন হত্যা করতে গেল? বেগমকে কথা না দিলে সেই হত্যা করতো এটাকে। কিন্তু বেগমের কসমের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। এলিকে হত্যার প্রচেষ্টা করেছে সে। তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার আছে বলে মনে করে না সুলতান। তবুও এমন কাজ কে করতে পারে এই ভেবে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছে। গুপ্ত শত্রু নয়তো? কিন্তু মাইরাকে হত্যা করে তার কী লাভ? কী উদ্দেশ্য?

লাশ তুলে নেওয়ার পূর্বেই ঝুঁকে আসে সুলতান। মাইরার মুখের সামনে এসে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,

“আমি হলে আরো ভয়াবহ মৃত্যু দিতাম। তবে আমার বেগমের বোনের মৃত্যুতে সহানুভূতি দেখানো আমার গুরুদায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তাই জানাজাটা হবে আমার পক্ষ থেকে।”

লাশ নিয়ে মহলে পৌঁছাতেই গুপ্তচর বার্তা নিয়ে আসে।
সৈনিক উচ্চস্বরে জানালো,

“মহামান্য সুলতানের জন্য বার্তা এসেছে।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই বার্তাবাহক এসে মাথা নুইয়ে জানালো,
“শেহজাদি তোহফা এবং শেহজাদি তানহা গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। সুস্থ আছেন তারা। চিন্তার কোনো কারন নেই।”

সস্তির শ্বাস ছাড়লো সুলতান। যাক, ওরা ভালো আছে। কিছুক্ষণের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছিল সে। তবে আরেকটা বিষয়। এলি এখনো অবগত নয় মাইরার মৃত্যুর ব্যপারে। তাকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু যখন উঠে জানতে পারবে তখন তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? কষ্ট পাবে? নাকি ভুল বুঝবে তাকে? কেননা শেষবার মাইরাকে যেদিক দেখা গিয়েছিল সেদিন সে তাকে শাস্তি দিতে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল এলির সামনে। শুধুমাত্র এলির কারনে বেঁচে গিয়েছিল মাইরা। আজ যদি এলি তাকেই সন্দেহ করে এই মৃত্যুর কারন হিসেবে?

উত্তরীয় সাম্রাজ্যে খবর নিয়ে গেছে সৈনিক। মাইরার মৃত্যুর খবর! মহলের কেউই খুব একটা শোকাহত নয়। শুধু গুটিকতক সেবক-সেবিকা আফসোস করে বলছে,

“আহারে! এই বয়সে মারা গেল। এতো ধন-সম্পদ থাকতেও বাঁচতে পারলো না।”

বেগমের ঘুম ভাঙলো কেবলমাত্র। চোখ মেলতেই মহলের কঠিন শোরগোল কানে এলো। কর্ণগহ্বর ঝলসে যাবার উপক্রম। হঠাৎ শোরগোলের কারন উপলব্ধি করতে না পেরে ভ্রুজোড়া কুচকে এলো। বিস্মিত কন্ঠে আওড়ালো,

“আবার কী হয়েছে?”

গুটি গুটি পায়ে উঠে বসলো। ঘুমানোর পূর্বেই সেবিকা তাকে যেই শরবত পান করতে দিয়েছিল সেই পাত্রটা এখনো পালঙ্কের পাশেই রয়েছে। খালি পাত্রের তলানিতে সামান্য কিছুটা শরবত লেগে ছিলো। যা এসময় ভয়ানক নিল বর্ণ ধারন করেছে। বিষের এ কঠিন বর্ণ নজর এড়িয়ে গেল বেগমের। সেবিকা তাকে নিজ হাতে শরবতের নামে বিষ এনে দেবে তা সে কল্পনাও করতে পারে না হয়তো। শোরগোলের কারন খুঁজতে দ্রুত উঠে দাঁড়াতে নিলে মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো। তাল হারিয়ে পড়ে যেতে গিয়েও কোনোমতে পালঙ্ক চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিলো। অতঃপর ধীরে সুস্থে কামরা ত্যাগ করে। যত এগোচ্ছে ততই শোরগোল বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমশ কৌতূহল বাড়ছে। হয়েছে টা কী? এভাবে সকলে শোরগোল করছে কেন?

কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই মহলের প্রধান দ্বারের সম্মুখেই একটি খাটিয়া নজরে এলো। ধ্বক করে উঠলো হৃদয়! কার কী হয়েছে? আতঙ্কিত হয়ে চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করে কোথাও সুলতানের দেখা পেলো না। পিপাসার্ত পাখির ন্যায় নজর শুধু সুলতানকেই খুঁজছে। দৃষ্টিতে শঙ্কা। ভয়ার্ত গলায় নরম স্বরে ডাকলো,

“সুলতান, সুলতান।”

আরোও কিছুদূর যেতে নজর কাড়লো কাফনে জড়ানো একটি লাশ। তার বোনের লাশ! তার ছোট বোনের নিথর দেহ মুড়িয়ে রাখা হয়েছে সফেদ কাপড়ে, মুখটা খোলা। ওদিকে দাফনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বোনটা কেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে আছে। টলকে ওঠে বেগমের পা’দুটো। কাঁপা কাঁপা স্বরে ডাকলো,

“মমাইরা, চোখ খোল। কী হয়েছে তোর?”

চোখ খুলছে না মাইরা। বোন যত বড় ক্ষতি করুক, যত বড় শত্রুই হোক না কেন, বোনের মায়া ত্যাগ করা দায়! তাইতো বেগম জ্ঞান হারিয়ে অসাড় দেহে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। নিভু নিভু দৃষ্টি জোড়া আবছা চিত্র তুলে ধরলো। অদূরে ছুটে আসছে সুলতান। উদ্বিগ্ন হয়ে বারংবার ডাকছে,

“এলি, এলি।”

চলবে………..