সাঁঝক বাতি পর্ব-১৭+১৮

0
324

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৭]

-‘হজম করতে পারবে? ভেবে নিও। বেস্ট অফ লাক।’

দিগন্তের একথায় প্রশান্ত শব্দ করেই হেসে উঠল। যেন হাস্যকর জোক্স শুনেছে। হাসিও থামছে না। হাসতে হাসতে ওর চোখের পানি বেরিয়ে আসার উপক্রম। দিগন্ত ফিরেও তাকাল না। সে ফোনে গেম খেলতে মগ্ন। খেলাতে টানটান উত্তোজনা। অন্যদিকে তাকালে হেরে যাবে।সে হারতে অভ্যস্ত নয়। হার জিনিসটা পছন্দও না। ওর ভাষ্যমতে,
মরে যাওয়া ভালো। তবুও হার মানব না। কারণ
হার স্বীকার মানে ;অন্যের বুড়ো আঙ্গুল দেখা। এটা গ্রহন করা ওর কর্ম নয়। এরচেয়ে মৃত্যু ঢের ভালো। তখন প্রশান্ত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘ভাই, জ্বলছে নাকি?’
-‘উহুম না, জ্বলতে নই জ্বালাতে পছন্দ করি।’
-‘বৈধ বউ বলে কথা!’
-‘শুধু বউ না বৈধ শত্রুও।’
-‘কাজ শুরু করি?’
-‘করো তবে পুনরায় ভাবো। পরিণতি ভয়ংকর।’

প্রশান্ত পুনরায় শব্দ করে হাসল। দিগন্তের কথায় না হেসেও পারছে না। দিগন্ত খেলা কমপ্লিট করে ঘুরে বসল। সফল হয়েছে। সে পাস্তা মুখে নিয়ে শিফার দিকে তাকাল। মেয়েটা অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। যেন ভষ্ম করে দিবে। দিগন্ত এক চামচ পাস্তা তুলে বলল,

-‘খাবে? নয়তো এভাবে তাকিও না আমার ব্রণ উঠতে পারে।’

-‘পিপীলিকার পাখার গজায় মরিবার তরে। তো তোরাও দেখি উড়তে শুরু করেছিস। সময় বুঝি ঘনিয়েই এসেছে।’

দিগন্ত উঠে শিফার পাশের চেয়ারে বসল।আদুরে
স্পর্শে নাকটা টেনে দিলো। ঠোঁটে ফিচেল হাসি।
প্রশান্ত সামনে বসে ভাইয়ের অভিনয় দেখছে।সে পারেও বটে। ভাইও হয়েছে তার মতোই অভিনয়ে
পারদর্শী। তখন দিগন্ত প্রশান্তকে বলল,

-‘আমি তোমাদের খেলার রেফারি। এই খেলার সমাপ্ত আমার সামনেই করিও। আমিও দেখতে চাই; ভাইয়ের দম বেশি নাকি বউয়ের।’

শিফা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে অমানুষ দেখছে। ওর
অমানুষ দেখার শখ পূরণ হয়েছে। নয়তো এরা এসব বাক্য উচ্চারণ করতেও পারত না। সম্পর্ক কী? সম্পর্কের মানেও তো বুঝে না। অমানুষের জাত! দিগন্ত শিফার দিকে তাকিয়ে হাসল। যেন
বিশ্বজয় করা কাজ করেছে। সচারচর অহেতুক হাসে না সে।মেয়েটাকে দেখতে বেশ লাগছে। ওর আদুরে গালদু’টোতে আদর দিতে ইচ্ছে করছে।
ওর স্পর্শে মেয়েটা আরো সুন্দর হয়ে গেছে। আর সুদর্শন মানুষটা স্পর্শ করেছে। সুন্দর তো হবেই। তেজী শিফাকে দেখে দিগন্তেরও ভালো লাগছে।
বাঘিনীকে বাঘিনী রুপেই মানানসই। আর
বাঙালি মেয়েরা সত্যিই খুব অদ্ভুত।এরা স্বামীকে হয়তো সুপারম্যান ভাবে। যেন সব অন্যয় কাজে স্বামীদের ঢাল হতে হবে। কেন স্বামীদের কি কাজ নেই? ওর তো অনেক কাজ। কাজে চাপেই বউকে ঠিকঠাক প্যারা দিতে পারছে না। বউকে চাপে না রাখলে সে কেমন ধাঁচের স্বামী? এই এখন যেমন
কঠিন গেমটা খুব কষ্ট করে খেলল। জিতলোও। এজন্য ওর কষ্ট করতে হলো। কষ্ট করে খেলছিল বিধায় বউকে তখন সাপোর্ট দিতেও পারল না।
আহারে, বউটা রাগ করেছে। এবার কি করবে?
প্রশান্ত যতটুকু বলার বলেছে, শিফা রেগে এদিকে তাকিয়ে আছে। যেন সব অপরাধ তার। অথচ সে কিচ্ছু করে নি। কিছু করলেও ওর দোষ; না করলেও। দিগন্ত ছোট খাটো কাজ করেও না।
শিফা হাসিবের কল পেয়ে উঠে চলে গেল। কিছু কাজ আছে। অহেতুক বসে থাকারও সময় নেই। শিফা কয়েকপা এগিয়ে আবার ফিরে এসে মৃদু স্বরে বলল,

-‘কুকুররা ভালো খাবার সহজে পায় না। আর পেলেও টানাটানি করা ওদের স্বভাব। তোরা ঠিক ওদেরই মতো।’

প্রশান্ত রেগে তাকাল। শিফার মরার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ওকে আর সহ্য হচ্ছে না। একটু বেশিই কথা বলে। দিগন্ত পাস্তা খেতে ব্যস্ত। খুব টেস্টি
পাস্তা! সে শিফার কথাটা যেন শুনেও শুনে নি।
শিফার চোটপাটে অভ্যস্ত। তাই কিছু মনে করল না। পাগলে প্রলাপ বকবেই শোনার কী ওর সময়
আছে? না নেই! ওর সময়ের দাম আছে। দিগন্ত
বরাবর সময়ের মূল্য বুঝে। শিফা ততক্ষণে স্থান ত্যাগ করেছে। অনাকাঙ্খিতভাবেই প্রশান্তের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। ঘৃণায় মুখ ফিরালে,প্রশান্ত কথা বলতে এসেছিল। এতটাই লাজহীন সে! দিগন্তের উপস্থিতি আশ্চর্যজনক ছিল। সে এখানে কেন?
কাজে এসেছিল নাকি অকাজে? হয়তো দু’জনেই
কাজে এসেছিল। পাবলিক প্লেসে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করে নি শিফা। এজন্য প্রশান্তর নোংরা কথা হজম করল। তবে জবাবটাও তোলা রইল। সুযোগ বুঝে দিবে। গলার জোর দেখিয়েও লাভ নেই। যা করার কাজে করেই দেখাতে হবে।
দিগন্ত পাস্তাটুকু গিলে বলল,

-‘সাফার সঙ্গে আমাকে না জড়ালেও পারতে?’
-‘এত ভালো মানুষ কবে হলি, ভাই?’
-‘যেদিন বেইমান চেনা শিখেছি।’
-‘শিফাকে ভালোবাসিস?’
-‘সেটা আবার কি?’
-‘অনুভূতি।’
-‘না।’

তারপর দু’জনেই উঠে চলে গেল। তমা পেছনের টেবিলে বসা। ওদেরই কথা শুনছিল। বোরকাতে নিজেকে আবৃত করা। এজন্য কেউ খেয়াল করে নি। শিফা ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।তবে পারল না। শিফা ইশারায় ওকে আসতে নিষেধ করেছে। কারণ প্রশান্ত আর দিগন্তও আছে। ওরা দেখলে সন্দেহ করত। আর তমার পেছনে লোক লাগাত। তমাকে আর বিপদে ফেলতে চাচ্ছে না।
তনয়ের কম ক্ষতি ওরা করে নি। তবুও তমা মুখ ফিরিয়ে নেয় নি। অভিযোগও করে নি। বরং সে শিফার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সাফার মতো বান্ধবী হয়ে।

প্রশান্ত আস্তানায় এসেছে। এখানকার কথা কেউ জানে না। এটা ওর একান্ত আস্তানা। জায়গাটা কেমন জানি। ভুতুরে পরিবেশ। প্রশান্তর পাপকর্ম গুলো এখানেই করা হয়। ওর পাপকর্মের স্বাক্ষীও এই জায়গাটা। প্রশান্ত, শিফার মামার কঙ্কালের দিকে তাকিয়ে বিশ্রী একটা গালি দিলো। তারপর বলল,

-‘তোর ভাগ্নীর শরীরে খুব তেজ। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে তেজ জমিয়েছে। ব্যাপার না, আমি পরখ করে নিবো। ওর তেজযুক্ত নগ্ন শরীরে চোখ আর হাত বুলিয়ে দেখব ;ওর তেজের পরিমাণটা ঠিক কতখানি।’

কথাটা বলে প্রশান্ত বিশ্রীভাবে হাসল। শিফার মামাকে সেই মেরেছে। তাও নিজের অাস্তানায়।
তারপর রয়েল হসপিটাল দিগন্তের নামে দলিলও
করিয়েছিল। যাতে কেস খেলে দিগন্ত খায়। কিন্তু দিগন্ত ঢের ধূর্ত। পরে, সব ঝামেলাগুলো মিটিয়ে ফেলেছিল। টাকা আর ওর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জোরে।
আর তখন থেকেই হসপিটাল তার নামেই রয়ে গেছে।

প্রশান্ত ওর সহকারীকে ডেকে কিছু বুঝিয়ে বলল। সে আপাতত হসপিটালে যাচ্ছে। এসে যেন দেখে কাজ হয়ে গেছে। নয়তো সহকারীকে কঙ্কাল করে ঝুলিয়ে রাখবে। আস্তানা ভর্তি কঙ্কাল।চারদিকে
ঝুলিয়েও রাখা। মৃদু বাতাসে নড়ছেও। ভয়ংকর লাগছে দেখতে। যাদেরকে অপছন্দ তাদেরকে সে কঙ্কাল করে। ওদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
ওরা ঝামেলা। মানুষ মারার চেয়ে সহজ কাজও আর নেই। মারতেও বেশ লাগে। হাত-পা বেঁধে এসিডের কূপে ফেলে দেয়। ব্যস, হয়ে গেল। মৃত
লাশ নিয়ে ঝামেলা নাই। আগে লাশ নিয়ে খুব বেশি ঝামেলা হতো। তাই কোটি টাকা খরচ করে এসিডের কূপ তৈরি করেছে। তবে এসিড দেখতে যতটা সাধারণ কাজটা কিন্তু অসাধারণ। কয়েক সেকেন্ডেই ঝলসে ফেলে। এই কাজটা ওর বাবার থেকে শিখেছে। ওদের বাসার পাতালঘরেও ওর বাবা তাই করতেন। ব্যবসা এমনি এমনি বড় হয় নি। তাও এত অল্প সময়ে। এজন্য অনেক মানুষ মারতে হয়েছে। প্রশান্তের বাবা ভদ্রলোকের বেশে থাকেন। অথচ উনার জন্যও মেয়ে আসে। উনি নিহার সঙ্গেও সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে। নিহাও রাজি ছিল। টাকা পেলে বুড়ো আর যুবক সব সমান।
পুরুষ তো পুরুষই! এমনকি, নিহা সাফার সঙ্গে লিপ্ত হতেও সাহায্য করেছিল। তাও অনেকবার।
প্রশান্তর কাজ সেরে চলে যেতো। তখন ওর বাবা আসতেন। অবচেতন সাফা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকত। এসবের বিনিময়ে নিহা টাকাও পেতো।
আর উনি এই বয়সেও যৌবনপূর্ণ শরীরের মজা লুটতেন। নিহা কিংবা দিগন্তের মা’ও কিছু মনে করতে না। ওই পরিবারে এসব সাধারণ ব্যাপার।
বরং হাসি-ঠাট্টা করে খিলখিল করে হাসতেন আর বলতেন,
-‘দম শেষ? বাপ্রে, তা আর লাগবে?’
-‘রাতে লাগবে ডালিং, তোমরা দু’জনই এসো।’

উনার একথা শুনে নিহা ও দিগন্তের আম্মু হেসে গড়িয়ে পড়তেন। যেন খুবই মজার কথা। মস্তিষ্ক বিকলাঙ্গদের বিবেকবোধ থাকে না। এরাও তাই।

রাত তখন দুইটা সাত। স্বপ্নীলের সামনে দিগন্ত বসে আছে। স্বপ্নীল তিনদিন কিছু খায় নি।তাকে জোর করেও খাওয়ানোও যায় নি। তার একটাই কথা, ছেড়ে দাও নয়তো মেরে দাও। দিগন্ত রেগে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটাকে মেরে দিতে মন চাচ্ছে। এরা সবাই প্যারা। মার খেয়েও খেতে রাজি হচ্ছে না। এটাও শিফার মতো ঘাড়ত্যাড়া।
এতদিন স্বপ্নীল দিগন্তের কাছে ছিল। তাও সুখুর বাড়িতে। নির্জন জায়গায়।এজন্য শিফা পুনরায় দিগন্তের পিছনে লোক লাগিয়েছিল। তবুও কিছু জানতে পারে নি। স্বপ্নীল চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় কাতরাচ্ছে। সুখু ওকে প্রচন্ড মেরেছে। হকিস্টিক দিয়ে। দিগন্ত সিগারেটে সুখ টান দিয়ে বলল,

-‘ভাই, তোর প্রেমিকা আর ভার্জিন নেই। আমি
এই পূর্ণের কাজটা করে ফেলেছি। এই কিছুক্ষণ আগেও খুব আদর দিয়ে আসলাম। উফ, শরীর তো নয় যেন মাখন। কেঁদে মিনতি করে ছাড়তে বলছিল। ছাড়ি নি। বরং যতটা কষ্ট দেওয়া যায়
দিয়েছি।’

স্বপ্নীল দু’চোখ বন্ধ করে নিলো। শুনতে পারছে না আর! বুকের ভেতরে খুব জ্বালাপোড়া করছে।
অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ওর শিফা ভালো নেই।
একটুও না, এক কিঞ্চিৎও না। সেও দগ্ধ হচ্ছে।
এসব ভেবে স্বপ্নীলের চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু ঝরছে। একই বাক্য, হৃদয় জ্বলছে বিধায় দু’চোখ কাঁদছে। আর স্বপ্নীলের চোখে অশ্রু দেখে দিগন্ত হাসছে।

To be continue………..!!

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৮]

দিগন্তকে হাসতে দেখে স্বপ্নীল স্বজোরে এক লাথি বসাল। পা বাঁধা না থাকায় সম্ভব হয়েছে। অদূরে থাকায় দিগন্তেরও লেগেছে; হাঁটু বরাবর। দিগন্তও রেগে স্বপ্নীলের বুক বরাবর লাথি দিলো। স্বপ্নীল
চেয়ারসহ মেঝেতে পড়ে পেল। আর মুখে থেকে বেরিয়ে এলো, ‘মা।’ মধুর এক ডাক। মনে আর মুখে সর্বদা ‘মা’ ডাকের বিচরণ। তাই সামান্য ব্যথা পেলেও আগে ‘মাকেই’ স্মরণে আসে।’মা’ অতি আপন কি না তাই। স্বপ্নীলের দু’হাত বাঁধা চেয়ারের সাথে। শত চেষ্টা করেও বাঁধন খুলতে পারছে না। দিগন্ত সেই অবস্থাতেই লাথি দিয়েই
যাচ্ছে। যেন ফুটবলকে কিক মারছে। রাগে ওর শরীরের রক্ত ফুটছে। এত বড় কলিজা দিগন্তের শরীর স্পর্শ করেছে! যেটা আজ অবধি কারোরই
সাহসে হয় নি। আর চুনো পুটিঁ! এজন্য শাস্তিও প্রাপ্য। দিগন্ত মারতে মারতে বিশ্রীসব গালি দিয়ে বলল,

-‘মা***তোকে পুঁতে ফেলব। জানিস আমি কে? হিরোগিরি দেখাস আমার সাথে! ঝলসে দিবো, শালা হারামজাদা।’

স্বপ্নীলের নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। লাল রক্তে মুখটাও লাল হয়ে আছে। রক্ত গড়িয়ে মেঝেতে টপটপ করে পড়ছে। দেখতে খুব
ভয়ংকর লাগছে। তবুও দিগন্ত থামছে না। রাগে সে কাঁপছে। স্বপ্নীল তখন অনেক কষ্ট বলল,

-‘এক বাবার ছেলে হয়ে থাকলে তুই বাঁধন খুলে দেখ। কাপুরুষ একটা।’
-‘ খুললে কী করবি, কুত্তার**?’
-‘খুলে তো দেখ।’
-‘ধৈর্য্য ধর, কালকেই তোর সব শখ মিটাবো।’
-‘এখন কি সাহস নেই?’

দিগন্ত সত্যি সত্যি’ই বাঁধন খুলে তাৎক্ষণিক মার শুরু করল। হকিস্টিক দিয়ে। স্বপ্নীল উঠে দাঁড়াতে পারল না। সেই সুযোগটুকুও দেওয়া হলো না।সে মাথা ধরে বসে পড়ল। দিগন্ত প্রচন্ড রেগে বলল,

-‘আমাকে চ্যালেঞ্জ? তোর কলিজা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব, ব্লাডি বিচ! অজানা কারণে
বেঁচে যাচ্ছিস। নয়তো বুলেট গিলিয়ে দিতাম।’

-‘মেরে দে। দেখি, তোর বুকে কেমন পাটা।’

স্বপ্নীলের কথায় দিগন্ত চুপ হয়ে গেল। কিছু ভেবে শিফাকে ফোন দিলো। রাত তখন সাড়ে তিনটা।
শিফা কল রিসিভ করল না। হয়তো গভীর ঘুমে মগ্ন। স্বপ্নীল রক্তাক্ত অবস্থায় হাসছে। দিগন্ত ওর হাসির কারণও বুঝেছে। তবে এখন কথা বাড়াল না। কালকেই জবাবটা দিয়ে দিবে। বুঝিয়ে দিবে সে কয় বাবার ছেলে! সে কে? আর ঠিক কেমন ধাঁচের? সুখু এসে দিগন্তকে অনেক কষ্ট সরালো।
নয়তো মেরেই ফেলতো। দিগন্ত ভয়ানক রাগী।
রাগ উঠলে হুশ থাকে না। নিঃশেষ করেই ক্ষান্ত হয়। স্বপ্নীল তবুও হাসছে। দিগন্তকে দেখেই হাসি পাচ্ছে। স্বপ্নীলের চালাকি দিগন্তও ধরে ফেলেছে।
রাগিয়ে দিয়ে’ই সে বাঁধন খোলার বুদ্ধি এঁটেছে।
তা তো হয় না। সে অন্যকে ঘোল খাইয়েই চলে।
এত সহজ নয় বোকা বানানো। সে সুখুকে ইশারা করল, বাঁধতে। তারপর দিগন্ত জোরে আরেকটা কিক মেরে স্থান ত্যাগ করল। মুখে ফিচেল হাসি। খুব শীঘ্রই ওদের দেখা হবে।স্বপ্নীল জ্ঞান হারাল। দিগন্ত পুনরায় ওর বুকে কিক মেরেছে। একটুপরে
সুখু ভয় পেয়ে দিগন্তকে ফোন করে বলল,

-‘ছ্যার, পোলাডা নড়তাছে না। মইরা গেলে?’
-‘মরলে ভালো, তবে না মরলে আরো ভালো।’
-‘এহন কি করতাম ছ্যার?’
-‘ ফোন রাখ। নয়তো নিজের কবর খুঁড়ে রাখ।’

সুখু তাৎক্ষণিক কল কেটে দিলো। তারমানে ওর রাগ কমে নি। এই রাগ কমাতে না জানি কত কী করবে! দিগন্ত বাসায় ফিরে দেখে ওর বাবা পানি খাচ্ছেন। অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আঙ্গুলের ফাঁক থেকে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। রুমজুড়ে সিগারেটের গন্ধ। সেন্টার টেবিলে অর্ধেক খাওয়া নাস্তা। হয়তো স্পেশাল কাউকে অাপ্যায়ন করে বিদায় করেছেন। উনি চরম মেয়েবাজ। বলারও অপেক্ষা রাখে না। এই লোককে দেখলে ওর রাগ হয়। মন বলে, পেটভর্তি বুলেট গিলাতে। নয়তো তৃপ্তি করে এসিড খাওয়াতে। উনি ওর বাবা নন।
এজন্যই হয়তো এমনটা মনে হয়। উনি সম্পর্কে ওর খালু আর প্রশান্তর মা আপন খালা। আর প্রশান্ত খালাতো ভাই। একথা এখানকার কেউ’ই জানেন না। জানার সুযোগও দেওয়া হয় নি।এর
কারণও আছে। দিগন্তের নিজের বাবা ওদেরকে
রেখে নিখোঁজ হয়েছিলেন। কোনোভাবে সন্ধান মিলে নি। এই শক ওর মা সহ্য করতে পারেন নি। ব্রেন স্টোক করে মারা গিয়েছিলেন। দিগন্ত তখন চার বছরের। অবুজ একটা বাচ্চা। তখন
থেকে সে প্রশান্তে মায়ের কাছে বড় হয়েছে। বুঝে নি ; দিগন্ত উনার ছেলে নয়। পরে একদিন ওর খালা সব জানিয়েছিল। যাতে হঠাৎ কোনোদিন জেনে কষ্ট না পায়। খালাকে প্রচুর ভালোবাসত;
‘আম্মু’ বলেই ডাকত। খালা জীবিত থাকতে ওর খালু অমানুষই ছিল। তবে চাপা ছিলো। এখন এরুপ উন্মোচন হয়েছে। উনি দিগন্তকে অপছন্দ করেন তবে সেটা প্রকাশ করে না। দিগন্তও বুঝে।
তবে কিছু বলে না। সে নিজের মর্জিমতো চলে।
লোকসম্মুখে বাবা বলে ডাকলেও, অন্য সময়ে ফিরেও দেখে না। ঘৃণা হয়। বাবা ডাকটা উনার সঙ্গে যায় না। কলংকিত করেছে এই ডাকটাকে।
উনি প্রশান্ত ও দিগন্তকে অপকর্মের দিকে ধাবিত করেছেন। টাকার লোভ ধরিয়েছেন। মেয়ের প্রতি আসক্ত করেছেন। আর মাঝে মাঝে নিজে ফেঁসে গেলে, ছেলেদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েও দিয়েছেন। ছেলে মরুক। নিজে বাঁচলেই হলো। ঠিক এমন জাতের বাবা উনি। উনি ঘুরে দিগন্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন,

-‘ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? দূর হও।’
-‘জানোয়ারের মতো ব্যবহার কবে ছাড়বেন?’
-‘দিগন্ত!’
-‘আমার নাম দিগন্ত, মনে আছে। আপনাকে মনে করাতে হবে না।’
-‘খুব বার বেড়েছে তোর? দাঁড়া কাল সকালেই তোর হচ্ছে, জানোয়ার একটা।’
-‘সকাল পেলে তো।’

কথাটা বলে দিগন্ত উনার গলা চেপে ধরল। এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তিও শুরু হয়ে গেল। দিগন্ত উনাকে গেস্ট রুমে নিয়ে গিয়ে মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর প্যান্টের বেল্ট খুলে বেধড়ক মারতে লাগল। ওর রাগ তুলছে। অনেকদিনের জমিয়ে রাখা রাগ।
মাকে অর্থাৎ ওর খালাকে সে খুব ভালোবাসত। এই লোকই খালাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরেছে। দিগন্ত একথা পরে জেনেছে। তাও আবার উনিই মাতাল অবস্থায় এসব বলেছিলেন।আর দিগন্ত চুপ করে শুনেছিল। খালাকে মারার কারণ, উনি সবাইকে পাতালঘরের অপকর্মের কথা জানিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। পাপকর্ম থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেছিলেন। এজন্য উনি খালাকেই সরিয়ে দিয়েছেন। বেল্টের মার খেয়ে উনি ছটফট করতে লাগলেন। অর্ধনগ্ন দেহে কালশিটাও পড়ে গেছে। দিগন্ত উনাকে মারতে মারতেই অবচেতন করে ফেললো। তারপর ধরে ওর রুমে যাওয়ার পথে সাবিনা খালা দেখে নিলেন। দিগন্ত মুচকি হেসে বলল,

-‘খালা আপনার কিডনী দুইটা, তাই না?’
-‘জ্বে ভাইজান।’
-‘আমাকে দিবেন?’
-‘ন ন না ভাইজান।’
-‘তাহলে বলুন, আপনি কিছু দেখেছেন?’
-‘না ভাইজান।’
-‘ভয় পাবেন না খালা। ভয়ে আপনি ভুলভাল
ডাকছেন। অন্যসময়ে বাপজান ডাকেন। এখন ভয়ে ভাই বলে ফেলেছেন। লাগাম ঠিক রাখুন, আপনিও ভালো থাকবেন।’
-‘জ্বে আচ্ছা।’

দিগন্ত কথাগুলো বলে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। তারপর গোপনঘরের সিঁড়ি বেয়ে খালুর পাতালঘরে চলে গেল।খালুর পাতালঘরেই কাজ সমাপ্ত। যেখানে শুরু সেখানেই শেষ। আহা,কত্ত চমৎকার বুদ্ধি। দিগন্ত পানি ছিঁটিয়ে উনার জ্ঞান ফিরালো। নয়তো মেরেও মজা পাবে না। অথচ মজার পাওয়ার জন্যই এতকিছু করা।মরার ভয় চোখে না থাকলে কিভাবে হবে? সব কষ্টই বৃথা।
দিগন্ত উনার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,

-‘খালুজান ভালো আছেন? আপনি নিজে তো অমানুষ; আমাকেও বানিয়েছেন অমানুষ। কেন বলুন তো?’

-‘সোনা আব্বা আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আব্বু হই না তোমার? আমার ভুল হয়ে গেছে; আব্বা। ভুলেও আর এমন ব্যবহার করব না।’

দিগন্ত হাসল। আর হাসতে হাসতে বসেও পড়ল।
আজকে দিনটা হাসতে হাসতে গেল। চারপাশে এত শয়তান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের কর্মে না হেসেও পারছে না। খালু ওকে আঘাত করতে
গিয়েও ব্যর্থ হলো। খালু হাল ছাড়লেন না।চেষ্টা করতে থাকলেন বাঁচার। দিগন্ত ওর পকেট থেকে ইনজেকশন বের করে উনার কাঁধে পুশ করল।
উনি আঁকুতি মিনতি করতে লাগলেন। তবে ওর মন গলল না। উনি ধপ করে পড়ে গেলেন। হুশ নেই। দিগন্ত উঠে একটা বক্স আনল। সেখানে সার্জারির যন্ত্রপাতি আছে। চকচক করছে। যেন সদ্য কিনে আনা।দিগন্ত সময় নিয়ে উনার চোখ, কিডনী, লিভার বের করল। মুখে তার মিটিমিটি হাসি। প্রশান্ত আর দিগন্ত দু’জনেই এসব কাজ পারে। শিখেছে। কালকে সুখুকে দিয়ে একজনের কাছে পাঠাতে হবে। টাকা পরিমানও বেশি পাবে। আপন খালুজানের পার্টস্ বলে কথা। দিগন্ত সব প্রয়োজনীয় পার্টস নিয়ে মৃত বডি এসিডের কূপে ফেলে দিলো। সেকেন্ডেই কঙ্কাল ভাসতে লাগল।
দিগন্ত রড দিয়ে তুলে দেওয়ালেই ঝুলিয়ে রাখল। নিচে নাম ঠিকানাও লিখল। তারপর সুইচ বাটন চেপে হাসল। মেঝেতে পড়ে থাকা সব রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে। পাতালঘর এই পদ্ধতিতে বানানো। রক্ত ধোঁয়ার ঝামেলাও নেই। ঘড়িতে তখন চার’টা।
দিগন্ত সব কাজ সেরে রুমে চলে গেল। আজকে ঘুম হলো না। ধ্যাত, কালকে চোখের নিচে কালি না পড়লেই হয়। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই, শিফার কথা মনে হলো। কিছু একটা ভেবে হেসে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো।

গভীর স্পর্শে শিফার ঘুম হালকা হলো। প্রথমে না বুঝলেও, পরে বুঝে স্বজোরে ধাক্কা দিলো। তবুও মানুষটাকে সরাতে পারল না। শিফা চোখ খুলে দিগন্তকে দেখে হতভম্ব। দিগন্ত এখানে? সে ঠিকানা জানল কিভাবে? কখনই বা এলো? ওর এখানে আসার কারণ কি? মুহূর্তে শিফার মাথায়
এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। ঘড়িতে কেবল পাঁচটা সাত বাজে। সে পুনরায় দিগন্তকে সরাতে ব্যর্থ হলো। দিগন্ত তখন কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,

-‘বাবা হওয়ার সুযোগ করে দাও। আমি খারাপ স্বামী হলেও ;একজন ভালো বাবা হবো।’

To be continue………!!