সাজিয়েছি এক ফালি সুখ পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
119

#সাজিয়েছি_এক_ফালি_সুখ
#লেখনীতে – #kazi_Meherin_Nesa
#শেষ_পর্ব

চেয়ারে হেলান বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আবরার, সকালে ব্যস্ত থাকলেও এখন বেচারার কাজে মন বসছে না। সামনে অনেকগুলো অর্ডার আছে কিন্তু সেগুলো নিয়ে এখনো কোনো কাজই শুরু করতে পারেনি। সেক্রেটারি ইমরান একটা ডকুমেন্ট সাইন করাতে এসেছিলো, আবরারের হা হুতাশ দেখে আর প্রশ্ন না করে পারলো না…

‘ আর ইউ ওকে স্যার?’

‘ আমাকে কি ঠিক মনে হচ্ছে না?’

‘ নো স্যার, আপনি আপসেট আছেন মনে হচ্ছে ‘

‘ আই অ্যাম ফাইন!’

আবরার ডকুমেন্টে সাইন করে সেক্রেটারির হাতে দিয়ে দিলো…

‘ আপনাকে কফি এনে দেবো, স্যার?’

‘ লাগবে না, আচ্ছা আপনি এক কাজ করুন। এ মাসে শোরুমে জুয়েলারি সেলের লিস্টটা নিয়ে আসুন ‘

‘ কিন্তু মাস তো এখনো শেষ হয়নি স্যার ‘

‘ আই নো, তবে কেমন বিক্রি হচ্ছে সেটা জানাটাও জরুরি। আপনি লিস্ট নিয়ে আসুন ‘

আবরারের আদেশক্রমে সেক্রেটারি লিস্ট দিয়ে গেলো। সাধারনত শোরুমের সেলস রেকর্ড ও মাসের শেষে চেক করে কিন্তু আজ মাসের অর্ধেকেই চেক করতে বসলো। উদ্দেশ্য একটাই, নিজেকে ব্যস্ত রাখা। আবরারের এই আপসেট হওয়ার কারণ হলো জারা ওর বাড়িতে গেছে পুরো এক সপ্তাহের জন্যে, ইতিমধ্যে ওর যাওয়ার দুদিন হয়ে গেছে। কাজের বাড়তি চাপ না থাকলে আবরার নিজেই শশুরবাড়ি চলে যেতো কিন্তু সেটাও করতে পারছে না। সবমিলিয়ে বাড়ি – অফিস উভয় স্থানেই ভীষণভাবে মানসিক অশান্তি ভুগছে বেচারা!বিকেলের নাস্তা হিসেবে সবার জন্যে গাজরের হালুয়া বানিয়েছে জারা, জাফা তো বোনের বানানো হালুয়া খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পাশেই বসে আছেন হাসনা বেগম, মেয়ের কর্মকাণ্ডে ভীষন বিরক্ত হচ্ছেন তিনি। ইদানিং ওনার দুই ছেলেমেয়েই জারার ভক্ত হয়ে গেছে, জাফা রায়ান দুজনেই বড় বোন হিসেবে জারাকে এখন বেশ সম্মান করে। সবাইকে দেওয়ার পর জারা ওর বাবার জন্য হালুয়া নিয়ে যায়, আনোয়ার সাহেব তখন প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। দরজায় নক করে জারা বলে..

‘ বাবা, ব্যস্ত নাকি?’

‘ না না, ওই গ্রামের এক জমি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে তার কিছু কাগজপত্র চেক করছিলাম। ভেতরে এসো ‘

ভেতরে এলো জারা, চেয়ার টেনে বাবার পাশে বসলো…

‘ ওই জমির কেস এখনো শেষ হয়নি? এক বছর তো ঘুরে এলো ‘

‘ না, এটা নিয়ে এখনো ঝামেলা মেটেনি তবে উকিল বলেছে শীঘ্রই একটা ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তুমি এটা কি নিয়ে এসেছো?’

‘ গাজরের হালুয়া বানিয়েছি, তোমার তো প্রিয় তাইনা?’

‘ আমার ডায়বেটিস কিন্তু আগের থেকে বেড়েছে ‘

‘ সুগার ফ্রি এটা ‘

‘ ঠিক আছে। কিন্তু এই গরমের মধ্যে আবার এই ঝামেলা কেনো করতে গেলে? বাপের বাড়িতে এসে মেয়েরা আরাম করে, আর তুমি কিনা এসব করে বেড়াচ্ছো?’

‘ একটু ভুল বললে বাবা, আমি শ্বশুরবাড়িতেও আরামই করি। সারাদিন তো বাড়িতে থাকিনা, তবুও আমার শাশুড়ি আমাকে কখনো রান্নাবান্নার জন্যে এখনও কথা শোনায়নি ‘

মেয়ের কথা শুনে হাসলেন আনোয়ার সাহেব, হালুয়ার পেয়ালাটা হাতে নিয়ে বললেন…

‘ ভাগ্য করে শাশুড়ি পেয়েছো বলতে হয়’

‘ হুমম, আলহামদুলিল্লাহ ‘

আনোয়ার সাহেব খাচ্ছিলেন, তখন জারা বললো…

‘ একটা কথা বলার ছিলো ‘

‘ হ্যাঁ বলো ‘

‘কয়েকদিন আগে আম্মু এসেছিলো আমার সঙ্গে দেখা করতে ‘

মেয়ের কথা শুনে খাওয়া থামিয়ে খানিকটা অবাক চোখে তাকালেন আনোয়ার সাহেব, প্রাক্তন স্ত্রী হঠাৎ কোন উদ্দেশ্যে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলো?

‘ হঠাৎ?’

‘ ওই মুহূর্তে আমিও এটাই ভাবছিলাম, এতোবছর পর হঠাৎ কি ভেবে এলো। দেশের বাইরে থাকে বললো, দেশে এসেছিলো তাই নাকি আমার ঠিকানা খুঁজে দেখা করতে এসেছিলো ‘

‘ ওহ! কি বললো?’

‘ অনেককিছুই বললো, আফসোস করলো আবার আমার কাছে ক্ষমাও চাইলো ‘

প্রাক্তন স্ত্রী মেয়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছে শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন আনোয়ার সাহেব…

‘ ক্ষমা কেনো চাইবে? সে তো কোনো দোষ করেনি। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, এতে দোষ নেই’

‘ সে তো তোমাকেও ভালোবেসেছিলো ‘

‘ কখনও কখনও সময়ের সাথে ভালোবাসার লিমিট ফুরিয়ে যায়, আমাদের ভালোবাসার সময় ফুরিয়েছিলো। আর ওকে একা দোষ দিয়ে লাভ কি, নতুন সংসার তো আমিও পেতেছি ‘

‘ তুমি আমার কথা ভেবে আবার বিয়ে করেছিলে, আর আম্মু নিজের সুখের কথা ভেবে আমাদের ছেড়ে চলে গেছিলো ‘

চমকে উঠলেন আনোয়ার সাহেব, মেয়েকে তো কখনও উনি এ কথা জানাননি তাহলে সে এ কথা জানলো কিভাবে? আবরার যে ওর সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করবেনা তা আনোয়ার সাহেব জানেন…

‘ তুমি এ কথা জানলে কিভাবে?’

‘ অবাক হচ্ছো কেনো বাবা? কি ভেবেছিলে, তুমি জানতে দেবেনা আর আমি কখনো জানবো না?’

মেয়ের কথায় নড়েচড়ে বসলেন আনোয়ার সাহেব, হালুয়ার পেয়ালাটা সাইড টেবিলে নামিয়ে বললেন…

‘ তোমার মা কি এতবছর পর এসব কথা বলার উদ্দেশ্যে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো?’

‘ কথায় কথায় উঠে এসেছিলো এই প্রসঙ্গ, আমিই তাকে প্রশ্ন করেছিলাম এ বিষয়ে। ভাগ্যিস করেছিলাম, নাহলে হয়তো জানতেই পারতাম না আসলে দোষ কার ছিলো আর আমি কাকে ভুল বুঝেছি ‘

উত্তর দিলেন না আনোয়ার সাহেব, বাবার নিরবতা দেখে জারা জিজ্ঞাসা করলো…

‘ তুমি তো আমাকে কোনোদিন নিজে বলতে না তাইনা?’

‘ এটা এমন কোনো বিষয় না যেটা তোমার জানতেই হতো, তাছাড়া ডিভোর্সটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিলো। তুমি তখন বাচ্চা ছিলে, বোঝার বয়স তোমার ছিলো না ‘

‘ বোঝার বয়স হওয়ার পর অন্তত বলতে পারতে, তাহলে আজ এভাবে আমাকে আম্মুর মুখ থেকে সবটা জানতে হতো না। তুমি জানো বাবা, আম্মু যখন কথাগুলো বলছিলো তখন আমার কেমন লাগছিলো। হয়তো আমি আমার মাকে বেশীই বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম ‘

কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা জড়িয়ে আসছিলো জারার, মেয়েটা কঠিন মনের মানুষ বটে তবে ইদানিং নিজেকে যেনো শক্ত রাখতে পারেনা। আনোয়ার সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন…

‘ খারাপ লেগেছে সবটা জেনে? কষ্ট হয়েছে? এজন্যেই তোমাকে কিছু বলিনি। বাবা হয়ে মেয়েকে এমন কথা জানানোর প্রয়োজনবোধ করিনি যা আমার মেয়েকে কষ্ট দেবে ‘

‘ কিন্তু আমি যে তোমাকে ভুল বুঝছিলাম বাবা, সেটা তো তুমি নিজেও বুঝতে পারছিলে। তারপরও কেনো চুপ রইলে? তোমার মেয়ে তোমাকে ভুল বুঝছিলো তাতে তোমারও তো কষ্ট হচ্ছিলো ‘

স্মিত হাসলেন আনোয়ার সাহেব, পরম আদরে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন…

‘ তোমার অভিমান মাখা কথা শুনে আমার কখনো খারাপ লাগেনি জারা, আমার মেয়ে আমার কাছে আছে এটাই আমার জন্যে যথেষ্ট আর আমি চাইনি যে তুমি তোমার মাকে ভুল বোঝো। মেয়েদের কাছে তার মায়ের সম্মানটা অন্যরকম, আমি চেয়েছি তুমি সবসময় তোমার মায়ের কথা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করো’

বাবার কথা শুনে চোখদুটো ভিজে এলো জারার, আজ অব্দি কোনোদিন বাবার সঙ্গে এভাবে বসে কথা বলার সুযোগ হয়নি ওর…

‘ একটা কথা মনে রেখো। ছেলেমেয়েরা যতোই বড় হয়ে যাক, মা বাবার কাছে বাচ্চাই থাকে। তুমি এখনো আমার কাছে আমার ছোট জারাই আছো’

অশ্রুসিক্ত নয়নে অবাক চোখে বাবাকে দেখছে জারা, “বাবা” নামক এই লোকটাকে রীতিমতো ঘৃণা করতো, সে কথা ভেবে আজ জারার নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। মাথা নীচু করে ধরা কণ্ঠে জারা বললো…

‘ আই অ্যাম সরি, বাবা। এতো বছর আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি, মেয়ে হিসেবে তোমার প্রতি অনেক দায়িত্বে অবহেলা করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিও ‘

‘ বোকা মেয়ে, তুমি কোনো দোষ করেছো নাকি? বাবার প্রতি মেয়ের অভিমান দোষের কিছু না ‘

বাবার কথা শুনে এবার ঠোঁট আঁকড়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা জারা, ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে ওর। ভীষন অনুশোচনা হচ্ছে। বাবার সঙ্গে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু চোখ তুলে তাকাতে পারছে না জারা, কণ্ঠ থেকে যেনো একটা শব্দ বেরোতে চাইছে না। এতগুলো বছর যে আগলে রেখেছে তাকে ভুল বোঝার এই অনুশোচনাবোধ কি জীবনে কখনো কমাতে পারবে? জানা নেই জারার! নয়দিন ধরে বাবার বাড়িতে আছে জারা, যদিও সাতদিন থাকার কথা ছিলো কিন্তু বাবার সঙ্গে একটু বেশি সময় কাটানোর ইচ্ছে হওয়ায় সাতদিন পার হওয়ার পরও জারা এখানে রয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, তাকে পছন্দের খাবার বানিয়ে খাওয়াচ্ছে। আনোয়ার সাহেবও সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে মেয়ের সঙ্গে ওর শৈশবের স্মৃতিচারণ করছেন। এদিকে জারা বাবার সঙ্গে খুব ভালো সময় পার করলেও ওদিকে আরেকজন এতদিনেও বউ বাড়ি না ফেরায় পাগল প্রায় হয়ে উঠেছে। আবরারের মা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলেন। রাতের খাবারের সময় হয়েছে, তখনই দেখলেন তার ছেলে তৈরি হয়ে আসছে, হাতে গাড়ির ছবি…

‘ এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস?’

‘ তোমার বৌমা বোধহয় এখানে ফেরার কথা ভুলে গেছে আম্মু, তাই ওকে আনতে যাচ্ছি ‘

এ কদিনে আবরার আরো কয়েকবার জারাকে আনতে যেতে চেয়েছে কিন্তু ওর মা বাঁধা দিয়েছে কারণ জারা তাকে ফোন করে জানিয়েছিল ও আরো কয়েকদিন পর ফিরবে। কিন্তু আজ শত বললেও আবরারকে আটকানো যাবে শুনবে না বুঝে আবরারের মা আর আর কিছু বললেন না…

‘ আচ্ছা, খবর খেয়ে যা ‘

‘ শ্বশুড়বাড়ি যাচ্ছি আম্মু, বাড়ি থেকে খেয়ে গেলে জামাই আদর উপভোগ করতে পারবো না ‘

ছেলের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে তাকালেন আবরারের মা, ছেলে ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। ওর বাবা এসে চেয়ার টেনে বসে প্রশ্ন করলেন…

‘ তোমার ছেলে ঐরকম হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটলো?’

‘ জারাকে আনতে গেলো ‘

‘ এতো রাতে?’

‘ ছেলেটা কয়েকদিন ধরে কেমন উদাস হয়ে আছে, মিস করছে জারাকে। নিয়ে আসুক গিয়ে ‘

প্রথম কয়েকদিন সমস্যা না হলেও তিনদিন পর থেকেই আবরার ভীষণ আপসেট ছিলো, বিয়ের পর এই প্রথম জারাকে ছাড়া এতোদিন থাকা। তবুও জারার কথা ভেবে নিজেকে সামলেছে কিন্তু দিন পেরিয়ে নয় হয়ে গেলেও জারার ফেরার কোনো উদ্দেশ্য নেই দেখে আর থেমে থাকতে পারলো না। জারার বাসায় এসে কলিং বেল বাজাতেই ওর ছোটো বোন এসে দরজা খোলে, এতো রাতে আবরারকে এখানে দেখে অবাক হয় জাফা..

‘ ভাইয়া!’

‘ হ্যালো জাফা, কেমন আছো?’

‘ অনেক ভালো! কিন্তু তুমি আসবে আপু বললো না তো’

‘ ও জানতো না, আমি সারপ্রাইজ দিতে এসেছি!’

হাতে থাকা ফল ও মিষ্টির প্যাকেটগুলো জাফার হাতে দিয়ে বাড়ির কে কোথায় আছে সেটা জেনে নিলো। এ বাড়িতে সবাই একটু আগেই ডিনার করে নেয়, জাফার থেকে জানলো রাতের খাবার শেষে সবাই নিজেদের ঘরে চলে গেছে। আবরার এর দেরি না করে সোজা গেলো জারার ঘরে, বিছানায় বসেছিলো জারা। হুট করে আবরারকে দেখে উঠে দাড়ালো..

‘ তুমি! আজকে আসবে বললে না তো!’

‘ আমার বলতে হবে কেনো? তুমি নিজে থেকেও আমাকে আসতে বলতে পারতে ‘

আবরারের কথায় রাগ স্পষ্ট, আজ ভ্যাপসা গরম পড়েছে, লোকটা ঘেমে গেছে একদম! জারা ফ্যান বন্ধ করে এসিটা চালিয়ে দিলো। ও কিছু বলবে তার আগেই আবরার অভিযোগের স্বরে বলে উঠলো…

‘ মেয়ে তুমি এতো পাষাণ কেনো হ্যাঁ! নয়টা দিন এখানে রয়েছো, একবারও আমার কথা ভাবলে না? আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে দিনযাপন করছি সেটা ভাবলে না? কতদিন হলো এখানে এসেছো?’

আবরার যে আজ খুব বকবে সেটা বুঝে জারা আমতা আমতা করে বললো…

‘ আমি কালকেই ফিরে যেতাম ‘

‘ আপনাকে আর কিছু করতে হবে না ম্যাডাম, আপনি আজই ফিরবেন আমার সঙ্গে ‘

‘ এই রাতের বেলা?’

আবরার উত্তর না দিয়ে শুধু চোখ গরম করে তাকালো, জারা তাতেই বুঝে গেছে আজ ফিরে যেতেই হবে। আবরার বাড়িতে এসেছে জানার পর আনোয়ার সাহেব ওর অ্যাপায়নের ব্যবস্থা করলেন। খাওয়া শ্বশুরের সঙ্গে কিছু সময় কথা বলে জারাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে আবরার, ওদের বিদায় দিতে আনোয়ার সাহেবও বাইরে এলেন। গাড়িতে ওঠার আগে আবরার জারার বাবাকে বললো…

‘ আব্বু, একটা কথা বলবো?’

‘ বলো ‘

‘ জানি আপনার মেয়ে আপনার অনেক আদরের, এখানে এলে আপনি অবশ্যই চাইবেন ও আরো কিছুদিন থাকুক। কিন্তু আপনি প্লিজ সাতদিন আপনার মেয়েকে এখানে রাখবেন না, সাতদিন পরেই পাঠিয়ে দেবেন ‘

‘ঠিক আছে, তাই হবে ‘

আনোয়ার সাহেব হাসিমুখে মেয়ের জামাইর অভিযোগ শুনলেন এবং মেনেও নিলেন, কিন্তু বাবার এই জামাইপ্রীতি দেখে অবাক না হয়ে পারলো না জারা।

‘ বাবা?’

‘ ওভাবে দেখার কিছু নেই। তুমি সাতদিন বলে নয়দিন থেকে দোষ করেছো তাই ও অভিযোগ করলো আর আমি তার সমাধান দিচ্ছি ‘

‘ বাবা তুমি পারোও! জামাইর প্রতি মেয়ের থেকেও বেশি দরদ তোমার, আর আসবোই না আমি এখানে!’

জারা মুখ গোমড়া করে গাড়িতে বসলো, আবরারও আর দেরি না করে ওর শ্বশুরকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে বসলো। আবরার ড্রাইভ করছে, প্রায় এক ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পরও জারা একটা কথা বলেনি, মেয়েটা অভিমান করেছে। আবরার নিজেই নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করলো…

‘ বাবার সঙ্গে কেমন সময় কাটালে?’

‘অনেক ভালো সময় কাটিয়েছি, জানো আমি আর বাবা মিলে ঘুরতেও গেছিলাম ‘

‘ ওয়াও! তারমানে আমার বউটার মুড একদম হ্যাপি হয়ে আছে এখন!’

‘ হুমম, কিন্তু তুমি আমাকে ওভাবে না নিয়ে এলেও পারতে। বাবা কি ভাববে বলোতো ‘

‘ কিছুই ভাববেনা, উল্টে এটা ভেবে খুশি হবে যে তার মেয়ের জামাই মেয়েকে কতো ভালোবাসে ‘

‘ তুমি আর বাবা দুজনে যা শুরু করেছো না!’

‘ এসব ছাড়ো, বাবার সঙ্গে ঘুরেছো এবার আমার সঙ্গে একটা নাইট ডেট হয়ে যাক?’

অনেকদিন আবরারের সঙ্গে সময় কাটানো হয়নি ভেবে আজ ওর প্রস্তাবে জারা চট করে রাজি হয়ে গেলো। আবরার আগে থেকেই প্ল্যান করে এসেছিলো সবটা, বিয়ের পর এটাই ছিলো ওদের প্রথম নাইট ডেট!
_________________________________________

নভেম্বর মাস চলছে, সারাদিন আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলেও রাতে হিমশীতল আবহাওয়া জানান দেয় যে শীতকাল আসছে। শীত উপলক্ষে এবার আবরারের বাবা ঠিক করেছে স্বপরিবারে দেশের বাড়িতে যাবেন, বহুদিন যাওয়া হয় না। এক শুক্রবারে সকালে এই নিয়েই পরিবারের সকলকে নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন আবরারের বাবা, আলোচনার এক পর্যায়ে জারার ফোন আসে যে ওর বান্ধবীর ছেলে হয়েছে, খবরটা শুনে আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়ে জারা। বিকেলে আবরারকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে নিউবর্ন বেবীদের প্রয়োজনীয় জিনিসের একটা সেট কেনে, এরপর বান্ধবীকে দেখতে হাসপাতালে যায়। তখন জারার বান্ধবী হুট করে বলে বসলো…

‘ সবার উপস্থিতিতে একটা কথা এখানেই আমি ডিক্লিয়ার করে দিচ্ছি, জারা তোর মেয়ের সঙ্গে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেবো ‘

এলিনার কথা শুনে সেখানে উপস্থিত সকলে হাসলো, জারাও একগাল হেসে এলিনার গাল টেনে বললো..

‘ তুইও না এলিনা, বাচ্চার মা হয়ে গেলি কিন্তু তোর পাগলামি গেলো না ‘

‘ পাগলামি না জারা, আমি সিরিয়াস! আবরার ভাই, আপনিও কিন্তু সাক্ষী রইলেন!’

আবরারও তালে তাল মিলিয়ে বললো…

‘ ইয়াহ শিওর! আমারই ভালো হলো, মেয়ের জন্যে আর কষ্ট করে ছেলে খুঁজতে হবেনা ‘

জারা হতবিহ্বল হয়ে তাকালো আবরারের দিকে, এই লোকটা কি কখনো শোধবারে না? বান্ধবীর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর পর ওরা বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বের হয়। এলিনার কেবিন থেকে বের হয় দুজনেই…

‘ ইশ! ওর ছেলেটা কি মিষ্টি হয়েছে দেখতে তাইনা? পুরো ওর বাবার মতো হয়েছে, মাশা আল্লাহ ‘

‘ হ্যাঁ, কিন্তু তোমার বান্ধবী আজ আমাকে অ্যাডভান্সেই শ্বশুর বানিয়ে দিলো দেখছি, মনে হচ্ছে আমাদের এবার তোমার বান্ধবীর জন্যে ছেলের বউ আনার ব্যবস্থা করা উচিত’

‘ অমনি শুরু হয়ে গেলো তোমার?’

‘ তুমি তো হ্যাঁ না কিছু বলছো না, তাই শুরু আমাকেই করতে হবে। আমার অনেকগুলো মেয়ে লাগবে’

হন্তদন্ত হয়ে আবরারের মুখ চেপে ধরলো জারা, আশেপাশের মানুষজন আড়চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে…

‘ অ্যাই! আস্তে বলো, আশেপাশে মানুষ আছে তো নাকি’

‘ তো? আমি আমার বউর সঙ্গে গুরুতর বিষয়ে আলোচনা করছি তাতে কারো হস্তক্ষেপ করার সাহস আছে নাকি?’

‘ উফফ, একবার শুরু হলে আর থামতে ইচ্ছে করেনা তোমার তাইনা?’

কথা বলতে বলতে করিডোর পার হলো ওরা, এবার সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হঠাৎ পায়ের ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে জারা। তৎক্ষণাৎ ওকে ধরে ফেলে আবরার…

‘ হেই, আর ইউ ওকে?’

এক হাতে আবরারের বাহু চেপে ধরলো ধরলো জারা..

‘ মাথা ঘুরে উঠলো হঠাৎ ‘

‘ তোমার কি হয়েছে বলোতো, কয়েকদিন ধরেই দেখছি বলছো মাথা ঘোরাচ্ছে। কিছু নিয়ে টেনশন করছো? বলো আমায় ‘

‘ আরে নাহ, কি নিয়ে চিন্তা করবো!’

‘ হাসপাতালেই যখন আছি, চলো ডাক্তার দেখিয়ে নাও’

‘ এইটুকুর জন্যে ডাক্তার দেখাতে হবেনা ‘

‘ একবার চেকআপ করে নিলে তো কোনো সমস্যা নেই, আরেকটু হলে তো আজ সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যেতে। মাথা ঘোরানোর কারণটাও জানতে হবে ‘

‘ আবরার, ঠিক আছি আমি ‘

‘ একটা কথা বলবে না, চলো ‘

আবরার ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, ডাক্তার কিছু টেস্ট দেয়। একেবারে টেস্টগুলো করে এরপর ওরা বাড়ি ফেরে, জারার ভীষণ টেনশন হচ্ছে রিপোর্টে কি আসবে ভেবে। পরদিন প্রেগন্যান্সি টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ পাওয়ার পর পরই যেনো জারার দুনিয়া বদলে গেলো। আবরার হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট নিয়ে বাসায় আসার পরই আনন্দ উল্লাস শুরু হয়ে গেছিলো, জারা ওই মুহূর্তে যেনো এক অজানা ঘোরের মধ্যে ছিলো। আনন্দ হচ্ছিলো, আবার ভয়ও! নতুন একটি প্রাণ পৃথিবীতে আনার এবং তাকে সঠিকভাবে লালন করার নতুন দায়িত্ব পালন করতে হবে যে…
______________________________

৬ বছর পর….আবরার একটু আগে অফিস থেকে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই দেখে জারা রাগী চোখে তাকিয়ে আছে, হাতে মেয়ের ড্রয়িংবুক। আবরার জারার মেয়ে আয়রার পাঁচ বছর বয়স। মেয়ে তার বাবার ভীষন ভক্ত, আবরারও মেয়েকে মাথায় তুলে রাখে। বাপের আহ্লাদ পেয়ে মেয়ে অনেক দুষ্টু হয়ে গেছে। জারা কি বলতে এসেছে সেটা বুঝে আবরার আগেই সরে যেতে যাচ্ছিলো, তার আগেই…

‘ আবরার, মেয়েকে মাঝে মাঝে শাসনও করতে হয় সেটা কি জানো? এই তোমার আহ্লাদের জন্যে মেয়ে আমার একটাও কথা শোনেনা ‘

‘ তোমার থেকে আমার মেয়ে এখন বেশি অ্যাটেনশন পাচ্ছে বলে জেলাস ফিল করছো নাকি?’

‘ আমি কিন্তু মজা করছি না!’

জারার ধমক শুনে চুপ হয়ে গেলো আবরার…

‘ আরে, ওই ড্রয়িংটা ও আকতেই পারছিলো না তাই আমি এঁকে দিয়েছি। তাতে এতো রাগ করার কি আছে?’

‘ ঐযে, আবার শুরু হলো! আবরার, এই ড্রয়িংটা ওর নিজের হাতে করতে বলেছে। প্রত্যেকবার তুমি একে দিলে ও শিখবে কিভাবে? না পারলেও চেষ্টা তো করতে হবে। সামনে ওর পরীক্ষা আছে, এখন না শিখলে…’

পুরো কথা শেষ করতে পারলো না জারা, তার আগেই আবরার ওর গালে টুপ করে চু’মু এঁকে দিয়ে বললো…

‘ রাগলে তোমাকে দারুন লাগে ‘

আবরারের কথা শোনামাত্রই জারার রাগ যেনো পানি হয়ে গেলো…

‘ এক বাচ্চার বাবা হয়ে গেছো, তাও তোমার হাবভাব বদল হলো না?’

‘ দশ বাচ্চার বাবা হয়ে গেলেও আমি এমনি থাকবো, আমাকে এভাবেই তোমার সহ্য করতে হবে ‘

বিয়ের এতগুলো বছর পরও আবরার একটুও বদলায়নি, উল্টে দিনদিন যেনো ওর ভালোবাসা আরো বেড়েছে। মেয়ের জন্মের দিন মেয়েকে আবরারের কোলে দেখা ওই মুহূর্তে জারার নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে নারী মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ দরজার পর্দা নড়তে দেখে জারার ভাবনায় ছেদ পড়লো, তার মেয়ে এসে লুকিয়েছে পর্দার পেছনে। মেয়েকে দেখেই জারা ডাকলো, মায়ের ডাক শুনে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো আয়রা…

‘ আয়রা, এসো পড়তে বসবে ‘

‘ আম্মু! আমি আরেকটু খেলবো ‘

মেয়ে এবার মায়ের কাছে বকা খেতে পারে এই আশঙ্কায় আবরার ওর মেয়েকে কোলে তুলে বলে…

‘ আয়রা, আজকে আব্বু তোমাকে পড়াবে।আমরা দুজনে মিলে সুন্দর সুন্দর ড্রয়িং শিখবো ওকে?’

‘ উম্ম! আমাকে খরগোশ আঁকা শেখাবে আব্বু?’

‘ ওকে! আজকে আমরা খরগোশ আঁকবো’

মেয়ে রাজি হয়ে গেলো, আবরার ইশারায় জারাকে বললো আজকে ওই পড়াবে জারাকে। জারাও আর দ্বিমত করলো না, একটু পর মেয়ের জন্যে চকলেট মিল্ক বানিয়ে এনে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। বিছানার ওপর বসে বাবা – মেয়ে ড্রইং করছে, আবার মাঝে মাঝে খুনসুটিতে মেতে উঠছে। জারা দাঁড়িয়ে দেখছে আর হাসছে, কিছু বছর আগে কল্পনাও করেনি জীবনে এমন সুন্দর দৃশ্য দেখার ভাগ্য হবে। হঠাৎ আবরারকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নেওয়াটাই যে জীবনের সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্ত ছিলো তা জারা এখন অনুভব করে। কখনো হতাশ হলে বা মন খারাপ থাকলে আবরার ও আয়রার দিকে দেখলেই ওর সব হতাশা মন খারাপ দুর হয়ে যায়, ছোট থেকে বড় হওয়ার সফরে মা বাবা সাজানো পরিবার না পেলেও স্বামী সন্তান নিয়ে নিজের সুখের সংসার সাজাতে সফল হয়েছে!

____ সমাপ্ত ____

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]