সাজিয়েছি এক ফালি সুখ পর্ব-০৩

0
94

#সাজিয়েছি_এক_ফালি_সুখ
#লেখনীতে – #kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০৩

সন্ধ্যাবেলা ড্রইং রুমে বসে চা খেতে খেতে ফোনে কিছু দেখছিলো জারা, তখন ওর ছোটো বোন জাফা ওখানে এসে বললো…

‘ আপু! আমাকে একটা হেল্প করবে?’

‘ আমি কোনো হেল্প করতে পারবো না ‘

‘ আপু প্লিজ, ছোটো একটা হেল্প ‘

‘ বললাম তো পারবো না, আর আমার কাছে নষ্ট করার মতো সময় নেই! যা বলার আছে নিজের মা নাহলে ভাইকে গিয়ে বলো ‘

‘ এতো ভাব দেখাচ্ছো কেনো আপু? শুনলাম তুমি নাকি কদিন পর বিয়ে করে চলেই যাবে, তার আগে আমাকে ছোটো একটা সাহায্য করে যেতে পারবে না?’

‘ আমি যাবো কি যাবো না সেটা তো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তোমার এই নিয়ে এতো আনন্দিত হবার দরকার নেই। ভেবো না আমি সারাজীবনের মতো চলে যাচ্ছি ‘

‘ সে তুমি যাই বলো আপু, বিয়ে হলে তো আর এখানে এসে থাকতে পারবে না তাছাড়া তুমি আমার বড় বোন হওয়া সত্ত্বেও আজ অব্দি একটাও সাহায্য করনি। প্রথমবার সাহায্য চাইছি তো ‘

ফোন রেখে জাফার দিকে তাকালো জারা, ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো…

‘ মা বাবা ভাই সবাইকে বাদ দিয়ে যখন আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছো তারমানে নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো কান্ড ঘটিয়েছো?’

‘ তেমন কিছুনা আপু, ছোট্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম শুধু আমার অভিভাবকের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে ব্যস এইটুকুই! তুমি আমার অভিভাবক হিসেবে যদি একটু…’

‘ ওহ! তারমানে ভার্সিটিতে কাহিনী করে এসে এখন আমার কাছে এসে ঢং করা হচ্ছে? ওসব আমি পারবো না, বাড়িতে আরো লোক আছে। তাদের গিয়ে বলো ‘

‘ আপু, এভাবে বলো না। এই প্রথম আর শেষবার, আর কখনও হেল্প চাইবো না। প্রমিজ করছি!’

‘ পারবো না আমি!’

জাফা অনেক অনুনয় বিননয় করলো কিন্তু জারা পাত্তাই দিলো না, ছোটো থেকেই জারা ওর সৎ মাকে অপছন্দ করার সুবাদে নিজের দুই সৎ ভাইবোনকেও সেভাবে আপন করে নিতে পারেনি। যদিও র’ক্তে’র সম্পর্ক বলে সৎ মায়ের মতো ওদের সঙ্গে সম্পর্ক এতটা খারাপও নয়। জারা চায়ের কাপ নিয়েই ঘরে যাওয়ার পথে হাসনা বেগমের সঙ্গে দেখা হলো…

‘ এইযে, আপনার মেয়ে কি কাহিনী করে বেড়ায় সে খবর বোধহয় রাখেন না! অবশ্য

‘ মানে? আমার মেয়ে কি করেছে?’

‘ কি করেছে সেটা গিয়ে ওকেই জিজ্ঞাসা করুন, ওর ভার্সিটিতে কিছু একটা হয়েছে। গার্ডিয়ান নিয়ে যেতে বলেছে, তাই আমাকে ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্যে বলছিলো ‘

‘ জাফা তো উল্টোপাল্টা কিছু করার মেয়ে নয়’

‘ ও কেমন সেটা আপনিই ভালো জানেন, গিয়ে নিজের মেয়েকে সাহায্য করুন আর ওকে বলে দেবেন আমার কাছে যেনো কোনো সাহায্য না চাইতে আসে ‘

কথাগুলো বলেই জারা চলে আসতে যাচ্ছিলো, তখনই হাসনা বেগম বলে উঠলেন…

‘ তোমার বাবার কাছে শুনলাম, তুমি নাকি কোন ছেলেকে পছন্দ করো? আমি তো এখনো বিশ্বাসই করে উঠতে পারছি না ‘

দাঁড়িয়ে গেলো জারা, ঘুরে তাকিয়ে বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বললো…

‘ কেনো? আপনি বুঝি ভেবে বসেছিলেন আমি কাউকে পছন্দ করবো না?’

‘ তোমার হাবভাব দেখে ঠাওর করতে পারিনি, সবসময় তো হয় পড়া নয় কাজ নিয়ে থেকেছো ‘

‘ ব্যক্তিগত দিকটা আমি কারো সামনে প্রদর্শন করিনি তারমানে এই না যে ব্যক্তিগত জীবনে আমার বিশেষ কোনো মানুষ নেই। আশা করি আপনার ভুল ধারণা ভেঙেছে?’

‘ সেটা তো পরে বোঝা যাবে। আপাতত ঐ ছেলের সঙ্গে তোমার বাবা দেখা করতে চান। তাকে বাড়িতে নিয়ে আসতে বলেছে ‘

বাবা ছেলেকে বাড়িতে আনতে বলেছে শুনেই চমকে উঠলো জারা…

‘ কি! বাড়িতে আনতে বলেছে?’

‘ ওমা, মেয়ে কাকে পছন্দ করছে সেটা আমরা দেখবো না? আদৌ পছন্দের ছেলে আছে কিনা সেটাও তো আমাদের দেখতে হবে তাইনা?’

‘ ফাইন, আনবো! তবে এখনি নয়, আরো কিছুদিন পর। বাবাকে বলে দেবেন কথাটা ‘

হাসনা বেগমের সামনে নিজের দুর্বল দিকটা কখনোই প্রকাশ করতে চায়না জারা, আজ অব্দি যতোটা সম্ভব সেটা লুকানোর চেষ্টা করেই এসেছে। আজও তার ব্যতিক্রম করেনি। মেয়ের পছন্দের ছেলের সঙ্গে বাবা দেখা করতে চাইছে এটা দোষের কিছু নয় কিন্তু জারা যে এখন অব্দি কোনো ছেলে ফিক্স করতে পারেনি। এবার জারার চিন্তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়, বাবা যদি জানে জারা মিথ্যে বলেছে তাতে হিতের বিপরীত হতে পারে আবার সত্যিটা জানলে বাবা বলবে তার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে যেটা জারা কিছুতেই করতে চায়না…ওদিকে, রায়হানের বিষয়ে খবরাখবর নিয়ে কিছু তথ্য জোগাড় করে এনেছে আবরারের সেক্রেটারি। অফ টাইমে এই বিষয়েই আবরারকে সবটা জানায়, বিস্তর সব শোনার পর আবরারের তেমন কোনো ব্যাপারে সন্দেহ হলো না

‘ তারমানে এখনও কোনো সন্দেহজনক কিছু জানতে পারেননি ‘

‘ না স্যার, আমি মোটামুটি সব খবর নিয়েছি। কিন্তু উনি হঠাৎ এতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো কেনো বললেন গেলেন সেটা এখনো বুঝলাম না ‘

‘ আমার তো মনে হচ্ছে এটা ওর ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া কিছুনা, পরপর দুবার আমার কাছে হেরে গেছে বলে মেজাজ গরম হয়ে গেছে আর কি। যাই হোক, ওসব নিয়ে না ভেবে আমাদের মূল কাজে মন দেওয়া উচিত ‘

‘ তবুও স্যার, আপনি যদি চান তাহলে আমি আরেকবার…’

‘ ইমরান, আমার একটা ব্যক্তিগত কাজে পাঠাতে চাইছি আপনাকে। আপনি একটু সময় বের করে আমাকে জানাবেন ‘

অফিসের কাজের মাঝে হুট করে ব্যক্তিগত কাজের কথা বলায় কিছুটা অবাক হলো সেক্রেটারি ইমরান…

‘ ঠিক আছে কিন্তু কাজটা কি, স্যার? মিস্টার. রায়হানের ব্যাপারে আরো কিছু..’

‘ না, অন্য একজনের সম্পর্কে কিছু ইনফর্মেশন জানা আমার অনেক দরকার, আমি নিজে সেগুলো আনতে পারবো না। আপনাকে করতে হবে ‘

‘ আমাদের কোনো ক্লায়েন্ট বা বিজনেস পার্টনার সম্পর্কিত কিছুই হয়তো আপনি জানার চেষ্টা করছেন তাইনা? সামনে যেহেতু বড় একটা ইভেন্ট আছে ‘

‘ মেয়ে! একটা মেয়ের ইনফর্মেশন এনে দিতে হবে ‘

‘ মেয়ে?’

সেক্রেটারি বেশ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে আবরার ভ্রুকুটি কুঁচকে প্রশ্ন করলো…

‘ এতো অবাক হচ্ছেন কেনো? ছেলে হয়ে আপনাকে একটা মেয়ের ইনফর্মেশন আনতে বলবো না তো কার আনতে বলবো? ছেলের?’

‘ আই ডিডন্ট মিন দ্যাট স্যার, আসলে আপনার মুখে তো আগে কখনও এমন কিছু শুনিনি তাই আর কি। আই অ্যাম রিয়েলি সরি ‘

‘ সরি বলার কিছু নেই, আপনি শুধু আমার এই ছোটো কাজটা করে দিন। এরপরের যা কাজ আছে সেটা আমি সামলে নেবো ‘

আবরারের একটা মেয়ের প্রতি এহেন উৎসাহ দেখে ওর সেক্রেটারি চমকেছে বটে, এতো বছরে বসকে কাজের বাইরে আর কোনো বিষয়ে আলাপ করতে কখনও শোনেনি। এবার যখন আবরার নিজেই বিষয়টা প্রকাশ করলো তারমানে মেয়েটার প্রতি বসের জানার আগ্রহ প্রখর এ বিষয়ে বুঝতে আর বাকি রইলো না সেক্রেটারি ইমরানের। ওদিকে, জারা হাউজে এসেছে। আজ একটা শো এর বিষয়ে এক চেনা ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করলো জারা। মোটামুটি কথা ফাইনাল হয়ে গেছে, ফ্যাশন শো টাতে অংশ নিলে ওর হাউজের নাম কিছুটা বিস্তৃতি লাভ করবে। আলাপ শেষে জারা গিয়ে রেস্টরুমের বড় সোফার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো। তখন ওর সেক্রেটারি এক কাপ চা নিয়ে এসে বললো…

‘ ম্যাডাম, আপনি কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত? কদিন ধরেই দেখছি কোনো এক চিন্তায় যেনো উদাস হয়ে থাকেন?’

‘ তেমন কিছুনা, আসলে কিছুদিন ধরে মন মেজাজ তেমন ভালো লাগছে না। তাই আর কি, আচ্ছা আপনার চেনা জানা কোনো অবিবাহিত ছেলে আছে?’

‘ আছে তো ম্যাডাম, কার জন্যে লাগবে?’

‘ লাগবে একজনের জন্যে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আপনাকে বলবো। আপনার চেনা ছেলে থাকলে অবশ্যই জানাবেন!’

সেক্রেটারির সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই জারার বান্ধবী এলিনা এসে হাজির!

‘ আমার তোর সঙ্গে কথা আছে জারা ‘

জারা ওর সেক্রেটারিকে যেতে বললো। এলিনার পরিচিত এক ছেলের সঙ্গে জারা দেখা করেছিলো, তার কাছ থেকে এলিনা জানতে পেরেছে যে জারা বিয়ের ক্ষেত্রে কিছু অদ্ভুত শর্ত দিয়েছে! এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই জারা বলে…

‘ হ্যা, শর্ত দিয়েছি আমি। বিয়েটা আমি শুধু একটা কারণেই করছি, বাবার ওই উইল। বাবার উইলে লিখা আছে আমাকে বিয়ে করতে হবে, সেটা আমি করবো। কিন্তু ছয়মাস পর আমরা আলাদা হয়ে যাবো ‘

‘ পাগল হয়ে গেছিস তুই? কোন ছেলে তোর এইসব উদ্ভট শর্ত মেনে বিয়েতে রাজি হবে?’

‘ আমাকে বিয়ে করতে হলে এসব শর্ত মানতে হবে এলিনা, আমি কারো সঙ্গে সারাজীবন সংসার করতে পারবো না। আমার বাবা আমার মায়ের সঙ্গে যা করেছে, সেই একই ঘটনার শিকার আমি হতে চাইনা ‘

‘ জারা, এটা তোর মনের ভুল। দেখ, তোর মায়ের সঙ্গে হয়েছে বলে তোর সঙ্গেও হবে তার তো কোনো মানে নেই তাইনা? সব ছেলে তো আর একরকম…’

‘ মানে আছে এলিনা, তুই বুঝবি না যে মা বাবার ডিভোর্সের পর ওই পাঁচ বছর বয়স থেকে আমি কতটা সাফার করেছি। আমি ভবিষ্যতে আর সাফার করতে চাইনা আর কোন ছেলে কেমন সেটাও আমার বোঝার ইচ্ছে নেই। এই বিয়ে আমার জন্যে একটা ডিল হবে, এর চেয়ে বেশি কিছুই না! ‘

জারার কথা শুনে কিছু বলতে পারলো না এলিনা, ওরা ছোটবেলার বন্ধু। তাই ও ভালোভাবেই জানে মেয়েটা কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে জড়িয়ে আছে একরাশ অভিমান, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও ভয়!
____________________________

আজকে শেষবারের মতো একটা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো জারা, আজ ঠিক করেই এসেছিলো যে এখানে কাজ না হলে টাকা দিয়ে ছেলে ভাড়া করবে। আর ভাড়া করা ছেলে তো ও যা বলবে তাই শুনতে বাধ্য। শেষ যে ছেলের সঙ্গে দেখা করেছে সেও জারার শর্তে রাজি হয়নি, এবার জারা ঠিক করেছে নিজ পরিকল্পনামাফিক এগোবে! আজকে লাঞ্চ টাইমে এসেছিলো জারা, খিদেও পেয়েছে। তাই ছেলেটা যাওয়ার পরই আর দেরি না করে ঝটপট খাবার অর্ডার করে দিলো, তখনই….

‘ সো, হাউ ওয়াজ ইউর ব্লাইন্ড ডেট?’

চেনা পুরুষ কণ্ঠ শুনে পেছনে তাকালো জারা, আবরারকে দেখে অবাক হলো!

‘ আপনি?’

আবরার এবার সামনে এসে জারার সামনের চেয়ারটা টেনে বসে ওয়েটারকে ডেকে নিজের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলো…

‘ আপনি কি আমাকে ফলো করছেন?’

‘ মোটেই না, আমি এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম হঠাৎ আপনাকে দেখে থেমে গেলাম আর আজকেও নতুন একটা ছেলেকে যেতে দেখলাম, ভালোই ডেট করছেন দেখছি!’

উত্তর দিলো না জারা…

‘ এতো ডেসপারেট হয়ে ব্লাইন্ড ডেট কেনো করছেন? এই বয়সে তো মেয়েরা সাধারণত বিয়ের দিকে মনোযোগ দেয় ‘

এ মুহূর্তে জারার খুব ইচ্ছে ছিলো একা বসে একটু শান্তিমতো খাবে কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না, তার ওপর প্রতিবার ব্লাইন্ড ডেটের সময়ই আবরারের সামনে পড়তে হচ্ছে। বিষয়টা বেশ অস্বস্তি লাগছে ওর, জারা জোরপূর্বক হেসে আবরারের প্রশ্নের উত্তরে বললো…

‘ ঠিকই বলেছেন। বিয়েটাই আমার মূল উদ্দেশ্য, তাই ডেট করে নিজের জন্যে উপযোগী ছেলের সন্ধান করছি ‘

‘ আই সি, তারমানে এখনও নিজের উপযোগী ছেলে পাননি?’

‘ লাইফ পার্টনার তো আর ড্রেস নয় যে সহজেই সিলেক্ট করে নেবো, সময় তো লাগবেই ‘

‘ হুমম, তবে আমার মনে হয় আপনার আমাকে ট্রাই করা উচিত। বলা তো যায়না, হতে আপনার জন্যে উপযুক্ত লাইফ পার্টনার প্রমাণিত হয়ে গেলাম’

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]