সায়র পর্ব-২০

0
446

#সায়র
#পর্ব_২০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

সকাল সাতটা। সূর্যের দেখা মিলেনি এখনো। পরিবেশ ঢেকে আছে আবছা কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে। সাত আটফুট দূরে থাকা জিনিসগুলোও অস্পষ্ট। আজ শীত একটু বেশিই পড়েছে। উজান হাত দিয়ে চুলগুলো পেছনের দিকে ব্রাশ করল। চশমাটা পরে নিলো। বারান্দার রেলিংয়ের উপর দুহাত ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে শীতল আবহাওয়া উপভোগ করছে সে। তবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাগানটাও অস্পষ্ট। সাতটা বাজলেও মনে হয় এখন ভোর চারটা। উজান আজ জগিংয়ে যায়নি। শীতের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। আজ বোধহয় সারাদিনে কুয়াশা কাটবে না।

উজান বারান্দার স্লাইডিং ডোর সবগুলো খুলে দিলো। হুড়হুড় করে হিমশীতল বাতাসে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল তার রুমটা।

উজান তার রুমে রকিং চেয়ারে এসে বসে। রুমে মৃদু সোনালী আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে সে। তার চোখের সামনে চারফুটের একটা ক্যানভাস ঝুলানো। এটা সে মাত্রই আলমিরা থেকে বের করে টানিয়েছে। উজান ঘোর লাগানো চোখে একধ্যানে তাকিয়ে ছিল ছবিটার দিকে। চশমা খুলে রেখেছে। সে এই ছবিটা কৃত্রিম উপায়ে নয়, নিজের চক্ষুদ্বয় দ্বারা দেখতে চায়। উজান রকিং চেয়ার থেকে উঠে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ছবিটার দিকে। ছবিটায় চমৎকার দেখতে একজন রমনী কতগুলো ফুল হাতে বসে ছিল। তার ঢেউ খেলানো চুল পিঠময় ছড়িয়ে। সাদা ড্রেসে স্বর্গীয় অপ্সরীর ন্যায় লাগছিল রমণীটিকে। উজান ডান হাতের তর্জনী দিয়ে মেয়েটির গাল ছুঁলো, ঠোঁট স্পর্শ করল। তৃষ্ণার্ত চাহনি মেলে তাকিয়ে থাকে সে। তখন উজানের নাকে এসে লাগল বেলী ফুলের মিষ্টি সুবাস। চোখ বন্ধ করে প্রাণভরে শ্বাস নিলো সে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। যতবারই এই ছবিটা তার কাছাকাছি থাকে ততবারই তার মনে হয় সে বেলীফুলের বাগানে এসে গেছে। এটা কি অলৌকিক কিছু? হয়তো! উজানের কাছে মনে হয় এটা আসলেই অলৌকিক। এই রমণীর আরো অনেকগুলো ছবি এঁকেছে সে। সেগুলোর সামনে গেলেও বিভিন্ন ধরনের ফুলের ঘ্রাণে ছেয়ে যায় তার আশপাশ। কখনো লিলি, কখনো গোলাপ…

উজান ভেবে রাখল সে সবগুলো ছবি এখন রুমে টাঙাবে। ঘুম থেকে উঠলেই যাতে চোখে পড়ে। পুরো রুমটা ভরে যাবে বিভিন্ন ফুলের ঘ্রাণে। কখনো খুলবে না এগুলো। আর কত লুকিয়ে রাখবে? আর নাহ! যে যা ভাবুক!

সে আলমিরা থেকে বড় বক্স বের করল। বাক্সে কাপড় মোড়ানো অনেকগুলো পেইন্টিং। উজান পেইন্টিংগুলো হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখছে। এই ছবিটার সামনে আসলে গোলাপের ঘ্রাণ আসে।

তখন ঠকঠক আওয়াজে কড়া নেড়ে উঠে। উজানের ঘোর কাটে। সে পেইন্টিংগুলো হাত থেকে নামিয়ে টেবিলে রেখে দিলো। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। অল্প করে ফাঁক করল দরজাটা। দেখল বাহিরে মমতাজ দাঁড়িয়ে। এবার সে পুরো দরজা মেলে দিলো।

‘কিছু বলবেন আন্টি?’

মমতাজ কিছু বলবে তার আগেই তার চোখ গেল দেয়ালে থাকা বড় একটি নিখুঁত চিত্রকর্মের দিকে। যেখানে একগুচ্ছ ফুল হাতে বসে ছিল হুরপরীর ন্যায় রূপবতী কন্যা কিরণ! তা দেখে মৃদু হাসি খেলে গেল মমতাজের ঠোঁটের কোণায়। তিনি যা ভেবেছিলেন তাই ঠিক!

.

.

‘কিরণ, এই কিরণ।’

মমতাজ কিরণকে জাগাচ্ছেন। কিরণ মরার মতো ঘুমাচ্ছে। গত রাতে উজানের সাথে নদীর ধার থেকে এসেছিল দেড়টা কী দুটোয়। তাই সেই সময়কার ঘুম এখন উসুল করে নিচ্ছে। কিন্তু মায়ের জ্বালায় সেটা ঠিক মতো হচ্ছে না। কিরণ অনেক বিরক্ত হয়। কম্বল দিয়ে মাথা ঢেকে হুম হুম করে। মমতাজ শেষে না পেরে এক ঝটকায় কম্বল সরিয়ে দেন। তারপর কিরণের বাহু ধরে ঝাঁকাতে থাকেন। কিরণ উঠে বসে। ঘুম ঘুম চোখে বিরক্তি। এখন মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। এই শীতে এই সময়টা এখন ভোর। এই টাইমে কেউ ঘুম থেকে উঠে! বিরক্তিকর শব্দ তুলে বলে,

‘কী হয়েছে তোমার? এমন করো কেন?’

‘আমার একটা কথা রাখতে হবে।’

চোখ ডলে হাই তুলে কিরণ, ‘কোনটা না রাখছি? বলো।’

‘কসম দে।’

‘উফফ, বলো তো। এমন করে বলো যেন কোনোদিন তোমার কথা রাখি নাই? বলছি না রাখব।’

‘তোকে বিয়ে করতে হবে।’

কিরণের ঘুম ছুটে যায়। ঘুমে ফুলে থাকা চোখ মুহুর্তেই বড় বড় হয়ে যায়।

‘মাথা খারাপ নাকি তোমার? সকাল সকাল বিয়ের ভূত তোমার মাথায় চাপলো? সরো তো, ঘুমাবো।’

কিরণ এই বলে কম্বল নিলো মূখ ঢাকার জন্য। মমতাজ তা হতে দিলেন না। ছোঁ মেরে কম্বলটা ফেলে দিলেন।

‘মা!’ বিরক্তির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তার।

‘তুই বিয়ে করবি কিনা বল!’

‘না।’

‘আমাকে কসম দিয়েছিস কিন্তু।’

কিরণ দুহাতে চুল খামছি দিয়ে ধরল। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে সে। মমতাজ কিরণের দুহাত নিজের হাতে রেখে বললেন,

‘উজানকে বিয়ে করবি তুই।’

কিরণের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সে কি ঠিক শুনছে? উজানের মতো ভদ্র মানুষ দেখে হয়তো তিনি কিরণের যোগ্য মনে করছেন। কিন্তু উজান তো কখনোই তাকে বিয়ে করবে না, আর না কিরণ! সে হাত ছাড়িয়ে নিলো মায়ের থেকে। তারপর হেসে বলল,

‘তুমি পাগল হয়ে গেছ মা, পুরো পাগল।’

এই বলে সে উঠে হাই তুলে বাথরুমের দিকে এগোতে লাগল। মমতাজ এসে হাত চেপে ধরলেন কিরণের।

‘হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি। এখন এই পাগল মায়ের কথা তোর শুনতে হবে। তুই উজানকে বিয়ে করবি।’

কিরণ হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, ‘মানুষ আর খুঁজে পেলে না? বিয়ে করতে হবে তাও কিনা ঐ উজানকে? এরচেয়ে ভালো সারাজীবন আবিয়াইত্তা থাকব।’

‘কিরণ!’ মমতাজের কণ্ঠ সিরিয়াস। ‘তুই উজানকেই বিয়ে করবি। আমার এই কথাটা রাখতে পারবি না তুই?’

কিরণ কোমরে দুহাত রেখে বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল, ‘আচ্ছা মা, তোমার মাথায় বিয়ের চিন্তাটা ঢুকিয়েছে কে বলোতো? আর ঐ উজান-ই কেন? উজানের কথা-ই তোমার মাথায় কেন আসলো? উজান আর আমি দুই মেরুর। না সে আমাকে পছন্দ করে আর না আমি। সে কখনোই আমাকে বিয়ে করবে না, এই চিন্তাটা তার স্বপ্নেও আসবে না আমি একশো পার্সেন্ট শিওর।’

তারপর সে বাথরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। তখন মমতাজ জোরে বলে উঠলেন,

‘উজান রাজি।’

কিরণ যেভাবে ধাম করে দরজা আটকে ছিল সেভাবেই খুলল। চোখে বিস্ময়। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

‘তুমি স্বপ্ন দেখেছ নিশ্চয়ই? কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকো। ঠিক হয়ে যাবে।’

মমতাজ কিরণকে টেনে বের করলেন বাথরুম থেকে।

‘সত্যি বলছি আমি। ও তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। তবে তোর মত ছাড়া বিয়ে করবে না।’

কিরণ যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য তার চোখের সামনে দেখল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে থমকানো গলায় বলল,

‘এই কথা উজান কখনোও বলবে না। জীবনেও না।’

তারপর পা ফেলে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। উদ্দেশ্য উজানের সাথে কথা বলা। তার বুক ধড়ফড় করছে। উজানের মতো মানুষ তাকে কেন বিয়ে করবে? এটা হতেই পারে না। কখনোই না। উজান তাকে বস্তি, রাস্তার মেয়ে এত বাজে কথা বলে এখন তাকেই বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছে! দোতলায় গিয়ে উজানের দরজায় কড়া নাড়ে সে। দরজাটা খোলাই। কিরণ এবার অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়ে রুমে। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। দেখল উজান দেয়ালে একটা পেইন্টিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পেইন্টিংটার নিচে লেখা ‘mi amor’

উজান রুমের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। দরজা খোলার শব্দে সে পেছনে ফিরে তাকায়। দেখে কিরণ অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় তার রুমে ঢুকছে। সে সেদিকে ফিরে পকেটে হাত পুড়ে দাঁড়াল।

কিরণ উজানের সামনে এসে দাঁড়াল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘এসব কী শুনছি?’

‘তুমি কী শুনছ আমি কীভাবে জানব?’

এই বলে সে কফিতে চুমুক দেয়। দৃষ্টি তার সদ্য ঘুম থেকে উঠা কিরণের ফোলা চেহারায়।

‘একদম ঢং করবে না আমার সামনে।’ চটে যায় কিরণ, ‘তুমি নাকি আমাকে বিয়ে করবে বলেছ?’

‘এই মিথ্যে কথা কার থেকে শুনেছ?’ উজান ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল।

কিরণ বুকে হাত দিয়ে শান্তির শ্বাস ছাড়ল। তার মা-ই সবসময় আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কিরণের শান্তির শ্বাস আটকে গেল মাঝপথে যখন উজান বলল,

‘বলেছি আমি বিয়ের জন্য রাজি। বিয়ে করব তখন যখন তুমি হ্যাঁ বলবে।’

কিরণ দম আটকে আসা চেহারায় তাকিয়ে থাকে উজানের দিকে। কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘কী যা তা বলছ তুমি?’

উজান জবাব না দিয়ে বারান্দায় চলে গেল। কিরণ তার পিছু পিছু গেল। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘কী বললে তুমি এসব? তুমি আমাকে বিয়ে করবে?’

উজানকে জবাব দিতে না দেখে দিশেহারা হয়ে গেল কিরণ। এটা কীভাবে সম্ভব? উজান কেন তাকে বিয়ে করবে?

‘উত্তর দেও না কেন?’

‘কিরণ। একটা কথা তোমাকে এতবার বলা লাগে কেন? কান পরিষ্কার করে এসে কথা বলো।’

কিরণ এক হাতে চুলে রেখে মাথা ঠাণ্ডা করতে লাগল। সে কয়েকটা গভীর শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

‘মা তোমাকে প্রস্তাবটা দিয়েছে? আমার মা না, আসলে, তোমাকে ভেবেছিল আমার যোগ্য তাই হুট করে বলে বসেছে। তুমি নিশ্চয়ই মাকে মজা করে হ্যাঁ বলেছ তাই না?

‘এই ধরনের বিষয়ে আমি মজা করি না। আর আমাকে কি সত্যি তোমার যোগ্য মনে হয় না কিরণ?’

‘কেন?’ ঢোক গিলল কিরণ, ‘কেন আমাকে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছ?’

‘রাজি না হওয়ায় কারণ আছে?’

‘না থাকার কথা না। তোমার কাছে আমি রাস্তার মেয়ে, বস্তির মেয়ে, থার্ড ক্লাস, লোভী আরো কত কী! সেই মেয়েকেই কেন বিয়ের জন্য রাজি হলে?’

উজান নীরক্ত চোখে তাকায়। ‘আমি তোমাকে সরি বলেছি।’

‘বেশ! কিন্তু আমাকেই কেন? এমন তো না যে আমাদের মাঝে কোনোরকমের প্রণয় সৃষ্টি হয়েছে। কিংবা তোমার মনে বা আমার মনে একে অপরের প্রতি ফিলিংস আসার জন্য এমন কোনো কাজ আমরা কেউই করিনি। তাহলে? তাহলে কীজন্য রাজি হওয়া?’

উজান রুমের ভেতরে সেই পেইন্টিংয়ের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করল। কিরণ উজানকে অন্যদিকে তাকাতে দেখে বলল,

‘আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো উজান।’
উজান তাকালো। কিরণের চোখ বরাবর। কিরণের রাগ হঠাৎ করে নিভে গেল ঐ চোখে তাকিয়ে। উজানকে শাসানোর জন্য কোনো শব্দ তার মুখে আসলো না। উল্টো তার মনে হল উজানকে তার চোখের দিকে তাকাতে বলে ভুল করেছে। ঐ ধারাল দৃষ্টির সামনে সমস্ত রাগ নিমিষেই পানি হয়ে গেল। কিরণ হাঁসফাঁস করতে লাগল ভেতর ভেতর। তার একটু পানি খাওয়া জরুরী।

‘আমার মনে যে ফিলিংস নেই সেই খবর তুমি কীভাবে জানো?’ উজান গভীর চোখে তাকাল।

উজানের কথাটার মানে বুঝতে অনেকক্ষণ লাগল কিরণের। তারপর হতবুদ্ধ হয়ে বলল, ‘তার মানে আমার জন্য তোমার মনে ফিলিংস আছে?’

‘টিউবলাইট কিরণ।’ উজান ঠোঁট টিপে বলল।

‘একদম অপমান করবে না আমায়।’

কিরণ মাথা চেপে ধরল। উজানের প্রতিটি কথা তার অবিশ্বাস্য ঠেকছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল সে। বলল,

‘তুমি তো জানো আমার অতীতে কী হয়েছিল। নাকি সেই দয়া থেকেই রাজি হওয়া?’

‘আমি কাউকে দয়া দেখাই না কিরণ।’ শান্ত স্বরে বলল সে।

‘তোমার ভাই কালকে যা বলেছে তা তো একদম ঠিক বলেছিল। আমাকে যে বিয়ে করবে তার কপাল পুড়বে। আমি তো নষ্ট…’

‘কিরণ!’ উজান আচমকা ধমকে উঠল। সেই ধমকে কিরণ হালকা কেঁপে উঠল। উজানের চোখের দৃষ্টি এমন যেন সে খুব খারাপ একটা কথা বলেছে। উজানের চোখ রাঙা। সেই চোখে চোখ রাখতে পারল না সে। চোখ ফিরিয়ে নিলো কিরণ।

‘এইসব বাজে কথা তোমার মুখে যেন দ্বিতীয়বার না শুনি।’ উজান কঠিন গলায় বলল। তারপর কফিমগটা বারান্দার টেবিলে রেখে, কিরণের নিকট এক পা এগিয়ে আসলো। কিরণের এক হাত দূরত্বে।

ভারী সোয়েটার থাকা সত্ত্বেও কিরণের শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। উজান কিরণের মুখের নিকট ঝুঁকল। রেলিং শক্ত করে চেপে ধরল কিরণ। দাঁত ঠকঠক করে কাঁপছে তার। সে চোখ খুব কষ্টে কুয়াশায় ঢাকা অস্পষ্ট বস্তুর দিকে তাক করে রাখল।

উজান কিরণের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,

‘ভালোবাসা শব্দটা চার অক্ষরের হলেও এর অর্থ সমুদ্রের ন্যায় গভীর। এই গভীর অর্থ প্রকাশের ধরন কিন্তু সবার এক না কিরণ। তাই জাওভান আর আমাকে এক কাতারে ফেলবে না। আমি আমিই।’

উজানের উষ্ণ নিশ্বাস কিরণের কানে পড়ছে। তার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। কিরণ এক পা পেছাল। কয়েকবার ঢোক গিলে শুকনো খটখটে গলাটা ভেজানোর চেষ্টা করল।

উজান তার আগের জায়গায় ফিরে গেল। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কফির মগটা হাতে নিয়ে অবশিষ্ট কফিটুকু মগে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,

‘আমাকে বিয়ে করবে কিরণ?’

কিরণ চমকায়। উজান নিজের মুখে বলেছে!! তাকে প্রস্তাব দিয়েছে বিয়ের!! উজানের প্রশ্নটা কিরণের মনে তোলপাড় সৃষ্টি করে দিলো। সে কখনো উজানের চোখে তার জন্য আলাদা কিছু দেখেনি। তার মনেও তো কিছু নেই। তাহলে সে কীভাবে উজানকে বিয়ে করবে?

‘তুমি তো বলেছিলে আমার মত ছাড়া বিয়ে করবে না তাই না?’

উজান মগ ঘুরানো থামিয়ে কিরণের দিকে তাকায়। কিরণ সেই চোখে চোখ রেখে বলে,

‘আমি যদি তোমাকে বিয়ে করতে না চাই?’

‘কারণ দেখাও।’

‘কারণ হলো… কারণ…’ কিরণ বিভ্রান্ত হলো, সে কী কারণ দেখাবে এখন? উজানকে বিয়ে না করার কারণ তো নেই। তাও সে জোর করে একটা কারণ দেখাল, ‘কারণ আমার মন সায় দিচ্ছে না।’

‘আমি তোমাকে কখনোই মনের বিরুদ্ধে যেতে বলব না কিরণ। তুমি ভাবো। তাও যদি তোমার মন না চায় তাহলে… তাহলে ব্যাপারটা এখানেই ক্লোজ।’

সেই মুহুর্তে কিরণ একপ্রকার পালিয়ে চলে এলো উজানের রুম থেকে। যেন সে কিছু চুরি করেছে। উজানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি সে পাচ্ছিল না। তার বুক কাঁপছিল।

কিরণ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অনেক কথা ভাবতে থাকে। জাওভান আর উজান দুজনেই আলাদা মানুষ। জাওভানের জন্য ভালোবাসা তার মনে তৈরি না হলেও প্রথম প্রথম একটু মায়া জন্মেছিল। তারপর সেটাও কেটে গেল। কিন্তু উজান! উজানের বেলায় তার কখনো কিছুই হয়নি। উজানকে সে নিজের জীবনের সর্বনাশের জন্য দায়ী করে। কিন্তু আদৌ কী তা? উজান তো তাকে আরো বাঁচিয়ে দিয়েছিল সর্বনাশ থেকে। তার পরিবারকে রাস্তায় বসা থেকে বাঁচিয়েছিল। হয়তো সে তার ভাইয়ের জন্যই করেছিল। কিন্তু এখানে তো উজানের স্বার্থ নেই। সব জাওভানের জন্য করেছে সে। উজানের দোষ সে খুঁজে পাচ্ছে না। কিরণকে জাওভানের জীবনে এনেছিল এই একটাই তো ভুল ছিল তার। এসব করেও লাভটা কী হলো উজানের? বরং উজান এতকিছু করে ভাইয়ের থেকে সেই অবজ্ঞাই পেয়ে যাচ্ছে, গালি শুনছে। বলতে গেলে সবদিক দিয়ে উজানের কোনো স্বার্থই ছিল না। সে অবহেলিত।

এখন আবার উজানের মনে নাকি তার জন্য কিছু আছে! এটা কী বিশ্বাস করার যোগ্য? কীভাবে? মানে কীভাবে সম্ভব? উজান সর্বদা এড়িয়ে গেছে কিরণকে। তাহলে তার জন্য…! কিরণের মনে তো উজানের জন্য কোনো ফিলিংস নেই। তবে… তবে অপছন্দ না হওয়ারও তো কোনো কারণ নেই! উজানের ব্যবহার ভালো, নমনীয়, সবদিক দিয়েই সে একশোতে একশো। জাওভানের মতো উচ্ছৃঙ্খল না। উজানকে রিজেক্ট করার মতো আসলে কোনো রিজনই খুঁজে পাচ্ছে না সে। তবে কী উজানকে একটা সুযোগ দিবে?

উজান ফের রুমে এসেছে। দেয়ালে টানানো ছবিটার দিকে তাকাল। কিরণ এটা কী দেখেনি? উজান সেই ঠাণ্ডা কফিতেই চুমুক দিলো। আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই ঠাণ্ডা কফিটাও তার কাছে এখন অমৃত লাগছে! সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বিড়বিড় করল, ‘mi amor’

.
.
চলবে…

#সায়র
#পর্ব_২০ [বোনাস]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

উজানের ফোনে হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। উজান তখন ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিল। ফোনের ওপাশ থেকে কিছু শোনামাত্র সে কাজ বন্ধ করে তড়িঘড়ি করে গাড়ি নিয়ে বের হলো।

কিরণ গার্ডেনে। দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে আর এটা সেটা ভেবে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সে মায়ের মুখোমুখি হয়নি। মাকে কী বলবে সেই আশায়। কিরণের ইচ্ছা নেই আপাতত বিয়ের পিঁড়িতে বসার। সে ব্যবসাটাও এখনো ঠিকমতো দাঁড় করাতে পারল না।

না চাইতেও বিভিন্ন আজগুবি চিন্তাভাবনা কিরণের মাথায় এসে চেপে বসেছে। সে যতই মনটাকে অন্যদিকে ঘুরাতে চাচ্ছে তার মন ততই ঘুরেফিরে সেই আজব চিন্তাতেই মশগুল হচ্ছে। এই যেমন সে ভাবছে, উজানের সাথে বিয়ে হলে, সে উজানের সাথে এই বাড়িতেই উজানের রুমে থাকবে, ঘুম থেকে উঠে উজানের ঘুমন্ত মুখ দেখবে, উজান যখন চশমা চোখে এঁটে আর্ট নিয়ে বসবে কিরণ গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকবে, আবার দুজনে রান্নাঘরে একই সাথে দুই রকম খাবার বানাবে। এই ধরনের চিন্তা থেকে কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছে না কিরণ। সে জানে না কেন এসব চিন্তা মাথায় ভর করছে। আর সবচাইতে বেশি যেই ব্যাপারটা ক্ষণে ক্ষণে উদয় হচ্ছে তা হলো উজান কি রোমান্টিক? দেখে তো মনেই হয় না, মনে হয় রসকষহীন মানুষ।

কিরণ চুল শক্ত করে চেপে ধরল। উফফ! এইসব আজেবাজে চিন্তা কেন তার মাথায় আসছে? লজ্জায় তার কান লাল হয়ে গেছে। কিরণ কান চেপে ধরে। মনটাকে কোথায় ঘুরাবে? সে এবার বাগানের গাছগুলো গুণতে লাগল। একটা দুইটা তিনটা, আচ্ছা, উজান কি প্রতিরাতে নদীর কাছে একসাথে হাত ধরে হাঁটার পারমিশন দিবে? উহ!

কিরণ দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। না আর পারছে না সে। মনটা বারবার উজানের কাছে চলে যাচ্ছে। কিরণ বুকে হাত দিয়ে নিজে নিজে বিড়বিড় করল, ‘আমি কি উজানকে ভালোবাসি? তাহলে কোনো ফিলিংস আসে না কেন?’

তার মন থেকে কেউ একজন বলল, ‘তাহলে তুই ওর কথা ভাবছিস কেন?’

‘ভাবা মানেই কি ভালোবাসা নাকি? এমনিতেই ভাবনা চলে আসে।’

‘কেন চলে আসবে যদি তার প্রতি তোর কোনো টান না থাকে?’

কিরণ বুক থেকে হাত সরাল। মনকে সে আর প্রশ্ন করবে না। এবার বাগান থেকে একটা টকটকে লাল গোলাপ ছিঁড়ে নিলো। সে মোবাইলে দেখেছে, ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভালোবাসে কিনা দেখে। তাই সে এবার একটা করে পাপড়ি ছিঁড়তে লাগল আর আওড়াতে লাগল, ‘আই লাভ হিম, আই লাভ হিম নট… ‘

শেষের পাপড়ি ছেঁড়ার পর উত্তর পজিটিভ। সে তাকে ভালোবাসে। কিরণ বিরক্ত হয়ে আরেকটা ফুল নিয়েও এমন করল। সেই সেম রেজাল্ট। কিরণ হাল ছেড়ে দিল। সবাই তার বিপক্ষে। কেউ তার পক্ষ হয়ে কথা বলছে না। তখন তার মন বলে, ‘তুই ইচ্ছে করেই নিজেকে বিপক্ষে নিচ্ছিস। নিজের জেদটাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমাকেও তোর বিপক্ষ দলে ফেলে দিলি। পাগল মেয়ে।’

কুয়াশা এখনো কাটেনি। কিরণ এদিক সেদিক হাঁটছে। তখন গাড়ির আওয়াজ শোনা যায়। সে বাগান পেরিয়ে উঁকি দিলো। দেখল উজান গাড়ি থেকে নামছে। ভ্রু কুঁচকে কৌতুহল নিয়ে চেয়ে রইল কিরণ। উজান আবার কখন বের হলো? সে তো দেখলোই না। কিরণ আরো অবাক হলো যখন দেখল উজানের সাথে একজন মহিলা ও পুরুষ নেমেছে। উজান আর মহিলাটি লোকটিকে দুদিক থেকে ধরে ঘরের ভেতর নিচ্ছে। কিরণ আরেকটু এগিয়ে গিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল এবার। এনাদেরকে এর আগে জাওভানের ফোনে দেখেছিল। উজান ও জাওভানের মা আর বাবা। এনারা তো নিউইয়র্কে। হঠাৎ এখানে? উজানও তো কিছু বলল না এই ব্যাপারে। আর উজানের বাবার এই অবস্থা কেন? হাতে আর কপালে ব্যান্ডেজ। সে ঘরে ঢুকে গেল পেছনের দরজা দিয়ে।

জাহানা এবং মহিনকে উজান নিচতলার একটা রুমে নিয়ে এসেছে। মহিনকে বেডে বসিয়ে মাকেও ফ্রেশ হতে বলল। সে বেরিয়ে সকলের জন্য খাবার তৈরি করার জন্য রান্নাঘরে গেল। মমতাজ রান্নাঘরেই ছিলেন এতক্ষণ। উজানকে রান্নাঘরে দেখে বললেন,

‘ওনারা কি তোমার বাবা মা উজান?’

‘জি আন্টি।’

‘তোমার বাবার হাতে কী হয়েছে?’

‘সিঁড়ি থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছিল।’

এবার কিরণ এসে রান্নাঘরে যোগ দিলো। মমতাজকে ঘরে পাঠিয়ে নিজে রুটি বানাতে লাগল। এই ফাঁকে উজানকে বলল,

‘তোমার বাবা মা যে আসবে বললে না তো একবারও।’

‘আমি নিজেও জানতাম না যে তারা আসবেন।’

‘মানে? আর আংকেলের হাতে কপালে ব্যান্ডেজ কেন?’

উজান ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তখন ফোন পাওয়া মাত্রই সে হাসপাতালে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে তার বাবা হসপিটালের বেডে, আর মা পাশে বসে কাঁদছেন। তাদেরকে জিজ্ঞেস করে যা জানা গেল তা হলো, জাহানা আর মহিনের এই মাসেই বিডিতে আসার কথা ছিল। তারা এটা জাওভানকে জানিয়েছিল। তারা জানতেন না যে উজান শিফ্ট করে বাংলোতে এসেছে। যখন ফ্লাটে পৌঁছায় তখন জাওভান মাতাল ছিল। জাহানা ছেলের এই অবস্থা দেখে অনেক ক্ষুব্ধ হন। অনেক কথা শোনান জাওভানকে। সাথে উজানকেও দোষ দিতে থাকেন তার ছেলেটাকে একা রেখে চলে গেছে বলে। উজানের কথা উঠতেই জাওভানের মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে উল্টো রাগারাগি করতে থাকে মায়ের সাথে। উজানকে বাজে কথা বলার সাথে সাথে তার মাকেও কথা শোনায়। তা দেখে জাওভানের বাবা মহিন সপাটে চড় মারেন জাওভানের গালে। চড়টা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে। সে ভুলে গেল সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো যে তার বাবা মা। জাওভান তার বাবাকে ধাক্কা মারল সজোরে। তার বাবা উল্টে পড়ে কপাল ফাটালেন। জাহানা চিৎকার করে উঠলেন। জাওভান তার বাবার কলার ধরে টেনে এনে দরজার বাহিরে ফেলল। তাল সামলাতে না পেরে মহিন সিঁড়িতে আছড়ে পড়েন। মাত্র তিনটা সিঁড়ি ছিল। সেই তিনটা থেকেই গড়িয়ে নিচে পড়েন। তারপর সে তার মাকে বের করে দিয়ে দরজা আটকে দিল। তার মা কাঁদতে কাঁদতে ড্রাইভারের সাহায্যে নিকটস্থ হসপিটালে নিয়ে আসেন।

সবকিছু শুনে কিরণ স্তব্ধ বনে গেল। জাওভান এতটা নিষ্ঠুর! নিজের বাবা মাকেও ছাড়েনি! ছিহ! ধিক্কার এমন সন্তানকে।

উজান একটা ট্রেতে রুটি ডিম আর ফ্রেশ জুস নিলো। বাবার জন্য ডিম সেদ্ধ করল আলাদা করে।

জাহানা স্বামীর পাশে বসে আছেন আর নিজের ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছেন। কেমন ছেলেকে পেটে ধরলেন তিনি যে কিনা নিজের বাবা মাকে আহত করে!

উজান নক করে ভেতরে ঢুকল। টি টেবিলে মায়ের খাবার রেখে বাবাকে ধরে বসাল। নিজ হাতে বাবাকে খাইয়ে দিতে লাগল সে। তা দেখে কান্না উপচে পড়ল জাহানার। এই একটা ছেলে যে তাদের যত্ন করে যেখানে নিজের পেটে ধরা ছেলেটা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। জাহানা আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকেন উজানের দিকে। তার বোন মারা যাওয়ার পর উজানকে নিজের ছেলের মতো করে বড় করেছিলেন। জাওভান আসার পর উজানের আদরে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। এমন না যে তিনি উজানকে কম আদর করতেন। দুজনকেই সমান আদর করতেন। তাও, কোনো না কোনোভাবেই তার নিজের ছেলের প্রতিই টানটা বেশি থাকত। তিনি সবসময় উজানের সাফল্য থেকে জাওভানের সাফল্যে বেশি খুশি হতেন। বড় হওয়ার পর জাওভান ভাইয়ের জন্য যখন পাগলপ্রায় হয়ে গেল তখন তার উজানকে বিরক্ত লাগা শুরু করেছিল। উজান সব দিক দিয়েই এগিয়ে ছিল জাওভানের থেকে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি জাওভানকে পাঠিয়ে দিলেন উজানের কাছে। জাওভানের ব্যবহারের চেয়ে উজানের ব্যবহার ছিল মনকাড়া আর আকর্ষণীয়। জাহানা ভেবেছিলেন তার উচ্ছৃঙ্খল ছেলেটা উজানের সংস্পর্শে এসে কিছুটা হলেও বদলাবে। বদলেও ছিল। তারপর কোন একটা মেয়ে আসলো জাওভানের জীবনে, তখন থেকে জাওভান আগের চেয়েও বেশি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। মুখে প্রকাশ না করলেও জাহানা মনে মনে এসবের জন্য উজানকে দোষ দিয়েছেন। কিন্তু উজানের জন্য তার ভালোবাসারও কমতি ছিল না। জাওভানকে যা দিতেন উজানকে আরো বেশি করে দিতেন। উজানের মায়া মায়া চেহারার দিকে তাকালে জাহানা উজানকে কাছে টেনে নিতেন, আর যখন জাওভানের বিশৃঙ্খলাপরায়ণ জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে যেতেন তখন আবার উজানের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাতো।

অথচ এই ছেলেটাই আজ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বুড়ো বাবা মাকে আগলে রেখেছে। জাওভান কখনো নিজ থেকে ফোন দিয়ে তাদের খোঁজ খবর রেখেছে কিনা তার মনে নেই, তাদেরকেই জাওভানকে কল করতে হতো। অন্যদিকে উজান প্রায়শই কল করে তাদের খোঁজ খবর নিতেন। উজান, তার বোনের ছেলেটা আজ তাদের নিজের ছেলের থেকেও বেশি আপন হয়ে উঠল। জাহানার এখন আফসোস হচ্ছে শুধু শুধু উজানকে মনে মনে তিনি খারাপ ভাবতেন। সেই খারাপ ছেলেটাই আজ মহিনকে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে।

‘মা তুমি খাচ্ছো না কেন?’

জাহানাকে মনমরা করতে দেখে উজান বলল। জাহানার ধ্যান ফিরে। তিনি চোখের পানি মুছে খাবারে মনোযোগ দেন। খাবার খেতে খেতেই তিনি স্বগতোক্তি করেন,

‘জুভ এতটা বেয়াদব হবে ভাবতে পারিনি। ও কীভাবে নিজের বাবার গায়ে হাত তুলল?’

বলতে গিয়ে তিনি কেঁদে ফেললেন। উজান এসে তার মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। জাহানা ছেলেকে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন।

কিরণ রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় ভেতরে গিয়ে সাক্ষাত করবে কিনা ভাবছে। এখন তাদের মাঝে ঢুকতে ইচ্ছা হলো না। তাই প্রস্থানের জন্য পা বাড়াল। তখন মহিন কিরণকে দেখে ডেকে উঠলেন,

‘কে তুমি?’

উজান তার মাকে ছেড়ে দরজার দিকে তাকায়। দেখে কিরণের জামার একাংশ দেখা যাচ্ছে। সে কিরণকে বলে,

‘কিরণ ভেতরে আসো।’

কিরণ ধীর পায়ে ভেতরে আসে। সালাম দেয় তাদের। জাহানার মনে হলো এই মেয়েটাকে দেখেছেন কোথাও। তার মনে পড়েছে। জাওভান তাদেরকে দেখিয়েছিল এই মেয়েটাকে। সে নাকি একে ভালোবাসে। এই মেয়েটার জন্যও তো জাওভান তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। উজান তার মায়ের চোখের ভাষা পড়ে ফেলল চকিতেই। মা যাতে কিরণ সম্পর্কে কোনো নেগেটিভ ধারণা না রাখে তাই সে বলল,

‘মা ও কিরণ। জাওভানের এক্স এখন। জাওভান তোমাদের সাথে যেই ব্যবহার করেছে কিরণের সাথে তারচেয়ে দ্বিগুণ বাজে ব্যবহার করেছিল।’

কথাটা অবিশ্বাস করলেন না মহিন ও জাহানা। যেখানে জুভ বাবা মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারে সেখানে কিরণ তো বাহিরের মেয়ে। জাহানা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। এখন আর তার কিরণের প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই। শুধু শুধু ক্ষোভ পুষে লাভ কী?

মহিন বলল, ‘ও এখানে কেন?’

‘কয়েকদিন আগে ও অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। আপাতত কোথাও উঠতে পারছে না। তাই এখানে নিয়ে এসেছি।’

উজান চোখের ইশারায় কিরণকে তার মায়ের পাশে বসতে বলল। কিরণও ভদ্র মেয়ের মতো বসল।

উজান জাহানার হাত ধরে বলল, ‘মা যা হয়েছে ভুলে যাও এখন। জাওভানের মাথা আপাতত ঠিক নেই। যখন নিজের ভুল বুঝবে তখন ঠিকই এসে ক্ষমা চেয়ে নিবে।’

জাহানার মনে হয় না জাওভান এমনটা করবে। জাওভান এমন ছেলেই না।

‘আমি ও’কে কখনো ক্ষমা করব না।’

‘এভাবে বলো না মা। ও তোমার ছেলে। সন্তানেরা ভুল করবেই। তুমি আর বাবা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে ও কার কাছে যাবে বলো! ও ক্ষমা চাইবেই। চাইতেই হবে। তুমি প্লিজ জুভকে ক্ষমা করে দাও মা।’

উজান আরো কিছু বলে মাকে আশ্বস্ত করল। তারপর তাদের বিশ্রাম করতে দিয়ে কিরণকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

.

দুপুরে সবাই খাবার টেবিলে বসল। মমতাজ চলে যাবেন বিকেলে। তিনি এখনো কিরণকে খোচাচ্ছেন উত্তর দেয়ার জন্য। কিরণ উত্তর দেয়নি। সে আরো ভাববে। ভেবে জানাবে।

উজান দ্বিধাবোধকে দূরে ঠেলে সবার সাথে বসল। কিরণ আর উজান মিলমিশ করে খাবার সবার পাতে তুলে দিচ্ছে। এরমধ্যে মমতাজ জাহানার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছেন।

খাবার পর্ব শেষে কলিংবেল বেজে উঠে। উজান গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা বোতল উজানের পায়ের সামনে এসে ভেঙে পড়ে। উজান সাইডে সরে দাঁড়ায়।

জাওভান নিয়ন্ত্রণহীন পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। উষ্কখুষ্ক চুল ছড়িয়ে আছে সারা কপালে। জাওভানকে দেখে সবাই চমকে যায়।

উজান জাওভানকে ভেতরে আসতে দেয়। জাওভান এসে সোফায় ধাম করে বসে পড়ে। জাহানা ভাবেন তার ছেলে ক্ষমা চাইতে এসেছে। কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত হলো যখন সে তার বাবা মাকে দেখে উজানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমি জানতাম। আমি জানতাম মম ড্যাড এখানেই আসবে। তুই এনেছিস তাই না। মম ড্যাডকে এখন আমার থেকে কেড়ে নিতে চাচ্ছিস তাই না?’ জাওভানের কণ্ঠ জড়ানো। সে যে মাতাল তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

উজান হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে ছিল। জাওভানের কথা শুনে বলল,

‘আমি কাউকেই কেড়ে নেইনি। তুই ভুল করেছিস এখন ক্ষমা চাইবি।’

‘ভুল?’ জাওভান বিদ্রুপ করে বলে, ‘আমি, এই জাওভান কখনো ভুল করে না। যা করে একদম ঠিক করে।’

‘জাওভান!’ মহিন ধমকে উঠলেন।

‘এই বুড়া চুপ। একদম চুপ।’ সে ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে মহিনকে চুপ করতে বললেন। জাহানা হতবাক। জাওভানের সাহস কত!

‘জাওভান, দিন দিন অসভ্য হচ্ছিস তুই।’ উজান বলে উঠে।

‘আমি সভ্য নাকি অসভ্য তা নিয়ে তোর মাথা না ঘামালেও চলবে।’

মহিন বসে ছিলেন চেয়ারে। জাওভান মহিনের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে আফসোসের ভান করে বলল, ‘আহারে। ঐ বুড়াটার কী অবস্থা হয়েছে। আমার তো ইচ্ছা ছিল একদম বসিয়ে দিবো।’

উজান কঠোর গলায় বলল, ‘লিমিট ক্রস করবি না।’

‘হুর! ছাড়তো। আজাইরা। তুই বলার কে? আমি আমার বাপ মাকে যা ইচ্ছা তা বলব। তোর সমস্যা?’

জাহানা এসে জাওভানের গালে চড় বসালেন। জাওভান হুট করে তার মাকে ধাক্কা দিলো। উজান পাশেই ছিল বলে সে মাকে ধরে ফেলল। সে কিছু বলবে তার আগে মহিন চেঁচিয়ে বললেন,

‘বেয়াদবির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি? বস্তি থেকে উঠে আসা ছেলে মেয়েরাও বাপ মায়ের কদর করতে জানে। তুমি তো তাদের চেয়ে আরো নিকৃষ্ট।’

জাওভান পাত্তাই দিলো না। সে বুজে আসা চোখে চারপাশটা দেখল। কিরণকে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চোখ বড় হয়ে যায়। এক ভ্রু উঁচু করে জিভ টেনে টেনে জড়িয়ে আসা গলায় উজানকে বলে,

‘আমি নাকি অসভ্য! তুই তো আরো বেশি অসভ্য তাহলে। এই স্লাটটাও দেখি এখনো এখানে। এখানে রেখে কি তার থেকে সার্ভিস নিচ্ছিস নাকি?’

উজানের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। তার রাগ লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং কিরণ সম্পর্কে বাজে কথা তার সহ্য হয় না। সে মাকে ছেড়ে কষিয়ে একটা চড় দেয় জাওভানের গালে। ঘুষির চোটে জাওভান উল্টে পড়ে ফ্লোরের উপর।
সে গালে হাত রেখে চোখ লাল করে বিড়বিড় করে বলল, ‘শুয়ো’রের বাচ্চা।

উজান জাওভানের কলার চেপে ধরে। জাওভানের চোখে চোখ রেখে কঠিন গলায় বলে,

‘বাপ মা তুলে কথা বলবি না জাওভান। তোর মতো কুলাঙ্গার ভাই যাতে কারো না হয়।’

‘ভাই! হাহ! কে ভাই? কার ভাই? তুই আমার ভাই?’ জাওভান তাচ্ছিল্য করে বলে। উজানের হাত থেকে ঝাড়া মেরে নিজের কলার ছাড়ায়। ‘তোকে আমি ভাই বলে মেনেছি কবে? আর কী বললি? বাপ মা! বাপ মায়ের কি বুঝবি তুই? তোর কোনো বাপ মা আছে?’

তারপর পৃথিবীর অকাট্য সত্যিটা জাওভান অবলীলায় বলে উঠল, ‘তুই তো বেজন্মা। মম বলেছে আমায়, তোর মা একশোটা লোকের বিছানায় যেত। তোর জন্মের-ই তো ঠিক নেই। যার জন্মের ঠিক নেই সে আমাকে বাপ মা নিয়ে বোঝায়? কিসের ভাই তুই? তোকে আমার মা দয়া দেখিয়ে আশ্রয় দিয়েছে, নাহলে তোর মতো বেজন্মা তো রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়াত।’

উজান থমকে যায়। রাগের পরিবর্তে একঝাঁক তমসা ঘনিয়ে এসে ঝেঁকে ধরে তাকে। কিরণ সহ বাকি সবাই বিস্ফারিত নয়নে তাকায় জাওভানের দিকে। জাহানা এগিয়ে এসে জাওভানকে আরো চড় দিতে লাগে। একটার পর একটা চড় দিয়েই যাচ্ছেন। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কোন কুক্ষণে যে তিনি জাওভানকে এসব বলতে গেলেন! আগে এসব বলতেন জাওভান যখন উজানের জন্য পাগল হয়ে গেছিল। পরে নিজেই অনুতপ্ত হয়েছিলেন এসব বলার জন্য। কিন্তু জাওভান যে এখনো সেসব মনে রেখে উজানকে এভাবে আঘাত করে বসবে ভাবেননি তিনি।

কিরণ জানত না যে উজান আর জাওভান আপন ভাই নয়। সে কখনো এসব ব্যাপারে আগ্রহই দেখায়নি। কিন্তু এখন জাওভানের মুখ থেকে কী শুনছে সে এসব? উজানের বাবা মা নেই? সে আসলে এই ধরণীতে নিঃস্ব?

উজানের চোখমুখ লাল, চোখ কেমন ঘোলাটে আর ঝাপসা। সে ঠিকমত চোখ খুলে রাখতে পারছে না। তার মাথায় ক্রমাগত হাতুড়ের মতো কিছু একটা আঘাত করেই যাচ্ছে। এই কথাগুলোর কিছু কথা জাওভান আরো একবার বলেছিল। যেদিন তাদের মধ্যে প্রথম ঝগড়া হয় ফ্লাটে। তখন উজানের ততটা গায়ে লাগেনি যতটা আজ লেগেছে। আজ জাওভান আরো বেশি বলেছে তাকে। উজান ঢোক গিলল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। এতটা একা, নিঃসঙ্গ, কখনো মনে হয়নি তার। যেই জাওভানকে এতদিন আপন ভেবে এসেছিল সে যে কথার পিঠে এভাবে আঘাত করবে উজান ভাবেনি। কয়েকটা বাক্য একদম ধারালো তীরের মতো এফোঁড় ওফোঁড় করে উজানের বুক চিরে বেরিয়ে গেল। উজানের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে অনেক। সে টের পেল তার চোখে জল এসে ভীড় জমাতে শুরু করেছে। উজান চেষ্টা করল চোখে জল জমতে না দেওয়ার। কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। নিজেকে সামলাতে পারল না। এক ফোঁটা জল সঙ্গে সঙ্গে চশমার কাঁচে টুপ করে পড়ল। আজ নিজেকে কঠিন আবরণে ঢাকতে পারল না সে। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল জাওভানের কথায়।

কিরণ উজানকে দেখে আতঙ্কিত হলো। সে কখনো উজানকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখেনি। এই কঠিন মানুষটা যে হুট করে দুর্বল হয়ে পড়বে সে কখনো কল্পনাও করেনি। উজানের কষ্ট দেখে তার কষ্ট হচ্ছে। উজানকে মলিন মুখে মানায় না, তার তো মানায় গম্ভীর মুখে। কিরণ এসে উজানের পাশে দাঁড়াল। উজানের চোখের দিকে তাকাতেই কিরণ ধাক্কা খায়। উজানের চোখে জল! ঠিক কতটা কষ্ট পেলে এই কঠিন পাথরের ন্যায় মানবটা কেঁদে ফেলে!

কিরণ নিজের অজান্তেই উজানের হাত চেপে ধরল। উজান ম্লান চোখে তাকাল। কিরণের কান্না পাচ্ছে ভীষণ। উজানের চোখের দৃষ্টি কেমন শূন্য।

কিরণকে উজানের হাত চেপে ধরতে দেখে জাওভানের অগ্নিশর্মা চোখে তাকাল। মাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। মমতাজ এসে জাহানাকে ধরলেন। জাওভান দাঁত কটমট করে বলল,

‘পাবলিক প্লেসেই নষ্টামি শুরু হয়ে গেছে। আর কত নষ্টামি করবি? লজ্জা লাগে না তোর কিরণ? এই মুখ নিয়ে বেরোস কীভাবে? লুচ্চামি করস যেখানে সেখানে। এখন তো দেখি উজানের সাথে তোর অনেক ভাব। উজান কী তোর নাগর হয় নাকি রে?’

জাওভানের কথার জবাবে কিরণ শক্ত গলায় বলল,

‘হয়নি। তবে হবে।’

তারপর সে উজানের দুহাত ধরল। উজানের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘তুমি বলেছিলে না আমি বিয়েতে রাজি হলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। আমি রাজি। এখন এই মুহুর্তে আমাকে বিয়ে করতে হবে তোমায়।’

এই বলে সে উজানের হাত ধরে টেনে নিতে লাগল। হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় জাওভান তেড়ে আসে, কিরণের গলা চেপে ধরে বলে,

‘দুশ্চরিত্রা ,আমাকে ‌দিয়ে হচ্ছে না দেখে আরেক বেজন্মাকে দিয়ে নিজের চাহিদা মেটাতে চাস? আমাকে রেখে আরেক বেজন্মা কে বিয়ে করবি? এতই শখ তোর? বিয়ের সাধ মেটাচ্ছি তোর আমি। বলেছিলাম না, আমি না পেলে তোকে কাউকেই পেতে দেব না। আজ তোকে মেরেই ফেলব।’

কিরণের চোখ উল্টিয়ে আসে জাওভান এত শক্ত করে ধরায়। জাওভানের নখ বসে যায় কিরণের গলায়। সেই মুহুর্তে উজানের ভয়ংকর রূপ প্রকাশ পায়। সে জাওভানকে এত জোরে টান দিল যে জাওভানের সবগুলো শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেল। তারপর নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জাওভানের মুখে গুণে গুণে তিনটা ঘুষি দিল। পেটে লাথি দিল। একটা ঘুষিতেই জাওভানের দাঁত ভেঙে গিয়েছিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু করল। কেউ এসে ধরল না তাকে। ধরার প্রয়োজনবোধও মনে করল না।

উজানের এই রূপের সাথে কেউ কখনো পরিচিত ছিলনা বিধায় তারা অনেকটাই বিস্মিত হয়। কিরণ ভয় পেয়ে যায় কিছুটা। শান্ত মানুষ রাগলে কতটা ভয়ানক দেখায় তা উজানকে না দেখলে বোঝা যাবে না।

উজান কিরণের হাত চেপে ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। মমতাজ আর জাহানাও আসলেন সাথে। উজান গাড়ি নিয়ে সোজা কাজী অফিস চলে গেল। সেই মুহুর্তেই তার আর কিরণের বিয়ে হয়। একদম সাদামাটাভাবে।

.
.
চলবে…