#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
১২.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
পুরোনো সব সম্পর্কের মেলবন্ধন ছিলো নিশাদের এই রিসিপশন। আত্মীয় স্বজনে ভরপুর তারা ভিলা। যারা এত বছর শাহাদকে কাছে পায়নি তারাও এসেছে এক নজর দেখা করতে।শাহাদ-দিয়ার বিয়েটা ঝাঁকজমক করে হয়নি শাহাদের ইচ্ছাতেই।এখনো শাহাদের পাশে বড্ড বেমানান দিয়া। দেখলে মনে হয় রাজ যোটক অথচ গভীর চিন্তার ফল হচ্ছে দুজনের বয়সের ফারাক। দীর্ঘদেহী শাহাদের পাশে শুকনা দেহী দিয়াকে আদর বাচ্চা লাগে। কোলে থাকে তার ন’ মাসের বাচ্চা। কাজিনরা চেয়েছিলো বাড়ির উঠোনে স্টেজে খাবারের আয়োজনের পরে ছোট্ট করে একটু গান নাচ হবে।সবাই মিলে আনন্দে আত্নহারা হবে। মা বাবারা আনন্দ করবে। তাই এক কোণায় সুন্দর স্টেজ সাজানো হয়েছে। ঘড়িতে তিনটা। আজ একবারো অপ্রিয় বউটার সাথে দেখা হয়নি। সামনেই আসেনি।শাহাদ ও ব্যস্ত ছিলো অতিথি আপ্যায়নে। কাল রাতের পর মেয়েটা একেবারে চুপসে গিয়েছে। হয়তো অপমানটা নিতে পারেনি। বারান্দায় ইজিচেয়ারে রাত কাটিয়ে দিয়েছে। এই রুমটা শাহাদের দাদা-দাদীর ছিলো। আসবাবগুলো শাহাদের খুব পছন্দের। তাই নিজের জন্য এই কামরাই বেছে রেখেছিলো। ওই মুহুর্তে নিজেকে সামলে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ ছিলো।
সকলে স্টেজের সামনে বসেছে। শাহাদের এক চাচা এগিয়ে এসে বললেন,
– অনেক বছর পর দেখছি বাবা, তোমরা তো মাঝে মইধ্যে ঘুইরা যাইতে পারো।
পরনে ধপধপে সাদা ফরমাল শার্ট, অফ হোয়াইট প্যান্ট,কালো বেল্ট,কালো শুজ। গরমে অস্থির হয়ে গায়ের কোট খুলে ফেলেছে। হাতা ফোল্ড করে কনুই অবধি উঠানো। আগের মত বাইসেপস নেই। ইচ্ছে করেই বাইসেপস এক্সারসাইজ কম করে। কি দরকার কারো আকর্ষণ হওয়ার। তবে পেটের দিকটা খেয়াল রেখেছে। পেশি গুলো কিছুটা ফুলো ফুলো এখনো আছে। টিনেজার প্রেমে পড়ার মত নেই বয়সটা। গেট আপ দেখলে অনেকেই ভাববে বয়স কম। সামনাসামনি গাম্ভীর্যতা দেখলে সহজেই বলে দিবে বিচক্ষন মধ্য বয়স্ক পুরুষ। কয়েকবছরের মধ্যেই চুলে পাক ধরবে। চাচার কথার প্রতিউত্তর করে হেসে বলে,
– চাচা আসবো এখন থেকে। এতবছর তো বাইরেই ছিলাম। সময় করে উঠতে পারিনি।
অন্যরাও এগিয়ে এসে কথা বলছে গ্রাম নিয়ে।শাহাদ স্টেজের সামনে বসার অনুরোধ জানালো সকলকে।অনুষ্ঠান রীতিমতো শুরু হয়েছে। শিফা, নিশি,বিদি নাচছে।
___
সিড়ি দিয়ে নামতেই সজোরে ধাক্কা খেয়ে বসে গেলো। লিমন দাঁত কটমট করে তাকাতেই দেখে তাহি। তাহিকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হালকা আকাশী রঙের শার্টে ছেলেটাকে দারুন মানিয়েছে। তাহি পাশ কাটিয়ে উঠে যেতে চাইলে লিমন মুখ না ঘুরিয়ে বলে,
– স্যরি বলাটাও তো এক ধরনের ভদ্রতা মিস।
– দেখে হাঁটা উচিত ছিলো তোমার। উপর থেকে চোখ বন্ধ করে নামছিলে নাকি?
– সামনে অপরূপা, হুঁশ কি অন্যদিকে যায়?
-আগে শুনেছি,আজ দেখেও নিলাম।অসভ্য।
তাহি উপরে চলে গেলো। লিমন সেদিকে চেয়ে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে নেমে আসলো। কাব্য লিমনকে লজ্জ্বা পেতে দেখে প্রশ্ন করলো,
– আবার কই ঢপ মারছিস?
– ভাই এবারের টা বুঝতে পারছিনা।
– মানে?
– নিজেকে আগে বুঝতে দেয়।পরে জানাচ্ছি।
কাব্য হেসে দিলো। আসলেই ভাইটা একটু পাগলাটে ধরনের। কাল রাতের বড় ভাইজানের ডোজ ভালো করেই কাজে লেগেছে। স্টেজের সামনে মেয়েরা নাচছে দেখতে বেশ লাগছে। নিশাদ ও উঠেছে বউকে নিয়ে। মেরে সাইয়্যা সুপারস্টার গানের সাথে নাচছে নিশাদ।
___
তাহি রুমের দরজা খুলতেই দেখতে পেলো দিয়া রেডি হচ্ছে। একটা লাল গাউন পরে আছে। যে কেউ দেখলে নিশাদের বউকে নতুন বউ না বলে এই ইরানী মেয়েকে বলবে বিয়ের কনে। জরি সুতার কাজ করা গাউন। হাতে গোল্ডের সিম্পল ব্রেস্লেট।কানে, গলায় পার্ল। চুলগুলোতে খোপা করে গন্ধরাজ ফুল লাগিয়েছে। কিছুক্ষন আগে রজতকে বলে বাগান থেকে এই গন্ধরাজ ফুল সংগ্রহ করিয়েছে। দিয়ার এই রূপ এখন অবধি কেউ দেখেনি।শেহজার কান্না থামাতে বের হয়নি রুম থেকে। মেয়েটা ভিড় সহ্য করতে পারেনা। সবাই স্টেজে থাকাতে কেউ এদিকটাতে আসেনি। শাহাদ ফোন দিয়ে দিয়াকে নিয়ে নামতে জানায়। তাহি মুখ খুলে আশ্চর্যজনক অভিব্যক্তি নিয়ে বলে,
– এই রূপ আজ যে দেখবে সেই কুপোকাত। ভাইজান কি করে পারে নিজেকে আটকাতে!
দিয়া লজ্জা পেয়ে বলে,
– আপু তোমরাই বেশি ভাবছো। চলো নিচে যাই।
___
চেয়ারম্যানের সাথে আশপাশে গ্রামের উন্নয়নের কিছু কাজ দেখতে গিয়েছিলো। গ্রামের মেঠোপথ দেখতেই ভালো লাগছে। বাড়ি ফিরতেই পাভেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
– জানো পাভেল, আমি বেইমানদের মাফ করিনা।
– জ্বি স্যার জানি।
– নোমানকে অনেক বেশি বিশ্বাস করতাম। এতটাই বিশ্বাস করতাম যে শেফালী বলার পর কোনো যাচাই-বাছাই না করে বাসার প্রতিটি মানুষকে রাজি করিয়ে বিয়ে দিই ওদের। কিন্তু পিঠ পিছে ছুরিটা আমাকেই মা*রলো ছেলেটা।
শুকনো ঢোক গিললো পাভেল। বসের এই আফসোস সবসময় থেকে যাবে। যখনই একা হয় তখন এই একটা কথাই পাভেলকে বলে।পাভেল আতঙ্কে থাকে কখন আবার কথার মাঝে ক্রোধান্বিত হয়ে উঠে। পাভেল কথার প্রসঙ্গ বদলাতে বললো,
– স্যার আপনি ঘেমে গিয়েছেন? গাড়ি নিয়ে আসলেই পারতাম।
– শুনো এটা এখন আমার শরীরের যত ঢং বুঝলে। এরচেয়ে বেশি কসরত করে আসা পাবলিক আমি।এখন কয়েক বছরে একটু স্বাস্থ্য বেড়েছে তাই ঘামছি। এই তো বাড়ি চলে এসেছে। সানগ্লাসটা সাথে আছে এই ভালো।
মানুষটা এত সোজাসাপটা কথা বলে কিভাবে পাভেল ভেবে পায়না। মুগ্ধ করে তার আচরন। বাড়ির কাছে ঢুকতেই মেয়েকে দেখতে পেলো শাহীনের কোলে। সারাদিনে মেয়েটাকে চোখের দেখাও দেখেনি। শেহজাকে একটা পিংক লেহেঙ্গা পরিয়েছে সুতির। মেয়েটা বাবাকে দেখে বা বা বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। শাহাদ মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে কথা কথা বলছে। স্ট্যান্ড ফ্যানের কাছটাতে চেয়ার নিয়ে বসলো। ঘামে সাদা শার্ট শরীরের সাথে লেপ্টে গিয়েছে। অকস্মাৎ চোখ গেলো অনাকাঙ্ক্ষিত একজনের দিকে। কিছুটা বিব্রত বোধ করে চোখ ফেরালো।চোখে সানগ্লাস থাকাতে সেই ব্যক্তি বুঝতে পারেনি শাহাদের দৃষ্টি তার দিকে। ভুল দেখলো! শাহাদের হারিয়ে যাওয়া সিলভার ব্রেসলেট তার হাতে।আরেকবার তাকানোর সাহস করেনি। অথচ চোখ দুটো জানান দিচ্ছে অন্য রকম কোনো কিছু। ঘটনা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এখনো কুনজর দিয়ে দেখছে শাহাদকে। পাভেলকে ইশারা দিতেই পাভেল হাজির। পাভেলের কানে কিছু একটা বলতেই পাভেলের চোখ তড়াক করে উঠলো।একটু জোরেই বলে উঠলো,
– স্যার আপনি এখন দেখছেন আমি গত ছয়মাস ধরে দেখছি।ভয়ে বলিনি। আমি নিশ্চিত এই ব্যাপারে।
– বুঝিয়ে বলো।
– স্যার আমার মনে হচ্ছে সামনে আপনার জীবনে নতুন ঝড় উঠানোর জন্য দল পাকিয়েছে। একজন বিবাহিত পুরুষের দিকে যেভাবে বিমোহিত হয়ে নজর দিচ্ছে দেখলেই মনে হবে আপনার ইশারা আছে।
– বুঝাতে চাইছো স্ক্যান্ডাল হতে পারে!
– আমি নিশ্চিত।
– খতিয়ে দেখো।
– ওকে স্যার।
শাহাদ স্তব্ধ। এমনটা সে আশাই করেনি। হালকা হেসে বলে,
– দেখলে আরেকটা ভুল।আমি জীবনে এত ভুল কি করে করলাম!
শাহীন চলে আসাতে কথা প্রসঙ্গ বদলায়। পাভেলকে নজর রাখতে হুশিয়ার করে। তাহিকে দেখলো সাথে কাউকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। সুলতানা কবির এগিয়ে গিয়ে ছেলের বউকে নিয়ে আসে।অন্য আত্নীয়রা উঠে দাঁড়ায়। দিয়া গুটি পায়ে এগিয়ে আসে। শাহাদের হাতে শরবতের গ্লাস ছিলো। এক চুমুক দিতেই থমকে গেলো পৃথিবী। শাড়ি,থ্রি পিছ অনেক রূপেই দিয়াকে দেখেছে। এই রূপ তার অচেনা। না একেবারেই অচেনা নয় দিয়াকে প্রথমবার এমনই নজরকাঁড়া রূপে দেখেছিলো আরো বছরখানেক আগে মজুমদার বাড়িতে। তবে আজকের রূপ অনলের মতো ঝলসানো। লালের সাথে একেবারে মিশে গিয়েছে।চুলে সাদা ফুল। বাবার বয়সী কয়েকজন পুরুষের দৃষ্টি সেদিকে। আকস্মিক মেজাজ রুক্ষ হয়ে গেলো। শেহজাকে কোলে নিয়েই এগিয়ে গেলো মায়ের কাছে দিয়ার ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাড়ির দাদী, চাচীরা শাহাদকে দেখে ঘোমটা তোলে।দিয়ার মাথায় ওড়না দিয়ে সকলের সামনে ঘোমটা তুলে দিলো শাহাদ, মায়ের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলো,
– আম্মু আমি একটু ফারাহকে নিয়ে যাচ্ছি। একটু পর পাঠিয়ে দিচ্ছি।
চাচীরা মিটমিট করে হাসছে। শাহাদ হাত ধরে সকলের সামনে থেকে নিয়ে এলো। দিয়ার দিকে কটমটে দৃষ্টি দিয়ে বলে,
– হিজাব কোথায় তোমার!
– আপুরা পরতে দেয় নি।
– যে ভয়াবহ সৌন্দর্য্য থেকে আমি নিজেকে দূরে রেখেছি,এই রূপ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেলো কি করে!
দিয়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কম্পিত গলায় বলে,
– আর হবে না।
– মাথা থেকে যেন ঘোমটা না পড়ে!
– আচ্ছা।
স্টেজের সামনে মনমরা হয়ে বসে আছে শাহাদের পাশে।শাহাদ হয়তো বুঝতে পেরেছিলো দিয়ার মন খারাপের আভাস। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
– এমপি বধূ আপনার ভুবনমোহিনী রুপ কারো মনে উথাল-পাতাল ঝড় তুলেছে। এতটা নজরকাঁড়া লাগা একদমই ঠিক নয়। এক কথায় অ-পরাধ! মারাত্মক- বি/পজ্জ/নক, ভ/য়া/নক অ-পরাধ!
দিয়া মনখারাপের মাঝেও ফিক করে হেসে দিলো। শাহাদ সানগ্লাসের ফাঁকে দিয়ার হাসি দেখে নিজেও ঠোঁট কামড়ে হাসছে। এই হাসি দেখে সব বয়সের মানুষ হতচকিত হবে। এভাবে ঠোঁট কামড়ে কামনা সূচক হাসি তো ছেলে জাতি মেয়ে পটাতে দেয়, মধ্যবয়সী স্বামী বউয়ের জন্য এমন লাজুক লাজুক হাসি দিতে পারে বলে জানা ছিলো না। এই বাড়িতে আসার পর মনে হচ্ছে কেউ শাহাদকে জাদু করেছে।এত মিষ্টি মিষ্টি কথা শাহাদ কি করে বলছে! যে শাহাদ কথাই বলেনা সে গত দুদিন কথার গোল খাইয়ে, হাসি দিয়ে দিয়াকে বেপরোয়া করে তুলেছে। দিয়া শাহাদের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় বলে,
– আপনি এমনভাবেও হাসতে পারেন!
শাহাদের ঠোঁটের কোণে তখনো হাসি লেগে আছে। মাথা নেড়ে দিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলে,
– জাদু করেছো।
পুনরায় দুই ওষ্ঠ দূরত্বে টেনে আলগা হয়ে হা সদৃশ ভাব করে বলে,
– আমি!
– তবে কি অন্য কেউ!
– মানে…??
শাহাদ হালকা হেসে বলে উঠলো,
– তেমন কিছুনা। মন ভালো তাই হাসছি।
দিয়া কথার আদ্যপ্রান্ত না বুঝেই অবুঝের মতো চেয়ে রইলো। শাহাদ পুনরায় বলে,
– আমি রাতে চলে যাব। কাজ পড়ে গিয়েছে। আর কয়েকটা দিন কি থাকতে চাও আম্মুদের সাথে?
দিয়া কিছু একটা ভেবে শাহাদের হাত চেপে বলে,
– এখান থেকে যাওয়ার সময় তো দাদা বাড়ি পড়বে তাই না, আমাকে একবার নিয়ে যাবেন?
শাহাদ কিছুটা অবাক হলো। এত কিছু ছেড়ে হঠাৎ দাদাবাড়ি! তবে গত একবছর আসা হয়নি তাই মাথা নেড়ে বললো,
– ঠিক আছে যাব।বাবা- মায়ের কবর জিয়ারত করে আসা দরকার। এদিকটাতে তো আসা হয়না।
দিয়া মুগ্ধ নেত্রে চেয়ে আছে যে মানুষটা কখনো দেখেই নি শ্বশুর শাশুড়িকে অথচ সে আজ বাবা মা সম্বোধন করলো। বিয়ের পর শাহাদ কখনো মজুমদার বাড়ি যায়নি। আজ যাবে বলেছে অথচ জামাই আদর করার মতো কেউ নেই। দিয়া উঠে গিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে চাচাকে ফোন দিয়ে জানালো রাতে আসবে। মঈন ভাস্তির আসার খবর শুনে মহাখুশি। শাহাদ দূর থেকে দিয়াকে দেখছে। পুনরায় চোখ গেল মানুষটার দিকে। এবার যেন তাকিয়ে আছে দিয়ার দিকে। শাহাদ শুকনো ঢোক গিললো। মনের কোণে নতুন ঝড়ের আভাস। কি চাইছে ওই মানুষটা! এত মানুষের মাঝে তাকে ধরা ও এখন বিপদের আগাম বার্তা। পাভেল কাছে এসে দাঁড়ায় ততক্ষণে,
– স্যার…
– হুম
– নোমানের খোঁজ পেয়েছি।
শাহাদ বিস্ময় নিয়ে বলে,
– কোথায়?
– মৌলভীবাজার।
– প্রসিড।
– ইয়েস স্যার।
_____
গন্ধরাজ লেবু গাছের আশপাশটা সুগন্ধে মৌ মৌ করছে। অনুষ্ঠানের নাচ গান ভালো লাগছেনা। বুকের ভেতর টা হু হু করে উঠছে থেকে থেকে। সামনে তারা ভিলার ব্যক্তিগত চৌবাচ্চা। বিকেলের ছায়া পড়েছে পানিতে। সিড়ি বেয়ে কয়েক সিড়ি নিচে বসলো তাহি। পানিতে নিবদ্ধ নেত্রদ্বয়। অক্ষিকোল ঘেঁষে নেমে পড়লো পানি। অক্ষিজোড়া স্ববেগে বুজে গেলো। মনে হলো পাশে কেউ বসেছে।একা থাকলে রাশেদকে খুঁজে পায় দুজনের মাঝে। কারো উপস্থিতি পেয়ে তাহি আনমনে বলে উঠলো,
– এভাবে ফে*লে গেলে আমাকে,আর তো পারছিনা ভুলে থাকতে। জানো রাশেদ ভাইজান প্রায় বলে জীবন সাজাতে। বকে ধমকে কথা বলা বন্ধ করে দেয় মাঝে মাঝে মানুষটা। আমি বসে আছি তোমাকে আগলে।
কোনো শব্দ আসেনা আশপাশ থেকে।আসবে কি করে,এটাতো তাহির ভ্রম যে পাশে রাশেদ বসে আছে। তাহি পুনরায় বলে,
– আমার মাঝে মাঝে দম আটকে আসে রাশেদ। তোমার ইউনিফর্ম বুকে নিয়ে বসে থাকি। তোমার জিনিস পথে এলোমেলো করে আবার গুছাই। চলেই যদি যাবে এলে কেনো আমার জীবনে,এত ভালো কেনো বাসলে। এক বছরে একটুও বুঝতে দিলে না তুমি না থাকার অশুভ শক্তি আমাকে গ্রাস করে ফেলবে তোমার অনুপস্থিতিতে। সারাক্ষন মেতে থাকতে মজা-দুষ্টুমিতে।
থেমে গেলো তাহি। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে চোখ খুলে মাথা সোজা করে বসে ঘাড় ফেরাতেই দেখতে পেল পাশে বাস্তবিকপক্ষে বসে আছে কেউ। কিছুটা ভয় পেয়ে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে উঠে দাঁড়ায়। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পুরুষালি কন্ঠ বলে উঠে,
– অতীত ততক্ষন সুন্দর যতক্ষন আপনি তাকে মনের মাঝে পুষে বেঁচে থাকার প্রেরণা বানাবেন। দুঃখ বিলাশে অতীত আপনাকে গুমড়ে মা*রবে। ভাইজানের কথা শুনে জীবন সাজিয়ে নিলেই পারেন।হয়তো আপনার অতীত ও আপনার ভালো চেয়েছে।
তাহি ক্ষেপে এসে কলার চেপে ধরে চোখ রাঙিয়ে বলে উঠলো,
– যা বুঝোনা তাই বলবে না। ছোট ছোটর মত থাকো।
– যেভাবে কলার ধরেছেন লোকে ভাববে আপনি আমাকে নিজের কাছে টানছেন।
তাহি কলার ছেড়ে দিলো চমকে গিয়ে। আশপাশে নজর দিয়ে ঢোক গিললো। লিমন মুচকি হেসে বলে উঠলো,
– দেখলেন, আমি অতটাও ছোট নই। ছোট হলে আপনি ভয় পেতেন না।
সামনে হাত বাড়িয়ে দেয় লিমন হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে,
– আমি লিমন, ভাইজানের মেজ চাচার ছেলে। আপনার মত বাবা নেই আমার। আপনার অভিভাবক যেমন বড় ভাইজান আমার ও ঠিক তেমন। ভয় পাবেন না, আমি নিরাপদ আপনার জন্য। ভাইজানের ছত্রছায়ায় মানুষ হয়েছি। একটু দুষ্টু কিন্তু অসভ্য নই। ফ্রেন্ডস হবেন আমার ডাক্তার সাহেবা!
তাহি রেখে গিয়ে বলে উঠলো,
– ক*ষে দুটো চ/ড় দিলে ঠিক হয়ে যাবে। বয়স কত তোমার!
– পঁচিশ।
– আমার আটাশ। ফাইজলামি পেয়েছো। শুনেছি মেয়েদের জ্বালাতন থেকে শুরু করে ফ্লার্ট, ইভিটিজিং কিছুই বাদ যায়না তোমার কর্মের লিস্ট থেকে। এখন এসেছো আমার সাথে ফ্লার্ট করতে। এক চড়ে দাঁত ফেলে দিব। ভাইজানকে বলবোনা আমি নিজেই তোমার জন্য একশ। ফাজিল।
হনহন করে হেটে চলে গেলো তাহি। অবাক হয়ে সামনে চেয়ে রইলো লিমন। আশ্চর্য এত রিয়েক্ট কেনো করলো! হুশ ফিরে এলে নিজে নিজে বললো,
– বাপরে কি এমন বললাম! আমি কথা বললেই কি মেয়েরা ভাবে আমি টিজ করতে আসছি! হায় কপাল।
___
গোধূলির আলোয় ছেয়ে গিয়েছে আকাশ নীলিমা। সন্ধ্যা আসন্ন। অনুষ্ঠান বাড়ির হৈ চৈ কমেছে। নিশাদ এবং তার নব বধূ আগামীকাল যাবে। বাড়ির ছেলেরা ড্রইং রুমে নাস্তা সারছে। শাহাদের দুই চাচা এবং বাবা ফুফুরা আলোচনা করছে কে কখন ফিরবে। শাহাদ এর মাঝেই বলে উঠলো,
– আব্বু আমি একটু পরই বের হবো আপনাদের বৌমাকে নিয়ে।
সুলতানা কবির চমকে উঠে রায়হান সাহেবের দিকে তাকালো।রায়হান সাহেব বুঝালো সে কিছুই জানেনা। শাহাদ কফি শেষ করে মাকে বলে,
– মজুমদার বাড়ি যাব। ফারাহকে একবার নেয়া দরকার। ভাবছি বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করে আসা দরকার,যা এত বছরেও করিনি।
রায়হান সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,
– এটা ঠিক বলেছো,কাজ টা অনুচিত হয়েছে। তা ও বাড়িতে জানিয়েছো তোমরা যাবে! মঈন জানে!
– ফারাহ জানিয়েছে।
– আরো আগে বের হতে রাত হয়ে আসছে তো। বেরিয়ে পড়ো তাহলে।
শাহাদ মাথা বেড়ে উঠে পড়লো নিজের কামরার উদ্দেশ্যে। শাহাদ উঠার পর সুলতানা কবির ফিসফিস করে বললেন,
– ছেলের বুদ্ধি ঠিক জায়গায় এসেছে বুঝলে।
রায়হান সাহেব মুচকি হাসলেন।
হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ চলে যাওয়াতে সিড়িতে শাহাদ আটকে গেলো। পকেট হাতড়ে ফোন বের করার আগেই কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝাঁকুনি অনুভব করে নিজেকে দৃঢ় করে পঞ্চ ইন্দ্রিয় জাগ্রত করলো। তীব্র অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে উঠলো। কি হচ্ছে অনুভব করতে চাইলো। শার্টের উপরের বাটনটা খুলে ফেললো। হাত প্রবেশ করলো শাহাদের উন্মুক্ত বুকে। পুনরায় হাত বের করে শাহাদের পিঠে হাত বুলিয়ে শব্দ করে চুমু খেয়ে নেমে পড়লো। পুরো ঘটনা শাহাদ নিরব থেকে পর্যবেক্ষন করলো। মিনিট পাচেক অতিক্রম হলো।শাহাদ ঠায় দাঁড়িয়ে আগের জায়গায়। আচমকা বিদ্যুৎ চলে এলো। এখনো দুই পা দুই সিড়িতে অবস্থান করছে। পুরো ঘর পুনরায় আলোকিত। মস্তিষ্ক সচল হতেই মাথায় খেলে যাচ্ছে অসংখ্য প্রশ্ন। নিচ থেকে মঞ্জিলা জোরে বললো,
– কিরে বাবা তুই এখনো সিড়িতে।
নিচে সবাই একসাথে হয়ে গেলো আচমকা। বিদ্যুৎ যাওয়া আসার মাঝে প্রায় পনেরো মিনিটের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে।শাহাদ আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাতে সকলে অপ্রতিভ। তড়াক করে উঠলো শাহাদের মস্তিষ্ক। সকলের সামনে শার্টের সবকটা বাটন খুলে ফেলে শরীর উন্মুক্ত করে ফেললো। উপরের রুম থেকে দিয়া, তাহি,মনিকা,শেফালী বেরিয়ে সিড়ির গোড়ায় এলো।
নিচে বাকিরা উপস্তিত। শার্ট খুলে আড়াল করে ফেললো কিছু একটা। উপরে পা বাড়িয়ে বললো,
– ফুফি মনে হলো পিঠে খারাপ কিছু লেগেছে। জ্বলছে, চুলকাচ্ছে। গোসল করে আসি। অন্ধকারে হয়তো খারাপ কিছু কামড় দিয়েছে।
সুলতানা কবির হুড়মুড় করে উপরে উঠতে আসলে বাঁধা দেয় শাহাদ।
– আম্মু,ঠিক আছি। গোসল সেরে আসছি। এমনিতে সারাদিন গরমে ঘেমে গিয়েছি।
উপরে উঠে দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
– ফারাহ,রুমে আসো।
দিয়া মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলো পিছু পিছু। শাহাদ রুমে ঢুকেই ট্রলি বের করে ঘর্মাক্ত শার্ট ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললো। প্রয়োজনীয় কাপড় বের করে গোসল করার জন্য পুকুরে যাবে ভেবে দিয়াকে বললো,
– আমার সাথে আসো। আমি একা যাওয়ার সাহস পাচ্ছিনা ফারাহ।
দিয়া শাহাদের কাজে হতবাক হয়েও তাকিয়ে আছে। মাথা নেড়ে বললো,
– আমার হাতে দিন আপনার কাপড়।
উন্মুক্ত শরীরে পরনের প্যান্ট পরে গায়ে টাওয়াল পেঁচিয়ে দিয়াকে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। নিচে সকলে উপস্থিত। রায়হান সাহেব প্রশ্ন করলো,
– কোথায় যাও তোমরা এই অবস্থায়?
শাহাদ অস্বস্তি নিয়ে বলে,
– আব্বু পুকুরে যাচ্ছি। আমি গোসল করবো। আমার অস্বস্তি লাগছে।
রায়হান সাহেব মাথা ঝাকাতেই দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেলো শাহাদ। দিয়া পেছন পেছন ছুটলো।সুলতানা কবির অশ্রুসিক্ত চোখে সকলের সামনেই বললো,
– কি হাসিখুশি ছিলো ছেলেটা আমার। কি হলো কিছুক্ষনের মধ্যে। কিসের নজর লাগলো আমার বাবুর উপর!
আকস্মিক শাহাদের এমন পরিবর্তন পুরো পরিবারকে ভাবাচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটেছে নিশ্চিত। যা কখনো হয়নি। শাহাদ আজ প্রকৃতপক্ষে ভীষণ বিচলিত,বিব্রত। এত স্পষ্ট একটা ব্যাপার এত কাছ থেকে ঘটে আসছে অথচ সে বুঝতেই পারলোনা। পাভেল ও ঘটনা নিশ্চিত করেছে। যা ঘটে ভালোর জন্য ঘটে, আল্লাহ আগে থেকেই সাবধান করে দিয়েছে আজকের ঘটনা ঘটিয়ে।
পাভেল মেসেজ করে জানানোর পর নিজেই স্তব্ধ। মনে মনে বললো,
– স্যারের মত একজন আজকের ঘটনায় এতটা বিচলিত হলে অন্য কেউ তো কিছুই না। আপন মানুষরা এভাবে আঘাত করতে পারে। যাকে এত স্নেহে মানুষ করেছে আজ সেই এভাবে আঘাত করলো।
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
১৩.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ কানে লাগছে। পুকুরের এক কোণায় সিড়ির উপর বসে আছে দিয়া। হাতে এবং কাঁধে শাহাদের কাপড়। এই প্রথম খোলামেলা ভাবে শাহাদকে গোসল করতে দেখলো। অনবরত ডুব দিয়ে যাচ্ছে। ঘষে ঘষে গায়ে সাবান লাগাচ্ছে। আশ্চর্য লোকতো! পোকার কামড়ে এভাবে সাবান ঘষলে তো শরীর জ্বলবে। ক্যামিকেল এরও তো একটা এফেক্ট হতে পারে। পাক্কা বিশ মিনিট হতে চললো এখনো পুকুর থেকে উঠার নাম নেই। এবার তো ঠান্ডা লেগে যাবে। দিয়া কণ্ঠের জোর বাড়িয়ে ডাক দিলো,
– শেহজার বাবা,উঠে আসুন। ঠান্ডা লেগে যাবে তো?
অকস্মাৎ খেয়াল করলো পুকুরের চারপাশ সুনসান। কি হলো মানুষটা কোথায় গেলো। দিয়ার বুকটা ধক করে উঠলো। আরো দুবার গলা ছেড়ে ডাকলো,
– শেহজার বাবা… কোথায় আপনি!
এবারো নিশ্চুপ। তৃতীয়বারের মত হাঁক ছাড়লো দিয়া,
– আমার ভয় করছে এমপি সাহেব। উঠে আসুন।
ছপাৎ করে উঠলো পুকুরের পানি। কেঁপে উঠলো পুকুরের চারপাশ। মনে হলো কেউ তান্ডব চালাচ্ছে পানিতে৷ জলধারার প্রতিধ্বনিতে চারপাশ আন্দোলিত। ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে চারদিকে।দিয়া লাফিয়ে দু সিড়ি উপরে উঠে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
– ইয়া আল্লাহ! পানিতে কে! শেহজার বাবা কোথায় আপনি?
পানিতে তোলপাড় করা ঢেউ, এলোমেলো তরঙ্গ সৃষ্টি করে পুকুরের ঠিক মাঝখান থেকে সাঁতরে আসছে কেউ। কাছে আসতেই লেবু গাছের পাশে হলদে বাতির আলোতে স্পষ্ট শাহাদের মুখ। সোজা সিড়ি বেয়ে দিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। চুল বেয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে মুখে। সেট করা চুলগুলো এলোমেলো অবস্থায় কখনো দেখা হয়নি। স্নিগ্ধ লাগছে গোসলের পর। শ্যাম বর্ণের মানুষটার মুখ জলজল করছে সিক্ততায়। পেটানো দেহের ভাঁজে ভাঁজে পানি। হাতে টাওয়াল নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলে উঠলো,
– শাহাদ ইমরোজ সমুদ্র শাসন করে এসেছে জীবনের পনেরোটা বছর। তাকে নিয়ে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। ডুব দিয়েছিলাম তাই প্রতি উত্তর করিনি।
গত রাতের ব্যবহারের পর দিয়ার ভেতরটা অনেকভাবে পুড়েছে।নিজেকে প্রতিনিয়ত মানুষটার কাছাকাছি কল্পনা করে। আজ দুপুর থেকে দিয়ার মন ফুরফুরে। সন্ধ্যার ঘটনায় প্রচন্ড মন খারাপ করে দিয়েছে। এখন শাহাদের ডুব দেয়ার ঘটনায় হৃদ স্পন্দন বেড়ে গিয়েছে।দিয়া তখনো শুকনো ঢোক গিলছে। কম্পিত গলায় বলে উঠলো,
– আমি একা ছিলাম,আপনার তখনকার অস্বস্তিকর পরিস্থিতি দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
– পোশাক কি এখানে পরিবর্তন করবো? লজ্জা পাবে না তো আবার!
দিয়ার দু গালে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। তা ঢাকতে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এমনভাবে বলছেন যেন আমি আপনাকে জীবনে প্রথম দেখছি!
কথা শেষ করেই জিহবায় কামড় দিলো। ইশ! কি বলে ফেললো। সাহস বেড়ে গিয়েছে। এখন যদি রেগে গিয়ে ধমকে একাকার করে… দিয়া মাথা নত করে নিজেকে মনে মনে শাসন করেই চলেছে। শাহাদের মনে হলো ওর প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। বড়ই অদ্ভুত! কি হলো ওর। সহজে হাসি না আসা মানবের আজ ছোট্ট কারণেও হাসি আসছে।তবুও নিজেকে সামলে বললো,
– তাই নাকি, আগেও দেখেছিলে! কখন বলোতো! কি অবস্থায় দেখেছিলে?
দিয়া লজ্জা পেয়ে দু অধর আলগা করে ফেললো।অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। এতক্ষন খেয়ালই করেনি কথা বলতে বলতে শাহাদ ইতিমধ্যে পোশাক পালটে ফেলেছে। দিয়া চমকে বলে,
– আপনি তো আমাকে ভুলিয়ে বদলেই ফেললেন।
– ওহ হো ভুল হয়েছে! না বদলালে ভালো হতো বলছো! আচ্ছা ঠিক আছে আবার খুলে তোমার সামনে বদলাচ্ছি।
– এ্যাই একদম না…
দু হাতে মুখ ঢেকে ফেললো দিয়া। শাহাদ হাসি লুকিয়ে পুকুরে নেমে প্যান্ট টা পানিতে চুবিয়ে নিলো। জোরে শ্বাস নিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিশব্দে হাসলো। শাহাদের এই হাসি যদি আজ দিয়া দেখতো আজো প্রেমে পড়ে যেত প্রথম রাতের মত। পুনরায় মুখ গম্ভীর করে উপরে উঠে আসলো ভেজা প্যান্ট নিয়ে। শাহাদের পোশাক কেউ ধুবে এটা তার পছন্দ নয়। শিফা আর সুলতানা কবির ছাড়া কারো অনুমতি নেই। বিয়ের প্রথম দিকে দিয়া সেই অনুমতি পেলেও এখন নেই। শাহাদ প্যান্টের পানি ঝেড়ে বলে,
– ফারাহ… কিছু একটা হলেই যে ঠোঁট দুটো আলগা করে ‘হা’ হয়ে যাও এই জিনিস টা দেখতে বেশ লাগে।
– এ্যাহ!!
দিয়াকে তোয়াক্কা না করেই শাহাদ হাঁটা ধরলো বাড়ির পথে। দিয়াকে বিব্রত করতে পেরে মজা পেয়েছে।মেয়েটা বেশ অপ্রস্তুত থাকে। এখনো বিবেচনাবোধ আসেনি।তাই তো বড় ভুলটা করে ফেলেছিলো। পুরোনো কথা ছেড়ে বর্তমানে মনোযোগ দিয়ে বলে,
– আমার পেছনে কখনো হাঁটবে না,সামনে হাঁটো। তোমার অবস্থান সবসময় প্রথম সারিতে।
দিয়া চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো সামনে হাঁটছে। সাধারণ কথার মধ্যেও কত অসাধারণ অর্থ লুকায়িত।শাহাদ দিয়াকে সামনে এগিয়ে যেতে বলেছে।এরচেয়ে সুন্দর বোধহয় কিছু হয়না। অকস্মাৎ শাহাদ ঘাড় ঘুরিয়ে দোতলার বারান্দায় তাকালো।অনাকাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখে নিজেকে সংযত করে ঘৃণায় এক দলা থুতু ফেললো এক পাশে। দিয়া সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছে। শাহাদ পেছনে পরিকল্পনা কষছে। ফোনে মেসেজ পাঠানো শেষ। পাভেলকে গাড়ি বের করার নির্দেষ দিলো।
…
গায়ে সাদা স্লিভলেস টিশার্ট, পরনে কালো ট্রাউজার। গলায় তোয়ালে ঝুলছে। সুলতানা কবিরের কাঁদো কাঁদো চেহারা দেখে বললো,
– আম্মু আমি ঠিক আছি, সারাদিনের ব্যস্ততায় হঠাৎ শরীর নেতিয়ে পড়েছে। চিন্তা করবেন না। বেরিয়ে পড়ি দেরি হয়ে যাচ্ছে।
– আজ না গেলে হয়না!
– অসম্ভব! আমার অনেক কাজ আম্মু।গতকাল মিটিং পোস্টপন্ড করে এসেছি।
রায়হান সাহেব সুলতানা কবিরকে বারণ করলেন ইশারাতে। উপর থেকে তাহি, মনিকা নেমে এলো। তাহি বলে উঠলো,
– ভাইজান আমাদের দুজনকে কি নিয়ে যাবেন! আমার একটা মেজর অপারেশন আছে আগামীকাল। পোস্ট অফিসের মোড়ে নামিয়ে দিলে হবে আমাকে। সি এন জি নিয়ে চলে যাব।
– আর মনি!
মনিকা হেসে বললো,
– ভাইজান আমিও চলে যেতে পারবো।
শাহাদ লিমনকে হাঁক ছেড়ে ডাক দিলো। লিমনের এলোমেলো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা দেখে শাহাদ চোখ ছোট করে অসন্তোষ ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– তুমি কি সর্বদাই এমন আচরন করো!
– স্যরি ভাইজান। কাপড় পাল্টাচ্ছিলাম।
তাহি মুখ চেপে হাসছে। দিয়া হাসি আটকে দুহাতে মুখ চেপে ধরলো। শাহাদ ধমকে বললো,
– শুধু যে দু পায়ে দু রকম জুতো পরেছো তাই নয় ট্রাউজার উলটো পরেছো,জিপার পর্যন্ত আটকাও নি। কমনসেন্স নেই তোমার! বাড়িতে কতগুলো ছোট বড় মেয়ে আছে। অসভ্য।
– ভাইজান ভেতরে আন্ডারওয়্যার আছে তো!
শাহীন খুব জোরে লিমনের মাথায় গাট্টা মেরে শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ভাইজান ছোট মানুষ মাফ করে দেন।
শাহাদ তেঁতে উঠে প্রবল বিরক্তি গর্জে উঠলো,
– ওর আচরণে পরিবর্তন আনতে বলো,কোনদিন তুলে আছাড় মা*রবো বুঝতে ও পারবেনা। বেয়াদপ।
শাহাদ উপরে উঠে যেতেই শাহীনকে বলে,
– ওকে বলে দাও তাহি এবং মনিকাকে পোস্ট অফিস মোড়ে নামিয়ে দিতে। আমি একটু প্রাইভেসি চাচ্ছি।
‘ আমি একটু প্রাইভেসি চাচ্ছি’ এই কথাটি অনেকের কর্ণে বাজলো। শাহীন,লিমন শাহাদের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো। শাহীন পাভেলকে ইশারা দিতেই পাভেল দু চোখের পলক ঝাপটে বুঝিয়ে দিলো গন্ডগোলের পূর্বাভাস। লিমনকে তৈরি হতে পাঠিয়ে দিলো শাহীন।
___
শেফালী রুমের দরজা আটকে চুপিচুপি বারান্দায় এসে কল রিসিভ করলো,
– বলো।
– তোর কি মনে হয়না তোকে সময় বেশি দিচ্ছি? এখনো কাজ সারতে পারলিনা কেনো?
– বললেই হলো, আমি সুযোগ পেলাম কই। আর ভাইজানের আশে পাশে তো ডাইনিটা সারাক্ষন থাকে।
– ব্যবস্থা কর। নাহলে তোর ঢেকে রাখা গোমড় ফাঁস করতে আমার বেশি দিন সময় লাগবে না।
-আপা…
টুট টুট করে ফোনটা কেটে গেলো। শেফালীর মন চাইলো নিজের চুল নিজেই ছিড়তে। যে করেই হোক শাহাদের সাথে আজ দিয়ার ও বাড়ি যাওয়া আটকাতে হবে। রুমের দরজা খুলে টিপে টিপে পা দেখে দিয়া শাহাদ নিচে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য রেডি। ঠিক তখনই শেফালী ইচ্ছাকৃত সিড়ি দিয়ে পড়ে গেলো।আকস্মিক আর্তনাদে কেঁপে উঠলো ‘তারা ভিলা’। শুরু হয়ে গেলো আহাজারি। শেফালীর শোকের মাতমে ছেয়ে গিয়েছে তারা ভিলা। শাহাদ, শাহীন ছুটে এলো বোনের পায়ের কাছে। শিফা পায়ে ম্যাসাজ করতে চাইলে তাহি বাঁধা দেয়। ম্যাসাজে ব্যাথা বাড়বে। মনি এসে বলে, যত দ্রুত সম্ভব ওর তো এক্সরে করা দরকার। তাহিও মাথা নাঁড়ালো। মনি এর মাঝে বলে উঠলো,
– শাহাদ ভাই, শেফালীকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন। তাহি চল। দেরী করলে বিপদ বাড়বে।
পেছনে দিয়ার কোলে শেহজা। রায়হান সাহেব বলে উঠলেন,
– তোমরা যাও শাহাদ। আমরা নিয়ে যাব শেফালীকে।হয়তো হালকা ব্যাথা লাগবে। বেশিদূর পড়েনি।
মনি বলে উঠলো,
– বড় আব্বু এই অবস্থায় কেউ কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। শেফালীকে হাসপাতালে নেয়া জরুরি।
মনির ধমকটা উপস্থিত কয়েকজনের খুব কানে লেগেছে। লিমনের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে। কোনো এক সংযত কারণে লিমনের মুখভঙ্গি পরিবর্তিত হলো। শাহাদ নিজেও কিছুটা হতবিহ্বল। বোনকে ফেলে যাওয়াটা বড্ড বোকামী। উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
– পাভেল গাড়ি বের করেছো? তোমরা ওকে গাড়িতে তোলো।
যে কাজ কখনো এই বংশে হয়নি এমন একটি কাজ হয়ে গেলো আজ। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগে কথা বলাটা বড্ড অন্যায় যেখানে গুরুজনেরা উপস্থিত। যার মুখের উপর কথা বলা মানায় না। অথচ আজ এমনি একটি ঘটনার সাক্ষী হয়েছে এই পরিবার। যেখানে অন্যসময় হলে ঘাম ছুটে যায়, অথচ আজ সেই ছেলে এসে শাহাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– বড় ভাইজান মাফ করবেন। আপনার কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। শেফালী আপার কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ। হয়তো পা মচকে গিয়েছে। আমি, শাহীন ভাই, কাব্য,মনি আপা মিলে হাসপাতালে নিচ্ছি।বড় আব্বুর গাড়ি আছে। আপার পা টা ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ভাবীমার মনে পাওয়া কষ্ট তো থেকে যাবে। এতদিন পর যাবে বলে নিয়ত করেছে না গেলে রূহ কষ্ট পাবে। এক্সিডেন্ট জীবনে কম বেশি হবেই। আমরা আপনাকে আপডেট দিব। আপনি ভাবীমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।
শাহীন ও এগিয়ে এসে বলে,
– জ্বি ভাইজান আপনি যান।
সুলতানা কবির মন খারাপ করে দিয়ার দিকে তাকালো।মেয়েটা আসলে বিষন্ন।মা হয়েও শক্ত হতে হলো আজ। শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
– শেফালী নিজের দোষে পড়েছে বাবু। যাও তোমরা। আপডেট দিব আমরা।
শেফালী চেঁচিয়ে বললো,
– না ভাইজান আপনি যাবেন না,আমার কষ্ট হবে আপনি গেলে। আপনিতো আমাকে আগলে রাখেন।
শাহাদ দো টানায় পড়ে গেলো। নিজেকে স্থির করে কথা বলবে তার আগেই লিমন চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
– মাথা ঠিক আছে তোমার, এতগুলা মানুষ থাকতে ভাইজানকেই কেন লাগবে। নাটক কইরোনা উঠো।
একেবারে কাছে চলে গেলো লিমন।শেফালীর দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি দিতেই শেফালী শুকনো ঢোক গিলে বলে উঠলো,
– আচ্ছা ভাইজান যান। আমি ঠিক হয়ে যাব।
শাহাদ, শাহীন সহ ভ্রু কুচকে ফেললো অনেকে,মিনিট পাচেকের মধ্যে এমন কি হলো…
শাহাদ আর কথা না বাড়িয়ে শেহজাকে কোলে তুলে নিয়ে দিয়ার কাছ থেকে। লিমনের মাথায় হাত রেখে বললো,
– সাবধানে যাবে। আমাকে আপডেট দিও। দায়িত্ব নিয়েছো কিন্তু…
– জ্বি ভাইজান।
লিমন মহানন্দে দু পাশে মাথা দুলালো।মনে মনে কুটিল হাসি দিয়ে বলে,
– মাফ করবেন ভাইজান। এভাবে না হলে আপনাকে আর ভাবীমাকে এরা এক হতে দিবেনা। এত বড় সত্যের মুখোমুখি আজ হব ভাবতেই পারিনি। এবার এই দুই মুখোশধারীকে বুঝাবো লিমন কি জিনিস!
কিছুক্ষন আগে যখন শেফালী শাহাদকে যেতে দেবেনা বলে চেঁচিয়ে উঠলো তখনি লিমন শেফালীর কানের কাছে গিয়ে বলে উঠলো,
– ইচ্ছে করে পড়েছো যে দেখেছি আমি, সাথে তোমার ফোন রেকর্ড ফাঁস করে দেব।
তাই ভীতসন্ত্রস্ত শেফালী ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে আর ঝামেলা বাঁধিয়ে শাহাদকে আটকানোর সাহস করেনি৷ লিমন হেসে বলে,
– একটাকে ও ছাড়বোনা। পিতা সমতুল্য আপন ভাইয়ের সাথে এসব করে যাচ্ছো তোমরা, ছেড়ে দেবো ভেবেছো। তোমরা ঠকাতে পারলেও আমি পারবোনা। মানুষটা আমার কাছে আমার বাবার মতো ছাদ।তোমাদের জন্য নিজের মাথার ছাদ হারাবো নাকি। লজ্জ্বাহীন,বেলেহাজ মহিলা। সাথে আছে আরেক ইবলিস।
___
অহেতুক কারণে বাড়ি মাথায় তুলেছে। মহান রব যা করে ভালোই করে। পায়ে হালকা মোচ লেগেছে এছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। বাড়িসুদ্ধ লোকজনকে নাস্তানাবুদ করে রেখেছিলো। এক্সরে করার পর ডাক্তার বেড রেস্ট দিয়েছে। লিমন হাসপাতালের ফরমালিটিস পূরণ করেই সিড়ি দিয়ে উঠতেই শাহীন ওকে আড়ালে নিয়ে আসে। শাহীনকে এভাবে দেখে ঘাবড়ে যায়। শাহীন রাগান্বিত হয়ে বলে,
– আজকে কি এমন ঘটেছে খুলে বল।
লিমন জোরে শ্বাস ছেড়ে বলে,
– ছোট দা শেফালী আপা ইচ্ছে করে পড়ে গিয়েছে সিড়ি থেকে। ভাইজান আর ভাবীমাকে আটকাতে। এমন একটা সিচুয়েশনে পড়বো চিন্তাও করিনি। ও যখন বারান্দায় ফোনে কথা বলছিলো তখন আমি বাড়ির ছাদ থেকে আম গাছটায় বেয়ে নামছিলাম।শিফা আর নিশি কাঁচা আম খাবে বলেছিলো।বারান্দায় শেফালী আপাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে ভাবলাম ভয় লাগাবো সেই মুহুর্তে ওর ফোনের কথাগুলো শুনি।তুমি অবাক হবে জানলে শেফালী আপা এমন একজনকে সাহায্য করছে যাকে কেউ কখনো কোনো অবস্থাতেই এমন কাজ করতে পারে বলে ভাবতে পারবে না।
– কে?
– দেয়ালের ও কান আছে।
শাহীন মাথা নেড়ে বলে,
– চল। ঢাকা ব্যাক করবো। আব্বু,আম্মুকে বুঝাতে হবে শেফালীর মাথা ঠিক নেই।
– তাই ভালো।
বেরিয়ে গেলো দুইভাই। মনে হাজারো প্রশ্ন।শাহীন এমন অনেক কিছু গত কয়েকদিনে শুনেছে,দেখেছে তবে যাচাই করার সুযোগ হয়নি। ভাইজান একাই সামলে নিতে পারবে তবুও ভাইজানের জন্য একজন সাপোর্ট হিসেবে থাকবে। নোমানের খোঁজ পেয়েছে ভাইজান। কি হয়েছিলো প্রায় তিন বছর আগে যার জন্য ভাইজান আর ভাবীমার সম্পর্কে আজ বিরোধ। সম্পর্কটা স্বাভাবিক হবেনা কিছুতেই তা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছে এই দুদিনে। লিমন ছোট মানুষ ওকে বুঝতে না দিয়েই ব্যাপারটা সামলে নিতে হবে। আগে ইনফরমেশন ওর কাছ থেকে আদায় করে নিতে হবে।
পকেটে দ্রিপ দ্রিপ করে বাজছে মুঠো ফোন। কার্গো প্যান্টের পকেট থেকে বের করে ফোন। নাম দেখেই ঠোঁটের কোণে সেই চির অধরা হাসি,
– জ্বি ম্যাডাম বলুন,বান্দা কিভাবে আপনার উপকার করতে পারে?
– কথা বলবেনা। আজ সারাদিনেও সুযোগ পাওনি?
– সে অনেক কথা,শেফালীর পা মচকে গিয়েছে।ওকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলাম।
– ওমা কি বলো,এখন কেমন আছে?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
হেঁটে হেঁটে কথা বলছে শাহীন। শেফালীর কেবিনের সামনে এসে দেখে ভেতরে শেফালী ছাড়াও অন্য কেউ আছে। বাড়ি থেকে তো শুধু লিমন আর শাহীন এসেছে। বাকিদের আপডেট ও জানানো শেষ তাহলে ভেতরে কে? এখন তো শেফালীর ঘুমানোর কথা। নওরীনকে বলে ফোন রেখেই ধপ করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে শাহীন। দুই নারী হকচকিয়ে গেলো। শাহীন নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
– মনি তুই না বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলি,এখানে কখন এলি?
মনি সাবলীলভাবে উত্তর দিলো,
– ছোট দা আমি তো চলেই যাচ্ছিলাম।পোস্ট অফিস মোড় এসে ভাবলাম শেফালীকে দেখে যাই। তাই এলাম।
– ওহ।
পুনরায় ফোন বেজে উঠাতে শাহীন বেরিয়ে এলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখে শাহাদের কল। রিসিভ করতেই শাহাদ বলে উঠলো,
– শাহীন আমরা ঠিক ভাবে পৌঁছেছি। তুমি সাবধানে থেকো।
– ভাইজান…
শাহীনের গলার স্বর শাহাদকে ভাবিয়ে তুললো।
– কি হয়েছে…সবকিছু ঠিক আছে।
শাহীন কেমন যেন অপ্রস্তুত। কিভাবে কথাটা বলবে ভাইকে। ভাই যদি বিচলিত বোধ করে।অন্যভাবে নেয়। এমন অসম্মানজনক কথা ভাইকে জিজ্ঞেস করতেও বিবেকে বাঁধছে। পাভেল যতটুকু বলেছে শুণেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।
– শাহীন…
– ভাইজান মনি হাসপাতালে এসেছে।
– তো…
– না… মানে… আমি চাচ্ছিলাম মনি থেকে শেফালীকে দূরে রাখতে।
– কেনো?
– দুজনেরই গোপনসন্ধিতে হয়তো আপনার ব্যাপারটা…
– স্টপ দেয়ার… আমি এই ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাচ্ছিনা। শেফালীকে নিয়ে বাড়িতে যাও। খেয়াল রেখো সবার।
শাহীন ঢোক গিলে বলে উঠলো,
– দুঃখিত ভাইজান। আমি বাড়ি গিয়ে আপনাকে জানাবো।
ও পাশ থেকে ফোনের টুট টুট আওয়াজ।শাহীন স্পষ্টত বুঝতে পারছে ভাই রেগে গিয়েছে।নিজের উপর রাগ হচ্ছে।এভাবে প্রশ্ন করা উচিত হয়নি হয়তো বিচলিত হয়ে গিয়েছে। যখনই পাভেলের কাছে শুনেছে মনির কুদৃষ্টি ভাইয়ের উপর পড়েছে।কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। অথচ এই মনিকে ভাইজান আদরে আদরে মানুষ করেছে। মনি আর তাহি দুজনই ফ্রেন্ড। ছোট কাকার মেয়ে মনি। কাকা অন্যদের তুলনায় সামর্থ্যের দিক থেকে কম স্বচ্ছল। তাহি সরকারি মেডিকেলে চান্স পেলেও বড় খালা যখন রাজি হয়না বাপ মরা মেয়েকে পড়াতে তখন শাহাদই নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলো। তা দেখে মনি জেদ ধরেছিলো তাকেও মেডিকেলে পড়াতে হবে। মনি সরকারিতে চান্স পায়নি। শাহাদ ও রায়হান সাহেব দুজনে একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করায়। এরপর থেকে মনি এবং তাহির পড়াশোনার সকল খরচ শাহাদ নিজে বহন করেছে। পুতুলের মত আগলে রেখেছে দুবোনকে। অথচ আজ সেই মনির কুনজর পড়েছে শাহাদের দিকে এই ব্যাপারটা ভাবতেই মনে হচ্ছে কত বড় পাপ! শাহাদ নিজেও এই কথা সহ্য করতে পারেনি বলে শাহীনের ধারণা।
মুঠোফোনের অপর প্রান্তে শাহাদ ভাবছে নিশ্চয়ই পাভেল বলেছে শাহীনকে। খোঁজ খবর নিতে বলেছিলো পাভেলকে। এই খবর তার কাছে থেকে পাওয়া। পাভেল, শাহীন দুটো এক পেট। শাহাদ ও পছন্দ করে ওদের বন্ধুত্ব। তবে ভাই এতটুকু শুণেই ঘাবড়ে গেলো। অথচ গতকাল বোনের মত আদরে যত্নে গড়ে তোলা মেয়েটার অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, অপবিত্র ছোঁয়ার কথা ভাবতেই বুকের ভেতর টা হাহাকার করে উঠলো। মন থেকে বেরিয়ে এলো আফসোস,
– কেনো রে মনি, তুই তো আমার আদরের ছোট্ট পরী ছিলিস। আমার শেহজার মতো। এভাবে কষ্ট দিতে পারলি তোর ভাইজানকে। ভুলটা আমারই ছিলো। তোকে বড় ভাইজান থেকে শাহাদ ভাই ডাকার অনুমতি দেয়াটাই আমার জন্য অস্পৃশ্য ছোঁয়া,অকল্যাণ বয়ে এনেছে। ভাইয়ের রূপ দেখেছিস।এবার বিচারকের রূপ দেখবি। তোর বিচার আমি করবো। মাথা যখন আমার,ব্যাথাও আমার। আমি চিকিৎসা করবো।
চলবে…