সায়রে গর্জন পর্ব-২+৩

0
8

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
২.
(অনুমতি ব্যতিত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বেশ কয়েকদিন থেকে শরীর খারাপের আভাস পাচ্ছে। মাইগ্রেনের পেইন বেড়ে গিয়েছে।মা সমতুল্য অভিভাবক সুলতানা কবিরের আদেশ অগ্রাহ্য করার সাধ্য ছিলো না বলেই হাসপাতালে এলো। ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় ফিরছে তিনজন।মা এবং মেয়ের সাথে শিফা আছে। বড় ভাবীকে শিফার বেশ পছন্দ। মেয়েটা শান্ত শিষ্ট থাকে। বড় আপা যে কেনো ভাবীর পেছনে লেগে থাকে এটাই শিফার মাথায় ঢুকেনা। শিফার কোলে এখন শেহজা। শেহজা শিফার মতে দুনিয়ার সবচেয়ে কিউট বাচ্চা। ফরসা গাল দুটো সারাক্ষন চেরীর মত টসটসা লাল হয়ে থাকে। সিল্কি সিল্কি চুল। একদম পিংকিশ ছোট্ট ঠোঁট দুটিতে কি আদো আদো করে কথা বলে। শিফা ভালো করে দেখে মেয়েটা কার মত হয়েছে। সবাই বলে বড় ভাইজানের মত। শিফা দেখলো গায়ের রঙ, নাক,ঠোঁট অনেকটাই ভাবীর মতো। চেহারার আদল আর হ্যাজেল আই বড় ভাইজানের। শেহজার সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে ওর হাসি। হাসলে মনে হয় যেন পৃথিবীতে দুঃখ বলতে কিছুই নেই।

গাড়ির গ্লাস অনেকক্ষানি খোলা। এসিতে দম বন্ধ হয়ে আসে দিয়ার। চকিতেই চোখ আটকে গেলো একটা পোস্টারে। পোস্টার টা এক নজর ভালো করে দেখতে লাগলো।জ্যামের কারণে গাড়ি থেমেছে। পোস্টারে কি স্বাচ্ছন্দ্যে মানুষটার ছবি আটকানো। মুখে ভুবন ভুলানো হাসি। এক হাত উঁচু করে ছবি তোলা। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। লিখা আছে” ঢাকা-** আসনের এমপি শাহাদ ইমরোজের পক্ষ থেকে সকলকে জানাই পবিত্র ইদুল ফিতরের প্রানঢালা শুভেচ্ছা।” পোস্টারটা সম্ভবত ঈদের সময়ের। মানুষটাকে এত স্নিগ্ধ লাগছে। গাড়িটা হঠাৎ টান দিলো জ্যাম শেষে। পোস্টারটা অনেকটা দূরত্বে চলে গেলো।ঠিক তার জীবনের মতো। মিলিয়ে গেলো দূরে। তার জীবনেও সব সুখ মিলিয়ে গিয়েছে। এই যে পোস্টারে হাসিমুখে দাঁড়ানো মানুষ টা তার স্বামী। বিয়ে হয়েছে আজ দু বছর। দু বছরে বিয়ের প্রথম একটা মাস ভালোই কে-টে-ছি-লো। এরপর জীবনের সব অ/ন্ধ/কা/র নেমে আসে। দু বছরে মানুষটা আর একটি বার ও ফিরে তাকায় নি। কথা বলেনি স্বাভাবিকভাবে। বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে মন ও স্ব-কামরা হতে। গুরুত্ব পায় মেয়েটা আছে বলে।নতুবা কবে আবর্জনার মতো ফেলে দিতো।দু হাত দিয়ে চোখ মুছে নিলো। গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থেমেছে। এই গাড়িটা শ্বশুরের। সচরাচর এই বাড়ির মেয়েরা রিকশা,সি এন জি এবং বাসে চলে অভ্যস্ত। শ্বশুরের কড়া আদেশ স্বাবলম্বী হতে হবে,শিখতে হবে পথচলা। মেয়েরা পরনির্ভরশীল হওয়াটা রায়হান সাহেবের বড্ড অপছন্দের। সেদিন ছোট ননদ শিফাকে দেখলো বাগানের প্রাঙ্গণে সাইকেল চালাতে। মনের অদম্য ইচ্ছে ছিলো সাইকেলটা ছুঁয়ে দেখার। অচিরেই দমিয়ে ফেললো অযাচিত ইচ্ছেটুকু। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। প্রবেশদ্বারে পা রাখতেই দেখা গেলো মুখের উপর ‘দ্য ডেইলি স্টার’ মেলে ধরেছে। বাসায় ফিরে একবার এই পত্রিকাতে নজর বুলিয়ে নেয়া উনার রোজকার রুটিন। আজ এত তাড়াতাড়ি কি করে আসলো! শিফা এবং দিয়া দুজনই সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। শিফার কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে মেয়ের সাথে কথা বলছে। দিয়া কোনো কথা না বলে রুমে এসে দরজা আটকে দেয়। ব্যাগটা এক পাশে রেখে ছুটে যায় ওয়াশরুমে। দরজা আটকে দিয়ে চাপা কান্না ছেড়ে দিলো। কাকে দেখাবে এই আর্তনাদ! কেনো মানুষটা এমন করে! কে আছে এখন তার। চোখের সামনে নিজের মানুষটা থাকে অথচ তাকে যোজন দূরত্ব মেনে চলতে হয়।ক্রন্দনরত ফোলা চোখ মুখে গোসল সেরে বের হলো। আলমারি থেকে সবুজ রঙা তাঁতের জরি পাড়ের একটা শাড়ি বের করে পরলো। শাড়ি পরার অভ্যাসটা এই বাড়িতে হয়েছে। নিজের বাড়িতে যখন ছিলো তখন কারুকার্য শোভিত স্কার্ট ছিলো সঙ্গী। আমিরার হাতের কাজ শোভা পেত সেই সব স্কার্টে।এরপর যখন মজুমদার বাড়িতে আসলো,তখন আনারকলি ছিলো প্রথম পছন্দ। বাড়ির মেয়েরা বৃত্তের মতো গোল, পা অবধি লম্বা আনারকলিতে অভ্যস্ত। দাদা হামিদ মজুমদার তার বাড়িতে কড়া নিয়ম রেখেছিলেন মেয়েদের জন্য। রাজবাড়ীর মতো ছিলো দিয়ার দাদাবাড়ি। অন্দরমহলে প্রবেশ করার কোনো অধিকার ছিলোনা পুরুষদের। দাদা সাহেব আদর করে নাতনীকে ডাকতেন মেহতাব বিবি। দাদা সাহেবের চোখের মনি মেহতাব ছিলেন। দাদী মজা করে বলতেন আমার দোসর। পুরোনো কথা মনে পড়ে যায় মাঝে মাঝে।স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো। এই বাড়িতে শাশুড়ির আদেশ শাড়ি পরাটা বাধ্যতামূলক। শেহজাকে খাওয়াতে হবে তা ভেবে রুমের দরজা খুলে বের হলো। এখনো বাবা মেয়ে ড্রইং রুমে খেলছে। বিষয়টা দেখতে বেশ মনোমুগ্ধকর। বুঝাই যাচ্ছে না এত বয়সী এই খটকটে মানুষটা বাচ্চার সাথে এভাবে খেলতে পারে। মানুষটার বয়স ত্রিশ বা বত্রিশের নারীদের জন্য রাজযোটক হলেও দিয়ার সাথে বড্ড বেমানান। এমপি হিসেবে প্রথম বার দাঁড়িয়েই জিতে গেলো।রায়হান সাহেব সাবেক এমপি ছিলেন। চারদিকে প্রভাব ও ভালো। বাড়িতে যখন বিয়ের প্রস্তাব গেলো তখন চাচা এক কথায় রাজী হলেও চাচী বেশ অসন্তুষ্ট ছিলো। কত ভাবে বিয়েটা ভাঙার চেষ্টা করেছিলো। নিজের মেয়ের সাথে এত স্বনামধন্য পরিবারের ছেলের বিয়েটা দিতে পারলে বোধহয় চাচীর সাধ পূরণ হতো। শেষমেষ শ্বশুর রায়হান মাহমুদ এবং শাশুড়ী সুলতানা কবির কারো কথায় কান না দিয়ে দিয়াকে ঘরের বউ করে আনে। হীরে ছেড়ে কে কয়লায় মুখ দিবে।মানুষ তো রূপের পূজারী। ইরানী মায়ের মেয়ের রূপে এক দেখাতেই ঘায়েল হয়ে যায় সবাই। বিয়ের সময়টাতে মনোহর পুর গ্রামের সরকারি কলেজে বাংলা সাহিত্যে অধ্যয়নরত ছিলো।সাহিত্যে রসটা এসেছিলো বাবাকে দেখে। গত দু বছরে গুটি কতক বার পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলো কলেজে। বাবার সাথে মায়ের পরিচয়টা যথেষ্ট রোমান্টিক। বাবা- মা দুনিয়াতে না থাকলে সব কিছুই ফিকে হয়ে যায়। যেদিন বাবা- মা মা*রা গেল সেদিন মনে হলো, দিয়া কেনো বেঁচে আছে! এই দুনিয়া তো ওর জন্য একটা অপরিচিত জায়গা। কে আগলে রাখবে। সতেরো বছর বয়সে বাবা মাকে হারিয়ে অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলো,তখন বাবা- মায়ের বিয়ে না মেনে নেয়া দাদা সাহেব আগলে নিলেন দিয়াকে। এরপর দাদার আদর্শে বেড়ে উঠছিলো দিয়া। নতুন ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছেন। হামিদ মজুমদার ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও সম্মানিত ব্যাক্তি। বাবা মারা যাওয়ার তিনবছরের মাথায় দাদাকে হারায়। সম্পত্তির বিশাল অংশ দাদা সাহেব দিয়ার নামে করে দিয়েছেন এই খবর কিছুদিন আগে চাচাতো ভাই দিয়েছে। চাচা জোর করে একটা বয়স্ক মানুষের সাথে বিয়ে দিবে বলাতে আরো ভেঙে পড়েছিলো সেই সময়টাতে। দিয়ার জন্য এখানে একা থাকাটা কতটা ভয়াবহ হয়তো চাচা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলো।দেখতে মায়ের মত হুবহু সেই মেয়েকে দিয়ে যেকোনো ছেলে মনস্কামনা পূর্ণ করতে এক পায়ে এগিয়ে থাকবে। উচ্চতায় সাধারণ নারীদের চেয়ে খানিকটা বাড়ন্ত, পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতা নিশ্চয়ই যা তা নয়, কুচকুচে কালো চোখের মনি, ঘন লম্বা পাপড়িতে ঘেরা চোখে যেন জন্মকাজল দেয়া। এই মায়ায় পড়লে যে দিয়ারই সর্বনাশ চাচা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন।নিজের ঘরেও এই অনল রাখতে চাননি তিনি। সবাই কত কি বলে ক্ষেপিয়েছে! কিন্তু তিনি অটল ছিলেন ভালো পাত্রস্থ করার জন্য ভাস্তিকে। চাচাই সঠিক ছিলেন। ভাবনা থেকে বের হয়ে পুনরায় মেয়ের সাথে খেলা করা মেয়ের বাবার দিকে নজর দিলো। একদম পরিপূর্ণ একজন মানুষ। তার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়াটা অন্যায়ের না, তার গাম্ভীর্যের প্রেমে না পড়লে মনে হবে যেন কিছু মিস হয়ে গেলো। তাকে হাসতে দেখা যায় খুব কম। কিন্তু মেয়ের আশেপাশে থাকলেই হাসে।সব মিলিয়ে এই মানুষটা তার। খুব কষ্ট লাগে যখন ভরা মজলিসের মেয়েকে সকলের সাথে পরিচয় করে দেয়। স্ত্রীকে কারো কাছেই পরিচিত করেনা।

সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। এখন ড্রইং রুমে শ্বশুর – শাশুড়ী, শিফা এবং শাহাদ। শাশুড়ী দিয়াকে দেখে বললো,

– বড় বৌমা ডাক্তার কি বলছে?

দিয়া উত্তর দেয়ার আগেই শিফা বললো,

– ভাবীকে মাথার টেস্ট দিয়েছে ডাক্তার। ডাক্তারের মুখটা কেমন যেন ছিলো আম্মু। ভাবী টেস্ট না করিয়ে চলে এসেছে।

দিয়া বাঁধা দিয়ে বলে উঠলো,

– না আম্মু ওরকম কিছু না। এমনি।আর আপনি তো জানেন ডাক্তাররা একটু বাড়িয়ে বলে।

– না বৌমা তোমার টেস্ট করানো উচিত ছিলো কাজটা ঠিক করোনি। কাল গিয়ে করিয়ে আসবে।আমি বলে দিব।

শ্বশুরের কথা অগ্রাহ্য করার যে কোনো ক্ষমতা নেই এটা বুঝতে পারছে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। শিফার দিকে তাকিয়ে বললো,

– শিফা,শেহজাকে খাওয়াতে হবে।

শিফা ভাইয়ের দিকে তাকাতেই শাহাদ শিফার কোলে মেয়েকে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাবা মা কে উদ্দেশ্য করে বলে,

– আম্মু কালকে ছাদের হল রুমটা ক্লিন করে রাখবেন। আমি সকালে লোক পাঠিয়ে দিব ওরা সাজিয়ে দিবে। আমার একটা মিটিং হবে ওখানে।

– ঠিক আছে বাবু।

দিয়া মেয়েকে নিয়ে রুমে চলে গেলো। মেয়েকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেই দেখলো ফোন এসেছে। ফোনের স্ক্রিনে নাম উঠেছে ‘Chachi’ ।দিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।ফোনটা রিসিভ না করে বন্ধ করে দিলো। এভাবে প্রায় গত ছয় মাস করছে। এই মহিলার কথা ভাবতেই মন মেজাজ ক্ষেপে যায়। কম কষ্ট দেয়নি তাকে। খাট থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে শিফার রুমে আসলো। শিফা তখনো পড়ছে। মেয়েটা এবার দশম শ্রেণিতে। শিফাকে অনুরোধ করলো শেহজার পাশে গিয়ে শুতে। শিফা খুশি হয়ে চলে গেলো। দিয়া বাড়ির লিভিং রুম থেকে বের হয়ে করিডর দিয়ে এগিয়ে গেল দোতলার রুফটপে। দোতলা, তিনতলা মিলিয়ে রায়হান সাহেবের বাড়ি।বাড়িটা শখ করে বানিয়েছেন। তার দোতলার এই রুফটপটা গুছানো।অনেক গুলো দেশি বিদেশী জাতের পিটুনিয়া ফুল, ড্রাগন,অ্যাভোকেডো ফল গাছ লাগানো। এখানে সবার আশার অনুমতি নেই। স্পেশালি দিয়ার তো নেই। শাহাদের নিজের হাতে লাগানো সব কটা গাছ।নিজেই যত্ন করে এসব গাছের। কাল শাশুড়ীকে বলে এই ছাদের চাবি নিয়ে রেখেছিলো।মন খারাপ হলে এখানে আসবে বলে ঠিক করেছে এখন থেকে। কারো কথা শুনবেনা। ওই লোকের যদি ইচ্ছে হয় নিজে এসে বারণ করুক।তখন না হয় চলে যাবে। অন্য কিছু তো চায় নি। একটু স্বস্তির জন্য এই ছাদে আসার অনুমতি চাইবে না হয়। ছাদের মাঝে একটা সুইমিং পুল আছে। মানুষটা এখানে আসে প্রায়। দিয়া শাড়ি খানিকটা তুলে পুলের নীল পানিতে পায়েল পরা সাদা পা জোড়া ভেজালো। পায়েলের শব্দে ঝনঝল করে উঠলো পুল সাইড। আঁচল বিছিয়ে গেল অর্ধেক পুলে,বাকিটুকু পানিতে। আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অভিমানী গলায় বললো,

– কেনো আমার জীবনে সব দিয়ে ও সব কেড়ে নিলে।আমি তো মেনে নিয়েছিলাম আমার ভাগ্যকে। তাহলে কেনো কেড়ে নিলে মানুষটার ভালোবাসাও।

বাড়ির সবচেয়ে বড় মাস্টার বেডরুম থেকে সরাসরি দেখা যায় এই ছাদ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুটো তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত, প্রখর নেত্র নজর রাখছেন শাড়ি পরা দীঘল কেশী কন্যার উপর। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো। দিয়া এখনো চুপচাপ। ভিজেই যাচ্ছে। উপর থেকে সেই দৃশ্য দেখছে কেউ। বেশ কিছুক্ষন পর উঠে দাঁড়ালো। ভেজা কাপড়ের পানি চিপে ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ঠিক তখনই রুম থেকে বেরিয়ে এলো মানুষটা। এক নজর দেখে চোখ নামিয়ে পানির বোতল টা নিয়ে রুমে চলে গেলো। এভাবে অগ্রাহ্য করলো মানুষটা! দিয়া তখনো নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো নিজের রুমে। আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে গোসল সেরে পরে নিলো। শিফা ঘুমিয়েছে আরো আগে। একপাশ করে নিজেও শুয়ে পড়লো।

_____

একটার পর একটা নাস্তা বানাতে বানাতে হাঁপিয়ে উঠেছে। আফিয়া খালাও দু হাতে কাজে সাহায্য করছে দিয়াকে। সকাল থেকেই শরীর টা ম্যাজ ম্যাজ করছে। শ্বশুর আজ ফুলকো লুচি খাবে খাসির মাংস দিয়ে। শিফা চেয়েছে এগুলোর সাথে ভাবীর হাতের স্পেশাল সালাদ। শেফালী এবং তার ছেলে খাবে ভুনা খিচুড়ি। কিছুক্ষন আগে শাশুড়ী এসে মাংস কেটে ধুয়ে দিয়েছে। সুলতানা কবির মানুষটা ছেলের বউয়ের প্রতি যথেষ্ট মায়াশীল। অসুস্থ না থাকলে কাজ গুলো গুছিয়ে দেয়। তার মনে একটাই আক্ষেপ ছেলেটা বউয়ের সাথে যদি তার জীবদ্দশায় ঠিকভাবে সংসার না করে মেয়েটার কি হবে! এই নিয়ে রায়হান সাহেবের ও চিন্তার অন্ত নেই।ছেলে দু বছর ধরে বউয়ের সাথে কথা বলা তো দূর ঠিক মতো মুখ ও দেখেনা।

– আম্মু উঠেন। রেস্ট নেন।বাকি গুলো আমি করে নিব।

মেয়েটা এত যত্ন করে শাশুড়ির মনেই হয়না পরের মেয়ে। তার ঘরেও মেয়ে আছে। শেফালীটা ঝগড়াটে স্বভাবের জন্য সংসার টাও ঠিক মতো করতে পারলোনা। দিয়া ধরে শাশুড়িকে উঠিয়ে দিলেন রান্নাঘর থেকে। সকলের আবদার পূরণ শেষে খাবার নিয়ে গেলো টেবিলে আফিয়া খালা। দিয়ার কেনো যেন মনে হচ্ছে সব কিছুর মাঝেও কোনো খাবার মিসিং। মনে পড়তেই হঠাৎ ছুট লাগালো ফ্রিজের দিকে। টেবিলে রীতিমতো সবাই বসে গিয়েছে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো ঘড়িতে আটটা বাজতে আরো পনেরো মিনিট বাকি। দ্রুততার সাথে ফ্রিজ থেকে গাজরের বক্স আর একটা মিল্কভিটার প্যাকেট নামালো। শাশুড়ি প্রশ্ন করলো,

– ওটা কেন বের করছো বৌমা?

– আম্মু এমনি।

একটা মুচকি হাসি দিয়ে ছুটে গেলো রান্নাঘরে। শেফালি মুখ ভেঙচিয়ে বললো,

– ঢং, এত আদিখ্যেতা এই মেয়ে কই পায়।

শিফা না পারতে বাবা মায়ের সামনেই শেফালীকে বলে উঠলো,

– আপা তুমি কি স্বাভাবিক আচরন করতে পারোনা।সব সময় ভাবীর পেছনে লাগো কেনো?

– যা দেখোস তা ভুল বুঝছিস,ওর রুপ দেখিয়েই তো সর্বনাশ করেছে আমার। শেষমেষ লোকটা অপমানে আমাকে ছেড়েই চলে গেলো।

– তোমার জামাই আগে থেকেই…

– একদম চুপ। বেয়াদপ। আদব কায়দা নেই তোমাদের। সবসময় খাবার টেবিলে এসব করো কেনো।

সুলতানা কবিরের ধমকে পুনরায় টেবিলে নিরবতা।

হাঁড়িতে দুধ গরম বসিয়ে, প্রেশার কুকারে চিনিগুড়া চাল,গাজর,বাদাম,কিশমিশ, চিনি, ঘি,কন্ডেন্স মিল্কসহ যা যা উপকরন লাগে সব দিয়ে এত দ্রুত করে ফেললো একটা পায়েশ। এই পায়েশ শাশুড়ি শিখিয়েছে। আজ টেবিলে সবার পছন্দের খাবার করেছে। মানুষটা বাদ থাকবে কেনো। তার পছন্দের এই গাজরের পায়েস রেডি করে সুন্দর ভাবে গার্নিশিং করে দিলো। আফিয়া খালা টেবিলে পায়েশ রাখতেই শাহাদ টেবিলে এসে বসলো। শ্বশুর, শাশুড়ি ও দুই ননদের দৃষ্টি পায়েশের বাটিতে। শাশুড়ি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এই মেয়ে এত তাড়াতাড়ি এই পায়েশ কিভাবে করেছে। শ্বশুর বকা দিতে চেয়েছিলো দিয়াকে এমন ছুটে ফ্রিজে যাওয়ার জন্য। গাজর,দুধ নামিয়েছিলো দেখেছে।ভেবেছিলো হয়তো শেহজার জন্য।এত জোরে ছোটাছুটি করলে তো পড়ে দূর্ঘটনা ঘটাবে! কিন্তু ব্যাপার তো অন্যটা। শ্বশুর – শাশুড়ি একে অন্যের দিকে তাকিয়ে এমন একটা ভাণ করলো যেনো কিছু হয়নি। দোয়া করছে মনে মনে যেন আজকে ছেলে খায়। মেয়েটা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছে। সকলে খাবার শুরু করেছে। একটু একটু করে সব খাবার খেলো শাহাদ। সবাই টেবিলে বসে খায় কিন্তু দিয়ার জায়গা হয়না টেবিলে। দিয়া টেবিলে বসলে শাহাদ উঠে যায়। সেই থেকে দিয়া আফিয়া খালার সাথে খায় নতুবা একা নিজের রুমে। শ্বশুর শাশুড়ি প্রথম দিকে ওর জন্য বসে থাকতো।কিন্তু এতে উনাদের ঔষধ নিতে দেরি হয়ে যায়। তাই এখন আর পারেনা। দিয়া নিজেও এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আড়াল থেকে দেখছে সবার খাওয়া। ওদের রান্নাঘরের একপাশ খোলা। কাচের গ্লাসের দরজা এক পাশ থেকে খুলে চাইলেই দেখা ভেতর থেকে বাইরেটা। শাহাদ খাবার খেয়ে উঠে যাবে এমন সময় রায়হান সাহেব বলে উঠলেন,

– পায়েশটা খাও।

শাহাদ বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,

– বাবা মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

বেসিনে হাত ধুয়ে রুমে চলে গেলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে গেলো। আজ ও পাভেল দাঁড়িয়ে ছিলো।
শাহাদ বের হওয়াত সাথে সাথে শেফালী বলে উঠলো,

– আহ হা রে, কত কষ্ট করে বানাইছিলো।ভাইজান তো মুখেও তুললোনা। থাক এগুলা আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের মোতাহের আংকেলের কুকুর ডো ডো আছে না তারে দিয়া দিতে কও আফিয়া খালা।

রান্নাঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিরবে,নিভৃতে চোখের পানি বিসর্জন দিলো। বুকের ভেতর টা কেমন হু হু করে উঠলো। ভুলেই গিয়েছিলো সে তো একজন কঠিন পাথর মানবের কথিত স্ত্রী। শরীরটাও আজ ম্যাজ ম্যাজ করছে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সকলের সামনে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ডাইনিং টেবিলে বসা সবার দৃষ্টি করুনার।দিয়া চায়না এদের কারো করুনা। রুমে ঢুকে মেয়ের সাথে শুয়ে পড়লো মেয়েকে খাইয়ে দিতে দিতে।

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

মেয়েটা সেই তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। অসুস্থ শরীরে মেয়েকে সামলানো কষ্টকর। সবাই এড়িয়ে চললেও গর্ভধারিনী যে পারেনা। চোখ মেলতেও কষ্ট হচ্ছে। দিয়া উঠে মেয়েকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষন হাঁটলো। ফিডিং করিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। ঘড়িতে বিকাল পাঁচটা। অবাক হলো।এতক্ষন ঘুমালো অথচ কেউ আজ ডাকলোই না। রান্নাঘরের দিকে গিয়ে দেখে কেউ নেই। পুরো বাড়ি ফাঁকা। আফিয়া খালাকে ডাকতেই বারান্দা থেকে ছুটে এলো।

– খালা বাকিরা কোথায়?

– বড় আম্মা আর খালু গেছে হাসপাতালে। খালুর কোন বন্ধু হাসপাতালে ভর্তি করাইছে। আর ছোট আপা কোচিং এ।বড় আপা বান্ধবীর বাসায়।

– আচ্ছা। আমাকে একটু খিচুড়ি দাও শেহজার জন্য।

– আপনে কিছু খাইবেন না ছোট আম্মা।

– ইচ্ছে করছেনা। শেহজার জন্য নিয়ে আসো ওখান থেকে খাব।

আফিয়া খালা সব এনে দিতেই শেহজাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা খেতে চাইছেনা। কেমন অনীহা করছে। এরপর নিজেও খেয়ে নিলো অল্প করে। মেয়েকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শাহাদের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। বুকটা ধক করে উঠলো। একমাসের জন্য এই রুমটা তার ও ছিলো। ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ওই ভাবনায় শেহজা কেমন যেন করলো ভেতরে যেতে। দরজার নব ঘুরাতেই খুলে গেলো। পুরো কামরা জুড়ে মানুষটার গন্ধ। কি সুন্দর টিপটপ গুছানো রুম। কাঁপা কাঁপা পায়ে খাটের কাছে এগিয়ে এলো। এক কোণায় বসে বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলো। এটা সেই বিছানার চাদর যে দুবছর আগে বিয়ের রাতে বিছানো ছিলো। স্মৃতি ঘিরে ধরলো দিয়াকে। উঠে দাঁড়ালো৷ আলমারির কাছে গিয়ে আয়নায় দেখলো চেহারা টা মলিন হয়েছে। মেয়েটা হওয়ার পর পড়াশোনাটাও ঠিকঠাক হয়ে উঠেনা। এইচ এস সি পরীক্ষার ফলাফল অনেক ভালো। শ্বশুর বলেছিলো এখানে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিবে। কিন্তু দু বছর পিছিয়ে যাবে তাই আর ভর্তি হয় নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাস ও করতে পারবেনা। দুশ্চিন্তা,মেয়ে, সংসার সব মিলিয়ে পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গিয়েছে দিয়ার জীবন। ওর বয়সী মেয়েরা এখনো অনেকে মায়ের হাতে ভাত খায়, বাবার সাথে ঘুরতে যায়। অথচ সে এখন এক সন্তানের জননী,কারো স্ত্রী কারো ছেলের বউ। সব সামলে সে এখন পুরোপুরি ঘরকন্নার দায়িত্ব পালন করছে। শেহজা নামতে চাওয়াতে নামিয়ে দেয় মেয়েটা হামাগুড়ি দিয়ে বাবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দিয়া রুমের প্রতিটা কর্ণার চোখ বুলিয়ে দেখছে। এমন সময় কিছু একটা ভাঙার শব্দ পেয়ে লাফিয়ে উঠে দিয়া। সামনে তাকিয়ে দেখে শেহজা বাবার শ্যানেলের পারফিউম ভেঙে ফেলেছে। আঁৎকে উঠেছে, কলিজার পানি শুকিয়ে গিয়েছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে থর থর করে কাঁপছে। ভাগ্যকে দুষছে। কেনো ঢুকলো এই রুমে। পেছন দিক থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,

– বাহ মা মেয়ে মিলে আমার ভাইয়ের জিনিস নষ্ট করা হচ্ছে। আসুক আজকে।

দিয়া ভয় পেয়ে বলে উঠলো,

– আপু আমি ভেঙেছি।হাত থেকে পড়ে গিয়েছে।

আফিয়া খালা এসে কাচ পরিষ্কার করছে। শেফালী আজ সব বলে দিবে। মেয়েকে ক*ষে একটা চ/ড় দিলো। আফিয়া ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো,

– ছোট আম্মা এটা কি করলেন?

আফিয়া দ্রুত হাত পরিষ্কার করে হাত মুছে এসে কোলে তুলে নিলো শেহজাকে। মেয়েটা রুম কাঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।দিয়া ধমকে বললো,

– চুপ একদম চুপ, আরেকবার কাঁদলে তুলে আঁ/ছা/ড় দিব। তোর জন্য আজ আমার কি হবে আল্লাহ জানে।

রুমে গিয়ে নিজেও কাঁদছে। মেয়েটার গালে চ/ড়ে/র দাগ বসে গিয়েছে। ফর্সা গালে আঙুলের দাগ গুলো দৃশ্যমান।

____

অফিসের ফাইল গুলো চেক করে দেখছে আর পাভেলের দিকে কড়া নজরে তাকাচ্ছে। পাভেল শুকনো ঢোক গিলছে। চারটা ফাইল দেখেই শেষের ফাইলটা ছুঁড়ে মা-র-লো। কেবিনে উপস্থিত ছিলো দলের আরো উচ্চ পদস্থ কর্মীরা।

– এই বিল টা পাশ হয়েছে আরো ছ মাস আগে।এখনো কাজ ধরা হয়নি কেনো? এভাবে কাজে গাফেলতি তো আমি অ্যালাও করবোনা। একদম গে*ড়ে ফেলবো।

কথাটা পাভেলের দিকে তাকিয়ে বললেও সিজারের গায়ে লেগেছে। কারণ কাজটা সিজারকে দিয়েছিলো। সে তো বিলের টাকা থেকে দশ লাখ নিজেই সরিয়ে ফেলেছিলো মালয়েশিয়া ট্যুরে যখন গিয়েছিলো তখন।

– এই কাজটা কার ছিলো?

পাভেল নেতার হুংকার শুনে ভয়ে আঁৎকে উঠেছে। সিজারের দিকে তাকাচ্ছে একবার নেতার দিকে। সিজার নিজ থেকে মুখ খুললো,

– বস, কাজটা আমাকে দিয়েছিলেন। আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম তো ধরতে পারিনাই। দু একদিনের মধ্যেই ধরবো।

একটা ফাইল ড্রয়ার থেকে বের করে সাইন করলো। কাকে যেন ফোন দিয়ে বললো দেখা করতে। এরপর সিজারের দিকে তাকিয়ে বললো,

– সুপার মার্কেটের কি অবস্থা দেখে আসো। আগুন লাগার পর দোকানদারদের কি পরিমান ক্ষ,য় ক্ষ/তি হলো। সরকারের পক্ষ থেকে কিভাবে সাহায্য করা যায় খতিয়ে দেখো। সাথে রবিন, নিয়াজকে নিয়ে যাও। আর দু ঘন্টার মধ্যে বিলটা দিয়ে যেও। তোমার যেহেতু সময় হচ্ছে না আমি কাজটা আরেকজনকে হ্যান্ড ওভার করেছি। এখন তোমরা যেতে পারো।

সকলে চমকে গেলো।এভাবে পাশ হওয়া বিল কখনো পরিবর্তন হয়না।এই প্রথম হলো। সিজার চোখ দিয়ে পাভেলকে ধ্বংস করে দেয়ার অভিব্যক্তি দেখালো। পাভেল সিজারের দৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরিয়ে গেলো।ওর পেছন পেছন বাকিরাও বেরিয়ে গেলো।

___

শিফা কোচিং থেকে ফেরার সময় রাস্তায় একটা বিড়াল ছানা দেখতে পেলো। কাঁদায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। বিড়ালটা তুলে রাস্তার পাশে পানির ট্যাপের কাছে নিয়ে গেলো। সম্ভবত মসজিদের ট্যাপ হবে। কয়েকজনকে দেখলো হাত মুখ ধুচ্ছে। তাড়াতাড়ি বিড়ালটাকে গোসল করিয়ে আবার আগের জায়গায় নিয়ে আসলো।দেখে মনে হলো পার্সিয়ান বিড়াল। একটা পিচ্চি মেয়ে দৌঁড়ে এসেছে। শিফার দিকে তাকিয়ে বললো,

– আপু এটা আমার টুকটুকি।

শিফা এতক্ষনে বুঝতে পারলো বিড়ালটা এই মেয়ের।বিড়ালটাও মেয়েটাকে দেখে ম্যাও ম্যাও করে ঝাপটে ধরলো। ক্লাস সিক্স কি সেভেনের হবে মেয়েটা। তবুও শিফা কৌতুহল দমাতে জিজ্ঞেস করলো,

– কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?

– ক্লাস সেভেনে।

– ও এখানে কি করে এলো?

– আপু গেইট খোলা পেয়ে বের হয়ে গিয়েছে।

– আচ্ছা সাবধানে রাখবে। ওকে আমি গোসল করিয়ে দিয়েছি।এই কাদায় গড়াগড়ি করছিলো।আমার ও একটা মিনি ছিলো তাই আমি বুঝি ওদের আদর।

– ঠিক আছে আপু অনেক ধন্যবাদ।

– তোমার নাম কি?

– অশমি। আপনার?

– শিফা। ঠিক আছে ভালো থাকবে অশমি।

– বাই আপু।

কি সুন্দর একটা বিড়াল।তিন বছর আগে শিফার একটা বিড়াল ছিলো।একদন হারিয়ে গিয়েছিলো।সেই দুঃখে শিফা আর বিড়াল পোষেনি। এখন গন্তব্য বাসা।একটা রিকশা ডেকে বাসার জন্য রওয়ানা দিলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে একজন লক্ষ্য করছিলো শিফার কাজ। একটা কাজে এই পথ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় শিফাকে দেখে থমকে গেলো। দূরত্ব বজায় রাখাই ভালো।

___

ড্রইং রুমের পরিবেশ থমথমে। বাবা,মা,দু বোন সবাই আছে। শাহাদ বাসায় ঢুকার পরই শেফালী বলতে শুরু করলো,

– ভাইজান আপনার রুমে আমরা যাই না অথচ ওই মেয়ে ঢুকেছে। রুমটাকে এলোমেলো করে এসেছে। এর মধ্যে আপনার দামী একটা পারফিউম ভেঙে ফেলেছে।

সুলতানা কবির মেয়েকে বকা দিচ্ছে।কিন্তু কে শুনে কার কথা।অনর্গল বলেই যাচ্ছে। পুনরায় বলছে,

– মেয়ে সামলাতে না পারলে ওর মেয়ে রাখার কি দরকার। কোনো ভাবেই এই বাড়ির যোগ্য না।ভাগ্যিস আমি আগে এসেছিলাম। ভাইজানের রুমে কত কি থাকে।কত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল,টাকা পয়সা থাকে।আল্লাহ জানে কি সরিয়েছে।

সুলতানা কবির এবার নিজেকে সামলাতে পারলেন না। মেয়েকে ধমকে বললেন,

– এক চ*ড় দিব বে য়া দ প। বড়দের সম্মান করতে শিখ।সম্পর্কে তোর বড় ভাবী।কাকে কি বলছিস তুই? ও ওর স্বামীর টাকা কেনো চুরি করবে।ওর এমনিতেই স্বামীর টাকায় সব অধিকার আছে।

– কিসের অধিকার। ওর কোনো অধিকার নেই। ওকে দয়া করে শেহজার জন্য থাকতে দিয়েছে ভাইজান।নতুবা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতো।

শেফালী উঠে সোজা দিয়ার রুমের দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো। দিয়া শেহজাকে কোলে নিয়ে দরজা খুলেছে।বাইরে থেকে সব কথা এতক্ষন কানে আসছিলো। মাঝে মাঝে মন চায় সব ছেড়ে ম*রে যেতে কিন্তু মেয়েটার জন্য পারছেনা। হয়তো কোনো একদিন তাই করবে। মেয়েকে নিয়ে বের হতেই শেফালী ওর শক্ত হাতের মুঠোয় দিয়ার ছোট্ট নরম হাত খামছে ধরে সকলের সামনে নিয়ে আসলো। সারা শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে দিয়ার। সেই সাথে শেহজার গায়েও একশ তিন ডিগ্রি জ্বর। ওদের খবর কেউ রাখেনা। মেয়েটা মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চুপসে আছে। অন্য সময় হলে শব্দ করতো। এভাবে টানতে টানতে দিয়াকে আনতে দেখে রায়হান সাহেব ধমক দিলেন,

– শেফালী দিন দিন তোমার বে/য়া/দ/বি বাড়ছে। কিভাবে বড় ভাবীর হাত ধরেছো।ছাড়ো বলছি।

শাহাদ আড়চোখে একবার সেই হাতের দিকে তাকালো। শেফালী ধরার জায়গাটা নীলছে বর্ণ ধারণ করেছে রক্ত জমাট বেঁধে। দিয়ার চোখ মুখ কেমন যেন ফ্যাকাশে আর ফোলা ফোলা।হয়তো কেঁদেছে। এগুলো নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর মেয়েটাও চুপ করে আছে। নিরস,নির্বিঘ্নচিত্তে মেয়ে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শেফালী সকলের সামনে চিৎকার দিয়ে বললো,

– বলো কি নিয়েছো ভাইজানের রুম থেকে? কেনো গিয়েছো সেখানে?

দিয়া বোকাবনে গেলো।চোখের পলক ঝাপটে বুঝার চেষ্টা করলো কথার অর্থ। কি নিবে সে! সে তো এমনি গিয়েছে। এমনভাবে বলছে যেন দিয়া চো/র। চোখ দুটো জ্বলছে।ভরে আসছে। মেয়েটা নড়ে উঠলো। শক্ত করে মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। আজ মেয়েকে যেভাবে মে*রেছে। মেয়েটা এক মুহুর্তের জন্য ও মায়ের বুক ছাড়া হয়নি। ভীষণ ভয় পেয়েছে বাচ্চাটা। দিয়া কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

– আমি কিছু নি নাই।

– তাহলে গিয়েছিলে কেনো?

– এমনি।

– নতুন কাহিনী করো। সত্যি কথা বলো কি চু/রি করতে গিয়েছো।

দিয়ার দুচোখ আর বাঁধ মানলোনা।কেঁদে দিলো। সুলতানা কবির মেয়েকে ধমকে যাচ্ছে। শাহাদ মায়ের দিকে তাকিয়ে মাকে দেখছে, দৃষ্টি স্থির। সুলতানার মনে হলো ছেলের এই দৃষ্টি তাকে ভর্ৎসনা দিচ্ছে যে মা হিসেবে সে ব্যর্থ এই মেয়েকে মানুষ করতে।রায়হান সাহেব ছেলের আচরনে অবাক।মেয়েটা অন্যায় ভাবে বউকে ঝাড়ছে অথচ ছেলেটা স্থির। দিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– আপু বিশ্বাস করেন আমি কেনো কিছু নিব। কিছুই নিই নাই। শেহজাকে নিয়ে পাঁচ মিনিট ছিলাম, ওর বাবার রুমে গিয়ে খুঁজছে ওর বাবাকে। এরপর তো আপনি আসছেন।

– আর ভাইয়াজানের দামী পারফিউম ভাঙলে যে।

– আমি খেয়াল করিনি। আমি একটা কিনে দিব?

শেফালী অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,

– তুমি তো নাকি অনেক দামী জিনিস সবাই বলে। তোমাকে বেচলে ওটার দাম পাওয়া যাবে!

দিয়া অবাক হয়ে দেখলো। পা কেমন যেন টলছে। পুরো বাড়িসুদ্ধ মানুষের সামনে এভাবে অপমান করছে। মানুষটা দেখে যাচ্ছে অথচ তার হয়ে কোনো প্রতিবাদ করছে না। দিয়া শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলে,

– বাবা আমি কিছু করিনি। আমার কাছে কোনো প্রমান ও নেই। আপনারা চাইলে আমার তল্লাশি নেন। শেহজার শরীর টা ভালো না। আমি আর দাঁড়াতে পারছিনা মেয়েটাকে নিয়ে। আমি ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়াবো আপনি অনুমতি দিলে।

– কি হয়েছে শেহজার?

রায়হান সাহেব, সুলতানা কবির উঠে দাঁড়ায়।

আর চুপ থাকতে পারলোনা আফিয়া খালা। সামনে এসে বলে,

– খালুজি ছোট মুখে বড় কথা হবে,একটা কথা বলতাম। শাহাদ বাবার সুগন্ধিটা ছোট আম্মা ভাঙে নাই। আমাগো শেহজা ভাইঙ্গা ফেলছে। ও ভাইঙ্গা ভয়ে কাইন্দা দিছিলো। আল্লাহ বাঁচাইছে, ওর কোথাও লাগেনাই।আমি কাচ পরিষ্কার কইরা ফেলছি। তখনই শেফালী আপা রুমে আইসা ছোট আম্মারে যা তা বইলা গেছে।এরপর ছোট আম্মা রাগে,কষ্টে শেহজারে খুব জোরে একটা থাপ্পড় মা*রছে। দেখেন এখনো গাল লাল হয়ে আছে।

– কিহ!

রায়হান সাহেব বুকে হাত দিয়ে সোফার হাতল আকড়ে ধরলেন।এতটুকু নাতনীটা কি করে মায়ের রাগের উত্তাপ সহ্য করে নিলো! সুলতানা কবির থতমত খেয়ে গেলেন। দিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা কাঁদছে। শাহাদ হতবাক হয়ে দিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আচমকা উঠে ছোঁবল মেরে দিয়ার থেকে শেহজাকে কেড়ে নিলো।মেয়ের মুখ দেখে আঁৎকে উঠলো।গায়ে প্রচন্ড উত্তাপ। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে। সোজা মেয়েকে নিয়ে রুমে ঢুকে হঠাৎ কাচ ভাঙ্গার শব্দ। সকলে ছুটে গিয়ে দেখলো শাহাদের পাগলামী। একটা একটা করে সব কটা পারফিউম আছাড় মেরে ভাঙ্গছে। সেই সাথে চিৎকার দিচ্ছে,

– রাখবোনা একটাও। সব ভেঙ্গে ফেলবো কত বড় সাহস আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলে। পারফিউম ভেঙেছে বেশ করেছে। ও ওর বাবার পারফিউম ভেঙেছে। পরবর্তীতে কেউ আমার মেয়ে বা মেয়ের মায়ের নামে নালিশ করতে আসলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিব।

কথাটা যে শেফালীর প্রতি রাগের বহিঃপ্রকাশ এতক্ষনে বাড়ির সবার পরিষ্কার। শেফালীকে সকলের সামনে কিছু না বললেও রুমের তান্ডবে প্রতিটি মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত। স্পষ্ট ইঙ্গিত বউ বা মেয়ের নামে নালিশ আসলেই সে কঠোর ভাবে দমন করবে। এতক্ষন সহ্য করে ছিলো ঘটনার আবহ বুঝতে। সুলতানা কবিরের চোখে সেই আতঙ্ক। এই ছেলে সহজে কিছু বলেনা, অনেক কিছু জেনেও সে চুপ। শেফালীকে সহ্য করছে বোন হিসেবে। মাকে দেয়া কথা রাখতে। মাতৃভক্তি আছে বলেই হয়তো এই বাড়িতে শেফালীর জায়গা হয়েছে। শাহাদের একটি কথা ও দিয়া শুনতে পায়নি। মেয়েকে আবার আগলে ধরে মেয়ের সারা মুখ চুমুতে ভরে দেয়। মেয়ের সাথে কথা বলছে,

– কোথায় কষ্ট হচ্ছে বাবাকে বলো আম্মা। বেশি ব্যাথা দিয়েছে মা! আর দিবে না কেউ কষ্ট আমার মাকে। আজ থেকে শেহজা বাবার রুমে থাকবে। বাবার রুম আমার আম্মার পছন্দ হয়েছে! আফিয়া খালা পানি নিয়ে এসো। ওর খাবার আনো।আমার মেয়ের জন্য আমি আছি। কাউকে লাগবে না।

সুলতানা কবির ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। শরীর স্পঞ্জ করে দেয় নাতনীর। আফিয়া খালা ততক্ষনে কাচ পরিষ্কার করে নিয়েছে। মেয়েটা কিছু খেতে চাইছেনা। একটু খিচুড়ি খাইয়ে দিলো। একটু সিরাপ খাইয়ে দিয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো শাহাদ। শিফাকে দিয়ে শেহজার সব জিনিস রুমে আনালো। নিজেও রুমে খেয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ঘুমালো।

দিয়া নিজের রুমে চলে গেলো। আজ ওর বাবা থাকলেও হয়তো ওকে এভাবে যত্ন করতো। যার বাবা মা নেই তার কেউ নেই এই দুনিয়াতে।এতটা কষ্টময় জীবন হয়তো না পেলেও পারতো।

চলবে…