সায়রে গর্জন পর্ব-৪৪+৪৫

0
3

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৪৪.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

আঁধার কাটতে সময়ের প্রয়োজন, প্রয়োজন ধৈর্য্যের। এসির টেম্পারেচার কিছুটা কমিয়ে কামরার পরিবেশ শীতল করে রাখা হয়েছে। ঠোঁটের কোণায় হাসি। এই হাসি জয়ের। পার্টি অফিসের এল ইডি স্ক্রিনে বড় করে সম্প্রচারিত হচ্ছে নায়িকা মোহনা মিশুর প্রতারণা ফাঁস। ঠকিয়েছে প্রেমিক রেদোয়ানকে। দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে প্রেমিক রেদোয়ানের কাছে। এরপর তাকে অমানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় রেদোয়ানের ঘরে। আজ সে হাসপাতালে মৃত্যুমুখে পতিত । প্রেমিক রেদোয়ান সাবেক এমপি রায়হান মাহমুদের ছোট ভাই এবং বর্তমান এমপি শাহাদ ইমরোজের চাচা। দেশবাসী জেনে অবাক হবেন এমপি নিজে বাদী হয়ে তার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে চাচা রেদোয়ানের নামে মামলা করেছেন। আট বছর আগে এমপি পত্নী ফারহানা মেহতাবের বাবা মুরাদ সাফায়েত মজুমদার ও মা আমিরার হত্যাকান্ডের সরাসরি মূল হোতা ছিলেন চাচা রেদোয়ান। তার হিংস্র লীলা সম্পন্ন ঘটনার সূত্রপাত ঘটে মেয়ে মনিকা ফেরদৌসকে ঘিরে। বাবাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবেগঘন পোস্টে যখন পুরো মাধ্যম মাতামাতি করছিলো,ঠিক তখনো কেউ একজন মন্তব্য বক্সে ফাঁস করে রেদোয়ানের দ্বিতীয় বিবাহের গুমোট। সেই বিবাহ অন্য কাউকে নয় নায়িকা মোহনা মিশুকেই।

একটার পর একটা অভাবনীয় তথ্য বের হয়ে আসছে। পাপ বাপকে ও ছাড়েনা। আরো একজন সন্তান তার বাবার চরিত্রের সর্বনাশের জন্য দায়ী। অন্যদিকে সরকার চাপে আছে আন্তর্জাতিকভাবে। ইরানী কন্যা আমিরার হত্যাকান্ডকে নিছক দূর্ঘটনা বলে চালানো বড়ই দুঃখজনক। ইরান সরকার ফারহানা মেহতাবের নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছে সরকারকে। ব্যাপারটা খুব সাধারণভাবে নিলেও সবচেয়ে বড় চাঞ্চল্যকর তথ্য আমিরা সেহরা বিনতে ফারহাদ, ইরানের বিখ্যাত লিডার ফারহাদ বিন আহমাদের কন্যা। ফারহানা মেহতাব তারই দৌহিত্রী। হাম্মাদ বিন ফারহাদ স্পষ্ট হুমকি দিয়েছেন ফারহানা বিপদের সম্মুখীন হলে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিকতা হা/রাবে।

__

রায়হান সাহেবের বাড়িতে মিটিং বসেছে। রেদোয়ানের কৃতকর্মের জন্য সকলে আজ চিন্তিত। বর্তমানে সবার চিন্তা অসুস্থ মনি এবং তার মা মোমেনার কি হবে? সুলতানা কবির স্পষ্ট বললেন,

– তাদের দিকে না তাকানোটা খুবই দুঃখজনক হবে। তাই তাদের নিরাপত্তা জোরদারের জন্য আমার বিনীত অনুরোধ বাবু এবং রায়হান সাহেব তোমাদের দুজনের কাছে। তবে সাবধান আমার ঘরের ত্রিশ সীমানায় যেন পা না দেয়। আমার সন্তানরা ওই মনির সংস্পর্শে এলেই বিপদে পড়ে। আরেকটা কথা বাবু তুমি মনির সামনে যাবেনা। ওর চরিত্রেও সমস্যা আছে তা আমরা জানি। বৌমাকে আসতে দাও মনির ব্যাপারটা আমি বুঝিয়ে বলব।

শাহাদ নিরবতা পালন করছে। রায়হান সাহেব জানালেন,

– আপাতত পুরান বাড়িতে থাকতে দি? কি বলো বাবু? কারণ ভাড়া বাসার টাকা মনে হয়না চালাতে পারবে৷ ফ্ল্যাট তো সব বিক্রি করে দিয়েছে রেদোয়ান।

শাহাদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

– আপনারা গিয়ে দেখেন কি করা লাগবে বলবেন লোক পাঠিয়ে দিব। মিষ্টি কথায় গলবেন না আব্বু। মাথায় রাখবেন আমি শান্ত আছি শ্রদ্ধা করি সম্পর্কগুলোকে। নতুবা যেই কাজ আপনার ভাইয়ের পরিবার করেছে অবশ্যই তাদের অস্তিত্ব বিলীন করতে আধ ঘন্টার বেশি সময় নিতাম না।

সোফা থেকে উঠেই ধুপধাপ পা ফেলে কামরার উদ্দেশ্যে। ফ্রেশ হয়ে ফোন হাতে নিলো। দশ পনেরো দিন কেটে গেলো শূন্য কামরাটিতে। রিনরিনে কন্ঠস্বর সালাম সহ ভেসে এলো,

– ওয়ালাইকুমুস সালাম। পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

– আলহামদুলিল্লাহ।

-বাড়িতে কখন ফিরেছো?

– দুইটা বাজে।

– মেয়ে কি করে?

– খেলা করছে বাইরে মামা, খালাদের সাথে।

– আচ্ছা৷ এ্যই ওয়ান মিনিট মামা কে?

দিয়া মুচকি হেসে ফোন কে*টে দিলো। এমপিকে একটু জ্বালাতে মন চাইলো। এর মাঝে কল্পনা এসে ডাকলো। ফোন রেখে নিচে চলে যাওয়াতে জানতেও পারলো না ও পাশের মানুষটা কতটা অস্থির হয়ে তড়পাচ্ছে। বিরামহীন লাগাতার ফোন দিয়েই যাচ্ছে।

__

সেদিন রাতে শাহাদের সাথে বিষদ আলোচনায় বসেছিলো দিয়া। অনেক কিছুই জানতো বাবা- মায়ের ব্যাপারে। কোনো এক অলৌকিক কারণে দিয়ার মনে হয়েছে শাহাদকে আটকানো প্রয়োজন তাই অনুরোধ করেছিলো যেন সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে হয়। ঝামেলা করতে গেলে শেহজার পরিনতি যদি দিয়ার মত হয় তা দিয়া মেনে নিতে পারবেনা। যতই ক্ষমতা থাকুক, আইনের ফাঁক ফোকরে অপরাধীরা পালিয়ে যায়। তবে সত্যি শাহাদের প্ল্যান ছিলো মা/রাত্মক ভয়াতুর। যার সমন্ধে অবগত ছিলো একমাত্র নোমান এবং পাভেল। রাতের আঁধারে সবচেয়ে বড় নৃসংশতা চালাতে প্রস্তুত ছিলো এমপি। সেনাপতিতের কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে এসেছিলো অর্ধাঙ্গিনীর নিকট। মাঝপথেই থামিয়ে দেয় ওদের দুজনকে। পরিকল্পিত হ/ত্যা/যজ্ঞ চালাতেই নোমান দুরত্ব পেরিয়ে রাতে আঁধারে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছিলো। রাশেদ চলে যাবার পর থেকে উপস্থিত রা/গের ধাক্কা সামলাতে পারেনা শাহাদ। কোনো না কোনো অকল্যানকর কাজ করেই বসে। যেমন বাসা থেকে বের হয়ে মোহনা মিশুর উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে পেট থেকে সব কথা উগলে এনেছে। সেখানে উপস্থিত ছিলো পাভেল এবং গোয়েন্দা ইউনিটের চৌকস নারী সদস্য উপমা। এক পর্যায়ে পাভেল ও ভয় পেয়ে গিয়েছিলো মোহনা মা*রা যাবে কিনা তা ভেবে। ইলেক্ট্রনিক শকড সবাই যখন দেয় মাথায়, শাহাদ দিতে বলেছিলো কানে, পায়ের আঙ্গুলে এবং পেটে। কতটা ভ/য়া/নক ভাবা যায়। ক্লান্ত হয়ে একের পর এক বলতে থাকে মোহনা। পুরোটা রেকর্ড করে উপমা। সর্বশেষ তথ্য ছিলো দিয়ার উপর যেকোনো সময় হামলা করতে পারে চাচা রেদোয়ান, কেবল তাই নয় পরিকল্পনা ছিলো দিয়াকে ধ/র্ষি/তা বানিয়ে শাহাদ ইমরোজের উপর প্রতিশোধ নিবে। নিস্তব্ধ শাহাদের প্রতিক্রিয়া ছিলো শেষ অংশে। ক্রোধানল ছড়িয়ে পড়ে বদনজুড়ে। চোখ জোড়া রক্তিম আকার ধারণ করে। বসা থেকে উঠে সরাসরি মোহনার চুলের মুঠি ধরে মাথাটা মচকে দেয়। মেয়েটার ঘাড় হয়তো আর কখনো ঠিক হবে বলে মনে হয়না। তবে উপমা পাভেল তৎক্ষনাৎ হাসপাতাল মুখী হয়। এরপর পুরো ঘটনা এমন ভাবে সাজানো হয় যেন সব দোষ রেদোয়ান করেছে।

___

মজুমদার বাড়ির উঠোন আজ আনন্দিত। দিয়া আজ নিজেই অসহায়,দুস্থদের খাবারের ব্যবস্থা করেছে। তদারকি করছে মঈন সাহেব ও কল্পনার স্বামী। গত পরশু সে দেশে এসেছে। চলছে বিশাল ভোজ আয়োজন। বড় বড় হাড়িতে রান্নার এলাহি কারবার। মন খুশি হবেনা কেনো? অকালে ছিনিয়ে নেয়া বাবা- মায়ের হ*ত্যার আসামীরা যে ধরা পড়েছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ছোট্ট সাজানো পরিবার। আকাশে মেঘনাদ। মাটির সোদা গন্ধ। হঠাৎ ধমকা হাওয়া। উঠোন থেকে সব সরিয়ে কাচারী ঘরের পথে সবাই। বৃষ্টি এলে যে সব বরবাদ হবে। আজ শাড়ি পরেছে এমপি বধূ। শেহজা খেলা করছে বাড়িজুড়ে, সাথে আছে বাড়ির সবাই,আত্নীয়রা। ধুপধাপ পা ফেলে ছুটে চললো ছাদের দিকে। হাওয়ার তেজ বাঁধ মানছেনা। ছাদের ঠিক মাঝখানটাতে দাঁড়িয়ে দু হাত মেলে ধরলো শূন্যে। একপাশে আঁচল উড়ছে। ঝমঝম করে বারিধারা। ভিজিয়ে দিচ্ছে তনু মন। দোলনচাঁপার সুবাস, বেলী ফুলের মায়া,রজনীগন্ধার অনুভূতি আজ সব ছাড়িয়ে বাবার সেই ছোট্ট দিয়া পানিতে ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। চোখ বেয়ে নেমে আসছে আনন্দ অশ্রু। আকাশের দিকে তাকাতে পারছেনা বারির তোড়ে। তবুও বারি ফোঁটার সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বললো,

– বাবাজান, পৃথিবীতে পিনিক ফোটা জোসনা আসেনি তোমরা চলে যাবার পর। শ্রাবন মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার শুনেনি তোমার মেয়ে। সেই অলৌকিক সঙ্গীত আজো তোমার মেয়ে শুনতে চায়না বাবাজান, এর কারণ তুমি নেই। আম্মিজান আমি তোমার কাচের চুড়ি পরেছি আজ। তুমি শাড়ি পরতে পারতেনা বলে তহমিনা আপার আম্মার কাছে যেতে মাঝে মাঝে। আজ তোমার মেয়ে শাড়ির সাথে বাস করে। তোমরা কোথায়? দিয়ার কাছে তোমাদের দিয়ার মতো একটা ছোট্ট পরী আছে। আমার বেঁচে থাকার সম্বল এখন সেই পরী। তোমরা কি ছুঁবে না আমার সেই পরীকে?

পানি ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসছে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। পেছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরলো কেউ। এই স্পর্শ পরিচিত দিয়ার। পেছন না দেখেই বললো,

– এমপি সাহেব, বাবাজানের টিনের চালের সেতার শুনবো আজ। আমাকে নিয়ে চলুন। চাচাসাহেব আমাকে যেতেই দিলোনা কাঁদবো বলে। সামলাতে পারবেন না তারা তাই। এখন তো আপনি এসেছেন নিয়ে চলুন।

নিজের দিকে ঘুরিয়ে ভেজা কপালে উষ্ণ পরশ দিয়ে কোলে তুলে নিলো প্রেয়সীকে। নিজেও ভিজে ছুপছুপা। আদুরে কন্ঠে জবাব দিলো,

– নিয়া যাবো ফারাহ্, আগে ভেজা শাড়ি বদলে নাও।

– এখনি যাবো।

– ক্ষুধা পেয়েছে তো।

গলা জড়িয়ে ধরলো শাহাদের। বাধ্য মেয়ের মতো বললো,

– বৃষ্টি থেমে যাবে তো।

– তুমি শাড়ি পরিবর্তন করে বাবাজানের প্রিয় রঙয়ের শাড়ি আর আম্মাজানের দেয়া কাচের চুড়ি পরো। এর মাঝে আমি একটা দরখাস্ত লিখি বৃষ্টিকে যেন আজ কিছুক্ষন থেকে যায়। অন্তত আমার বৃষ্টিবিলাসী সেই বাড়ি পৌঁছানো অবধি। ঠিক আছে?

বাধ্য বাচ্চার মতো মাথা নাড়ে। এতক্ষনে শাহাদ সিড়ি বেয়ে সহধর্মিণীকে নিয়ে কামরায় চলে এসেছে সে কথা জানতেই পারেনি বিভোর হয়ে থাকা প্রেয়সী। কোল থেকে নামিয়ে ওয়াশরুমের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,

– বলো মেয়ে, বাবাজানের প্রিয় রং কি?

– সবুজ।

হাতের পানি ঝেড়ে একটা সবুজ শাড়ি,ব্লাউজ নামিয়ে ফেললো পুরোনো কাঠের আলমারি থেকে। নিজের গায়ের শার্ট খুলে ফেললো। আলমারি থেকে টিশার্ট নামিয়ে গায়ে গলিয়ে বললো,

– এবার বলো মেয়ে, আম্মাজানের চূড়ি কোথায় পাবো?

দিয়া থরথর করে ঠান্ডায় কাঁপছে। হাত উঠিয়ে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করে দেখালো,

– ড্রেসিং টেবিলের কর্নার দরজা খুললে।

টাওয়ালটা কোমড়ে পেঁচিয়ে প্যান্ট খুলে ছুঁড়ে মারলো এক পাশে। ট্রাউজার পরে ড্রেসিং টেবিল থেকে চুড়ি বের করে একসাথে খাটের উপর সাজিয়ে রেখে বললো,

– পালটে দিবো নাকি নিজে পালটাবে।

দিয়া নিশ্চুপ। মেয়েটা ধ্যানে নেই। শাহাদ সরাসরি সামনে এসে এক টানে আঁচল ফেলে দিলো নিচে। দিয়ার চোখে তাকিয়ে দেখে এখনো কাঁদছে। এজন্যই নিচে মঈন চাচা বলছিলো আজ এই মেয়ে সকাল থেকে পাগলামী করছে। গত রাতেই শাহাদ জানিয়েছে সব সম্প্রচার ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে টেলিভিশনগুলোতে।চিন্তিত ভঙিতে মঈন চাচা জানালেন, পরীক্ষা কিভাবে দিয়েছেন আল্লাহ জানেন ভালো। ভাবনা থেকে বের হয়ে টাওয়াল দিয়ে প্রেয়সীর মাথা মুছে দিতে দিতে বললো,

– কি দরকার ছিলো আমাকে এভাবে চিন্তায় ফেলার?

চোখ তুলে দিয়া বললো,

– চিন্তায় ফেলিনি তো।

– শেহজার আংকেল এসেছে,এই কথা না বলে মামা বলেই তো ঝামেলা পাকিয়েছেন।

দিয়া ফিক করে হেসে দিলো কান্নার মাঝে। এতক্ষনে এই মেয়ের হাসি দেখে আত্মায় পানি এলো শাহাদের। পুনরায় ঠোঁট উলটে রেখেছে। বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ। মানুষজন ঘরে ফেরে নিজেদের মাঝে আবেগঘন মুহুর্ত তৈরিতে। অথচ সে ছোট্ট বউ সামলাতে ব্যস্ত। এর মাঝে এই মেয়ের কান্ড কারখানা মোহনীয়। নিজের শরীরের সাথে ছোট্ট দেহটাকে মিশিয়ে রেখেছে সযতনে। দিয়ার অধর ছোঁয়া ছুঁয়ে দিচ্ছে টিশার্টের বোতাম খোলা উদাম বুকে। প্রতিটি লোমকূপ শিহরে উটলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখছে এমপি। এই মেয়ে নিজেই নিজের মাঝে নেই৷ পাতলা তুলতুলে অধরের ছোট ছোট উষ্ণ ছোঁয়াতে ভরিয়ে দিচ্ছে এমপির উন্মুক্ত লোমশ বুক। জোরে শ্বাস ফেলছে এমপি। নিজেকে পুরোপুরি কাঁবু করে ফেলেছে। প্রেয়সীর অধরে আলতো অধর ছুঁয়ে প্রশ্ন করলো,

– কি হয়েছে বউ?

মাথা নাড়ালো ফারাহ্। কিচ্ছু হয়নি বুঝালো। যত্নের সাথে প্রতিটি দেহ-আবরনী খুলে আলমারি থেকে বের করা নতুন শাড়ি ব্লাউজে সজ্জিত করে শাহাদ সত্ত্বাকে মর্মে মা*রারা জন্য নিজ হাতেই গায়ে জড়িয়ে দিতে ব্যস্ত শাহাদ। দিয়া মুচকি হেসে বলে,

– শাড়ি পরানো শিখলেন কি করে?

– সব কয়টা নারী সদস্য পিচ্চি কালে তাদের বায়না নিয়ে উপস্থিত হতো ভাইজানের নিকট। আদুরে বায়না ছিলো শিফার। আম্মুর কাছ থেকে তাই শিখে নিয়েছি। কাজের সময় আম্মুকে অনেক জ্বালাতো শাড়ি পরিয়ে দিতে। খুন্তির বাড়িও খেত। রক্ষা করে আমি রাজকার্য হাতে নিলাম। সেভাবেই শেখা।

দিয়া হাসে আর ভাবে মানুষটা কেমন আচরণ করলো দুটো বছর আগে, কেউ কি বিশ্বাস করবে এই সেই শাহাদ। দিয়া সেই বিশ্বাস করে কারণ সে জানে মানুষ ভুল করে। ভুল না করলে সঠিকের কোনো মূল্যই থাকতোনা দুনিয়াতে। যেমন আঁধার না থাকলে মানুষ বুঝতো কি করে আলোর প্রয়োজনীয়তা। কপালে পুনরায় উষ্ণ পরশ পেয়ে দিয়া প্রশ্ন ছুড়লো,

– সন্দেহ করেছিলেন বুঝি মামা বলাতে?

– উঁহু জেলাস। ভাবছি কোন মামা আছে এই বাড়িতে? ঘরে মিষ্টি রেখে গেলে মালিকের এমনিতেই চিন্তায় ঘুম হয়না যদি পিঁপড়া ধরে?

– আপনি বুঝি আমার মালিক?

– তোমার মালিক,আমার মালিক সবার মালিকই তো মহান আল্লাহ। বলতে পারো তোমার মনের একচ্ছত্র মালিক। এখন যাও প্লিজ খাবার আনো। অনেকটা পথ নিজে ড্রাইভ করে এসেছি। এরপর বৃষ্টি থেমে গেলে কিন্তু আমি নিরপরাধী।

– চুড়ি?

শাড়ি পরিয়ে, শাহাদ দুহাত সাজিয়ে দিলো চুড়িতে। হাত দুটো তুলে মুখের কাছে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দিলো। দিয়া হেসে বের হতে যাচ্ছে কামরা ছেড়ে তখনই বললো,

– আমার ছানাটাকে নিয়ে এসো।

– আচ্ছা।

দিয়া বের হতেই নিজেদের ভেজা কাপড় ধুয়ে বারান্দায় মেলে দিয়ে রুমে এসে দেখলো খাবার নিয়ে এসেছে দিয়া। মেয়েকে কোলে নিয়েই ঝটপট করে খেয়ে নিলো। মেয়ে বাবাকে পেয়ে একবার কোলে উঠছে একবার নামছে। একবার কোলে উঠছে তো অন্যবার মাথায়। দিয়া জোর করে কেড়ে নিয়ে মেয়েকে ধমকে বলে,

– এমন করছো কেনো? বাবাকে খেতে দাও।

দিয়ার ধমক খেয়ে শাহাদের নাকে মুখে খাবার উঠে গেলো। পানি পান করে জোরে বললো,

– তোমার কি সমস্যা? আমি এতেই অভ্যস্ত।

খাওয়া ইতিমধ্যে শেষ। এদিকে রাজকন্যা গাল ফুলিয়ে কান্না শুরু করেছে। ফুফিয়ে ফুফিয়ে বলতে লাগলো,

– বাবা, মা

এরপর যে নিজের কি ভাষা উচ্চারণ করলো তা বুঝার সাধ্য নেই। এতটুকু পরিষ্কার মাকে নিয়ে নালিশ করছে বাবার কাছে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে চোখে মুখে হাতে আদর দিয়ে ভরিয়ে দিতেই মেয়ে খুশি।
দিয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো শাহাদ। রাখি এসে প্লেট গুছিয়ে নিয়ে গেলো। মেয়ের কান্না থামিয়ে বললো,

– চলো বের হবো।

রাখি এবং কল্পনা হাজির হলো। রাখি শাহাদের ইশারা বুঝে বললো,

– দুলাভাই আমরা তো দিয়া আপাদের খামার বাড়িটা দেখি নাই। আমাদের নিবেন?

দিয়া চেয়েছিলো সময়টা একান্তে কা*টাতে। আজ হবেনা বুঝতে পেরে এদের বারণ করলোনা। মুচকি হেসে বললো,

– সবাই চলো।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো শাহাদ। কারণ ও নিষেধ করলে ভাবতো সব শাহাদের প্ল্যান। এই বাড়িতে সামলানো যাচ্ছেনা ওই বাড়ি একা গেলে তো পাগলামি বেড়ে যাবে। এদিকে মেয়ে থাকবে শাহাদের কোলে। দিয়ার পাগলামি সামলাতে বেগ পেতে হবে। মেয়েকে এই বাড়িতে রেখে যাওয়ার পক্ষে সে নেই। মেয়ে মানুষের একমাত্র নিরাপত্তা প্রদান করতে পারেন
আল্লাহ তাআলার পর তার বাবা মা। তাই রাখি এবং কল্পনাকে সুকৌশলে বলে রেখেছিলো যেন তারাও যেতে চায়। পরিকল্পনা সফল হওয়াতে প্রশান্ত হলো মন। গন্তব্য এখন খামার বাড়ি।

চলবে।
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
#খামার_বাড়ি_স্পেশাল
৪৫.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

রাস্তায় কাদামাটি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। গাড়ি একটু যায় তো আরেকটু চাকা ডেবে যাচ্ছে। ড্রাইভার গাড়ি উঠাতেই পারছেনা। এখন উপায় একটাই গাড়ি রেখে যেতে হবে নতুবা ফিরে যেতে হবে। দু দুটো গাড়ির একই অবস্থা। বৃষ্টি থেমেই গেলো। দিয়ার নিরবতা সায় দিচ্ছে ঝড় অন্যদিকে উঠতে পারে। বৃষ্টি থেমে যাওয়াতে তো কারো কোনো হাত নেই। গাড়ির দরজা খুলে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো এমপি। দিয়াকেও বের হতে বললো। দেখাদেখি কল্পনারাও গাড়ি থেকে বের হয়ে শাহাদের পিছু নিলো। কল্পনার স্বামী সালিফ বললো,

– দুলাভাই, আমরা আর গাড়ি নিয়ে আগাতে পারবোনা।

শাহাদ প্রশ্ন করলো,

– তাহলে উপায়?

– ভ্যান,রিকশা অথবা দুটো মানব চাকা।

– কতদূর এখান থেকে।

– প্রায় তিন কিলো।

– এই বৃষ্টির রাস্তায় ভ্যান ও তো অসম্ভব।

দিয়া ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। কার যেন নাম্বার ডায়াল করলো। এর মাঝে ফোন ও চলে গিয়েছে।

– আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছিস?

ওই পাশে থেকে প্রতিউত্তর,

– আলহামদুলিল্লাহ কি মনে করে?

– ভাই, আমাকে একটা ভ্যান ম্যানেজ করে দিতে পারবি? মনোহরপুর এসেছি। রাস্তায় কাদা।

– কোথায় আটকে আছিস?

– মুন্সীর হাটের ধান ক্ষেতের রাস্তায়।

– থাক, ম্যানেজ করছি।

দিয়া ফোন রাখতেই দেখতে পেলো ড্যাব ড্যাব করে সব কটা চোখ তার দিয়ে চেয়ে আছে। গমগমে গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,

– কে?

– আশিক।

দাঁত কিড়মিড় করে বললো,

– ওই ডাক্তার ছেলে টা না? আবার কেনো, আমাকে অকর্মক মনে হয় যে অন্য মানুষের সাহায্য লাগবে।

– এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

– প্রয়োজন হলে হেঁটে যাবে। আমি কোনো আশিকের হেল্প নিবো না। সামনে হাঁটো।

দিয়া থমকে আছে, এর মাঝে শাহাদ কয় পা এগিয়ে গিয়েছে। পুনরায় পিছিয়ে দিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে আগানো শুরু করলো শেহজাকে নিয়ে। পেছন ফিরে সালিফকে বললো,

– কারো অপেক্ষায় না থেকে হাঁটা ধরুন। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে রাত হবে।

কল্পনা,রাখি এবং সালিফ মুখ লুকিয়ে হাসছে। দিয়া থমথমে মুখে ধুপধাপ পা ফেলছে। মনে হচ্ছে কেউ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। শাড়ি সামলে কাদায় হাঁটা ভীষন কষ্টকর। তবুও মুখটাকে ফুলো লুচির মতো করে রেখেছে। তাল গাছের নিচে এসে শাহাদ থামে। দিয়ার কোলে মেয়েকে দিলো। আশপাশে তাকিয়ে দেখলো কোনো রিকশা বা ভ্যান আছে নাকি। নাহ! কিছুই পেলোনা। অবশেষে শেহজা সুদ্ধ তার মাকে পাঁজকোলে তুলে নিলো। মেয়ের মায়ের চোয়াল ঝুলে গেলো। সামনে চোখ নিবদ্ধ রেখে বললো,

– পড়বেনা, আমার দায়িত্বে আছো। মেয়েকে ধরো শক্ত করে।

– মেয়েটা এভাবে চিৎ হয়ে থাকলে বমি করে সব ভাসাবে। বাড়ি থেকে খাইয়ে এনেছি।

তৎক্ষনাৎ সামনে একটা গ্রামীন রিকশা এলো। মা এবং মেয়েকে নামিয়ে দিলো। শহরের রিকশা থেকে নকশায় ভিন্ন আদল। শাহাদ ডাক দিলো,

– যাবেন?

রিকশা থেমে আগাগোড়া ভালোভাবে দেখে মাথা কাত করে প্রশ্ন করলো,

– কই যাইবেন?

দিয়ার দিকে তাকাতেই দিয়া উত্তর দিলো,

– খামার বাড়ি।

রিকশা চালক উত্তর দিলো,

– ওইহানে তো অহন কেউ থাহে না। মুরাদ সাব আর তেনার বউ মইররা যাইবার পর মাইয়াডা দাদার বাড়ি আছে। মাঝে সাঝে উনার ভাই মানুষ পাডাইয়া পইষ্কার করায়।

শাহাদ বিরক্ত নিয়ে বললো,

– আপনি যাবেন?

– হ হ যামু মামা চলেন।

দিয়া রিকশায় উঠে বসে। এরপর শাহাদ মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে। প্রথম চাকা ফেলতেই রিকশা নড়ে উঠলো। মেয়েকে শক্ত করে ধরে বসতেই দেখে মেয়ের মা তার হাত আকড়ে ধরেছে। সহধর্মিণীর কাঁধের উপর হাত ঘুরিয়ে নিজের কাছে এনে মিশিয়ে নেয়। আওয়াজ ছাড়লো,

– মামা একটু আস্তে চালাবেন। দুটো বাচ্চা সামলানো কষ্ট।

রিকশাচালক মুচকি হেসে ঘাড় কাত করলেন। যেতে যেতে অনেক কথাই বললেন। আকাশে মেঘের পুনরায় ঘনঘটা শুরু। শাহাদ মনে মনে প্রার্থনা করলো, বৃষ্টিটা যেন ও বাড়ি গেলেই হয়। এখন হলে মেয়েটা ভিজে যাবে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ঝমঝমিয়ে শুরু হয়ে গেলো বারিধারা। দিয়া শাড়ির আঁচল তুললো মেয়ের মাথায়। ভাড়া মিটিয়ে শাহাদ এবং দিয়া ছুটলো বাড়ির দিকে। চারদিকে গাছ মাঝে একটা সরু সিমেন্টের রাস্তা। উপরে ছাউনি দেয়া। বাড়ির মেইন গেইট খোলা দেখে বুঝলো কল্পনারা আগেই পৌঁছে গেছে। সামনে ঢুকতেই এই সৌন্দর্য দেখার জন্য শাহাদ মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। মঈন সাহেব বাগানের মালিকে আগেই পাঠিয়েছে সব গুছিয়ে রাখতে। আশপাশে এত ফলের গাছ, বিভিন্ন রকমের ফুল পড়ে আছে ঘাসে, সত্যি একটা টিনের রাজপ্রাসাদ বানিয়েছেন শ্বশুর মশাই। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে দিয়াকে প্রশ্ন করলো,

– ভিজবে?

সবাইকে বাড়ি ঘুরে দেখতে বলে দিয়া শাহাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের কামরার দিকে। রুমে এসে দরজা আটকে শেহজার জামা বদলে দিলো। বাচ্চাটা স্থির হয়ে বসছেনা ছটফট করছে এদিক সেদিক যেতে। রুমের ডান পাশে কর্ণারে গিয়ে দুয়ার কাঁটা উঠিয়ে আরেকটা দরজা খুলে দিলো। এতেই যেন উন্মুক্ত হলো এই বাড়ির প্রকৃত রহস্য। ছোট্ট একটা পদ্ম পুকুর। ঘরের ভেতর থেকেই দেখা যাচ্ছে পুকুরে বিচরন করছে রাজহংসী ও তার দল। পদ্মতে ভরা পুকুর। ঝনঝন করছে বৃষ্টির ফোঁটা টিনের চালে। ভেজা মাটির সোদা গন্ধ। বেল গাছের পাতা বেয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে বসার জায়গাতে। শাহাদের কোলে মেয়েকে দিয়ে দু হাত মেলে নেমে পড়লো বাড়ির উঠোনে। মুরাদ মজুমদার মেয়েকে ঠিক কতটা ভালোবাসতেন আজ শাহাদ অনুমান করতে পারছে। একটা ছোট্ট রাজ্য বানিয়ে দিলেন মেয়ের জন্য। ধারণা ছিলো শেহজা তার কাছে তার সবটা জুড়ে, আজ বুঝতে পারলেন দিয়া মুরাদের কতটা জুড়ে ছিলো। এতটা বছর বাবা বিনা এই মেয়ে কিভাবে টিকে ছিলো? শেহজা হাত দিয়ে দেখাচ্ছে মায়ের কাছে যাবে। শাহাদ জোর করে আটকে রেখেছে মেয়েকে। দিয়া বৃষ্টিতে ভিজেই চলেছে। এই মেয়ে নির্ঘাত শয্যাশায়ী হবে। যেভাবে টানা ভিজেই যাচ্ছে। দিয়া চিৎকার দিয়ে বললো,

– এমপি সাহেব, আপনি যেখানটাতে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে বাবাজান দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমি এখানে ভিজতাম। আম্মিজান পুকুরে নেমে আমার জন্য শালুক তুলে আনতো। এরপর আমরা মা মেয়ে ভিজতাম। এই যে বেল গাছটাতে বারো মাস বেল ধরতো। টেবিলে সাজানো থাকতো বেলের শরবত। বাবাজান বৃষ্টিতে ভিজতেন না। একদিন বাবাজান বলে বসলেন, “একদিন আমি আর আমার মেয়ের জামাই বসে বেলের শরবত খাবো, সেদিন আর আমি একা থাকবোনা। তোমরা মা- মেয়ে আমাকে ফেলে ভিজছো তো, সেদিন আমি দেখে নিব।” অথচ আজ দেখুন বেল নেই, আমার বাবাজান নেই, আপনি আছেন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, আমি আছি আমার জায়গায়, আমার আম্মিজান নেই। কি দোষ ছিলো আমার বাবাজানের -আম্মিজানের?

নিশ্চুপ শাহাদ, অনেক দিন পর চোখ দুটো ভারী হয়ে এসেছে। শেহজাকে বুকের সাথে চেপে ধরেছে। শেহজাকে দিয়ার সাথে কল্পনা করতেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। একা এই দুনিয়াতে মুরাদ,আমিরা ছাড়া তার ফারাহ্ ঠিক কতটা অসহায় ছিলো? নিজেকে সামলাতে না পেরে ছেড়ে দিলো চোখের জল। সামনে তাকিয়ে দেখে দিয়া কাদার মধ্যে বসে পড়েছে। শেহজা কাঁদছে ওদিকে যাবার জন্য। মেয়েকে সামলে পুনরায় সামনে তাকালো। তাকিয়ে দেখে দিয়া নেই। হন্তদন্ত হয়ে এদিক সেদিক চোখ বুলালো। ছুটে গিয়ে দিয়ার রুমের দরজা খুলে কল্পনাকে ডেকে শেহজাকে দিলো। রুমে এসেই বৃষ্টিতে নিজেই নেমে গেলো। আশপাশটা গাছ পালায় ভর্তি। হঠাৎ চোখ গেলো পুকুরে। ভেতরটা কেঁপে উঠলো। দিয়ার আঁচল ভাসছে। ঝাঁপিয়ে পড়লো পুকুরে। যা ভেবেছিলো এই মেয়েকে সামলানো যাবেনা! তাই হলো। পানিতে ডুব দিয়ে হাতড়ে কোমড় জড়িয়ে জোর করে উঠালো। উঠবেনা বলে ধাপাধাপি করছে পানিতেই। ধমকে বললো,

– পাগল হলে মেয়ে? কি করছিলে?

দিয়ার মুখে হাসি। চোখ ঝাপটা দৃষ্টিস্থির শাহাদের মাঝে। রাজহংসী গুলো ঘিরে ধরেছে তাদের। দিয়া হেসে বলে,

– এমপি সাহেব, আমার মনে হচ্ছে এখানে আম্মি জানের ছোঁয়া পাচ্ছি। উঠোনে টিনের চালে বাবাজানের গন্ধ। যখন ডুব দিলাম মনে হলো আম্মিজান আমাকে কোলে তুলে আদর করছে। কেনো দিলেন না আরেকটু ডুবে থাকতে?

বার বার চোখের পলক ফেলা মেয়েটির এক গালে হাত রেখে আদুরে ভঙ্গিতে বললো,

– চলো ফারাহ্, আম্মিজান – বাবাজান আমাদের জন্য অনেক দোয়া করেছেন। উনারা থাকলে কি তোমাকে এভাবে বেপরোয়াভাবে থাকতে দিতেন। এই যে পুকুরে ঝাঁপ দিচ্ছো, বৃষ্টিতে ভিজেই যাচ্ছো। তুমি অসুস্থ হলে যে শেহজাও অসুস্থ হবে।

দিয়া হাসে আর বলে,

– আপনি একদম বাবাজানের মতো। বাবাজান ও আম্মিজানকে বলতো, আমিরা জানেমান আপনি কি এভাবেই ভিজবেন আর পুকুরে সাঁতরে যাবেন? আপনাকে দেখে তো মেয়েটা দুষ্টু হচ্ছে। অসুস্থ হয়ে পড়বে যে আমাদের মা টা।

পদ্ম পুকুরের মাঝে কপোত-কপোতীদের এত সুন্দর দৃশ্য হয়তো কখনো কেউ দেখবেনা, দেখার সুযোগ হবেনা। কল্পনা এবং রাখি শেহজাকে নিয়ে কামরায় আসতেই চক্ষুবদ্ধ হলো এই মনোরম, সুদৃশ্য। কল্পনা ফোন বের করে দুটো ছবি তুলে নিলো। ছবি তুলেই বের হয়ে গেলো কপোত-কপোতীর ব্যক্তিগত কামরা থেকে।

দিয়াকে কোলে নিয়েই পুকুর থেকে উঠে আসলো। কপালে অধর ছুঁয়ে দিলো প্রেয়সীর। দিয়া বুকের সাথে কতগুলো পদ্ম জড়িয়ে ধরে রেখেছে। শাহাদের বুক থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ শ্বাস। পৃথিবীর সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে দিলেও এই মেয়ের শূন্যতা অপূরণীয়। নিজেকে আজ বড্ড অপরাধী লাগছে। এতদিন অপরাধ বোধ ছিলো দুবছর এই মেয়েকে সাজা দেয়ার। আজকের অপরাধ বোধ হলো এই মেয়েকে সারাজীবন ভালো রাখতে না পারার, সেই ক্ষমতা না থাকার। দো জাহানের সমস্ত সুখ এনে তার সহধর্মিণীর পায়ের কাছে বিছিয়ে দিলে যে তার সিকিভাগ ও পূর্ণ হবে না সে কথা আজ যথেষ্ট জানা হয়েছে। কারণ তার দুনিয়া-জাহান তো ছেড়ে চলে গিয়েছে আট বছর আগে। এই আট বছরে মেয়েটা শতবার ভেঙেছে,সহস্রবার নিজেকে গড়েছে। সেরা স্ত্রী হয়েছে, সেরা মা হচ্ছে। শাহাদ ইমরোজ তুচ্ছ প্রাণী, অধম স্বামী। তার কোনো যোগ্যতাই নেই এই নারীর অর্ধাঙ্গ হবার। এই নারীকে অর্ধাঙ্গী হিসেবে পেয়েছে বলে, কত সহস্র সময় শোকরানা আদায় করলে তার আত্মা শান্তি পাবে? আদৌ কি সময়ের হিসেব হবে?

__

সুলতানা কবির ডাইনিং রুমটাকে এলাহি আয়োজনে ভরিয়েছেন। শেফালীকে শক্ত পোক্ত ভাবে বারণ করেছেন যেন ঘর থেকে বের না হয়। কলিং বেল বেজে উঠলো। রায়হান সাহেব উঠে দাঁড়ান, দরজায় সবাইকে দেখে এগিয়ে গিয়ে আগে জড়িয়ে ধরেন নোমানকে। নোমান বিব্রত বোধ করে। সাবেক শ্বশুর এভাবে তাকে আগলে নেবে ভাবেনি। এরপর শাহীন এবং পাভেলকে জড়িয়ে ধরেন। দুপুর দুটোয় এয়ারপোর্টে নেমেছে। সাথে পাভেল ও আছে। সুলতানা কবির উঁকি দিয়ে মুখে হাসি রেখে তিনছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। তিনজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

– আমার তিন মানিক। আয় ভেতরে আয়।

ছেলেদের ছেড়ে নওরীনকে জড়িয়ে ধরে কপালে আদর দিয়ে বলে,

– বৌমা তোমাকে অনেক মিস করেছি। আমার সংসারের চাঁদ সূর্য দুটোই আমার থেকে দূরে ছিলো এতদিন এখন আসার সময় হয়ে এলো বলে। চাঁদটা যে প্রথম হয়ে গেলো এবার বাবুর আব্বু।

সোফায় বসে হাসতে হাসতে রায়হান সাহেব বললেন,

– এবার তাহলে সূর্যকে আসতে বলো। বাকি যা পরীক্ষা এই বাড়ি থেকে দিক। বাড়িটা যে শূন্য সবাইকে ছাড়া। আমার শেহজা দিভাই টাও নাই। পরিপূর্ণ বাড়ি দেখে শেষ নিশ্বাস নিতে চাই।

শাহীন,পাভেল এবং নোমান কপট চোখে তাকাতেই বললো,

– মজা করেছি এমন করে তাকাস কেনো? সবাই ফ্রেশ হয়ে নেয়। তোদের মা অনেক মজার খাবার রেঁধেছে। একটু চেখে দেখবো ভাবলাম! ছুঁতেই দিলোনা। উলটো গলা ছাড়ে আগে আমার ছেলেরা আর ছেলের বৌ আসুক এরপর একসাথে। এখন তোরা এই বুড়ো বাপের উপর কৃপা করে তাড়াতাড়ি আয়।

হেসে তিনজনই ফ্রেশ হতে চলে গেলো। শিফা,আফিয়া,তাহি টেবিল গুছায়। লিমন এখন সুলতানা মঞ্জিলে আছে। সবাইকে বুঝিয়ে ম্যানেজ করে নেয় শাহাদ। রত্নাও ছেলেকে বাইরে রাখতে চাচ্ছেনা। এখানে নিরাপদ। দেখাশোনা কে করবে! তাহি দুবেলা ডাক্তার নিয়ে এসে দেখে যায়। এই অনেক বাপ মরা ছেলেটার জন্য। মাথার উপর ভাসুর এবং শাহাদ থাকাতে রত্না নিশ্চিন্তে থাকে। সুস্থ হয়ে উঠলে আর কখনো বাইক চালাতে দেবেনা। সব দোষ এই বাইকের! শাহাদের সাথে বসে লিমনের বাইক চালানো বন্ধ করতে হবে।

খাবার টেবিলে সব খাবার লোভনীয়। ঘরনীরা দাঁড়িয়ে নিজেদের মানুষগুলোকে খাওয়াচ্ছে। হাতের রান্নার প্রশংসা কে না শুনতে চায়। ছেলেরা সরাসরি জানালো নিজেরা নিয়ে খাবে। সুলতানা কবিরকে বসতে বলায় বসলেন না তিনি। শাহীন প্রিয় চিংড়ীর মালাইকারীটা মুখে দিয়ে বললো,

– আহ! কি স্বাদ। মালয়েশিয়াতে কাছাকাছি খাবার পাওয়া গেলেও চিংড়ীর মালাইকারীটা পাওয়া যায়না। এই কয়টা দিন অনেক মিস করেছি।

পাভেল নিরব ভূমিকা পালন করছে। নিজের মত খাচ্ছে। শিফা এসে একটা রোস্ট তুলে দিলো। আজ চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। কোনো কথাই বাড়ানো যাবেনা। কথায় কথা বাড়বে। নোমান খাসির কলিজা ভুনা নিয়ে মুখে পুরলো পোলাও দিয়ে মাখিয়ে। আচমকা টেবিলের সবাই চুপ হয়ে গেলো। অভ্যাসবশত কাজটা করেছে সবাই বুঝতে পেরেছে। এই বাড়িতে খেতে বসলে সবার আগে কলিজা ভুনা দিয়েই শুরু করতো। কিছু একটা টের পেয়ে সুলতানার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

– মা শুনেন, আমি মানুষটা জীবনসঙ্গী হয়তো বদলে ফেলেছি তবে ছেলেটা আপনারই আছি। তাই আপনার হাতের সেই স্বাদ, অভ্যাস ভুলিনি আর ভুলবোনা।

তারপর টমেটো চাটনী নিলো। মুখের দিয়েই বুঝতে পারলো এটা কার বানানো। খেতে খুব মজা হলেও বেশি খেলোনা। সবার খাওয়া শেষ হলে শিফার বানানো ডেজার্ট একটু করে সবাই মুখে তুলছে। শাহীন আর নোমান প্রশংসা করতে করতে মুখের ফেনা বের করে ফেললো।

– আহ! শিফা এবার তোকে বিয়ে দিব। এত ভালো হয়েছে পায়েসটা।

নোমানের কথায় শিফা লজ্জা পেয়ে পাভেলের দিকে তাকায়। পাভেলের মাথা নোয়ানো। কিছু ইঙ্গিত পেয়ে নোমান পাভেলকে ডাকে। দেখতে পায় ছেলেটার মুখটা মলিন। বুঝতে পারলো নিজের মতো ভুলটা বন্ধুও করতে বসেছে। খাবার শেষে পাভেলের চিলেকোঠা খোলা হলো বিশ্রামের জন্য। পাভেল চলে যাবে বলাতে ধমক দিলো সুলতানা। সুলতানা বেরুতেই নোমান বিছানায় শুয়ে হেসে বললো,

– মামা আমার মতো একই ফাঁদে পা দিছোস?

– মানে?

– তুই ভালোবাসিস নাকি তোকে বাসে পিচ্চিটা?

পাভেল চমকে উঠে নোমানের মুখ চেপে ধরলো। আশপাশটা দেখে বলে,

– একদম চুপ একটা কথাও উচ্চারন করবিনা।

দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে উঠে দরজা খুললো। তাকিয়ে দেখে শিফা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। নোমান উঁকি মে*রে হেসে দিলো। শিফা ধীর গলায় বললো,

– একটু বাইরে আসবেন?

– নাহ।

– প্লিজ…

নোমানের দিকে তাকিয়ে দেখে সুরাইয়ার সাথে ভিডিও কলে ব্যস্ত। তাই দরজা আবজে ছাদের কর্ণারে দাঁড়ালো। সময় নষ্ট না করে শিফা বললো,

– পাভেল ভাই, না বলে চলে গেলেন কেনো সেদিন? এত ফোন দিয়েছি রিসিভ করেন নি বিপরীতে ব্লক করে দিলেন। আমার অপরাধ কি?

– আমার পিছু পিছু ঘুরা।

– এভাবে বললেন?

– আবেগের বয়সে এমন হবেই। পড় কয়েক মাস পরেই তো পরীক্ষা। মাথা থেকে এসব বাদ দাও।

– পড়বোনা। বলেন কি হয়েছে?

পাভেল কিছুটা দম নিয়ে বললো,

– বস সেদিন কিছুটা অনুমান করে ফেলেছে তোমার কৃতকর্ম। ভেবেছে দোষ আমার। তাই ছেড়ে দিতে বলেছে চিলেকোঠা।

শিফা আঁৎকে উঠলো। ভয় পেয়ে বললো,

– আপনি বলেন নি আমার দোষ?

– না।

– ভাইজান কি মে*রেছে আপনাকে?

– না।

– আমরা বুঝিয়ে বললে ভাইজান শুনবে।

মেজাজ হারিয়ে ধমকে পাভেল বললো,

– তোমার মত অবুঝ পেয়েছো বসকে। কথা বুঝোনা কেনো? আমি তোমাকে পছন্দ করিনা। কেনো পেছনে পড়ে আছো এবং আমার বিপদের কারণ হচ্ছো। বস জানতে পারলে কি করবে তোমার ধারনা আছে? আমার লা*শ খুঁজে পাবেনা এই তল্লাটে। রেহাই দাও আমাকে। দু হাত জোড় করে বলছি মাফ করো আমাকে এসব থেকে। শেফালীর কথা মনে নেই? কি পরিণাম হয়েছে। নোমানকে যত্ন করছে কারণ দোষটা শেফালীর ছিলো। আমাকে মে*রে কুকুর বেড়ালকে দেবে আমার গোস্ত। কারণ দোষটা আমার। নোমান না বুঝে ভুল করেছে। আমি সেই ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে একই ভুল করে অপরাধী হলে সাজাটাও কল্পনাতীত হবে। যাও সামনে থেকে।

চোখের পানি মুছে শিফা হুংকার ছাড়লো,

– বিয়ে করলে আপনাকেই করবো, নতুবা ম*রে যাব।

ছুটে বেরিয়ে গেলো এই মেয়ে। পিলারের সাথে হেলান দিয়ে বেঞ্চিতে বসলো পাভেল। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

– কেনো বুঝতে পারছোনা মেয়ে, এই সম্পর্ক হবার নয়। বাচ্চামি করে সব আদায় করা সম্ভব নয়।

চলবে…