#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৫০.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
গতকালকের তুলনায় আজ পরিবেশ কিছুটা শান্ত। গোলযোগ ডাইনিং টেবিলে। খাবার সার্ভ করতে ব্যস্ত আফিয়া এবং তার সাহায্যকারী নতুন সহকারী কাকলী। নিরবে খাবার খাওয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলছে সুলতানা কবির। চামচের টুংটাং শব্দ টেবিল জুড়ে। রায়হান সাহেব ছেলেকে দু দুবার ডাকার সত্ত্বেও ছেলে আজ অমনোযোগী। ছেলের বৌকে ডাকলেন,
– কি হয়েছে বৌমা?
দিয়া স্বামীকে কিছুটা পরোখ করে শ্বশুরকে জানালেন,
– আমি জানিনা আব্বু।
স্তব্ধতা, নিগূঢ়তা কা*টিয়ে আচানক মাথা তুলে বাবার দিকে দৃষ্টি রেখে প্রতুত্তর করলো,
– আব্বু ঠিক আছি।
চমকে উঠলো সকলে। ঈগল চক্ষু মানবের। গভীর চিন্তায় ছিলো বলে ডাকে সাড়া দেয়নি নিশ্চিত হলো বাকিরা অথচ এদিকেও মনোযোগ। অবশ্য তার পক্ষে এসব সম্ভব। রত্নার দিকে লক্ষ্য করে বললো,
– চাচী আম্মু রাতের মধ্যে কি নিজেকে স্বাভাবিক করতে পেরেছেন তাহির ব্যাপারটাতে?
রত্না আশ্বস্ত করে বললো,
– মেনে নিতে কিছুটা কষ্ট হয়তো বা হতো তবে এখন আর সেই আক্ষেপ নেই। সামান্য বিষয়ে
খোদা তাআলার কাছে পাপের ভাগীদার বানাবোনা নিজেকে। তাহি আমার বড্ড আদরের। হঠাৎ এমন কাহিনীতে খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম বাবা। আশা করি তুমি চাচী আম্মুর উপর ওই ভরসাখানা রাখতে পারো।
টিস্যুতে মুখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। খানিকটা হাসলো।অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনার সাক্ষী হলো সুলতানা মঞ্জিলের ডাইনিং রুম। শিফা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ভাইজান, এই শার্ট পরা ছবিটি কাল আপনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেইজে দেখেছিলাম। শার্টটি কি এলিন আপু গিফট করেছেন? মন্তব্য করেছিলেন, আপনাকে রঙটাতে বেশ মানিয়েছে মশাই।
সকলের চক্ষু অক্ষিপট থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কথার বোমটি এখনই না ফাটালে কি হতো না? এমন বাক্য শুনে নিশব্দ তামশা দেখার জনতা শাহাদ ইমরোজ নয়। কথা না বাড়িয়ে সরাসরি নিজের কামরায় প্রবেশ করে সকলের মুখের উপর ধড়াম করে দরজার খিল দেয়। সুলতানা কবির মেয়েকে রাম ধ/মক দিলেন। শিফার বুঝতে অসুবিধা হলো সে কী ভুল করলো? গাল ফুলিয়ে শিফা বললো,
– এলিন আপুই তো কমেন্ট করলো, ‘আপনাকে রঙটাতে বেশ মানিয়েছে মশাই। বাবার সাথে তর্ক করে শার্ট কিনেছি।বাজিতে জিতে গেলাম।’ আচ্ছা! তবে কি ভাইজান পড়েনি সেই কমেন্ট!
জিভের ডগায় কামড় পড়লো শিফার। কি বলে ফেললো? ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মনে মনে দোয়া জপা শুরু করলো। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে সুলতানা।
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল সকলে। দরজার খোলার আওয়াজটা কানে লাগলো। শার্ট বদলে হাতা গুটিয়ে নিতে ব্যস্ত। পেশীবহুল হাতের বাইসেপ্স ফুলে উঠেছে। কালো শার্টে পূর্বের চেয়ে বেশী সুদর্শন লাগছে, সাথে কালো ফরমাল প্যান্ট। পাভেল উপরে এসে নিরবে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে উদ্দেশ্য করে জানতে চাইলো,
– আমার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্ট কে দেখে?
– বস তুহিন।
– ডিলিট করতে বলবে। প্রচারনার প্রয়োজন নেই। ব্যক্তিগত প্রোফাইল আমি চালাতে জানি।
– জ্বি বস।
পুরো ঘটনা এত সময় নিরবে অবলোকন করলো শাহাদ পত্নী। শেফালীর কোল থেকে শেহজাকে নিয়ে আদর করে দিতেই মেয়ে ঢের আহ্লাদী হয়ে বাবার দু গাল চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছে। সুলতানা কবির প্রশ্ন ছুড়লো,
– এলিন কে বাবু?
কথা কেড়ে নিলো পাভেল।
– আন্টি এলিন মন্ত্রী দেলোয়ারের মেয়ে। নিশাদের বিয়েতে এসেছিলো।
– বাবুর কি সম্পর্ক ওর সাথে?
কথাটি বলা যতটা স্বাভাবিক ছিলো, শোনা ততটাই অস্বাভাবিক। শাহাদ তড়াক করে মায়ের দিকে তাকালো৷ শিফা শুকনো ঢোক গিলছে। শাহাদ পত্নীর চাহনী পরীক্ষা করা দূর্বোধ্য। পারতপক্ষে সে নিজেই মহান ট্রিক্সের অধিকারী। একান্তে পেলে তার মনের ঝড় দমানো যাবে, এই জনসম্মুখে তা অসম্ভব। শাহীন জোরে বোনের মাথায় গাট্টা মে*রে মাকে বললো,
– আম্মু কি আজাইরা পেঁচাল নিয়ে পড়লেন?
এক্ষুনি এই কৌতুহল দমাতে হবে। পরিবারের নিকট নিজেকে গসীপের বিষয়বস্তু বানানো বড্ড অপছন্দের। সহধর্মিণীর দৃষ্টি সূচালো, তীক্ষ্ণ এবং বেশ ঘন গম্ভীর। স্পষ্ট, সুক্ষ্ম, প্রগাঢ় গলায় জানান দিলো,
– থামো মেজর। আমাকে উত্তর দেয়ার সুযোগ দাও। দেলোয়ার স্যার স্নেহের সহিত একটি গিফট সেট পাঠিয়েছিলেন কিছু মাস আগে। আমার পছন্দের ব্র্যান্ডের কিছু পোশাক আর এক্সেসরিস ছিলো। শার্টটি উপহারের একটি অংশ ছিলো। অজানা ছিলো স্যারের মেয়ের পছন্দের। দ্যাটস ইট।
মেয়েকে শেফালীর কোলে দিতে চাইলে যেতে চায়না। উলটো শেফালী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। শাহাদের গলা আঁকড়ে বলে উঠলো,
– বাবা, দাবো।
বাবা দাবো, এটি যেন গুরুত্বপূর্ণ বাণীর মত কানে বাজলো এক্স- কমান্ডার সাহেবের। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে শেহজাকে অনুকরণ করে বললো,
– যাবেএএ?
– বাবা দাবো।
– অবশ্যই যাবে।
যেনো এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো এক্স কমান্ডার এমপি শাহাদ ইমরোজ। বেগমের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বললো,
– মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে বসছি৷ দশ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে মেয়ের প্রয়োজনীয় খাবার,পোশাক নিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে আসো।
সুলতানা কবির প্রশ্ন করলো,
– কই নিয়ে যাবে এদের?
মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
– আপাতত অফিসে। মেয়েকে রেখে কাজ করে শান্তি মিলবেনা আম্মু। আর মায়ের অভাব ও অপূরনীয়। সুতরাং দুজনকেই নিয়ে যাই। থাকুক সারাদিন আজ আমার সাথে।
দিয়া হতভম্ব। পুনরায় প্রশ্ন করার সাহসের সংকুলান। মৃদু ধমক কানে এলো,
– সেভেন মিনিটস লেফট।
সুলতানা ইশারা দিতেই পুত্রবধূ কামরায় ছুটে গেলো। এদিকে শিফা,শেফালী, নওরীন গাল ফুলিয়ে ফেললো। ভাইজান কেনো ভাবীজানকে নিয়ে যাচ্ছেন! সারাদিনের প্ল্যান ভেস্তে দিচ্ছে। দিয়া ছুটে চললো কামরায়। সবুজ রঙের কুর্তিতে নিজেকে তৈরি করে মেয়ের প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাগে ঢুকিয়ে যন্ত্রের মতো ডাইনিং এ এসে দাঁড়ালো। শাহাদ বের হওয়ার আগে বোনদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– তোমরা আয়োজন করো ভাবীমাকে বিকেলের মধ্যে পেয়ে যাবে। বিয়ে রাতে পড়ানো হবে।
বেরিয়ে গেলো ডাইনিং রুম ছেড়ে। কাঁধে মেয়ের ব্যাগ নিয়ে সুলতানার দিকে গোমড়া মুখে তাকিয়ে বললো,
– আম্মু কিছু বললেন না কেনো আপনি?
সুলতানা বেগম হেসে বললেন,
– যাও। বাবু সময়মত চলে আসবে আমি জানি। তুমিও একটু ঘুরে আসো৷ বেশ কিছুদিন হলো তুমি বের হও না।
ঠোঁট উলটে দিয়া নওরীনদের দিকে তাকালো। তিনটি মেয়েরই ভীষণ মন খারাপ। সুলতানা কবির তাড়া দিয়ে বললেন,
– যাও তো বৌমা। বাবুর বকা খাবে দেরি হলে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ মলিন করে বেরিয়ে এলো দিয়া। বাড়ির আঙিনায় লোকজন ভীড় করছে। এখন থেকেই কাজ শুরু। গাড়ির কাছে আসতেই দেখতে পেলো মেয়ের সাথে কত কি বলে রাজ্যের আলোচনায় বসেছে এই গোমরামুখো। সবুজ কুর্তিতে যেনো পাতার মতো দেখাচ্ছে। দেখা মাত্রই ঝুকে বেক ডোর খুলে দিলো। উঠার পর মেয়েকে নিয়ে নিজেও পেছনের সিটে বসে পড়লো। ড্রাইভার গাড়ি টান দিলো। মেয়ের সাথে দুষ্টুমি করতে করতে বললো,
– এলিনকে তুমি চেনো। ওকে নিয়ে মনের মাঝে অপ্রয়োজনীয় চিন্তা খাটানোর দরকার নেই। প্রিয়জন ছাড়া উপহার জিনিসটা অপছন্দের তবে দেলোয়ার স্যার ভালোবেসে দেয়াতে নাকোচ করিনি। উপহারের পেছনে উদ্দেশ্য এবং কার পছন্দে কেনা হয়েছে তা নিশ্চয়ই আমার জানার কথা নয় তাই না?
ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো ঘরনীর দিকে। ওড়নার কোণা আঙুলে পেচাতে পেচাতে ঠোঁট বাকিয়ে উত্তর দিলো,
– আমি কি জানতে চেয়েছি?
– পুনরায় প্রশ্ন করার ধাঁচেই স্পষ্ট কতখানি সন্দেহ জমিয়ে রাখা হয়েছে ছোট্ট মনটাতে। ভেবে কূল পাইনা, যেখানে আমায় নিয়ে সুচিন্তা বাস করার কথা সেখানে সন্দেহের এত দুঃসাহস হয় কি করে?
আঙুলের ডগা থেকে ওড়না ছেড়ে শাহাদের দিকে নাক ফুলিয়ে তাকিয়ে প্রতুত্তর করলো,
– আমি যেসব ছবি দেখতে পাইনা, সেখানে অন্য নারী কমেন্ট করে কি করে? তাও আবার এই জানা সত্ত্বে ও মানুষটা বিবাহিত ও কন্যা সন্তানের জনক।
সূচালো, ধারালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পকেট থেকে ফোন বের করে কললিস্টের পরিচিত নাম্বারে মেসেজ পাঠায়। মিনিট দুয়েকের মাঝে জবাব এলো। মেসেজে পাঠানো নাম্বারে ডায়াল করেই স্পিকারে রাখলো ফোন। নারী কণ্ঠে ভেসে উঠেছে বিপরীত পাশ থেকে। ঘুম জড়ানো কন্ঠ।
– জ্বি মি. শাহাদ ব লু ন? কেমন আছেন?
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ। খুব বেশি কথা বলে বিরক্ত করবোনা। আমার পাঁচ মিনিট সময় লাগবে। দেয়া কি সম্ভব?
– অবশ্যই বলুন।
– ধন্যবাদ। প্রথমত দুঃখিত আপনার সময় নষ্ট করছি। সর্বশেষ বলব, অনেক বড় দায়িত্ব না নিলেও সরকারের বেতনভুক্ত ছোট কর্মচারী। দু চারজন মানুষ মনে হয় চেনে। আমি জানি ব্যপারটিতে আপনি অভ্যস্ত নন। তবুও বলছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বদা সক্রিয়। আপনার একটি মন্তব্য আমার ক্যারেক্টর সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আপনি পছন্দ করে উপহার পাঠিয়েছেন ব্যাপার টা আমার জন্য লজ্জাজনক। আমি পরিবার ব্যতীত অন্য রমনীর উপহার গ্রহন করতে বিচলিত ও বিব্রত বোধ করি। ভবিষ্যতে আশা করছি এসব কাজ হবেনা আমার সাথে। আপনি কি ধরতে পেরেছেন আমার পয়েন্ট অফ ভিউ?
এলিন লজ্জ্বা পেয়ে বিস্মিত হলো। ভাষা হারিয়ে এক বাক্যে বললো,
– স্যরি মি. শাহাদ। আর এমনটা হবেনা। আমি বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা এভাবে ছড়াবে।
– রাখছি।
ফোন কে*টে পকেটে পুরে রাস্তায় চোখ দিলো। দিয়া মনে মনে শান্তি পেয়ে গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হাসছে চুপি চুপি। ঘাড় ঘুরিয়ে শাহাদ দেখতে পেলো প্রিয়তমা স্ত্রী প্রাণোচ্ছল হাসি। কি করে রেখেছিলো মুখটাকে এতক্ষন? গাড়ির মাঝে পুচকি ঘুমিয়ে পড়েছে বাবার বুকে। পার্টি অফিসের সামনে গাড়ি থামতেই গাঢ় স্বরে বললো,
– কতখানি হীনমন্যতায় ভুগতে হয় এমন আগুন সুন্দরীকে সাথে নিয়ে ঘুরলে, শাহাদ ইমরোজ না হলে বুঝা দায়। নিজের দিকে তাকালে লজ্জা লাগে, কোথায় ইরানী সুন্দরী আর কোথায় ব্ল্যাক প্যান্থার! মুখ ঢাকো নতুবা মাস্ক পরো।
হতবাক দিয়া হা সদৃশ মুখ করে চোখের পলক ঝাপটাচ্ছে। কি বললো? ব্ল্যাক প্যান্থার! ইয়া আল্লাহ শেষমেষ কালা চিতা? ঠোঁট বাকিয়ে দিয়া বললো,
– তবুও তো দম্ভ কমেনি। ব্ল্যাক প্যান্থার না বলে ব্ল্যাক বেঙ্গল ও তো হতে পারতো। হুহ!
শাহাদ ভ্রু কুচকে বললো,
– এক মিনিট। ব্ল্যাক বেঙ্গল মানে তো ছাগল।
– আমি ও তো তাই বললাম। বিড়াল তো বলিনি।
– কিহ?
অধর প্রসারিত হাসি দিলো দিয়া। আচ্ছা জব্দ করেছে এমপি কে। পরনের ওড়না মুখে পেচালো। ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করে চোখে দিলো।
শাহাদের ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি যেন বলে দিচ্ছে সহধর্মিণীর প্রস্তুতি তাকে মুগ্ধ করেছে। এখন সহধর্মিণী তাকে ব্ল্যাক প্যান্থার ভাবলেই কি আর ব্ল্যাক বেঙ্গল ভাবলেই কি?চোখ মুখ মাথা সবই ঢাকা। পার্টি অফিসের প্রবেশ করতে সকলে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আপাদমস্তক ঢাকা মানবীকে দেখে চমকে উঠেছে উপস্থিত জনতা। প্রশ্ন করার সাধ্য নেই। কোলে সুন্দর রাজকন্যা দেখে সবাই ধরে নিয়েছে স্যারের সহধর্মিণী। শাহাদ স্ত্রী-কন্যা নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
রুমে এসেই শাহাদ স্ত্রীকে বসিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– ম্যাডাম আমি ব্ল্যাক প্যান্থার হলেও সহ্য করতে হবে, আর বেঙ্গল হলেও সহ্য করতে হবে কিন্তু দিনশেষে তালগাছ আমার।
___
দেখতে দেখতে মধ্যাহ্ন পেরিয়ে অপরাহ্ন, হৈ হৈ রব চারদিকে, আত্নীয়রা সবাই ভিড় করছে। মঞ্জিলা ছুটে এসেছে ভাতিঝার বিয়ে, নিশাদ এসেছে বউ নিয়ে।কেবল নিকট আত্নীয় দিয়েই ভরে যায় সুলতানা মঞ্জিল। দিয়া ফোনালাপে জানিয়েছে সে ফিরছে। গায়ে হলুদের জন্য সবাইকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। তাহি নিরব দর্শক। দু চোখ ভর্তি অবাধ জল। অনুভূতি শূন্য। কি হতে যাচ্ছে জীবনে। যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে তার নামের সাথে নিজের নাম বেঁধেছে। যার সাথে মজার ছলেও আলাপ জমায় নি সে হতে যাচ্ছে একান্ত সুখ-দুঃখের সঙ্গী। গত কাল থেকে আজ অবধি লিমন- তাহি কেউ কারো সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। সকালে নাস্তার টেবিলে এক পলক দেখেছে একে অপরকে। দুজনই আজ দ্বিধায় আক্রান্ত। হুড়মুড় করে শিফা,নওরীন,শেফালী,নিশি এবং নিশাদের বউ প্রবেশ করলো। ঢুকেই দিয়ার সাথে কথা হয়েছে জানিয়ে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাহি নিরবে সব দেখে যাচ্ছে। দুহাত ভর্তি মেহেদী। হাতে আজ লিমনের নাম। যে হাতে চার বছর আগে রাশেদের নাম ছিলো আজ সেই হাতে লিমনের নাম। হাতের দিকে তাকাতেই টুপ টুপ করে পড়ছে চোখের জল। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। মেয়েরা ফিরে দেখে লিমন দাঁড়িয়ে আছে। শেফালী লিমনকে ডেকে বললো,
– কি হয়েছে দুলাভাই, আপনার এখানে কী কাজ?
লিমনের মুখাবয়ব বলে দিচ্ছে ছেলেটা মজা করার অবস্থায় নেই। তবুও একটু শক্ত হয়ে বললো,
– আপা দশ মিনিট কি সময় দেয়া যাবে? আমার কথা ছিলো উনার সাথে।
শেফালী নওরীনের দিকে চেয়ে চোখের ভাষায় বুঝালো। নওরীন ব্যাপার সিরিয়াস বুঝে সবাইকে বুঝালো উঠে আসতে। সকলে বেরিয়ে যেতেই লিমন দরজা আটকে দিলো। শান্ত, স্থির, ধীর পায়ে এগিয়ে এসে খাটে তাহির মুখোমুখি বসেছে। সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে কি নামে সম্বোধন করতে হয় মস্তিষ্ক ফাংশন করা বন্ধ করে দিয়েছে। দশ মিনিট সময় চেয়ে নিয়েছে। সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। লিমন দম ফেলে বললো,
– ডাক্তার সাহেবা কিছু কথা ছিলো, আপনার কি সময় হবে?
পুরুষালী স্বরে পরিচিত সম্বোধন পেয়ে সম্বিত ফিরল তাহির। লিমনকে কামরায় দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। ঢোক গিলে আশপাশে দেখছে। লিমন আশ্বস্ত করে বললো,
– চিন্তিত হবেন না, চলে যাবো। দশ মিনিট সময় নিয়ে এসেছি। কিছু কথা ছিলো অনুমতি কি পাবো?
দু হাতে চোখ মুছে তাহি মাথা নাড়লো। সম্মতি পেয়ে লিমন চোখ বুজে বললো,
– আপনি কি আমার সাথে সংসার করতে পারবেন?
প্রশ্ন করেই লিমন চুপ। অন্যদিকে তাহি লিমনের বুজে থাকে চোখের দিকে তাকিয়ে, নিজেকে প্রশ্ন করছে সে কি সত্যি পারবে? সময় ছুটছে। তাহি বাচ্চা নয়। যা করেছে ভেবে চিনতে করেছে। কাটকাট উত্তর দিলো,
– পারতে হবে। অন্য কোথাও হলেও করতে হতো।
চোখ খুললো লিমন। খানিকটা হেসে হাত বাড়িয়ে বললো,
– পারতে হবে না। অন্য কারো কথা জানিনা। লিমনের একমাত্র লোভ ডাক্তার তাহির বন্ধু হয়ে তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা। তাহি শুধু হেসে মিষ্টি করে দুটো কথা বললেই হবে। তবে একটা অনুরোধ বিয়ে যেহেতু করেছি সংসার নামের শব্দে আবদ্ধ হচ্ছি। একটা আবদার প্রতিদিন একবেলা ভাত আমার সাথে বসে একসাথে খাবেন। আমি সারাদিনের জমিয়ে রাখা গল্প শুনাতে চাই, অফিসের কোন কলিগের সাথে ঝগড়া করেছি, কোন ফাইলে ভু ল করেছি, বসের কি বকা খেয়েছি আর কোন মেয়ে আমার সাথে ফ্লার্ট করেছে এসব। রাজি?
তাহি নড়েচড়ে বসলো। প্রতিটি আবদার সুন্দর, সাবলীল। হয়তো নিজেও সহজ হচ্ছে, তাহিকেও সহজ করার প্রচেষ্টা। কি নাম দিবে এমন সম্পর্কের?
তাহি প্রশ্ন করলো,
– কি চাইছেন বলুন তো?
লিমনের অধর আলগা হয়ে গেলো। কনিষ্ঠ আঙ্গুল কানে ঢুকিয়ে কান পরিষ্কার করার ভঙ্গি করে
আশপাশে তাকিয়ে বললো,
– জ্বি! আমাকে কিছু বলেছেন?
– আপনি ছাড়া রুমে আর কে আছে?
– এহ! আপনি!
তাহি অসন্তোষ প্রকাশ করলো লিমনের না বুঝার ভাণ দেখে। ভ্রু কুচকে বদন জুড়ে বিরক্তির চাপ নিয়ে এলো। লিমন ঠোঁট চেপে বুঝার চেষ্টা করছে তাহিকে। চট করে বললো,
– ডাক্তার তাহি আমার কি প্রমোশন হলো?
– এত চ*ড় থাপ্পড় খেয়েও শিক্ষা হয়নি? আমি কি এখন আমার স্বামীকে তুমি ডাকবো? তবুও ডাকতাম যদি সে আমাকে তুমি ডাকতো। জনসম্মুখে ডাক্তার তাহি,ডাক্তার সাহেবা বলা হয়, সেখানে তুমি সম্বোধন করে তাকে অসম্মান করতে পারবো না।
বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় লিমন। চোখের পলক ঝাপটে তাহিকে বার বার দেখছে। খানিকটা হেসে বলে,
– আপনি ভাইজানের কথাটা সিরিয়াসলি নিলেন? উনি শ্রদ্ধা করতে বলেছে তাই আপনি সম্বোধন করছেন?
– তার আগেই আমি শুধরে নিয়েছি। আমি সেদিন আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাবেও আপনি সম্বোধন করেছি মনে করে দেখুন।
লিমন মনে করে দেখলো সত্যি সেদিন তাহি ‘আপনি’ সম্বোধন করেই এমনই এক প্রশ্ন করেছিলো, লিমন এই মুহুর্তে বিয়ে করবেন আমায়? না তাহলে ঠিক আছে এই মেয়ে মন থেকেই সম্মান করছে। লিমন সোজা সামনের দিকে হেঁটে দরজা বরাবর অগ্রসর হলো। আচানক ঘুরে বললো,
– ডাক্তার সাহেবা একটা কথা?
– কি?
– আমি কি বেশি ছোট? মানে আপনার সাথে কি বড্ড বেমানান?
– আপনি ছোট কে বললো?
– আপনিই তো বলেন।
– নিজেকে প্রশ্ন করুন। উত্তর কি মিলে দেখুন। আমি বলতাম স্যাটায়ার করে। বয়স কি কম হয়েছে আপনার?
এক পেশে হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে বললো,
– ধন্যবাদ। তৈরি থাকবেন। আজ আপনাকে সবচেয়ে সুন্দর রূপে দেখতে চাই৷
– অধিকার?
– উঁহু, বলতে পারেন লিমনের এক পাক্ষিক ভালোবাসা। তবুও শান্তি। তাহি আমার…
বেরিয়ে গেলো দরজা খুলে। কানে বাজলো মুগ্ধ স্বর, তাহি আমার! মানুষটার হাসি সুন্দর।
স্মৃতি মুছেনা। তাহি নিজেকে শান্ত করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। বুঝাচ্ছে, তাহি তুই দুনিয়াতে বাস করিস, এখানে তো সঙ্গী প্রয়োজন। ছলে বলে কৌশলে তোকে সকলে আঘাত করেছে, সেদিন হাসপাতালে অপ্রীতিকর ঘটনা কতেছে,বাড়িতে হামলা হয়েছে। একটু সময় করে হলেও পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। মনে পড়ে গেলো, আম্মার কথা। যে কথা কেউ জানেনা। তাহিকে সেদিন পালিয়ে যাবার বুদ্ধি দিয়েছিলো মেহেরজান আম্মা। রাশেদের স্মৃতি নিয়ে প্রায়ই আম্মার সাথে দেখা করতে যেত। আম্মার বুদ্ধিতেই সেদিন হুটহাট এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। ফোন কেঁপে উঠলো। হাতে নিতেই শেফালী অন্যদের নিয়ে ঢুকলো। আঙুলের ইশারায় গুরুত্বপূর্ণ কল বলে বারান্দায় এলো। সালাম দিতেই ও পাশ থেকে ভেসে এলো স্বর,
– আম্মাজান ভালো আছো?
– জ্বি আম্মা আপনি?
– ভালো আছি। আমার ছেলেটা কেমন আছে?
– আছে ভালোই।
– শুনো আম্মা। আমার রাশেদ গেছে তো কি হইছে লিমন আছে। ছেলেটা আমাকে অনেক মায়া করে। দেখতে আসতে চায়। আমি মানা করি। আমি নিজেই দেখা করি রেস্টুরেন্টে গিয়ে। আমার জায়গাটা তো ভালোনা। এখানে সে আসলে লোকে গাল মন্দ করবে। তা এমপি সাহেব কি সব মেনে নিছে?
– জ্বি আম্মা।
– শুনো আম্মা,আর জীবনে পিছে ফিরোনা। আমার দূর্দশা হয়েছে একা থেকে। আমি একা ছিলাম বলে ফরিদ আমাদের মা ছেলেকে শেষ করেছে। আমি চাই না তোমার জীবনেও কোনো ফরিদ, খালেদ পারভেজের মত কালো ছায়া পড়ুক। এর আগেই কেউ আগলে নিক। আমি লিমনের মাঝে রাশেদকে দেখি; তোমাকে আগলে নেয়ার, ভালোবাসার অধিকার দেখি; যার তার হাতে তো আর এমনি এমনি রাশেদের সম্পদ তুলে দেবোনা আমি! অনেক ভেবেই বলেছি বিয়েটা লিমনকেই করো। ও জানে তোমার কদর। তোমাকে তোমার মতো মেনে নেবে। কষ্ট দিও না,কষ্ট পেওনা। অতীতকে শক্তি বানিয়ে ভবিষ্যতকে সাজাও। আমরা সবাই তোমাদের সুখ দেখতে চাই।
– জ্বি আম্মা দোয়া করবেন, যেন সব ধাক্কা সামলে নিতে পারি।
– আমিন। আমি আসবো কিছুক্ষন পর।
– সত্যি আম্মা!
– হ্যাঁ এমপি সাহেব নিজে এসেছেন আমাকে দাওয়াত দিতে। কেমন অসম্মানজনক কাজ হলো, উনি আমার কুঠিতে এসেছেন বৌমা আর ছোট্ট নাতনীটাকে নিয়ে আমাকে দাওয়াত দিতে। আমার লজ্জ্বা লেগেছে। যদি না যাই ব্যাপারটা কেমন অপমান জনক। তুমি আজ সাজো। খুব সুন্দর সাজো। দুনিয়া দেখুক, আমার রাশেদ তোমার মাঝেই ভালো থাকবে। তুমি আজ হাসবে, আমি আজ হাসবো। মেয়ের বিয়ে দিব। অনেক খুশি থাকবো আমরা। রাশেদ চোখ মেলে শান্তি দেখবে আজ। তার মা আর প্রিয়তমা ভালো আছে।
ঝরছে অশ্রু, র*ক্ত ঝরা ব্যাথা হৃদয়জুড়ে। দুটো মানবীর হাহাকার। আজই হয়তো শান্তি পাবে হৃদয়। সব কিছুর শেষ আছে। কথা শেষ করে তাহি রুমে আসলো। তাহিকে বসিয়ে সাজাতে ব্যস্ত মেয়েরা। দ্রুত গতিতে পা ফেলে রুমে ঢুকলো লিমন। সরাসরি তাহির পায়ের কাছে বসে ওর হাত দুটো শক্ত করে ভেজা চোখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো,
– ডাক্তার তাহি ফরিদ রেজা মা*রা গিয়েছে কিছুক্ষন আগে। শেষ পর্যন্ত অপমানে যন্ত্রণায় ম*রেছে। মানুষের মৃত্যুতে খুশি হতে নেই। তবে আজ আমি খুশি, মা*রা যাওয়ার আগে নাকি সর্বোচ্চ পাগলামি করে ম*রেছে। চিৎকার দিয়ে বলেছে নাকি রাশেদ ভাইকে ম্যানিপুলেট করার কথা, তার মাকে নিয়ে বাজে কথা। পাগলামির ঝোঁকে সব উগলে দিয়ে সকলের সামনে। বলুন তো এখন আমাদের কি করা উচিত? আজকের দিনটা আমার কাছে সেরা একটি দিন।
চোখে পানি সকলের। ফুফিয়ে কাঁদছে তাহি। বাড়ির বড়রা ছুটে এসেছে তাহির রুমে। পাপের বিনাশ দেরিতে হলেও হয়, উৎকৃষ্ট প্রমান এই ফরিদ। লিমন উঠে দাঁড়িয়েছে। চুপচাপ বেরিয়ে এসেছে কামরা ছেড়ে। তাহির ভেতরে জমা কষ্ট বেরিয়ে আসুক। মেয়েটা জোরে কাঁদছেনা। কাঁদুক, মনের সব কষ্ট মুছে যাক। ভালোবাসার মানুষ হা*রালে কত কষ্ট যার হা*রায় সেই বুঝে। লিমন ও আজ খুশি। তাহি শান্তি পাবে, আম্মা শান্তি পাবে।
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৫১.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
মেয়েকে তৈরি করে মনোযোগ দিয়ে দেখছে দিয়া। দোয়া পড়ে ফুঁ দিলো মেয়ের শরীরে যাতে বদ নজর না লাগে। এই প্রথম ছোট্ট শেহজা ফুফি-চাচ্চুর বিয়েতে লাল লেহেঙ্গা পরেছে। মেয়ের ঝাঁকড়া চুলে ফুল পেঁচিয়েছে। ঘুরে ঘুরে খাটের উপর লাফাচ্ছে। দিয়া হিমশিম খাচ্ছে মেয়েকে নিয়ে। পাশ থেকে একটা খেলনা নিয়ে খেলতে বসিয়ে দিলো। এই সুযোগে নিজে তৈরি হয়ে নিচ্ছে। বাকিরা বাইরে সাজছে।
তাহির শরীরে কিছুক্ষন আগে মা,খালা হলুদ ছোঁয়ালেন। খুবই সাধারণ ঘরোয়া হলুদের আয়োজন ছিলো। সন্ধ্যা হতেই বিউটিশিয়ান এসে সাজানো শুরু করেছে। দিয়া সেজেছে আজ বাঙালী রাজবধূ সাজে। হাতে মোটা মানতাশা, রতনচুড়, গলায় বাহারী সিতা। মেজেন্ডা পাড়ে জরি সুতায় জড়ানো কালো কাতানের প্রতিটি কুচি থাকে থাকে সাজানো। এক হাতে ফুলের গাজরা। শেহজা ছটফট করছে। হাঁটা শেখার পর থেকে একটুখানি চুপচাপ বসতে নারাজ মেয়েটা। মেয়েকে অতিষ্ট হয়ে মৃদু ধমক দিলো,
– শেহজা, চুপ করে বসো। এমন করছো কেনো? বাইরে নিবোনা। পিট্টু দিব বলে দিলাম।
চোখ রাঙিয়ে তাকায় মেয়ের দিকে। মেয়ে গাল ফুলিয়ে টলমল চোখে উচ্চারণ করে,
– বাবা দাবো, বা বা আ আ আ আ।
ফোনে কথা বলতে বলতে উদয় হলো স্ব কামরায়। চাবি দিয়ে নিজেই লক খুললো কামরার। গলার ভারী আওয়াজে স্পষ্ট, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে ফোনে৷ আয়নায় শাড়িটি ঠিক করে মেয়েকে খাটে দাঁড় করিয়ে মেয়ের পোশাক ঠিক করে দিচ্ছে। অন্যদিকে আহ্লাদী কন্যা বাবা আসার আলামত পেয়ে গলা ছাড়লো পূর্বের চেয়ে তীব্র আওয়াজে। কান থেকে ফোন খানা নামিয়ে ত্রস্ত্র পায়ে এগিয়ে প্রথমে নজর পড়লো কন্যার দিকে। দ্রুত পা চালিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে সহধর্মিণীকে বললো,
– শুরু হয়ে গেলো ঝাড়াঝাড়ি…
থেমে গেলো চলন্ত অধর। প্রেয়সীর একি রূপ! এত এত রূপে ভস্ম হলো, এই রূপ তো অচেনা। রাজ বধূ লাগছে। স্বর্ণে মুড়িয়েছে আজ নিজেকে। শুকনো ঢোক গিলে মেয়ের দিকে ফিরে মেয়ের চোখ মুছে দিলো। মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
– আম্মাজান আপনি ঠোঁটে লাল রঙ লাগিয়েছেন?
কি নাটুকে মেয়ে! বাবাকে দেখে তার ঠোঁটে হাসি। এদিকে চোখ এখনো পানিতে ছলছল। যে কেউ দেখলে এক্ষুনি বলে দিবে এই মেয়ে কাঁদছে। শেহজা ঠোঁটে তর্জনি দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে বলে,
– মা ইবিত্তিক।
শাহাদ মেয়ের কথায় হো হো করে হেসে বলে,
– আপনার ইবিত্তিক সুন্দর আম্মা। মা ইবিত্তিক লাগিয়ে দিয়েছে?
শেহজা ঠোঁট উলটে দেখাচ্ছে,
– ইবিত্তিক লাল
হাতের মেহেদী দেখাচ্ছে,
– মিদী লাল, তেজা লাল।
মানে লিপস্টিক লাল, মেহেদী লাল, শেহজা লাল। একটু করে সব কিছু বুঝতে শিখছে দু বছরের শেহজা। শাহাদ মেয়ের কথায় সায় দিয়ে বলে,
– সব লাল, শুধু শেহজার মা গোলাপী। চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য্য।
মেয়ের দিকে তাকিয়েই এসব বলছে। দিয়া ভ্রু কুঁচকে ভাবছে মানুষটা তার দিকে না তাকিয়ে কেনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলছে? শাহাদ গলা ঝেড়ে বলে,
– যে সাজে সেজেছো চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে, ভাগ্যিস ইনভাইটেড গেস্টরা সবাই কাছের, নিজেদের আপনজন।
দিয়া নিজের দিকে তাকিয়ে বলে,
– কি এমন সেজেছি, এমন ভাবে বলছেন মনে হয় যেন আমি আসামী।
– মা/রাত্মক অপরাধী তুমি, অন্তরদহনের গন্ধ পাওনা?
বৃদ্ধা আঙ্গুলে ঘষে চট করে টকটকা রানী গোলাপি রঙের লিপস্টিক মুছে দিলো রমনীর অধর থেকে। দু ঠোঁটের মাঝে দূরত্ব এলো মানবীর। হা হয়ে গেলো মুখ গহবর। মানুষটা লিপস্টিক শুদ্ধ বৃদ্ধাঙ্গুল নাকের কাছে নিয়ে সুবাস বোঝার চেষ্টা করলো। মুখে বিরক্তিকর শব্দ করে বলে উঠলো,
– মাঝে মাঝে সব কিছু বেশি বুঝি, কি দরকার ছিলো আঙ্গুলে লিপস্টিকটা মোছার? অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে লিপস্টিকটা আঙুলে না মুছে অনুভুতিকে আশকারা দিয়ে ঠোঁট দিয়েই মুছলেই পারতাম! ইশ!এখন আর বলে কি লাভ! যা ভুল করার তো করেই ফেলেছি। ঘড়িতে বাজে আটটা, বসে থাকতে হবে বারোটা অবধি, মর্মে মরিবে হৃদয়।
ফোস করে দম ছেড়ে পুনরায় বললো,
– বাই দ্য ওয়ে, হালকা রঙা লিপস্টিক লাগিয়ে নাও। যার দেখার সে দেখে নিয়েছে গোলাপিতে কুইন ফারাহ্ লাগছিলো। বাকিরা দেখার প্রয়োজন নেই। আমি শেহজাকে নিয়ে ডাইনিংয়ে যাচ্ছি। দেখি ওদিকে কতদূর হলো।
চক্ষুচড়ক গাছ শাহাদ বধূর। স্বামী মানুষটা তাকে দেখিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলে ঠোঁট ছুঁইয়ে জিহবা লাগিয়ে বললো,
– টেস্টলেস। আই প্রেফার মাই পারসোনাল বার্মিজ গ্রেইপ।
দু অধর আলগা করে বিস্মিত মানবী। এই মানুষটা একেকবার একেকরকম কাজ করে। এ রূপের ব্যাপারে যদি পরিবার, বন্ধু সমাজ জানতে পারে হয়তো তাদের মাঝে অনেকের মিনি হার্ট অ্যাটাক আসতে পারে।
ঠোঁট উলটে কাঁদো কাঁদো ভাব করলো দিয়া। চোখ দুটো ছলছল করছে। অনেকটা সময় নিয়ে আজ আউটলাইন করে লিপস্টিকের কয়েকটি শেড মিলিয়ে প্রপার শেড দিয়েছিলো। লোকটা এসে সব ভেস্তে দিলো। দিয়ার করুন অবস্থা দেখে শাহাদ ঠোঁট কামড়ে হাসছে। হায়! লিপস্টিকটা মোছাতে বেচারীর অবস্থা দেখার মতো হলো। শাহাদ যেতে যেতে বললো,
– এটা তোমার শাস্তি ফারাহ্ শাহাদ। কিছুক্ষন আগে না আমার মেয়েটাকে কাঁদিয়েছিলে না।
__
লিভিং রুমে বাড়ির পুরুষরা সবাই। সাথে আছেন কাজী সাহেব। তাহিকে বিয়ে পড়ানোর পরই আনা হবে। রুমে সবার গমগমে অবস্থা। কাজী এসে পাশে বসেছে। সেদিন ও এতটা নার্ভাস লাগেনি আজ যতটা কষ্ট ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। সকলের আড়ালে বলাতে সেদিন মনে হয়েছিলো হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। অথচ একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি মাত্র, তবে কেনো আজ এতটা বিচলিত লাগছে। হৃদ স্পন্দন বেড়ে চলেছে ক্রমশ। কাজী সাহেব বারবার কবুল বলতে বলছে। অথচ তাহি নিরব। কামরা ভিড় ঠেলে শাহাদ সোজা সোজি একটা চেয়ার টেনে তাহির বরাবর বসলো। তাহির মাথায় হাত রাখতেই মেয়েটা সজোরে কেঁদে দিলো। স্বাভাবিক স্বরে শাহাদ বলে উঠলো,
– তাহি কবুল বলো। আল্লাহ যা করেন সবই মঙ্গলজনক। সময় নষ্ট করা তোমায় সাজেনা। সময় নিয়েই তোমার কাজ, এক মিনিট দেরী হলে যেমন তোমার রোগী ছটফটিয়ে শেষ হয়ে যায় ঠিক তেমনি প্রতিটি মিনিটের গুরুত্ব অসীম। শুভকাজ শেষ করো। আমি আছি পাশে। কবুল বলো।
বড় বড় নিঃশ্বাস টেনে তাহি কবুল বললো। কাজী কলম এগিয়ে দিলে স্বাক্ষর করে দেয়। কাজী বেরিয়ে গেলো লিমনের কাছে কবুল শুনে সই নিয়ে বিয়ের পর্ব শেষ করে।
শাহাদ নিজ হাতে বিয়ে দিলো তাহির। সবটা স্বাভাবিক। আচমকা শাহাদ উঠে দাঁড়ায়। বেডরুমে এসে দরজা আটকে দিলো। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। মনে হলো যেন একটা সাদা চকচকে হোয়াইট বোর্ডে লিখা স্মৃতি গুলো বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে। ড্রয়ার থেকে ছবিটা বের করতেই টুপটুপ করে বারির ন্যায় ধারা বেয়ে পড়ছে নেত্র বেয়ে কাচের ফ্রেমের উপর। হাস্যজ্বল মানুষটা। নাক টেনে ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি কথা রেখেছি রাশেদ। তোর তাহির একটা ব্যবস্থা করেছি। গত কটা দিন এত পরিমাণ অশান্তিতে কেনো রেখেছিস আমাকে? শান্তিতে চোখ দুটো বুজতে দিস নি। চোখ বুজলেই মনে হতো এসে বলছিস তাহির যেন একটা ব্যবস্থা করি। এখন তোর কি হবে? কে ভাববে তোকে নিয়ে। আমি আর আম্মা ছাড়া তো আর কেউ রইলো নারে? সবাই ভাবে শক্ত পোক্ত কঠিন পুরুষ শাহাদ। তুই তো জানিস আমি কত ভঙ্গুর। অন্যরা বলে শাহাদ ইমরোজের শরীর জুড়ে ক্রোধ অথচ আমি মন খারাপ হলেই তোর কাছে গিয়ে গাল ফুলিয়ে রাখতাম৷ তোকে জড়িয়ে কাঁদতাম। সেদিন কেনো বেঁচে গেলাম আমি? আমার বন্ধু রাশেদ
হা/রিয়ে গিয়েছে। জানিস ফরিদ ম*রাতে সবাই খুশি অথচ আমি খুশি হইনি৷ ও আরো কয়েকটা বছর বাঁচতো আর ম*রনের তীব্র যাতনা সহ্য করতো। রাশেদ তোর ‘কিং অভ ওয়েভ’ এর সাহস হারিয়েছে, আলবাট্রস আর আগের মত উড়তে পারেনা। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে বন্ধু। আমি তাহিকে লিমনের হাতে তুলে দিই নি মনে হয়েছে রাশেদকে চিরতরে হারিয়েছি। অথচ কেউ বুঝলোনা রাশেদের জায়গার ক্ষতিপূরণ অপূর্ণ থেকে যাবে। তবে আমার লিমনকে মাফ করে দিস বন্ধু। ও পাগলের মতো তোর তাহিকে ভালোবেসে ফেলেছে।
দরজার খটাখট আওয়াজ পেয়ে চোখ মুছে ফ্রেম পুনরায় ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলো। দরজা খুলেই দেখতে পেলো সহধর্মিণীকে। খানিকটা হেসে বললো,
– কোনো সমস্যা?
দিয়া প্রশ্ন ছুঁড়লো,
– মন খারাপ?
– উঁহু।
বেড সাইড টেবিল থেকে ফোন নিয়ে উঠে বললো,
– চলো।
সামনে এগিয়ে শাহাদের হাত ধরে যাওয়া আটকে দিলো। শাহাদকে ধরে খাটে বসিয়ে রুমের দরজা আটকে দিলো। চোখ মুখে স্পষ্ট যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা বিয়োগের,বিষাদের, চির শূণ্যস্থানের। মানুষটার গালে ডান হস্ত ছোঁয়াতেই, সেই হস্তে মুখের ভার ছেড়ে দিলো। দিয়া দু হাতে দু গাল ধরে অবলোকন করার চেষ্টা করছে। নিরবতা, নিস্তব্ধতা ব্যতীত সকল ধরনের শব্দ কামরায় অনুপস্থিত। ভেতর থেকে মানুষটা গুমরে যাচ্ছে৷ কাউকে হারানোর কষ্ট প্রকাশ করতে না পারাটা অসহনীয় মানসিক যন্ত্রনা দেয়। স্বামীর মাথা বুকে চেপে ধরে আশ্বস্ত করলো,
– লিমন ভাইয়া, আপুকে ভালো রাখবে এমপি সাহেব।
এই ভরসা চেয়েছিলো এতটা সময়। দু হাতে প্রেয়সীর কোমড় জড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে ছোট্ট নরম হস্তদ্বয়ের মধ্যিখানে। মুখনিঃসৃত বাক্যরা যেন আজ ঝংকার হারালো, শব্দেরা তাল লয় তুঙ্গে তুলে সুর হারিয়েছে। দিয়া স্বামীর মাথা তুলে বললো,
– শেহজা দেখলে বলতো বাবা কাঁদে না, আতো আদর কলে দিই।
শাহাদ দিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। দিয়া শাহাদের দুচোখে হাত রেখে কপাকে উষ্ণ পরশ দিয়ে বললো,
– আপনাকে মানায় না এমন ভঙ্গুরতায়। আপনি থাকবেন পাহাড়ের মত অটল, পাথর মত কঠিন এবং…
– এবং…
– এবং ভালোবাসা দেয়ার মত কোমল।
– লোভ তাই না? গ্রিডি লেডি। ইট’স নট ফেয়ার।
– সামলাতে পারিনা সেই লোভ।
দুজন মিলে হেসে দেয়। এই প্রস্তর কঠিন মানবকে সামলানোর জন্য কোমলতাময়ী মানবী যথেষ্ট।
___
বাগানে ঘরোয়া অতিথিদের ভিড়। মাঝে কিছু সংখ্যক শাহাদ এবং শাহীনের বন্ধু এসেছে। শাহাদের বন্ধুরা আলোচনায় বসেছে। পূর্ব পরিচিত সকলে। পাইলট র কানিজ রোকসানা শাহীনের বিয়েতে ও এসেছিলো। দিয়াকে দূর থেকে আসতে দেখে শাহাদকে একটু পিঞ্চ দিয়ে বললো,
– বাবু মশাই, এই অনন্ত যৌবনা নারীকে নিয়ে ভালোই দিনকাল কাটছে তবে এদিকে যে একখানা পত্র পাঠানো হলো বন্ধু মহল থেকে তা কি গিন্নীকে জানিয়েছেন? নাকি একেবারে ঘরের ছেলে, বউয়ের বাধ্যগত সোয়ামী হয়ে বাকি জীবনটা মা বৌয়ের আঁচলের তলে কাটাবেন ভাবলেন। তাতে অবশ্য দোষের কিছু নেই মানে আমরা শুধু জানতে চাইলাম আর কি আপনি যাবেন?
কথার মাঝেই লক্ষ্য করলো এক্স কমান্ডারের চোখ হাসছে, সকলের তার চোখ অনুসরণ করে সম্মুখে চেয়ে দেখে শাহাদপ্রিয়া শাড়ির কুচি ধরে ধীর পায়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। তাহলে এক্স-কমান্ডারের নজর বুঝি তাতেই নিবদ্ধ! চোখের ভাষায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। দিয়া সামনে চলে এসেছে। সবাইকে দেখে সালাম দিলো। ডাক্তার মল্লিকা হেসে জড়িয়ে ধরলেন। ঠোঁটের কোণে হাসি দিয়ার। চিকন স্বরে শুধালো,
– ভালো আছেন আপু?
মল্লিকাও ভালোবেসে জবাব দিলো,
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাবী। আপনাকে মিস করছিলাম এতক্ষন। আপনার কথাই হচ্ছিলো।
– আমার কথা?
ব্যারিস্টার মনিরুজ্জামান আগ বাড়িয়ে বললেন,
– রাজকন্যাটি কোথায় ভাবীসাহেবা?
– আম্মুর কাছে, আচ্ছা দুষ্টু হয়েছে। সকলকে নাস্তানাবুদ করে রেখেছে। বাড়ি জুড়ে ছুটোছুটি করছিলো। একজন আত্নীয়ের বেবি আছে তার সাথে খেলা করছে। আম্মু,আব্বু পাহারায় বসে আমাকে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন। চলুন খেতে বসবেন।
কমিশনার রকিব হালদার আচমকা কেশে উঠলো। শাহাদের মনোযোগ বিচ্যুত হলো। এতক্ষন এই পুরুষ তার চোখ নিবদ্ধ করেছিলেন আপন রমনীতে। ধরনীতে সংঘটিত বাকি ঘটনায় তার মনোযোগ শূন্য। রকিবের দিকে তাকাতের সে বললো,
– মানে ভাবী একটা কথা বলতাম?
দিয়া সেদিক ফিরে নম্রতা নিয়ে বললেন,
– জ্বি ভাইয়া বলুন।
– আমরা একটা ট্যুরের প্ল্যান করছি শাহাদ কি অনুমতি পাবে যাওয়ার?
চোয়াল ঝুলে গেলো দিয়ার। হতবাক হয়ে বিনা বিলম্বে প্রশ্ন করলো,
– আমাকে জিজ্ঞেস করছেন ভাইয়া?
বাকিরা একে অন্যের মুখ চেয়ে অবাক চোখে দিয়ার দিকে তাকালো। শাহাদ সেই ভ্রম ভেঙ্গে বললো,
– ম্যাডাম আপনার কাছ থেকে অনুমতি না নিলে কার কাছে থেকে নিবে? আফটার অল শাহাদের উপর কব্জা তো আপনার, তাই একটা ছোট্ট জিজ্ঞাসা এই অপরাধীদের।
কানিজ রোকসানা শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
– এবার বুঝলাম বন্ধু আমার কেনো দেওয়ানা।
দিয়ার লজ্জ্বয় আনত মুখ। কানিজ এগিয়ে এসে দিয়াকে ধরে বললো,
– আর লজ্জ্বা পেতে হবে না। আসল কথায় আসি…
শাহাদ থামিয়ে দিলো হাতের ইশারায় কানিজকে। দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ফারাহ্ আপনাকে তো আপাতত ক্লাস করতে হবে না তাই না?
– না।
– আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে রকিব, শুন আমার জন্য তিনটা টিকিট কাটবি। তবে এখানে নয়, সাউথ আমেরিকা থেকে কা*টবি। তোরা আগে যাবি আমি সী হয়ে যাবো।
মল্লিকা ভ্রু কুৃঁচকে চমকে বললো,
– সী হয়ে মানে? তুই সাগর দিয়ে কিভাবে যাবি?
– ইট’স মাই বিজনেস।
কানিজ আর ঘাটালো না। বেশি ঘাটালে কিছুই বলবেনা। একটু পর হয়তো নিজ থেকেই বলবে। তবে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো কানিজ,
– তিনটা টিকিট অমন জায়গার জন্য?
শাহাদ মাথা নেড়ে বললো,
– হুম।
দিয়া হতবিহবল হয়ে মিনমিনে গলায় বললো,
– কি হচ্ছে? কিসের টিকিট।
শাহাদ ইশারা দিলো সামনে হাঁটার জন্য।সবাই সামনে হাঁটছে মনে কৌতুহল নিয়ে। অপেক্ষা এমপি মশাইয়ের উত্তরের। দিয়া মুখের উপর প্রশ্ন করেনি। মানুষটা বাগানের ঘাষের উপর এক কদম করে ফেলছে আর ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। এর মাঝে শাহাদের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে উষ্ঠা খেলো রকিব। মনিরুজ্জামান ধরাতে পড়ে যায়নি। থেমে গেলো সকলে। রকিব মৃদু চেঁচিয়ে বললো,
– এ্যাই, ব*দ বুদ্ধির রাজা; কৌতুহল ক্লিয়ার কর। নেমতন্ত করে তো হাত পা ভাঙানোর পায়তারা করছিস। তোর দিকে ফিরে হাঁটছি, আরেকটু হলে পা টা যেত। চাইছিস কি তুই? গেলে যাবি বল না গেলে না যাবি। হেয়ালী করছিস কেনো?
কানিজ ধুপ করে বন্ধুর পিঠে কিল দিলো। রে*গে বললো,
– উলটা পালটা প্রশ্ন করিস কেনো? এতে করে এই মহা রোবট এক কথায় উত্তর দিবে। আগে প্রশ্ন কর তিনটা টিকিট কার জন্য?
শাহাদ হো হো করে হেসে বলে,
– আমার অস্তিত্ব শেহজা এবং প্রিয়দর্শীনি ফারাহ্ র জন্য।
– কিহ???
সমস্বরে চিত্কার।
শাহাদ গম্ভীর গলায় বললো,
– ডোন্ট টক ঠু মাচ, আ উইল লেটার এক্সপ্লেইন।
ইট’ স ফাইনাল। স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন পাড়ি দেবো।
খাবার টেবিলের কাছাকাছি চলে এসেছে সকলে। এতক্ষন নিরবতা পালন করলেও দিয়া এবার প্রশ্ন করলো,
– কোথায় যাবেন শেহজার বাবা?
সকলের সামনে দু হাত শূন্যে ছড়িয়ে চোখ বুজে উত্তর দিলো,
– গ্যালাপাগোস…
আশপাশে উপস্থিত ঘরের মানুষ ছিলো থমকে গেলো সকলের পদযাত্রা। শাহীন দেখছে ভাইয়ের অদম্য ইচ্ছাশক্তি, রায়হান সাহেব বিড়বিড় করলো মনে মনে, গ্যালাপাগোস! পাভেলে চক্ষু ছানা বড়া। বস সত্যি যাবে গ্যালাপাগোস! শিফা চিৎকার দিয়ে উঠলো গ্যালাপাগোস! সবার মুখে একই শব্দ গ্যালাপাগোস! গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জীববৈচিত্র পূর্ণ জায়গা। অনেকের কাছে ভূস্বর্গ কাশ্মীর হলেও, পর্যটকদের জন্য ভূস্বর্গ এই দীপপুঞ্জ। অজানা,অদেখা,না শোনা কল্পকথা ঘিরে আছে এই গ্যালাপাগোস জুড়ে। ঘুরে আসা যাক পৃথিবী বিখ্যাত মেরিন ইগুয়ানার, গ্যালাপাগোস কচ্ছপ, আলবাট্রসের দ্বীপ গ্যালাপাগোস।
চলবে…