#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
#গ্যালাপাগোস_ভ্রমণ
৫৪.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
সকালের নাস্তায় ছিলো বিন,ব্রেড টোস্ট, ম্যাংগো জুস, লেমন মিন্ট, চিকেন সসেজ এবং মাশরুম সালাদ। দিয়া নাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। নিজের প্লেট টা হাতে নিয়ে মুখটা বিবর্ণ করে মেয়ের মুখে খাবার দিলো। শাহাদ নাস্তা করতে করতে সহধর্মিণীকে বললো,
– খিচুড়ি খেতে চাইলে বলতে হয়, মনে মনে রেখে দিলে কি শিপের কুক বুঝে যাবে যে তাদের ম্যাডাম ফারহানা মেহতাবের মন পিঞ্জরে খিচুড়ি আর মাংস উঁকি দিচ্ছে?
শেহজা নতুন খাবারের টেস্ট পেয়ে টুকটুক করে খাচ্ছে। শাহাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
– বাবা খাবার মজা?
মেয়ে মাথা নাড়িয়ে দু হাতে তালি দিয়ে বলে,
– বাবা খাবা মদা। মদা আ আ।
শাহাদ হেসে বলে,
– আমার ছানাটাও মজা পেয়েছে। চুপ করে খেয়ে নাও। লাঞ্চে বাঙালী খাবার রাখতে বলবো। হ্যাপি?
দিয়া মন খারাপ করে বললো,
– কাল থেকে এসব খাচ্ছি, আধ সেদ্ধ শাক পাতা,বিন, ওটস কেক, লাল চালের ভাত, কম মশলাদার মাংস। এগুলা কিভাবে খায় সবাই?
– তোমাকে বুঝতে হবে, এরা কেউ বিয়ের দাওয়াত খেতে আসেনি বা শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে যায়নি যে পেট পুড়ে মজা করে খাবে। প্রত্যেকের ক্যালরি,ফিটনেস নিয়ে ভাবতে হয় কুককে। অসুস্থ হলে মাঝ সমুদ্রে কি করবে? হ্যাঁ অবশ্যই ডক্টর আছে, মেডিকেল সিস্টেম আছে। কিন্তু এরপরো তো সাবধানে থাকতে হবে।
– বুঝেছি থাক আর বুঝাতে হবেনা।
দিয়া আপন মনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেয়ে যাচ্ছে।
শাহাদ এগিয়ে এসে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বললো,
– দুজন চুপ করে বসো। খাইয়ে দিচ্ছি। যেভাবে খাওয়া হচ্ছে পুরোটা দিন লেগে যাবে।
খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,
– খাবার শেষে ছানাকে রেডি করে রেখো। আমরা প্রোগ্রামে যাবো।
দিয়া চমকে বলে,
– কি? সাগরে প্রোগ্রাম?
– অবশ্যই। আমাদের সাথে আরো একটি শিপ ঘন্টা খানেকের মাঝে যুক্ত হবে।
ব্যাপারটা সুন্দর। দিয়ার কাছে এই ব্যাপারগুলো খুব ইউনিক মনে হচ্ছে। কত সৌন্দর্য্য দেখা বাকি। এর মাঝে মা মেয়েকে খাইয়ে শাহাদ বললো,
– শেহজাকে রেডি করো আমি আসছি কিছুক্ষনের মাঝে।
___
আলোচনায় বসেছে সিক্স স্পাইডার। সরাসরি ঝুঁকিপূর্ণ বলে সবাই ভিডিও বার্তায় সংযোগ স্থাপন করেছে। ইয়াজের মাথায় কিছু দূর্লভ অদ্ভুত ভাবনা ঘুরছে। সবাই অনেক দিন পর আলোচনায় বসাতে নিজেরা কথা বলছে। নোমান ইয়াজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– ইয়াজ চুপ করে কি ফন্দি আঁটছিস?
ইয়াজ সম্বিত ফিরে বললো,
– ভাই একটা খটকা লাগছে। আমার মনের ভুল নাকি ব্যাপারটা রহস্যময় বুঝে উঠতে পারছিনা।
সকলের পূর্ণ মনোযোগ ইয়াজের দিকে। শাহীন প্রশ্ন ছুঁড়লো,
– কি খটকা?
ইয়াজ উত্তর দিলো,
– বস আকাশপথ ছেড়ে পানিপথে নেমেছে কেনো? নতুন যুদ্ধ ঘোষণা করবে নাকি?
শাহীন বিরক্ত হয়ে বললো,
– এবার থাম। একটু স্বাভাবিক হ। সব বিষয়ে গোয়েন্দা গিরি স্বভাব এখনো আছে। ভাবীমা আর শেহজাকে নিয়ে একটু স্মৃতি ধরে রাখার প্রচেষ্টায় পানিপথে। আর কিছুই না।
ইয়াজ হালকা হেসে বলে,
– তবে সেই শিপে ভাইস এডমিরাল মানিক মোজাম্মেল কেনো?
চমকে উঠলো সকলে। আমেরিকা যাওয়ার শিপে মানিক মোজাম্মেল স্যারের কি কাজ? শাহীন,পাভেল চিন্তায় পড়ে গেলোম এদিকে নোমান প্রশ্ন করে যাচ্ছে। অন্য দিকে লিমন ঘটনার আগপিছ বুঝতে পারছেনা। হঠাৎ তানভীর বলে উঠলো,
– আমি খোঁজ নিয়ে কি দেখবো?
ইয়াজ মাথা নাড়িয়ে জানালো,
– দরকার নেই। কিছু একটা চলছে যা আমাদের চিন্তার বাইরে। আপাতত চুপ থাকাই ভালো। ঘাটাতে গেলে এবার আর থাপ্পড় মিশন নয়, স্টিলের এগ মিশন চালাবে জায়গামত।
নোমান,পাভেল এবং শাহীন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আর বাকি তিনজনের মুখ চুপসে আছে। ইয়াজ মলিন মুখে বলে উঠলো,
– নেন, আরো বেশি করে মজা নেন। আমরা নাদান বাচ্চা বলে সব আমাদের উপর দিয়েই যায়।
তৎক্ষনাৎ নোমান প্রতিবাদ করে বললো,
– তুই নাদান? আমি ভাইজানের হাতে রক্তাক্ত হয়েছি। এরচেয়ে বড় কথা যতই সিক্স স্পাইডারে থাকিনা কেনো ভাইজান আমাকে আগের মত পছন্দ করেন না। গলার কাঁটা ভাবে। উগড়ে ফেলতে পারলেই বাঁচে। মায়া আছে বলে এখনো আছি। একবার ভাইজানের অপছন্দের তালিকায় ঢুকলে ফিরে আসা সম্ভব না।
পাভেল মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
– এই একটা ভয় সারাক্ষন মনের মাঝে কাজ করে। মানুষটা যতই আগলে রাখুক, মন থেকে যদি কাউকে অপছন্দ করে তার সাথে সব ধরনের আন্তরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। টিমে আছে বলে নোমানকে সহ্য করে অথবা সুরাইয়ার জন্য। নতুবা কবেই মে/রে ফেলতো।
নোমান ক্ষীণ হেসে বলে,
– অপরাধটাই যে অমন। ভাবীমার চরিত্রে দাগ আমার জন্য লেগেছে। দুনিয়াতে শ্বাস নিতে পারি সেই অনেক। ভাইজান আমাকে দু চোখ দিয়ে সরাসরি যেন না দেখতে পারে তাই এখানে পাঠিয়েছে। নতুবা তোরা কাছে থাকিস, আমাকে কি দেশে আসতে বলতে পারতোনা? আমি চাইলাম আর উনি পাঠিয়ে দিলেন? মোটেই না। উনি নিজেও চান না। প্রয়োজন ছাড়া দেখাও করতে চায়না। ফোনেই কাজ সেরে নিতে হয়। সবই বুঝি কিন্তু মানুষটার স্নেহের জন্য মন ছটফট করে।
– বাদ দে। যা হওয়ার হয়েছে। ভাইজানকে ঘুরে আসতে দে। এরপর দেখি কি হয়।
নিজেদের মাঝে আলোচনা চলছে। প্রশ্নবোধক চিহ্নটির সঠিক ভাবে প্রয়োগ করছে সিক্স স্পাইডার। ইন্টিলিজেন্স টিম হলে এই এক ঝামেলা সাদামাটা কাজকে ও গভীর ভাবে দেখা শুরু হয়ে যায়।
___
শিপের বরন্য,বর্নাঢ্য যাত্রার অন্তিমকাল আজ। কিছুক্ষনের মাঝেই শীপ ইকুয়েডর সীপোর্টে ভিড়বে। এই কটা দিনে একবারের জন্য বিরক্তির আভাস যেমন ছিলোনা, তেমনি করে ছিলোনা কোনো কষ্ট। সেদিন সন্ধ্যায় জাহাজ পার্টি থেকে নিজেদের ব্যক্তিগত কেবিনে এসে শাহাদকে খুশি মনে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,
– শেহজার বাবা, আমি আমার জীবনের সুন্দরতম সময় গুলো কাটাচ্ছি বোধ করি। আমি ভীষণ খুশি। আপনি না থাকলে কি যে হতো আমার!
শাহাদ আহ্লাদিত বউকে আগলে ধরে বললো,
– আমি না থাকলে আপনার মতো বিদেশীনির কিছুই হতনা তবে এই শ্যাম সুন্দরের কপাল পুড়তো বোধ করি।
খিলখিল করে হেসে উঠেছিলো শাহাদপ্রিয়া।
– তুমি কি তৈরি? নেমে যাবো আমরা এখন।
স্বামীর বাক্যে ধ্যান ছুটে গেলো দিয়ার। দিয়া গায়ে সুন্দর করে ওড়না জড়িয়ে মাথা নেড়ে সায় দিতেই জাহাজের স্টাফরা এসে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। শাহাদ সামনে হাঁটছে শেহজাকে কোলে নিয়ে। দিয়া পিছু নিলো। শেহজা বাবার কোলে এটা ওটা দেখাচ্ছে। উত্তেজিত কন্যার সকল প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে বাবা। শিপ থেকে নামতেই দেখা পেলো বন্ধুদের। রোকসানা এবং মল্লিকা এসে দিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। শাহাদের বন্ধুদের পরিবার এসেছে। যে যার মত ঘুরবে। তবে মল্লিকার স্বামী এবং রোকসানার ছেলে জয়েন করবে তাদের সাথে। পোর্ট থেকে সোজা হোটেলে উঠবে তারা। গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত বন্ধুরা। শেহজাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে শাহাদ। মনিরুজ্জামান হাত বাড়াতেই শেহজা বলে উঠলো,
– দাবো না।
শাহাদ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললো,
– মেয়ে আমার নাখরা তুলে, একটু স্বাভাবিক হোক তারপর যাবে।
রোকসানা হেসে বলে,
– তোর এই মেয়ে বড় হলে সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে দেখিস।
শাহাদ হেসে বললো,
– এর আগেই বিয়ে দিয়ে দিবো। যেন সব নাখরা হাসবেন্ডের উপর যায়।
দিয়া মিটমিট হাসছে। মল্লিকা দিয়ার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
– হাসছো কেনো?
দিয়া মুখে হাত দিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– যেভাবে উনি বললেন, আমি যদি তাই করি। নিজের মেয়ের বেলায় সব জায়েজ দেখলেন আপা।
রোকসানা আঁড়ি পেতে এদের দুজনের কথা শুনে বললো,
– শাহাদ, তুই নিজের মেয়ের বেলায় সব জায়েজ করলি কেনো? দিয়া ভাবী কি নাখরা তোলে?
হালকা ঘাড় উঁচিয়ে ঠোঁট উলটে এক পেশীহাসি দিয়ে বললো,
– আমি কি ধরে রেখেছি?
– ওরেহ বাবাহ!
বন্ধুরা হাসতে হাসতে মজা নিচ্ছে। বয়সের এই সময়টাকে বেশ সুন্দর ভাবে উপভোগ করছে তারা। হাসতে হাসতেই এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে। দুটো গাড়ি। মল্লিকা জোর করে দিয়াকে নিজেদের গাড়িতে তুলে শাহাদকে পাঠিয়ে দিলো মনিরুজ্জামানের গাড়িতে। দিয়া প্রথমে আনবান করলেও রোকসানা এবং মল্লিকার কথার জালে পড়ে রাজি হয়ে বসে পড়েছে।
গাড়ি চলছে পৃথিবী বিখ্যাত ইনকা সভ্যতার দেশ ইকুয়েডরের রাস্তায়। ইকুয়েডর নিয়ে যত বলা যায় বোধ হয় কম হয়ে যাবে। দক্ষিন আমেরিকা দেশ পেরু ও কলম্বিয়ার মাঝে অবস্থিত ইকুয়েডর। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত। ভৌগোলিক অবস্থানে সেরাদের মধ্যে অন্যতম এই দেশ। যার তুলনা শুধুই সে নিজে। সবগুনে গুনান্বিত এই দেশ, যেমন প্রাচুর্যতায় ভরা, তেমনি সভ্যতা, তেমনি নিদর্শন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, ঐতিহাসিক সম্পদ ও বৈচিত্রপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রথাতে সমৃদ্ধ দেশ। পর্যটকদের জন্য স্বপ্নের দেশ এটি। সর্বপ্রথম ইনকা সভ্যতার জনগোষ্ঠী এখানে বসবাস গড়ে তুলে। সেই সময় স্পেনীয় শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। আদৌ ভাষাগত পরিবর্তন আসেনি এখানে। এখানকার মানুষজন কথা বলে স্পেনিশ ভাষায়। আয়তনে বাংলাদেশের দ্বিগুণ প্রায় দু লাখ তিরাশি হাজার বর্গকিলোমিটার অন্যদিকে জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি ষাট লাখ মাত্র। রাজধানী কিটো প্রাচীন শহরের মধ্যে অন্যতম। বিষুবরেখার সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। এই বিষুবরেখার অপর নাম ইকুয়েটর। এই কাল্পনিক রেখার অবস্থান ইকুয়েডরের উপর। তাই তো দেশের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছে ইকুয়েটর।
সভ্যতায় ঘেরা,সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ এই দেশের রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জানার আকাঙ্ক্ষা। শাহাদ মেয়েকে বুকে নিয়ে গাড়িতে। রকিব পিঞ্চ কেটে বললো,
– তুই এমন চুপ করে আছিস কেনো?
শাহাদ বিরক্ত নিয়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে পুনরায় জানালার দিকে তাকায়। মনিরুজ্জামান ফিসফিস করে রকিবকে বলে,
– কি হয়েছে ওর?
– আমি কি করে বলবো।
শাহাদ পিছন ফিরে কিছুক্ষন পর পর কি যেন দেখছে। মুখের রঙে পরিবর্তন এনে বিবর্ণ করে রেখেছে। যেন মেঘের আবছায়া বুঝি মুখেই পড়লো। কেমন ছটফট করছে। চোখ বুঝে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। মনির প্রশ্ন করলো,
– তোর কি ঘুম আসছে?
– না।
– তাহলে নিরব কেনো। দেখ আমাদের সাথে আদিত্য দাদা এসেছেন। উনি কি ভাবছেন?
আদিত্য হেসে বললো,
– সমস্যা নেই ভাই। হয়তো উনার শরীর খারাপ লাগছে।
শেহজা বাবার বুকে ঘুমিয়েছে। নতুবা এতক্ষনে তুলকালাম করতো গাড়িতে। শাহাদ চোখ খুলে জিজ্ঞেস করলো,
– হোটেলে যেতে কতক্ষন লাগবে?
ড্রাইভারকে স্পেনিশ ভাষায় প্রশ্ন করলো আদিত্য। ভ্রমণ পিপাসু মানুষ মল্লিকার স্বামী। অনেক ভাষাই তার জানা। আদিত্য জানালো,
– ভাই আরো দু ঘন্টা।
আকস্মিক ভাবে শাহাদ গর্জে উঠে বললো,
– অসম্ভব! গাড়ি থামান দাদা।
চমকে উঠলো সকলে। গর্জন শুনে আদিত্য ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললো। শাহাদ মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে গেলো। বাকিরাও নেমে পড়লো। একসাথে সকলের জ্ঞাতিগুষ্টি উদ্ধার করে বললো,
– সবগুলা ব্যাডা মানুষ এই গাড়িতে উঠছিস কেনো? ওদের গাড়ি কোথায়? আমি ওই গাড়িতে উঠবো।
সকলে তাজ্জব বনে গেলো, মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এতক্ষন ওর ছটফটানোর কারণ তবে এই। রকিব উত্তর দিলো,
– ওই গাড়িতে রাহিল আছে, আর রোকসানা আছে। এত চিন্তা কেনো করছিস?
– রাহিল বাচ্চা। রোকসানা আকাশে উড়োজাহাজ উড়ানোর জন্য সম্পূর্ণা। অপরিচিত একটি দেশে মোটেও সিকিউর নয়। আর আদিত্য দাদা আপনি কিভাবে বউটিকে ছাড়া বসলেন বলুন তো। এই দুই হতচ্ছাড়াদের তো একজনের বউ রেখে চলে গেছে অন্যজনের বিয়েই হয়নি। এরা নাহয় পরিবারচ্যুত। আপনি কেনো ভাবলেন না।
আদিত্য লজ্জা পেয়ে গেলো। জিহবায় কামড় দিয়ে বললো,
– রাহিল ওই গাড়িতে থাকাতে ব্যাপারটা গুরুত্ব দি নি ভাই।
– আমি নিজেই তো অপরিচিত দেশে ভয় পাচ্ছি সেখানে রাহিল তো চব্বিশ পঁচিশের ছেলে।
ওই যে সাদা গাড়িটি দেখা যাচ্ছে। আসছে ছুটে। শাহাদের মনে হলো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ভয় পেয়েছে। ইকুয়েডরে কিশোর গ্যাং ওয়ারের কথা ইদানীং বেড়েছে। এরা নিজেরাই ঝামেলা করে আবার আক্রমণ করতে পারে পর্যটকদের উপর। সাদা গাড়ি ওদের দেখে থেমে গেলো। মনিরুজ্জামান হাসতে হাসতে বলে,
– বন্ধু বয়স তো বেশি হয়নাই। বিয়ে করা দরকার। একটা মাইয়া খুঁজে দে। এতদিন বুঝি নাই বিয়ের জ্বালা। আজকে একটা বউ নেই বলে অপমান করলি।
শাহাদ বিড়বিড় করে গালি ছুঁড়লো। সাদা গাড়ি সামনে এসে দাঁড়ায়। সকলে নেমে পড়লো। দিয়াকে নামতে দেখে শাহাদ এগিয়ে গিয়ে একপাশে বুকে আগলে নিলো। সবার মুখে একই প্রশ্ন,
– কি হয়েছে?
শাহাদ এক কথায় উত্তর দিলো,
– কিছুই না। নতুন দেশ তোরা সবাই একা ছিলি তাই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। তোদের গাড়িতে আদিত্য দাদা এবং মনির যাক। আমার সাথে রকিব থাকলেই হবে।
রোকসানা দিয়ার হাত ধরে বলে,
– হাত ছাড় ভাবীর। আমার সাথে বসবে।
শাহাদ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– আমার বউ আমার সাথে বসবে।
– দিবোনা।
– তুই কে দেয়ার? ফারাহ্ গাড়িতে বসো।
বাকিরা এদের ঝগড়া দেখে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। শাহাদের ক্রোধের সীমা বেড়েই চলেছে। বড় বড় চোখ করে দিয়ার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে কেনো সময় কিছু বলছে না। দিয়ার হাত ছেড়ে রাগ করে গাড়িতে গিয়ে বসে। দিয়া রোকসানার সামনে গিয়ে বললো,
– আপু অপারেশনের পর তো এত দীর্ঘ যাত্রা করেনি। মনের মধ্যে হয়তো ভয় কাজ করছে। আমাকে আর শেহজা একা ছাড়তে চায় না। এমন না যে আপনাদের পছন্দ করেনা, তবে আমাদের দুজনের ব্যাপারে বেশিই পসেসিভ। হয়তো এখন আমাকে পাশে চাচ্ছে। আমি না থাকলে পুরোটা রাস্তা ছটফট করবে।
রোকসানা অধর প্রসারিত করে বললো,
– এত সহজে শাহাদ বউ বউ করার পাবলিক না। আজ বুঝলাম। যান ভাবী।
মল্লিকা মাথার উপর হাত বুলিয়ে দিতেই দিয়া চোখের পলক ঝাপটে হাসি দিলো। গাড়িতে উঠে বসতেই দেখে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়েছে শাহাদ। চোখ বন্ধ। রকিব সামনে বসে ড্রাইভারের সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। সবাই বুঝতে পেরেছে শাহাদ নিজের মতো স্পেস চাচ্ছে, পাশে বসেই শাহাদের এক হাত নিজের কোলে রাখলো। পুরুষালি চওড়া কাঁধে মাথা রাখতেই মানুষটার ঠোঁটের কোনে ঝলমলে উঠলো হাসি। একহাতে আগলে ধরে বুকে টেনে নিলো। মাথা ঝুঁকে মাথার অগ্রভাগে ঠোঁট ছোঁয়ালো। শরীর জুড়ে মেয়েলী মন মাতানো গন্ধ যেন শাহাদের ভেতর টা জুড়ে শীতলতা বইয়ে দিয়ে গেলো। দেশেই বউ নিয়ে সারাক্ষন চিন্তায় থাকে এই দেশে তো এই সুন্দরী নিরাপদ নয়। শ্বেত সুন্দরীদের সাথে যেমন এরা অভ্যস্ত, ঠিক তেমন আফ্রিকান সুন্দরীরা এদের সই। তবে এই হাইব্রিড বাঙালী-ইরানী রুপসীকে দেখলে পুরুষের চোখ ঝলসে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। এখন মনে হচ্ছে আসাটা ভুল হয়েছে। পুরোটা ট্যুর দুশ্চিন্তায় কা/টাতে হবে।
হোটেলে এসেই বিশ্রামের জন্য স্ব স্ব কামরায় চলে গেলো সকলে। আজ আর যাত্রা সম্ভব না শাহাদের। কটা দিনের টানা জার্নি মাথা ধরেছে। কাল সকালেই যাত্রা আরম্ভ করবে সেই জগৎ বিখ্যাত গ্যালাপাগোসের উদ্দেশ্যে।
____
ইকুয়েডর থেকে প্রায় ৬০০ মাইল দূরে এই গ্যালাপাগোস। সরাসরি গ্যালাপাগোস যাওয়ার জন্য কোনো স্থলপথ,আকাশপথ কিংবা জলপথ নেই। যেভাবে,যেই উপায়ে যাওয়া যাক না কেনো প্রথমে সকলকে আসতে হবে ইকুয়েডর। ইকুয়েডর পরবর্তী যাত্রা হলো গ্যালাপাগোস। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে এই দ্বীপগুচ্ছের মায়ায় পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষ ছুটে আসে। জীবন্ত জাদুঘর হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় এই গ্যালাপাগোসকে। ইকুয়েডর থেমে সেখান থেকে রাজধানী কিটোতে যেতে হয়। ইকুয়েডর থেকে গ্যালাপাগোস যাওয়ার পথ দুটি। একটি হলো কিটো বিমানবন্দর থেকে উড়ান পথ অথবা ক্রান্তীয় বানিজ্যিক রাজধানী গুয়াকিল থেকে বিমানপথ। ইকুয়েডর সমুদ্রবন্দর থেকে গ্যালাপাগোস পরিষেবা দেয়ার জন্য কোনো নদীপথ ব্যবস্থা, ক্রুজ বা জাহাজ নেই। সুতরাং পথ খোলা শুধু বিমান পথ।
কিটোর ‘মারিসকাল সুক্রে’ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং গুয়াকিলের জোসে জোয়াকিন ডি ওলমেডো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট গ্রহন করে বিশ্বের অন্যদেশ। সুতরাং যে যেভাবেই যেতে চাক না কেনো এই দুটি ফ্লাইট ব্যতীত অন্য কোনো ফ্লাইট ইকুয়েডর গ্রহন করেনা।
যেহেতু হোটেল থেকে কিটোর দুরত্ব কম সুতরাং শাহাদ এবং তাদের টিমের গন্তব্য কিটো এয়ারপোর্ট। ভোরেই যেতে হবে নতুবা ফ্লাইট মিস। খুব ভোরে ঘুম ছেড়েছে সকলের। ইকুয়েডর থেকে গ্যালাপাগোসের উদ্দেশ্যে দুটি ফ্লাইট ছাড়ে। বাল্ট্রা এবং সান ক্রিস্টোবাল দ্বীপপুঞ্জের গালাপাগোসে দুটি প্রধান বিমানবন্দর রয়েছে। ফ্লাইট বুক করা শেষ। রওয়ানা হবে কিছুক্ষনের মাঝেই সেই স্বপ্নরাজ্যে। গ্যালাপাগোস যেতে দু ঘন্টা সময় লাগবে। ইকুয়েডর থেকে কিটো, এরপর কিটো থেকে গুয়াকিল, তাই একটু সময় বেশি লাগবে। বাংলাদেশের লোকাল বাস গুলোর মতো পথে পথে যাত্রী তোলার প্রবনতা না থাকলে কিটো থেকে এই ফ্লাইট গুয়াকিল গিয়ে যাত্রী তুলতে বেশ সময় লাগায়। সেখানে প্রায় চল্লিশ মিনিট বিরতি নেয়। তাই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি সকলেরই নেয়া শেষ। আরেকটি ব্যাপার ফ্লাইট বুকিংয়ের পাশাপাশি গ্যালাপাগোস এয়ারপোর্টে থেকে ক্রুজ বুকিং করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এয়ারপোর্ট থেকে যার যার নির্দিষ্ট ক্রুজ এসে অতিথিদের নিয়ে যাবে। গ্যালাপাগোসে পৌঁছানো মাত্রই সময় ও কঠোর সময় ও নিয়মের মধ্যে চলে আসতে হবে সকলকে।
এয়ারক্রাফটে উঠে সকলে নিজেদের আসন গ্রহন করলো। শেহজা এরোপ্লেন দেখে খুশিতে লাফাচ্ছে। দিয়ার শরীর ভালো ঠেকছেনা। বার বার ঘুম আসছে। শাহাদ দিয়াকে বললো,
– ঘুমিয়ে পড়ো। ছানার খাবার টা সামনেই রাখো। আমি দেখছি ওকে। ঘুম থেকে উঠেই দেখবে আমরা গ্যালাপাগোস এয়ারপোর্টে।
মাথা নেড়ে চোখ বুঝলো দিয়া। শাহাদের হাতে হাত রেখে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো। অন্যদিকে শাহাদ মেয়েকে পাশে বসিয়ে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। ট্যাবের মাঝে গ্যালাপাগোসের ভিডিও ছেড়ে দিয়েছে। আর প্রতিটি প্রানীকে দেখিয়ে খেলছে মেয়ের সাথে। মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে এই জার্নিতে। অথচ এই মেয়ে এখনো বিন্দাস। শাহাদ হেসে মেয়েকে আস্তে বললো,
– আম্মা তুমি কি ঘুমাবেনা? তোমার মা তো ঘুমে অতল সমুদ্রে হা রিয়েছে।
মেয়ে বাবার কথা বুঝেছে হয়তো। ঘুমাবে না টুকু বুঝে বললো,
– তেজা খেলা, মো মাছ। এতা মাছ।
– জ্বি আম্মা শেহজা খেলা করছে জানি, হ্যাঁ মোবাইলে মাছ দেখেন আপনি। আমার রক্ত যে আপনার শরীরে তার ডিএনএ করানোর প্রয়োজনই নেই।
– এমপি সাহেব, জার্নি ছানার পছন্দের মানলাম, আপনার রক্তেরই টান। ছানা যে মিষ্টি করে চুপটি করে আছে সেটা আমার স্বভাব। আমার ও সুনাম করুন।
– একটা কথাও মাটিতে পড়তে দেবে না তাই না ফারাহ্?
– ওই যে আপনার স্ত্রী বলে কথা।
হালকা হাসলো শাহাদ। বউটা না ঘুমিয়ে চুপি চুপি কথা শুনছিলো বাবা- কন্যার। মেয়েকে ভিডিও দেখাতে ব্যস্ত। বাম হাত তুলে স্ত্রীর মাথার ঘোমটা সরিয়ে আলতো করে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
– টাইট স্লিপ স্ট্রবেরি।
চোখ বুজেই হেসে দিলো দিয়া। ভাবছে বার্মিজ গ্রেইপ উচ্চারন করলেই বোধ হয় এমপি সাহেবের রোমান্স পায় তাই এই মুহুর্তে অনুভুতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পুরোনো নাম স্ট্রবেরি ডেকেছে।
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
#গ্যালাপাগোস_ভ্রমণ
৫৫.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
সান ক্রিস্টোবাল এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে নেমে গন্তব্য ক্রুজ। চাইলেই গ্যালাপাগোসের পুয়ের্তো আয়োরা বা পুয়ের্তো বাকরিজো মোরেনার মতো শহরে থাকতে পারা যায়। সেই ক্ষেত্রে শহর থেকে আসা যাওয়া করে ভ্রমন করতে হবে। দুটি শহরেই রাস্তায় অনেক কোম্পানি আছে যারা ট্রিপ গুলি অফার করে এবং ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। এখানকার হোটেলগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। হোটেলে এক রাত যাপনের জন্য গুণতে হবে প্রায় ৫০০ ইউ এস ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। এর চেয়ে ঢের ভালো ক্রুজ বুকিং করা। স্থানীয় লোকদের ব্যক্তিগত ক্রুজ থাকতে পারে। তবে তারাও চাইলে তা ব্যবহার করতে পারবেনা। ব্যবহার করতে হবে নির্ধারিত লাইসেন্সকৃত ক্রুজ। এক একটি বৃহত্তর ক্রুজ প্রায় আশি জন্য যাত্রী বহন করতে পারে, যার ভাড়া এক সপ্তাহের জন্য ৬৫০০ ইউ এস ডলার অর্থাৎ বাংলা টাকা সাত লক্ষ তিয়াত্তর হাজার পাঁচশত টাকা। আশিজনের ক্রুজ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না ছোট দল গুলো। শাহাদ,রকিব এবং মনিরের সাথে পরামর্শ করে আদিত্য আগে থেকে দশজনের জন্য একটি ক্রুজ নিয়েছেন। সাথে থাকবে কুক এবং ট্যুর গাইড। যা এখানকার সংস্থা Ecoventura দ্বারা পরিচালিত এবং সুন্দর একটি নাম, ‘ফ্লেমিংগো’ । গ্যালাপাগোসের উদ্দেশ্যে কিছুক্ষনের মাঝেই ‘ফ্লেমিংগো’ প্রশান্ত মহাসাগরে তার যাত্রা আরম্ভ করতে যাচ্ছে। ‘ফ্লেমিংগো’র সবচেয়ে আনন্দের এবং ইতিবাচক দিক হচ্ছে দু ধরনের পানি আরোহী সরঞ্জামই আছে। শাহাদ শক্তভাবে বলেছে স্কুবা ডাইভিং এর সরঞ্জাম যেন থাকে, সেখানে বোনাস স্নোরকেলিং ও আছে। শাহাদের চোখে মুখে খুশি। যেহেতু নভেম্বর মাস, ভ্রমণের জন্য উপর্যুক্ত সময়। শীতল আবহাওয়া। শরীর খারাপ হওয়ার ভয় আছেই। সকলে সাথে করে প্রয়োজনীয় ঔষধ সামগ্রী নিয়ে এসেছে। মোশন সিকনেস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বডি স্যুটের ব্যবস্থা ও করা হয়েছে কারণ নিরক্ষীয় অঞ্চল, রুক্ষ আবহাওয়া। এর মাঝে শেহজা ছোট। সব মিলিয়ে প্রস্তুতি পর্ব শেষ। যাত্রা শুরু করেছে ফ্লেমিংগো।
শাহাদ কেবিনে এসেই ধুপ করে শুয়ে পড়েছে বেডে। কিছুক্ষন আগ থেকেই শরীর কলাপস করছিলো। বুঝে উঠতে পারছিলোনা খারাপ লাগার কারণ। শেহজা ছুটোছুটি করছে কেবিন জুড়ে। এভাবে শুয়ে পড়তে দেখে দিয়া ছুটে গিয়ে ধরলো। চোখ বন্ধ করেই বললো,
– চিন্তা করোনা, ঠিক হয়ে যাবো। জেটল্যাগ হয়েছে হয়তো।
জেট ল্যাগ ট্রাভেলার বা দূর দূরান্তে ভ্রমণকারীদের কাছে পরিচিত শব্দ। এর লক্ষণগুলো হল, ভালো ঘুম না হওয়া, দিনের বেলাতেও ক্লান্তবোধ করা, কাজে মন বসাতে না পারা ইত্যাদি৷ বিমান যাত্রার পরেই এই লক্ষণ দেখা যায় সাধারণত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ট্রিপের পরেই এই জেট ল্যাগের সমস্যা দেখা দেয়৷ দুই বা তার বেশি টাইম জোন পেরোলেই এই সমস্যাটা দেখা দেয়৷ আসলে এই সময়ে আমাদের বায়োলজিকাল ক্লকের অনেকটাই বদলে যায়৷ অর্থাত্ আমরা সাধারণত যে সময়ে ঘুমোতে যাই, যে সময় জেগে থাকি, সেই অভ্যাসের অনেকটাই এই টাইম জোনের পরিবর্তনের ফলে বদলে যায়।
দিয়া এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো,
– ঔষধ দিব?
– নাহ। সময় হলে আমি নিজেই নিব। চিন্তা করোনা।ঠিক হয়ে যাবো। তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও৷
শেহজা একবার বেডে লাফাচ্ছে তো অন্যবার সোফায়। জিনিসপত্র ফেলে দিচ্ছে। দিয়া ধমকে যাচ্ছে। ছুটে গিয়ে চেপে ধরলো শেহজা। বকছে,
– এই পাকনা মেয়ে, এমন ছুটছো কেনো? বাবাকে দেখছোনা, তোমার জ্বালায় মানুষটা শান্তি পাচ্ছে না। সারা টা রাস্তা তোমাকে সামলাতে গিয়ে অসুস্থ হয়েছে।
তড়াক করে বন্ধ চোখ খুললো শাহাদ। স্ত্রীর দিকে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
– আমি ওকে সামলাতে গিয়ে অসুস্থ হয়েছি?
– তা নয় তো কি?
– শিখে গিয়েছো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল? ছানাটা আমার কথা বললে যে শান্ত হবে সঠিক বুঝেছো।
শেহজা বাবার কাছে এসে বসেছে। বাবার বুকের উপর উঠে বাবার গালে হাত দিয়ে বলছে,
– বাবা ব্যাতা? এতানে ব্যা তা। কোথা ব্যাতা?
মেয়ের ডান হাতে চুমু দিতেই বাম হাত বাড়িয়ে দিলো।শাহাদ মেয়েকে বুকের উপর শুইয়ে বললো,
– না আমার মা, বাবা ঠিক আছি। একদম ঠিক। কিচ্ছু হয়নি।
দিয়া ঠোঁট বাকিয়ে বলে,
– ঢং কত। আপনি বেশি আহ্লাদ করে মেয়েকে বিগড়াচ্ছেন।
– তুমি কি চাও, ছানাটাকে মা*রি?
– না তা কখন বললাম। মাঝে মাঝে একটু রাগ তো দেখাতে পারেন।
বাবা মায়ের মৃদু খুনশুটির মাঝে মেয়ে বাবার বুক থেকে সরে গিয়েছে। দিয়া ঘোমটা খুলে ওড়না এক পাশে রেখে শাহাদের টি-শার্ট ট্রাওজার নামাতে নামাতে কথা বলছে। বিপরীতে শাহাদ জবাব দিচ্ছে,
– রাগ দেখানোর মত কি করেছে আমার বাচ্চাটা শুনি?
স্বামীর পায়ের কাছে এসে জুতা খুলে দিতে পায়ে হাত দিবে, শাহাদ শুয়েই ধমক দিলো,
– পায়ে হাত দিবে না। আমি খুলবো।
কিন্তু কে শুনে কার কথা, দিয়াকে হাত দিতে দেখে শেহজা খাটে মায়ের পাশে বসে আরেকটা জুতা খুলছে। মা মেয়ে দুজনকে দু পায়ে হাত দিতে দেখে লাফিয়ে উঠে গিয়েছে। ধমকে গিয়ে বললো,
– ইয়া আল্লাহ! কি শুরু করলে তোমরা। আম্মা সরো। ফারাহ্ নিষেধ করছি। মেয়েটা একই কাজ করছে তোমাকে নকল করে।
দিয়া সরে মুচকি হেসে একপাশে দাঁড়িয়েছে ঠিকই,কিন্তু জানে শেহজা সরবেনা। তাই তামশা দেখবে বলে চুপিসারে সরে গিয়েছে। শেহজা বাবার জুতা নিয়ে টানাটানি করছে খোলার জন্য। ভারী জুতা কারো সাহায্য ছাড়া খোলা কি সম্ভব, এত খানি মেয়ের পক্ষে? এদিকে শাহাদ মেয়েকে বলছে,
– আম্মা জুতোয় ময়লা, ছাড়ো বাবা ছিঃ।
আফসোস করে বলছে,
– আমারই ভুল হয়েছে। জুতো নিয়ে শোয়া।
এদিকে মেয়ে উলটো বাবাকে ধমকে বলে,
– বাবা এত্তোপ( স্টপ) তেজা পালে। দুতো তুলে দিত্তে বাবা।
শাহাদ চমকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়ে বাবাকে ধমকাচ্ছে। শেহজা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– মা আতো। দুতা কত্ত পাত্তি।
আহারে! জুতা খুলতে কষ্ট দিচ্ছে,তাই মাকে ডাকছে সাহায্য করতে। দিয়া হেসে মেয়েকে সাহায্য করতে গেলো। এদিকে শাহাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে দিয়াকে বললো,
– ফারাহ্ কিভাবে বললে কিছুক্ষন আগে, আমার ছোট্ট জানটাকে বকা দিতে?
দিয়া জুতা খুলতে খুলতে শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমি না থাকলেও আফসোস নেই। এই মেয়ের মায়ের প্রয়োজন পড়বেনা। আপনি যেভাবে ওকে বুকে আগলে রাখেন, সেভাবে খুব কম বাবাই পারে।
– রাখবোনা বলছো? আমার রিজিকে আর কটা সন্তান আছে জানিনা বা হবে জানিনা। তবে শেহজা আমার সেই সন্তান যার জন্য আমি বাবা হওয়ার সুখ পেয়েছি। আমার জান কুরবান এই মেয়ের জন্য।
এর মাঝে দিয়া আর শেহজা জুতা খুলে ফেলেছে। দিয়া কাছে এসে বোতাম খুলছে শার্টের। শেহজা মাকে অনুকরণ করে বোতাম খোলার চেষ্টা করছে। শাহাদ মা মেয়ের কান্ড দেখছে। বোতাম প্রায় খোলা শেষ। শার্টের ডান পাশ দিয়া খুলছে, বাম পাশ শেহজা খুলছে। শাহাদ হাসতে হাসতে দুজনকে দুপাশে বুকে টেনে বললো,
– আহা! কি রাজকীয় সেবা প্রদান করছেন আপনারা মাতা-কন্যা। নিজেকে তো রাজা মনে হচ্ছে।
এর মাঝে শেহজা বলে উঠলো,
– বাবা লাজা, মা লানী তেজা লাজতন্যা।
দিয়া হাসছে। শাহাদ দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
– মেয়েকে এসব তুমি শিখিয়েছো?
দিয়া হেসে প্রতিউত্তর করলো,
– না আমি না, শিফা আর শেফালী আপা। সারাক্ষন এসব বলে। রাজা রানীর গল্প শোনায়। আর ওকে মুখস্ত করায় ওর বাবা রাজা,ওর মা রানী আর ও রাজকন্যা। এখন আপনি রাজা উচ্চারণ করেছেন তাই হয়তো ওর মস্তিষ্কে শব্দটার উপর জোর পড়েছে। মনে পড়াতে রাজা,রানী করছে।
শাহাদ চোখ বুজে বললো,
– ফারাহ্ এত সুখ আমার সইবেনা। বুজলে।
– আল্লাহ মাফ করুন। কি বলেন এসব?
– কি বললাম! আরেহ সিরিয়াস হয়োনা। এমনি বললাম। বাই দ্য ওয়ে আপনাদের মা মেয়ের আমাকে যত্ন শেষ হলে নিজেরা একটু তৈরি হয়ে নিন। নাস্তা করতে হবেনা? ঘড়ি দেখেছো? সেই সকালে খেয়ে বের হয়েছো। এখন এগারোটা বাজে।
দিয়া উঠে একটা সাদা গাউন নিয়ে কেবিনের ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাহাদ নিজেই কিনে এনেছে এই গাউনগুলো। প্রায় সময় ম্যাচিং করে তিনজনের জন্য ড্রেস নেয়। শেহজাকে ও নিজের মতো একটা টি শার্ট পরিয়ে দিয়েছে। দুটো বেবি পেঙ্গুইন আছে শেহজার সাদা টি শার্টে। কি খুশি সেই মেয়ে বাবার মতো সাদা পরতে পেরে। এদিকে ছোট্ট চুল মুড়িয়ে পেঁচিয়ে শাহাদ নিজেই মেয়ের চুল বেঁধে দিয়েছে। দিয়ার মেক আপের ব্যাগ থেকে একটা লিপস্টিক নিয়ে মেয়েকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে,
– লাগাবে?
মেয়েও সজোরে বলছে,
-ইবিত্তিক লাগাবে তেজা
শাহাদ হেসে আঙুলের মাথায় একটু নিয়ে মেয়ের ঠোঁটে লাগিয়ে হেসে বলছে,
– এত্ত ঢংগী হয়েছেন আম্মা। পুরাই আপনার মায়ের কপি।
ঠোঁট দুটোকে ফুলিয়ে রেখেছে। দিয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বাবা-মেয়ের কান্ড দেখে হাসছে। শাহাদ মেয়ের লিপস্টিক নিয়ে দিয়াকে বলছে,
– মাঝে মাঝে আমার ছানার জন্য মেক আপ কিনবে। আলাদা তোমার মত একটা ব্যাগ রাখবে।
___
ক্রুজের ডাইনিং এরিয়াতে এসে সকলে একসঙ্গে বসেছে। ওদের আসতে দেখে রোকসানার ছেলে জোরেই বলে উঠলো,
– আংকেল ইউ আর লুকিং ড্যাম হট। লাইক ইয়াং ম্যান।
দিয়া ও এই প্রথম শাহাদকে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টে দেখে অবাক হয়েছিলো কিন্তু মুখ বন্ধ রেখেছে। রাহিলের সম্বোধনে শাহাদের পরিবর্তে দিয়া লজ্জা পেয়ে গেলো।
শাহাদ চেয়ার টেনে বসে একপাশে মেয়ে অন্য পাশে দিয়াকে বসিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো। এদিকে রোকসানা ছেলেকে ধমকে বললো,
– রাহিল, এভাবে কথা বলবেনা।
– মাম্মা ইটস ট্রু।
ক্রুজের কুক কিছু এপিটাইজার পরিবেশন করা হয়েছে। ক্লিয়ার স্যুপ, টোস্ট জাতীয় কিছু এবং কিছু সী ফুড সালাদ। সবাই খাবার শুরু করেছে। শাহাদ রাহিলের দিকে তাকিয়ে বললো,
– রাহিল হাউ ওল্ড আর ইউ?
– ঠুয়েন্টি ওয়ান আংকেল।
– ওহ! আই থট ইউ আর ঠুয়েন্টি ফোর।
– আম নট দ্যাট মাচ ওল্ড আংকেল।
রোকসানা ছেলেকে ধমকে বলে,
– রাহিল বাংলা বলো।
শাহাদ রোকসানার দিকে তাকিয়ে বললো,
– সমস্যা নেই। ও যেই ভাষায় আরামবোধ করে তাই বলুক।
রাহিল মায়ের ইঙ্গিত বুঝে চুপ হয়ে গেলো। বাড়ন্ত বয়সের ছেলে। ভালোই তেজ আছে। তাই একটু ছটফটে হওয়া স্বাভাবিক। এর মাঝে মনিরুজ্জামান বললো,
– জেটল্যাগ হয়েছে মনে হয়। শরীরটা কেমন করছে আমার।
শাহাদ ও রকিব দুজনই বলে উঠলো,
– আমার ও।
মনিরুজ্জামান শাহাদকে পুনরায় প্রশ্ন করলো,
– শাহাদ তুই কি স্কুবা করবি?
– অবশ্যই।
– এই শরীরে।
– মেডিসিন নিয়েছি। ঠিক হয়ে যাব।
রাহিল উত্তেজিত হয়ে বললো,
– আমিও পারি স্কুবা করতে৷ আংকেল আপনি এই বয়সে স্কুবা করবেন?
আদিত্য আর মল্লিকা জিহবায় কামড় দিয়েছে। এত কথা বলে এই ছেলে! রোকসানার ইচ্ছে করছে কষিয়ে দিতে এই ছেলেকে। যে ছেলের বাপ ও শাহাদকে মান্নি করে চলতো এখন ছেলে পাঙ্গা নিতে আসছে। শাহাদ খেতে খেতে বললো,
– তুমি কোথায় করেছো স্কুবা?
– সেন্ট মার্টিন।
– ভেরি গুড। কত ফুট নেমেছো?
– মনে নেই। মুখে মাস্ক লাগিয়ে দিয়েছিলো। সাঁতার কেটে প্রবাল দেখেছি। কিছু মাছ দেখেছি। কস্টিং প্রভাবলি ৭০০ টাকা।
– ওটা স্নোরকেলিং। স্কুবার জন্য তোমাকে আরো নিচে নামতে হবে রাহিল। ট্রেইনড হতে হবে। স্কুবা কস্টিং সেন্ট মার্টিন আমার জানামতে ২৫০০ টাকা। তবে বেশি গভীরে যেতে পারবেনা। সাথে কাউকে নিতে হবে। পানি থেকে কিছুটা প্রায় সাত বা আট ফিট নেমে প্রবাল,মাছ দেখা হচ্ছে স্নোর কেলিং।
– তাহলে স্কুবা কি?
– যাবে আমার সাথে?
রোকসানা নার্ভাস হয়ে বললো,
– একদম না, আমার একটা ছেলে। তুই যা।
– আমি যাবো মাম্মা।
রোকসানা ছেলেকে ধমকে বললো,
– না যাবেনা তুমি।
আদিত্য না করছে। মনিরুজ্জামান কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো,
– শাহাদ স্নোরকেলিং এ যা। আমাদের কথা শুন,
তোরও স্কুবা তে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। শরীরের কন্ডিশন ও ভালোনা। স্কুবা তে অনেক রিস্ক শুনেছি। শখের বসে স্কুবা করা বিপজ্জনক।
শাহাদ মাথা তুলে হেসে বলে,
– রকিব, আমি কি শখের বসে করছি? আমার কি ভয় লাগা উচিত?
রকিব নিরবে সব শুনছিলো এত সময়। মাথা তুলে খেতে খেতে বললো,
– আজ যাবি নাকি কাল? আমাকে সাথে নিস।
সকলে চমকে গেলো। এতক্ষন শাহাদকে বুঝাচ্ছে সকলে আর এখন রকিবও পাগল হলো। মল্লিকা ধমকে বললো,
– এতক্ষন পাগলামি শাহাদ করেছে এখন তুই করছিস? তুই কি আসলে যাবি?
– অবশ্যই। আমি স্কুবা শিখেছি শাহাদ থেকে। ইভেন শাহাদ ইজ আ ওয়েল ট্রেইন্ড সার্টিফাইড স্কুবা ট্রেইনার। ওর রেকর্ড আছে পানির দেড়শ ফিট নিচে যাওয়ার। ওদের নেভিতে সবাই স্কুবা পারে। শাহাদ সহ আরো কয়েকজন রেকর্ড করেছে। আর তোমরা শাহাদকে দেখাও পানির ভয়। পানির নিচ থেকে সাসপিশাস সাবমেরিন ফাইন্ড আউট করে নিয়ে আসতো। বঙ্গোপসাগর মাঝে ডুব দিয়ে কত কি উদ্ধার করার রেকর্ড আছে এই ‘কিং অফ ওয়েবের’। সাধে ওর নাম এমন? আমার মনে আছে অনেক আগের কথা, রাশেদ কম পারতো স্কুবা। ফোন দিয়ে আমাকে বলে, আজকে আমি আর শাহাদ পানির নিচে হাঙ্গর দেখেছি। আমার তো জান ওখানেই শেষ। চুপ করে ছিলাম। যতক্ষন না হাঙর টা নিজের পথে গিয়েছে। শাহাদ না থাকলে হাঙ্গর নিজের খাদ্য হিসেবে আমাকে চালান করতো পেটে।
– আল্লাহ!
আর্তনাদ করেই দিয়া মুখে হাত তুলেছে। আওয়াজ শুনে সবাই ওর দিকে তাকাতেই দেখে ও বিস্ময়ে চোখ মুখ মলিন করে ফেলেছে। শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আপনার নামার কোনো প্রয়োজনই নেই। আমি ঢাকা যাব। কেনো আসলাম এখানে?
শাহাদ রকিবকে ধমকে বলে,
– তোর এখানেই হাঙ্গর কাহিনী শুনাতে হলো। ফারাহ্ ভয় পাওয়ার কিছু নেই। হাঙ্গর, হাঙ্গরের জায়গায়; আমি,আমার জায়গায়। এখানে এসব নেই। চিন্তা করোনা।
দিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে সবাইকে বললো,
– একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনবে সাগরের?
সবাই সম্মতি দিতেই বলে উঠলো,
– নীল তিমি যে আ ত্ন হ ত্যা করে তা কি জানো?
বিস্মিত উপস্থিত সবাই। মানুষ আ ত্ম হ ত্যা করে তা জানে, লাভ বার্ড নামক পাখিসহ আরো কিছু প্রাণী করে ধারণা আছে কিন্তু নীল তিমি!
কৌতুহল দেখে শাহাদ নিজ থেকেই খেতে খেতে বললো,
– তিমিরা দল বেঁধে চলতে পছন্দ করে, দলনেতা যেভাবে নির্দেশ দেয়,সেভাবে চলে। একবার তাদের দলনেতা অসুস্থ হলো, তারা তাকে অনুসরণ করে তীর অবধি চলে এসেছে। তীরে আসার পর দলনেতার আর ফিরে যেতে পারেনি অসুস্থতার জন্য। তাকে অনুসরণ করে বাকিরাও থেকে গিয়েছে। দলনেতা মারা যাবার পর আর কেউ ফিরে যায়নি। সবাই মিলে আ ত্ম হ ত্যা করেছে।
এমন আরো আছে, ওরা যখন বুঝতে পারে মা রা যাবে তখন এমন হিপনোটাইজিং সাউন্ড করে যা শুনলে যে কেউ হিপনোটাইজ হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে তারা কাউকে আকৃষ্ট করতে এমন শব্দ করে অথবা এটি তাদের কান্নার শব্দ। অনেক আবেগপ্রবন,কষ্ট জাগানো সেই আওয়াজ। এতটাই উচ্চ ডেসিবেলে প্রতিধ্বনিত হয় যে মাইলের পর মাইল এই আওয়াজ শোনা যায়। পাঁচ থেকে ছয় সেকেন্ড স্থায়িত্ব কাল। মানুষ যদি শুনে তাহলে সম্মোহিত হয়ে ভুল কাজ করে বসতে পারে। এই আওয়াজ সবচেয়ে বেশি করে হাম্পব্যাক প্রজাতির তিমি। কথিত আছে ব্লু হোয়েল গেম নাকি সেখান থেকেই উদ্ভুত। মা রা যাওয়ার আগে তিমি নিজেকে সমুদ্রের তীরবর্তী নিয়ে আসে যাতে করে হাঙ্গর বা কিলার হোয়েল তাকে খাদ্য বানাতে না পারে। এরপর সে নিজেই পানির অভাবে তীরে মা রা যায়। তাই আমরা মাঝে মাঝে মৃত তিমি তীরে দেখি। সঙ্গীর অভাবেও তিমি মৃ ত্যুকে নিজের করে নেয়।
সকলে সম্মোহনী হয়ে শুনছে শাহাদের কথা। শাহাদ খেতে খেতে আরো বললো,
– আল্লাহর দুনিয়া কত সুন্দর, বৈচিত্র্যময় জানো?
রাহিল প্রশ্ন করলো,
– আংকেল তিমিকে ও খায়?
– অবশ্যই। তাই বলতে যাচ্ছি। তিমিকে খায় হাঙ্গর, কিলার হোয়েল এবং অন্য অনেক মাছ। ব্যাকটেরিয়া এসে তিমির শরীর পঁচিয়ে দেয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, তিমির সেই শরীর খেয়ে সেখানে সমুদ্রের গভীরে নতুন বাস্তুতন্ত্র মানে ইকোসিস্টেম তৈরি হয়। প্রবাল তৈরি হয়৷ প্রানীদের আবাসস্থল তৈরি হয়। প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। কি সুন্দর ভাবে তিমির শূন্যতাকে হাজার ও প্রাণীর বাস্তুসংস্থান করে দিয়েছে দেখলে?
মনিরুজ্জামান মাথা নেড়ে বললো,
– এই তিমি নিয়ে যে কত গল্প শুনেছি। আজো শুনি। বালিন তিমির গল্প শুনেছো কেউ?
শাহাদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ও খেতে খেতে বললো,
– তুই কন্টিনিউ কর। আমি শেহজাকে খাওয়াই।
মনিরুজ্জামান বলতে থাকলো,
– ১৯৮৯ সালে বালিন প্রজাতির একটি তিমির সন্ধান পায় নেভির একটি টিম। হাইড্রোফোনে ধরা পড়ে বায়ান্ন হার্জ কম্পাংকে তিমির গান। যেই গান অন্য প্রজাতির তিমি বা বালিন প্রজাতির অন্য তিমি শুনতে পায় না কারণ অস্বাভাবিক কম্পাঙ্কের ছিলো সেই গান। অন্য তিমিদের কম্পাংক থাকে ১০ থেকে ২০ হার্জের মাঝে। গবেষকদের ভাষ্যমতে সেটি কোনো গান নয়, তিমির কান্না। তার অনুসারীরা কেউ হয়তো বেঁচে নেই,তাকে ভালোবাসার কেউ নেই। তার ডাকেও কেউ সাড়া দেয় না তাই সে ডেকেই যায়। সেই নিঃসঙ্গ তিমি এখনো বেঁচে আছে। আমাদের মত তিমিও সামাজিক জীব। একা বাস করা যে কত কষ্টের তা হয়তো যে একা থাকে সে ছাড়া কেউ বুঝে না।
দিয়া খেতে খেতে বলে,
– আহারে! আমার তিমি টার জন্য মায়া হচ্ছে। ওকে একটু একটু আদর করে দিয়ে আসতে পারতাম!
দিয়ার কথা শুনে সকলে খাবার থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। শাহাদ সরাসরি দিয়ার দিকে ফিরে বলে,
– বেশি কষ্ট হচ্ছে?
– হুম
– ইশ! সবাই দেখেছো আমার গিন্নীর কি কষ্ট তাও আবার তিমির জন্য।
– তো কি হয়েছে তিমি কি মানুষ না? ওহ! স্যরি মানুষ না। তিমি স্তন্যপায়ী তো! ওই বাচ্চাটার কেউ নাই। কত কষ্ট।
– থাক তোমার আর ভাবতে হবে না। আদর করতে গিয়ে আমাদের বাবা মেয়েকে আদরশূণ্য করে তিমির পেটে গিয়ে পার্টি করার মতো কিছু হয়নাই। কি আজিব কথা বার্তা। তিমির জন্য নাকি মায়া হচ্ছে! তিমি যে মাংসাশী প্রাণি তা কি ভুলে গেছো? আল্লাহর দুনিয়ায় এত জিনিস থাকতে মায়া তিমির জন্যই হলো?
রোকসানা হাসতে হাসতে বলে,
– আরেহ ভাবীর কি দোষ? মনির এমন ভাবে বলছে মায়া তো আমার ও হচ্ছে, বাচ্চা টার জন্য।
শাহাদ ভ্রু কুচকে বললো,
– যাকে তোমরা বাচ্চা বলছো সেই তিমির বয়স কম হলেও কয়েক মিলিয়ন বছর হবে। মজার কথা শোনো। আমরা এখন প্রশান্ত মহাসাগরে আছি, ওই তিমি কিন্তু এখানেই ঘুরে বেড়ায়। চাইলেই আদর করতে পারো দুজন। আচ্ছা আমি ওকে দেখলে ডেকে বলবো, আমার বান্ধবী আর স্ত্রী তোমাকে আদর করতে চায় বাবু। কাছে এসে ধরা দাও। চলবে?
রাহিল হো হো করে হাসতে হাসতে মাটিতে লুটোপুটি খাওয়ার মতো অবস্থা, সেই সাথে রকিব,মনিরুজ্জামান, আদিত্য এবং মল্লিকার ও একই দশা। শাহাদ দুজনকে এমন ভাবে প্রতিটি কথা বললো দুজনই ঠোঁট বাকিয়ে একে অন্যের দিকে চেয়ে আছে। এদিকে শেহজা মুখে হাত দিয়ে হাসছে। মেয়েকে খাইয়ে শাহাদ বলছে,
– আম্মা, আপনার আদরে ভাগ বসাতে আসছে তিমি। থাক আজকে থেকে বাবাই আপনাকে আদর করবো। তিমি তো অনেক বড়, মায়ের সব আদর শেষ হয়ে যাবে।
দিয়া খাবার একপাশে রেখে গাল ফুলিয়ে বলে,
– খাবোনা আমি আর! কি এমন করলাম যে আপনি মজা নিচ্ছেন?
রোকসানা শাহাদকে ধমকে বললো,
– তুই কি পাগল, কেনো এমন করছিস। মা জাতি আমরা। মায়া লাগাটা কি অস্বাভাবিক?
রকিব বলে উঠলো,
– না স্বাভাবিক, ঠিক আছে। তবে তিমিই কেনো? আচ্ছা শাহাদ এমন করিস না আর। ওদের মায়া গ্যালাপাগোস গিয়ে কাজে লাগাবো আমরা। ওখানে অনেক একা প্রাণী আছে।
রকিবের মাথায় যে দুষ্টু বুদ্ধি শাহাদ ধরে ফেলেছে। মিটমিটিয়ে হেসে বলে,
– ঠিক আছে। আমি খুবই দুঃখিত আর মজা করবোনা।
দিয়া খাবার শেষ করে উঠে মেয়েকে কোলে নিয়ে রুমে চলে গেলো। খাবার টেবিলে সবাই শাহাদের দিকে মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এবার মল্লিকা বলে উঠলো,
– আহারে! শাহাদ তোর জন্য মায়া লাগছে এবার। যা গিয়ে কথা বল। তিমির জন্য রাখা মায়া থেকে একটু মায়া যদি পাস তুই তো চাঁন কপালী। ভাবী আর কথা বলবেনা।
মুখে বিষাদের ছাপ এনে মনিরুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– পুরো জগৎ জাহান জুড়ে এত কাহিনী থাকতে এই বালিন তিমির কাহিনীটাই তোকে শোনাতে হলো?
উঠে চলে গেলো শাহাদ। এদিকে ভ্যাবাচেকা মনিরুজ্জামান বলে উঠলো,
– ওমা! আমি কি করলাম। যত দোষ নন্দ ঘোষ!
হো হো করে হেসে উঠলো সবাই। সৃষ্টি হলো আনন্দঘন সুন্দর একটি মুহুর্ত।
চলবে।