সুখ অমৃত পর্ব-০৫

0
103

#সুখ_অমৃত
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

আবু সুফিয়ান রাশেদকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে মানতাশাদের বাড়িতে। এখানে এসে শুরুতেই সে লক্ষ্য করল চারিপাশের থমথমে পরিবেশ। বুঝতে বাকি রইল না নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে। পুরো বাড়ি জুড়ে মানুষের ভীড়। সুফিয়ান রাশেদকে আদেশ দিলো,
“তুমি এক্ষুনি সবাইকে ঠেলে সরানোর ব্যবস্থা করো। আমায় ভেতরে যেতে হবে।”

রাশেদ সুফিয়ানের আদেশ মতোই কাজ করল। কয়েকজন গার্ডকে দিয়ে ভীড় ভাট্টা কমালো। ভীড় কমতেই সুফিয়ান বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। ড্রয়িংরুমে এসেই হতবাক হয়ে গেলো। মঞ্জুয়ারা বেগম ফ্লোরে বসে আহাজারি করে কেঁদে চলেছেন। কি মানে এই কান্নার? সুফিয়ানের সন্দেহ এবার গাঢ় হলো। মঞ্জুয়ারা বেগমের কাছে এসে সে বেশ উত্তেজিত গলায় বলল,
“কি হয়েছে টা কি? এখানে এত জটলা কেন? মানতাশা কোথায়?”

সুফিয়ানকে দেখে মঞ্জুয়ারা বেগমের আহাজারি আরো বাড়ে। তিনি নাকি সুরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“পালিয়েছে ও..”

সুফিয়ানের চেহারায় শক্ত ভাবমূর্তি ফুটে ওঠে। নিজ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে বলে,
“এত পাহাড়া ভেঙে ও পালালো কিভাবে? আপনাকে তো আমি বলেছিলাম ওকে দেখে রাখতে।”

“আমি ওকে প্রায় ধরেই ফেলেছিলাম..কিন্তু ও আমার নাকে কিছু একটা স্প্রে করে পালিয়ে গেল..”

“ড্যাম ইট..রাশেদ..এক্ষুনি গোটা শহরে লোক লাগিয়ে দাও। আমার মনে হয়না মানতাশা এখনো খুব দূরে গিয়েছে বলে। আর হ্যাঁ, সব বাস স্ট্যান্ড, রেলস্টেশন আর এয়ারপোর্টে লোক ছড়িয়ে দাও। ও যেন কোনভাবেই পালাতে না পারে।”

“জ্বি, স্যার।”

সুফিয়ান সামনে থাকা একটা ফুলদানি তুলে নিয়ে আছড়ে ফেলে বলে,
“এত সহজে তোমাকে আমি পালাতে দেব না মানতাশা। তোমাকে আমার বন্দিনী হতেই হবে।”


“আপনাকে ধন্যবাদ ভাইয়া, আমাকে এখান অব্দি পৌঁছাতে সাহায্য করার জন্য।”

মৃদু হেসে কথাটা রাসেলকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে মানতাশা। রাসেল বলে,
“ধন্যবাদ জানানোর কোন প্রয়োজন নেই। তুমি আমার বোন রেখার বন্ধু, মানে তুমি আমারও বোন। কখনো কোন বিপদে পড়লে এই ভাইকে অবশ্যই স্মরণ করবে।”

“জ্বি, অবশ্যই। আচ্ছা ভাইয়া, আমি তাহলে এখন আসি। আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে।”

“হ্যাঁ, এসো। আর সাবধানে যেও।”

মানতাশা দ্রুর এয়ারপোর্টের দিকে পা বাড়ায়। এতক্ষণে বুঝি সুফিয়ানের কাছে তার পালানোর খবর পৌঁছে গেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে এই দেশ ত্যাগ করতে পারবে তত তাড়াতাড়ি সে শান্তি পাবে। এয়ারপোর্টে ঢুকে যাবতীয় ফর্মালিটিস পূরণ করতে গিয়ে মানতাশার নাভিশ্বাস উঠে যায়। ভীষণ বিরক্তি বোধ হয়। কিন্তু তার কিছু করারও ছিল না। মানতাশা ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আল্লাহ, তুমি আমার সহায় হও। এতদূর যখন আসতে পেরেছি তখন যেন নিশ্চিন্তে এই দেশটাও ত্যাগ করতে পারি।”

অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মানতাশা বিমানে ওঠে বসে। আর মাত্র কিছু সময় তারপরই সে সুফিয়ানের বদনজর থেকে অনেক দূরে চলে যাবে। ভাবতেও মনে অভাবনীয় শান্তি অনুভূত হচ্ছে। সে আর কখনো চায় না ঐ লোকটার মুখোমুখি হতে। এখন দুবাইয়ে গিয়ে নিজের মতো একটা সুন্দর জীবন গড়ে তুলবে এটাই তার স্বপ্ন।


আবু সুফিয়ান থেকে থেকে ঝিমোচ্ছে। জীবনে প্রত্যাখ্যান শব্দের সাথে সে খুব একটা পরিচিত নয়। কিন্তু আজ একটা একরত্তি মেয়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করে এভাবে চলে গেল। এটা তার কাছে তুমুল অপমানের। যার ফলে ক্রোধে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। প্রচুর রাগ জমছে মানতাশা নামক মেয়েটির প্রতি। ভেবেছিল মেয়েটাকে বিয়ে করে নিজের রাণী করে রাখবে কিন্তু মেয়েটার এহেন কর্মকাণ্ডে তার ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। এখন সে চায় মেয়েটাকে খুঁজে বের করে তাকে নিজের কাছে বন্দি করে রাখতে। এবার প্রয়োজনে তাকে রক্ষিতা করে রাখবে। এভাবেই ঐ মেয়েকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।

রাশেদ খেয়াল করছে সুফিয়ানের উদ্বেগ। তাই সে সুফিয়ানের কাছে এসে বলে,
“স্যার,আপনার কি কিছু লাগবে?”

“আমার এখন শুধু আর শুধু ঐ মেয়েটাকে লাগবে। যেখান থেকে পারো ওকে আমার সামনে এসে হাজির করো। স্বর্গ-মর্ত-পাতাল যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, আমার পায়ের কাছে এনে ফেলো ঐ মেয়েক।”

রাশেদ কর্তব্যপরায়ণ ভৃত্যের মতো বলে,
“আমি সব যায়গার ঐ মেয়ের খোঁজে লোক লাগিয়ে দিয়েছি স্যার। আপনি চিন্তা করবেন না। ঐ মেয়ে যেখানেই ঘাপটি মে’রে বসে থাক খুব শীঘ্রই ওকে আপনার সামনে এনে হাজির করবো।”

সুফিয়ান রাশেদের এই অভয় বাণীতে স্বস্তি পায় না। রাগে কাপতে থাকে তার পুরো শরীর। মানতাশার উদ্দ্যেশ্যে তীব্র ভৎসর্না করে বলে,
“তুমি যেখানেই লুকিয়ে থাকো মানতাশা…খুব শীঘ্রই তোমাকে আমার পায়ে এসে পড়তে হবে। তোমাকে আমার দাসত্ব বরণ করতেই হবে।”


দুবাই, ইমারতের শহর। যার বুকে অবস্থিত বিশ্বের সবথেকে উঁচু ইমারত বুর্জ খলিফা। পারস্য উপসাগরের পারে অবস্থিত এই শহরে পা রাখলো মানতাশা। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে সে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার উড়ানের পর সে অবশেষে আবু সুফিয়ানের থেকে হাজার মাইল দূরে এসে পৌঁছেছে। যেখানে ঐ লোকটা আর চাইলেও তার খোঁজ পাবে না। ভাবতেই অদ্ভুত প্রশান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছে পুরো মন। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের ফুফুকে খুঁজতে থাকে মানতাশা। তার ফুফু হুসনেয়ারা বেগম তো বলেছিলেন তিনি বিমানবন্দরে মানতাশাকে নিতে আসবেন। তাহলে এখনো এলেন না কেন?

মানতাশা অপেক্ষা করতে লাগলো। ক্রমশই অধৈর্য হয়ে উঠল। এরমধ্যেই সে দেখতে পেল একজন বোরকা পড়া মহিলা তার দিকে এগিয়ে আসছে। মানতাশার নিজের পরণেও বোরখা। তবে হিজাব ব্যবহার করায় তার মুখটা দেখা যাচ্ছে। তবে ঐ মহিলার আপাদমস্তক বোরখায় আবৃত। তাই মানতাশা সহজে চিনতে পারল না। মহিলা যখন কাছে এসে সস্নেহে ডেকে উঠল,
“মানতাশা।”

তখনই এই পরিচিত স্বর চিনে ফেলল। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল নিজের ফুফুকে।

“আমি কি একটু বেশি দেরি করে ফেললাম? তোকে কি একটু বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে?”

হুসনেয়ারা বেগমের প্রশ্নের জবাবে মানতাশা বলল,
“হ্যাঁ, একটু।”

দুজনেই সমস্বরে হেসে উঠল। আজ অনেক দিন পর মানতাশা কারো সাথে এমন আনন্দে কথা বলতে পারছে। মায়ের থেকে কাঙ্খিত স্নেহ কখনো পায়নি, বাবার মৃত্যুর পর তো মায়ের জঘন্য রূপ দেখতে হয়েছে। তবে ফুফুর থেকে সবসময় মাতৃস্নেহ পেয়ে এসেছে।

মানতাশার ফুফু বিয়ে করেছে এই দেশেরই এক নাগরিককে এবং সে এই দেশের নাগরিকত্বও পেয়েছে। বাংলাদেশে খুব একটা যায়না সে। সর্বশেষ মানতাশা যখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল তার কিছু দিন আগে ফুফুর দেখা পেয়েছিল। তারপর আজ এই প্রথম। মানতাশার ফুফু তাকে বলে,
“অনেকক্ষণ বোধহয় তোকে অপেক্ষা করতে হলো। চল, এখন আমার সাথে।”

মানতাশা তার ফুফুর সাথে চলে। একটু সামনে যেতেই একটি ল্যাম্বরগিনী গাড়ি দেখতে পায়। এটা তার ফুফুর। মানতাশা অবাক হয়না। তার ফুফু দুবাইয়ের অন্যতম ধনী এক শেখ পরিবারের পুত্রবধূ। তাই তার কাছে এরকম গাড়ি থাকাটা স্বাভাবিক। হুসনেয়ারা বেগম মানতাশাকে সেই গাড়িতে উঠে বসতে বলে। মানতাশা হালকা হেসে গাড়িতে উঠে বসে।


সুফিয়ানের রাগ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মানতাশাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ১৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো কেউ তার খোঁজ দিতে পারছে না। সুফিয়ান রাশেদের উদ্দ্যেশ্যে চিতকার করে বলে,
“টাকা দিয়ে একগাদা অকর্মন্য পুষে রেখেছি, কেউ কোন কাজের না।”

“আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি স্যার।”

সুফিয়ান রাগত স্বরে বলে,
“ঐ মেয়ের খুব শখ আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর। একবার শুধু ওর খোঁজ পাই, তারপর দেখাবো কত ধানে কত চাল।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨