সুখের ঠিকানা পর্ব-২৮+২৯

0
212

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব২৮

আবাসিক এলাকার সরু পথ দিয়ে গাড়ি চলছে।পথটা লিয়ার কেমন জানি চেনাচেনা লাগছে। মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে লিয়া মনে করতে থাকে।কিছুক্ষণ পর লিয়ার মনে পড়ে।এটা তো জারিফদের বাসার রাস্তা।একবার এসেছিলো লিয়া।সেই নাতাশার জন্মদিন উপলক্ষে।তাছাড়া এদিকটায় আগে বা পরে কখনো আসা হয়নি।তাই অতটা মনে ছিলো না।লিয়া বুঝতে পারার সাথে সাথেই তড়িৎ ঘাড়টা ঘুরিয়ে জারিফের দিকে তাকালো।জারিফ ড্রাইভিং করছে।নজরজোড়া সামনে থাকলেও বিশেষ মনোযোগ তো পাশে বসা লিয়ার দিকে।লিয়ার এভাবে তাকানো দেখে জারিফ স্মিত হাসলো।লিয়া কপাল কুঁচকে শুধালো ,,

“এই আপনি আগে বলেননি কেনো?আর এভাবে আসলে কেমন দেখাবে না?সবাই কি ভাববে, বলুনতো? আপনার আগে বলা উচিত ছিলো।”

লিয়া মিছেমিছি একটু রা’গ দেখালো।মুখটা ভার করে রাখলো।জারিফ দৃষ্টি সামনে রেখেই স্পষ্ট গলায় সোজাসুজি বললো,,”কে কি বললো?আই ডোন্ট কেয়ার।আমার বউকে আমার বাড়িতে আনছি তাতে কেমন দেখাবে আবার। বরং সবদিক দিয়ে ভালোই দেখাবে।আর তোমাকে আগে থেকে বলিনি কারন,তুমি অজুহাত দেখিয়ে আসতে চাইতে না। উত্তর পেয়েছো?”

লিয়া ছোট শ্বাস ফেলে নিশ্চুপ রইলো।তবে ভেতরে ভেতরে লিয়ার অস্বস্তি ফিল হতে থাকে।বাড়ির বউ হিসেবে এই প্রথম আসা হবে।আর বিয়েটা তো আর সবার মতো স্বাভাবিকভাবে হয়নি।তার উপরে কত কাহিনী হলো।এখন হুট করে এইভাবে তাদের সামনে যেতে হবে।এটা ভাবতেই লিয়ার অস্বস্তি বোধ সর্বোচ্চ হতে থাকে। এরমধ্যে জারিফের গাড়ি বাড়ির সামনে এসে পরে।লিয়া মাথাটা তুলে নিভুনিভু চোখে সামনে তাকায়।বাড়ির তোরণে নামফলকে দৃষ্টি যেতেই লিয়া একবার চোখের পলক ফেললো। সুন্দর কারুকার্য খচিত সুখের ঠিকানা লেখা নামফলক লিয়ার নজর কাড়লো। এরমধ্যে জারিফ গার্ডেন এরিয়ায় গাড়ি দাঁড় করায়।জারিফ নেমে লিয়ার পাশে গিয়ে ডোর খুলে দেয়।লিয়া জারিফের দিকে চাইলো।লিয়ার চোখেমুখে কেমন জানি দ্বিধা স্পষ্ট না হলেও, জারিফ ঠিক বুঝতে পারলো লিয়ার মুখায়বের এরুপ এক্সপ্রেশনের কারন।জারিফ চোখ দিয়ে ইশারা করে আশ্বাস দিলো।লিয়া কতটা ভরসা পেলো জানেনা তবে অস্বস্তিটা কাটানোর চেষ্টা করলো। জারিফ একহাত লিয়ার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে শীতল কন্ঠে বললো,,

“ওয়েলকাম লিয়া।এগেইন ওয়েলকাম মাই বেটারহাফ।আমার বেটারহাফ পরিচয়ে এই প্রথম তোমার আগমন আমাদের ছোট্ট সুখের ঠিকানায়।আমি চাই সকল আনইজি, দ্বিধা দূরে ঠেলে হাসিমুখে প্রবেশ করবে।”

লিয়া জারিফের হাতের দিকে একপলক চাইলো।আবার জারিফের মুখের দিকে।লিয়া একটু সময় নিয়ে নিজের ডান হাতটা জারিফের হাতের উপর রাখলো।জারিফ আলতোভাবে লিয়ার হাতটা ধরলো।ইশারা করতেই লিয়া নামলো।জারিফের পাশাপাশি ধীর পায়ে হেঁটে যেতে থাকলো।সুন্দর রুচিশীল কারুকার্য করা আভিজাত্যপূর্ণ কাঠের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো জারিফ লিয়া।জারিফ একহাতে বেল চাপলো।লিয়া শাড়ির আঁচলটা একহাতের সাহায্যে অপর কাঁধের উপরও খানিকটা তুলে রাখলো।জারিফকে ইশারা করে বললো,সব ঠিকঠাক আছে কিনা।জারিফ লিয়াকে স্ক্যান করে। অতঃপর পলক ঝাপটে বোঝালো ঠিক আছে। এরমধ্যে দরজা খুলে দেয়।দরজা খুলে হাসিমুখে জারা দাঁড়িয়ে আছে।জারা মিষ্টি হেসে বললো,,

“ঈদ মোবারক ভাবী।কেমন আছো?”

লিয়া স্মিত হাসলো। মৃদুস্বরে বললো,,
“ঈদ মোবারক। আলহামদুলিল্লাহ।”

জারার স্বাভাবিক এটিটিউড দেখে লিয়া অবাক হচ্ছে ।বাট লিয়াকে দেখে জারা একটুও অবাক হয়নি বা হচ্ছে না।তা জারার ফেস দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে লিয়া।জারা বললো,,

“ভাইয়া এতো দেরি হলো যে।কখন থেকে ওয়েট করছি।”

লিয়া এবার জারার এতটা স্বাভাবিক থাকার কারন ধরতে পারলো।তারমানে জারা আগে থেকেই জানতো লিয়ার আসার খবর।লিয়া মনেমনে আওড়ায়,তবে কি জারার মতো বাকিরাও জানে?জারিফ পাঞ্জাবীর গলার পাশে একহাতের সাহায্যে সামান্য ফাঁকা করে ঠোঁট গোল করে ফু দিয়ে নিলো । কিয়ৎকাল পরে বললো,,”গরম লাগছে খুব।পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস যে।জারা ভেতরে যেতে দিবি তো।”

জারা একহাত কপালে রেখে বললো,,”ওহ্ শিট।”

একটু থেমে লিয়াকে উদ্দেশ্য করে ফের কোমল স্বরে বললো,,”ওয়েলকাম এবাড়ির বড় বউ। মোস্ট ওয়েলকাম আমার মিষ্টি ভাবীকে।”

লিয়া বিনিময় স্মিত হাসলো।জারিফ লিয়া একসাথে ভেতরে ঢোকে।ভেতরে যেতে যেতেই জারা চেঁচিয়ে বলতে থাকে,,”মা,ছোটোমা তাড়াতাড়ি আসো।দেখবে ভাইয়া কাকে নিয়ে এসেছে।”

জারিফ জারার মাথায় একহাতে গাট্টা মে’রে বললো,,”এভাবে চিল্লিয়ে বলে কেউ।এইসময় সবাই রুমে বিশ্রাম করছে হয়তো।”

জারা জারিফের কথায় মুখ ভেংচি কাটলো।লিয়াকে জারা বসতে বললো।লিয়া শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেচাতে থাকে।লিয়ার গলা শুকিয়ে আসছে।টেনশন আর লজ্জা লিয়াকে ঘিরে ধরছে। টেনশন টা অজান্তেই হচ্ছে।আর লজ্জা সবাই কি ভাববে হুট করে আজ এভাবে আসায়। উফ্!মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে অথচ লিয়া ঘামতে শুরু করে। এরমধ্যে একএক করে সবাই আসতে থাকে।নিরুপমা বেগম এসে লিয়াকে দেখে অবাক হয়ে বললেন,,

“ওমা!লিয়া তুমি।”

লিয়া সালাম দেয়। নিরুপমা বেগম মায়াময় জড়ানো কন্ঠে ভালোমন্দ জিগ্গেস করলেন। অতঃপর জারিফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,”জারিফ লিয়াকে আজ আনবি আগে একবার বলতে পারতি তো।আমি তো এইসময় লিয়াকে দেখে একদম সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।”

কথাটা শেষ করেই নিরুপমা বেগম শব্দহীন অমায়িক হাসলেন। জারিফ কিছু বলার আগেই এরমধ্যে জাহানারা বেগম ড্রয়িংরুমে আসতে আসতেই বললেন,,”কি হয়েছে জারা?এতো চিৎকার করছিস যে?কে এ

কথাটা শেষ করার আগেই লিয়াকে দেখতে পান।আর কিছু বললেন না।চুপ করে গেলেন। পিছুপিছু নাতাশা আসে।লিয়াকে দেখে দৌড়ে আসে।তবে আগে জারিফের কাছে যায়। অভিযোগের সুরে বললো,,

“মামা তুমি মামীকে আনতে গিয়েছিলে।খালামনিকে তোমার কথা জিগ্গেস করায় বললো সারপ্রাইজ আছে। তাহলে আজ মামীই হলো ঈদের বড় সারপ্রাইজ তাইনা?”

শেষের কথাটা বলে নাতাশা ঝকঝকে দাঁত বের করে ঠোঁট মেলে হাসলো।জারিফ নাতাশার গাল টিপে দিয়ে বললো,,”হ্যা সোনা। আচ্ছা মামীর সাথে গল্প করো আমি ফ্রেশ হবো।”

কথাটা শেষ করে জারিফ নিজের রুমের দিকে যেতে থাকে। জাহানারা বেগমের মুখায়ব দেখে লিয়া বুঝতে পারছে না। লিয়ার আসায় খুশি হয়েছে নাকি খুশি হননি?কারন মুখটা বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে।লিয়া প্রথমে সালাম দেয়। অতঃপর নিজ থেকেই ভদ্রতার খাতিরে নম্র স্বরে বললো,,”আন্টি কেমন আছেন?”

লিয়ার দিকে একপলক চাইলো। গম্ভীর গলায় বললো,,”ভালো।”

আর দ্বিতীয় কথা না বলে ভেতরে চলে গেলেন।ওনার এভাবে যাওয়াতে লিয়ার মনটা খচখচ করতে থাকে। ভালোমন্দ কিছুই জিগ্গেস করলেন না।লিয়া মনেমনে আওড়ায়,তবে কী ছেলের বউ হিসেবে আমাকে মেনে নিতে পারেননি? উফ্! আন্টি তো আপুকে খুব পছন্দ করতো। সেটা আমি ভালো করেই জানি।হয়তো আপুর জায়গায় আমাকে মেনে নিতে পারছেন না।লিয়ার মুখটা মলিন হয়ে আসে।জারা আর নিরুপমা বেগম লিয়াকে ঘিরে ধরেছে।জারা তো এটাসেটা বলেই চলছে।সাথে নিরুপমা বেগমও মনের অনুভূতি প্রকাশ করেই চলেছেন।ওনার কি যে ভালো লাগছে তা বলে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছেন না। এরমধ্যে কথা আর কল্পনা বেগম আসলেন।কথার কলেজে ছুটি হওয়ার পর বাড়িতে গিয়েছিলো।মায়ের সাথে ঈদের দিন আবার ফিরলো।কথা এখানে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কল্পনা বেগমও ভাইয়েদের কাছেই বেশি থাকেন। স্বামী বিদেশ থাকেন।আর কোনো সন্তান সন্ততি নেই।তাই আর বাড়িতে একলা একলা মন টেকে না।এইতো একসপ্তাহ আগে শ্বশুরের ভিটায় গিয়েছিলেন ঈদ উপলক্ষে।ঈদ না ফুরাতেই আবার মেয়েকে নিয়ে হাজির হয়েছেন। এসে লিয়াকে দেখে রীতিমতো অবাক হলেন।ব্যাকা চোখে তাকালেন।কথা ব্লাক কালারের জর্জেট থ্রি পিস পড়েছে।ওড়নাটা কাঁধের উপর দিয়ে একপাশে নেওয়া।জামাটা গায়ের সাথে আঁটসাঁট। চুলগুলো কাঁধ সমান কালার করা।কথা অপরিচিত কাউকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে।তবে কে তা জানার আগ্রহ হলেও বাইরে তা প্রকাশ করলো না। সিঙ্গেল সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করতে লাগলো।জারা লিয়াকে কল্পনা বেগমকে দেখিয়ে পরিচয় করে দিলো।লিয়া কার্টেসি মেইনটেইন করতে নম্রস্বরে কুশল বিনিময় করে।তবে কল্পনা বেগম দায়সারা ভাব নিয়ে দু একটা কথা বললেন।আশেপাশে তাকিয়ে বললেন,,

“তোমরা সবাই এখানে বড় ভাবীকে দেখছি না।তা ভাবী দেখেছে ছেলের বউ ঘুরতে চলে এসেছে।”

কথাটা লিয়ার কাছে ভালো শোনালো না। চলে এসেছে ঠেস দিয়ে বলা কথাটা লিয়ার ইগোতে লাগল।কথাটা যে ভালো মনে বলেনি তা লিয়া নিজেও বুঝতে পারলো।তবে ভদ্রতার খাতিরে মুখ বুজে সহ্য করলো লিয়া। আর কাউকে বুঝতেও দিলো না ভেতরের অবস্থাটা।জারা আর নিরুপমা বেগম দু’জনের কাছেও ভালো লাগলো না। নিরুপমা বেগম চুপ থাকলেও জারা চুপ থাকতে পারলো না।জারা বেশ সুক্ষভাবে বলে উঠলো,,

“ওহ্! ফুপ্পি।এসেছে নয়।বলো নিয়ে এসেছে।তোমার ভাইয়ের ছেলে নিজে গিয়েছিলো আনতে।ভাইয়া নিজে ভাবীকে আনতে গিয়েছিলো। এখন ভাইয়া এতো করে বলার পরে না আসে তাহলে কেমন হয়না।তাইতো ভাবী ভাইয়ার মন রাখতে আজকে ঈদের দিন আমাদের সবার আনন্দটা বাড়িয়ে দিতে আসছে। ঈদের দিনের আনন্দঘন পরিবেশটা আরো বেশি করে মনোমুগ্ধকর করার জন্য তোমাকে এত্ত এত্ত লাভিউ ভাবী।থ্যাংকস আ লট ভাবী।তুমি আসায় আমার এই ঈদটা তো আরো বেশি স্পেশাল হয়ে গিয়েছে দেখছি।”

শেষের কথাগুলো দুইহাতে লিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে জারা বলতে লাগলো। কল্পনা বেগম মনেমনে অনেক কিছুই বললেন।তবে মুখে আর কিছুই বলার ফাঁকফোকর খুঁজে পেলেন না। শুধু মনেমনে আওড়ালেন, যত্তসব আদিখ্যেতা।তারপর কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন।নিরুপমা বেগম উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,,
“তোমরা কথা বলো।আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”

এই বলে নিরুপমা বেগম কিচেনের দিকে যাবেন বলে পা বাড়ান।ঠিক এইসময় চারু নাস্তা হাতে ড্রয়িংরুমে আসে। চারুর হাতে নাস্তা দেখে নিরুপমা বেগমের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে।মনেমনে ভাবলেন,ভাবী তো লিয়ার সাথে ঠিকমতো কথা বললো না।তবে চারুকে নাস্তা আনতে কে বললো? কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায় জারিফ হবে হয়তো।কারন ভাবীকে এখন অব্দি লিয়াকে নিয়ে কখনো কিছু বলতে শুনিনি।জারিফের বিয়ের আগে তাসনিমকে নিয়ে অনেক গল্প করতেন আমার কাছে।ছেলের বউকে আদর করে পুতুলের মতো করে রাখবেন।কই জারিফ যখন থেকে লিয়ার সাথে যোগাযোগ শুরু করলো।তারপরেও তো লিয়াকে নিয়ে কখনো এতটুকু আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখেনি।তবে আমার মনে হচ্ছে উনি হয়তো লিয়াকে এখনো মেনে নিতে পারেননি।এসব কথা মনেমনে ভেবেই মাথা ঝাড়া দিলেন নিরুপমা বেগম। কাজের মেয়েকে উদ্দেশ্য করে শুধালেন,,

“বাহ্!চারুর দেখছি অনেকটা উন্নতি হয়েছে।আজ এতো তাড়াতাড়িই নাস্তা রেডি হলো।আগে তো হাতে হাতে হেল্প করে বলে বলে এটা কর সেটা কর বলতে হতো।তা আজকে জারিফ বলেছে জন্য চারুর এই উন্নতি।তবে ভালো।”

চারু হাতের ট্রে টা টি-টেবিলের উপর নামালো। বলতে লাগলো,,”খালা আম্মা আমারে নাস্তা রেডি করতে বলছে।আর উনিই হাতে হাতে সাহায্য করলেন। সেইজন্য তো তাড়াতাড়ি হইলো।যেই শুনলাম জারিফ ভাইজানের বউ আইছে ।আমার মন তো ছটফট করছিলো দেখবার জন্যি।তয় খালাআম্মা আদেশ জারি করলেন।একবারে যেনো নাস্তা নিয়ে যাই।তাইতো ভাবীরে দেখতে আসতে দেরি হইলো।”

একনাগাড়ে গড়গড় করে কথাগুলো বললো চারু। নিরুপমা বেগম একটু অবাক হলেন। জাহানারা বেগম চারুর দিয়ে নাস্তা পাঠিয়েছেন।তবে কেনো লিয়ার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বললেন না?নিরুপমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেতরে যেতে থাকেন।চারু হাসিমুখে বললো,,

“মাশাআল্লাহ।ভাবী তো এক্কেবারে পরির মতোন সুন্দর দেখছি।জারিফ ভাইজানের সাথে দারুন মানাইছে।”

কথা পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন স্ক্রল করছিলো। এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ আগেই পরিষ্কার হয়েছে এই লিয়া।জারিফের বউ।লিয়াকে আজ এখানে দেখে কথার জেলাস হচ্ছে।তার উপর জারা আর ছোটো মামীর লিয়াকে নিয়ে এতো আদিখ্যেতা সহ্য হচ্ছে না ।আবার চারুর কথাশুনেও রা’গ টা যেনো মূহূর্তেই বেড়ে গেলো।মনেমনে সাপের মতো ফুঁসছে।চারুকে উদ্দেশ্য করে আদেশের সুরে বললো,,

“এই চারু।এক মগ কফি এনে দাও।সুগার কম দিবে কিন্তু।মনে থাকে যেনো,হ্যা।”

চারু আড়ালে মুখ বাকালো।এই বাড়ির কোনো ছেলেমেয়েরা কখনো এইভাবে আদেশের সুরে বলে না।কিছু বললেও কত সুন্দর বিনয়ের সাথে বলে।আর কথার এই বিহেভে চারু ভীষণ বিরক্ত।তবে সাহস করে মুখে কিছুই বলতে পারে না।মনেমনে এক পশলা ঝাড়লো কথাকে। অতঃপর কিচেনে চলে যায়।

লিয়া নিজের পার্সোনালিটি নিয়ে চুপচাপ আছে।সামনে বসা মেয়েটা যখন কথা বলার, পরিচিত হবার কোনোই আগ্রহ দেখাচ্ছে না।তাই নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলার খুঁজে পেলো না লিয়া।কথা ভেবেছিলো লিয়া হয়তো নিজ থেকেই কথা বলবে।পরিচিত হবে। কথার সে ভাবনা ভুল প্রমাণ করে লিয়া স্বাভাবিক আছে।কথা হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।একটু ভাব নিয়ে কপাল কুঁচকে চিকন স্বরে বললো,,

“ইউ লিয়া?রাইট?”

লিয়া মাথা নাড়িয়ে বললো,,”ইয়াহ।”

থেমে লিয়া ফের বললো,,” এন্ড ইউ?”

“আমি কথা।জারিফ ভাইয়ার কাজিন।”

লিয়া ছোট করে বললো,,”ওহ্।”

জারা কিছু বলছিলো।সেই সময় কথা প্রসঙ্গে লিয়া জারাকে শুধায়,,”জারিফ আমাকে আনবে তুমি জানতে।ঠিক তো?”

জারা মিষ্টি হেসে বললো,,”হুম।তবে শুধু আমি নই।আরেকজনও জানে।নীল।নীল ভাইয়াও জানে। আমি আর নীল ভাইয়াকে বলেছিলাম তোমাকে আনার কথা।ভাইয়া শোনার সাথে সাথেই বললো বাহ্! দারুণ আইডিয়া।”

লিয়া বিনিময় স্মিত হাসলো।কথা ফোড়ন কে’টে বললো,,”হাউ স্ট্রেইন্জ! এখনো সবাইকে জানিয়ে উঠিয়ে আনা হয়নি।উঠানো ছাড়া কি কেউ শ্বশুর বাড়িতে এভাবে আসে?বিষয়টা কেমন দৃষ্টিকটু লাগবে না। এমনিতেই ওদের বিয়েটা স্বাভাবিক নয়।জোর করে বিয়ে।নিকট আত্মীয়রা ছাড়া তেমন কেউ জানেও না।তাই আমার মনেহয় এভাবে না আসলেই ভালো হতো।আর আমাদের সোসাইটিতে উঠিয়ে আনার আগে হুটহাট এইভাবে আসা ভালো দেখায় না।”

লিয়ার মুখের হাসিটা ম্লান হয়ে যায়।লিয়ার জারিফের উপর অভিমান হতে থাকে,কি দরকার ছিলো আজ এভাবে আনার। শুধুশুধু এই সমস্ত কথা সৃষ্টি করার কোনো মানে ছিলো না।জারা কথাকে উদ্দেশ্য করে তড়িৎ বলে উঠলো,,”কথা আপু তুমি চুপ করো তো।ভাইয়া যেহেতু এনেছে।ভাইয়া নিশ্চয় তোমার থেকে কম বোঝে না। তাই মনেহয় তোমার কথাটা সম্পূর্ণ অহেতুক আর অযৌক্তিক।”

কথা ফের বললো,,”আই ডোন্ট থিংক এ্যস লাইক বাট আই থিংক দেয়ার পেস্ট্রিজ। সমাজের লোকেরা এটাসেটা বলতে পারে।”

জারা এবার বিরক্তিকর ফেস করে ঠোঁট চেপে বললো,,”হয়েছে হয়েছে।তোমাকে এত জ্ঞানের কথা বলতে হবে না। বিয়েটাই মেইন আর উঠিয়ে আনা, সবাইকে জানানো এসব জাস্ট আনুষ্ঠানিকতা।বুঝলে?”

কথার মুখটা থমথমে হয়ে যায়। পাল্টা কি বলা যায় উপযুক্ত কোনো যুক্তি দাঁড় করাতে না পেরে কথা রাগে গজগজ করতে করতে রুমে চলে যায়। এরমধ্যে আনোয়ার রহমান বাসায় আসেন।লিয়ার সাথে ভালোমন্দ কথা বলে ঈদের সালামি দেন।জারা লিয়াকে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে।লিয়া না করে।বলে আজ নয়।পরে দেখা যাবে।সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে লিয়ার খা’রাপ লাগছে। শ্বাশুড়ি মা এখনো আর সামনে আসেনি।এইজন্য লিয়ার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।কথা আর কল্পনা বেগমের কথা অতোটা গায়ে মাখেনি লিয়া।ধরতে গেলে ওনারা এই বাড়ির মেহমান।তাই তাদের বিষয়টা আমলে নিচ্ছে না লিয়া।তবে জারিফের মায়ের বিষয়টা লিয়াকে খুব ভাবাচ্ছে।তাই আর কোনো কিছু দেখার এতটুকু আগ্রহ হচ্ছে না লিয়ার। নিরুপমা বেগম এসে সোফায় বসলেন।নীল এখনো বাসায় ফেরেনি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।এই নিয়ে নিরুপমা বেগম আফসোস করে কতকি বলছেন।ঈদের দিন ছেলেটা আজ সারাদিন বাইরেই বলা চলে।না দুপুরে খেতে এসেছে। ‌কোথায় কোথায় যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছে। এরমধ্যে জাহানারা বেগম আসলেন।জারাকে ডেকে ভরাট গলায় বললেন,,

“জারা এতো তো গল্প করছিস।একবারো খেয়াল করেছিস।মেয়েটা কখন থেকে সোফায় বসে আছে।এভাবে বসে থাকলে পিঠ লেগে যাচ্ছে না।ও তো নতুন যায়গায় আসছে। লজ্জা করে কোনো অসুবিধার কথা বলতে পারবে না। তুই তো একটু খেয়াল করে বলবি কিনা?বড় হয়েছিস।কোনো বুদ্ধি শুদ্ধি হয়নি এখনো। যা লিয়াকে রুমে নিয়ে যা। অনেক্ষণ এভাবে আছে ‌রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিবে।”

লিয়া মুখটা কিঞ্চিৎ তুলে জাহানারা বেগমের দিকে চাইলো। মনের কোণে এইবার একটু হলেও লিয়ার প্রশান্তি হলো।এরমধ্যে জারিফ আসলো।জারিফের গায়ে লিয়ার গিফট করা চেইক শার্ট।সাথে এ্যশ কালারের জিন্স। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। শার্ট টা ছেড়ে দিয়ে পড়া।জারিফ মায়ের সব কথাই শুনতে পায়।জারিফ জাহানারা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো,,

“মা বলছি যে, সন্ধ্যা হয়ে আসছে তো। আন্টিকে বলে আসছিলাম। সন্ধ্যার পরপরই লিয়াকে পৌঁছে দিবো।তাই এখন লিয়াকে বাসায় দিয়ে আসি।”

জাহানারা বেগম গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বললেন,,”এখান থেকে বেশি দূর নয় লিয়ার বাসা।তাই রাত হলেও সমস্যা হবে না।লিয়া ডিনার করে যাবে।রাতে লিয়াকে পৌঁছে দিয়ে আসিস,কেমন?”

থেমে ফের বললেন,,”জারা ওকে রুমে নিয়ে যা।”

আর কোনো বাক্য প্রয়োগ না করে জাহানারা বেগম প্রস্থান করেন।লিয়া রীতিমত অবাক জাহানারা বেগমের কথায়।তবে লিয়া এখনো সমীকরণ মেলাতে পারছে না। জাহানারা বেগম ভালোবেসে বললেন।নাকি সৌজন্যতার খাতিরে বললেন। একজন মানুষ বাসায় আসছে।না খেয়ে গেলে কেমন হয়। হেনোতোনো শুধু কী এইজন্যই ডিনার করে যেতে বললেন?নাকি ছেলের বউ হিসেবে একটা স্নেহ ভালোবাসার জায়গা থেকে বললেন?এই প্রশ্নগুলো লিয়ার মনমস্তিষ্কে বিচরণ করতে থাকে।তবে উত্তর অজানাই থাকে লিয়ার। দোদুল্যমান অবস্থায়ই থাকে লিয়া। নেগেটিভ চিন্তাই মানুষের মনমস্তিষ্কে বেশি হয়।ঠিক তেমনি লিয়ারও হচ্ছে। শ্বাশুড়ি হয়তো সো কলড সৌজন্যতার জন্য এরকম বললেন।মন থেকে এখনো হয়তো মেনে নিতে পারেননি।তাইতো এখনো একবারো কাছে এসে আদূরে গলায় কিছুই বললেন না।আর নাতো স্নেহের হাত মাথায় রেখেছেন।জারিফ নাতাশাকে নিয়ে বাইরে হাঁটতে যায়।

জারা লিয়াকে জারিফের রুমে নিয়ে যায়।জারা মিষ্টি কন্ঠে বললো,,”ভাবী এইটা তোমাদের রুম। বিশ্রাম নাও।আমি আসছি।”

জারা চলে যায়।লিয়া রুমের চারিদিকে নজর বুলাতে থাকে।এই বাড়িতে এর আগে একবার আসা হয়েছে তবে এই রুমে আসা হয়নি।এই প্রথম এই রুমে পা ফেলানো হলো।জানালার দামি আভিজাত্যপূর্ণ সফেদ পর্দাটা দক্ষিণা মৃদু বাতাসে হালকা উড়ছে। রুমটা বড়সড়।মাঝে বেড।বেশ পরিপাটি,গুছানো সব কিছু। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো লিয়া। কিছুক্ষণ এভাবে বসে রইলো। অতঃপর রাজিয়া সুলতানাকে ফোন করে বললো। বাসায় যেতে একটু দেরি হবে।লিয়া ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বের হয়ে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছে নিলো।ওয়ালের সাথে সেট করা আয়নার সামনে দাঁড়ালো।নিজেকে নিজেই আনমনে প্রশ্ন করলো, আন্টি কি আমাকে অপছন্দ করে?যার কারনে আমার সাথে কোনো কথাই বললেন না এখন পর্যন্ত। উফ্! এরমধ্যে লিয়ার ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস পড়ে।লিয়া ভাবনায় নিমজ্জিত থাকায় কারো আগমন টের পায়নি।লিয়ার ভাবনার ছেদ পরে জারিফের স্পর্শে।জারিফ লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখে।লিয়ার সাথে আয়নায় চোখাচোখি হয়।শাড়ির আঁচল ভেদ করে জারিফের হাত লিয়ার পেট স্পর্শ করে।লিয়ার গলা শুকিয়ে আসছে যেনো।জারিফ শীতল কন্ঠে বললো,,

“কি এতো ভাবছো বলোতো?মন খা’রাপ?আগে থেকে বলিনি সেইজন্য সত্যিই রেগে আছো তুমি।”

লিয়া আয়নাতে দৃষ্টি রেখেই মাথা ঘুরালো।ছোটো করে বললো,,”উঁহু।”

জারিফ লিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। শক্ত করে লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে।লিয়া আচমকা জারিফের বুকে মাথা রাখলো।জারিফের হার্টবিট যেনো শুনতে পারছে লিয়া।জারিফ আন্দাজ করতে পারলো।লিয়ার নিশ্চয় মন খা’রাপ।জারিফ লিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,,

“এই লিয়া কি হয়েছে বলো?কেউ কিছু বলেছে তোমাকে? বলো আমাকে।”

লিয়া জারিফের বুকে মুখ গুঁজে থেকেই বললো,,”নাহ্ এমন কিছুই না।”

জারিফ এবার দুইহাতে লিয়ার মুখটা আঁজলা করে ধরে। শান্ত চাহনিতে লিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,,”তাহলে কেমন কিছু?”

লিয়ার কোনো উত্তর আসলো না।লিয়াকে নিশ্চুপ দেখে জারিফ মজা করে বললো,,”তুমি মন খা’রাপ করে আছো কেনো আমি বুঝতে পারছিনা। মন তো আমার খা’রাপ করা দরকার। তাও আবার একটু আধটু নয়। অনেক বেশি।কারন তখন গাড়িতে কত করে বললাম মিষ্টি মুখ করাও।তোমার পাথর মন কিছুতেই নরম হলো না। একটা কিস অন্তত দিলে না।সেই দুঃখে কষ্টে আমার তো একযুগ মন খা’রাপ করে থাকার কথা। তবুও দেখ আমি মন খা’রাপ না করে দিব্যি স্বাভাবিক আছি।”

জারিফের কথাশুনে লিয়া হেসে ফেলে।জারিফ লিয়াকে হাসানোর জন্যই মূলত মশকরা করে কথাগুলো বলে।জারিফ লিয়াকে আরেকটু টাইলি জড়িয়ে ধরে।লিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,”কি করছেন ছাড়ুন।কেউ আসতে পারে।”

জারিফ একহাতে লিয়ার পেটে স্লাইড করতে করতে দুষ্টুমির স্বরে বললো,,”এখনো তো কিছুই করিনি।উই আর ম্যারিড।সো এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।আর কেউ আসলে নক করবে।”

জারিফের গরম নিঃশ্বাস লিয়ার চোখে মুখে পড়ছে।লিয়ার গোলাপি পাতলা ওষ্ঠ তিরতির করে কাঁপতে থাকে।জারিফ এক আঙ্গুল দিয়ে লিয়ার ঠোঁটে স্লাইড করে।লিয়ার ঠোঁট জোড়া জারিফকে চম্বুকের মতো টানছিলো।জারিফ লিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট রাখে।লিয়া একহাতে জারিফের বাহু খামচে ধরে।আবেশে লিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলে। প্রায় তিন মিনিট খানেক পরে জারিফ লিয়ার ঠোঁট ছেড়ে দেয়।জারিফ বড় করে শ্বাস টেনে নেয়।লিয়া জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিতে থাকে। লজ্জায় লিয়া জারিফের বুকে মুখ লুকায়।জারিফ মুচকি হেসে বললো,,

“টেস্টটা দারুণ ছিলো।এই লিয়া আমার তো এ্যগেইন মোর টেস্টটা নিতে ইচ্ছে করছে।”

লিয়া তড়িৎ জড়তা নিয়ে বললো,,”এ একদম নয়।”

কথাটা শেষ করে লিয়া নিজেকে জারিফের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নেয়।জারিফের সামনে থাকতে লজ্জা হচ্ছিলো তাই ব্যালকনিতে যায়।জারিফ মুচকি হেসে বললো,,”এতটা লজ্জা পেলে তোমার সাথে বাসর কি করে হবে আমি তো সেই চিন্তায় আছি।তবে ভালো লজ্জা নারীর ভূষণ।”

লিয়া ব্যালকনিতে গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়।রুমের মৃদু আলো দরজা দিয়ে ব্যালকনিতে আসছে। কিছুক্ষণ পর জারিফ লিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদুস্বরে বললো,,”লিয়া আমি ভেবেছি খুব শীঘ্রই তোমাকে উঠিয়ে আনবো।নীল কি বলে জানো?আমার নাকি অর্থের সংকট চলছে তাই বউকে বাবার বাড়ি রেখেছি।নীল নাহয় সামনে এটা বলেছে। অসামনে,আড়ালে এরকম কথা অনেকেই হয়তো বলবে।তাই ভেবেছি বউকে বাবার বাড়ি রাখা ঠিক হচ্ছে না। দ্রুত আমার কাছে নিয়ে আসবো।”

লিয়া বললো,,”লেইম এসকিউজ রাখেন।আমি যথেষ্ট ব্রেনি। আপনার এই সুক্ষ চাল আমি ধরতে পারি,হুম।”

জারিফ লিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুইহাতে লিয়ার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,,”ওয়েল।তবে সত্যিই দিনকে দিন তোমার মায়ায় আমি খুব জড়িয়ে যাচ্ছি।তোমাকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।আমি সিরিয়াসলি বলছি লিয়া।লিয়া আমি ভেবেছি তাসনিমের বিয়ের রেশটা কাটলেই সবাইকে জানিয়ে তোমাকে উঠিয়ে আনবো।”

লিয়া দুইহাতে জারিফের গলা জড়িয়ে ধরলো। নির্বিকার কন্ঠে বললো,,”আমি সবে এইচএসসি দিলাম। এখনো পড়াশোনা অনেক বাকি।এখনই ঘর সংসার করার মতো ম্যাচিউরড আমি হইনি ‌। পৃথিবীর সব থেকে বড় দায়িত্ব হলো সংসারের দায়িত্ব। সেটা নেওয়ার জন্য আরো অনেক কিছু জানাশোনা প্রয়োজন।আর একজন স্টুডেন্ট একটা দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। একজন স্টুডেন্ট একটা দেশের রত্ন।আর আপনি কিনা সংসারের বোঝা কাঁধে তুলে দিয়ে।একটা দেশরত্নকে শেষ করতে চাইছেন। একজন টিচার হয়ে আপনার থেকে এমনটা জাতি কখনোই আশা করবে না।”

অদ্ভুত লজিক এর। লজিক শুনে আমি শিহরিত।যত উদ্ভট লজিক যেনো আমার ক্ষেত্রেই এর দেখানো লাগে। উফ্!এসব কথা মনেমনে ভেবেই মাথা ঝাড়া দিলো জারিফ।গলা ঝেড়ে কন্ঠে শীতলতা নিয়ে বললো,,”ব্যাপার না।”

লিয়া একটু চমকালো। এতক্ষণ কি বোঝালো।আর এ কি বুঝলো।আল্লাহ মালুম।লিয়ার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে দিয়ে জারিফ ফের বলতে থাকে,,”ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক ডজন দেশরত্ন দেবো দেশের স্বার্থে।তাহলে বলো একটার জায়গায় ডজন খানেক হলে দেশের তো লাভই হবে।”

লিয়ার কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজের সৃষ্টি হলো। লিয়া দৃষ্টি সরু করে চাইলো। প্রশ্ন করে উঠলো,,”মানে?কি বলছেন বুঝলাম না?”

জারিফ মুচকি হেসে বললো,,” একজন দেশরত্নের ঘাড়ে সংসার নামক বোঝা তুলে দিয়ে তার ভবিষ্যৎ শেষ করলাম।এই একজনের যায়গায় এক ডজন খানেক পিউপিল দিতে পারি। তুমি রাজি থাকলেই সম্ভব। জাস্ট বারো বছর লাগবে।বারো বছরে বারোটা বাচ্চা কাচ্চার জন্ম দিয়ে ক্ষতিপূরণ পুষিয়ে দেবো,হুম। ‌কি বলো ভালো আইডিয়া না?”

জারিফ ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করে।লিয়ার মুখটা হা হয়ে যায়।লিয়া ঠোঁট প্রসারিত করে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,,”মোটেই ভালো আইডিয়া নয়,হু।”

লিয়া কিয়ৎকাল ভেবে ফের বললো,,’এটা তো মজা করে বলছিলাম।আসল কথা হলো আমি পরিবারের ছোটো মেয়ে ।আমার বড় তুলি।তুলির এখনো বিয়ে হয়নি। তাই কিকরে ওকে ফেলে আমাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাবে।এটা কেমন দেখায় না।আপনি যদি একান্তই আমাকে চান তবে ওয়েট করুন। আমার অনার্স কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত মনেহয় না আমার আব্বু কন্যাদান করবে। এদিকে আমি অনার্স কমপ্লিট করতে থাকি ততদিনে তুলির বিয়েটাও হয়ে যাবে।”

জারিফ অসহায় ফেস করে করুণ সুরে বললো,,”এটা তো ওয়ান কাইন্ড অব পানিশমেন্ট হয়ে যাচ্ছে। এখনো চার থেকে পাঁচ বছর ওয়েট করা লাগবে।আমি ততদিনে অ’ক্কা পাবো। এতদিন ওয়েট করার ধৈর্য্য আমার নেই।”

লিয়ার নাকে নাক ঘসে আদূরে গলায় ফের বললো,,”এই লিয়া।আমার প্রতি একটু সহৃদয় হও।কঠোর মনটাকে একটু তো নরম করো।”

লিয়া বলতে থাকে,,”ভালোবাসার জন্য মানুষ কতকি করে। সম্রাট শাহজাহান তার বেগমের জন্য তাজমহল পর্যন্ত বানিয়ে ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।আর আপনি মাত্র চার থেকে পাঁচ বছর ওয়েট করতে পারবেন না।ভেরি ব্যাড।”

জারিফের মুখটা থমথমে হয়ে যায়।জারিফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ম্লান স্বরে বললো,,”অনেক নিদর্শন দেওয়া যাবে।সেটা আমার কাছে থেকেই নাহয়।”

লিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে উল্টোদিক হয়ে একহাতে লোহার গ্রিল খুঁটতে খুঁটতে বললো,,”সহজেই কোনো কিছু পেয়ে গেলে তার মূল্য থাকে না।আর আপনাকে একটু পরখ করে দেখাও দরকার।আমি শুধুই আপনার মোহ কিনা।যা আবার সময়ের সাথে কে’টে না যায়। এসবের জন্য হলেও একটু সময়ের প্রয়োজন।”

জারিফ গ্রিলের সাথে ঠেস দিয়ে লিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালো।দুইহাত বুকে গুঁজে নরম কন্ঠে বললো,,”সময় যত চাও দেওয়া যাবে।তবে দূরত্ব যেমন ভালোবাসা বাড়ায় ঠিক তেমনি বিভিন্ন সময় সমস্যাও সৃষ্টি করে।সেই হিসেবে বলছি আরেকবার ভেবে দেখো।”

লিয়া নির্বিকার থাকে। কোনো কিছু না বলে নিশ্চুপ রয়। লিয়াকে চুপচাপ দেখে জারিফ হতাশ হলো।চুলের মধ্যে আঙুল চালনা করে নিলো। অতঃপর লিয়ার দিকে ঝুঁকে একদম ক্ষীন আওয়াজে একটু সুর করে বললো,,

“এতো ভালোবাসা দেবো তোমায় যে ভালোবাসা পৃথিবীতে নাই।জানিনা কিকরে আমি তোমাকে বোঝাই?না বলা কথা আজ বলে দিতে চাই!”

লিয়া ভেতরে ভেতরে মুচকি হাসলো।তবে বাইরে শক্ত খোলস ধরে রাখে।জারিফের সামনে দূর্বলতা প্রকাশ করলো না।লিয়া ঠোঁট মেলে বললো,,”এত অবহেলা করেছেন।এখনো সবটা ভুলতে পারিনি।জানিনা কিকরে সবটা ভুলবো আমি।”

জারিফ এবার সত্যিই হতাশ হলো। ছোট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।জারিফ লিয়াকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।লিয়ার মুখের উপর থাকা চুলগুলো কানের পাশে ঠেলে দিলো।একহাত লিয়ার গালে রেখে আদূরে গলায় বললো,,”এই লিয়া সরি টা কি গ্রান্ট করা যায়না।মানছি তোমার সাথে রুঢ় আচরণ করেছি।ক্ষমা করা হলো মহৎ গুণ।আর আমি চাই সব মহৎগুণের অধিকারী মিসেস জারিফ হবে।তো আমাকে ক্ষমা করে গুণটা নিজের মধ্যে আছে কিনা তার প্রুভ দাও।”

লিয়ার ঠোঁটের কোণের হাসিটা চওড়া হলো।লিয়া জারিফের চুলের মধ্যে হাত চালনা করে। ঠোঁট আওড়িয়ে বললো,,”আপনি খুব কানিং। গল্পের সেই ধূর্ত শেয়ালের মতো মনে হচ্ছে।কথা দিয়ে আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন।তবে মিসেস জারিফ এতটা বোকা নয়, যে আপনার চাল ধরতে পারবে না।”

জারিফ লিয়ার গলায় মুখ ডুবিয়ে বললো,,”যেমনই হই না কেনো।তোমারই তো বর।”
.
জাহানারা বেগম কিচেনে রান্না করছেন।এমন সময় কল্পনা বেগম আসলেন।এসে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,,”ভাবী একা একা এইসময় রান্না করছো।আমাকে বলো কি করতে হবে।আমি হেল্প করছি।”

জাহানারা বেগম কড়াইয়ে কিছু নাড়তে নাড়তেই বললেন,,”থাক লাগবে না।এইতো হয়ে গিয়েছে প্রায়।ছোটো ছিলো এতক্ষণ কেবলই রুমে গেলো।”

কল্পনা বেগম ঠোঁট উল্টে বললেন,,”ওহ্!”

মুখায়বটা দুঃখী দুঃখী করলেন।হতাশার সুরে ফের বললেন,,”জানো ভাবী আমার না নাতাশার জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।”

জাহানারা বেগম ঘাড় ঘুরিয়ে কল্পনা বেগমের দিকে চাইলেন।কপাল কুঁচকে শুধালেন,,”তোমার হঠাৎ নাতাশাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে যে।তা বুঝতে পারলাম না।কারনটা কী?”

চলবে,,,

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব২৯

“বাচ্চা মেয়েটার মা নেই।আর বাবা থেকেও নেই। এরকম বাবা থাকা আর না থাকা সমান কথা। কোনোদিন এসে খোঁজখবর পর্যন্ত নেয়না নাতাশার। তার উপর মেয়েটা অসুস্থ।একবারো ফোন করেও ভালমন্দ খোঁজ নেয়না।আজ পাঁচ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে।এতদিনেও যখন নাতাশার বাবা মেয়ের খোঁজখবর নেয়নি। আমার মনেহয় না আর ভবিষ্যতেও নিবে।নাতাশাকে সারাজীবন নানার বাড়িতেই থাকতে হবে।বাবা বেঁচে থাকলেও বাবার আদর,স্নেহ মেয়েটার কপালে নেই।”

আফসোসের সুরে বলতে থাকেন কল্পনা বেগম। জাহানারা বেগম হালকা কেশে নিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,,”তাতে কি হয়েছে?আমরা আছি তো।এখন পর্যন্ত নাতাশাকে কখনো বাবা মায়ের অভাব বুঝতে দেইনি।অসুখ আছে। সৃষ্টিকর্তা চাইলে একসময় সুস্থ হয়ে যাবে।নাতাশা নানার বাড়ির বোঝা হয়ে বড় হবে এরকম আচরণ আমি বা আমাদের পরিবারের কেউই এখনো করেনি।আর আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতেও করবে না। জন্ম দিয়ে নামে মাত্র বাবা হওয়া যায়।আর সেই নামে মাত্র একজন বাবার মধ্যে পরে নাতাশার বাবা।এরকম বাবার ছায়াও যেনো আমার নাতনীর উপর না পরে আমি মনেপ্রাণে চাই।তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।নাতাশার বাবা ওকে আমাদের কাছে রেখে আমাদের উপকারই করেছে। নাতাশার মধ্যে আমি আমার মেয়েকে খুঁজে পাই। আমার মেয়ের সবচেয়ে বড় জীবন্ত স্মৃতি তো নাতাশা। আমার মেয়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন আমার কাছে ।আমি তো এইজন্য মনেমনে নাতাশার বাবাকে ধন্যবাদ জানাই।আর সৎ মায়ের কাছে মানুষ হওয়ার থেকে নানা নানীর কাছে বড় হওয়া ভালো নয় কি?নাতাশার নানা নানী এখনো বেঁচে আছে।তার উপর নাতাশার মামা আছে।জারিফ ওকে কম ভালোবাসে না।বাবার আদর স্নেহ পাবেনা তাতে কি হয়েছে।বাবা,মামা,চাচা এরাই তো হলো একটা মেয়ের আসল অভিভাবক। সৃষ্টিকর্তা চাইলে জারিফ একাই নাতাশার সব অভাব পূরণ করতে পারবে। এতটুকু বিশ্বাস আমার ছেলের উপর আছে।”

জাহানারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে মনোযোগ দিলেন ‌।কল্পনা বেগম ফোড়ন কাটলেন। ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে ফের বললেন,,”আরে ভাবী চিন্তাটা তো আমার মূলত এইখানেই।জারিফ নাতাশাকে খুব আদর করে ভালোবাসে তা আমিও জানি।এখনকার ছেলেমেয়ে বিয়ে শাদি করলে বদলে যায়।তার উপর যখন নিজের বাচ্চা কাচ্চা হবে তখন কি আর বোনের মেয়ের উপর এতো আদর যত্ন থাকবে?আর এই মেয়েটাকেও আমার ঠিক অতটা সুবিধার ঠেকছে না।দেখো বলে রাখলাম দিনদিন নাতাশার উপর জারিফের আদর ভালোবাসা ক্ষীন হয়ে আসবে। আল্লাহ না করুক,তোমাদের অসম্ভবে জারিফের বউ এতিম মেয়েটার সাথে কিকরম আচরণ করবে।সেই ভেবে আমার খুবই টেনশন হচ্ছে। এখনকার ছেলেরা বউয়ের বিরুদ্ধে গলা উঁচিয়ে কথা বলতে পারেনা।কিছু বললেই হুমকি স্বরূপ সংসার ছেড়েছুড়ে যাওয়ার ভয় দেখায়।আর শান্ত শিষ্ট ভদ্র ছেলেরা মানসম্মানের দরুণ বউয়ের সব কিছু মেনে নেয়।তাই বলছি,নিজের নাতনির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু হলেও ভেবো,কেমন?”

জাহানারা বেগম যথেষ্ট বিরক্ত হলেন কথাগুলো শুনে।কড়া করে কিছু বলার ইচ্ছে হলেও ভদ্রতার জন্য সেটা করলেন না।তবে ঠান্ডা মাথায় কিয়ৎক্ষন ভেবে নিলেন। অতঃপর বেশ ভদ্রভাবে শান্ত কন্ঠে বললেন,,”এখনই নেগেটিভ ভাবছো কেনো? পসিটিভও তো ভাবা যায়।এরকম বলছো কেনো?নাতাশা ওর মতো করে লেখাপড়া করবে।ভালো কোনো পজিশনে যাবে।তখন ওর দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে না।আর সেই পর্যন্ত যাওয়ার জন্য তোমার ভাই আছে।তার অবর্তমানে জারিফ থাকবে।জারিফ একটা দায়িত্ববান ছেলে। কখনোই জারিফ ওর মরালিটি থেকে বিচ্যুত হবে না।আমার ছেলে আমি তাকে চিনবো না।এতদিনে আমার ছেলেকে এতটুকু যদি নাই চিনি,তাহলে কেমন মা হলাম আমি।”

কথাটা বলে মৃদু হাসলেন। অতঃপর থেমে ফের বললেন,,”আর তোমাকে বলি এতো এসব নিয়ে চিন্তা না করে, তুমি বরং ওদের জন্য দোয়া করো।জারিফ লিয়ার জন্য মন থেকে দোয়া করো।যাতে ওদের সংসার জীবন হুরঝুর এককথায় ঝামেলা মুক্ত হয়।এখন তো ঝামেলা ছাড়া জীবনযাপন করাই দায়। প্রায় সংসারেই হুটহাট এটাসেটা নিয়ে ভুলবোঝাবুঝি অশান্তি লেগেই থাকে। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে প্রে করো ওদের সংসার লাইফটা যেনো অনাবিল আনন্দ প্রশান্তিতে কাটাতে পারে।”

কল্পনা বেগমের মুখে যেনো আমাবস্যা নামলো। ফর্সা মুখটা লহমায় কালো হয়ে যায়।তবে আর বলার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। মনেমনে আওড়ালেন,ধূর!ভাবীকে কি বোঝাতে আসলাম।আর উনি তো নিজের বুঝ নিয়ে অটল রইলেন।আরো উল্টো আমাকে বুঝিয়ে গেলেন।তবে আমিও দেখতে চাই কতদিন জারিফের বউ নাতাশার উপর আলগা দরদ দেখায়।এখনকার মেয়েরা ছোট সংসার চায়।সময় গেলেই দেখা যাবে।এসব কথা মনেমনে বললেও মুখে ফের বলার ফাঁকফোকর পেলেন না।
.
জারিফের রুমে বেডের একপাশে লিয়া বসে।লিয়ার সামনে বেডের মাঝখানে নাতাশা বসে। নাতাশা আর লিয়া দুজনে মিলে জারিফের ফোনে এন্জেলা গেইম খেলছে। দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিচ্ছে,গোসল করিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছে।যখন খাবার খেতে চাইছে না তখন ঠাসঠাস করে মা’র’ছে ।লিয়ার হাতে ফোন। নাতাশা সামনে বসে থেকেথেকেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে।জারিফ ব্যালকনি থেকে রুমে আসে। এদের দুজনের কারবার দেখে জারিফের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে।তবে মনেমনে হাসিও পায় লিয়ার ছেলেমানুষী দেখে।লিয়া সহজেই সব পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।এটা দেখে জারিফের খুব ভালো লাগে।নাতাশার আর লিয়ার আদূরে মিষ্টি সম্পর্ক দেখে জারিফের মনে প্রশান্তি হয়।জারিফ লিয়ার পাশে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ে।পা বেডের বাইরে ঝুলছে।জারিফ লিয়ার শাড়ির আঁচল একহাতে পেচাতে পেচাতে মায়াময় স্বরে বললো,,

“এই লিয়া।”

লিয়া একটু সময় নিয়ে ছোট করে বলল,,”হুম।”

জারিফ মৃদু আওয়াজে ফের বললো,,”আজকে থেকে যাও-না।”

লিয়া তড়িৎ বিস্ফোরিত নয়নে জারিফের দিকে চাইলো।জারিফের শান্ত নজরজোড়ায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো লিয়া।জারিফ শাড়ির আঁচল একহাতে পেঁচিয়ে রেখেছে।সেই হাতের কনুই ভর দিয়ে মাথাটা হাতের উপর রেখে কাঁৎ হয়ে শুয়ে লিয়ার দিকে চেয়ে আছে।লিয়া কপট রাগ দেখিয়ে মোটা চোখে চাইলো।জারিফ ভ্রু কুঁচকে বললো,,”ইয়ে মানে বলছি যে রাত হয়ে গিয়েছে। রাত-বিরাতে নতুন বউয়ের বাইরে যাওয়া ঠিক নয়।ভূত পেৎ এর কুনজর পরে এরকম একটা ইথিকস আছে না। অনেকে তো বিশ্বাস করে।সেই কথায়ই বলতে চাইছি।”

কথাটা বলে জারিফ অপর হাতের সাহায্যে মাথা চুলকায়।লিয়ার ভীষণ হাসি পাচ্ছে।লিয়া ঠোঁট টিপে হাসলো।লিয়া মৃদুস্বরে বললো,,”আপনি ভূত-পেৎ এসবে বিশ্বাস করেন?আমার তো বিশ্বাস-ই হচ্ছে না।”

জারিফ ফেসটা অসহায় বানিয়ে করুণ সুরে বললো,,
“বিশ্বাস করিনা।তবে এখন বিশ্বাস করে যদি কোনো বেনিফিট পাওয়া যায়।সেই বেনিফিট পাওয়ার জন্য আজকের জন্য বিশ্বাস করলে মন্দ হয়না। কি বলো?”

জারিফ ভ্রু নাচায়।লিয়ার থেকে উত্তরের অপেক্ষায় থাকে।লিয়া ত্যাড়া করে বললো,,”জানিনা।”

এরমধ্যে জারা খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে আসে।ঘড়ির কাঁটা রাত আটার ঘর পেরিয়েছে। প্রতিদিনকার থেকে আজকে অনেক আগেই খাবার রেডি করছেন জাহানারা বেগম।লিয়া যেহেতু বাসায় যাবে তাই শুধুশুধু বেশি রাত করে পাঠানো ঠিক হবে না।লিয়া জারার সাথে ডায়নিং এর উদ্দেশ্য রুম থেকে যেতে থাকে।নাতাশা নানুভাইয়ের কাছ থেকে গল্প শুনবো বলে একদৌড় দেয়।জারা পিছনে ফিরে জারিফকে ডেকে বললো,,

“এই ভাইয়া তুইও আয়। সবাই একসাথেই খাবার খাবো।আয়।”

“আমি আসছি।যেতে থাক।”

ডায়নিং এ গিয়ে একটা চেয়ারে নীলকে দেখতে পায় লিয়া।নীলের চুলগুলো ভেজা।নীল ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল হাতে নিয়ে বড় করে বাইট দেয়।নিরুপমা বেগম ছেলের দিকে মোটামোটা চোখে চাইলেন।কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললেন,,”সারাদিন পর এখন রাত করে বাসায় ফিরলি।ভাব দেখে মনে হচ্ছে রাজ্যের কাজ সেরে নবাব পুত্র গৃহে ফিরলেন।এখন এসে ক্ষুধা লাগছে বলে পা’গল বানিয়ে দিচ্ছে। দুপুরে বাসায় এসে খাবার খেয়ে গেলে কি এমন ক্ষতি হতো?জানি সারাদিন তো পেটে ভাত পরেনি।কিছু খেয়ে থাকলেও ঐ ফাস্টফুড হাবিজাবি।আর এখন কিনা খালি পেটেই ফল খাচ্ছে। বললাম একটু অপেক্ষা কর সবাই এই চলে আসবে বলে।তোর যে আর তর সইছে না।”

নীল গালে থাকা আপেলের টুকরো গলাধঃকরণ করে বলে উঠলো,,”ও আম্মু।মাঝে মাঝে মনেহয়,তুমি আমার আম্মু না।আমাকে বোধহয় কুড়িয়ে পেয়েছিলে।সব সময় খিটখিটে মেজাজ তো দেখাও।আবার দেখছো মুখে কিছু একটা দিয়েছি।এখন আবার বকা শুরু করে দিয়েছো। জানানো কিছু খাওয়ার সময় বকলে বেষম উঠে।বেষম উঠে খাবার তালুতে উঠবে।আবার খাবার গলায় আঁটকে যেতেও পারে।তারপর

নিরুপমা বেগম ধমক দিলেন। তারপরের কথা উনার জানা।এরকম বলতে বলতে একদম উপরে চলে যাওয়া পর্যন্ত বলে তবেই নীল থামবে।এর আগে নয়।তাইতো ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।জারা শব্দ করে হেসে বললো,,”এতদিনে তুই বুঝতে পারলি।তোকে কুড়িয়ে পেয়েছে ছোটোমা ‌।আরে আমি তো আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই জানি।তুই আমাদের বংশের কেউ না।বক্ষ্মপুত্র নদের তীর থেকে কোনো এক কাক ভেজা ভোরে ছোটমা তোকে কুড়িয়ে পেয়েছিলো।”

“আরেকজন আসলো চাপাবাজ।আর এই চাপাবাজ এতোকাল শুনে আসলাম কাক ডাকা ভোর হয়।কাক ভেজা ভোর এইটা কোথায় পেলি তুই, হ্যা?”

দাঁত কটমট করে ঘাড় ঘুরিয়ে জারার দিকে তাকায় নীল।জারার পাশে লিয়াকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায় ।লিয়াকে দেখে মাথা চুলকিয়ে অপ্রস্তুত হাসলো নীল। তাৎক্ষনিক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।একহাতে ইশারা করে একটা চেয়ার দেখিয়ে ভদ্রভাবে বললো,,”ভাবী বসেন।এসে আপনার কথা প্রথমেই আম্মুকে জিগ্গেস করেছি। আম্মু বললো আপনি রুমে আছেন। বাইরে থেকে আসলাম গরম লাগছিলো। তাই ভাবলাম শাওয়ার নিয়ে এসে পরে আপনার সাথে দেখা করবো।”

জারা একটা চেয়ার টেনে লিয়াকে বসতে বলে।লিয়া বসে।নীল এটাসেটা বলছিলো সেই সময় কথা এসে চেয়ার টেনে বসলো। জাহানারা বেগম আর নিরুপমা বেগম খাবার সার্ভ করতে শুরু করেন। জাহানারা বেগম জারাকে শুধালেন,,

“জারা জারিফকে ডেকেছিস?জারিফ এখনো আসছে না যে।”

“ভাইয়া রুমেই ছিলো।বলেই তো আসলাম। ভাইয়া বললো আসছি।ও মা! এখন আবার তোমার ছেলেকে ডাকতে যেতে বলোনা, প্লিজ।তোমার ছেলের তো এত আগেই ডিনারের অভ্যাস নেই।তাই মনেহয় এখন খাবে না।পরে খাবে।”

একনাগাড়ে চঞ্চল গলায় কথাগুলো বলে থামলো জারা। এরমধ্যে কথা চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,,”ব্যাপার না জারা।তোমাকে যেতে হবে না।আমি ভাইয়াকে ডেকে দিচ্ছি কেমন।”

লিয়া প্লেটে একহাতে খাবার নাড়তে নাড়তে কথার দিকে আড়চোখে চাইলো। জাহানারা বেগম বলে উঠলেন,,”থাক কথা তোমাকে যেতে হবে না।তুমি খাবার খাও।জারিফ আসলে নিজেই চলে আসবে।”

কথা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসলো। নীল লিয়াকে উদ্দেশ্য করে শুধালো,,”ভাবী শুনলাম আপনার আপুর বিয়ে।তা বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি যাচ্ছেন কবে?”

“শুক্রবার আপুর বিয়ে। আমরা হয়তো বুধবারে যাবো।”

কথা ভ্রু বাকিয়ে বললো,,”লিয়া তোমার আপু মানে তো ভাইয়া যাকে পছন্দ করতো। মানে যার সাথে ভাইয়ার বিয়েটা হওয়ার কথা ছিলো।সে রাইট?”

মাত্র লিয়া মুখে খাবার তুলেছে এমন সময় কথার এহেন কথা শুনে মুখটা মলিন হয়ে আসে।লিয়া খাবারটা গলা দিয়ে নামাতে পারছে না।যদিও কথা ভুল কিছু বলেনি।কথাটা সত্যি তারপরেও লিয়ার কষ্ট অনুভব হতে থাকে।লিয়া মনেমনে আওড়ায়,এখানে সবার সামনে এই সত্যি কথাটা না বললে কি এমন ক্ষতি হতো?এটা বলা কি খুব জরুরী ছিলো? উফ্!কিছু কিছু মানুষের নেচারই হয়তো এমন।ঠিক দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করবে।লিয়া হ্যা না কিছুই বলতে পারছে না।

যতটা না কথার উপর রা’গ হচ্ছে তার থেকে দ্বিগুণ রা’গ নীলের নিজের উপরই হচ্ছে।নীলের নিজের মাথার চুল নিজেরই টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।নীলের মনে হচ্ছে আমি যদি এই কথাটা না বলতাম তাহলে এই বেয়াদব মেয়েটা এরকম বলার সুযোগই পেতো না। উফ্!আমার অপ্রয়োজনীয় কথার জন্য ভাবীর মনটা গেলো খা’রাপ হয়ে।জারা দাঁত কটমট করে বললো,,

“তাসনিম আপুর বিয়ে।শুনেছো?”

কথা খাবার চিবাতে চিবাতে ফের বললো,,”বাই দ্য ওয়ে,লিয়া তোমরা ঈদে বাড়ি যাওনি।না মানে ঈদ তো বেশিরভাগ মানুষ পরিবারের সবার সাথেই করে।এইদেখো আমাকে,আমি দাদুবাড়ি থেকে ঈদ করে।বিকেলে নানুবাড়িতে আসলাম।”

লিয়া ছোট করে বললো,,”নাহ্!এবার যাওয়া হয়নি।”

বারবার লিয়া লিয়া করে সম্বোধন করছে। জাহানারা বেগমের কাছে ভালো লাগছে না।উনি গম্ভীর মুখায়ব করে শান্ত স্বরে বললেন,,”কথা লিয়াকে নাম ধরে সম্মোধন করছো।এটা কেমন যেনো লাগছে।আমার কথায় কিছু মনে করো না,মামনি।আসলে তুমি তো শিক্ষিত একটা মেয়ে তোমার থেকে এমন সম্বোধন ঠিক ভালো দেখাচ্ছে না।”

“বড় মামী লিয়া আমার থেকে জুনিয়র।ও সবে এইচএসসি দিলো।আর আমি অনার্সে। ওর থেকে মিনিমাম দুই বছর খানেকের সিনিয়র তো হবো।”

জাহানারা বেগম তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন।ভরাট গলায় ফের বললেন,,”এখানে লিয়ার আর তোমার বয়সের ব্যবধান ম্যাটার করছে না। এখানে লিয়ার পরিচয় জারিফকে দিয়ে।জারিফের পরিচয়ে পরিচিত হবে লিয়া।লিয়া এবাড়ির বউ।জারিফের বউ হিসেবে লিয়ার প্রাপ্য সম্মান ওকে দিতে হবে।আর জারিফ যেহেতু তোমার বড়।বড় ভাইয়ের বউকে বারবার নাম ধরে ডাকা এটা আমার কাছে শোভা পায় না।তাই আমি চাইবো বড় ভাইয়ের বউকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে।”

কথা ভিতরে ভিতরে ফুঁসছে। মনেমনে আওড়ায়,আজ বড় মামী শুধুমাত্র এই মেয়েটার জন্য সবার সামনে আমাকে এত্তগুলা কথা শোনালো। একদিন এসেই সবাইকে বশীভূত করে ফেলেছে নাকি?এসব কথা মনেমনে ভেবেই মাথা ঝাড়া দিলো। অতঃপর মৃদুস্বরে বললো,,”সরি!বড়মামী। নেক্সট খেয়াল রাখবো।”

এরমধ্যে জারিফ এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। জাহানারা বেগম শুধালেন,,”জারিফ তোর দেরি হলো যে।জারা সেই কখন না ডেকে আসলো।”

“সরি!দেরি হয়ে গেলো।রুপম ফোন করেছিলো।কথা বলতে গিয়ে লেইট হয়ে গিয়েছে।”
.
খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষে লিয়া সবার থেকে বিদায় নিতে থাকে। লিয়া জাহানারা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু আওয়াজে বললো,,”আন্টি আসি।”

জাহানারা বেগম হঠাৎ করে নিজের গলার মোটা স্বর্ণের চেইনটা খুলে লিয়ার গলায় পড়িয়ে দিতে দিতে বললেন,,”আমার দেওয়া ঈদের সালামি হিসেবে দিলাম। যদিও পুরাতন।তুমি আবার মন খা’রাপ করো না। যে আমার শ্বাশুড়ি মা তার ব্যবহার করা জিনিস আমাকে দিলো। জারিফ তোমাকে আনবে তা জানতাম না। আগে থেকে বললে ভালো হতো।”

লিয়া হতবাক চোখে কিয়ৎক্ষন চাইলো । আনন্দে লিয়ার দুচোখ ছলছল করে উঠলো। চোখে ছলছল পানি নিয়েই লিয়া মৃদু হাসলো। কন্ঠে একরাশ শীতলতা নিয়ে ঠোঁট আওড়িয়ে বললো,,”মোটেই ওরকম কিছু ভাববো না।আর গিফটের থেকে বড় হলো আপনার দোয়া।আপনাদের দোয়া পেলে আর কিছু চাইনা আমার।”

জাহানারা বেগম অমায়িক হাসলেন। লিয়ার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতেই।লিয়া জাহানারা বেগমেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। জাহানারা বেগম লিয়ার পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। অতঃপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসে লিয়া।গাড়ি মূহূর্তেই চোখের আড়াল হয়ে যায়। জাহানারা বেগম আর নিরুপমা বেগম মেইন দরজার সামনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন।নিরুপমা বেগম অবাক চোখে বড় জা’য়ের দিকে তাকিয়ে আছে।নিরুপমা বেগম জিগ্গাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।ছোটো জা’য়ের চোখের দৃষ্টি দেখেই জাহানারা বেগম বুঝতে পারেন।তাইতো প্রশ্ন করার আগেই বললেন,,

“এইভাবে বিয়ে হওয়া।আবার সেদিন লিয়াকে ওর বাড়ির সবাই এতকরে বললো,তবুও লিয়া নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়লো না।আর সেদিন আমার ছেলে সহ পুরো পরিবার সবার সামনে অপমানিত হয়েছিলো।লিয়া যদি হলুদের পরের দিন বিয়েতে বসতো,তাহলে এতটা সম্মান ক্ষুন্ন হতো না। ইনভাইট করা অতিথিদেরকে ফোন করে বিয়ের অনুষ্ঠান ক্যান্সেল করার কথা বলা।এতটা সহজ বিষয় ছিলো না ছোটো।

থেমে আবার বললেন,,”উফ্ফ!কেউকেউ তো সামনের উপরই কতকি বলেছিলো তোর নিশ্চয় মনে আছে।আমার এসবের জন্য একটু হলেও লিয়াকে দায়ী মনে হতো।তবে আমার ছেলের মনের অবস্থা যখন আমি বুঝতে পারলাম।তখন থেকে মনে হলো,যা হওয়ার হয়েছে।এসব কিছু মনে পুষে রেখে ছেলের বউয়ের উপর রা’গ করে থাকা বো’কা’মি আর ছেলেমানুষি হয়ে যাচ্ছে।মেয়েটাও তো ছোট কতই বা বয়স ওর।ওর উপর অভিমান করা আমার সাজে না।আরো উপলব্ধি করলাম,কখনো কোনো জায়গায় ফাঁকফোকর রাখতে নেই।যদি সামান্যতমও ফাঁকফোকর থাকে তবে ঠিক সেখান দিয়েই তৃতীয়পক্ষ সু্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে।”

কথাটা বুঝতে নিরুপমা বেগমের এতটুকু সময় দেরি হলো না।মৃদু হেসে বললেন,,”একদম ঠিক বলেছো ভাবী।”

দুই জা আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে যায়।

গাড়ি চলছে শা শা করে।লিয়া বড় করে হামি দেয়।জারিফ তা দেখে কপাল কুঁচকে লিয়াকে শুধালো,,”এই তোমার ঘুম পাচ্ছে?”

লিয়া কাধটা সিটের উপর রাখলো। ঠোঁট মেলে বললো,,”হুম। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস তো। আজকে ঘুমানো হয়নি।তাই এত দ্রুতই ঘুম পাচ্ছে।”

জারিফ মুচকি হেসে বললো,,”তাহলে দেরি করছো কেনো?ঘুম যখন পাচ্ছে ঘুমিয়ে নাও।শিমুল তুলার বালিশ হিসেবে আমার কাঁধটা তো আছেই।যা কিনা বিয়ের আগে থেকেই ব্যবহার করে আসছো।”

লিয়ার পাঁচ সেকেন্ড লাগলো কথাটা বুঝতে।সেই ঢাকা থেকে ফেরার দিন বাসে জারিফের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলো। সেইকথা মনে হতেই লিয়া লজ্জা পায়।জানালা দিয়ে হুহু করে মৃদু শীতল বাতাস আসছে ‌রাতের আলো অন্ধকার পথে জারিফের পাশে বসে সময়টা লিয়া দারুন উপভোগ করছে।লিয়ার ভীষণ ভালো লাগছে।জারিফ একমনে ড্রাইভ করছে। আচমকা লিয়া জারিফের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দেয়।জারিফের কাঁধে মাথা রাখলো।জারিফ একহাতে ড্রাইভ করছে।অন্যহাতে লিয়াকে আগলে নেয়।লিয়ার হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তি বইতে থাকে।লিয়ার ঘুমুঘুম চোখ এভাবে প্রশান্তিতে থাকতে থাকতে অবশেষে ঘুমিয়ে পরে।গাড়ি এসে লিয়াদের কোয়ার্টারের সামনে থামে। লিয়া ঘুমের মধ্যে একহাতে জারিফকে জড়িয়ে ধরে আছে।জারিফ নিজের কাঁধের দিকে মাথাটা কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে চাইলো।লিয়া বাচ্চাদের মতো বিভোরে ঘুমাচ্ছে। লিয়ার ঘুমন্ত ফেসটা অসম্ভব সুন্দর লাগছে।জারিফ কিছুক্ষণ লিয়ার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখশ্রীর দিকে চেয়ে থাকলো।একহাতে লিয়ার কপালের উপর আসা এলোমেলো ছোট ছোট চুলগুলো হাত দিয়ে ঠেলে দেয়।লিয়া এবার একটু নড়ে উঠলো।নাক মুখ কুঁচকালো।জারিফের যদিও ইচ্ছে করছিলো না লিয়ার ঘুম ভাঙ্গাতে তবুও ডাকতে হবে লিয়াকে।এমনিতেই রাত দশটা বেজে আসলো।জারিফ লিয়ার গালে একহাত রাখলো। মৃদুস্বরে ডাকলো,,

“লিয়া।এই লিয়া।”

লিয়া চোখের পাতা টেনে তুললো। ঘুমুঘুম চোখেই তাকালো।ইশারায় করে বললো,,”কি হয়েছে?”

কথাটা বেধে যাচ্ছিলো ঘুমের কারনে।জারিফ বললো,,”উঠো এবার।থাকতে বললাম থাকলে না তো।থাকলে পরে সারারাত এভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারতে।এখন গাড়িতেই সারারাত এভাবে কাটানোর প্লান করেছো নাকি?”

জারিফের কথাটা কানে বারি খেতেই লিয়ার হুঁশ ফেরে।লিয়া দেখে সত্যিই জারিফকে জড়িয়ে ধরে আছে ‌।লিয়া দ্রুত সোজা হয়ে বসে।জড়তা নিয়ে ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,”চলে এসেছি।আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।বুঝতে পারিনি।”

জারিফ বিনিময় স্মিত হাসলো।লিয়া গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। সৌজন্যতার খাতিরে বললো,,”ভিতরে আসুন।”

“নাহ্।আজ আর নয়।রাত অনেক হয়েছে।”

একটু সময় নিয়ে দুষ্টুমি করে জারিফ ফের বললো,,
“তবে যদি মিষ্টিমুখ করাও তাহলে যেতে পারি।”

লিয়া জারিফের ফা’জ’লা’মো বুঝতে পেরে আর বাক্য ব্যয় না করে সোজা ভেতরে যেতে থাকে।
.
আজ মঙ্গলবার। পড়ন্ত বিকেল। এনামুল খাঁন সোফায় বসে কল লিস্টে গিয়ে কাংখিত নম্বরটা বের করে কলে চাপ দিলেন।ফোনের ওপাশ থেকে আনোয়ার রহমান রিসিভ করে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলেন। ভালোমন্দ খোঁজ খবর নেওয়ার পরে এনামুল খাঁন বললেন,,”ভাইজান আমি অসুস্থ। জানেনই তো।ডায়াবেটিস,হাই পেশার আরো এটাসেটা রোগ আছেই। অসুস্থতার কারণে যেতে পারলাম না।তুষার তো গতকাল গিয়েছিলো ইনভাইট কার্ড নিয়ে।আমি যেতে না পারায় ক্ষমা প্রার্থি।যেতে পারিনি তাই ফোনেই বলছি, আপনারা সবাই বিয়ের আগের দিন আসবেন কিন্তু।”

ওপাশ থেকে আনোয়ার রহমান ভদ্রভাবে বললেন,,
“আরে ভাইজান ব্যাপার না।তুষার আসছিলো তো।আর কেউ না এসে শুধু ফোনে বললেও আমরা মাইন্ড করতাম না।এসব কোনো ধরার বিষয়ই না। ‌আর ভাইজান আগের দিন হয়তো যাওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন ব্যস্ততা আছে।তবে বিয়ের দিন যাবো ইনশাল্লাহ।”

আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ফোন রাখেন।
.
সন্ধ্যার পর লিয়া বিছানায় বসে ছিলো।ফোন স্ক্রল করছিলো। চুলগুলো খোলা থাকায় ফ্যানের বাতাসে উড়ছে।কিছু মনে হতেই লিয়া জারিফের কাছে কল করে। জারিফ ল্যাপটপ সামনে নিয়ে কিছু একটা করছিলো।এমন সময় ফোন বেজে উঠলো।লিয়ার নামটা জ্বলজ্বল করছে।জারিফ রিসিভ করে বলে,,

“হ্যা বলো।”

লিয়ার মৃদু রা’গ হলো।হ্যা বলো এটা কেমন কথা। কোথায় মিষ্টি করে কিছু বলবে। কেমন আছো? হেনতেন আরো কতকি আছে।সেসব না বলে। উফ্!লিয়ার ভীষণ অভিমান হলো।লিয়া নিশ্চুপ রইলো।লিয়ার কোনো উত্তর না পেয়ে জারিফ ফের বললো,,

“এই লিয়া কথা বলছো যে।হ্যালো। শুনতে পাচ্ছো।”

“হুম।”

“কি করছো?”

“কিছু না। আপনার সাথে কথা বলছি।”

জারিফ শব্দহীন হাসলো।লিয়া ফের বললো,,

“আমরা সকালে দাদুবাড়িতে যাচ্ছি। আব্বু বিকেলে আঙ্কেলের কাছে ফোন করেছিলো। আঙ্কেল নাকি বলেছে শুক্রবারদিন আসবে।তাহলে আপনিও তো শুক্রবার দিন আসছেন আপনার শ্বশুর বাড়িতে।”

“উঁহু।আমি আমার শ্বশুর বাড়ি শুক্রবার যাচ্ছি না।”

লিয়ার কপাল কুঁচকে যায়।লিয়া তড়িৎ বললো,,”মানে আপনি বিয়েতে আসছেন না? কিন্তু কেনো?”

”তোমাকে এত করে বললাম ডিসিশনটা চেন্জ করো।প্যানিশমেন্টটা একটু কমাও।চার বছর অপেক্ষা না করে দ্রুত আমার বাড়িতে চলে আসো।তুমি তো শুনলেই না। তাই ভেবেছি চার বছরের আগে আমিও জামাই পরিচয়ে তোমার দাদুবাড়িতে যাবো না।সো জামাই হিসেবে ও বাড়িতে আমি যাচ্ছি না,ম্যাডাম।”

লিয়ার মুখটা ভার হয়ে আসলো।লিয়া রাশভারী স্বরে বললো,,”তারমানে আপনি সত্যিই শুক্রবার দিন আসছেন না।আমি আরো ভাবলাম আপনি আসবেন।ভাইয়া গিয়ে দাওয়াত দিয়ে আসলো। আবার আব্বু নিজে ফোন করে বললো। তারপরেও আপনি আসবেন না।সত্যিই আসবেন না?”

“জানিনা।”

জারিফের এরকম হেঁয়ালিপূর্ণ উত্তর শুনে লিয়ার রা’গ হয়।লিয়া ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বললো,,”আমি চার বছর অপেক্ষা করতে বলেছি।তার সাথে এখানে না আশার কি সম্পর্ক! আশ্চর্য!”

“যদি তুমি ডিসিশনটা চেন্জ করতে।তাহলে আমি ভেবে দেখতাম।তোমাকেই ফাস্ট প্রায়োরিটি দিতাম। তোমার বর পরিচয়ে খাঁন বাড়ির জামাই হিসেবেই যেতাম।সরি লিয়া তুমি যেহেতু জিদ ধরে আছো তাই আমার পক্ষেও তোমার বর পরিচয়ে এই প্রোগ্রামে যাওয়া সম্ভব নয়।”

লিয়ার এবার রা’গের মাত্রা বেড়ে যায়।লিয়া ঠোঁট চেপে ফের বললো,,”আচ্ছা আপনি না আসলে আমিও আর ফোনেও কথা বলবো না আপনার সাথে,হু। একেবারে চার বছর পরই সামনাসামনি কথা বলবো, হুঁম। এবার আপনি কি করবেন দেখা যাবে।”

লিয়ার কথাশুনে জারিফ এবার শব্দ করে হেসে ফেললো। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই বললো,,”ওকে দেখা যাবে।তবে একটা কথা মনে রেখো।আমি যেহেতু বলেছি জামাই হয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে যাবো না।তখন এই কথা আর উইথড্র করা সম্ভব নয়, হাবিবী।”

এরমধ্যে মেয়েলি কন্ঠস্বর আসলো,,”ভাইয়া আসবো।”

জারিফ ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে চাইলো।কথা দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে।জারিফ বললো,,”লিয়া তুমি লাইনে থাকো।আমি একটু পর কথা বলছি, কেমন?”

চলবে,,,