#সুতো_কাঁটা_ঘুড়ি 🪁
#পর্ব_০৩
#শেখ_সাদিয়া_স্বীকৃতি
_______________
🌸
তুমুল বৃষ্টিপাতের পর সূর্যের লাল রঙা আভা আকাশে ছড়িয়ে পড়তেই বেপারীপাড়ার শাপলা বিল আবার নতুন উদ্যমে জেগে উঠে। নৌকা বিলের মাঝপথে চলে আসাতে মেঘ অনেকটা লাফিয়ে উঠে বললো,
– রুদ্র! এই শাপলা গুলো আমার চাই।
নৌকার পাটতনে পা মেলে বসে রুদ্র শার্টের কলার ঠিক করার ভান করে বললো,
– চাই তো নিয়ে আয়। এভাবে মাইকের মতো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিস কেন?
– আমি কিভাবে আনবো? (মুখ গোমড়া করে)
– কিভাবে আনবি? বিলে ঝাপ দিবি আর তুলবি, ঝাপ দিবি আর তুলবি।
রেগে গিয়ে মেঘ রুদ্রের পিঠে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলো।
– তুমি একটা আস্ত আনরোমান্টিক বয়ফ্রেন্ড।
এই বলে মেঘ রাগ দেখিয়ে মুখ গোমড়া করে অন্যদিকে ঘুরে বসে। রুদ্র হালকা কেশে একগুচ্ছ ভেজা শাপলা মেঘের সামনে ধরে বলে,
– এই ফুল আমার শ্যামলতা ফুলের জন্যে।
খুশিমনে ফুলগুলো নিয়ে নিলো মেঘ।
– আমি জানতাম, আমি চেয়েছি আর তুমি না দিয়ে থাকতেই পারবে নাহ্।
– বাহ্! এতোটা জানিস আমায়?
– এত্তোটা জানি আমি তোমায়। (দুই হাত দুইদিকে প্রসারিত করে)
রুদ্র এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
– তাই নাকি? বলতো আমার প্রিয় সময় কোনটা? রাত না দিন?
– বর্ষার গোধূলি বেলা। নিজে পুড়ে চারদিকে আলো ছড়িয়ে দেওয়া ক্লান্ত রৌদ্রকে যখন মেঘ নিজের ছায়ায় ঢেকে দেয়, সেই সময়..তোমার প্রিয় সময়। (রুদ্রের নাক টেনে)
*
দক্ষিণা হাওয়ায় মেঘের কোমর ছুঁইছুঁই চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে৷ বাতাসের দাপটে কপালের সামনে কয়েক গোছা চুল বারবার চলে আসায় মেঘের তাকাতে অসুবিধা হচ্ছিলো। তা দেখে রুদ্র তার পরনের ক্যাপ টা খুলে মেঘের মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বলে,
– পড়ে থাক। আমার মাথা ব্যথা করছে।
মুচকি হেঁসে মেঘ পানিতে পা ডোবায়। অষ্টাদশী প্রণয়িনীর হাস্যোজ্জ্বল চেহারার পানে চেয়ে রুদ্র ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,
– আমার খুশির কারণ?
পানিতে পা দুলিয়ে মেঘ বললো,
– আমার কান্না।
বেজায় ক্ষেপে গেলো রুদ্র। রাগান্বিত স্বরে বললো,
– আর আমার কষ্টের?
– আমার হাসি। (দাঁত বের করে)
ওমনি রুদ্র মেঘের মাথায় চাটি মারলো।
– ফাইজলামি করিস?
– তুই আমায় মারলি কেন?
– আমার রোমান্টিক মুডটা স্পয়েল করে দিবি। মারবো না তো চুমু খাবো? আর তুই করে বলছিস কাকে? নিজের বয়ফ্রেন্ডকে কেউ তুই ডাকে? রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলবি বুঝেছিস? বেয়াদব কোথাকার!
মেঘ মুখ বিকৃত করে বললো,
– ইশশ্ আসছে বয়ফ্রেন্ড! রেসপেক্ট? যা ভাগ!
কিছু একটা বলতে যেয়ে মেঘের পায়ের দিকে চোখ পড়তেই রুদ্র ধমকে বললো,
– এই মেয়ে, পানি থেকে পা তুলে বস!
– নাহ্ তুলবো না।
– মেঘ! একদম ছেলেমানুষী করবি নাহ্। পানিতে অনেক সাপ, পোকামাকড় আছে।
এই বলে রুদ্র নিজেই মেঘের পা দু’টো টেনে নিয়ে নিজের কোলের উপর রাখে। তারপর যত্ন সহকারে এক জোড়া পায়েল পায়ে পড়িয়ে বললো,
– এই পায়েল ভুলেও খুলবি না। যদি কখনো খুলে যায় তাহলে আমার কাছে নিয়ে আসবি। আমি আবার নিজ হাতে পড়িয়ে দিবি।
🌸
বর্তমান~
খোলেনি মেঘ। এখনো সেই পায়েল তার পায়ে ঝলমল করছে। শুধু এই পায়েল নয় এ ঘরের প্রতিটা আনাচে-কানাচেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তার আর রুদ্রের প্রেমময় স্মৃতি। ঘরের প্রতিটি দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে তাদের খুনসুটি ভরা মুহুর্তগুলি। রুদ্রের এই ঘর এখন বাড়ির স্টোর রুম হিসেবে পরিচিত। মেঘের দম বন্ধ হয়ে আসছে। সবার সামনে দেখানো নিজের শক্ত আবরণীকে আর ধরে রাখতে পারছে না। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধপ করে ফ্লোরের উপর বসে নিঃশব্দে কাঁদতে আরম্ভ করে।
– তোর কষ্ট হচ্ছে না মেঘ?
আওয়াজ পেয়ে মেঘ হকচকিয়ে উঠে। তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে পেছন ফেরে বললো,
– আরে বড় মা তুমি এত রাতে?
ঝুমুর ধীরপায়ে মেঘের পাশে এসে বসলেন। মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে বললেন,
– কি থেকে কি হয়ে গেলো তাই না!
– তুমিও কি বিশ্বাস করো বড় মা, আমার ভাইয়া ঐ জঘন্য কাজ করেছে?
ঝুমুরের চেহারা মলিন হয়ে গেলো। করুণ স্বরে বললেন,
– রুদ্র, রুহি, তোদের দুই ভাই-বোনকে আমি কখনো আলাদা চোখে দেখিনি। আমাদের সবার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে মিরাজ ওমন কাজ করতে পারে৷
– তাহলে আমার ভাইয়াকে তোমরা কেন একটা সুযোগ দিলে না নিজেকে প্রমাণ করবার? (কান্না করে)
মেঘের কান্না মিশ্রিত অভিযোগ ঝুমুরের মনের ভেতর আঁচড়ে পড়লো যেন।
– ওরা যখন মিরাজকে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না রে! মেয়েকে হারিয়ে তোর বড় বাবাও শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত প্রমাণও মিরাজের বিরুদ্ধে ছিলো। তাহলে আমরা কি-ই বা করতাম বল?
– সবসময় আমায় কেন সব প্রশ্নের, বাধার সম্মুখীন হতে হবে বলতে পারো? আমায় আজ জীবনের এই মোড়ে কেন দাঁড় করানো হলো? আমার নিরপরাধ ভাইয়া কেন শাস্তি পাচ্ছে? এইসব কিছুর কারিগর রুদ্র। আটটা বছর! আটটা বছরের সবকিছুই কি ওর অভিনয় ছিলো? কাকে প্রশ্ন করবো আমি? কে দেবে জবাব?
– শান্ত হ মেঘ!
– আমি পারছি না! অভিনয় করিনি আমি! এখন করছি। আমার কষ্ট হচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বড় মা! (চেঁচিয়ে)
ঝুমুরের হাতটা নিজের গলার কণ্ঠনালীর উপরে রেখে বললো,
– এই…এখানটায় দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। তোমরা বোঝো না কেন? যেই রুদ্র নিজে পুড়ে আমায় ছায়ায় রাখতো আজ সে আমায় তার রক্ষিতা করে নিয়ে এসেছে। কেন জানো বড় মা? বলো না জানো? (ঝাঁকিয়ে)
মেঘের পাগলামি দেখে ঝুমুরের গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। তার নিরবতা মেঘকে আরও অস্থির করে তুললো। উত্তেজনায় ওর সারা শরীর কাপছে। একপর্যায়ে মেঘ ক্লান্ত হয়ে ঝুমুরের কোলে লুটিয়ে পড়ে। আঁতকে ওঠেন ঝুমুর। তাড়াতাড়ি মেঘের গালে হাত চাপড়ে ডাকতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন ওর শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে সে জোরে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলো,
– আম্মা? আম্মা? আম্মা তাড়াতাড়ি এখানে আসেন!
আস্তে আস্তে মেঘের চোখ বুজে আসছে। ক্লান্ত চোখের পাতা জোড়া বন্ধ করার আগে সে দেখলো দরজার বাইরে এক গুচ্ছ শাপলা হাতে রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত বাড়িয়ে তাকে ইশারায় ডেকে বললো,
– মেঘ! চল রুপকথার দেশে হারাই৷
মেঘের ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হলো। জ্ঞান হারাবার আগে সে জোরে জোরে শ্বাস টেনে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
– কেন করলে রু..দ্র?
*
*
প্রকৃতি এখনো শীতকে ডালা সাজিয়ে বরণ না করলেও শীত তার আগমনী বার্তা হাওয়ায় ভর করিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। কালিগঙ্গার এই সুবিশাল উঁচু ব্রিজের অবস্থান ঢাকা থেকে অনেকটা দূরে দুই জেলার সংযোগস্থলে। রাত্রের মধ্যাহ্নে ব্রিজের দুই দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। রেলিঙের ধারে শির ধারা সোজা করে নদী দেখছে রুদ্র। তার ওমন প্রখর দৃষ্টি দেখে মনে হবে সে খুব মনোযোগ সহকারে নদীর গভীরতা মাপছে। পাশেই হিনা হাতে পড়া বেলি ফুলের মালাটা বারবার ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখছে। রুদ্রের দেওয়া প্রথম গিফ্ট। যদিও রুদ্র নিজ থেকে দেয়নি হিনা বায়না করায় কিনে দিয়েছে।
– চোখ খোলার পর প্রথম মাকে দেখতে পাই। মায়ের মুখ দেখে মনে হয়েছিলো অনেকদিন ঘুমাননি। আমাকে দেখেই সে কান্না জুড়ে একে-একে বলতে শুরু করে..
থেমে যায় রুদ্র। প্রশ্নাত্মক চাহনিতে চেয়ে আছে হিনা। চোখ বুঁজে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে রুদ্র বললো,
– মায়ের মতে আমি তোমার প্রথম ভালোবাসা, আমার মনেও তোমার জন্য ফিলিংস রয়েছে! যখন জানলাম তুমি সবে এসএসসি দিয়েছো, বয়সে অনেক ছোট। আমি রাজি হইনি। কিন্তু মা মানলো না, তার মতে আমার একটা হাত দরকার। শেষে কাবিন করাতে বাধ্য করে।
থেমে অস্থিরচিত্তে বললো,
– অন্যদিকে বাড়ির সবাই, যাদের আমি এখনো চিনে উঠতে পারিনি সেই ফ্রেন্ড সার্কেল, গ্রামের লোক প্রত্যেকে বলে আমি মেঘকে ভালোবাসি!
হিনা কপাল কুঁচকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
– সবাই বললো মানে! আপনি কাকে ভালোবাসেন সেটা অন্যদের থেকে কেন জানবেন!?
– কারণ আমি জানিনা! (চিৎকার করে) শুধু এটুকুই জানি মেঘ আর মিরাজের জন্য আমার বোন রুহি হারিয়ে গেছে। আর কিচ্ছু না। নিজেকে খোঁজার দায়ে একজন ডানে যেতে বলছে যাচ্ছি, আরেকজন বাঁয়ে যেতে বলছে তা-ও যাচ্ছি৷ কিন্ত নাহ্, নিজের সত্ত্বাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না!
হতবিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে আছে হিনা। রুদ্রের এহেন ব্যবহার, কথা কোনোকিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। নিজেকে ধাতস্থ করে রুদ্র গম্ভীর গলায় বললো,
– আর আমার এই টানাপোড়েনের মধ্যে তোমার জীবনও নষ্ট হচ্ছে। জেনেবুঝে এই ক্ষতিকে আমি আর প্রশ্রয় দিতে পারি না। ইট’স নট ফেয়ার! তাই আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি।
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে হিনার। সে থেমে-থেমে বললো,
– কি..ডিসিশন!
– ভালোবাসা যতটা সুন্দর নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে ভালোবাসা সুন্দরের ঠিক বিপরীত। সামনে তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
পাশ ফিরে হিনার মুখোমুখি দাড়িয়ে বললো,
– আমি ডিভোর্সের জন্যে আপিল করেছি। বড়জোর একমাসের মধ্যেই পেপারস রেডি হয়ে যাবে। আমার জন্মদিনের জন্য মা তোমায় বাড়িতে এনেছিল কিন্তু আমি চাই না তুমি আর ও-বাড়ি থাকো। এতে করে তোমার মনে আরও বাজে প্রভাব পড়বে।
স্তব্ধ হয়ে হিনা দুই পা পিছিয়ে গেলো। রুদ্র অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে বললো,
– আমার জন্য তোমার অনেক ক্ষতি হয়েছে। আর না! নিজের জীবনকে গুছিয়ে তোলো হিনা, প্লিজ!
থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে হিনা। পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেছে তার কাছে। নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করলো,
– আমিই কেন রুদ্র? মেঘ কেন নয়?
– নিজেকে প্রশ্ন করো। আমি যা কিছু করেছি তারপরেও কি তুমি সুখী থাকবে আমার সাথে? সেই ভালোবাসায় কি সুখ যার বদলে তুমি ভালোবাসা পাবে না?
হীনার চোখে জল ঠোঁটে হাসি। বুড়ো আঙুলে চোখ মুছে বললো,
– রুদ্র?
রুদ্র তাকায়।
– আমি ভালো থাকবো রুদ্র! আপনাকে ছাড়াই। আই প্রমিজ!
আর একমুহূর্ত দাড়ালো না সে৷ ছুটে চলে যায় তার একতরফা প্রেমের ইতি টেনে। সাই-সাই করে চলে যায় কালো রঙের গাড়ি। ব্রিজের ধারে পড়ে রয় হিনার হাতের সেই সতেজ বেলি ফুলের মালা যা ধীরেধীরে একসময় শুকিয়ে যাবে। গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই রুদ্র পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে আনে। ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় কাগজে নিজের সিগনেচার সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
– আ’ম সরি হিনা। যদি এই কাগজটা এক মাস আগে আমার কাছে পৌঁছুত তাহলে আজ তোমাকে এতো কষ্ট পেতে হতো নাহ্!
ব্রিজের ধারে বসে রুদ্র ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থাকলো। মিনিট ছয়েক পর কাগজটা মুখের সামনে ধরে আপমনে নিজেকে প্রশ্ন করলো,
– মা, বাড়ির বাকিরা কি এ বিষয়ে কিছুই জানে না? যদি জেনে থাকে তবে আমায় জানালো না কেন? এতো ইম্পর্ট্যান্ট একটা পেপার গ্রামের বাড়িতে কি করছে ! আমি রেখেছিলাম?
নানা চিন্তার মাঝে রুদ্রের ফোন বেজে ওঠে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসা কথাগুলো শুনে তার হাত থেকে মোবাইলটা নিচে পড়ে ভেঙে যায়। দ্রুত ব্রিজ থেকে নেমে চলে আসে রাস্তার ধারে। গ্রামের নির্জীব নিরিবিলি রাস্তায় এতো রাতে গাড়ি পাওয়া দুষ্কর। শেষে উপায়ন্তর না পেয়ে দৌড়ে পা বাড়ায় গন্তব্যে।
চলবে..!