সে আমার অপরাজিতা পর্ব-০২

0
161

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_২
#সারা মেহেক

শাড়ির আঁচলখানা ছিঁড়ে বৃত্ত হা করে তাকিয়ে রইলো শাড়ির দিকে। আর বিন্দু সেদিকে তাকাতেই দু’জনে একে অপরের দিকে চরম বিস্মিত এবং স্তব্ধ চাহনিতে চেয়ে রইলো।

হতভম্ব দৃষ্টিজোড়া ব্যক্তিটি না চাইতেও বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে ফেলে,
” এটা কি করলেন আপনি!”

বিন্দুর এহেন হতবাক সুরের সাক্ষী বৃত্ত একবার শাড়ির দিকে, একবার বিন্দুর দিকে চাইলো। অতঃপর মুহূর্তের মাঝেই বলে উঠলো,
” সরি, সরি ফর দ্যাট। ইচ্ছে করে করিনি। পা আটকে গিয়েছিলো।”

বৃত্ত’র মুখে ‘সরি’ শব্দটি আশ্চর্যান্বিত হয়ে শুনলো সাকিব। কেননা এখন অব্দি সে বৃত্ত’র মুখে সরি শব্দটি উচ্চারিত হতে শুনেনি। আর আজ কি না প্রথম শুনলো তাও এক জুনিয়রের সামনে! এ যেনো বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্যের এক ঘটনা।

অডিটোরিয়ামের বাকি সকলে অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত। শুধু কতিপয় মেয়েরা, যারা বিন্দুর আশেপাশে বসে আছে, তাদের চক্ষুজোড়া চম্বুকের ন্যায় বৃত্ত’র উপর স্থাপিত হয়ে আছে। আর বৃত্ত’র দৃষ্টিজোড়া এ মুহূর্তে স্থাপিত হয়ে আছে বিন্দুর উপর। সদ্য ভার্সিটিতে পা রাখা এক জুনিয়রের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছে সে। এসব নারীঘটিত ঘটনা হতে সে সবসময় দূরে দূরে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু ঠিক সেসব ঘটনাই তার সাথে বারংবার ঘটে। নারী নামক এই মানুষগুলোর সাথে গা’ লা’ গা’ লি, মা’ রা’ মা’ রি’ করা যায় না বলেই আরো ঝামেলা বাঁধে। মুখ বুজে সহ্য করতে হয় সব। অথচ এই জায়গায় যদি একটি ছেলে থাকতো তাহলে অডিটোরিয়ামের মানুষজন সব একসাথে জড়ো হয়ে যেতো।

সাকিব ‘সরি’ শব্দের বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে একটুখানি সময় নিলো। অতঃপর গলা পরিষ্কার করে কড়া গলায় বিন্দুর উদ্দেশ্যে বললো,
” ফ্রেশারস না?”

বিন্দু বসে দ্রুত মাথা দোলালো। কিন্তু মারিয়া তাকে পাশ থেকে ঠেলে দাঁড়াতে ইশারা করলো। তার ইশারা বুঝতে পেরে চট করে উঠে দাঁড়ালো বিন্দু। সাকিব পূর্বের ন্যায় বললো,
” সিনিয়রের সাথে যে কথা বলছো, সম্মান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয় এটা জানো না? নাকি এই পনেরো দিনেও এটুকু ম্যানারও শিখোনি?”

বিন্দুর দৃষ্টিজোড়ায় ক্ষীণ ভীতির ছায়া দেখা দিলো।তার এ দৃষ্টিজোড়ার প্রতিক্রিয়ার সাক্ষী হলো বৃত্ত। বিন্দু চট করে দৃষ্টিজোড়া নামিয়ে ফেললো। ইতোমধ্যে সে দাঁড়িয়ে পড়ায় অডিটোরিয়ামের অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করলো সে। তবে সেদিকে তোয়াক্কা না করে সে বললো,
” সরি ভাইয়া। বুঝতে পারিনি আমি। এমনটা আর হবে না। ”

সাকিব কিছু বলার পূর্বেই বৃত্ত বললো,
” ইট’স ওকে। তবে সরি’টা আমার বলা উচিত। তোমার শাড়িটা আমার কারণে ছিঁড়েছে। আই এম এক্সট্রেমলি সরি।”

বিন্দু প্রত্যুত্তর করলো না। তবে সাকিব নারাজ হয়ে বললো,
” তুই সরি বলছিস কেনো বৃত্ত? মেয়েটারই দোষ। সিঁড়ির পাশে বসেছে। অথচ আঁচলটাও ঠিকমতো সামলাতে পারে না। তাহলে শাড়ি পরার দরকার কি?”

বৃত্ত এবার পাশ ফিরে প্রখর চাহনিতে সাকিবের দিকে চাইলো। শক্ত কণ্ঠে বললো,
” দোষটা আমার বেশি। তুই এতো কথা বাড়াচ্ছিস কেনো? আর এখন চল এখান থেকে। শুধু শুধু সিন ক্রিয়েট হচ্ছে। ”
বলেই সে বিন্দুর দিকে চাইলো। কণ্ঠে নমনীয়তা বজায় রেখে বললো,
” তুমি বসো। আর শাড়ির জন্য সরি। এর ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিবো পরে। ”
বলেই সে চলে যেতে এক কদম এগুলো। তা দেখে বিন্দুও বসতে লাগলো। কিন্তু পরক্ষণেই বৃত্ত এক কদম পিছিয়ে পূর্বের জায়গায় এসে বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,
” তোমার নামটা কি?”

বিন্দু বসতে গিয়েও চমকে উঠে দাঁড়ালো। তড়িঘড়ি করে বললো,
” বিন্দু।”

” আচ্ছা। আসলে পরবর্তীতে ক্ষতিপূরণ পাঠানোর জন্য তোমার নামটা জেনে নিলাম। ”
বলেই সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সাকিবকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
অডিটোরিয়াম থেকে বের হওয়া মাত্রই সাকিব বৃত্তকে জিজ্ঞেস করলো,
” আজকে তুই উল্টাপাল্টা কিছু খেয়ে এসেছিস নাকি বিপক্ষ দলের কেউ জাদু টোনা করেছে তোর উপর?”

সাকিবের এহেন প্রশ্নে বৃত্ত ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
” কি সব ফালতু প্রশ্ন করছিস? কি খেয়ে আসবো সকালে?”

” তাহলে সরি শব্দটা তোর মুখ দিয়ে বের হলো কি করে? আমার জীবদ্দশায় তোর সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকে কোনোদিনও মনে হয় তোর মুখে সরি শব্দটা শুনেনি। নিজের দোষ থাকলেও। আর আজকে এক ফ্রেশারসকে সরি বললি! স্ট্রেঞ্জ! ”

” স্ট্রেঞ্জ হওয়ার কি আছে? দোষটা আমার ছিলো। তাই সরি বলেছি। আর দেখিসনি মেয়েটা কত ভয়ে ভয়ে ছিলো? ”

সাকিব ঠোঁট উল্টে বললো,
” উঁহু, তুই যেমনটা বলছিস অতোটাও ভয় পেতে দেখিনি ওকে। ”
বলেই সে মুখ ‘চ’ এর ন্যায় আওয়াজ করে বললো,
” তোর আচরণ আজ বড়ই অদ্ভুত হতে দেখলাম। ডাল মে কুচ তো কালা জারুর হ্যায়।”

বৃত্ত সাকিবের মাথায় একটা চাপড় মেরে বললো,
” ডাল সাদা কালা দেখা বাদ দিয়ে আমাকে আজকে সকালের মিটিং এর খবর দে। বাবার কারণে আজকের মিটিং মিস করেছি।”

” চল,আগে কিছু খাওয়াদাওয়া করি। তারপর মিটিং এর কথা হবে।”

” চল”

——

বৃত্ত অডিটোরিয়াম ছেড়ে যেতেই মেয়েরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস কথা শুরু করলো। কেউ কেউ আঁড়চোখে বিন্দুকে দেখলো। এদিকে বিন্দুর স্তব্ধতা এখনও কাটেনি। একে তো শাড়ির আঁচলটা প্রায় পুরোপুরি ছিঁড়ে গিয়েছে। উপরন্তু এ কারণে আজ এক সিনিয়রের নজরেও পড়েছে সে, যা মোটেও চাইছিলো না সে।
বিন্দু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে মারিয়াকে বললো,
” এখন আমার কি হবে মারিয়া!”

মারিয়া অতি উৎসাহী কণ্ঠে বললো,
” প্রেম হবে দোস্ত, প্রেম হবে।”

মারিয়ার কথায় একরাশ বিরক্তিমাখা চেহারাখানা নিয়ে মারিয়ার পায়ে গুঁতো দিলো। বললো,
” মেজাজটা খারাপ করিস না মারিয়া। এমনিতেই শাড়িটা ছিঁড়ে-টিঁড়ে একদম শেষ। একটুখানি আঁচল আটকে আছে শাড়ির সাথে। এটা পুরোপুরি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। খালা আমাকে একদম আস্ত রাখবে না।”

মারিয়া বিন্দুর কথার তোয়াক্কা করলো না। বরং চিল মুডে বললো,
” ওসব শাড়ি-টাড়ির কথা বাদ দে দোস্ত। তুই যে সিনিয়রের নজরে পড়েছি সেটা দেখ।”

বিন্দু এবার পুনরায় উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
” সেটা আমিও ভাবছি। একটা অঘটনের মাধ্যমে এমন সিনিয়রের নজরে পড়া মানে কপালে নির্ঘাত শনি আছে। ”

” আরে ধ্যাত,কিসের শনি! বৃত্ত ভাই তোকে কথার মাঝে যেভাবে দেখছিলো, আমি শিওর উনি তোকে পছন্দ করেছে।”

বিন্দু খিটখিটে গলায় ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললো,
” উল্টাপাল্টা কথা না বললে তোর পেটের ভাত হজম হয় না? আমাকে আর রাগাস না মারিয়া। এখন দয়া করে চুপ থাক।”

কিন্তু মারিয়া চুপ থাকলো না। বললো,
” এখানে কত্তগুলো মেয়ে যে তোর প্রতি জেলাস, তা তোর অজানা বিন্দু। বৃত্ত ভাইয়ের…. ”
বলতে বলতেই থমকে গেলো মারিয়া। চট করে তার মাথায় খেললো বিন্দু ও বৃত্ত’র নাম দুটো। সে তৎক্ষনাৎ প্রচণ্ড খুশিতে জবুথবু হয়ে বললো,
” দোস্ত, তোদের দুজনের নামটাও জোস। কি মিল দেখ! তোর নাম বিন্দু। উনার নাম বৃত্ত। বিন্দু-বৃত্ত। আবার আজ তাহসানের প্রেমাতাল গানটাও গেয়েছে! উফ উফ, আমার তো ভাবতেই এক্সাইটমেন্টে হাত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।”

মারিয়ার কথায় বিন্দু আর কান দিলো না। সে জানে, মেয়েটার সাথে যত কথা বলা হবে সে ততই এমন খবর বের করতে থাকবে। এর চেয়ে বরং নীরব থাকাই শ্রেয়। একা একা আর কতক্ষণই বা কথা বলতে পারবে।
এদিকে মারিয়া প্রচণ্ড খুশিতে আত্মহারা। তার ধারণা বিন্দু ও বৃত্ত’র মাঝে নিশ্চিত কিছু হবে। এক্ষেত্রে মারিয়া নিজের প্রেম নিয়ে যতটা উদাসীন, বান্ধবীর প্রেম নিয়ে ঠিক ততোটাই উৎসাহী।

———

আফতাব সাহেবের অফিসের চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে বৃত্তকে ফোন দিলো বাদল। বৃত্ত ওপাশ থেকে ফোন তুলতেই সে জিজ্ঞেস করলো,
” ভাই, তুমি কোথায়?”

বৃত্ত জবাব দিলো,
” ভার্সিটিতে। কেনো?”

” অফিসে আসবে না?”

” হ্যাঁ, এখন আসবো। কোনো নিউজ আছে?”

” তা তো আছেই। তুমি আসো আগে। তারপর দেখাচ্ছি। ”

পনেরো মিনিটের মাথায় বাবার অফিসে চলে এলো বৃত্ত। কেবিনে ঢুকতেই দেখলো বাদল বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে। বৃত্তকে কেবিনে প্রবেশ করতে দেখে সে বেশ ধীরেসুস্থে আড়মোড়া ভেঙে দাঁড়ালো। হাই তুলতে তুলতে বললো,
” এসেছো ভাই! বসো বসো। চা নাস্তা করো। তারপর একটা মজার খবর দিচ্ছি।”

বৃত্ত ভ্রু কুঁচকে তাকালো বাদলের দিকে। বললো,
” খাওয়াদাওয়া শেষ। এখন আমাকে খবর দে আগে। তোর কাছে কোনো খবর আছে মানে, সে খবর বেশ গরম গরম।”

বৃত্ত’র প্রশংসায় বাদল দু পাটি দাঁত বের করে হেসে বললো,
” প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ ভাই। সোফায় বসো। ”

বৃত্ত বসলো। বাদলও গিয়ে তার পাশে বসলো। পকেট থেকে ফোন বের করে একটা ভিডিও অন করলো। দুজনে মিলে দেখলো, বিপক্ষ দলের দলনেতা খালেদ মোল্লা বংশীপাড়ার লোকেদের প্রয়োজনীয় রাশনপত্র দিচ্ছে। ফলে ঐ এলাকা লোকেলোকারন্য হয়ে উঠেছে।
ভিডিও শেষ হতেই বাদল ফোন বন্ধ করে বললো,
” খালেদ মোল্লার কাজ দেখেছো ভাই! কি ফাস্ট! ইলেকশনের এখনও কত মাস বাকি আছে। এখন থেকে জনদরদী কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। ”

বাদলের কথায় বৃত্ত বাঁকা হাসলো। বললো,
” রাজনীতির ‘অ আ’ খুব ভালো করেই জানে খালেদ মোল্লা। কখন কোন চাল দিলে জিতবে সেটা বোধহয় এতোদিনে ওর নখদর্পনে চলে এসেছে। যাই হোক, সময়ই বলে দিবে, ইলেকশনে এবার কে জায়গা দখল করবে।”
পরবর্তী পর্ব পেতে পেইজ ফলো দিয়ে রাখুন: সারা মেহেক । Sara Jahan Mehek
®সারা মেহেক

#চলবে