সে আমার অপরাজিতা পর্ব-১০

0
144

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_১০
#সারা মেহেক

বৃত্ত ও বাদলের প্রশ্নসূচক কথাটিকে বর্ষা তার প্রশ্নের জবাব হিসেবে ধরে নিলো। ফলস্বরূপ বিস্ময়ে তার চক্ষুজোড়া বৃহদাকার ধারণ করলো। সে দ্রুত পায়ে এসে বৃত্ত ও বাদলের সম্মুখে বসলো। বৃত্তকে উদ্দেশ্য করে তীব্র উদ্দীপনা ও ছটফট মন নিয়ে বললো,
” কি বৃত্ত ভাই! তুমি বিয়ে করে বাচ্চাও নিয়ে ফেলেছো আর আমাদের জানাওনি! বাদল ভাই তুমিও জানো, অথচ আমাকে জানাওনি! এখন যদি আমি গিয়ে বাবাকে জানাই তাহলে তোমাদের কি হবে ভেবেছো একবার?”

বাবার নাম শোনা মাত্র বৃত্ত খানিকটা জোরেই বর্ষার মাথায় গাট্টা মারলো। ধমক দিয়ে বললো,
” কান যে পুরোটাই নষ্ট আজকে একদম হাতেনাতে প্রমাণিত হলো। আর এ-ও প্রমাণিত হলো যে তুই সবসময় এক লাইন বেশি বুঝে চলিস।”

বর্ষা বৃত্তের দেওয়া আঘাতে ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অভিযোগের সুরে বললো,
” আমাকে মারলে কেনো! আর কি বেশি বুঝেছি আমি হুম?”

বৃত্ত বললো,
” এই যে, তোর অপরিচিত একটা মেয়েকে তুই আমার বাচ্চার মা বানিয়ে দিলি।”

” আচ্ছা? তাহলে কে সে মেয়ে?”

বৃত্তের কণ্ঠস্বর এবার পূর্বের তুলনায় পরিবর্তন হলো। খানিকটা কোমল কণ্ঠে বললো,
” আমাদের ভার্সিটির জুনিয়র। তুই আর বিন্দু সেইম ব্যাচের। ”

” আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু তোমাদের দুজনের মাঝে বিন্দুকে নিয়ে কথা হচ্ছে কেনো?”

বর্ষার প্রশ্নে বৃত্ত এবার বাদলের দিকে চাইলো। বাদল এমন ভাব ধরলো যে বৃত্তকে চিনেই না৷ বললো,
” কি হয়েছে? আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই ভাই। তুমি যে প্রেমে পড়েছো এটা আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর। তুমি বললে কালই আমি প্রপোজ করার ব্যবস্থা করে দিবো।”

বৃত্ত এবার অকপট রাগ দেখালো। বললো,
” মনে হচ্ছে তোর মা’ র খাওয়ার খুব শখ হয়েছে। ”

বাদল বৃত্ত’র কথায় পাত্তা দিলো না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বেশ হালকার উপরে বললো,
” মা’ র’ লে মা’ র’ তে পারো। কিন্তু যা সত্য তাই বলবো আমি।”

বর্ষা এবার বিরক্ত হলো। বললো,
” বাদল ভাই, আমাকে সম্পূর্ণ ঘটনা বলো তুমি। কিচ্ছুই বুঝতে পারছি না। ”

বাদল বিন্দু ও বৃত্ত’র মাঝে শাড়ি ছেঁড়ার ঘটনা থেকে এ পর্যন্ত যেসব ঘটনার সাক্ষী হয়েছে তা সম্পূর্ণট বললো। অতঃপর বর্ষাকে জিজ্ঞেস করলো,
” এবার তুই-ই বল, বৃত্ত ভাই বিন্দুকে ভালোবাসে না?”

সম্পূর্ণ ঘটনা শোনার পর বর্ষা বৃত্তের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হলো। তার সংসার নিয়ে ভাবতে বসলো। কিন্তু এর পাশাপাশি সে বেশ খুশিও হলো। কেননা তার অনেক দিনের শখের বড় ভাবী সম্ভবত খুব শীঘ্রই এ বাড়িতে আসতে চলেছে। তার মাঝে বিশাল উত্তেজনা কাজ করলো। তবে এ উত্তেজনাকে পাশ কাটিয়ে সে চেহারায় ঈষৎ গাম্ভীর্য ভাব তুলে বড়দের মতো রাশভারী গলায় বললো,
” সবকিছু মানতে পারলাম। তবে এটা মানতে পারলাম না যে বৃত্ত ভাই এভাবে হুটহাট ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবাসা কি এতোটাই হুটহাট করে হয়ে যায় নাকি। হয়তো বৃত্ত ভাই বিন্দুকে শুধু পছন্দ করে?”

বৃত্ত এতক্ষণ বেশ হতাশা নিয়ে বাদল ও বর্ষার কথোপকথন শুনছিলো। যে এসেছিলো নিজের সমস্যার সমাধান চাইতে উল্টো সে-ই বসে বসে আরেকজনকে এ সমস্যার বিবরণী শুনতে দেখছে। কিন্তু বর্ষার শেষোক্ত কথাটি শুনে বৃত্ত উত্তেজনায় এক প্রকার লাফিয়ে উঠে বললো,
” এক্সেক্টলি। আমিও এটাই বলতে চাচ্ছিলাম।”

বর্ষা ও বাদল খানিকটা কিম্ভুত চাহনিতে চেয়ে বৃত্তকে জিজ্ঞেস করলো,
” কি?”

বৃত্ত বললো
” এই যে,মেবি আই লাইক হার। আমার মনে হয় আমি বিন্দুকে পছন্দ করি। আমি কিন্তু নিজেও ওর প্রতি আমার আচরণের ধরণটা বুঝতে পারছি। অথচ আমার এ আচরণকে আমি ডিফারেন্সিয়েট করতে পারছি না।”

বাদল বললো,
” ঐ তো, বললামই তো, তুমি বিন্দুকে ভালোবাসো।”

” উঁহু, পছন্দ করা আর ভালোবাসাকে গুলিয়ে ফেলিস না বাদল। ভালোবাসা কখনও এত দ্রুত হয় না। পছন্দ থেকে ধীরেধীরে ভালোবাসার জন্ম হয়।”

বর্ষাও বললো,
” আমিও বৃত্ত ভাইয়ের সাথে একমত।
বাদল ভাই, তুমি আমাকে এ পর্যন্ত যা যা বললে সব বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি এটা মানতে নারাজ যে বৃত্ত ভাই বিন্দুকে ভালোবাসে। হ্যাঁ, পছন্দ করে। আর কোনো সন্দেহ নেই, এই পছন্দ করাটাই সময় যেতে যেতে ভালোবাসায় পরিণত হবে। বিন্দুকে এখন বৃত্ত ভাই যাস্ট পছন্দ করে। তাই সে হিসেবে সে চায় বিন্দু সব সমস্যা থেকে দূরে থাকুক। ভালো থাকুক। আমাদের কোনো জিনিস বা কোনো মানুষ পছন্দ হলে কি আমরা চাইবো না আমরা সে জিনিসটাকে বা মানুষটাকে যত্নে রাখি, আগলে রাখি? বৃত্ত ভাইয়ের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হচ্ছে। ভাইও চাচ্ছে বিন্দুকে সব ঝামেলা হতে আগলে রাখতে। ”
এই বলেই সে মুহূর্তেই দুষ্টু চাহনিতে চেয়ে টিপ্পনী কেটে বললো,
” বাড়িতে খুব শীঘ্রই বিয়ের সানাই বাজতে চলেছে তাহলে। সবকিছু রেডি করতে হবে। বুঝলে বাদল ভাই?”
বলেই সে আর বাদল হাওয়ায় হাত উঠিয়ে হাই ফাইভ দিলো। কিন্তু তৎক্ষনাৎ বৃত্ত ভারী হতাশাপূর্ণ কণ্ঠে বললো,
” কিসের বিয়ের সানাই! ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণত হওয়ার আগেই রিজেক্ট খেয়ে বসে আছি।”

বৃত্তের এহেন কথায় বাদল ও বর্ষার চেহারা হতে খুশির ঝলক মুহূর্তেই উবে গেলো। বাদল বললো,
” কি বলো? কিভাবে কি হলো। সব বলো শুনি।”

অতঃপর বৃত্ত আজকে ক্যাম্পাসে তাদের কথোপকথনের পুরোটা বললো। এ শুনে বাদল চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
” মেয়ে দেখি বড়ই শক্তপোক্ত গোছের মেয়ে। তোমার মতো ছেলে ওকে এভাবে পাত্তা দিচ্ছে,এটা দেখলেই তো এক চান্সে রাজি হয়ে যাওয়ার কথা। আর সেখানে ও এমনভাবে কথা বলছে!”

বর্ষা এবার বললো,
” বিন্দু সম্ভবত খুব পড়ুয়া টাইপের মেয়ে। এসব জিনিস পছন্দ করে না ও। ”

বৃত্ত কিঞ্চিত অনুনয়ের সুরে বললো,
” তাহলে এক্ষেত্রে তুই কি পরামর্শ দিবি?”

বর্ষা খানিকটা নড়েচড়ে বসলো। চেহারাখানায় একটুখানি বিদ্বান ভাব ফুটিয়ে বললো,
” দেখ বৃত্ত ভাই, আমি কোনো লাভ গুরু নই। তবে একজন মেয়ে হিসেবে আমার মনে এখানে তোমার ওয়েট বজায় রাখা জরুরি বেশি। হ্যাঁ, বিন্দুর খেয়াল রাখবে, খোঁজ রাখবে। কিন্তু তাই বলে সবসময় ওর সাথে কথা বলতে চাওয়ার চেষ্টা করবে না। বেশি দুশ্চিন্তা দেখাবে না ওর প্রতি। ও হয়তো বিরক্ত হতে পারে এসব দেখে। তাই বলছি চেষ্টা করো ওর থেকে দূরে দূরে থাকার। ততদিনে নিজের অনুভূতিগুলোর ব্যাপারে নিশ্চিত হও। বিন্দুর মনের খবর জানতে চেষ্টা করো। এখন এসব কিভাবে করবে তার সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত তোমার উপর।”

বর্ষার কথায় বৃত্ত দুশ্চিন্তা মুক্ত হলো। তবে বিন্দুর সাথে বলার নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে বেশ কষ্ট হলো। কেননা এখন তার মন চায় রোজ বিন্দুর সাথে এক মিনিট হলেও কথা বলতে। মাঝে মাঝে এ ইচ্ছা তীব্র আকার ধারণ করে। এখন ভবিষ্যতে যদি এমন বাধঁ ভাঙা ইচ্ছে জেগে উঠে মনে তখন নিজেকে সামলাবে কি করে? এ ভেবেই বৃত্ত অস্থির হয়ে পড়লো।

———

ক্যাম্পাসের রাজনীতি যে এতোটা ভয়ানক হতে পারে তা বিন্দুর অজানা ছিলো। এতদিন সংবাদে শুনে এসেছে এমন তুমুল মা’ র’ পি’ টের কথা। আর আজ নিজেই সে মা’ র’ পি’ টের সম্মুখীন হয়েছিলো। ভাগ্য ভালো থাকায় শেষ মুহূর্তে এসে বৃত্ত তাকে বাঁচিয়েছে। আজ বৃত্ত না আসলে হয়তো তাকে ওখানেই লাঠি দিয়ে মে’রে জখম করতো!

মারিয়া এসেছে বিকেলে। তাকে আজ ক্যাম্পাসের সব ঘটনা খুলে বলেছে বিন্দু। স্বভাবতই মা’র’পি’ট নিয়ে মারিয়ার কোনো মাথা ব্যাথা না থাকলেও বিন্দু ও বৃত্তকে ঘিরে প্রতিটি ঘটনার আগাগোড়া শুনতে সে বরাবরই উৎসুক থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। তবে বৃত্ত’র প্রতি বিন্দুর আচরণে মারিয়া বেশ নাখোশ হয়েছে। সে বিন্দুকে বললো,
” এমনটা না বললেও পারতি বিন্দু।”

বিন্দু খানিকটা কড়া গলায় বললো,
” এমনটা বলা উচিত ছিলো। উনার আচরণ আমার পছন্দ হয়নি।”

” কি এমন আচরণ করলো উনি শুনি? বখাটের মতোও তো আচরণ করেনি। তাহলে এত কড়া কথা শোনানোর মানে কি?”

বিন্দু তেঁতে উঠে বললো,
” বখাটের মতো আচরণ করেনি। কিন্তু ছ্যাচড়ার মতো আচরণ করেছে৷ আমার এসব মোটেও পছন্দ না। এটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, উনার আর আমার মাঝে স্বাভাবিক সেই সিনিয়র জুনিয়র সম্পর্ক নেই। আমি এতোটাও গাধা না মারিয়া। ”

” তাহলে তুই এটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস, বৃত্ত ভাইয়া অকারণে তোর প্রতি এত কেয়ার দেখায়নি। উনি হয়তো তোকে পছন্দ করে?”

” দেখে মারিয়া, আমি আগেও এটা বলেছি। এসবে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। রিলেশনশিপ জিনিসটা আমার কাছে চরম বিরক্তিকর একটা সম্পর্ক। আর আমি আমার পুরো ফোকাস পড়াশোনায় লাগাতে চাই। এত বিষয়ে সময় নষ্ট করতে রাজি নই আমি। আর আমি চাই না লোকে বলুক, শহরে গিয়ে বিন্দু খারাপ মেয়ে হয়ে গিয়েছে। আমি চাই না আমার বাবার মান সম্মানে কোনো আঘাত আসুক। আমি চাই না আমার কারণে আমার খালা খালুর মাথা নিচু হোক। বুঝতে পারছিস মারিয়া? আমি কি বলতে চাইছি?”

মারিয়া মাথা দোলালো। বললো,
” বুঝতে পেরেছি। তোর জায়গায় তুই ঠিক আছিস। তবে বৃত্ত ভাইয়ার সাথে ওভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। ভবিষ্যতে যেকোনো কাজে হয়তো উনার সাহায্য লাগতে পারে। তখন কি করবি?”

বিন্দু অনেকটা জেদি কণ্ঠে বললো,
” আমরা এতোটা অক্ষম নই যে নিজেদেরকে নিজেরা দেখে রাখতে পারবো না।”

” আমি তা বলছি না বিন্দু। ডিপার্টমেন্টের যেকোনো কাজেই উনার হেল্প লাগতে পারে।”

” বললাম তো কোনো হেল্প লাগবে না। এবার আর কথা বলিস না। আমার মাথা ব্যাথাচ্ছে। উনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে একের পর এক বিপদে পড়ছি। লাইফে আগে বিপদ কম ছিলো নাকি যে এখন ভার্সিটিতে এসে বৃত্ত নামক বিপদের সাথে দেখা!”
বলেই সে ওয়াশরুমে চলে গেলো। পিছে মারিয়া বিন্দুকে দেখে একরাশ হতাশা নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
” নাহ, তোদের আর কোনো ফিউচার দেখতে পাচ্ছি না আমি। ”

———————

সকালে ঘুম থেকে উঠে টিভিতে হেডলাইন দেখে আফতাব হোসাইনের মাথায় হাত পড়লো। তব্দা খেলো বৃত্ত ও বাদল। হেডলাইনে ধীরেধীরে যাচ্ছে একটি লাইন,
” আফতাব হোসাইনের নিজস্ব অফিসের এক উচ্চপদস্থ সহকর্মীর বাড়িতে বিপুল পরিমাণে কালো টাকার মজুদ পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ সন্দেহ করছে স্বয়ং আফতাব হোসাইনের বাড়িতেও এমন অগণিত কালো টাকার মজুদ রয়েছে।”
®সারা মেহেক

#চলবে