সে আমার অপরাজিতা পর্ব-১১

0
139

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_১১
#সারা মেহেক

খবরের হেডলাইন দেখে আফতাব হোসাইন ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লেন। নিজের দলের লোকেদের অগাধ বিশ্বাস তাঁর। দলের প্রতিটি লোক জানে আফতাব হোসাইন তাদের প্রত্যেককেই নিজের পরিবারের সদস্যদের মতো ভাবেন। কিন্তু পরিবারের এক সদস্যই যদি এভাবে
পিঠে ছু রি চালায় তাহলে বিশ্বাসের স্থানটা ঠিক ঐ মুহূর্তেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

এহেন পরিস্থিতিতে বৃত্ত নিজের মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু বাদলের মেজাজ হয়ে গেলো গরম। তীব্র আক্রোশে সে টিভি বন্ধ করে বললো,
” ঐ মুহিবের বাচ্চাকে আজ আমি খু’ ন করে ফেলবো। শা’ লা আমাদের সাথে সারাদিন থেকে রাতে কালো বাজারী করে টাকা কামায়! আমরা কি টাকা কম দেই! আজ আমি সত্যিই ওকে মে’ রে ফেলবো।”

বাদলের এহেন রূপ দেখে বৃত্ত এগিয়ে এলো। বাদলের কাঁধে হাত রেখে শান্ত তবে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” মেজাজ গরম করিস না বাদল। এমন মেজাজে একটা অঘটন ঘটলেই খালেদ মোল্লা আমাদের পেয়ে বসবে। আর জনগন এক মুহূর্তও ভাবতে দেরি করবে না যে পরবর্তী নির্বাচনে তারা খালেদ মোল্লাকেই জয়ী করবে।”

বাদল কিছু বলতে নিলো। কিন্তু এর পূর্বেই আফতাব হোসাইন উদ্বিগ্নপূর্ণ স্বরে বললেন,
” বৃত্ত ঠিক বলেছে। এখন আমাদের প্রতিটা কদম খুব সাবধানে ফেলতে হবে। কেননা এ আরোপ শুধু আমার দলের লোকের উপরই দেয়নি। আমার উপরও এ আরোপ এসেছে। সুতরাং ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে প্রতিটা কদম ফেলতে হবে।”

বাদল বললো,
” কিন্তু বাবা, মুহিবের কারণে যে সবাই আমাদের ভুল বুঝবে!”

” কিছু করার নেই বাদল। এ অবস্থাই আমাদের সামাল দিতে হবে। বৃত্ত, তুমি জহিরকে কল করো। ও কোথায় আছে, শুনো। ওর ফ্যামিলি ট্যূর কি এখনও শেষ হলো না!”

হুকুম পাওয়া মাত্রই বৃত্ত আফতাব হোসাইনের সেক্রেটারি জহিরকে কল দিলো। একবার রিং হওয়ার সাথে সাথেই জহির কল রিসিভ করে উৎকণ্ঠিত স্বরে বললো,
” বৃত্ত স্যার,আমি আসছি। রওনা দিয়েছি। ঘণ্টাখানেক আগেই হেডলাইন দেখলাম। ”

বৃত্ত জিজ্ঞেস করলো,
” এখন কোথায় আছো? ফ্যামিলি আছে সাথে?”

” জি স্যার। ওরা সবাই আছে।
কেবল মৌলভীবাজার পার হলাম। আপনারা চিন্তা করবেন না স্যার।”

” হুম আসো তাহলে তুমি।”
বলেই বৃত্ত কল কেটে দিলো।আফতাব হোসাইনের উদ্দেশ্যে বললো,
” বাবা,জহির রওনা দিয়েছে। মৌলভীবাজার পার হয়েছে। আপনি চিন্তা করবেন না প্লিজ। আপনার হার্টের সমস্যার জন্য বাড়ির সবাই চিন্তিত। মা এ ব্যাপারে জানলে নিশ্চিত অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

” তোমার মা’কে বলো না এ বিষয়ে কিছু।”

” আমরা না বললেও টিভি খুললে ঠিকই টের পেয়ে যাবে উনি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন৷ আমি আর বাদল সব সামলে নিবো।”

আফতাব হোসাইন বৃত্ত’র কথায় খানিকটা আশ্বাসিত হলেও পরমুহূর্তেই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেেন। আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বললেন,
” ভেবেছিলাম মেয়র থেকে এমপি হওয়ার পথ কিছুটা হলেও সহজ হবে। কেননা এসব নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এখন দেখছি সারাজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েও এসব ঝামেলা হতে মুক্তি পাওয়া যাবে না। ”

বৃত্ত তার বাবার দুশ্চিন্তার কারণ সম্পর্কে পূর্ব হতেই অবগত। তাই সে এগিয়ে গেলো আফতাব হোসাইনের দিকে। দু হাঁটু গেড়ে বসলো তাঁর সম্মুখে। অতঃপর আফতাব হোসাইনের দু হাঁটুতে হাত রেখে নম্র কণ্ঠে বললো,
” এতদিনের রাজনীতিতে যুক্ত থেকে অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছি, এ পথ কখনও মসৃণ হবে না। শত্রুরা সবসময় ওঁৎ পেতে থাকবে, কখন আমরা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবো। কিন্তু আমাদের বুঝেশুনে কাজ করতে হবে। আপনার দশ বছরের অভিজ্ঞতা কোনো কাজে আসবে না যদি না আপনি বুঝেশুনে কাজ করেন৷ আর এমপি হওয়ার সিদ্ধান্ত আপনার ছিলো। কিন্তু আপনার এ সিদ্ধান্তে আমরা সবাই পাশে আছি। ”

আফতাব হোসাইন জিজ্ঞেস করলেন,
” বৃত্ত? আমার এমপি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কি ভুল হয়েছে?”

” উঁহু মোটেও ভুল হয়নি। আপনি জনগণের সেবার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ছোট পরিসরের কাজটা এখন বড় পরিসরে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর ভালো কাজে বাঁধ আসবে এটা চিরন্তন সত্য। জনগণ জানে আপনি তাদের জন্য কতটুকু করেছেন। তবে তারা এ-ও বিশ্বাস করে যে রাজনৈতিক দলের লোকেরা ভালো হয় না৷ সামনে নির্বাচন আসছে। বেশি সময় নেই। এজন্য আমাদের চোখকান খোলা রাখতে হবে। আমি আর বাদল………”
বৃত্ত নিজের সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারলো না। এর পূর্বেই বেডরুমে প্রবেশ করলেন শাহানা হোসাইন ও জাহানারা বেগম। দুজনের চোখেমুখেই উদ্বিগ্নতা। তাঁরা দুজনে ড্রইংরুমের বিশাল পর্দার টিভিতে সকালের সংবাদ দেখছিলেন আর টুকটাক কাজ করছিলেন। এমন মুহূর্তেই আফতাব হোসাইনকে নিয়ে আলোচিত হেডলাইন তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে। তা দেখেই দুজনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসেন।
শাহানা বেগমের চাহনিতে উদ্বিগ্নতা। মুখমণ্ডলে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ। তিনি এসেই আফতাব হোসাইনের সম্মুখে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে বৃত্ত মুহূর্তেই উঠে গেলে মা’কে জায়গা দেওয়ার জন্য।

শাহানা হোসাইন এসে দাঁড়ালেন। উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন,
” এসব কি শুনছি বৃত্ত’র বাবা? আপনাদের অফিসের একজনের কাছে নাকি কালো টাকা পাওয়া গিয়েছে? ”

আফতাব হোসাইন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। এই জিনিসটাই তিনি চাচ্ছিলেন না। কেননা শাহানা হোসাইনের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা সম্পর্কে তিনি বরাবরের মতোই অবগত। তাঁর স্ত্রী যে দুশ্চিন্তায় থাকলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নেয় তা অজানা নয় উনার৷ আফতাব হোসাইন আশ্বস্ত স্বরে বললেন,
” চিন্তা করো না তুমি। আমরা আছি না৷ সব সামলে নিবো৷ অতীতে যেমন সামলিয়েছি। এবারও সামলে নিবো। আর আমাদের দুই দুইটা ছেলে থাকতে এত টেনশন কিসের! ”

জাহানার বেগম এবার ছেলের মাথায় হাত রেখে নম্র সুরে ধীরেসুস্থে বললেন,
” রাজনীতি জিনিসটা আমার খুব একটা পছন্দ নয়। কিন্তু তোর বাবার রাজনীতির প্রতি ভীষণ নেশা ছিলো। সে নেশার ঘোরে পড়েই নিজের জীবন ত্যাগ দিয়েছিলেন উনি। তুইও রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছিস। সাথে নিজের দু ছেলেকেই নিয়েছিস। এজন্য বলবো, সবার আগে নিজের আর নিজের ছেলেদের কথা ভাববি। রাজনীতির পথ কাঁটায় পূর্ণ থাকে। আমি চাইবো না আমার স্বামীর মতো আমার ছেলে আর নাতির পরিণতি হোক। আমার দোয়া সবসময় তোদের প্রতি আছে। তোরা সফল হবি ইন শা আল্লাহ।
বউমা তুমি চিন্তা করো না৷ আমার ছেলে আর নাতি দুটো সব সামলে নিবে। ”

আফতাব হোসাইন তৃপ্তির হাসি হাসলেন। এ পরিবারকে নিয়েই তাঁর সকল গর্ব, সকল সম্মান। জাহানারা বেগম, যে সকল পরিস্থিতিতে সন্তানের পাশে থেকে তাকে সাহস জোগায়। শাহানা বেগম, যে সকল পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি মাথায় তোলেন। তবে পাশাপাশি স্বামী, সন্তানদের বিপদের মুহূর্তে পাশে থাকেন। বৃত্ত, যে পরিস্থিতি বুঝে মাথা গরম ও ঠাণ্ডা করতে জানে। শ’ ত্রু’ দের সাথে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে নম্র স্বরে কথা বলতে জানে, সাথে পরিবেশ গরম হলে তার প্রতিক্রিয়াও দেখাতে জানে। যে বাঁধাহীন ভাবে নিজের পরিবারকে ভালোবাসতে পারে৷ বাদল, যে শ’ ত্রু’ দের নাম শুনলেই মাথায় আ’ গু’ ন লাগিয়ে নেয়। যে তার বাবা ও ভাইকে নিজের আদর্শ মনে করে।

—————-

টানা দু সপ্তাহ দলের কাজে ব্যস্ত ছিলো বৃত্ত ও বাদল। এ দু সপ্তাহে তারা ভার্সিটিতে পদধূলি রাখেনি বললেই চলে। শুধু বাদল সপ্তাহের দু দিন গিয়েছিলো পরীক্ষা দিতে। এ ছাড়া দুজন সারাটা সময় লাগিয়েছে মুহিবের দ্বারা তৈরীকৃত সমস্যার সমাধান করতে।
সেদিন বৃত্ত ও বাদল একটুখানি আশা নিয়ে গিয়েছিলো যে, হয়তে মুহিন নির্দোষ। তাকে বি’ রো’ ধী দলের লোকেরা ষ’ ড়’ য’ ন্ত্রে’ র মাধ্যমে ফাঁসিয়েছে। কিন্তু থানায় গিয়ে তারা মুহিবের কাজের সত্যতা খুঁজে পেলো। সে থেকে বেশ কারসাজি করে আফতাব হোসাইনকে এ মিথ্যে অপবাদ থেকে মুক্ত করিয়েছে। আর মুহিবকে দলচ্যূত করেছে। বৃত্ত জানে, এই একটি আরোপই তাদের নির্বাচনের কাজে ছোট কংকর হিসেবে কাজ করবে। আর এ কংকর পার হতে হবে খুবই সাবধানে। যেনো বাতাসেও সে কংকরের উপস্থিতি নড়ে না উঠে!

দলের কাজে ব্যস্ত বৃত্ত এ সপ্তাহে নিজ হতে বিন্দুর কোনো খোঁজ রাখতে পারেনি। সাকিবের মাধ্যমে দুদিন একটু খোঁজ নিয়েছিলো। সে থেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস টিকে আছে তার। না হলে হয়তো দলের কাজও ভালোভাবে করতে পারতো না সে!

এদিকে সে ঘটনার পর থেকে দু সপ্তাহ বৃত্তকে ভার্সিটিতে না দেখে খানিকটা অবাকই হয়েছিলো বিন্দু। ভেবেছিলো হয়তো সেদিনের বলা কথাগুলো বৃত্ত’র গায়ে লেগেছিলো। এজন্যই বোধহয় তার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করে না। তবে গেলো সপ্তাহেই বিন্দু নিজের বলা কথাগুলো নিয়েই আনমনে ভাবছিলো। উপলব্ধি করতে পেরেছিলো, বৃত্ত’কে বলা কথাগুলো আরো একটু নম্র ভাষায় হওয়া দরকার ছিলো। একটু বেশিই কর্কশ ভাষায় সব বলেছিলো সে। এজন্য নিজের ভেতরে অপরাধবোধের অনুভূতিটাও তৈরী হয়েছিলো তার।

ক্যান্টিনে বসে সকালের নাস্তা করছিলো বিন্দু, মারিয়া ও সজীব। তবে সজীবের ক্ষেত্রে ঠিক নাস্তা করছিলো তা বলা যায় না। কেননা নাস্তায় কম, তার মনোযোগের সম্পূর্ণটা জুড়ে ছিলো তার গার্লফ্রেন্ড দিশা। ফোনে ম্যাসেজের মাধ্যমে দিশার সাথে কথা বলছিলো সে। ফলে পরোটা আর ডাল সেই একই রকম রয়ে গিয়েছে। সজীবের এহেন অবস্থা দেখে বিন্দু ও মারিয়া একে অপরের সাথে এ নিয়ে হাসাহাসি করছিলো। এক পর্যায়ে মারিয়া বললো,
” আজ সজীবের মতো তোরও এমন অবস্থা হতো, যদি না তুই বৃত্ত ভাইয়ার সাথে সেদিন ওমন আচরণ করতি!”

বিন্দু পরোটা মুখে নিতে নিতে বললো,
” সরি মারিয়া। এমন পাগল হওয়ার শখ নেই আমার। আর ভালো ভালো মুহূর্তের মধ্যে তুই ঐ বৃত্ত-টৃত্ত’কে টেনে আনিস কেনো? দু সপ্তাহ উনার চেহারা দেখিনি বলে শান্তিতে আছি। দোয়া কর যেনো চোখের সামনে উনি না পড়ে। ”

” বিন্দু নামের মেয়েটা যে এতোটা অকৃতজ্ঞ তা আজ জানতে পারলাম৷। ”
এই বলতে বলতেই কোথা থেকে যেনো বৃত্ত’র আগমন ঘটলো। অকস্মাৎ বৃত্তকে দেখে চমকে বিষম খেলো বিন্দু। ফলস্বরূপ পরোটার টুকরোটা তার গলা আটকে গেলো। কাশতে কাশতে বৃত্তকে উপেক্ষা করে গ্লাসের পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো সে।
এদিকে বৃত্ত’র উপস্থিতিতে তটস্থ হলো সজীব। কোনোমতে পকেটে ফোন ঢুকিয়ে বাধ্য ছেলের ন্যায় সোজা হয়ে বসলো সে। বৃত্তকে সালাম জানালো। বৃত্ত’ও সালামের জবাব দিলো। আর মারিয়া, সে তো দু সপ্তাহ পর বৃত্তকে দেখে খুশিতে আটখানা হলো। যথারীতি বিন্দুর চেয়ে বৃত্তকে নিয়ে বেশি আগ্রহী হলো মারিয়া।

বৃত্ত বিন্দুর সোজাসোজি বসলো। তাকে বসতে দেখে ক্যান্টিনের সকল জুনিয়ররা তটস্থ হলো। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা কমিয়ে ফিসফিস করে দু চারটা কথা বলতে লাগলো। বৃত্ত তাদের সকলকে উপেক্ষা করে বিন্দুর উদ্দেশ্যে খানিকটা অভিযোগের সুরে বললো,
” আমার এত সুন্দর নামটাকে তুমি কি করলে! সিনিয়রদের কি করে সম্মান জানাতে হয় জানো না? টৃত্ত কি হ্যাঁ? আজ বানালে টৃত্ত। কবে না জানি বৃত্ত-টৃত্ত থেকে নৃত্য বানিয়ে দাও আমাকে!”

#চলবে