সে আমার অপরাজিতা পর্ব-২৭

0
124

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_২৭
#সারা মেহেক

বৃত্ত হতবিহ্বল দৃষ্টিতে বিন্দুর পানে চাইলো। তার চাহনিতে নিষ্প্রভতা নেমে এলো। অবিন্যস্ত গলায় শুধালো,
” এমন কথা বলছো কেনো বিন্দু? ”

বিন্দুর গাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো। বারংবার নিজের পোড়া কপালের কথা ভেবে কল্পনায় নিজেকে কষিয়ে চড় মাড়ছে। বৃত্ত’র প্রশ্নে বিন্দু সরাসরি ঐ দৃষ্টিতে চেয়ে তীব্র অভিমান ও দুঃখ নিয়ে বললো,
” আমার গায়ে কলঙ্ক লেগেছে। আপনি মানুন আর নাই মানুন। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে আমার। আপনি আমাকে স্পর্শ করে নিজের হাত নোংরা করবেন না। ”

বৃত্ত ঈষৎ ক্রুদ্ধ গলায় বললো,
” এসব কি বলছো তুমি! এমন কিছুই হয়নি। তুমি আগের মতোই পবিত্র আছো বিন্দু।”

” আমি জানি আমি পবিত্র। কিন্তু লোকে তো জানে না৷ তারা তো ভেবেই নিয়েছে আমি নষ্ট মেয়ে।”

” খবরদার এসব কথা মুখে আনবে না। লোকে কি বলে তা দিয়ে আমাদের কাজ নেই। আমরা নিজের কাছে নিজেরা ভালো হলে সমস্ত দুনিয়া ভালো। এসব নিয়ে আর ভেবো না বিন্দু। ”

বিন্দু এ কথার প্রত্যুত্তর করলো না। বরং অভিযোগের সুরে বললো,
” আপনি আমার জীবনে না এলেও পারতেন বৃত্ত। আপনার উপস্থিতি আমার জীবন তছনছ করে দিয়েছে।”
বলেই হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো বিন্দু। তার প্রতিটি কথা বৃত্ত’র বুকে কাঁটার ন্যায় বিঁধলো। বুকের ভেতরে অগোচরে রক্তক্ষরণ হলো। ক্ষণিকের জন্য জবান দিয়ে বেরুলো না একটি শব্দও। বিন্দুর গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়া প্রতিটি অশ্রুবিন্দু বৃত্ত’র মাঝে তীব্র আক্রোশ তৈরী করলো। আশরাফের প্রতি প্রতিশোধের নেশা তাকে উন্মাদ করে ফেললো। দাঁতে দাঁত পিষ্ট করে ক্রুদ্ধ স্বরে বললো,
” আমার ওয়াদা রইলো বিন্দু, তোমার গায়ের কলঙ্ক চিরতরে মুছে ফেলবো আমি। তোমার প্রতি অন্যায়কারীকে নিজ হাতে শাস্তি দিবো। তার এমন বেহাল দশা করবো যে তোমার নাম মুখে আনতেই তার রুহ কেঁপে উঠবে। ”
বলেই সে বিন্দুর মাথায় আস্থার হাত রাখলো। তার স্পর্শে পূর্বের চেয়েও সশব্দে কেঁদে উঠলো সে।

——

কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো ঠিক মনে পড়ছে না বিন্দুর। শোয়া ছেড়ে উঠতেই আচমকা ব্যাথায় টনটন করে উঠলো মাথা। মুহূর্তেই দু হাত মাথায় চেপে ধরে ‘আহ’ শব্দে নড়ে উঠলো সে। খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে পাশ ফিরে চাইলো। বৃত্ত নেই। কখন উঠে গিয়েছে কে জানে!

বিন্দু ধীরেসুস্থে উঠলো। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিয়ের শাড়ি বদলে নিলো। খালার দেয়া একটা শাড়ি পরে বেরিয়ে রুম হতে বেরিয়ে এলো সে।
ঘড়িতে প্রায় ন’টা বাজে। শাহানা হোসাইন, জাহানারা বেগম, বর্ষা বসে আছে ডাইনিং এ। তাদের নাস্তা প্রায় মাঝপথে। সিঁড়ি বেয়ে বিন্দুকে নিচে নামতে দেখেই বর্ষা খাবার রেখে এগিয়ে গেলো বিন্দুর দিকে। মিষ্টি হাসি দিয়ে আপ্যায়ন করলো বর্ষা। বললো,
” আপনার জন্য ওয়েট করছিলাম ভাবী। আসুন,খেতে বসুন আমাদের সাথে। শ্বশুরবাড়িতে আপনার প্রথম সকাল বলে আপনার জন্য বাহারি নাস্তা তৈরী করা হয়েছে। ”
বলতে বলতে সে ডাইনিং এ নিয়ে এলো বিন্দুকে। বিন্দু মুচকি হেসে বর্ষার পাশের চেয়ারে বসলো। সারা রাত কান্না করার ফলে তার চোখজোড়া ফুলে উঠেছে। শাহানা হোসাইন বিন্দুর এ করুণ দশা দেখে মমতা পূর্ণ কণ্ঠে বললেন,
” ইশ! কান্না করে চেহারাটার কি অবস্থা বানিয়েছে মেয়েটা! এত কান্না কিসের হুম? নতুন দাদি আর মা’কে পেয়ে কি ভালো লাগছে না?”

বিন্দু ম্লান হাসলো। তার অধর কোনের হাসির রেখাই বলে দিচ্ছে তার ভেতরকার অসহনীয় দুঃখের সীমানা কতটুকু। জাহানারা বেগম নিজের ভারত্ব বজায় রেখে গাম্ভীর্যের সহিত বললেন,
” তুমি পরিস্থিতির শিকার হয়েছো বিন্দু। জানি, এ বিয়ে মেনে নিতে বেশ কষ্ট হবে তোমার। তবে এটা তো জানো তাই না? আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। আর মানুষের কথায় কান দিবে না। তুমি জানো, তুমি ভালো। মানুষের কথায় তুমি নিশ্চয়ই খারাপ হয়ে যাবে না? তাহলে শুধু শুধু এসব নিয়ে ভেবে কান্না করছো কেনো? সমস্ত কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো। আর নিজেকে শক্ত করো, বৃত্ত’র উপর ভরসা রাখো। ও সবসময় তোমার পাশে আছে। জীবনের এ কালো অধ্যায় ভুলে বৃত্ত’র সাথে নিজের সংসার জীবন গুছিয়ে নিতে শুরু করো। ঠকবে না তুমি। ”

বিন্দু নত দৃষ্টিতে প্রতিটি কথা শুনলো। তবে এ মুহূর্তে এসব কথা নিয়ে ভাবলো না। জীবনের এ জটিল সমীকরণ মেলাতে নিজেকে একান্তে কিছু সময় দেওয়া প্রয়োজন। ভাবনার ডায়েরিটা খুলে নিজের সাথে আলাপন জমানো প্রয়োজন। এর জন্য দরকার কিছু সময়। একান্তে কিছু সময়।

বিন্দু খেতে আরম্ভ করলো। পাশ থেকে বর্ষা আগ্রহের সহিত বললো,
” খেয়ে নিন ভাবী। আপনাকে বাড়ি ঘুরে দেখাবো। সবকিছু চিনে রাখতে হবে তো নাকি! আপনাকে আজ সময় দেওয়ার জন্য ভার্সিটি মিস করেছি। ”
বলেই এক গাল হেসে ফেললো সে৷ তার হাসির পিঠে হাসলো বিন্দুও।
খেয়েদেয়ে মাত্রই বিশাল ড্রইংরুমের সোফায় বসেছে বাড়ির চার মহিলা সদস্য। শাহানা হোসাইন ও জাহানারা বেগম আত্মীয়স্বজন, বাড়িঘর নিয়ে কথা বলছেন বিন্দুর সাথে। বিন্দুর এসবের প্রতি একরত্তিও আগ্রহ নেই। বরং খানিকটা বিশ্রাম নিতে পারলে বেশ হতো।

অকস্মাৎ বাড়ির প্রধান দরজা দিয়ে মারিয়াকে প্রবেশ করতে দেখে চমকে উঠলো বিন্দু। মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিচরণ করলো তার সমস্ত অঙ্গে। সোফা হতে দ্রুত উঠে দৌড়ে গিয়ে মারিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। মারিয়াও জড়িয়ে ধরলো তাকে। মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছিস বিন্দু? ”

বিন্দু জবাব দিলো না। কান্না করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। এ মুহূর্তে কান্না করা অনুচিত হবে। মারিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
” তুই চিনলি কি করে?”

” বৃত্ত ভাইয়ার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছি।”

” ওহ।”

মারিয়াকে দেখে শাহানা হোসাইন উঠে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার বান্ধবী? ”

বিন্দু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালে মারিয়া সালাম দিলো। শাহানা হোসাইন সালামের জবাব দিয়ে তাদের দুজনকে সোফায় বসতে বললেন। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে শাহানা হোসাইন অন্য গল্প জুড়ে দিলেন। এক পর্যায়ে মারিয়াকে নিয়ে বিন্দু রুমে গিয়ে বসলো।
মারিয়া তাল-বাহানা ব্যতিতই জিজ্ঞেস করলো,
” কাল রাতে কি কথা হলো বৃত্ত ভাইয়ার সাথে?”

মারিয়ার সামনে বসতে বসতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো বিন্দু। সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললো,
” আমি কিভাবে মেনে নিবো মারিয়া? আমার মন এখনও মানছে না। গত কয়েকদিনে আমার জীবনে কি বাজে একটা পরিবর্তন এলো তাই না?”

মারিয়া বিন্দুর হাতে হাত রাখলো। আস্থাপূর্ণ গলায় বললো,
” আপাতদৃষ্টিতে তোর কাছে এ পরিবর্তন বাজে মনে হতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। হ্যাঁ, তোর গায়ে একটু কাঁদা ছিটেছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, এ পর্যন্ত ভার্সিটির দু একজন ছাড়া আর কারোর কাছেই তোর ভিডিওর কথা শুনিনি আমি। বরং তোর আর বৃত্ত ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ভার্সিটির সকলেই জানে তোদের বিয়ে মাসখানেক আগে হয়েছে। নির্বাচনের জন্য এতোদিন লুকিয়ে রেখেছিলো।
তুই ভাবছিস তোর এ ভিডিও সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আদোতে এমন হয়নি৷ ভিডিও ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই রিমুভ করে দিয়েছে। আর সামনে যেনো কেউ এ ভিডিও প্রকাশ না করে সে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। তুই শুধু শুধু অতিরিক্ত ভাবছিস। এসব ভাবনা বাদ দিয়ে এটা ভাব যে বৃত্ত ভাইয়া কতটা দায়িত্বশীল একজন মানুষ। উনি কিন্তু চাইলেই এসব বিষয় হতে গা ঢাকা দিতে পারতেন। কিন্তু তোর জন্য উনি যা সম্ভব হয় তাই করে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে অন্য ছেলে হলে বোধহয় তোকে বিয়েই করতো না। কিন্তু বৃত্ত ভাইয়া করেছে। কারণ উনি তোকে ভালোবাসে। উনার এ ভালোবাসার মূল্য দিস বিন্দু। একটু সময় নে। কিন্তু ভালোভাবে, গভীরভাবে এসব নিয়ে ভাব। জবাব পেয়ে যাবি।
তুই যতোটা খারাপ ভাবছিস, পরিস্থিতি কিন্তু অতোটা খারাপের পর্যায়ে যায়নি৷ আর খারাপের পর্যায়ে না যাওয়ার মূল কারণ তোদের ঐ নকল কাবিননামা। বৃত্ত ভাইয়া যদি ঐ কাবিননামা না বানাতো তবে ঘটনা অনেক বিগড়ে যেতো। এখন কেউ যদি ঐ ভিডিও নিয়ে কথাও বলে তার মুখের উপর কাবিননামা ছুঁড়ে দেওয়া যাবে। তখন না চাইতেও চুপ হয়ে যাবে সে মানুষটা। ”

বিন্দু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার মস্তিষ্কে সমস্ত কিছু জটলা পাকিয়ে গিয়েছে। এর পরিণতি কি হবে তার কাছে অজানা। নিজের সাথে ঘটা ঘটনা কি আদৌ তার জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলবে নাকি ভালো কিছু বয়ে আনবে এখনও দেখার পালা। প্রকৃতপক্ষে মারিয়ার কথা ঠিক, এমন ঘটনায় পরিস্থিতি যতোটা বিগড়ে যাওয়ার কথা ততোটা বিগড়ে যায়নি। বরং সবকিছুই আড়ালে আবডালে সামলে নেওয়া যাচ্ছে।

———-

মাত্রই ক্লাব ছেড়ে ছেলেপুলেদের নিয়ে মোটরসাইকেল করে বেরিয়েছে আশরাফ। ম’দ খেয়ে অর্ধ মাতাল সে। তবে এই অবস্থাতেও নিজ হাতে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে সে। দু পাশে, পিছনে, সব দিয়ে পাঁচটা মোটরসাইকেল চলছে সুনসান এই রাস্তায়।
হঠাৎ জনশূন্য রাস্তায় কিছু লোকের উপস্থিতিতে মোটরসাইকেলে ব্রেক কষলো আশরাফ। হকিস্টিক হাতে নিয়ে কালো পোশাক, কালো হেলমেট ও গ্লাভস পরিহিত পাঁচজন লোককে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে। মুহূর্তেই তাদের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য ভাষায় গালি ছুঁড়ে বললো,
” মাঝ রাস্তায় কি করিস রে তোরা?”

সামনে উপস্থিত লোকগুলোর কেউই জবাব দিলো না। তবে তন্মধ্যে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি অকস্মাৎ হকিস্টিক দিয়ে আশরাফের মোটরসাইকেলের হেডলাইট ভেঙে ফেললো
চমকে উঠলো সকলে।
#চলবে
®সারা মেহেক