সে আমার অপরাজিতা পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
163

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_৩৪(শেষ পর্ব)
#সারা মেহেক

হাসপাতালের জরুরী বিভাগে হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে। ডাক্তাররা হিমশিম খাচ্ছে আহতদের চিকিৎসা দিতে। আধ ঘণ্টা আগেই একটা বাস এক্সিডেন্টে ২৫জন আহত হয়ে জরুরী বিভাগে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে বৃত্ত’র অনুষ্ঠিত সভায় বো’ মা’ হা’ ম’ লা’ য়’ আহতরাও একই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সব মিলিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ডাক্তাররা।
সভায় যে হা’ ম’ লা’ হয় তাতে দুজন পুলিশ সদস্য, পাঁচজন সাধারণ জনতা নিহত হয়েছে। নেতাদের মধ্যে একজনের অবস্থা বেশ শোচনীয়। বৃত্ত, বাদল ও বাকি দুজন প্রাণে বেঁচে ফিরলেও আহত হয়েছে বেশ। দুজনের পায়ের উপর স্টেজের অনেকাংশ পড়ে ছিলো। ফলে পা থেতলে গিয়েছে। মূলত বৃত্ত ও বাদলকে বাঁচাতে গিয়েই তারা এতোটা আহত হয়েছেন। বাদলও বৃত্তকে বাঁচাতে গিয়ে বাম পায়ের গোড়ালিতে ফ্র্যাকচার করে ফেলেছে। বৃত্তকে বাঁচানোর মূল কারণ, সামনের সপ্তাহেই নির্বাচন। এমতাবস্থায় শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্য যদি সফল হয় তবে নির্বাচনে দাঁড়াতেই পারবে না সে। যদিও স্টেজের উপর উপস্থিত সকলে বৃত্তকে বাঁচাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে, তবুও সে আহত হয়েছে। শরীরের বেশ কিছু জায়গায় কেটে গিয়েছে। বাহুতে স্টেজ বাঁধানো পেরেক ঢুকে গিয়েছে।
প্রতিপক্ষ দলের হা’ ম’ লা’ য় একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছে নেতারা। কারণ স্টেজের ঠিক পিছনেই তবে সামান্য একটু দূরে হা’ ম’ লা’ হয়।

হামলার কথা শুনে আফতাব হোসাইন পার্টির লোকদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান। ওদিকে বিন্দুও আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু এ অবস্থায় অত র’ ক্তা’ র’ ক্তি’ র মধ্যে যেতে কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয় তার শ্বশুর। এর ফলে দাদির কাছে বসে বসে কাঁদতে থাকে বিন্দু। শাহানা হোসাইন ও বর্ষা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বিন্দুকে বুঝানোর। কিন্তু সে কান্না করেই যাচ্ছে। ওদিকে নিউজে এ নিয়ে খবর বের হয়েছে। গুটি কয়েক নিউজ চ্যানেলে যা হয়েছে তার চেয়েও বরং অধিক রংচঙ মিশিয়ে বলছে। এক নিউজ চ্যানেল তো মাত্রা ছাড়িয়ে আসন্ন নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী বৃত্তকে মৃ’ তও ঘোষণা করে দিয়েছে। এসব দেখে বিন্দুর আরোও অস্থিরতা বাড়ছে।
মানসিক চাপে কাহিল হয়ে কান্নাকাটি করার পর বিন্দু জ্ঞান হারালো। আপাতত তাকে বাসারই তিনজন মহিলা মিলে দেখাশোনা করলো।

দুটো ছেলের এ করুণ অবস্থা, পার্টির অন্যান্য সদস্যরা যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তাতে আফতাব হোসাইন বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। সেটাও আবার অজ্ঞাত কারোর বিরুদ্ধে না। খলিল মোল্লার বিরুদ্ধে। আফতাব হোসাইনের সকল সন্দেহ খলিল মোল্লাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। কেননা নির্বাচনের সময় এই লোকটাই তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে যায়। উপরন্তু গত পরশু রাতে অজ্ঞাত নামে হুমকিপূর্ণ এক চিঠি আসে। তাতে আফতাব হোসাইন ও বৃত্ত, উভয়কেই নির্বাচন থেকে হটে যাওয়ার হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু বাপ ছেলে এসব হুমকিতে মোটেও ঘাবড়ায় না। রাজনীতিতে এসে এসব তাদের কাছে নিতান্তই ডাল-ভাত।

আফতাব হোসাইন বৃত্ত ও বাদলের সর্বোচ্চ দেখভাল নিশ্চিত করছেন। সাথে পার্টির বাকি লোকদেরও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করছেন।

রাতের দিকে শরীর খানিকটা ভালো হলে বিন্দুকে কল করে বৃত্ত। সারাদিন ধরেই বিন্দু কথা বলার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু বৃত্তর শারীরিক অবস্থার জন্য কেউই কথা বলতে দেয়নি। বৃত্তর নাম স্ক্রিনে দেখা মাত্রই বিন্দু কল রিসিভ করে। আদ্র চোখে জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছেন এখন? ”
বৃত্ত হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে মৃদু হাসলো। বিন্দুর ঐ উদ্বেগমাখা গলার স্বর শুনতেও স্বস্তি। বললো,
” মোটামুটি সুস্থ। তবে পুরো শরীর মারাত্মক ব্যাথা।”
বিন্দু কিছু না বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ওদিকে বৃত্ত তাকে সতর্ক করলো,
” খবরদার কাঁদবে না। আমি তো সুস্থ আছি। তুমি এভাবে দূর্বল হয়ে পড়লে আমাদের বাচ্চার কি হবে?”
” আপনি না থাকলে আমাদের বাচ্চার অস্তিত্বই থাকবে না।”
বৃত্ত এবার অকপট রাগ দেখিয়ে বললো,
” খবরদার বিন্দু,ওসব কথা বলতে যাবে না। আমি না থাকলেও আমার স্মৃতি হিসেবে আমাদের বাচ্চা থাকবে। ওকে ঘিরেই তোমাকে বাঁচতে হবে।”
” বৃত্ত, আমি আর সহ্য করতে পারছি না এসব রাজনীতি। আপনাকে আর কতবার এমন বিপদে পড়তে দেখবো!”
” যতদিন রাজনীতিতে আছি ততদিন আমার শত্রু থাকবে। আর এসব তো ছোটখাটো ঘটনা।”
” এটাকে ছোট ঘটনা বলছেন! জানেন কতজন মা’ রা’ গিয়েছে? ”
” জানি। আর এত চিন্তা করো না। কারণ নির্বাচনের আগে এটাই আমাদের শেষ সভা ছিলো। সামনের সপ্তাহেই তো নির্বাচন। ততদিন আমাকে বেডরেস্টই থাকতে হবে। ”
” হুম। বেডরেস্ট মানে কিন্তু বেডরেস্ট। একদম কড়াকড়ি বেডরেস্ট। ওসব মিছিল মিটিংয়ে বের হওয়া যাবে না। ”
” আচ্ছা, যথা আজ্ঞা মহারাণী। এখন তাহলে রাখি? কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। ঘুম আসছে।”
” আচ্ছা, ঘুমান তবে। খেয়াল রাখবেন নিজের।”
” তুমিও নিজের খেয়াল রেখো।”

—————

তিনদিন পর খলিল মোল্লা গ্রেফতার হলেন। সেদিন হা’ ম’ লা’ র পিছনে উনারই হাত ছিলো। আফতাব হোসাইনের জোরে পুলিশ দ্রুতই হা’ ম’ লা’ কারীকে সামনে আনতে সক্ষম হলো। সন্দেহ নেই ক্ষমতা পাওয়ার লোভেই তিনি এ নিচ কাজ করেছেন। আপাতত দলের কিছু নেতা ও তাকে জেলে পুরা হয়েছে। বাকিটা আফতাব হোসাইন নির্বাচনের পরে দেখবেন। ওদিকে বৃত্ত ও বাদলও বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছে। ফলে প্রধান হিসেবে একা কাজের দায়িত্ব পড়েছে আফতাব হোসাইনের উপর। যদিও তিনি ভালোমতোই সামলে নিচ্ছেন সব।

নির্বাচনের দিন এলো। সুষ্টু নির্বাচনের মাধ্যমে বৃত্তই জিতলো। ফলে সারারাত সে পার্টির লোকদের সাথেই ব্যস্ত থাকলো। ওদিকে বিন্দু তার অপেক্ষায় থেকে থেকে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি। তার ঘুম ভাঙলো বৃত্তর ডাকে। পিটপিট করে চোখ মেলে দেখলো সকাল হয়ে গিয়েছে। চট করে ঘড়িতে তাকালো সে। সকাল ৮টা বাজে। এবার বৃত্তর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে এখনও বাইরের পোশাকেই অর্থাৎ সাদা পাঞ্জাবি পরেই আছে।
বিন্দু তড়িতে উঠে বসলো। বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি মাত্র আসলেন?”
বৃত্ত একগাল হেসে বললো,
” হুম। একটু দাঁড়াও তো।”
বিন্দু ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
” কেনো?”
” আহহা, দাঁড়াও তো। ”
বিন্দু কথামতো দাঁড়ালো। মুহূর্তেই বৃত্ত তার পা ধরে তাকে কোলে উঠালো। কয়েক চক্কর দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললো,
” বিন্দু! আমি জিতে গিয়েছি। আমি জিতে গিয়েছি।”
তার এ উচ্ছ্বাসে ভীষণ খুশি হলো বিন্দু। তবে মাথা ঘুরছিলো বলে দ্রুতই বৃত্তকে নামাতে বললো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য বৃত্ত তার প্রেগন্যান্সির কথা ভুলেই বসেছিলো। কোল থেকে নামানোর পর দুজন ধাতস্থ হলে বৃত্ত বললো,
” চলো ছাদে চাই।”
” কিন্তু কেনো?”
” আরে চলো তো। ”
বিন্দু দ্বিতীয় প্রশ্ন করলো না। বৃত্ত তাকে নিয়ে ছাদে এসে তাদের অপরাজিতা গাছটার সামনে দাঁড়ালো। একটা সদ্য ফোঁটা অপরাজিতা নিয়ে বিন্দুর কানে গুঁজে দিলো। নীরবে, নিষ্পলক চাহনিতে কয়েক মুহূর্ত প্রাণভরে দেখে নিলো বিন্দুকে। অতঃপর কপালে গভীর চুমু এঁকে বললো,
” আমার অপরাজিতা, আমার বউ, আমার ভালোবাসা। ”
বিন্দু আলতো হাসলো৷ সে-ও এগিয়ে বৃত্তর গালে চুমু বসিয়ে বললো,
” আমার বাচ্চার আব্বাজান, আমার ভালোবাসা। ”
হাসলো বৃত্ত। অতঃপর আরেকটি অপরাজিতা ছিঁড়ে নিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বিন্দুর সামনে বসলো। বিন্দুর পেটের উপর ফুলটা ধরে তাতে চুমু দিয়ে বললো,
” এই যে আমার ছোট্ট অপরাজিতা, আমার বড় অপরাজিতাকে ডিস্টার্ব করবে না যেনো।”
বিন্দু কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
” বাবু যে মেয়েই হবে তা কি করে নিশ্চিত হলেন?”
” আমি আল্লাহর কাছে চেয়েছি যে। আমি চেয়েছি আমাদের যেনো ছোট্ট একটা রাজকন্যা হয়, যার আদুরে নাম রাখবো অপরাজিতা। আমার ছোট্ট অপরাজিতা। ”
বলে বৃত্ত উঠে দাঁড়ালো। বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” আমার ছোট্ট অপরাজিতাকে ঘিরে থাকবে তুমি। আর তোমাকে ঘিরে থাকবো আমি। বিন্দুকে ঘিরে বৃত্ত আজীবন থাকবে।”

❤️সমাপ্ত❤️