সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
209

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩২
আজ কতগুলো বছর পরে যে আশা এই পাড়ায় পা রাখলো নিজেই মনে করতে পারছিলো না। যদিও এতগুলো বছরেও পাড়ার কোনো পরিবর্তন নেই! গলির মুখের বলাইয়ের মুদির দোকানটা থেকে সান্যালদের বাড়ি, এমনকি রাস্তার ধারে বসানো জলের কলের সামনের ভিড়টাও একই রকম থেকে গেছে।

সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে, দু একটা আলো জ্বলতে শুরু করছে আস্তে আস্তে, আধো অন্ধকার বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে গলির মুখের আলোটা দেখতে পেয়েই মাথার আঁচলটা আরো বিঘৎ খানেক সামনে টেনে আনলো আশা। এদিক ওদিক তাকিয়ে চেনা শোনা কাউকে দেখতে না পেয়ে বড়ো রাস্তাটা টপকে গিয়ে দ্রুত পায়ে মুদির দোকানটায় গিয়ে দাঁড়ালো সে। দোকানদার বলাই চমকে মুখ তুলে তাকালো, চাপা গলায় বললো,

তুই! এখানে কি মরতে এলি নাকি!

আশার মুখ শুকিয়ে গেলো, প্রতাপ সান্যাল তাকে খুঁজছে সেটা রতনের মুখেই শুনেছিলো সে। সেই খবরের সত্যতা যাচাই করতেই সে আজ অনেকদিন পরে এখানে এসেছিলো। বলাই তার অনেক দিনের চেনা দোকানদার, এ পাড়ায় যাতায়াতের সুবাদে তার সঙ্গে বলাইয়ের ভাই বোনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। অনেকটা বলাইয়ের পরামর্শেই সান্যাল গিন্নি তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেবার পর থেকেই সে এ পাড়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। বুদ্ধিটা বলাই তাকে দিয়েছিলো,

সান্যাল বাড়িতে একবার ঢুকলে আর বেরোনো মুশকিল! সেখানে তোকে সান্যাল গিন্নী নিজেই যখন বার করে দিয়েছে, তখন আর এক মুহূর্তও দেরি করিস না! যা পেয়েছিস এতকাল, এট্টু দেখে শুনে খেলে বাকি জীবনটা হেসে খেলে চলে যাবে! যেদিকে থাকবি সেদিকে না হয় দু চারখান আলতা পরানোর কাজ ধরে নিস আবার! তবে খবরদার, এ পথও মাড়াস নে আর! ও বাড়ি থেকে যে বেঁচে বেরিয়েছিস এই ঢের!

আশা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়েছিলো, যদিও আশা সান্যালদের কি কি কাজ করে দিয়েছে সে খবর বলাই এর জানা ছিলো না। আশা নিজেও কোনোদিনও ভাঙেনি কিছু! তবে সান্যাল বাড়িতে কাজে ঢুকলে যে ছেড়ে আসা যায়না, সে খবর পাড়ার সবারই জানা। সেখানে সান্যাল গিন্নী আশা কে বার করে দিয়েছে জেনে বলাই ধারণা করেছিলো আশা খুব কিছু গর্হিত কাজই করেছে নিশ্চয়ই। তাই আশা কে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলো সে।

আশা চলে গিয়েছে অনেক বছর। সে চলে যাবার কিছুদিন পর থেকেই প্রতাপ সান্যাল তাকে খুঁজছে সে খবর বলাইয়ের কাছে ছিলো। আজ এতো বছর পরে হটাৎ করে তাকে সামনে দেখে বলাই আতঙ্কিত হলো, তার দোকানে আশা কে দেখলে যে তারও বিপদ হবে এটা বুঝেই সে তাড়াতাড়ি আশা কে দোকান থেকে তাড়াতে চাইলো।

এখনো দাঁড়িয়ে আছিস! নিজেও মরবি, আমাকেও মারবি! যা শিগগির এখান থেকে!

আশা ঘোমটাটা আরো খানিকটা সামনে টেনে এনে নিচু গলায় বললো,

চলে যাচ্ছি গো বলাই দাদা, শুধু একটা কথা বলো দিকি! রতন দাদাবাবু বলছিলো সান্যাল মশাই আমাকে খুঁজছে, সত্যি নাকি?

বলাই ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ, খুঁজছে মানে! গরু খোঁজা করছে তোকে! কে জানে কি ঘটিয়েছিস! তবে রতন দাদাবাবু তোকে খুঁজে পেলো কি করে? অবাক কথা তো! রতন বাবু তোর খোঁজ পেলো আর প্রতাপ সান্যাল পেলো না! ব্যাপারখানা কি!

সেই টে জানতেই তো আসা গো দাদা! পিসি, ভাইপোয় হলো কি, এই খপরখান আমার চাই! রতন দাদাবাবু তো সান্যাল বাড়ি কে শত্তুর ঠাওরেছে গো! আমায় তার সঙ্গে হাত মেলানোর কথা বলতেছে!

আশার কথা শুনে বলাই অবাক হলো,

বলিস কি! রতন বাবু তো সান্যাল গিন্নীর নয়নের মণি ছিলো রে! সব কিছুতে তো সেই মাথা গলাতো আগে! ছেলে দুটো কে তো তিনি মোটে ভরসা করতেন না, এখন আবার সে শত্তুর হলো নাকি! কি জানি বাবা, বড়লোকদের বড়ো বড়ো ব্যাপার, ওসব কথায় আমাদের কাজ নেই! তোকে ভালবাসি, বোনের মতো দেখেছি তাই বলি, রতনের ধারে কাছেও থাকিস না! ও ব্যাটা আরো বদ! যেমন ছিলিস তেমন থাক, রতনের সঙ্গে হাত মেলাতে যাসনে, ওটা দু মুখো সাপ!

আশা মাথা নাড়লো,

ঠিক বলেছো বলাই দাদা, এলুম তবে! কিছু খপর পেলে জানিও কিন্তু! এ পাড়ায় তুমিই আমার একমাত্তর ভরসা গো!

হ্যাঁ, হ্যাঁ সে জানাবোখন, এখন পালা দিকি! আর এক মিনিটও দাঁড়াস নে এখানে!

মাথা নিচু রেখে দাড়িপাল্লায় চাল মাপতে মাপতে উত্তর দিলো বলাই, তৎক্ষণাৎ আশা পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। বড়ো রাস্তাটার মুখে এসে আলো ঝলমলে রাতে কেমন যেনো থতমত খেলো আশা, একটু আগেও সে যখন এসেছিলো তখনও রাতের রাস্তার আলোগুলো জ্বলে ওঠে নি। এখন আলোকোজ্বল রাস্তায় নিজেকে কি ভাবে লুকিয়ে রাখবে বুঝতে না পেরে সে দ্রুত উল্টোদিকের সরু গলিতে ঢুকে পড়লো।

উত্তর কলকাতার গলিগুলোকে হাতের তালুর মতো চেনে আশা, একসময় সারাদিনে সে কতোবার যে এখান দিয়ে যাতায়াত করতো তা গুনে শেষ করা যাবে না। এখনো এতবছরেও সেগুলোরও খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি, আর হবার সুযোগও নেই খুব বেশি। পাশাপাশি গায়ে গায়ে লাগানো বাড়িগুলো একই রকম থেকে গেছে, গলি চওড়া হবার কোনো জায়গা নেই। সরু গলিটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই একটা ছাতার কারখানা, আলো বিহীন অন্ধকার গলিকে ঝোলানো ছাতা গুলো আরো অন্ধকার করে রেখেছে। যদিও তাতে আশার কোনো অসুবিধা নেই, সে চোখ বন্ধ করেই এই রাস্তায় নিশ্চিন্তে চলতে পারে, এতো পরিচিত রাস্তা যে আলো না থাকলেও কোথায় গিয়ে এ গলি শেষ হবে সে আশা পা গুনে বলে দিতে পারে।

ছাতা গুলোর ফাঁক দিয়ে হাঁটতে গিয়েই আশা সজোরে একটা শক্ত সমর্থ লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেল, দুজনেই দু মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো, আশা তাকে অন্ধকারে ঠিক বুঝে ওঠার আগেই উল্টো দিকের লোকটার বিদ্রুপ মাখানো গলা ভেসে এলো,

আরে! আমাদের আশা রাণী যে! তা এ পাড়ায় কি মনে করে? আমি সত্যি বললাম কিনা জানতে এসেছিস নাকি!

আশার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠলো, রতন দাদাবাবু! আশা কে চুপ করে থাকতে দেখে রতন হাসলো, আধো অন্ধকারে তার দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠলো,

তোর বাড়ি থেকেই ফিরলাম! বাড়িতে নেই দেখে ভেবেছিলাম, এখান থেকেও পালালি বোধহয়! তা না সোজা শিয়ালের গর্তেই হাত ঢুকিয়েছিস! তোর ধক আছে মাইরি! তবে বেশি সাহস ভালো নয়, এটুকু বলে দিলাম। তোর গোপন খবর দেওয়ার লোক কি বলছে? আমার কথা সত্যি? নাকি মিথ্যে?

আশা মাথা হেলালো, হাত জোড় করে বললো,

বাঁচান দাদাবাবু! সান্যাল মশাই সত্যিই আমাকে খুঁজছে! জানিনা তাদের কোন পাকা ধানে মই দিলাম! আজ পর্যন্ত কোনো কথার খেলাপ করিনি দাদাবাবু, তবু তারা আমায় মারতে চায়!

রতন মাথা নামালো, আশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি যা! কাল বিকেলে তোর বাড়িতে আসছি!

প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে সুমনের ফোন আসেনি, আগের রাগ এখন অভিমানে বদলে গেছে, গত দিন দুয়েক ধরেই ক্রমশ ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছিলো অদ্বিতীয়া। দাদু বা ছোট কা কেউ বাড়িতে না থাকার সুযোগে আজ দাদুর ঘরে ঢুকে এলো সে, যদিও সতর্ক কান তার পরিচিত গাড়ির হর্নের দিকেই ছিলো, দাদু, ছোট কা দুজনের গাড়ির হর্ন ই তার খুব পরিচিত। আরো আগে আসতে পারলে ভালো হতো, যেকোনো সময় দাদু রা ফিরে আসতে পারেন, কিন্তু ঠাকুমা যতক্ষন না হরিসভার আসরে বেরিয়ে যাচ্ছেন ততক্ষন সে এ ঘরে আসার সাহস করে উঠতে পারছিলো না। তাছাড়া সুমনের বাড়ি ফেরার সময়টাও এটাই এর আগে সে মাঠ থেকে ফেরেনা।

সব কিছু মিলিয়ে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফোনটা ডায়াল করে ফেললো অদ্বিতীয়া, দু এক বার বাজার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সোমা ফোন তুললো। পরিচিত গলার সম্ভাষণ শুনেই অদ্বিতীয়া দ্রুত কথা বললো,

তোর দাদা বাড়িতে আছে?

না রে, দাদা তো এখনও ফেরেনি, তোর খবর কি? সেই যে গেলি সেদিন আর তো কোনো কথাই হলো না! এখন তো আর আমাকে পাত্তা দিসনা, দাদা নেহাৎ আজ বাড়িতে নেই, তাই কথা বললি!

সোমার কথা শুনে অদ্বিতীয়া বুঝতে পারলো তার সঙ্গে গন্ডগোলের বিষয়ে সুমন বোন কে কিছু জানায়নি! সে একটু অবাক হলো, নিজেকে সামলে নিয়ে মজার গলায় বললো,

তুইও তো ফোন করিস নি আমাকে, নতুন বৌদি পেয়ে ভুলে গেছিস!

সোমা হেসে ফেললো, দুই বন্ধুর কথোপকথনের মধ্যেই নিচে প্রতাপ সান্যালের গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো। অদ্বিতীয়া তাড়াতাড়ি কথা শেষ করলো,

দাদা বাড়ি এলে আমাকে ফোন করতে বলিস!

ফোন রেখেই দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে এলো অদ্বিতীয়া, মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছিলো। ওকি নিজেকে ছোটো করে ফেললো সুমন কে ফোন করতে বলে! সুমন কি আরো বেশি করে অবহেলা করবে ওকে! যদি ওকে ফোন না করে সুমন তাহলে তো ও আরো ছোটো হয়ে যাবে নিজের কাছে! মনের অস্বস্তি ক্রমশ বাড়তে থাকায় আর থাকতে না পেরে নিচে নেমে এলো অদ্বিতীয়া, রান্না ঘরের সামনে এসে ডাকলো,

ছোটো মা! তুমি কি ব্যস্ত? আমার কিছু কথা ছিলো!

সরলা রান্না ঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো,

কথা ছিলো! আচ্ছা চলো তবে! তুমি ওপরে যাও আমি বাবার চা দিয়ে আসছি!

দোতলার নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে ছোটো মার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো অদ্বিতীয়া, সরলা চা দিয়ে ঘরে ঢুকে এলো। সরলা কে ঢুকতে দেখেই অদ্বিতীয়া হটাৎ তাকে জড়িয়ে ধরলো, কান্না ভেজা গলায় বললো,

আমি আর পারছিলাম না ছোটো মা! আমি সুমন কে ফোন করে ফেলেছি! ও বাড়িতে ছিলো না, সোমা কে বলেছি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলতে! আমি কি ভুল করে ফেললাম ছোটো মা, আমার নিজেকে খুব ছোট লাগছে!

সরলা আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত রাখলো, নরম গলায় বললো,

তুমি বুঝতে পেরেছো তুমি ভুল করেছিলে, দাদার বিয়েতে তোমাকে সময় দিতে না পারার জন্যে সুমনের কোনো দোষ ছিলো না! নিজের ভুল বুঝে তুমি আগে ফোন করেছো, এতে ছোটো হওয়ার কি আছে? সুমন তোমাকে আগে ফোন করলে কি সে ছোটো হয়ে যেতো? কখনই না!

অদ্বিতীয়া চোখ মুছলো, সংশয়ের গলায় বললো,

যদি সুমন ফোন না করে ছোটো মা!

সরলা হাসলো,

সেটা ওর পরীক্ষা, সামান্য ভুল বোঝাবুঝি তে তুমি নিজে ফোন করার পরেও যদি ও ফোন না করে তাহলে বুঝবে ও কখনোই তোমাকে ভালোবাসে নি! সেক্ষেত্রে এরকম সম্পর্ক তোমাকে ভবিষ্যতে দুঃখ ছাড়া অন্য কিছু দেবে না! জোর করে কখনো ভালোবাসা আদায় করা যায় না!

অদ্বিতীয়ার মনের মধ্যে উথাল পাথাল চলতে লাগলো, সুমন ফোন করবে তো!

সুমন ব্যাগ কাঁধে ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই সোমা কে ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখতে দেখলো। ওকে দেখেই সোমা মুখে আফসোসের শব্দ করলো,

ইসস! আর একটু আগে এলি না! জাস্ট ফোন টা রাখলাম! অদ্বিতীয়া তোকে খুঁজছিলো, ফোন করতে বলেছে তোকে!

সুমন হাঁফ ছাড়লো, যাক! রাগ পড়েছে তাহলে! রাগলে অদ্বিতীয়ার মাথার ঠিক থাকে না, এই জন্যেই তো ও অপেক্ষা করেছিলো, আগে অদ্বিতীয়া নিজে থেকে করুক ওকে!

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সোমা অবাক হলো,

কি রে! চুপ করে আছিস কেনো? কি বললাম শুনতে পেলি না?

সুমন অন্য মনস্ক ভাব কাটিয়ে বাস্তবে ফিরলো, ব্যাগ নামিয়ে রেখে দোতলায় উঠতে উঠতে বললো,

হুম্! শুনেছি তো! করে নেবো! তুই আমার ঘরে আয় তো একবার, কথা আছে তোর সঙ্গে!

ছোড়দার পেছন পেছন সোমা দোতলায় উঠে এলো, ইদানিং সবারই নিজস্ব ঘর হয়েছে তাদের। দোতলার দুটো ঘরে দুই ভাই, আর নিচের দুটো ঘরে বাবা, মা আর সোমা। সোমা কে ঘরে ঢুকিয়ে সুমন দরজা বন্ধ করলো, বোনের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো,

তোকে বারণ করেছিলাম তরুণের সঙ্গে মেলামেশা করতে, তুই কিন্তু শুনিস নি!

সোমা মনে মনে চমকালো, মুখে কিছু প্রকাশ না করে বললো,

ফালতু কথা বলিস না! আমার সঙ্গে তরুণের অনেকদিন কোনো যোগাযোগ নেই!

সুমন খাটে পা ছড়িয়ে বসলো,

তাই! নিজেকে সবাই চালাক ভাবে, তবে অন্য কে বোকা ভাবতে নেই! পাড়ায় আমার লোক কম নেই, তারা তরুণ কে তোর কলেজের সামনে দেখেছে! এখনো বলছি ছেলেটা ভালো নয়, শুধরে যা, নাহলে বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দেবো কিন্ত। কলেজ ছাড়িয়ে বাড়িতে বসিয়ে রাখবো।

সোমার মাথাটা গরম হয়ে গেলো, চিৎকার করে বললো,

নিজেকে কি ভাবিস রে? দু পয়সা রোজগার করছিস বলে বিরাট তালেবর হয়ে গেছিস? শোন তোর পয়সায় আমি খাইও না, পরিও না! বাবা এখনো বেঁচে আছে, যতদিন বাবা থাকবে ততদিন তুই কোনো ব্যাপারে আমার কাছে জবাবদিহি চাইবি না!

সুমনও চিৎকার করে উঠলো এবার,

তোর ফুটানির টাকা কে দেয় তোকে? আজ বড়ো বড়ো কথা বলছিস? নিজেকে তাকিয়ে দেখেছিস কখনো, যা স্ট্যান্ডার্ড করেছিস, এরপর ওই শালা তরুণ সেটা মেনটেইন করতে পারবে?

সোমা ঘুরে তাকালো, রাগের গলায় বললো,

তোকে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না! মাঝে মাঝে জামা কাপড়ের জন্যে টাকা দিস তো, আর কখনো চাই বো না তোর কাছে! দেখা যাক তোর টাকা ছাড়া চলে কি না আমার!

সুমন হাত মুঠো করলো,

শালা মালটা কে একবার হাতের কাছে পাই, এমন ক্যালান ক্যালাবো না, সারা জীবনেও ভুলতে পারবে না!

সোমা বিদ্রুপের হাসি হাসলো,

ঠিক এই কথাগুলোই না অদ্বিতীয়ার দাদুও বলবে তোকে! জানতে পারলে এমন ক্যালাবে যে দুনিয়া থেকেই হাপিস করে দেবে! ও তোকে বিয়ে করলে, ওর বিয়ের আগের স্ট্যান্ডার্ড মেনটেন করতে পারবি তো? আগে নিজের কথা ভাব, তারপরে তরুণ কে ক্যালাতে আসিস!

দাঁতে দাঁত চেপে সুমন উঠে পড়লো, ওর আজকে নতুন মোটর সাইকেলের ডেলিভারি ছিলো। বাড়িতে ভয়ে কাউকে জানায় নি এখনো, বাড়ি ফিরলেই মা অশান্তি করবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ক্লাবের সামনে থেকে গৌর কে ডাকলো, গৌর একটু অবাক হলো,

এখন এই সন্ধ্যে বেলায় আবার কোথায় যাবি!

সুমন হাসলো,

চল একটু, সেই নতুন বাইকটা আজ ডেলিভারি দেবে। আজ মাঠ থেকে ফিরেই শালা সোমার সঙ্গে গন্ডগোল হয়ে গেলো, খাওয়াও হলো না কিছু, চল একেবারে খেয়ে দেয়ে ফিরবো!

আবার গন্ডগোল!

গৌর অবাক হলো, সুমন ঘাড় কাত করলো,

হুঁ! তুই ঠিক বলেছিলি, শালা তরুণের সঙ্গে সোমার যোগাযোগ আছে। মালটাকে একটা ছুটির দিন দেখে ডাক তো ক্লাবে, একটু হাতের সুখ করি!

গৌর হাসলো,

ওটা আমার ওপর ছেড়ে দে! তুই এখন বিখ্যাত হয়ে গেছিস, এইসব ভুলভাল কাজ করলেই কেস খাবি, কালই পেপারে নাম বেরিয়ে যাবে, দেখবি!

সুমন কাঁধ ঝাঁকালো,

শালা! বিখ্যাত হবার কি জ্বালা!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩৩
মেয়ে কে সিঁড়িতে আওয়াজ করে দৌড়ে নামতে দেখে সোমার মা চিৎকার করলো,

ধিঙ্গি মেয়ে একটা, পড়ে পা ভাঙবি, তারপর বুঝবি! সব সময় এতো তাড়া কিসের তোর?

সোমা দরজার দিকে ছুটতে ছুটতে উত্তর দিলো,

শিগগির এসো, দেখো ছোড়দা বাইক কিনে এনেছে!

সোমার মা চমকে উঠলো, বাইক! তড়িঘড়ি মেয়ের পেছন পেছন বাইরে বেরিয়ে এসেই সুমন কে বাইকের ওপরে বসা দেখেই মাথাটা একদম গরম হয়ে গেলো তার। ছেলে কে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বললো,

এখনো বোনের বিয়ে বাকি আছে আর তুই মোটর সাইকেল কিনে নিয়ে চলে এলি? তোর কি কখনো কোনো কান্ডজ্ঞান হবে না রে?

সুমন মায়ের কথার কোনো উত্তর দিলো না, বাইকটা পাশের দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,

একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে বুঝলি! বাড়িটা করার সময় বাইক রাখার একটা জায়গা করে নেওয়া উচিত ছিলো।

কিছুক্ষন আগের করা ঝগড়া ভুলে গিয়ে সোমা চিৎকার করলো,

দারুন দেখতে রে বাইকটা! এই ছোড়দা, বাইক কিনলি কেনো? একটা গাড়িই তো কিনতে পারতিস, বেশ সবাই মিলে ঘুরতে যেতাম!

সুমন হাসলো,

আরে দাঁড়া! এখন এতেই ঘোরাবো তোকে! গাড়ি কিনতে দেরি আছে!

সুমনের মা বিরক্তি নিয়ে বললো,

হ্যাঁ, সেতো দেরি থাকবেই! গাড়ি কিনলেই তো আমাদের তুলতে হবে, বাইকে তো আর আমরা উঠতে পারবো না! সব বুঝি আমি! এবার আরো বেশি করে ওই মেয়েটাকে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াও!

সুমন কোনো উত্তর দিলনা, সে ঘরে ঢুকে আসতেই, তার পেছন পেছন সবাই বাড়িতে ঢুকে এলো, ইতিমধ্যেই তার দাদা এবং বাবা দুজনেই ফিরে এসেছিলো, মায়ের চিৎকারে সবাই বসার ঘরে এসে জড়ো হলো। সুমনের দাদা ভাই কে উদ্দেশ্য করে বললো,

মা তো ঠিকই বলেছে, এখনো সোমার বিয়ে হয়নি, সবে মাত্র বাড়িটা তৈরি করা শেষ হলো, এগুলো তোর মাথায় ছিলো না? বাইক কিনতে তো তোকে কেউ বারণ করেনি, এতো তাড়াহুড়োর কি ছিলো? ওই মেয়েটার পেছনে ঘুরে ঘুরে এবার তোর খেলাটারও বারোটা বাজবে!

সুমন মুখ নিচু রেখে চেয়ারে বসে জুতো খুলছিল, মায়ের পরে এবার দাদাকেও বলতে দেখে ধৈর্য্য হারালো, চিৎকার করে বললো,

মা বলছে সেই পর্যন্ত ঠিক আছে তাই বলে ভাবিস না তোর জ্ঞানের কথাও আমি শুনবো! অতো যদি সোমার জন্যে তোর দরদ ছিলো তাহলে সাত তাড়াতাড়ি নিজে বিয়ে করতে গেলি কেনো? বোনের বিয়ে দিয়ে তারপর করতে পারতিস তো? এমনকি আমার ঘাড় ভেঙে তো নিজের বিয়ের জন্যে দোতলায় ঘরও করে নিলি, তখন বোনের বিয়ের কথা মনে ছিলো না তোর? সবার সব হচ্ছে আর আমি একটা নিজের সখে বাইক কিনলেই দোষ? আর, কার পেছনে ঘুরলে আমার বারোটা বাজবে সেই নিয়ে তোকে চিন্তা করার দায়িত্ব আমি দিই নি, সেটা মাথায় রাখ!

নতুন বউয়ের সামনে ছোটো ভাইয়ের করা অপমান মেনে নেওয়া সুমনের দাদার পক্ষে অসম্ভব ছিলো, তাই মুখের গন্ডগোল এবার প্রায় হাতাহাতি তে বদলাতেই যাচ্ছিলো, এমন সময় সুমনের বাবা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে এগিয়ে এলো। বড়ো ছেলেকেই ধমকে বললো,

সব টাই তো ছোটো ভাইয়ের পয়সাতেই হচ্ছে, এবার বোনের বিয়ের জন্যে তুই কিছু দে!

সুমনের বড়দা থতমত খেলো, ভাইয়ের রোজগার শুরু হবার পর থেকেই তার স্বল্প রোজগারে হাত পড়েনি, আর এখন তো বাড়িতে বউ এসেছে। বাবার ছোঁড়া তির ঠিক জায়গাতেই লেগে ছিলো, এই কথার পরেই সে রণে ভঙ্গ দিয়ে দোতলায় উঠে গেলো, এমনকি সুমনের মাও চুপ করে গেলো, স্বামীর কথায় তার সম্বিত ফিরলো, ছেলে কে চটাতে গেলে পাছে মেয়ের বিয়েতে এক পয়সাও হাতে না আসে সে ভয় তার ছিলো।

অদ্বিতীয়া নিজের ঘরে পড়াশোনা করছিলো, ইতিমধ্যেই সুকান্তও বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন, হটাৎ করেই নিচে গাড়ির হর্নের আওয়াজ হলো। নিচের গেট খোলার আওয়াজ শুনে অদ্বিতীয়া কৌতুহলী হয়ে জানলায় এসে দাঁড়ালো, এটা তাদের গাড়ির আওয়াজ ছিলো না। একটু পরেই গাড়ির দরজা খুলে প্রতাপ সান্যালের ভাই পো রথীন এবং তাঁর স্ত্রী নেমে এলেন। অদ্বিতীয়া এনাদের চেনে, ছোটো থেকেই অনেক বার বিভিন্ন শরিকি মিলন অনুষ্ঠানে দেখেছে।

রথীন সান্যালের ছেলের যে পৈতের কথা হচ্ছে সে খবর সরযূর কাছে ছিলো। তাদের আসার উদ্দেশ্য জানা থাকায় সরযূ চিন্তিত হলেন না, নাহলে রথীন ছেলেটি কে তাঁর একটুও পছন্দ নয়। তাঁর বংশধর না থাকার সুযোগে প্রতাপ সান্যালের বনেদী বাড়ি, বংশ, রক্ত, এসব মূল্যবোধ কে ব্যবহার করে সে বেশ কিছু সম্পত্তি নিজের ছেলের নামে করতে চায়। সরযূ স্বামী কে অনেক বুঝিয়েছেন, কিন্তু কোনো কোনো ব্যাপারে স্বামী তাঁর কথা শোনেন না। ভাইপোর সম্পর্কে তাঁর মনে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে, ভবিষ্যতে ভাইপোর ছেলে কে কিছু দিয়ে যাবার ইচ্ছেও তাঁর আছে বলেই বোঝেন সরযূ! কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁর কোনো উপায় নেই! বংশধর তো আর জোগাড় করে আনতে পারবেন না তিনি! পুত্র বধূ সরলা এবং নাতনি অদ্বিতীয়া কে তাই মনে মনে তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। বাঁজা বউ আর মেয়ে হয়ে জন্মে বংশধর না হতে পারা নাতনির ওপরে তাঁর প্রবল রাগ।

বামুন ঠাকুর দরজা খুলে দেওয়ার পরে তাঁদের ওপরে উঠে আসতে দেখে সরযূ বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, মুখে অনেকটা জোর করেই হাসি টেনে এনে বললেন,

এসো বউমা! এসো এসো! কতদিন পরে বাড়িতে পা দিলে বলো দিকি! সেই পিয়ার মুখে ভাতে এসেছিলে! ছেলের পৈতে লাগলো তাই এই বুড়ো বুড়ির কথা মনে পড়লো!

রথীন এর বউ সুমনা মনে মনে একটু ক্ষুব্ধ হলো, পিয়ার মুখেভাতে সরলার অপমানের স্মৃতি ফিরে এলো তার। মুখে প্রকাশ না করে জ্যেঠ শাশুড়ি কে প্রণাম করতে করতে মৃদু হাসলো,

আসা হয়না বড়ো মা! ইচ্ছে তো করে কিন্তু উপায় নেই, আপনাদের ছেলের খুব ব্যস্ততা। কিন্তু আপনারা বয়োজ্যেষ্ঠ, আপনাদের বাদ দিয়ে তো আর নাতির পৈতে হতে পারে না, তাই প্রথমেই আপনাদের অনুমতিই নিতে এলাম।

সরযূ এসব তৈল মর্দনকারী কথাবার্তা শুনতে অভ্যস্ত, তাঁর স্বামী এসবে গলে গেলেও তিনি গলেন না। তিনি রথীন আর সুমনার পেছন পেছন ঘরে ঢুকে এলেন। প্রতাপ সান্যাল আরাম কেদারায় বসে ছিলেন কোর্ট থেকে ফিরে, রথীন এবং সুমনা তাঁকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। রথীন নিজের ছেলের পৈতের নিমন্ত্রণ পত্র তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বললেন,

জ্যেঠুবাবু! সামনের বোশেখে আমার ছেলের পৈতে, শুনেছেন নিশ্চয়ই? আপনার অনুমতি না নিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছি! বাবা, মা জীবিত নেই তাই আপনার নাম দিয়েই নিমন্ত্রণ পত্র ছাপিয়েছি! অন্যায় মনে হলে ক্ষমা করে দেবেন!

প্রতাপ সান্যাল নিমন্ত্রণ পত্র তৎক্ষণাৎ খুলে দেখলেন, পত্রের শেষ নিমন্ত্রণকারি হিসেবে নিজের নাম দেখে যারপরনাই পুলকিত হলেন। তাঁকে বংশের বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে সম্মান দিয়ে রথীনের এই কাজে ভীষন খুশি হলেন তিনি, সে খুশি গোপন না করেই উৎফুল্ল গলায় বললেন,

আহা, বেশ করেছো! আমার বংশের ছেলের পৈতে, আমার নাম থাকবে কিনা তাতে আর অনুমতির কি আছে! নিশ্চয়ই থাকবে! আমাদের সান্যাল বংশের বংশধর! ওই তো সব!

রথীন হাত জোড় করলেন, তার উকিলি বুদ্ধির সূক্ষ্ম চাল কাজে লেগেছে বুঝেই মৃদু হাসলেন,

সে ঠিক! আপনি রাগ করবেন না, সেই ভরসাতেই তো আপনার অনুমতি না নিয়েই একাজ করে ফেলেছি। আপনি আমাদের মাথার ওপরে ছাতার মতো আছেন, পৈতের দিন সকাল থেকেই আপনার উপস্থিতি চাই কিন্তু। সেদিন কিন্তু কোর্টে যাওয়া চলবে না, আগের থেকেই বলে দিলাম।

বংশ মর্যাদা, বংশ গৌরব, বংশধর, এইসব আবেগের কাছে উকিলি বুদ্ধি কাজ করে না, প্রতাপ সান্যালের মতো ঝানু উকিলও যে এতেই বশ হন, সেটা জেনেই রথীন তাঁর ছেলের নিমন্ত্রণ পত্রে জ্যেঠুর নাম ছাপিয়েছেন। প্রতাপ সান্যাল বিগলিত হলেন,

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসবো! সে তো এখনো মাস কয়েক দেরি আছে! সকাল থেকেই থাকবো অবশ্যই! নিজের হাতে পৈতে পরাবো নাতিকে! পৈতের সব কাজ আমিই করবো, তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না, তুমি নিমন্ত্রিতদের দিকটা দেখো শুধু!

সরযূ স্বামীর নির্বুদ্ধিতায় বিরক্ত হলেন, রথীন এর চাল বুঝতে তাঁর একটুও অসুবিধা হয় নি। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রতাপ সান্যাল তাঁর কোনো কথা কানে নেবেন না, তিনি ভালো করেই জানেন! ইদানিং আশা কে তাড়িয়ে দেবার জন্যে মাঝে মাঝেই বড্ড আফসোস হয় তাঁর, সে যদি আজ থাকতো, তবে শুধু স্বামী কেনো পুরো বাড়িটা তাঁরই হাতের মুঠোয় থাকতো আজ।

রথীন এবং প্রতাপ বাবুর কথোপকথনের মধ্যেই সরলা ট্রে তে মিষ্টির প্লেট সাজিয়ে বামুন ঠাকুর কে সঙ্গে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো। তাকে ঢুকতে দেখেই সান্যাল মশাই উচ্ছসিত হলেন,

দেখো বৌমা! রথীন কি কান্ড করেছে! ছেলের পৈতের কার্ডে আমার নাম ছাপিয়েছে। সে নাকি আবার এটা করতে কুণ্ঠা বোধ করছিলো, পাছে আমি বিরক্ত হই!

সরলা মিষ্টির প্লেট তুলে ভাসুর, জায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে মৃদু হাসলো,

এ তো খুব ভালো কথা, এতে কুণ্ঠার কি আছে! বাবা তো নাতিকে ভীষণ ভালোবাসেন, তার কার্ডে নিজের নাম দেখলে বাবা ভীষণ খুশিই হবেন!

মিষ্টির প্লেট হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে সুমনার আবার সেদিনের অপমানের কথা মনে পড়লো, সে এই সুযোগ ছাড়লো না, মোলায়েম গলায় বললো,

সেই তো! জ্যেঠু বাবু ছেলে ছেলে করে পাগল হন, আর ওনার ভাগ্য দেখো! নিজের দু দুটো ছেলে, তা একজন বিয়ে করলো না, আর একজনের তো ভাগ্যই খারাপ! কি আর করা যাবে, ভগবান যাকে যা দেন! তাঁর ওপরে তো আর কারো কোনো হাত নেই! না হলে দেখো, সান্যাল বংশে তো এতো বছরেও কারো কখনো মেয়ে হয়েছে বলে শুনি নি বাপু, অথচ বড়দার মেয়ে হলো! তারপরে বড়দির বিয়েরও তো কম দিন হলো না, ঠাকুর যে কবে মুখ তুলে চাইবেন কে জানে!

সরলার মুখে কালো ছায়া পড়লো, সে যথেষ্টই বুদ্ধিমতি, সুমনার অপমানের পেছনের কারণটা বুঝতে তার একটুও দেরি হলো না। রথীন চালাক চতুর, প্রসঙ্গ ঘুরে গিয়ে পাছে তাঁর পরিকল্পনার কিছু ক্ষতি হয়, তাই মৃদু ধমকে স্ত্রী কে থামিয়ে দিলেন,

আহ্! ছাড়ো ওসব! তোমার ছেলে কি জ্যেঠুর নাতি নয়!

সুমনা চুপ করে গেলো, রথীন সরলার দিকে ফিরে মৃদু হাসলেন,

রতি কই? সুকান্ত? বাড়িতে কেউ নেই নাকি! পিয়া কেও তো দেখছি না, ডাকো সবাই কে, বলে যাই একটু!

রতিকান্ত ততোক্ষনে নিজের ঘরে বোতল খুলে বসে পড়েছিলো, হাজার ডাকাডাকিতেও এলো না। তবে সুকান্ত এবং অদ্বিতীয়া এসে উপস্থিত হলো, তাদের দেখেই রথীন হাসলেন,

আয়, আয়! তোদের জন্যেই বসে আছি! সবাই ছুটি নিবি কিন্তু, সেদিন কোর্ট, কলেজ কোনো অজুহাত শুনবো না!

সুকান্ত হাসলেন,

নিশ্চয়ই! ভাই পোর পৈতে বলে কথা! কবে থেকে কব্জি ডুবিয়ে খাবো বলে বসে আছি!

আরো কিছুক্ষন গল্প করে রথীন বউ সহ বেরিয়ে যাওয়ার পরে সরযূ স্বামীর সামনে এসে দাঁড়ালেন,

শুনি বুড়ো হলে নাকি বুদ্ধি পাকে! তোমার তো দেখছি ভীমরতি ধরেছে! কার্ডে নামটুকু ছাপিয়ে দিব্যি কাজ হাসিল করে বেরিয়ে গেলো, আর উনিও অমনি নাতি নাতি করে গলে গেলেন। মরণ দশা!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩৪
কলেজের গেট থেকে বেরোতেই একটা মোটর সাইকেল একদম অদ্বিতীয়ার গা ঘেঁসে দাঁড়াল, অদ্বিতীয়া চমকে উঠে ফিরে তাকাতেই হেলমেট পরা মাথাটা একটু সামনে ঝুঁকে এলো, হাতে ধরা আর একটা হেলমেট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,

হেলমেট টা মাথায় দিয়ে চট করে বাইকের পেছনে উঠে পড়! দেরি করো না!

অদ্বিতীয়ার বুকের ভেতরটা পরিচিত গলার আওয়াজে ধড়াস করে উঠলো, সুমন! আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে জীবনে প্রথম বার কোনো ছেলের বাইকের পেছনে উঠে বসলো অদ্বিতীয়া, আশেপাশের কেউ লক্ষ্য করার আগেই সুমন গতি বাড়ালো, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের কারোর জন্যেই নিরাপদ ছিলো না একটুও। জোরে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে গড়ের মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে দাঁড় করলো সুমন, গাড়ি টা একটু দূরে রেখে দুজনে একটা গাছের ছায়ায় এসে বসলো। অদ্বিতীয়া অভিমানী গলায় বললো,

বাইক কিনে ফেললে আর আমি জানতেও পারলাম না! এটা তোমারই তো? নাকি অন্য কারো?

সুমন হাসলো,

আমারই! তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো ভেবেছিলাম তাই বলিনি! আর বলতাম কখন? তুমি তো বাড়ি এসে ঝগড়া করেই চলে গেলে!

তুমি তো ফোন করো নি! আমি না করলে করতেও না বোধহয়! এখন বিখ্যাত হয়ে গেছো তো, তাই আমাকে নিয়ে ভাবছো না আর!

সুমন মুচকি হাসলো,

বিখ্যাত হয়েছি বলে ফোন করি নি? নাহ! অতোটা বিখ্যাত নই যে তোমাকে ফোন করার সময় পাবো না। আসলে ভয়ে করিনি, করলেই তুমি ভাও খেতে, আরো বেশি করে রাগ দেখাতে। অপেক্ষা করছিলাম, জানতাম তোমার রাগ পড়লেই নিজেই ফোন করবে!

অদ্বিতীয়া অভিমানী হলো,

তার মানে, কোনোদিনও ঝগড়া হলে তুমি নিজে থেকে আমাকে ফোন করবে না? সব সময় আমাকেই এগিয়ে গিয়ে মিটমাট করতে হবে?

আচ্ছা, করবো এরপরের বার, কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে তুমি ফোন করলে ভাও খাবে না একদম! এই যে আমাকে দেখো, কাল তুমি সোমার কাছে আমাকে ফোন করার জন্যে বলেছিলে, আর আমি একদম তোমার সঙ্গে দেখা করতে চলে এলাম! তোমার সঙ্গে আমার কথাও হয়নি একবারও, এমনকি তুমি তোমার চিৎকারের জন্যে সরিও বলোনি কিন্তু! তাও তুমি ফোন করতেই আমি চলে এলাম! তোমাকেও এরকম হতে হবে, তবেই আমি তোমাকে ফোন করে রাগ ভাঙাবো।

সুমনের কথায় অদ্বিতীয়া কপট রাগ দেখালো,

তার মানে কি? তুমি অদ্ভুত তো! বললে না তো যে আর কোনোদিনও ঝগড়াই করবো না! উল্টে ঝগড়া হলে কি করতে হবে সেটা বলছো! প্রমিস করো, আর কোনোদিনও ঝগড়া হবে না আমাদের!

সুমন মুচকি হাসলো,

যাহ শালা! ঝগড়া হবে না এটা কি করে প্রমিস করবো? তাই আবার হয় নাকি! সেটা গ্যারেন্টি দিতে পারছি না!

সুমনের কথার ভঙ্গিতে অদ্বিতীয়া হেসে ফেললো,

আবার শালা! তুমি যে কি করে আমাদের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলবে কে জানে! দাদুভাই তোমার এই শালা শুনলে অজ্ঞানই হয়ে যাবেন।

ধুর! কে তোমার দাদু কে পটাতে যাবে? ওই বুড়ো পটবে না আমি জানি! আমি ওসব ভুলভাল কাজে নেই।

অদ্বিতীয়া বিরক্ত হলো,

তোমাকে আর কতো বার বলতে হবে যে দাদুভাই কে বুড়ো বলবে না? দাদুভাই কে না পটিয়ে তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারবে ভেবেছো?

সুমন কানে হাত দিলো,

সরি! আর বলবো না! আচ্ছা একটা কথা বলো তো? তোমরা কি বাড়িতে সাধু ভাষায় কথা বলো? মানে বুড়ো কে বুড়ো না বলে ঠিক কি বলো জানতে ইচ্ছে করছে!

অদ্বিতীয়া হেসে ফেলে ঘুষি মারার ভঙ্গিতে হাত মুঠো করলো,

খালি বাজে কথা! যেটা নিয়ে কথা হচ্ছে সেটার উত্তর দাও!

সুমন মুখে গম্ভীর ভাব আনার চেষ্টা করলো,

হ্যাঁ, ঠিক করেছি, ওনাকে পটিয়ে আমি সময় নষ্ট করবো না। যতই চেষ্টা করিনা কেনো তোমার দাদু যে বনেদি ছাড়া পটবে না এটুকু আমি বুঝে গেছি। আমি অন্য কিছু ঠিক করেছি, ওই জন্যেই বাইক কিনেছি বুঝলে?

অদ্বিতীয়া অবাক হলো,

কি জন্যে বাইক কিনেছো?

সুমন মুচকি হাসলো,

তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবো বলে! দেখি প্রতাপ সান্যাল কি করে! দম দেখি লোকটার! দ্যাখো, এবার বুড়ো বলিনি কিন্তু, লোক বলেছি!

অদ্বিতীয়া হেসে ফেললো,

প্রতাপ সান্যালের দম দেখতে চাও! সে চেষ্টাও করো না! মাটিতে ঢুকে থাকলেও গর্ত খুঁড়ে বার করে নিয়ে আসবে, চেনো না তুমি আমার দাদু কে। ছাড়ো ওসব, বলো বাড়িতে সবাই তোমার নতুন বাইক দেখে কি বললো?

সুমন কাঁধ ঝাঁকালো,

কি আর বলবে! ওই সোমা বলছিলো বাইকের বদলে গাড়ি কিনলে ভালো হতো! তাহলে সবাই চড়তে পেতো। আমি ওকে আপাতত এতেই চড়াবো একদিন বলেছি! মাও একই কথা বলছিলো, এই আর কি!

গাড়ি কিনতেই পারতে তাহলে, সত্যি সবাই চড়তে পারতো,

সুমন হাসলো,

আমার টাকার গাছ আছে নাকি তোমার দাদুর মতো? দেখি যদি নতুন ক্লাবে সই করি তাহলে হয়ত আরো অনেকটা বেশি পাবো, তখন বছর কয়েক পরে নাহয় গাড়ির কথাও ভাবা যাবে।

তোমাকে একটা কথা বলবো রাগ করবে না তো? অনেকদিন ধরেই বলতে চাইছিলাম, কিন্তু বলে উঠতে পারছিলাম না কিছুতেই,

সুমন অবাক হলো,

কি এমন কথা, যা বলতে চেয়েও পারছো না? এই আবার ছেড়ে টেড়ে দেবার কথা বলবে না তো? তাহলে কিন্তু ফাটাফাটি হয়ে যাবে, আগে থেকেই বলে দিলাম,

অদ্বিতীয়া হেসে ফেললো,

তুমি বড্ড কথা বলো! ছেড়ে দেওয়ার হলে নিজে তোমাকে ফোন করতাম নাকি! আমি অন্য কথা বলছি, প্লিজ শোনো। সেদিন দাদুভাই বলছিলো মনোজ দাদুর কাছে শুনেছে তুমি নাকি ওনাদের ক্লাবে সই করছো? ওটা না করে যদি আমাদের ক্লাবে থেকে যাও তাহলে দাদুভাই খুশি হবেন, আর ভবিষ্যতে এটা আমাদের খুব কাজে লাগবে।

সুমন অবাক হলো,

মানে? আমি অন্য ক্লাবে না গেলে উনি খুশি হবেন এটা বুঝলাম, কিন্তু এতে আমাদের ভবিষ্যতে কি লাভ হবে সেটা বুঝলাম না!

অদ্বিতীয়া সুমনের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় ধরলো,

দাদুভাই ক্লাব কে ভালোবাসা, বিশ্বাস এগুলোতে খুব ভরসা রাখেন, উনি যখন জানবেন শুধু ক্লাব কে ভালবেসে, ক্লাবের সমর্থকদের বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে অনেক বেশি টাকার অফার ফিরিয়ে এখানে থেকে গেছো, সেটা ওনার কাছে তোমার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াবে, বুঝলে কিছু? এমন একটা দিন তো আসবেই সুমন, যেদিন তোমাকে দাদুভাই এর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। সেদিন যেনো তোমার বনেদি বাড়ির ছেলে না হওয়া বাদে আর কোনো কিছু দোষ না থাকে, এটা দাদুভাই এর সেই আস্থা অর্জনের একটা পদক্ষেপও বলতে পারো। এটা আমার রিকোয়েস্ট, প্লিজ থেকে যাও আমাদের ক্লাবে, জানি তোমার ক্ষতি হবে অনেকটা কিন্তু আমার ভালো লাগবে খুব। আর একটা কথা কি জানো, খেলা দেখতে বসে তোমাকে বিরোধী দলে খেলতে দেখতে আমারও একটুও ভালো লাগবে না!

সুমনও অদ্বিতীয়ার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরলো,

জীবনে টাকাটাই সব নয় বুঝেছো? এটা ঠিক আমার টাকার দরকার আছে, সোমার বিয়েটা বাকি আছে এখনো, কিন্তু কোনো কোনো সময় অন্য কারো ইচ্ছেটাও মেনে নিতে ভালো লাগে। তুমি রিকোয়েস্ট করেছো, এটাই আমার কাছে সব, আগে তো সেভাবে বলোনি কখনো, তাহলে অনেক আগেই না বলে দিতাম ওদের। এই ক্লাবেই খেলবো, অন্য কোথাও সই করবো না কখনো, কথা দিলাম তোমাকে!

অদ্বিতীয়ার গলা আবেগে বুজে এলো,

তুমি সত্যি অন্য ক্লাবে সই করবে না! শুধু আমি চাই না বলে? এতোটা ভালোবাসো আমাকে! নিজের জন্যে অনেক বড়ো কিছু চেয়ে ফেললাম তাই না? এই টাকায় সোমার বিয়ে হবে না কিছুতেই?

সুমন অদ্বিতীয়ার চোখের দিকে তাকালো,

ওটা নিয়ে ভেবো না, একটু সময় লাগবে কিন্তু জোগাড় হয়ে যাবে, আসলে মাত্র কদিন আগেই বাড়িটা দোতলা করলাম তো! আর কালই সোমার সঙ্গে ফাটাফাটি হয়ে গেলো, ওর নাকি আমার টাকার দরকার নেই। কতো উল্টোপাল্টা কথা শুনিয়ে দিলো আমাকে।

কেনো? কি হলো এইটুকু সময়ের মধ্যে? কালই তো ওর সঙ্গে কথা হলো, তোমার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বললো না তো কিছু? আবার ভাব হয়ে গেছে নাকি?

একটু অবাক গলায় প্রশ্ন করলো অদ্বিতীয়া, সুমন বিরক্ত হলো,

ধুর! ছাড়ো তো ওর কথা! গৌর সেদিন বলছিলো সোমা নাকি আবার তরুণের সঙ্গে দেখা করছে, ও তরুণ কে সোমার কলেজের সামনে দেখেছে! সেই কথা বলতে গেলাম, তা তার উল্টো রাগ, আমার পয়সা নাকি নেবে না কখনো আর! আমিও দেখবো কি করে চলে ওর এখন! দাদা তো বিয়ের পর থেকে এক পয়সাও বার করে না, মা তো আগে থেকেই ওর হাতে পয়সা দিতো না, যা দিতাম আমিই। এবার ও কি করে দেখা যাক!

অদ্বিতীয়া মনে মনে প্রমাদ গুনলো, সোমা যে মাঝে মধ্যেই ওর কাছ থেকে টাকা পয়সা নেয় বা ওকে দিয়ে বাড়িতে মিথ্যে বলে তরুণের সঙ্গে দেখা করে এগুলো ও সুমন কে কখনো বলেনি আজ পর্যন্ত। পাছে সোমা রাগ করে আর তাতে ওর সঙ্গে সুমনের সম্পর্কে কোনো জটিলতা তৈরি হয় তাই এই বিষয়গুলো কে এতকাল সুমনের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেই এসেছে। সুমন টুকটাক টাকা পয়সা বোন কে দিতো, তাই অদ্বিতীয়াও যে সোমা কে লুকিয়ে টাকা দেয় সে খবর এতকাল প্রকাশ্যে আসেনি, এখন সুমন পয়সা দেওয়া বন্ধ করে দিলে সোমা কি করে সেটা কে ম্যানেজ করে চালাবে, অদ্বিতীয়ার দেওয়া টাকাকে সুমনের দেওয়া বলবে এটাই অদ্বিতীয়া বুঝে উঠতে পারছিলো না। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমন অবাক হলো,

তোমার আবার কি হলো? আরে, সোমার বিয়ের ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে, তুমি চাপ নিও না! তোমাকে ওসব নিয়ে মন খারাপ করতে হবে না, তুমি বরং কাজের কাজটা করো।

অদ্বিতীয়া অন্য মনস্ক গলায় বললো,

নাহ! আমি কিছু ভাবছি না! তুমি কি কাজের কাজ এর কথা বললে?

সুমন মুচকি হেসে বলল,

আজই বুড়োটাকে, সরি মাননীয় প্রতাপ সান্যাল মহাশয় কে এটা টুক করে একটু জানিয়ে দাও তো যে আমি তাঁর পেয়ারের ক্লাবেই থাকছি।

অদ্বিতীয়া হেসে ফেললো,

মাননীয় সান্যাল মহাশয় ইহা শুনিয়া অত্যন্ত উৎফুল্ল হইবেন!

সুমন চমকে ওঠার ভান করে অদ্বিতীয়ার পায়ের দিকে হাত বাড়ালো, মুচকি হেসে বললো,

কি বললে? উৎফুল্ল হইবেন? বাপরে! দেখি একটু পা টা, তোমার একটু লেগ ডাস্ট দাও গুরু! এই বাংলায় তোমাদের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের পরে কথা বলতে হবে নাকি?

অদ্বিতীয়া হাসতে হাসতে হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গি করলো,

সাধু ভাষায় পারদর্শী হও বৎস!

আশা দুদিন ধরেই অপেক্ষা করেছিলো, আজ দরজায় টোকা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিচু গলায় ভেতর থেকেই জিজ্ঞেস করলো,

কে?

রতনের চাপা গলায় দেওয়া উত্তর শুনেই দরজাটা খুলে ধরলো আশা, রতন চটপট ভেতরে ঢুকে এলো।

সেই মল খসালি তবু লোক হাসালি! কবে থেকে বলছি তোকে চল দুজনেই বাঁচি, তা কথা কানে নিলে তো! গরীবের কথা বাসী হলে মিষ্টি হয়! নিজে খবর নিয়ে এসে এটুকু বুঝেছিস নিশ্চয়ই যে বাঁচতে গেলে হাতে হাত মেলাতে হবে আমাদের!

আশা সরাসরি রতনের চোখের দিকে তাকালো,

এটুকু বুঝি দাদাবাবু যে আপনি আমার সব কথা জানলেও আমি কিছুই জানিনা। কেনো আপনি আপনার আদরের পিসির শত্তুর হলেন সেটা আগে আমাকে জানতে হবে। নাহলে যে আর এগোতে পারবুনে দাদাবাবু!

রতন একটু থমকালো, চাপা অথচ কড়া গলায় বললো,

এটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না আশা? তুই কি আমাকে তোর সমগোত্রীয় ভাবলি নাকি! এই জন্যেই বলে লোককে লাই দিতে নেই, সুযোগ পেলেই মাথায় চড়ে বসে! করতিস তো বাড়ি বাড়ি আলতা পরানোর কাজ, এতো গুমোর কিসের তোর?

আশা মাথা নাড়লো,

সে যাই বলুন দাদাবাবু, সান্যালদের নুন আমিও খেয়েছি, আপনিও খেয়েছেন, এখন দুজনেই আতান্তরে পড়েছি, তো কি যেনো বললেন, সম কি একটা ঐটাই তো দুজনেই হলাম নাকি? আমি আমার কথা বললাম, আপনি আপনার কথা বলবেন না সেটি হয়না দাদাবাবু!

আশার জেদ দেখে রতন বুঝলো আশা কে না বলে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। সে খানিকটা কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করলো, পিসি তাকে বাপের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে, এরকম একটা যুক্তিসঙ্গত তথ্য পাওয়ার পরে আশা তার সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি হলো।

কি করতে চান দাদাবাবু?

রতন গলা নিচু করলো,

পুলিশের কাছে গিয়ে খুব বেশি লাভ হবে না বুঝেছিস আশা, আমি তাই অন্য কথা ভেবেছি। খবরের কাগজের একজন লোক আমার চেনা শোনা আছে সে এইসব কথাগুলো ছাপিয়ে দেবে! তোকে সামনে আসতে হবে না, যা করার সবটাই লুকিয়ে করবো। প্রতাপ সান্যাল এই খবর দেখলেই সেই কাগজের নামে মানহানির মামলা করবে তখন তুই সরাসরি কোর্টে আসবি। একবার সবাই এসব জেনে গেলে সাক্ষীকে মারার সাহস প্রতাপ সান্যাল করে উঠতে পারবে না আর!

মানহানির মামলা? সেটা কি জিনিষ দাদাবাবু?

আশা অবাক হলো, রতন হাসলো,

কারোর সম্মানে লাগলে সে এই মামলা করে, তুই ওসব বুঝবি না! বোঝার দরকারও নেই! তোকে যেভাবে বলছি সেই ভাবে কর, কোনো অসুবিধা হবে না। তবে এখানেই বসে থাকবি, আমি না বলা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে পা দিবি না। যা যা তোর লাগবে আমি সপ্তাহে একদিন করে এসে দিয়ে যাবো তোকে, বুঝলি তো?

আশা ঘাড় কাত করলো, বুঝেছে!
ক্রমশ