সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
195

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪৪
গত রাতে রথীন কে ফোনে অপমানজনক কথা বলার জন্যে প্রতাপ সান্যাল ছোটো ছেলের ওপরে ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলেন। সুকান্ত অসহায় বোধ করছিলেন, তাঁর কাছে কোনো প্রমাণ না থাকার জন্যে তিনি বাবার মুখোমুখি হতে পারছিলেন না। খানিকটা বাধ্য হয়ে শেষ চেষ্টায় তিনি সকালে উঠেই দাদার ঘরে টোকা মারলেন। সরলা ঘুম থেকে উঠে গিয়েছিলো, টোকার আওয়াজে দরজা খুলে দেওর কে দেখে অবাক হলো,

ছোড়দা! এতো ভোরে! আসুন, আসুন!

সুকান্ত ঘরে ঢুকে এলেন, তখনও বিছানায় শুয়ে থাকা রতিকান্তের দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বললেন,

কাল রাতেই আসতে চেয়েছিলাম! জানতাম তুই কথা বলার মতো জায়গায় থাকবি না, তাই সকাল পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরতে হলো! আমার তোর মেয়ের ওপরে আইনত কোনো অধিকার নেই, তাই বাধ্য হয়েই তোর কাছে এলাম! ছেলেটা ভালো নয় দাদা, তুই বাবাকে বল, এই বিয়েতে তোর মত নেই!

রতিকান্ত তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকালো,

আমি তো একটা মাতাল! মাতালের মেয়ের আবার ভালো ছেলে! ওই যে পাওয়া যাচ্ছে ওই যথেষ্ট! তুই নিজের চরকায় তেল দে! ওসব ব্যাপারে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না!

সুকান্ত হতাশ ভঙ্গিতে দাদার দিকে তাকালেন, সরলার মুখ ঘেন্নায় বিকৃত হলো, সুকান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,

আপনিই কিছু করুন ছোড়দা! আপনিই ওর আসল বাবা! পিয়া আপনাকে বলতে দেয়নি, ছেলেটা ওর পড়াশোনা বন্ধ করতে চাইছে! আপনি এলেন তাই, নাহলে আমিই আপনার কাছে যেতাম! যে করেই হোক এই বিয়ে আপনি বন্ধ করুন!

সুকান্ত হাত মুঠো করলেন, দাদার দিকে তাকিয়ে বললেন,

তাহলে তুই কিছু করবি না তাই তো? অন্য সময় তো বাবার ইচ্ছের উল্টো পথে চলিস! আজ এই সুযোগে কিছু কর! এবার তোর উল্টো পথে চলাকে আমরা সবাই সমর্থন করবো!

রতিকান্ত মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়লো,

ধুস! প্রতাপ সান্যাল কে টাইট দিতে রতিকান্ত সান্যালের কারো সমর্থন লাগে না! তবে আমি যা করি নিজের জন্যেই করি, অন্য কারোর জন্যে আমি লড়তে যাবো কেনো! মেয়ে তো তোর! ছোটো থেকেই সবাই সেটা জানে! যা করার তুই কর! এখন দরকারের সময় আমার মেয়ে বলে ঘাড়ে ঠেলে দিলেই হবে নাকি! তবে হ্যাঁ! ওই যে আরেকজন বসে আছে! সেও মেয়ে মেয়ে বলে তড়পায়, ওটাকেও সঙ্গে নিতে পারিস দরকার হলে!

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সরলার দিকে ইঙ্গিত করলো রতিকান্ত। সুকান্ত কিছুক্ষন দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, পেছন পেছন সরলা, বেরিয়ে এসে সরলা দেওরের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললো,

আমার আপনাকে আরো কিছু বলার ছিলো ছোড়দা! ওই সুমন নামের ছেলেটি, সোমার দাদা, পিয়া ওকে ভালোবাসে! কিন্তু সোমার ঘটনার পর জেদ দেখিয়ে, অভিমান করে এই বিয়েতে মত দিয়ে দিয়েছে! ছেলেটা খুব ভালো ছোড়দা, আমি কথা বলেছি নিজে, আপনি একবার কথা বলে দেখতে পারেন!

সুকান্ত অবাক হয়ে বৌদির মুখের দিকে তাকালেন,

আপনি জানতেন! আমাকে আগে বলেন নি কেনো? ওতো বলছিলো ওর কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ নেই! আগে জানলে তো আমি আর বাবাকে এগোতেই দিতাম না!

সরলা মাথা নাড়ল,

আমি আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওই রাজি হচ্ছিলো না! কিন্তু আর চুপ করে থাকার সময় নেই এখন, ওসব রাগ অভিমান ওরা পরে মিটিয়ে নেবে!

সুকান্ত আশ্বাসের ভঙ্গিতে বৌদির দিকে হাত তুললেন,

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি পিয়ার সঙ্গে আবার কথা বলছি!

বাবার ঘরের পাশ দিয়ে যখন তিনি বেরিয়ে আসছেন তখন সরযূ তাঁকে ডাকলেন,

সুকান্ত! এট্টু এদিকে শোন বাবা!

মায়ের গলা শুনে সুকান্ত থমকে দাঁড়ালেন, সরযূ তাঁর পাশে এসে গলা নামিয়ে বললেন,

তোর বাবাকে আমি একটুও বিশ্বাস করিনা! রথীনটা মহা শয়তান! ওরা জ্যেঠু ভাইপো তলে তলে হাত মিলিয়ে ঠিক ওই সম্পত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছে! এদিকটা একটু দ্যাখ বাবা, তোরা বড়ো হয়েছিস এখন, রতির তো ওই অবস্থা! তোকে ছাড়া আর কাকেই বা বলি! সব দিয়ে ফেললে যে আমাদের শেষ পর্যন্ত বাটি হাতে ভিক্ষা করতে হবে বাবা!

সুকান্ত বিরক্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালেন,

মেয়েটার যে ওই ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে জীবনটা শেষ হয়ে যাবে, সেটা নিয়ে তোমার কোনো মাথাব্যথা নেই! তুমি তোমার সম্পত্তি নিয়ে ভাবছো! বিয়ে আমি বন্ধ করবোই, তবে তোমার সম্পত্তির জন্যে নয়, পিয়ার ভালোর জন্যে!

সরযূ তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লেন,

হ্যাঁ, তাই কর তাহলে! ওর ভালোর জন্যেও তো সেটাই করা উচিত! রথীন আবার কাল রাতে কি জন্যে ফোন করেছিলো কে জানে! কিসব ফুসফুস, গুজগুজ হলো দেখলাম ভাইপোর সঙ্গে! আগে তোর বাবা এরকম ছিলো না, সব আমাকে জানিয়ে করতো! এখন কিছুই মুখ ফুটে বলে না আর!

সুকান্ত আর সরযূর কথার মধ্যেই প্রতাপ সান্যাল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন,

মায়ে পোয়ে কি কথা হচ্ছে? সুকান্ত! তোমার মুখ এখনো গম্ভীর কেনো? তুমি কি ভাবছো আমি তোমার ভাইঝির ক্ষতি করতে চাইছি? একটা কথা সব সময় মনে রেখো, নিজের রক্তের ক্ষতি প্রতাপ সান্যাল কখনো করে না! শুভ ছেলেটি বনেদি, ভালো, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, প্রতিষ্ঠিত, সরকারি চাকরি করে! দিদিভাই এর জন্যে এর থেকে ভালো ছেলে তুমি পাবে কোথায়?

সুকান্ত বিদ্রুপের হাসি হাসলেন,

ব্যাস! এইগুলোই একটা ভালো ছেলে হবার যোগ্যতা? সে কেমন, তার চরিত্র কেমন, মনের দিক থেকে সে কতোটা আধুনিক, সেগুলোর খোঁজ নেওয়ার কোনো দরকার নেই বলছো? তুমি জানো ছেলেটি কিরকম চরিত্রের? জানো সে পিয়া কে প্রায় ঘুরিয়ে পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছে?

সান্যাল মশাই হাত তুললেন,

সে মেয়েদের বিয়ের পরে পড়াশোনায় আমারও মত নেই! বিয়ে দেওয়ার জন্যেই তো তাকে যোগ্য করে তোলা, সেটুকু যখন হয়েই গেছে তখন আর পড়াশোনা করে লাভ কি?

সুকান্ত অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন,

বিয়ের জন্যে পড়াশোনা! তুমি কোন যুগে বাস করছো! এখন সবাই পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্যে, ভালো পাত্র পাওয়ার জন্যে নয়!

প্রতাপ সান্যাল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন,

তুমি কি পাগল হলে! সান্যাল বাড়ির মেয়ে চাকরি করবে! ছি ছি! ও কি খেতে পায়না? ওর চাকরির প্রয়োজন কি? এখন যে কিছু কিছু মেয়ে চাকরি বাকরি করছে সেটা আমিও দেখেছি, তবে তারা পয়সার জন্যে করে! সংসার চালানোর জন্যে করে! দিদিভাই এর কি টাকার অভাব? আমার সম্পত্তির কথা ছেড়েই দাও, সে তার স্বামীর রোজগারেই পায়ের ওপরে পা তুলে বসে বসে খাবে সারাজীবন!

সুকান্ত মুখ বিকৃত করলেন,

আর চরিত্র! সেতো শুনলাম রথীনদার কল্যাণে রেপ কেস থেকে মুক্তি পেয়েছিল! সেটাও কি পয়সার জোরে ঢাকা পড়ে থাকবে নাকি?

মুখ দিয়ে বিরক্তিসুচক আওয়াজ করলেন প্রতাপ সান্যাল,

কে বলে এসব তোমাকে? নিয়ে এসো দেখি আমার কাছে, প্রমাণ দেখি একটু! তুমি বোঝোনা সুকান্ত, দুনিয়াটা খুব জটিল! প্রতাপ সান্যালের নাতনির বিয়ে ভাঙানোর জন্যে আমার শত্রুরা হাত বাড়িয়ে আছে সব সময়! তুমি তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছ! তুমি নিজে উকিল হয়ে প্রমাণ ছাড়া কথাকে বিশ্বাস করলে কিছু করার থাকে না আর! আমি তোমাকে বলছি, এসব শুধু একটা ভালো ছেলেকে ভাঙিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়! যদি তোমার কাছে একটা প্রমাণও থাকে, তাহলে আমাকে দাও! আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই বিয়ে ভেঙে দেবো!

বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলেজে যাওয়ার রাস্তার বদলে সুকান্ত যখন গাড়ি অন্য রাস্তায় ঢুকিয়ে দিলেন তখন অদ্বিতীয়া অবাক হয়ে তাকালো,

ছোট কা! কোথায় যাচ্ছো? এদিকে তো আমার কলেজ নয়!

সুকান্ত হাসলেন,

কি করবি আর কলেজ গিয়ে? বৌদির মুখে শুনলাম, তুই তো পড়াশোনা বন্ধ করে শুভর সঙ্গে ধানবাদ চলে যাবি বিয়ের পরে, তাহলে আর কদিনের জন্য মিছিমিছি কষ্ট করে লাভ কি!

অদ্বিতীয়ার মুখ ম্লান হলো,

আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম ছোট কা! কিন্তু জানতাম তাতে বাড়িতে অশান্তি বাড়বে আরো, তাই আর বলিনি! আর শুভ আমাকে বলেছে কয়েক বছর পরে কলকাতায় ফিরলে আমি পড়তে পারবো হয়ত আবার!

সুকান্ত গম্ভীর মুখে তাকালেন,

আর কি কি তুই বলতে চেয়েছিস অথচ পারিস নি! আজ সেগুলোই শুনতে চাই! আজ আমরা কলেজ বা কোর্ট কোথাও যাবো না, কোথাও বসে তোর না বলা কথাগুলো শুনবো বলে এসেছি!

বোস এখানে! তোর সঙ্গে আজ অনেক কথা আছে!

শহর থেকে বেশ অনেকটা দূরে গঙ্গার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ভাইঝি কে নিয়ে বসে পড়লেন সুকান্ত।

সুমন তোকে বলেছিলো, শুভ ভালো ছেলে নয়? আমাকে জানাস নি কেনো? নিজের ক্ষতি তো পাগলেও বোঝে! তুই সব জেনেও চুপ করে আছিস কেনো?

অদ্বিতীয়া মুখ নিচু করে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে উত্তর দিলো,

ওসব ভুল কথা ছোট কা! ওর কথায় তুমি বিশ্বাস কোরো না!

আমার তো ছেলেটির কথা বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো! তোর কেনো হচ্ছে না? আমি খবর নিয়ে দেখেছি ছেলেটি মিথ্যে বলছে না!

অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,

আমি বিশ্বাস করি না ওকে!

সুকান্ত বিদ্রুপের হাসি হাসলেন,

তাই! যাকে বিশ্বাস করিস না, তারই সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করতে জলখাবারে গিয়েছিলিস? তারই বাইকের পেছনে বসে গোটা কলকাতা ঘুরে বেড়িয়েছিস এতদিন?

আচমকা অদ্বিতীয়ার গলা কান্নায় বুজে এলো,

তখন করতাম! এখন করি না! বিশ্বাস করার মতো কোনো কাজ কি করেছে ও? আমি কোনোদিনও ভাবিনি ও আমার নামে পুলিশে অভিযোগ জানাতে পারে! আমি ভুল করেছিলাম ওকে বিশ্বাস করে! আমি ওর সঙ্গে দেখা করেছি সেই কথাটাও ও ফোনে চিৎকার করে বলেছে! একবারও ভাবেনি দাদুভাই জানতে পারলে আমি কতটা বিপদে পড়তে পারি!

আর সেই রাগে তুই তোর জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছিস!

নরম গলায় বললেন সুকান্ত, অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,

নাহ! আমি জানি দাদুভাই আমার ভালোই চান সব সময়! তিনি জেনেশুনে এরকম কিছু করবেন না ছোট কা! তুমি আর ছোটো মা দুজনেই ভুল ভাবছো!

আমি জানিনা তোদের মধ্যে কি সমস্যা হয়েছে, তবে ওর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে ও সত্যি তোর ভালো চাইছে! ওর দিক থেকেও কিছু বলার আছে বোধহয়! আমি শুনলাম ও বাড়িতে থাকে না এখন, কোথাও নাকি ভাড়া থাকে! তুই কি জানিস শুধু তোর কথা ভেবে ও বাড়ির লোকেদের সঙ্গে অশান্তি করে আলাদা থাকে? তোর জন্যেই ও নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে? ও আমাকে জানিয়েছে ও তোকে থানায় নিয়ে যেতে চায়নি, ওগুলো সব ওর বাড়ির লোকেদের করা, ও ক্ষমাও চেয়েছে আমার কাছে!

অদ্বিতীয়া চমকে তাকালো,

তুমি কি করে জানলে?

ও এসেছিলো আমার কাছে! তবে বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে কিছু বলেনি! ওটা আমি অন্য জায়গায় শুনেছি! ও সত্যিই বোধহয় তোকে ভালোবাসে! তোর যাতে ক্ষতি না হয় তার চেষ্টা করছে! এখনো সময় আছে পিয়া, তুই একবার শুধু হ্যাঁ বল, এই বিয়ে আমি কিছুতেই হতে দেবো না! আমার মনে হয় তোর একবার সুমনের সঙ্গে বসে কথা বলা উচিত!

অদ্বিতীয়ার ভেতরে তোলপাড় হতে লাগলো হটাৎ, ও কি সুবর্ন সুযোগ হেলায় হারিয়ে ফেলছে! ও তো নিজের মনেই জানে সুমনের ওপর অভিমানেই ও এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে! ছোট কা যখন নিজে ওকে সেই সুযোগ এনে দিচ্ছে সেটা কি ওর হারিয়ে ফেলা উচিত। তাছাড়া সুমন ওর জন্যেই বাড়ি ছেড়েছে এটা জানার পরেও কি ওর আর জেদ ধরে রাখা উচিত! সুমন তো ওর কাছেও ক্ষমা চেয়েছে সেদিন! ভাইঝি কে অন্য মনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুকান্ত নরম হলেন, ভাইঝির হাত ধরে বললেন,

ছোটো থেকে কখনো তোর খারাপ চাই নি! মেয়ের মতো নয় তোকে মেয়ে বলেই ভেবেছি সব সময়! তুই যে কথাগুলো বলতে পারিস না মুখে, সেগুলো আমি বুঝতে পারি! তোর এই বিয়েতে একটুও মত নেই আমি জানি! তোর চোখে মুখে কোথাও এক ফোঁটাও আনন্দের ছাপ নেই! সুমন ভালো ছেলে, ওর সঙ্গে তুই ভালো থাকবি, এটা আমার বিশ্বাস! ওকে ডেকে পাঠাই?

অদ্বিতীয়া মাথা নিচু করে ফেললো,

আমি ওর মুখোমুখি হতে পারবো না ছোট কা! আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে!

সুকান্ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, তাঁর কাছে শুভর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছিলো না ঠিকই কিন্তু তিনি মনে মনেই জানতেন এতো জনের বলা কথা মিথ্যে নয়! এই বিয়ে রুখতে গেলে তাঁর একটাই উপায় ছিলো ভাইঝি কে রাজি করানো, তার জন্যেই তিনি বাড়িতে কথা না বলে তাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। ভাইঝির দিকে তাকিয়ে তিনি খুশির হাসি হাসলেন,

ঠিক আছে! আমি ওর সঙ্গে কথা বলে নেবো! তোকে সামনে আসতে হবে না! একদম না হয় বিয়ের রাতেই দেখা করবি! শুধু একটা কথা, দাদু যখন তোকে ডাকবে, তুই নিজের মুখে সুমনকে বিয়ে করতে চাওয়ার কথা বলবি, আমি, বৌদি তোর সঙ্গেই আছি, একদম ভয় পাবি না!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪৫
সময়ের হিসেব কষে একটু বেলার দিকেই শুভঙ্কর কে ফোন করলেন রথীন সান্যাল, কাগজের দপ্তর থেকে ফিরতে প্রতিদিনই শুভঙ্করের রাত হয় তিনি জানতেন।

গুড মর্নিং!

শুভঙ্করের গলা শুনেই নিজের গলাটা একটু নামিয়ে নিয়ে প্রতি শুভেচ্ছা জানালেন রথীন সান্যাল, তারপর বললেন,

আজ বিকেলের মিটিং টা কনফার্ম তো? তোর ছেলেটা ওই মহিলা কে নিয়ে আসবে তো?

শুভঙ্কর হাসলেন,

অতো চিন্তা করিস না! আমি সামলে নেবো সব! ওসব অশিক্ষিত মেয়ে, একটু বেশি করে ধমকে দিতে হবে শুধু, যেনো ভবিষ্যতে মুখ না খোলে!

রথীন সান্যাল এদিক ওদিক তাকিয়ে রিসিভারের কাছে মুখ নিয়ে এলেন,

অতো সোজা হবে না বন্ধু! ওসব পোড় খাওয়া মেয়ে, রতন যথেষ্ট আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে, আমি জানি! ধমকে চমকে লাভ নেই, আমি যা বলছি সেটা কর! মেয়েটা কে উঠিয়ে নে, আমি আমার চেম্বারে থাকবো তখন! তুই শুধু চেম্বারে পৌঁছে দিয়ে যা, বাকিটা আমি বুঝে নিচ্ছি!

শুভঙ্কর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শঙ্কিত গলায় বললেন,

কি করবি? সরিয়ে দিবি নাকি একদম?

রথীন হাসলেন,

আরে, না, না! ও তো তুরুপের তাস! সরিয়ে দিলে ক্ষতি! বরং যাতে অন্য কেউ সরাতে না পারে, তারই চেষ্টা করবো! চারিদিকে শত্রু তো কম নেই, কখন, কোথায় কি বেফাঁস বলে ফেলে মুখ ফস্কে, তার ঠিক আছে কিছু? তাই একটু আলাদা করে সরিয়ে রাখা আর কি!

শুভঙ্কর মুচকি হাসলেন,

শালা! তুমি বহুত ধড়িবাজ গুরু! জ্যেঠু কে মাত দিতে চাইছো! বদলে কি চাই? মাল তো তোমার জ্যেঠুর কম নেই জানি!

রথীন সশব্দে হেসে উঠলেন,

আহা! এসব কি ভাষা! ভাষা সংযত করো! ওসব মাত ফাত কিছু নয় ভাই, নিজের দিকটাও একটু দেখতে চাইছি! সামনে বিয়ে আছে নাতনির, অর্ধেক সম্পত্তি দেওয়ার কথা আছে আমার ভায়রা ভাই কে, যদি পরে সম্পত্তি দেওয়া নিয়ে কিছু বেগড়বাই করে সেই ভয়ে আর কি! আর তাছাড়া সান্যাল বাড়ির সম্পত্তির বিষয়টাও তো দেখতে হবে, এখন বুঝে না নিলে তো বাকি অর্ধেক ওই ছোটো ছেলের অনাথ আশ্রমে যাবে! সেটা কি করে হতে দেওয়া যায় তুই বল! সব দিক বিচার করে দেখতে গেলে অন্যাহ্য তো কিছু চাইছি না, সান্যালদের সম্পত্তিতে আমার ছেলের হকই সবচেয়ে বেশি! নিজের হকের কথা বলতে গেলে যদি অন্যজন না শোনে তাহলে তো শোনানোর জন্যে ব্যবস্থা করতেই হয়!

শুভঙ্কর হাসলেন, রিসিভার নামিয়ে রাখার আগে বললেন,

দেখিস! যা করবি সাবধানে!

ক্লাব থেকে বেরিয়ে এসেই সুমন গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুকান্ত কে দেখতে পেলো, দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে সে গাড়ির সামনে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে কাউকে খুঁজছে দেখে সুকান্ত সুমনের দিকে তাকালেন,

কাউকে খুঁজছো নাকি?

সুমন ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো,

হ্যাঁ! সুখময়দা কে! আমি জানি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন নি, তাই সুখময়দার সঙ্গে একবার কথা বলিয়ে দিতে চাই! অবশ্য আপনি তো উকিল মানুষ, প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেন না, সেটা জানি! কিন্তু সুখময়দার কাছেও কোনো প্রমাণ নেই! তবে ঝাড়গ্রামে ব্যাপারটা সবাই জানে, কিন্তু ওই যে ওর মেসো! সে তো বহুত সেয়ানা মাল, প্রমাণ রেখে কিছু করেনি! গরীব ঘরের মেয়ে, অনেক পয়সা পেয়েছে, তাই মুখ সেও খুলবে না!

মুখ ফস্কে মাল বলে ফেলেই জিভ কাটলো সুমন,

সরি!

সুকান্ত হাসলেন, সামনের সিটের দরজা খুলে ধরে বললেন,

বাইকটা এখানে রেখে যদি আমার সঙ্গে কিছুক্ষনের জন্যে গাড়িতে ওঠো,তাহলে কি তোমার খুব অসুবিধা হবে?

সুমন একটু অবাক হয়ে তাকালো, থমকে গিয়ে বললো,

কোথায় যেতে হবে আমাকে?

সুকান্ত হাসলেন,

বিশেষ কোথাও না! জাস্ট তোমার সঙ্গে একটু মুখোমুখি বসতে চাই, সেটা এখানে সম্ভব হবে না!

সুমন আর কথা বাড়ালো না, গাড়িতে উঠতে উঠতে বললো,

আমি একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকি! যদি অসুবিধা না হয় আপনার, তাহলে ওখানে নিশ্চিন্তে বসে কথা বলা যেতে পারে!

সুকান্ত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে হাসলেন,

কোনো অসুবিধা নেই, ওখানেই চলো তাহলে! ভাইঝি বিয়ের পরে কোথায় থাকবে সেটা তো একবার দেখতে হবেই!

সুমন চমকে তাকালো, তাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুকান্ত গাড়ি চালাতে চালাতে সামনের দিকে তাকিয়েই মৃদু গলায় বললেন,

তোমার আপত্তি আছে মনে হচ্ছে? আমি মনে হয় কিছু ভুল বলে ফেলেছি!

সুমন খানিকটা নিজের অজান্তেই মাথা নাড়লো,

না, না! আপত্তির কথা নয়! কিন্তু আপনি কি করে জানলেন! কে বললো! অদ্বিতীয়া?

সুকান্ত সামনের দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসলেন,

কতো বছর ওকালতি করছি জানো সেটা! শুধুমাত্র সম্পর্কে বোনের বান্ধবী, তাও এমন বান্ধবী যার সাহায্যে সেটা অজান্তে হলেও,বোন পালিয়ে গিয়েছে, তার বিয়ের পাত্র যে চরিত্রহীন, সেটা প্রমাণ করতে কোনো বন্ধুর দাদা এতো পরিশ্রম করে না!

সুমন মাথা নিচু করলো, হতাশ গলায় বললো,

তারমানে আপনি সবটাই নিজেই ধারণা করেছেন! অদ্বিতীয়া কিছু বলে নি!

হতাশ হলে? অদ্বিতীয়া আসলে বলতে চায়, কিন্তু ওই যে, ইগো! রাগ, জেদ কাটিয়ে বেরিয়ে এসে বলতে পারাটা কার্যত তার পক্ষে অসম্ভব! সেতো ছোটো থেকেই একটু চাপা, কখনো এগিয়ে এসে নিজে থেকে কিছু বলতে পারে না। আমরা যারা ওকে ছোটো থেকে চিনি, ভালোবাসি, তারা ওর এই স্বভাবটা জানি! তুমিও আস্তে আস্তে জেনে যাবে!

কিন্তু আমিও কিছু ভুল করে ফেলেছি! সবটাই হয়ত জেদ বা ইগো নয়! তবে আমার ভুলের জন্যে ও জেদ দেখিয়ে যেটা করতে যাচ্ছে, সেটা আরো বড়ো ভুল! যদি সত্যিই এমন কিছু হয় তাহলে ও ভবিষ্যতে আফসোস করবে!

হতাশ গলায় বললো সুমন, সুকান্ত হাত তুললেন,

আমরা সবাই যে যার মতো করে এই ভুলটা হওয়ার থেকে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি! তুমি তোমার মতো করে, ওর মা তাঁর মতো করে, আমি আমার মতো করে! বৌদি আমাকে তোমার কথা বলেছিলেন, তাই তোমার কাছে এসেছি! তুমি যদি এই বিয়ের প্রস্তাবে রাজি থাকো, তাহলে এই ভুলটা হওয়া থেকে আমরা ওকে বাঁচাতে পারি!

সুমন উজ্জ্বল মুখে তাকালো,

আমি তো রাজিই, কিন্তু অদ্বিতীয়া তো আমার সঙ্গে কথা বলতেই চাইছে না!

সুকান্ত মুচকি হাসলেন,

অতো তাড়া কিসের? আমি তো বলছি, তাতে চলবে না? এখন আপাতত ওর মা আর আমিই বলি তারপরে বিয়ে হয়ে গেলে না হয় ও বলবে!

সুমন লজ্জায় মাথা নিচু করলো, সুকান্ত আচমকাই গাড়ি থামিয়ে দিলেন,

নেমে পড়! সব কথা যখন গাড়িতেই হয়ে গেলো তখন বাড়ি দেখতে আর যাবো না এখন! আবার তোমাকে বাইক নিতে ফিরতে হবে অনেকটা!

সুমন অবাক হয়ে তাকালো,

বাড়ি দেখবেন না! আপনি তো একটু আগেই বাড়ি দেখতে চেয়েছিলেন!

সুকান্ত হাসলেন,

ওটা তো ভাড়া! তুমি যখন নিজের বাড়ি বানাবে তখন অবশ্যই দেখতে আসবো! তাহলে ঐ কথাই রইলো, আমি রেজিস্ট্রির নোটিস দিচ্ছি!

সুকান্ত গাড়ি ঘোরাতে যাচ্ছিলেন, সুমন এগিয়ে এলো,

একটা কথা ছিলো! আপনার বাবা, সরি, মানে দাদুভাই, তিনি কি রাজি হবেন অতো সহজে?

সুকান্ত গম্ভীর হলেন,

সহজ, কঠিন জানিনা, তবে এটুকু জানি কোনো ভাবেই রাজি হবেন না! তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই! উনি আপত্তি করলে বিয়ে আমার বাড়ি থেকে হবে, তুমি শুধু তৈরি থেকো! আর একটা কথা, বলতে না চাইলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, একটু সাবধানে থেকো! আপাতত কিছুদিন বাইক নিয়ে যাতায়াত কোরো না! তোমার বাড়িতে জানাতে হবে তো?

সুমন ম্লান মুখে তাকালো,

জানাবো তো অবশ্যই কিন্তু তারা আসবে কিনা জানিনা!

দরজায় টোকা পড়তেই আশা দরজাটা খুলে ধরলো, ঘোমটায় মুখ ঢেকে শিয়ালদা স্টেশনের পেছনের রাস্তাটা ধরে সোজা এগোলেই বড়ো রাস্তা, ওটুকুই যা সমস্যা! ওটা একবার পেরিয়ে যেতে পারলেই আধো অন্ধকার গলি গুলো যেনো আশার যাতায়াতের সুবিধার কথা মাথায় রেখেই বানানো হয়েছে! লোকটার পেছন পেছন দ্রুত পা চালাচ্ছিল আশা, লোকটা যেনো উড়ে উড়ে যাচ্ছে!

বাবু! একটু আস্তে চলুন!

আশার চাপা গলা লোকটা কে দাঁড় করিয়ে দিলো, লোকটা মুখ ফিরিয়ে আশার দিকে তাকিয়ে খিঁচিয়ে উঠলো,

পা চালাও! তুমি কোথাও বেড়াতে যাচ্ছ না! কাগজের সম্পাদক মশাই নিজে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন! ওনার সময়ের দাম আছে অনেক!

আশা আর কোনো প্রত্যুত্তর করলো না, কলেজের পাশ দিয়ে যে সরু গলিটা, ওটা তে ঢুকে পড়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত লাগছিলো এবার। মাঝের বড়ো রাস্তাটা পেরোতে পারলেই উল্টো দিকে ছাতা কারখানার গলি, আশা এখান থেকেই প্রায় অন্ধকার গলির মুখের জটলাটা দেখতে পেলো। সময়টা প্রায় সন্ধ্যে, অথচ এখনো রাস্তার আলোগুলো জ্বলে ওঠেনি, এই সময়টাকেই রতন দেখা করার জন্যে বেছে নিয়েছিলো কাল, বলেছিলো,

আলো গুলো জ্বলতে শুরু করার আগেই কথা বলে চলে আসবি! বেশিক্ষন দাঁড়াবি না কিন্তু!

অন্য মনস্ক আশা এসব কথা ভাবতে ভাবতেই জটলার দিকে লোকটা কে হাত দেখালো,

ওখানে এতো লোক কেনো বাবু? ওরা কারা?

লোকটা বিরক্ত হলো,

আমি কি করে জানবো! তবে আমাদের কাগজের সম্পাদক মশাই তো রয়েছেন ওখানে, সেটা দেখতে পাচ্ছি! উনিই মনে হয় সঙ্গে এনেছেন ওদের! তোমাকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না, তুমি তাড়াতাড়ি চলো!

শুভঙ্কর বড়ো রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে ড্রাইভার কে সঙ্গে নিয়ে গলির মুখে দাঁড়িয়ে বার বার নিজের ঘড়ি দেখছিলেন। প্রায় অন্ধকার কলকাতা শহরে এখনো রাস্তায় আলো জ্বলে ওঠেনি, দু একটা দোকানে আলো জ্বলে উঠছে এক এক করে। গলির পাশেই হাতে টানা রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে গোটা তিনেক, সওয়ারি নেই বলে চালকরা গলির মুখের পাশেই গামছা পেতে তাস খেলছে, একদিকে গোটা তিনেক সাইকেল নিয়ে গোটা পাঁচেক ছেলে সারা গায়ে কাদা মেখে ফুটবল হাতে খেলে ফিরছে দল বেঁধে। এতো লোকের মধ্যে দিয়ে ঠিক কি ভাবে আশা কে রথীন এর কথামত গাড়িতে তোলা যায় তার চিন্তাই করছিলেন তিনি। উল্টোদিকের গলির শেষ প্রান্তে নতুন ছেলেটা কে একজন মাঝ বয়সী মহিলার সঙ্গে দেখেই ড্রাইভার কে ইশারা করলেন,

যা গাড়িতে উঠে বস! স্টার্ট দিয়ে রাখবি, আমি হাত দেখালেই এগিয়ে নিয়ে আসবি! আমাদের কিছু দরকারি কথা আছে, গাড়ি নিয়ে অন্য জায়গায় যেতে হবে!

নতুন ছেলেটা মহিলা কে সঙ্গে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ছাতা কারখানার গলির ভেতরে ঢোকার আগেই গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো সাইকেল নিয়ে গলিতে ঢুকে পড়লো। গলিটা এল ধাঁচের, মাঝের অংশটায় ছাতার কারখানা, সার সার ঝোলানো ছাতা গুলো, সরু গলি কে আরো সরু করে দিয়েছে এলের মাঝের অংশটায়। ওখানে পৌঁছেই তিনজনেই আটকে পড়লো, ছেলে গুলো মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়েই গুলতানি মারতে শুরু করেছে!

শুভঙ্কর অধৈর্য্য হলেন,

এই ভাই! এগিয়ে যাও! মাঝ রাস্তায় কেও দাঁড়ায়! এতো সরু গলি!

একটা লম্বা মতো ছেলে ফিরে তাকালো, অন্ধকারের মধ্যেই ইশারা করলো,

বেরিয়ে যান না কাকু, অনেক জায়গা আছে!

নতুন সাংবাদিক ছেলেটি এগিয়ে গেলো,

কোথায় জায়গা ভাই! একে তোমরা এতো গুলো ছেলে, তার ওপরে তিন তিনখানা সাইকেল! বেরোবো কোথা দিয়ে!

ছেলেগুলো সাইকেল সমেত দেওয়ালের গায়ে ঠেসে দাঁড়ালো,

যান, যান! এবার বেরিয়ে যান! আমরা পাড়ার ছেলে কাকু, খেলে ফেরার সময় এখানেই একটু আড্ডা দিই!

আর কথা না বাড়িয়ে গোটা তিনেক সাইকেল, গোটা পাঁচেক ছেলে, ঝোলানো একগাদা ছাতা টপকেই বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন শুভঙ্কর, পেছন পেছন বাকি দুজন। শুভঙ্কর পেরিয়ে যাওয়ার পরেই অন্ধকারে একটা হুড়মুড় করে আওয়াজ হলো, নতুন ছেলেটা আর আশার গলায় অস্ফুটে একটা আর্তনাদ বেরোলো,

আহ্!

শুভঙ্কর দ্রুত ফিরে তাকালেন, অন্ধকারে কিছু দেখতে না পেয়ে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলেন,

কি হলো! পড়ে গেলে নাকি!

ছেলেটা অন্ধকারে গলির মধ্যে বসে পড়ে উত্তর দিলো,

আমি পড়িনি স্যার! সাইকেলটা পায়ের ওপরে পড়লো! উফফ! পাটা কেটে গেছে মনে হচ্ছে! এই গলিতে কেউ এতো সাইকেল ঢোকায়!

তার শেষের কথাগুলো ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে ছিলো, ছেলে গুলো দ্রুত পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতেই উত্তর দিলো,

সরি কাকু! বুঝতে পারিনি সাইকেলটা পড়ে যাবে! ভুল হয়ে গেছে! আমরা বরং বেরিয়েই যাচ্ছি, আপনাদের সুবিধা হবে!

ছেলেগুলো হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেলো, পড়ে থাকা সাংবাদিক ছেলেটা চিৎকার করলো,

আরে! সাইকেলগুলো ফেলে চলে গেলে! ওঠাও পায়ের ওপর থেকে! খুব যন্ত্রণা হচ্ছে!

মুহূর্তে শুভঙ্করের সাংবাদিক সত্বা জেগে উঠলো, তিনি চিৎকার করে উঠলেন,

আশা! আশা কোথায়?

আশা কোনো উত্তর দিলোনা, পকেট থেকে টর্চ বার করে মাটিতে ফেললেন শুভঙ্কর, পা চেপে বিকৃত মুখে বসে থাকা ছেলেটার পাশেই আশা পড়ে আছে, পেটের কাছের শাড়িটা রক্ত মাখা! সেই রক্ত চুঁইয়ে পড়ে গলির রাস্তা লাল হয়ে রয়েছে! দ্রুত দুজনকে টপকে গিয়ে গলির মুখে পৌঁছতেই বাধা পেলেন শুভঙ্কর, কিছুক্ষন আগের রিক্সাচালকরা গলির মুখ জুড়ে গামছা পেতে তাস খেলছে এখন!

শুভঙ্কর চিৎকার করে উঠলেন,

গলির মুখে কেনো? সরো তাড়াতাড়ি! কোথায় গেলো ছেলেগুলো?

চালকরা নির্বিকার ভঙ্গিতে তাস খেলছিল, দান ফেলতে ফেলতে তাদেরই একজন ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো,

গলিটা আপনার কেনা নাকি বাবু? আস্তে কথা বলুন! এতো চেঁচামেচি কিসের?

শুভঙ্কর থমকে দাঁড়ালেন, ততক্ষনে নতুন ছেলেটাও খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে দাঁড়িয়েছে ওখানে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সম্বিত ফিরে পেয়ে রিকশাচালকদের হিমশীতল চোখের দিকে তাকালেন শুভঙ্কর, নিজের অজান্তেই তাঁর গলা নরম হলো,

বেরিয়ে যেতে দাও আমাদের! সামনেই আমার গাড়ি আছে!

একজন তাস ফেলতে ফেলতে মাটির দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় উত্তর দিলো,

উল্টো দিকের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যান! আবার গলির মধ্যে ঢুকে পড়ুন! এখন খেলা ছেড়ে ওঠা সম্ভব নয়!

শুভঙ্কর আর কথা বাড়ালেন না, ছেলেটা কে সঙ্গে নিয়ে অনেকটা প্রাণ হাতে নিয়েই গলির ভেতর দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা মৃত আশাকে টপকে গিয়ে উল্টো দিকের বড়ো রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন প্রায় ছুটতে ছুটতে! মোড়ের মাথায় পৌঁছে নতুন ছেলেটা শ্বাস ফেললো,

মেয়েটা মরেই গেলো স্যার! এরকম তো কথা ছিলো না!

শুভঙ্কর ঠোঁটে আঙুল রাখলেন,

চুপ! কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে পড়!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪৬
এটা তুই কি করলি রথীন? নিজের ইচ্ছেমতো প্ল্যান চেঞ্জ করে ফেললি? আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না একবারও?

ফোন ধরেই শুভঙ্করের উত্তেজিত গলায় রথীন সান্যাল থতমত খেলেন,

মানে! কি প্ল্যান চেঞ্জ করলাম? কি হয়েছে? মেয়েটা কোথায়? তুই এখনো এলিনা কেনো? আমি তো সেই থেকেই চেম্বারে বসে আছি তোর জন্যে!

শুভঙ্কর থমকে গেলেন,

তুই সত্যি কিছু জানিস না? নাকি আমার সঙ্গেও চালাকি করার চেষ্টা করছিস?

সত্যিই কিছু জানিনা! কি হয়েছে খুলে বল তো? মেয়েটা তোর সঙ্গে দেখা করতে আসেনি?

উদগ্রীব গলায় প্রশ্ন করলেন রথীন সান্যাল, শুভঙ্কর একটু চুপ করে থেকে গলার স্বর নিচু করলেন,

এসেছিলো তো! আচমকা গলির মধ্যে কতগুলো ছেলে ভিড় করে ঘিরে ধরে ছুরি বসিয়ে দিল পেটে! স্পট ডেড! আমার মনে হয়েছিলো তুই প্ল্যান চেঞ্জ করেছিস! কিন্তু তুই তো কিছুই জানিস না বলছিস! তাহলে? কাজটা কে করলো বলতো?

রথীন এর গলা গম্ভীর হলো,

আমি জানি এটা কার কাজ! তুই ফোন রাখ এখন, আমি পরে তোর সঙ্গে কথা বলছি আবার!

ফোনটা রেখে দিয়ে কয়েক মিনিট দু হাতে কপাল চেপে ধরে বসে রইলেন রথীন সান্যাল, তারপরে ফোন হাতে তুলে নিলেন, উল্টোদিকে প্রতাপ সান্যালের গলা শুনতে পাওয়া মাত্র রথীন একটু শক্ত গলায় বললেন,

জ্যেঠু বাবু! কাজটা ঠিক করলেন না! আমার ওপরে একটু ভরসা রাখতে পারতেন! আমি আপনার কোনো ক্ষতি হতে দিতাম না কিছুতেই!

প্রতাপ সান্যাল বিস্মিত গলায় উত্তর দিলেন,

কি হয়েছে রথীন? কোন ভরসার কথা বলছো? তুমি আমার যা উপকার করেছ এরপরে আবার ভরসা না রাখার কথা উঠছে কেনো?

রথীন দাঁতে দাঁত চাপলেন, কেটে কেটে বললেন,

আশাকে মারার কি খুব দরকার ছিলো জ্যেঠু বাবু? আমিই ওটা সামলে নিতে পারতাম! যদি আপনিই ব্যবস্থা নেবেন জানতাম, তাহলে আমি আর এর মধ্যে জড়িয়ে ফেলতাম না নিজেকে! শুভঙ্করের কাছে আমার মাথা হেঁট হয়ে গেলো জ্যেঠু বাবু, ও ভাবলো ওকে না জানিয়ে আমি আমার প্ল্যান পাল্টে ফেলেছি!

আশা মারা গেছে! কি ভাবে? কে মারলো ওকে? আমি তো কিছুই জানিনা! সবটা তোমার ওপরে ছেড়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে বসে ছিলাম! এই বয়সে কি আর এইসব পোষায়? তুমিই বলো! আর তাছাড়া ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না প্রতাপ সান্যাল, এটা তোমার আমাকে এই কথাগুলো বলার আগে ভাবা উচিত ছিলো রথীন!

শেষের কথাগুলোতে প্রতাপ সান্যালের গলা কড়া হলো, রথীন তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন,

না, না জ্যেঠু বাবু, আমি আপনাকে দোষারোপ করছি না! আসলে আমার মনে হয়েছিলো আপনি কিছু জানেন, হয়ত আমার ওপরে ভরসা করতে পারেন নি! আমার বুঝতে ভুল হয়েছে, আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনার কাছে! দেখছি খোঁজখবর নিয়ে এটা কার কাজ!

প্রতাপ সান্যাল স্মিত হাসলেন,

আহা! এসব ক্ষমা টমা আবার কি! তুমি আমার কতো স্নেহের তা কি তুমি জানো? ছোটো ভাইয়ের একমাত্র স্মৃতি তুমি, তোমার ওপরে আমার অগাধ আস্থা! শুধু তুমি বলেছো তাই এক কথায় আমি নাতনির বিয়েতে রাজি হয়ে গেছি! সুকান্ত তো এর তীব্র বিরোধিতা করছে! তার কাছে নাত্ জামাইয়ের সম্পর্কে খবর পৌঁছালো কি করে কে জানে! ভালো কথা, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, কার্ড ছাপিয়ে এসে গেছে জানো নিশ্চয়ই? এবার একটু নিমন্ত্রণ করতে আমার সঙ্গে বেরোতে হবে তো, নিজের ছেলেদের ওপরে তো একটুও ভরসা রাখতে পারিনা আর!

তিনি জ্যেঠুর সঙ্গে নিমন্ত্রণ করতে বেরোবেন কথা দিয়ে ফোন রাখার পরে রথীন নিস্ফল আক্রোশে পাশের দেয়ালে সজোরে ঘুষি মারলেন,

স্কাউন্ড্রেল!

সরযূ এতক্ষন পাশেই দাঁড়িয়ে স্বামীর সঙ্গে রথীন এর কথোপকথন শুনছিলেন, ইদানিং তিনি রথীন ফোন করলেই সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁর সব সময় মনে হয় রথীন বিয়ের সুযোগে বেশ কিছু সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করছে! স্বামীকে ফোন নামিয়ে রাখতে দেখে তিনি সামনে এগিয়ে এলেন,

আশার কথা কি হচ্ছিলো? রথীন ওর কথা কেনো বলছিলো?

প্রতাপ সান্যাল ততোক্ষনে আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে পড়েছিলেন, ওখান থেকেই চোখ না খুলেই জবাব দিলেন,

আশা খুন হয়ে গেছে গিন্নী, পথের কাঁটা সরেছে এবার পুরোপুরি! বড্ড নিশ্চিন্ত লাগছে আজ!

সরযূ উৎফুল্ল মুখে এগিয়ে এলেন,

কে করলো? রথীন নাকি?

প্রতাপ সান্যাল মাথা নাড়লেন,

নাহ! খবর সেই জোগাড় করে দিয়েছিলো বটে তবে মারতে সে পারে নি! কে করলো সেটা বলা মুশকিল এই মুহূর্তে! তবে যেই করুক, উপকার তো আমাদেরই হয়েছে, সেটা তো অস্বীকার করার জায়গা নেই!

সরযূ স্বামীর চোখে চোখ রাখলেন,

এতো বড়ো উপকারটা কে করলো শুনি?

প্রতাপ সান্যাল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন,

ড্রাইভারকে গাড়ি বার করতে বলো, নিমন্ত্রণ শুরু করতে হবে এবার। হাতে আর একদম সময় নেই! চলো তৈরি হয়ে নাও, প্রথম তোমার বাপের বাড়ি দিয়েই শুরু করবো! রতন নিশ্চয়ই এই রাতে বাড়িতেই আছে!

সরযূ দরজা ঠেলে বন্ধ করে দিয়ে স্বামীর মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন,

আমার ভাইপোর কোনো ক্ষতি আমি মেনে নেব না, এখানে দাঁড়িয়েই তোমাকে বলে দিলাম!

প্রতাপ সান্যাল মৃদু হাসলেন,

পাগলামি করো না সরযূ, আজ পর্যন্ত তার কোনো ক্ষতি হয়েছে? তুমি যাকে ভালোবাসো সে আমারও প্রিয়জন! তার মাকে এখানে রেখেছিলাম যাতে সে কোনো ভুল না করে! আর এখন তো আশাই নেই, সে তো মুক্ত বিহঙ্গ এখন! শুধু সেটুকুই তাকে বলে দেবো, আর তার লুকিয়ে বেড়ানোর কোনো দরকার নেই! তার কাছে কোনো প্রমাণ আর থাকলো না মানে সে আমার নজরেও আর থাকবে না!

আশা খুন হয়ে গেছে এ খবর সাংবাদিক ছেলেটির কাছ থেকে পাবার পর থেকেই নিজেকে ঘরবন্দী করেছিলো রতন। সন্ধ্যে থেকেই সে ঘরের আলো নিভিয়ে চোখ বন্ধ করে খাটে শুয়ে ছিলো, এমন সময় বাড়ির তলায় গাড়ি থামার আওয়াজ হলো। রতন দ্রুত জানলার সামনে এলো, বন্ধ জানলার খড়খড়ি তুলে ধরে নিচের দিকে তাকাতেই তার সারা শরীর কেঁপে উঠলো, গাড়ির দরজা খুলে নামছেন প্রতাপ সান্যাল!

রতন দৌড়ে মায়ের ঘরে গেলো,

দেখো তোমার ননদ এসেছে বাড়িতে! যদি আমার খোঁজ করে বলবে আমি খুব অসুস্থ, ঘুমিয়ে পড়েছি!

মাকে দরজা খুলতে বলে রতন দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল, কিছুক্ষন পরে দোতলায় কথোপকথনের আওয়াজ উঠে এলো। সরযূ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভাইপোর উদ্দেশ্যে নরম গলায় ডাক দিলেন,

রতন! তোর শরীর খারাপ শুনলাম! কি হয়েছে বাবা!

রতন উত্তর দিলো না, তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সরযূ ভাইবৌ এর বাধা কে পাত্তা না দিয়েই ভেতরে ঢুকে এলেন, ঘরের আলো জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন,

ইস! এই ভর সন্ধ্যেবেলায় কেউ ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে! এতে গৃহস্থের অকল্যাণ হয় বাবা! তুলসী তলায় প্রদীপ দিয়েছে তোর মা! ওঠ, উঠে বোস! দেখ, তোর জন্যে তোর পছন্দের চপ নিয়ে এসেছেন তোর পিসেমশাই!

অগত্যা নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রতন বাধ্য হয়েই উঠে বসলো, পিসির হাত থেকে চপ, মুড়ির থালা হাত বাড়িয়ে নিয়ে পাশে রেখে পিসি, পিসেমশাই কে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। প্রতাপ সান্যাল মাথায় হাত রাখলেন,

দীর্ঘজীবি হও!

পাশেই রাখা চেয়ার টেনে বসতে বসতে প্রতাপ সান্যাল শ্যালকের বউয়ের দিকে কার্ড বাড়িয়ে দিলেন,

নাতনির বিয়ে! সপরিবারে আসতে হবে কিন্তু! বিয়ের বেশ কয়েকদিন আগেই এসে পড়বেন বৌদি, আপনার ননদের কিন্তু আপনি ছাড়া চলবে না!

রতনের মা পাংশু মুখে ঘাড় নাড়লো, সরযূ তাঁর ভাই বউয়ের হাতে চাপ দিলেন,

চলো বৌদি! আমরা তোমার ঘরে বসি! ওরা এখানে থাক! বিয়ের দেওয়া থওয়া নিয়ে একটু আলাপ আলোচনা আছে তোমার সঙ্গে!

নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ননদের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন রতনের মা, প্রতাপ সান্যাল বাটি থেকে চপ তুলে খেতে খেতে রতনের দিকে ইশারা করলেন,

নাও! শুরু করো! চপ ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!

রতন কাঁপা কাঁপা হাতে চপ তুলে নিলো, তার হাতের কাঁপুনি লক্ষ্য করে সান্যাল মশাই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,

কি হলো! শরীর খুব খারাপ নাকি?

নির্জীব ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো রতন, প্রতাপ সান্যাল গলা খাঁকারি দিলেন,

তাড়াতাড়ি সুস্থ হও! বিয়েতে কোমর বেঁধে লাগতে হবে তো! ওই তো রতির অবস্থা! আর সুকান্তর ভরসা আমি করিনা! তোমার দায়িত্বেই সবটা থাকবে কিন্তু! দিনকাল বদলাচ্ছে রতন, আজকাল একটা বিশ্বাসযোগ্য, ভরসাযোগ্য লোকের বড়ই অভাব! এককালে সান্যাল বাড়িতে কাজের লোকের অভাব ছিলো না, আমার দাদু, বাবাদের সময়ে শুধু একটা ডাকের অপেক্ষা ছিলো, চারটে ছেলে হাত জোড় করে সামনে এসে দাঁড়াতো! এখন আর সেদিন কোথায়? প্রতাপ সান্যালকে আর কটা লোক সম্মান করে বলতো?

রতন তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো,

কি বলছেন পিসেমশাই! আপনি ডাকলেও পাঁচটা লোক সামনে এসে দাঁড়াবে! আপনার কথাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আছে কার!

সান্যাল মশাই মাথা নাড়লেন, রতনের চোখে চোখ রেখে বললেন,

নাহ! সেদিন আমার আর নেই রতন! আমার বাড়িতে বহু বছর আগে একটি মেয়ে আলতা পরাতে আসতো, নাম আশা, মনে আছে তোমার?

রতন চমকে তাকালো, সান্যাল মশাই তার চমককে গ্রাহ্য করলেন না, শান্ত গলায় বললেন,

সেই মেয়েটি নাকি আমার বিরুদ্ধে কোনো সংবাদপত্রে কিছু গোপন খবর ফাঁস করার চেষ্টা করছিলো! যদিও তার একার দ্বারা সেসব হতো না! সাংবাদিককে যোগাযোগ করে দেওয়ার দায়িত্ব অবশ্য অন্য কেউ নিয়েছিলো শুনলাম! কি ধৃষ্টতা তাদের! ভাবো তুমি একবার! আমার বাবা, দাদুদের আমলে এরকম কোনো খবর প্রকাশ্যে আসতে পারে জানতে পারলে তাঁরা তাদের মাটিতে পুঁতে দিতেন সেই মুহূর্তে! তোমার দাদু, বাবাও তো একই কাজ করেছেন প্রয়োজনে! তাদের অবশ্য দোষ আমি দিই না, কি আর করা! বনেদি বাড়ির মূল বিষয় হলো সম্মান! সেটা যদি হারিয়ে যায়, তাহলে আর জীবনে বেঁচে থেকে লাভ কি! কিন্তু আমাকে দেখো! সেই প্রতাপ আমি দেখাতে পারলাম কই! আমার নরম মনের সুযোগ নিয়েই তো আশা এসব করার কথা ভাবলো! একবারও তার বিবেকে বাধল না! মনে হলো না প্রতাপ সান্যাল তোকে বাড়ি থেকে জীবিত বেরোতে দিয়েছিলো সেটার জন্যে তোর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিলো!

রতন করুন দৃষ্টিতে তাকালো,

পিসেমশাই! আমি কিন্তু আপনার কথা অমান্য করিনি কখনো! কারোর কাছে একবারের জন্যেও মুখ খুলিনি!

প্রতাপ সান্যাল বরাভয়ের দৃষ্টিতে তাকালেন,

আহা! এতে আবার তোমার কথা আসছে কেনো? প্রসঙ্গ উঠলো তাই তোমায় বললাম! ওহো! তোমায় তো বলাই হয়নি, শুনলাম আশা নাকি খুন হয়ে গেছে বিকেলে! কে করলো সে বিষয়ে অবশ্য কোনো খবর পাইনি! যাইহোক, কাজের কথায় আসি, তুমি কবে থেকে ভাইঝির বিয়েতে হাত লাগাবে বলো দিকি!

রতন শেষ চেষ্টা করলো,

আমার যাওয়া সুকান্ত বা সরলা ভালো ভাবে নেবেনা পিসেমশাই! আমি বরং আপনার বাইরের দায়িত্বগুলো করবো, বাড়িতে ঢুকবো না!

প্রতাপ সান্যাল মাথা নাড়লেন, একটু শক্ত গলায় বললেন,

নাহ! বাড়ির দায়িত্ব তোমারই! সুকান্তকে আমি বিশ্বাস করিনা! ওর এই ছেলেকে পছন্দ নয়, কারণ ছেলে পণ চেয়েছে! বনেদি বাড়ির ছেলে পণ চাইবে না তো কি ভিখিরি বাড়ির ছেলেরা চাইবে! আমি ঠিক করেছি ও যদি বেশি আপত্তি করার চেষ্টা করে সেক্ষেত্রে বিয়ের কদিন আমি ওকে এবাড়িতে ঢুকতেই দেবো না! ও যা পারে করে নিক! অনেক বড়ো বড়ো কথা সহ্য করেছি ওর, এবার ওকে প্রতাপ সান্যালের ক্ষমতা কতোটা সেটাও একবার বুঝতে দিতে হবে!

সুকান্ত যখন বাড়িতে ফিরলেন তখনও প্রতাপ সান্যাল আর সরযূ ফিরে আসেন নি। তাঁদের ঘরে দেখতে না পেয়ে সুকান্ত অবাক হলেন, ভাইঝির ঘরের দরজার পর্দা তুলে উঁকি দিয়ে বললেন,

দাদুভাইরা কোথায়? বাড়িতে নেই নাকি?

অদ্বিতীয়া ঘাড় নাড়লো,

না বেরিয়েছেন তো! জানিনা কোথায়!

সরলা দেওরের চা জলখাবার নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলো, সুকান্ত কে ভাইঝির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো,

মা বাপের বাড়ি গেছেন ছোড়দা! বিয়ের নেমন্তন্ন করতে!

সুকান্ত ট্রে বৌদির হাত থেকে নিয়ে মুচকি হাসলেন,

ভালো, ভালো! কিন্তু পাত্র যে পাল্টে গেছে সেটা জানেন তো?

সরলা অবাক হয়ে তাকালো,

মানে! বাবা জানেন? রাজি হয়েছেন?

সুকান্ত তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন,

ওসব আর পরোয়া করিনা! জানানোর কথা জানিয়ে দেবো বাড়ি এলে! রাজি হওয়া না হওয়ায় আর আমার কিছু এসে যায় না! বেশি জেদ দেখালে আমার বাড়ি থেকে বিয়ে দেবো, দেখি প্রতাপ সান্যাল কি করে আটকায় এবার! মেয়ে অ্যাডাল্ট, সে এই বিয়েতে রাজি নয়, এর থেকে বড়ো আপত্তি আর কিই বা থাকতে পারে? দাদা কে বলেছিলাম, সেতো এগিয়ে এলোনা, তাই পিয়াকেই সামনে আনতে হলো! নাহলে এক্ষুনি তোমার মেয়ে নয়, তোমার আপত্তি মানবো না, এই ধরনের যুক্তি তৈরি করতেন বাবা!

সরলা উৎফুল্ল মুখে অদ্বিতীয়ার দিকে তাকালো, দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,

উফফ! যাক তোমার যে সুবুদ্ধি হয়েছে অবশেষে, সেটাই বড়ো কথা! পাগলি মেয়ে একটা! আচ্ছা বলো, সুমন কি বললো? কান ধরে ক্ষমা চেয়েছে তো?

অদ্বিতীয়া লজ্জা জড়ানো গলায় বললো,

আমার সঙ্গে কথা হয়নি ছোটো মা!

সুকান্ত হাসলেন,

এতো বেশি রাগ দেখিয়ে ফেলেছে যে এখন সুমনের সামনে যেতেই তো লজ্জা লাগছে তার! তাই আমিই কথা বললাম! সেতো ফ্যান খাবি, নুন হাতে করে বসে আছি অবস্থা ছেলের! শুধু বলার অপেক্ষা, সে এক কথায় রাজি! আমি দু একদিনের মধ্যেই রেজিস্ট্রির নোটিশ দিচ্ছি, বলে দিয়েছি তাকে!

সরলা দু হাত জোড় করে কপালে ঠেকালো,

সব কিছু ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক ঠাকুর!
ক্রমশ