“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ১৮
(নূর নাফিসা)
.
.
রবিবার সকালে দই মিষ্টির ফেরি বসিয়েছে আমজাদ আলী মেয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য। গতকাল বিকেলে অর্ডার করে এসেছিলো। সকালে নিয়ে আসার জন্য আজমাইনকে পাঠিয়েছে বাজারে। আজ মাহতাবের বাড়িতে আয়োজন। প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও প্রতিবেশীদের নিয়ে ভালো আয়োজন করেছে মরিয়ম। নানাজানকে বিশেষ যত্নে নিয়ে যাওয়ার জন্য রিকশা পাঠিয়েছে মাহতাব। বাকিরা কেউ ভ্যানে, কেউবা হেটেই চলে যাচ্ছে। সেই রিকশায় দই মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে নানাজানের সাথে উঠেছে আজমাইন। মৌসুমী আজও শ্বাশুড়ির দেওয়া শাড়ি এবং গহনা পরে সুন্দর সেজেছে। ফুটফুটে গ্রাম্য বউ দেখাচ্ছে। তার এই রূপ নিয়ে সে তো হেটে যাবেই না। আমজাদ আলী রিকশা না পেয়ে কয়েকজন মিলিত হয়ে যাতায়াতের জন্য যে ভ্যান ঠিক করেছে তাতেও সে উঠবে না। নিজের সাজসজ্জাকে একটু বিশেষ প্রাধান্য দিচ্ছে নিজে নিজেই। তার নজর সেই এক রিকশাতেই। মা, বড় মা এবং মামীশাশুড়ীরা ভ্যানে বসে গেলেও সে যাচ্ছে না। হালিমা খাতুনের ধারে ঘুরে ঘুরে বারবার বলছে,
“বড় মা, আমি যাবো ক্যামনে?”
“আমাদের সাথে ভ্যানে বসে যাবি।”
“না, আমি ভ্যানে যাইতাম না।”
“তবে ক্যামনে যাবি? তোর আব্বা, জেঠুদের সাথে হেঁটে যাবি?”
“ইশ! শাড়ি পরে আমি হেঁটে যাইতাম!”
“তাইতো বলি, ভ্যানে উঠে যা।”
“জ্বি না। আমি রিকশায় যাবো।”
“রিকশায়? রিকশায় তো তোর দাদাজান আর আজমাইন যাইবো দইমিষ্টি, পানসুপাড়ি নিয়া।”
“যাক। তোমার ছেলে উপরে উঠলেই তো আমিও বসতে পারি। আমি কিছু জানি না। আমি রিকশাতেই যাবো।”
“যাইতে পারলে যা।”
“তুমি বলে দিয়া যাও। নইলে উঠতে দিবো না তোমার ছেলে।”
“তুই যা। আমার কথা বলে উঠ। যা, আমি ঘরে তালা দিয়া আসি।”
মৌসুমী রিকশার কাছে যেতে লাগলে মমোও সাথে সাথে হাটতে শুরু করলো।
“তুই কই যাস?”
“ফুপু বাড়ি।”
“ফুপু বাড়ি যাবি ভালো কথা। আমার সাথে কি?”
“তোমার সাথে যামু।”
“তোমার সাথে যামু? আমার সাথে যাইতে হবে না। ভাগ! আমারই ঠাঁই নাই। আবার পিছে বাজে।”
“না, যামু।”
মৌসুমী তাকে দুইহাতে শূন্যে উঠিয়ে ভ্যানে বসিয়ে দিলো।
“চুপ করে বইসা থাক। নামলে পায়ে মাইর।”
সে তাকে শাসিয়ে রিকশার কাছে এলো। দাদাজানকে বসিয়ে প্যাকেটগুলো ঠিকঠাক তুলছে আজমাইন। মানবে কি মানবে না সেই দ্বিধায় মৌসুমী এসে পাশে দাঁড়িয়ে দুলতে দুলতে বললো,
“দইমিষ্টি সব ঠিকঠাক নিছো?”
“হো, নিছি।”
“বড় মা বলছে…”
“বড় মা বললেও তোরে একটা তো দূর, এক চিমটি মিষ্টিও ভিক্ষা দিতাম না। এগুলা মেহমান হইয়া বিয়া বাড়ি নিয়া যাইতাছি, ছ্যাচড়ামি করলে দাত ফালায় দিমু।”
“এহ! আমি কি তোমার কাছে মিষ্টি চাইছি? আমি বলতে আইছি, আমি তোমার সাথে রিকশায় যাবো আপুর বাড়ি।”
“দাদাজানরে কি তবে পথে ফালায় দিয়া যামু?”
“পথে ফালাইবা ক্যা? এক রিকশায় তিনজন বসা যায় না?”
“না। যায় না। দুইজনের সিট থাকে রিকশায়। তারউপর মিষ্টির প্যাকেট অতিরিক্ত জায়গা মারছে। পেছনে দাঁড়িয়ে যদি হুডে ধইরা ঝুলে ঝুলে যাইতে পারোস, তো যা।”
“তুমি দাঁড়ায় থাকো হুডে ধইরা। আমি সিটে বসেই যাবো। দাদাজান, আমারে রিকশায় নাও। তোমার নাতিরে কও উপরে বইতে।”
আহমদ আলী বললেন,
“এতোকিছু নিয়া সবাই যাইতে পারমু নাকি! তুই ভ্যানেই যা, দাদাভাই।”
“না, আমি রিকশায়ই যাবো।”
“আচ্ছা, আয় তবে। আজমাইন, উপরে উঠ।”
“উপরে উঠতাম মানে! বললেই হইলো? রিকশা উল্টে গেলে কেমন হইবো? দইমিষ্টি তখন রাস্তায় বইসা ভাঙা হাড়িতেই খাইতে হইবো কিন্তু।”
পরপরই মৌসুমীর মাথায় জোরেসোরে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“রিকশায় যাওয়ার এতো চোট ক্যা? ভ্যানে উঠলে উঠ। নইলে ঘরে গিয়া ঘুমা।”
“তুমি মারো ক্যা?”
“তোরে মারতাম না, কি করতাম? ঘাড়ামী করবি, ঘাড় ভাইঙ্গা দিমু। যা এখান থেকে, যা!”
পরপর আরও জোরে জোরে মারলো মাথায়ই। আহমদ আলী ধমক দিলেন। এদিকে মৌসুমী ব্যাথা পেয়ে এবং রিকশায় না নেওয়ার বেদনায় মুখ ভেঙিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো বড় মায়ের কাছে বিচার দিতে। নালিশ জানিয়ে হালিমা খাতুনকে নিয়ে গেইটের বাইরে এসে দেখে রিকশা উধাও! নিশ্চিত, আজমাইন তাকে পাঠিয়ে দিয়ে চালাকি করে রিকশাওয়ালাকে দ্রুত চলতে বলেছে। আরামে বসে চলে গেছে তারা দাদা নাতি। এদিকে সবাই ভ্যানে বসতে লাগলেও মৌসুমী উঠছে না। রিকশায় যেতে না পারার বেদনায় অভিমানযোগে দাঁড়িয়ে আছে গেইটে হেলান দিয়ে। আমজাদ আলী ঘটনা জেনে তার মন রক্ষা করতে অন্য রিকশা যোগাড়ের চেষ্টা করলেন। কিন্তু এই দুপুরে রাস্তায় রিকশা দেখাই যাচ্ছে না। সেলিনা বেগমের বকাবকিতে ক্ষুব্ধ হয়ে এবং রিকশা না পাওয়ার কারণে অবশেষে ভ্যানেই উঠে বসলো। তাদের ভ্যান চলতে লাগলে আমজাদ আলীও অন্য চলতি ভ্যানের কোণে বসে চলে গেছেন। বাকি পুরুষগণ আগেই হেঁটে চলে গেছেন। দশ-বারো মিনিটের পথে ভ্যানে খরচ করার প্রয়োজন মনে করেনি। তাছাড়া, তারা মাঝপথে মসজিদে নামাজ পরতে যাবে আগে।
ফুপুর বাড়ি এসে ভ্যান থেকে নেমে উঠুনে আজমাইনকে দেখেই চোখ মটকে মটকে তাকালো মৌসুমী। আজমাইন মিলিত ঠোঁট দুটো যতটুকু সম্ভব টানটান করে মিচকে একটা হাসি দিলো তাকে রিকশায় না নেওয়ার আনন্দে। মৌসুমী ভেঙচি কেটে ঘরের ভেতর চলে গেছে আপুর সাথে দেখা করতে। এসে দেখে মাহতাব, রোজা এবং দাদাজান একত্রে বসে কথা বলছে। রোজা আজ যেই শাড়িটা পড়েছে, সেটাও লাল রঙের। বিয়ের শাড়ি থেকে একটু ভিন্ন হবে। লাল খয়েরী বলা যায়। একদম ফুটফুটে বউ লাগছে। যেন আজও তার বিয়ে। মৌসুমী এগিয়ে এসে উৎফুল্লতার সাথে বললো,
“আপু! কি যে সুন্দরী লাগছে তোমাকে! কে সাজিয়েছে গো?”
“আমিই সেজেছি গো। তোকে কম লাগছে কিসে? টুনটুনি বউ।”
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দুই আঙুলে গাল টিপে বললো রোজা। মৌসুমী হেসে বললো,
“সত্যিই বউ বউ লাগছে আমাকে?”
“আবার জিজ্ঞেস করে! আয়নায় দেখ। চোখের এদিকে তো মেকাপ হালকা উঠে গেছে। কেঁদেছিস নাকি?”
মুখের হাসি ইচ্ছাকৃত সরিয়ে ফেলে সে বললো,
“হ্যাঁ, দাদাজান আর তোমার ভাই মিলে মেরে রেখে এসেছে আমাকে।”
“কেন?”
“রিকশায় আসতে চাইছিলাম বলে।”
“তাই বলে মারবে?”
“হু, মেরেছে। এই বুড়োর খবর আছে। বাসায় গিয়ে নেক আজ।”
আহমদ আলী তাদের সাথে কথায় যোগ দিয়ে বললেন,
“আমি আবার কি করলাম? আমি তো আজমাইনরে ধমক দিছিলামই।”
“ধমক দিছিলা, ধাক্কা দিয়া রিকশা থেকে ফালায় দিতে পারলা না? চালাকি কইরা দুজন আমারে রেখে আসছো, আমি কি বুঝি নাই? ছোট বাচ্চা, অবুঝ আমি? মমো পাইছো আমারে?”
মৌসুমী বাদে বাকি তিনজনই হাসলো। এতোক্ষণে যেন মাহতাবকে খেয়াল হলো। সে তো সালাম দিতেও ভুলে গেছে, ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেছে! তাই তৎক্ষনাৎ মুখের হাসি ফিরিয়ে এনে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আসসালামু আলাইকুম, দুলাভাই। এখন তো দুলাভাই ডাকতেই পারি। নাকি?”
মাহতাব মৃদু হেসে বললো,
“নিষেধ করলাম কোথায়? ডাকো।”
মৌসুমী আঁচলের কোণে আঙুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে আড়চোখে রোজার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বললো,
“আপুই তো নিষেধ করছে। আমি বলছি ডাকবোই। দশটা না, পাঁচটা না, একটা মাত্র দুলাভাই আমার। তো এই দুলাভাইকে দুলাভাই ডাকতে না পারলে আর কারে ডাকবো?”
মাহতাব তার দুষ্টুমাখা মিষ্টি কথায় সায় দিয়ে বললো,
“হুম, তাইতো। অবশ্যই ডাকবে। বিয়ের শাড়ি পছন্দ হয়েছিলো তোমার?”
“আবার জিগায়! অনেক পছন্দ হইছে। আজও তো সেইটাই পরতে চাইছিলাম, বড় মা বলছে আজ এইটা পরতে।”
“আচ্ছা, থাকুক। ওইটা আবার নাহয় অন্য দিন পরে নিয়ো। সবটাই তো পরতে হবে। সবাই এসে গেছে না?”
“হুম।”
“রোজা, আমি বাইরে যাই। দেখা করি সবার সাথে। নানাজানের খাবার এখানেই পাঠাচ্ছি।”
“ঠিক আছে।”
গল্পস্বল্প এবং খাওয়ার আয়োজন নির্ভেজালভাবে ভালোই চলছিলো সবার। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে, সকলের খাওয়া শেষ হওয়ায় কোনো কোনো দিকে ডেকোরেশনের আসবাব গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মুরব্বিরা একপাশে চেয়ার নিয়ে বসে পান চিবানো রঙিন মুখে গল্পসল্প করছে। নিয়মিত পান খাওয়ায় অভ্যস্ত না থাকলেও হালিমা খাতুন এবং সেলিনা বেগম কোনো দাওয়াতে গেলে খাওয়া শেষে পান চিবায়। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে সুষ্ঠু আয়োজনের মধ্যেও একটা ছোটখাটো ঝড় বয়ে গেলো আজমাইনের উপর। সে আর এখানে থাকতে চাইছিলো না। তার বন্ধুবান্ধবদের আড্ডা পড়ে আছে সেদিকে, এখানে অযথা সময় কাটানোর মানে হয় না। তাই বাবা-মাকে বলে চলে যাওয়ার তাড়া দেখাচ্ছে। কারণ তার এখানে আর কোনো কাজ আছে বলে মনে করছে না। কিন্তু তারা কেউই যাওয়ার পারমিশন দিচ্ছে না। যদিও পারমিশনের দায়ে আটকে থাকার লোক সে নয়। আটকে রইলো মরিয়মের জন্য। খাবার দিয়ে দিবে তাদের বাড়িতে। সে চলে গেলে এই খাবার নিয়ে যাবে কে? এতো বড় ছেলে থাকতে বড় ভাইদের হাতে বোজা ধরাবে? একদম না। তাছাড়া মাহতাব আর রোজা যাবে, তাদের সাথে না থাকলে কেমন হবে? তাই আটকে রাখলো কাজ আছে বলে বলে। আর তারই মধ্যে ঘটলো ছোটখাটো অঘটন! মা, চাচীদের পান চিবাতে দেখে মৌসুমীও শখ করে পান মুখে দিয়েছে। ভালোই লাগে মাঝে মাঝে পান চিবিয়ে ঠোঁট লাল করতে। দাদি থাকতে প্রায়ই হতো এমন ঠোঁট রঙিন করার আয়োজন৷ এখন ততটা হয় না। নতুন বউ, পান চিবায়। লোকে কি বলবে? সেই ভেবে নিষেধ করছিলো সেলিনা বেগম। হালিমা খাতুনও চাইছিলো না এখন পান মুখে দেক। তবুও সে কিছু বললো না সেলিনা বেগমের নিষেধাজ্ঞায় মৌসুমী জেদ করছিলো বলে। ঠোঁট রঙিন তো হলো ঠিক, কিন্তু পানের পিক শুরুতেই গিয়ে ফেললো আজমাইনের পায়ে! হালিমা খাতুনের চেয়ার ধরে পিছু দাঁড়িয়ে থেকে সে-ও পিক ফেলতে মুখ ঘুরিয়েছে, আজমাইনও এসে দাঁড়িয়েছে মাকে জিজ্ঞেস করতে কখন বাড়ি যাবে। তা আর জিজ্ঞেস করা হলো না। মৌসুমীকে বলি দিতে উঠে পড়ে লাগলো। যদিও বিয়ে বাড়িতে এতো মানুষজনের সামনে সেটা অসম্ভব। মৌসুমী পিক ফেলার পরপরই থমকে গিয়ে ছুটেছে সোজা ফুপুর ঘরে, আজমাইনের ভয়ে। দরজার সামনে গিয়ে হাসতে হাসতে লুটিয়ে যায় সে। যেন অনিচ্ছাকৃতভাবেই একটা প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেলো তার উপর। এদিকে আজমাইন যেন চোখে গিলে খাচ্ছিলো তাকে। পা এবং জুতো তো রঙিন হয়েছেই, সাদা প্যান্টেরও নিচের দিকটায় ছিটা দাগ পড়ে গেছে। হালিমা খাতুনের সান্ত্বনায় এবং বাড়ি ভর্তি মেহমানের জন্য এ যাত্রায় মৌসুমীর রক্ষা। বাড়ি ফেরার সময় রিকশা ভ্রমণের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে মৌসুমীর। কিন্তু নিস্তার নেই। উক্ত ঘটনার জন্য যে আজমাইন তাকে পানের মতো পিষে চিবিয়ে খাবে আজ, সেই ভয় তার মনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করছে। যখন বুঝতে পারলো আজমাইন বাইরে ঘুরেফিরে ভুলেই গেছে সেই ইতিহাস, তখন থেকে একটু স্বাভাবিক চলাচল করতে লাগলো। রাতে একটু দেরি করেই ঘুমাতে গিয়ে শুরু হলো আরেক কাণ্ড! আজমাইন তার আগেই এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। গতরাতে ভুলে গিয়েছিলো ভুতের ব্যাপারটা। আজ ঘুমাতে এসে মনে হতেই চোখে ঘুম নামছে না তার। অপেক্ষা করতে লাগলো ঘটনা বুঝে উঠার। কিছুক্ষণ পর থেকে ঠিকই নড়চড় শুরু হলো আজমাইনের। ঘনঘন নয়, থেমে থেমেই একটু পরপর এদিক সেদিক কখনো হাত, কখনো পা রাখছে। কখনোবা ধাক্কা লাগছে মৌসুমীর দেহে। মৌসুমী চোখ-কান খাড়া রেখে তার নড়াচড়া দেখছে। নিরব রাতের নিরিবিলিতে যেন এই নড়াচড়াকে তার সত্যি সত্যিই ভুতের ধাক্কা মনে হচ্ছে। মনের ভেতর ভয় জন্মাচ্ছে। আসলেই তো ভুতের ভর আছে তার উপর। এই ভুত থেকে তো মুক্তি নেওয়া দরকার। কখন না আবার তার বরটাকেই জ্বালাতন করতে করতে মেরে ফেলে! ভয়ে ভয়ে সে হাত বাড়িয়ে খাটের ঝাড়ুটা হাতে নিলো। সে জানে, ঝাড়ুর আঘাতে ভুত প্রেত দূর হয়। একটু ট্রাই করে দেখা যাক এতে কাজ হয় কি না। যেই ভাবা, সেই কাজ! আজমাইন পুনরায় নড়তেই উঠে বসে ঠাসঠাস দুইটা মেরে বসলো! ঝাড়ুর আঘাতে ঘুম ভেঙে গেছে আজমাইনের। কি হলো তার শরীরের উপর, বুঝতে একটু সময় লেগেছে। ঝাড়ু হাতে মৌসুমীকে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে কটাক্ষ চোখে তাকাতেই মৌসুমী আগের চেয়েও জোরে আরও দুইবার আঘাত করে ফেললো। কারণ, তার মনে হচ্ছে আজমাইনের দেহে ভর করা ভুত রেগে গিয়ে এমন করে তাকিয়েছে তার দিকে। তাই উত্তমমধ্যম আঘাত করা দরকার এই ভুতকে!
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ১৯
(নূর নাফিসা)
.
.
পরবর্তী দুই ঘা দেওয়ার পর আজমাইনই হতম্বিত হয়ে গেলো। হুটহাট উঠে বসে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো ঝাড়ু হাতে বসে থাকা মৌসুমীর দিকে। তার আবার কি হলো? মারলো কেন তাকে? মাঝরাতে ভুতে ভর করেনি তো? মৌসুমী ভাবছে আরও দিবে কি না। যে আজমাইন বসে আছে, সে কি খাঁটি মানুষ? নাকি ভুতের ভরে চ্যাপ্টা মানুষ? আজমাইন কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো,
“মারলি ক্যা?”
মৌসুমী দুইবার ঘনঘন পলক ফেলে বললো,
“আমি জানি, তুই শাকচুন্নি। আমার বরের উপর ভর করে আমার জায়গা দখল করতে আইছোস। আমি থাকতে এতো সহজেই পারবি নাকি? এই ঝাড়ু দিয়া তোরে আজকে বাপের বাড়ি পাঠামু। আমার বরের উপর নজর দিতি? আমার সতীন হওয়ার সাধ জাগছে? আজ তোর একদিন, আমার এক রাত।”
ব্যাপারস্যাপার এবার দোল খেলো আজমাইনের মাথায়। মৌসুমী আবার ঝাড়ু উঠাতেই সে হাতে ধরে ফেললো।
“দাঁড়া। শাকচুন্নির সাথে লড়তে আইছোস, না? আমার উপর থেকে শাকচুন্নির নজর উঠাবি ঝাড়ু মাইরা? খড়কুটো ছড়ানো ভিটা পাইছোস আমার শরীর? যেমন ইচ্ছে তেমন ঝাটা মাইরা যাবি? তোরে শাকচুন্নির নজর দেখাইতাছি।”
দুইহাতে ঝাড়ুর দুই দিকে শক্ত করে ধরে এক আড়িতে মাঝখান থেকে শলা গুলো ভেঙে ফেললো আজমাইন। ভাঙা ঝাড়ু মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে মৌসুমীর চুলের মুঠি খাবলে ধরে পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো। তারপর ছেড়ে দিয়ে বললো,
“এই হচ্ছে শাকচুন্নির খেলা। কেমন লাগলো?”
মৌসুমী ভ্যাঁ করে কান্নার আওয়াজ তুলে রেখে নেমে গেছে বিছানা ছেড়ে। চুলগুলো মনে হচ্ছে এক টানে সব ছিঁড়ে গেছে। এতোটাই ব্যাথা লাগছে। পিঠের হাড় বোধহয় ভেঙেই গেছে। এতোটাই ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। আজমাইন রগরগে চোখে তাকিয়ে বললো,
“বের হো আমার ঘর থেকে। নইলে ব্যাটটা দেখছোস? ওইটা দিয়া মাথা ফাটামু। কাশেম মোল্লার বউয়ের মতো উঠানে গড়াগড়ি দিয়া কান্না করবি। শালী! আমারে আইছে ঝাড়ু দিয়া মারতে। চামড়াটা কাইটা ফেলছে!”
“থাকতাম না তোর ঘরে। শয়তান, ইতর…”
গালাগালি করে “ই…” শব্দযোগে কাঁদতে কাঁদতেই বেরিয়ে গেলো মৌসুমী। দাদাজানের ঘরের দিকে এগিয়ে ডাকতে গিয়েও থেমে গেলো। এসেছিলো বিচার দিতে। এখন মনে উঁকি দিলো, কি বিচার দিবে? দোষ তো সে-ই আগে করেছে। ঝাড়ু দিয়ে না মারলে তো এই মাইরটাও খেতে হতো না। বিচার দিতে গেলে তো এখন তার বিচারই আগে হবে। মিথ্যা বলেও লাভ হবে না। আজমাইন সত্যিটা ঠিক বলে দিবে। তার দোষ মোটেও চাপা থাকবে না। ধ্যাৎ! কেন গেলো মারতে? পেছনে ফিরে যেতে গিয়ে দেখলো আজমাইনের ঘরের দরজা বন্ধ! মাত্রই বন্ধ করেছে। তাকে হুমকিও দিয়েছে,
“আয় খালি আবার!”
সে আর যাবে কোন মুখে? যেই গালি দিয়ে এসেছে, এখন গেলে আবার মারবে নিশ্চিত। মৌসুমী তাদের ঘরেই চলে গেলো। এপাশের ঘরটা খালিই পড়ে আছে। দরজাও তাদের বাকি দুই রুম থেকে আলাদা। ওপাশের দুইটা একত্রিত করা। একটাতে বাবা-মা থাকে, আরেকটায় মমো আর সিয়াম থাকে। বিয়ের আগ পর্যন্ত মমো আর সে এই ঘরে থাকতো। ছিটকিনি খুলে নিজের ঘরে চলে গেলো মৌসুমী। দরজা লাগিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম দিলো। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, দরজায় কোনো শব্দ হলো। চোর টোর এলো নাকি? ভেবে কান সজাগ করে রাখলো মৌসুমী। উঠে দেখলো, দরজা ঠিকভাবে লাগিয়েছে কি না। ঠিকই আছে। পরক্ষণে আর কোনো শব্দ না পেয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে হুশ নেই। সকালে ঘুম ভাঙলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো বাইরে থেকে আটকানো। বেশ কয়েকবার টেনেও যখন খোলার উপায় হলো না, নিশ্চিত হলো কেউ দরজা আটকে দিয়েছে। কে আর হবে? ওই শয়তানটাই হয়তো রাতে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেছে। তাই শব্দ শুনতে পেয়েছিলো তখন। সে জানালা খুলে উঠুনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ওপাশে হালিমা খাতুনকে দেখে চেঁচালো,
“বড় মা, ওই বড় মা। দরজাটা খুলে দিয়া যাও তো।”
হালিমা খাতুন ডাকের অনুসন্ধানে এদিকে ফিরে জানালা দিয়ে মৌসুমীকে হাত নাড়তে দেখে আবার আজমাইনের ঘরের দিকে তাকালো। সেই ঘরের দরজা বন্ধ। সে তো ভেবেছিলো, আজমাইনের মতো সে-ও আজ বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছেই। তাই সকাল থেকে দেখা যায়নি, দরজাও বন্ধ। এই মেয়ে এই ঘরে কেন? তা-ও দরজা বন্ধ করা! হালিমা খাতুন এগিয়ে এসে বললো,
“দরজায় তো তালা দেওয়া! তুই এই ঘরে ক্যা?”
“কি! তালা লাগায় দিছে ওই বিলাইর বাচ্চা!”
এদিক থেকে সেলিনা বেগম শুনে বললেন,
“এই, বিলাইর বাচ্চা কস কারে? তোর আব্বা তালা লাগাইছে। খাড়া, চাবি নিয়া আইতাছি।”
মৌসুমী জিভ কেটে মুখ চেপে ধরেছে। না জেনে, না বুঝে, বাবাকে গালি দিচ্ছে সে! সেলিনা বেগম তালা খুলে দিয়ে বললেন,
“তুই এই ঘরে ক্যা?”
“আগে কও, আব্বা তালা লাগাইছে ক্যা?”
“সন্ধ্যায় তালা দিতে মনে নাই। চোর টোর আইলে আবার। তাই মাঝ রাতে যখন উঠছে, হঠাৎ মনে হওয়ায় তালা দিয়া গেছে। তুই এইটার ভিতরে ঢুকলি কখন?”
মৌসুমী মুখ গম্ভীর করে বললো,
“রাতেই।”
হালিমা খাতুন বললেন,
“ওইঘরে না ঘুমাইলি?”
“তোমার পোলায় মাইরা বের করে দিছে।”
“ক্যা? মারলো ক্যা?”
ঝাড়ুর কথা মুখে আনবে কিভাবে এখন? বড় মা শুনলে তো রাগ করবেনই, তাছাড়া তার মা তো এখানেই দাঁড়ানো। শুনলেই না আবার তাকেই এখন ঝাটাপেটা শুরু করে! তাই বললো,
“কি জানি! মনে হয় তোমার ছেলেরে ভুতে ধরছে। আর নইলে গতকাল ফুপুর বাড়ি গিয়া যে পানের পিক ফেলছি না, সেইটার প্রতিশোধ নিছে।”
হালিমা খাতুন বিরক্তিকর নিশ্বাস ফেলে ফিরে যেতে যেতে বললো,
“পোলাটারে বুঝাইয়া পারি না। এতো বড় মেয়ের উপর হাত তুলতে হইবো ক্যা? বাপে যে ওইদিন চোখ গরম করলো, দৌড়ানি দিলো, গায়ে লাগে নাই নাকি? উঠুক আজ।”
এদিকে সেলিনা বেগম মৌসুমীকে হালকা বকে গেলো,
“না করি একশো বার, খোঁচাখুঁচি করিস না। তুই কি তার লগে পারবি? সে হইছে পোলা মানুষ। সিয়াম একটা কিল দিলেই ত্যাড়া হইয়া যাস, আবারও আজমাইনের লগে যাস খোঁচাইতে। মাইয়া মানুষ, বড় হইছোস, বিয়া দিয়া দিছি। আর বুঝবি কবে?”
“এই, তুমি জানো আমি খোঁঁচাখুঁচি করছি? খালি বেশি কথা।”
“না, আমি চিনি না তো তোরে। আজমাইন তো পাগল হইয়া গেছে কারণ ছাড়া তোরে মারতে। যারে তারে দেখলে খোঁচা না দিলে তো পেটের ভাত হজম হয় না তোর। তারপরে ইচ্ছামতো খাইয়া আইয়োছ।”
“তুমি সারাজীবন আমারে দোষী বানাইয়া রাখো, এইটা আমি ভালোই জানি।”
“দোষী রে দোষী কইতো না। ধোয়া তুলসীপাতা!”
বিরক্তি নিয়ে হাতমুখ ধুতে চলে গেছে মৌসুমী। পরক্ষণে সংসারের কাজে হাত লাগালো। রান্নাবান্নার কাজ সেড়ে ফেলেছে বড় মা এবং রোজা। বাড়িঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে ফেললো মৌসুমী। পরপরই দাদাজানকে সাথে নিয়ে মাহতাবকে বাড়ি ফিরতে দেখা গেলো। নানা নাতি হাটতে বের হয়েছিলো সকাল সকাল। একসাথেই তাদের নাস্তা নিয়ে দিলো রোজা এবং মৌসুমী। এদিকে গত রাতেই সেলিনা বেগম এই পরিবারকে দাওয়াত করে রেখেছেন। গতকাল মরিয়মকেও বলে এসেছেন আজ দুপুরে তাদের বাড়ি এসে খাওয়ার জন্য। মাহতাব যখন আছে, দুই জামাইয়ের আপ্যায়ন একসাথেই হয়ে যাক। আজমাইন ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করতে রান্নাঘরে এলেই হালিমা খাতুন শাসাতে লাগলেন মৌসুমীকে মেরেছে কেন? মেরে মেরে রাতে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, লোকে শুনলে হাসবে না? তার চাচা চাচীই বা কি মনে করবে? বিয়ে কি খেলাধুলা? এখনো কি জ্ঞান বুদ্ধি বাড়েনি? এসব কি হচ্ছে? বিচার দিবে নাকি আবার তার বাবার কাছে?
এতো এতো শাসানিতে আজমাইন খেতে খেতে বিরক্তবোধ করে বললো,
“তোমার মৌটুসীরে গিয়া জিগাও আগে সে কি করছে।”
রাগান্বিত গরম চোখে ক্ষেপে গিয়ে হালিমা খাতুন বললো,
“কি করছে সে?”
“ঝাড়ু দিয়া মারছে আমারে।”
“ক্যা? ঝাড়ু দিয়া মারছে ক্যা? পাগল হইয়া গেছে।”
“হো, গেছে। এইজন্যই বের কইরা দিছি। পাগল টাগল ঠাঁই নাই আমার ঘরে। ঘুমায় রইছি, অযথা ঝাড়ু দিয়া পিটান শুরু করছে। কেমনডা লাগে! তারে যে দা দিয়া কোপাই নাই, ওইটাই তো বেশি।”
“আবার! আর একদিনও যেন তোরে না দেখি কোনো কারণে কারো উপর হাত তুলছোস। যে কোনো পোলাপানের উপরই তোর হাত খুব নড়ে। বড় মানুষ, সম্মানের জায়গায় বইসা থাকবি। হাত নড়বো ক্যা? ছোটরা কি শিখবো? আর মৌসুমী এতো বড় মাইয়া হইছে, তুই তার গায়েই হাত তুলবি ক্যা? মাইয়া মানুষ দোষ করলেও তো তার উপর হাত তুলতে লজ্জা হওয়া উচিত।”
“হো, আমারে পিটাইবো আর আমি ছাইড়া দিমু।”
কথা শুনতে শুনতে এবং জবাব দিয়ে ফটাফট খেয়েদেয়ে বেরিয়ে গেলো আজমাইন। বারান্দায় থেকে মৌসুমী সবই শুনে একটু ভরকে গেছে। অবশেষে বলেই দিলো, সে ঝাড়ু দিয়ে মেরেছে! ধ্যাৎ! নিজে মাইরের ব্যাপারে না বললেই হতো তখন। হালিমা খাতুনও চুপ করে রইলেন। আসলেই কি তা-ই? মৌসুমীকেও একা একা জিজ্ঞেস করে বুঝাতে হবে তবে। এতো ছেলেমানুষী করলে হয়? বড় হয়েছে তো তারা। এদিকে আজমাইন গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সেলিনা বেগম শুকনো পাতার ডালা হাতে সামনে পড়লেন। আজমাইনকে বিশেষভাবে দাওয়াত করার উদ্দেশ্যে বললেন,
“আজ দুপুরে কিন্তু তোমার দাওয়াত, বাবা। কোনোদিকে যাইয়ো না।”
“কিসের দাওয়াত, ছোট মা?”
“বা রে, নতুন জামাই। দাওয়াত খাইবা না শ্বশুর বাড়ি? মৌলভী দাওয়াত করছি দুপুরে।”
“আমার আজকে খেলা আছে। দুপুরে আমি থাকতাম না।”
তৎক্ষনাৎ রান্নাঘর থেকে বারান্দায় এসে হালিমা খাতুন উঁচু গলায় বললো,
“এই, কোনো খেলা মেলা নাই। দুপুরে যেন তোরে বাড়িতে দেখি। নইলে তোর বাপের রূপ ভালো কইরা দেখিস।”
মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবার সেলিনা বেগমকে বললো,
“আচ্ছা, যাও। আমার খাবার রেখে দিয়ো। রাতে দাওয়াত খামু।”
চলে গেলো আজমাইন। সেলিনা বেগম পাতার ডালা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
“হায়রে খেলা!”
মৌসুমী কুটিকুটি হেসে বললো,
“তোমাদের স্পেশাল জামাই বাসি খাবার খাইতে পছন্দ করে মা। তার খেলাধুলা কেবল টাটকা হওয়া চাই।”
চলবে।