“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ২০
(নূর নাফিসা)
.
.
খেলতে গেলেও দুপুরেই বাড়ি ফিরতে পেরেছে আজমাইন। তবে একটু দেরি হয়ে গেছে। আরও কিছুক্ষণ আগে এলেই হয়তো দোয়া পড়তে পারতো মৌলভীর সাথে। সে যখন গেইট দিয়ে ঢুকে, মৌলভী তখন আমজাদ আলীর সাথে বের হয়। মলিন মুখে একটা সালাম দিয়ে সামনে দিয়েই বাড়ির ভেতরে এলো আজমাইন। সেদিনের ফাইনাল খেলাটা যেন কুফা হয়ে গেছে তার কাছে। আজ সামান্য একটা ম্যাচেও জিততে পারেনি। মৌসুমী বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললো,
“আইছে এক শয়তান। হুজুর বাড়ি থেকে বের হইলে শয়তান ঢুকে।”
স্পষ্ট শুনতে না পেলেও আজমাইনের মনে হলো সে বিড়বিড় করলো। থমথমে মুখে একবার তার দিকে তাকিয়ে ঘরে চলে গেলো চুপচাপ। গোসলের জন্য কাপড়চোপড় নিয়ে বের হলো। ঘরটা বেশ পরিচ্ছন্ন লাগছিলো। তবে ততটা নজর তখন দেয়নি। বের হওয়ার পর যেন মনে হলো। গোসল শেষে গামছায় মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে চাচাদের বাথরুম থেকে ধোয়া থালাবাটি হাতে মৌসুমীকে ঘরের দিকে যেতে দেখে বললো,
“এই, এদিক আয়।”
“ক্যা?”
“কাজ আছে।”
“আমি এখন কাজই করতাছি। সময় নাই।”
“আবার বলে সময় নাই! এদিকে আয়!”
আজমাইনের ধমকে সামান্য বিরক্ত হয়ে এগিয়ে গেলো মৌসুমী,
“কি?”
“তুই না আমার বউ?”
“তো?”
“গোসলখানায় লুঙ্গি রাখছি। কেঁচে দে।”
মৌসুমী লম্বা সুর টেনে বললো,
“ই…শ! বউ! কাজের সময় বেডা তোমার বউ মনে পড়ে, মাইরের সময় মনে পড়ে না?”
“বউ দেইখাই তো মারি। অন্যের বউরে মারছি? যা, তাড়াতাড়ি কেঁচে দে। রোদ পইড়া গেলে শুকাইতো না।”
“পারতাম না। এতো ঠ্যাকা পড়ে নাই। নিজের কাজ নিজে করতে শিখো। তোমার মতো শয়তানের কাজ কইরা আমার কোনো লাভ না।”
বলতে বলতে চলে গেলো মৌসুমী। আজমাইন পেছন থেকে বললো,
“তাইলে সারাদিন এই জায়গায়ই পড়ে থাকবো।”
“থাকুক, আমার কি?”
“তাইলে তোর সব জামাকাপড়ও এইটার সাথে ভিজে থাকবো।”
“তোমার খবর আছে আজমাইন। আমি বড় মার কাছে বিচার দিতাছি, খাড়াও। এতোক্ষণে বাড়ি আইছো যে, তার হিসেবই আগে দিয়ো।”
“তুই আবার আমার নাম ধইরা ডাকলি?”
মৌসুমী কুটিকুটি হেসে ঘরে প্রবেশ করলে আজমাইনও নিজের ঘরে চলে এসেছে। সরিষার তেল নিয়ে শরীরে ঘঁষতে ঘঁষতে এবার ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলো ঘরটা গোছানোই আছে। কে গুছিয়েছে? আপু? নাকি মৌসুমী? যাক, একজন হলেই হলো। ঘর গোছানো থাকলে সুন্দরই দেখায়। এতে মনটাও ভালো হলো। খেলার মন্দাভাব দূরে চলে গেলো। পরার জন্য গুছানো আলনা থেকে আকাশী রঙের পাঞ্জাবিটাই নিলো। চিরুনি কোথায় রেখেছে, না পেয়ে হাতেই চুল চিরুনি করে মৌসুমীদের ঘরে গেলো। সবাই এখানেই আছে। কেউ এই রুমে, কেউ সেই রুমে। আজমাইন ঘরে এসেই চাচীমাকে বললো,
“ছোট মা। খাবার দাও। ক্ষুধা লাগছে।”
পাঞ্জাবি পরাতে সুন্দরই দেখাচ্ছে আজমাইনকে। তবে মৌসুমীর একটু উপহাস না করলেই নয়,
“ওই দেখো, বড় মা। আমাদের বিলম্বিত লম্বা হুজুর এতোক্ষণে আইছে। আবার মোনাজাত ধরো।”
আজমাইন পাশের রুমে যেতে যেতে বললো,
“কথা কম বইলা খাবার নিয়া আয়। আমি মনে মনে মোনাজাত করে নিছি।”
মরিয়ম এবং সেলিনা বেগম হাসলেও তার ফাজলামোতে ক্ষেপানো চোখে তাকালেন হালিমা খাতুন। এখানেই মোড়ায় বসে খাচ্ছেন মোয়াজ্জেম আলী। আজমাইনকে তিনি পাশের রুমে গিয়ে খেতে বসতে বললেন। পাশের রুমে সিয়াম, মমো, রোজা এবং মাহতাব খেতে বসেছে। আহমদ আলী এখানেই চেয়ারে বসে আছেন। মৌলভীর সাথেই খাওয়া হয়ে গেছে তার এবং বড় ছেলের। আজমাইন আরেকটা চেয়ার টেনে বসে এক টুকরো শসা নিয়ে মুখে দিলো। পরক্ষণে নিলো এক টুকরো গরুর মাংস। মৌসুমীকে ডাকলো প্লেট নিয়ে আসার জন্য। মাহতাব বললো,
“আজমাইন সালাদ থেকে একেবারে গরুর মাংসতেই হাত দিলে? মাছ, মুরগির পর্বও তো ছিলো মাঝে। আর মাংসই যখন নিবে সালাদের নাম নেওয়ার কি দরকার ছিলো?”
রোজা মুখ চেপে হেসে বললো,
“শুরুতে সালাদ নেওয়া ফর্মালিটি।”
“তা-ই তো দেখছি।”
আজমাইন জবাব দিলো,
“একটা খাইলেই হইছে। সব পেটেই যাইবো।”
“এই হাড়টা তোমার জন্য রেখেছি।”
“এইটা দাদাজান রে দাও। বেচারা বইসা বইসা তাকায় আছে। সময় কাটবো ভালা।”
আহমদ আলী জবাব দিলো,
“তোর লোকমা গুনতে বইসা রইছি। হাড় তুই খা। তোর যৌবনের পোক্তা দাত। আমি খাইতে খাইতেই বুড়া হইছি।”
“ঠিক আছে। তুমি দেখো তবে।”
মৌসুমী দুইটা প্লেট নিয়ে এসে আরেকটা চেয়ার টেনে বসলো। আজমাইনকেও খাবার দিলো। নিজের জন্যও প্লেটে নিলো। আজমাইন বললো,
“এই হাড়টা আমার জন্য রাখিস। বড় ভাই খাইতে বলছে যখন, পরে খামু। এখন খাওয়ার ধৈর্য্য নাই।”
“পরে বলতে কিছু নাই। এখনই ধৈর্য্য সঞ্চয় করে খাও।”
এদিকে মৌসুমীকে খেতে বসতে দেখে রোজা বললো,
“আজমাইনের অপেক্ষায় বসে ছিলি নাকি? এতোক্ষণ বললাম, খেতে বসলি না।”
মৌসুমী লজ্জাময়ী হেসে বললো,
“হো।”
মাহতাব খাওয়ায় মনযোগ রেখেই বললো,
“মহব্বত।”
কিন্তু প্রকাশিত এই মহব্বত দেখার কোনো সময় মহব্বত আলীর নেই। প্লেটে খাবার দেওয়ার পরই সে খাওয়ায় ব্যস্ত। তাতে কোনো আক্ষেপ নেই মৌসুমীর। সে যে এই দুষ্টু মহব্বত আলীকে ভালোবাসতে পারে, এটাই যেন তার সার্থকতা। খাওয়া শুরু করেছে রোজা এবং মাহতাবের অনেক পরে, অথচ উঠেছে একত্রে। এমন গপাগপই চলে তার খাওয়া। মৌসুমীও উঠে গেছে পরপরই। তবে তার খাওয়া হয়েছে অল্প। তৈলাক্ত খাবারের ঘ্রাণে ঘ্রাণেই যেন অর্ধপেট ভরে গিয়েছিলো। খাওয়া শেষে রোজা ও মৌসুমী মিলেই এপাশের আসবাব গুটিয়ে ফেললো। দই মিষ্টি দিলো মাহতাব এবং আহমদ আলীকে। আজমাইনটা এখানে নেই। তাই একটা প্লেটে তার জন্য তিন রঙের তিনটা মিষ্টি নিয়ে গেলো মৌসুমী তাদের ঘরে। আজমাইন ততক্ষণে পাঞ্জাবি খুলে ফেলেছে। তাই সে বললো,
“শ্বশুর বাড়ি বেড়ানো শেষ বলে পাঞ্জাবি খুলে ফেললে? নাও, মিষ্টি খাও। তুমি তো খালি হাতেই দাওয়াতে চলে গেলে।”
“এই মিষ্টি কে নিছে?”
“এইটা আমার শ্বশুর আব্বা নিছে। আর আমার দুলাভাইও নিছে। তুমি জামাই হইয়া কিছুই নেওনি।”
“আব্বারটাই আমার।”
“সেইটা মিষ্টিতে লেখা নাই। তোমার হাতে কইরাও ওই ঘর পর্যন্ত যায় নাই।”
“উইড়া গেলেও গেছে।”
মৌসুমীর হাতে প্লেট রেখেই টুপটাপ দুইটা মিষ্টি মুখে পুরে নিলো। মৌসুমী বললো,
“আর খাইবা না?”
“না।”
“দই খাইবা?”
“না। পেটে জায়গা নাই।”
“কাজের বেলায় খুব তো বউ বউ করো। এখন মিষ্টি করে ভালোবেসে কি এই মিষ্টিটা বউকে খাওয়ায় দিতে পারো না? ফেরত কেন দিতাছো? দাও, এক্ষুনি খাওয়ায় দাও।”
আজমাইন মিষ্টিটা হাতে তুলে টুপ করেই নিজের মুখে দিয়ে ফেললো। ভরো মুখ নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“যা, দিলাম না ফেরত।”
মৌসুমী রেগে হনহনিয়ে বের হতে হতে বললো,
“বেদ্দপ পোলা! খালি কইছ আবার লুঙ্গি ধুইয়া দিতে, গেঞ্জি ধুইয়া দিতে।”
আজমাইন আরেকটু জ্বালিয়ে দিতে বললো,
“পানের পিক ফেলা প্যান্টটা ধুইছিলি?”
“তোরে ধুইয়া দিমু, তোরে। তোরে ধুইয়া এই রশিতে চব্বিশ ঘণ্টা লটকায় রাখমু।”
“তুই আয় খালি আবার আমার ঘরে।”
বিকেলটা তার ঘুমে কাটলেও বাকি বাচ্চাদের কেটেছে রোজা এবং মাহতাবের সাথে নদীর পাড়ের চড়ে ঘুরতে ঘুরতে। বাড়ি ফিরেই দায়িত্ববান বউ সকলের কাপড়চোপড় নিয়ে যার যার ঘরে গুছিয়ে রেখে এলো। মাগরিবের আজান পড়ে যাচ্ছে। পরক্ষণেই মনে হলো আজমাইনের লুঙ্গি ধোয়া হয়নি৷ বড় মা কিংবা আপু তো জানেই না লুঙ্গি রেখে এসেছে। সেটা ধুয়ে বারান্দায় নেড়ে দিলো মৌসুমী। হালিমা খাতুন চিতুই পিঠার আয়োজন করছে। তবে এক্ষুনি বানাবে না। ইশারের পরপর বানাবে। যেন গরম গরম পিঠার স্বাদ উপভোগ করতে পারে সবাই। নিজের ঘরে কাপড়চোপড় রাখতে এসেই দেখেছে আজমাইন ঘুমায় এখনো। এখন ঠান্ডা ভেজা হাত তার পিঠে চেপে রেখে ধাক্কিয়ে ডাকতে লাগলো,
“আজমাইন, এই আজমাইন। উঠো। মাগরিবের আজান পড়ে গেছে।”
পরপরই একহাতে কিল মেরে বললো,
“এই ব্যাটা, ওঠ! আর কত ঘুমাবি! সারাদিন খেলে এসে নেশাখোরের মতো ঘুমায়!”
তার ধাক্কায় আজমাইন জেগে গেলেও সাড়া দেয়নি তখন। এখন খপ করে হাত টেনে নিয়ে মচকে ধরতেই চিৎকার করে উঠলো,
“ওই মা! ওই আল্লাহ! ওই, ছাড়ো ছাড়ো! মরে গেলাম।”
ওপাশে হাত টেনে নেওয়ায় তার উপর পড়ে থেকেই চিৎকার করছে মৌসুমী। সদ্য ঘুমভাঙা জড়ানো কণ্ঠে সে বললো,
“আরেকবার ডাক আজমাইন।”
“না, না।”
“আমি তোর নানা না। আজমাইন ডাক, আজমাইন।”
“এই জীবনে আর ডাকতাম না।”
“তোর জীবন এক সেকেন্ডও টিকে না। প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে তোর নতুন জীবন আসে।”
“আল্লাহ গো! আমার হাত ভাইঙ্গা ফেললো!”
“আজমাইন ডাক।”
“তোমার পায়ে পড়ি। ছাড়ো।”
“তুই আমার হাত আর পিঠে পড়ে আছোস। পায়ে কই পড়লি?”
“না ছাড়লে ক্যামনে পড়ি?”
আজমাইন ছেড়ে দিতেই ব্যাথা নিঙড়াতে হাত ঝাড়তে লাগলো।
“শয়তান। হাতটা আমার শেষ করে দিছে। আমার ঠ্যাঙের ঠ্যাকা লাগছে তার পায়ে পড়তে।”
মৌসুমী চলে গেলে আজমাইনও আড়মোড়া ভেঙে হাতমুখ ধুতে চলে গেলো। দুপুরে এতো খেয়েও যেন ক্ষুধা লেগে গেছে। এই সন্ধ্যায় কি খাবে? রান্নাঘরের দিকে গিয়ে মাকে কাজ করতে দেখে মৌসুমীকেই মুড়ি মেখে দিতে বলে এলো। মৌসুমী বাটিতে মুড়ি নিয়ে তার জন্য আলাদাভাবে এনে রাখা সেই হাড়সহ গরুর মাংসের ঝোল এনে দিয়ে গেলো গোমড়ামুখো হয়ে। জানে এই গাধার কাছে কোনো কিছুরই মূল্য নেই, তবুও এক টুকরো অভিমান জন্মেছে হাতে ব্যাথা দেওয়ায়। তার মুখ দেখে আজমাইনের হাসি পেলো। যেন শিক্ষা দিতে পারার উল্লাস জন্মেছে তার মাঝে।
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ২১
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে পিঠার স্বাদ উপভোগ করতে মরিয়মকেও রেখে দেওয়া হয়েছে। পরদিন রোজাসহ সবাই-ই চলে এসেছে বাড়িতে। মাহতাব দুপুরেই রওনা দিয়েছে শহরের উদ্দেশ্যে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় রোজার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“আমার বউয়ের যত্ন নিয়ো। মায়ের খেয়াল রেখো। সংসার তো তোমার। সংসারের পাশাপাশি পড়াশোনায়ও মনযোগ দিয়ো। খুব বেশি সময় তো নেই পরীক্ষার। শেষটায় যেন মনযোগ উঠে না যায়।”
“ইনশাআল্লাহ। সাবধানে যেয়ো। পৌঁছে সাথে সাথেই ফুপির ফোনে কল দিয়ো।”
“ওহ্, তোমার ফোনের কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। লাগবে ফোন? একটু সময় লাগবে, ব্যবস্থা করে নিবো।”
“উহুম। আমি চিঠি লিখবো।”
মাহতাব মুচকি হেসে তার গাল স্পর্শ করে বললো,
“ঠিক আছে। তবে আমিও চিঠির অপেক্ষায় থাকবো। আসি।”
চোখের পলকে বিদায় সম্মতি দিলো রোজা। মায়ের কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে বাড়ির সীমানা ছাড়লো। রোজা পৌঁছে দিলো ঘরের গেইট পর্যন্ত। মরিয়ম পৌঁছে দিয়ে এলো বাড়ির সামনের রাস্তা পর্যন্ত। আবারও পরিচিত পথ ডিঙিয়ে ছুটে চললো কর্মস্থলের দিকে। ফিরে না আসা পর্যন্ত স্বামী, ছেলে নিয়ে ব্যস্ততার অবসান ঘটলো ঘরের রমনীদের। পরক্ষণে ঘরের টুকটাক কাজকর্মে হাত লাগালো রোজা। বিকেল হতেই চাচীকে বড় লাঠি নিয়ে মুরগি তাড়া করতে দেখে ঘর থেকে দুই মুঠ চাল নিয়ে বের হলো সে। চাচীদের মুরগির খাবারে হাক বসাচ্ছে তাই ফুসতে ফুসতে মুরগি তাড়াচ্ছেন তিনি। রোজা দুয়ারে চাল ছিটিয়ে দিতেই মরিয়মের পোষ্য মুরগি সব চলে এলো এদিকে। বাইরের কাপড়চোপড় ঘরে নেওয়ার সময় চাচীদের বারান্দায় সাইদুরের বউকে দেখতে পেলো। এর আগে আর দেখেনি সে। তবে ফুপির মুখে শুনতো, খুব সুন্দর একটা মেয়ে বিয়ে করে এনেছে সাইদুর ভাই। বিয়ে যে করেছে, তা-ও খুব বেশি সময় হয়নি। তিন-চার মাস হবে। এরমধ্যে ফুপির বাড়ি বেড়াতে আসা হয়নি তাই দেখাও হয়নি। আসলেই সুন্দর দেখতে। আসরের নামাজ আদায় করে ফুপি কোথায় যেন গেলো বোরকা পরে। তাকে বলে গেছে ঘরের খেয়াল রাখতে। এখন মাগরিবের আজান পড়ে গেছে, ফুপির খবর নেই। প্রথমবারের মতো এখানে একা ঘরে একটু অন্যরকম লাগছে। দরজা আটকে নামাজ আদায় করে সব রুমের লাইট জ্বালিয়ে বসে বসে সবজি কেটে নিচ্ছে রোজা। একটু পরেই লোহার গেইটে শব্দ এবং ফুপির কণ্ঠে ডাক এলো,
“আফরোজা? আফরোজা গো?”
“আসছি ফুপু।”
দরজা খুলতেই প্যাকেট হাতে ঘরে প্রবেশ করলো মরিয়ম। জিজ্ঞেস করলো,
“আমি যাওয়ার পরে কেউ আইছে ঘরে?”
“উহুম।”
“ভালো হইছে। খোয়ারের দরজা আটকাইছোস?”
“হ্যাঁ। এগুলো কি ফুপি?”
“এই একটু বাজার কইরা আইলাম। মাহতাব আজ না গেলে তারে দিয়াই করাইতাম। আমার একটু জরুরি ছিলো, তাই ভাবলাম আমিই যাই। ধর দেখি, নামাজটা পইরা নেই তাড়াতাড়ি।”
প্যাকেট গুলো রোজার হাতে দিয়ে চলে গেলেন তিনি। প্রতিটি প্যাকেটে উঁকি দিয়ে কোনোটায় মিঠাই, কোনোটায় আটা, কোনোটায় মুড়ির মোয়া, কোনোটায় কিছু ছোট ছোট কৌটা দেখতে পেলো। কিসের কৌটা, বুঝতে পারেনি সে। প্যাকেট থেকে বেরও করেনি। ফুপির প্রয়োজনীয় কিছু হবে হয়তো। সে আবার সবজি কাটতে বসলো। ঘরে বায়োগ্যাস আছে। পাশের বাড়ি থেকে মাসিক একশো টাকার বিনিময়ে তাদের গোয়ালের গোবর নেয় মরিয়ম। তাদের যখন গরু ছিলো, তখন নিজেদের গোয়ালের গোবরেই ভালো গ্যাসের যোগান হতো। অতিরিক্ত খরচ যেতো না। পাশের বাড়ির গুলোও হয়তো তারা ফেলেই দিতো। নিজ দায়িত্বে এনে দিয়ে যায় বলে মাসে মাসে একশো টাকা দেয়। আবার তার জমিতে ঘাস জন্মালেও তাদের দিয়ে দেয়। দৈনিক যেটুকু গ্যাস উৎপন্ন হয়, তাতেই তার রান্নাবান্না ঢের চলে যায়। মেহমান এলে বেশি রান্নাবান্নার ক্ষেত্রে বাইরে মাটির চুলায় চলে যায়। মরিয়ম নামাজ পড়ে এখানে এলো রান্নার আয়োজন করতে। হাড়িতে চাল নিতে নিতে বললো,
“ব্যাগে তোর জন্য মোয়া আনছি। খা। তোর যদি কিছু খাইতে মন চায়, সাথে সাথে আমারে বলবি। বুঝছোস?”
“আচ্ছা।”
“সাইদুরের মায় কিছু জিগাইছিলো?”
“না।”
“কিছু জিগাইলে আমারে জানাবি। বুঝলি?”
“আচ্ছা। সাইদুর ভাইয়ের বউ দেখলাম। সুন্দরই। ঘর থেকে বের হয় না বোধহয় খুব একটা।”
“খুব একটা কি? একদমই হয় না। আলো বাতাস লাগতে দেয় বুঝি গায়ে!”
“কেন, বাচ্চা হবে?”
মরিয়ম বিদ্রুপাত্মক সুর টেনে বললো,
“আরে না। বাচ্চা! চার মাস হইয়া যায়। বাচ্চার খবর আছে বুঝি? বাইর হইতে দেয় না, মনে করে বাইরে আইলেই রূপ খসে পইড়া যাইবো। তুই কিন্তু আগেভাগেই বাচ্চাকাচ্চা নিয়া নিস। আল্লাহ কার হায়াত কতদূর রাখছে, কে জানে? নাতি নাতনি দেখার খুব সাধ জাগে এই বয়সে।”
শেষটুকু নরম গলায় বলে মৃদু হাসলেন তিনি। রোজা কিছুই বললো না। চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। মরিয়ম চাল ধুয়ে চুলায় বসিয়ে পাশে এসে মোয়ার প্যাকেট খুললো। নিজে একটা নিয়ে মুখ দিয়েই বললেন,
“বাজারের মোয়া, মানে ভালা না। শক্ত। আমি তোরে বানায় দিমু নে মুড়ি, মিঠাই, মশলা দিয়া। এই মোয়া নিজে বানানো মোয়ার ধারে কাছেও যাইবো না। ধানের কাজগুলা শেষ হোক। আনছি যখন, খাইয়া শেষ কইরা ফেলবি। ওই প্যাকেটটা খুলে দেখছোস?”
“উহুম। কি এটা?”
মরিয়ম সেই প্যাকেট থেকে ছোট ছোট কৌটাগুলো বের করে তার দিকে দিয়ে বললো,
“ক্রিম। দেখ তো ডেট ঠিকঠাক আছে কি না।”
রোজা হাতে নিয়ে দেখে বললো,
“ঠিক ই তো আছে। কিন্তু এগুলো তো নাইটক্রিম দেখা যাচ্ছে।”
“হো, লাইট ক্রিম অই।”
“লাইট না। নাইট ক্রিম।”
“ওই একটা হইলেই হইলো। তোর জন্যে আনছি।”
“কিন্তু আমি তো এইসব ব্যবহার করি না, ফুপু। আমার ব্যবহারের স্নো, পাউডার, লোশন সবই আছে ঘরে।”
“এইগুলা দামি বেশি। ভালা বেশি। ব্যাডারে কইছি সবচেয়ে ভালা, এক নাম্বারটা দিতে। বাজারের বড় দোকান থেকে আনছি। প্রত্যেকদিন রাইতে দিয়া ঘুমায় থাকবি। সকালে উঠে মুখ ধুইয়া ফেলবি।”
“এসব দিলে চেহারা নষ্ট হয়ে যায়, ফুপু।”
“বেশি বুঝিস না। তুই দিছোস কোনো সময়?”
“না।”
“তাইলে? স্কুল কলেজে পড়ছ, একটু আধুনিক হবি। ঢাকার সব মাইয়ারা এইসব দিয়া সুন্দর হইয়া যায়। তুইও দিবি। ত্বক সুন্দর থাকবো। দোকানদারেও কইলো, মুখ পরিষ্কার থাকে। মুখের ময়লা কাটে। সাইদুরের ঘরে গিয়া দেখি, এত্তো কৌটা দিয়া ডেসিং টেবিল ভরা। সব দেয় বউয়ে। এমনে এমনেই কি সুন্দর হইয়া রইছে?”
“ড্রেসিং টেবিল।”
“হো। সেইটাই। ঠিকঠাক দিস।”
রোজা ভালোমন্দ কিছুই বললো না। তার এসব ব্যবহারের ইচ্ছে নেই। সে দেখে দেখে প্যাকেটে রেখে দিলো। ফুপু বোধহয় খুব করে চাইছে তার উজ্জ্বলতা আরও বেড়ে উঠুক। রান্নাবান্না শেষে একটু পড়তে বসেছিলো রোজা। খুব বেশি পড়াও হয়নি। ভালো লাগছে না আজ পড়তে। কিছুক্ষণ আগে মাহতাব কল করে জানিয়েছিলো সে ঠিকঠাক পৌঁছেছে। এখন মাহতাবকেই মনে পড়ছে তার। আবার পরিবারকে নিয়েও ভাবছে। একা একা থাকলে ভাবনারা যেমন পিছু নেয় আরকি। পরক্ষণে ফুপুর সাথে খেয়েদেয়ে আজ ফুপুর রুমেই দুজন একসাথে ঘুমালো। ঘুমানোর আগে ক্রিমও মেখে নিতে হলো।
দুই বাড়িতেই আবার ধানের ব্যস্ততা জেগে উঠলো। বিয়ের আয়োজনের জন্য তুলে রাখা অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হলো প্রত্যেকে। দু সপ্তাহও পুরোপুরি নেই, আমজাদ আলী চলে যাবেন। তার আগে আগেই এই কাজগুলো শেষ করা দরকার। নিয়মিত রোদে ধান মেলে দেওয়া, আবার বেলা শেষে গরম গরম ধান তুলে চটের বস্তায় ভরা একটা রুটিনমাফিক কাজ হয়ে গেলো। হেমন্ত কেটে বায়ু বলে শীত নামতে শুরু করেছে। এসময়ে বৃষ্টি খুব একটা হয় না। তাই ভালোয় ভালোয় ধানগুলো শুকিয়ে নিতে পেরেছে। ধান শুকানোর কাজ শেষ হলে সারাদিন ব্যাপী বাড়ির বাইরে সেই ধান শুকানোর মাঠে ধান ভানার কাজ চললো আজ আমজাদ আলীর। মেশিনের লোককে বলে রাখলো আগামীকাল আবার মোয়াজ্জেম আলীর ধান ভেনে দিতে। ধানের কাজের এই সময়টা বেশ উপভোগ করে মৌসুমী। ওড়নার আঁচল কোমড়ে ভালোভাবে বেঁধে বাতাসের তালে তালে চাল উড়ানোর কাজ তার ভীষণ প্রিয়। মায়েরা কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুজে দেয়। দুইহাতে বেতের কুলায় চাল তুলে শূন্যে ছেড়ে দিয়ে ছমছম শব্দে চালের স্তুপ দেওয়া চোখ জুড়ানো সুন্দর একটা সৃষ্টি। দেখতে ভারি মিষ্টি লাগে। খুব আহ্লাদ নিয়ে বরাবর রোজা আপুর সাথে এই কাজে এগিয়ে আসে মৌসুমী। এবার রোজার অভাবটা হয়তো উপলব্ধি করতে হবে অনেক ক্ষেত্রেই।
চলবে।