সোনালী আলোর ঘ্রাণ পর্ব-৩৮+৩৯

0
413

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৩৮
(নূর নাফিসা)
.
.
শুক্রবার ছুটি পেয়ে দুপুরের পর একা ঘুরতে বের হতে যাচ্ছিলো আজমাইন। মাহতাব দেখতে পেয়ে বললো,
“কোথাও যাচ্ছো, আজমাইন?”
“না, এইদিকেই।”
“চলো, তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় ঘুরতে যাই।”
“কোথায়?”
“জাদুঘরে।”
“জাদুঘরে যাওয়ার কি দরকার? আমিই কত জাদু জানি। আমাদের গ্রামেই কত কঠিন জাদুকর আছে। মেয়ে পছন্দ হওয়ার পর একজন খালি বলবো, মেয়ে বিয়ে দিতো না। তারে দুচারদিনের মধ্যেই বশ কইরা ফেলবো। ঘ্রাণে ঘ্রাণেই মেয়ে শ্বশুর বাড়ি হাজির!”
মাহতাব হাসলো।
“এই জাদু সেই ঘরে হয় না। ওটা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।”
কথা শেষ না হতেই আজমাইন আবারও দুষ্টু মন্তব্য করলো,
“তাই নাকি! ওই ঘরে জাদু করে করেই তবে মিলিটারি দৌড়াইছে? দাদাজান যে রাইফেল নিয়া ঘুরলো, ওসব কি ফ্যাশন?”
মাহতাব না হেসে পারলো না। আবারও হাসলো।
“আরে বোকা। ফ্যাশন না। ওটাই প্রকৃত যুদ্ধ ছিলো। আর ওই জাদুঘরে যুদ্ধভিত্তিক ছবি এবং সরঞ্জাম রাখা আছে। দেখার জন্য যাবে। ভালো লাগবে। চলো।”
আজমাইন পড়লো বিপাকে! তার তো একটা কাজে যাওয়ার দরকার ছিলো। আবার ঘুরাফেরার নেশাও প্রখর। মহল্লা তো কাছেই। যখন তখনই যাওয়া যাবে। তাই বড়ভাই যখন বলছে, জাদুঘর দেখতেই যাওয়া যাক। চলে গেলো মাহতাবের সাথেই। সময় পেলে প্রায়ই এদিক সেদিক ঘুরতে বের হয় মাহতাব। আজমাইনকে নিয়ে যায় সাথে। কখনো বা তার পরিচিত দুয়েকজনও সঙ্গী হয়। এইদিন ঘুরে এসে আর মহল্লার দিকে যাওয়ার সময় হয়নি। আজমাইন পরদিন সকালেই গেলো সেদিকে। পোস্ট অফিসের কর্মচারীকে নিয়েই গেলো সাথে। তাকে পথ দেখিয়ে কর্মচারী চলে গেছেন কাজের অজুহাতে। গন্তব্য পর্যন্ত যায়নি। আজমাইন একা একাই এগিয়ে গেলো। ঘরের উপর ঘর, এক চালার উপর যেন আরেক চালার ঠাঁই! সরকারি জায়গায় খুঁটি পেতে বাসিন্দারা মাথা রেখেছে যেন ছাউনির নিচে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সরু সরু রাস্তা। লোকজন চলাকালীন এই পথে একটা সাইকেল চলতেও যেন বারবার বাধাগ্রস্ত হবে। চারিদিকে কোলাহল। ন্যাংটা ছেলেপুলে ছোটাছুটি করছে, হৈচৈ করছে। কোনো কোনোদিকে কর্কশ কণ্ঠে বড়দের কথা কাটাকাটিও হচ্ছে। ঘর ঘেঁষে কোথাও কোথাও ভাঙাগড়া টয়লেট। কোথাওবা কাঁচামাটিতে টিউবওয়েলের দেখা মিলছে। পানির জন্যও লাইন ধরে, ধাক্কাধাক্কি করে জয়ী হতে হয়। দশে মিলে একটা ব্যবহার করছে। নোংরা নোংরা পরিবেশ। এতো কাছাকাছি ঘরদোর, এক ঘরের ময়লা ঝাড়ু দিয়ে ফেলতে গেলে আরেক ঘরে চলে যাবে! অথচ তাদের গ্রামের পরিবেশটা কত সুন্দর, কত পরিচ্ছন্ন, বিশুদ্ধ বায়ু প্রবাহিত হয় মৌ মৌ করে। এখানে নিশ্বাস নেওয়াও আপত্তিকর হয়ে ঠেকে। স্থান, পাত্র ভেদে কি জীবনযাত্রা চলছে এই পৃথিবীর লোকেদের!
আজমাইন আশপাশ দেখতে দেখতেই সেই মধ্যবয়স্ক লোকের ঘর পর্যন্ত পৌঁছালো। জিজ্ঞেস করে জেনে নিলো এখানে আলো নামে কেউ থাকে কি না? আলোর ঘর দেখিয়ে দিলো স্থানীয় এক লোক। মরিচাধরা টিনের বেড়া, উপরেও আধ পুরনো টিনের চালা। পঁচন ধরা কাঠের দরজায় ঝুলছে ক্ষুদ্রাকৃতির এক পুরনো তালা। আজমাইন পাশের ঘরের মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো, আলো কোথায় গেছে? মহিলা সঠিক জবাব দিতে পারলেন না। তিনি জানেন না কোথায় গেছে। হবে হয়তো আশেপাশেই কোনো প্রয়োজনে নাহয় কাজে। কখন ফিরবে, সে সম্পর্কেও কিছু বলতে পারলেন না। আজমাইন স্বেচ্ছায়ই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে এলো। ওই ঘরের তালা খুলতে দেখতে পেলো না কাউকে। পরবর্তী দিন হতে আবারও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
এদিকে বাবার বাড়ি থাকতেই রোজার হাতে মাহতাবের চিঠি এলো। রোজা তখন বারান্দায় বসে বিলি কেটে দিচ্ছে মৌসুমীর মাথায়। উকুনের সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। রাতে ঘুমের মধ্যে ঘনঘন মাথা চুলকায়। এমনি জাবেদ কাকা এসে বললেন,
“তুমি এইখানে? মরিয়ম আফার কাছে খুঁজে আইলাম।”
“আসসালামু আলাইকুম, কাকা। ভালো আছেন?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। জ্বি, আল্লাহ রাখছে।”
“বেড়াতে এসেছিলাম ক’দিনের জন্য।”
“যাক, ভালোই হইছে। চাচার শরীরটা কেমন? ভালোই আছে?”
“আছে আল্লাহর রহমতে। যান ঘরে, দেখা করুন।”
“হু, যাই। তোমার আব্বা তো চিঠি দেয় না এখন। ভালোই আছে, না?”
“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ।”
জাবেদ কাকা গেলেন আহমদ আলীর সাথে দেখা করতে। রোজা চিঠিটা নিয়ে পাশেই মেঝেতে রেখে আবার মাথায় বিলি কাটতে মনযোগ দিলো৷ মৌসুমী হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে নিয়ে বললো,
“মাহতাব ভাইয়ের চিঠি? কি লিখছে, একটু পড়ি তো!”
রোজা হুট করেই চিঠিটা নিয়ে নিলো। রেখে দিলো কোলে।
“এতো পড়তে হবে না।”
মৌসুমী কুটিকুটি হেসে উচ্ছ্বাসের সাথে বললো,
“প্রেমপত্র পাঠাইছে, না?”
“একটা মাইর দিবো।”
“আমিও মাহতাব ভাইয়ের কাছে বিচার দিবো।”
“দিস বিচার। ঠিক করে বস বলছি, নয়তো সত্যিই মাইর খাবি। একটু শান্ত হয়ে বসে না। যেন তার ভালোর জন্য এনে দিচ্ছি না উকুন।”
“এতো উকুন এনে কি হবে? কি দরকার অযথা তাদের কষ্ট দেওয়ার?”
“বা রে! তাদের রেখে রেখে কি লাভটা হচ্ছে শুনি?”
“হচ্ছে তো। হচ্ছে না? সম্মান পাচ্ছি, গুরুত্ব পাচ্ছি।”
“তাই?”
“নয়তো কি? চিন্তা করে দেখো, তোমার কাছে উকুন মাত্র এইটুকু একটা পোকা। অথচ উকুনের পৃথিবীটাই তোমার মাথা। তুমি ঠাঁই না দিলে উকুন যাবে কোথায়? সহজে হওয়া যায় নাকি এমন কারো পৃথিবী?”
রোজা হালকা করে ঠুসি দিয়ে বললো,
“কি আমার দরদী রে! এজন্যই উকুন সরে না তোর মাথা থেকে। নিজের মাথার বারোটা বাজিয়ে করে সে উকুনের মায়া!”
“হা হা! আমি মায়াপরী।”
তাদের কথপোকথন শুনে ওদিকে রান্নাবান্না শুরুর প্রস্তুতি নিতে নিতে সেলিনা বেগম বললেন,
“গিলায় খাওয়ায় দেও কয়টা। মায়া বাইর হইয়া যাইবো নে।”
মৃদু হাসলো রোজা। জাবেদ কাকা দাদাজানের সাথে দেখা করে চলে গেলেন। একটু পরেই মৌসুমীর চুলে বিনুনি করে চিঠিটা খুলতে খুলতে নিজের ঘরে গেলো রোজা। চেয়ার টেনে বসে টেবিলে চিঠি রাখলো। টেবিলে কনুই ভর করে মাথা রাখলো হাতে। আনমনে পড়তে লাগলো তার চাঁদের অনুভূতি। মানুষটা এতো মধুরভাবে ভাব বিনিময় করে তার সাথে, যখনই তার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবের সম্মুখীন হয়। হারিয়ে যায় আনমনে, কল্পরাজ্যে। এখনো গেছে। কল্পনায় অনুভব করছে তাকে প্রতিটি বর্ণে বর্ণে। হঠাৎই কারো ছায়া অনুভূত হতে পেছনে তাকিয়ে দেখলো মৌসুমী উঁকি দিয়েছে। মাত্রই এসেছে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে চিঠি পড়ার চেষ্টা করছে। সে তাকাতেই জিভ কেটে দাঁত কেলিয়ে ভোঁ করে ছুটে বেরিয়ে গেলো। প্রথমে চোখ রাঙিয়ে তাকালেও সে ছুটে পালানোর পরক্ষণে হেসে ফেললো রোজা। বড্ড দুষ্টু যে এই পরী।
পরবর্তী বৃহস্পতিবার বিকেলে আজমাইন আবারও উঁকি দিলো আলোর দুয়ারে। আজও দরজা তালাবদ্ধ। একজন মানুষও কি বাড়িতে থাকে না? যখনই আসে, তখনই তালা দেওয়া থাকে কেন? আবার এলে সন্ধ্যায় আসতে হবে নয়তো ভোরে আসবে, ভেবে রাখলো। তখন নিশ্চয়ই বাড়ি পাওয়া যাবে। এদিকে তার গ্রামে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। রবিবার থেকে পরীক্ষা শুরু। প্রায় এক মাস তাকে কাজ থেকে বিরতি নিতে হচ্ছে। এতোদিন পর ফিরে এসে এই কাজটা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তার জন্য এতোদিন কাজ বন্ধ রাখা যাবে না। নতুন লোক নিয়োগ দিবে কর্মকর্তা। মাহতাব তাকে আশ্বাসিত করলো,
“নিশ্চিন্তে গিয়ে পরীক্ষাটা দাও। কাজ একটা গেলে, আরেকটা পাবে। আমি ব্যবস্থা করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ। পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হলে কিন্তু কোম্পানিতেও ভালো পদে চাকরি পাবে। বই তো সাথে নিয়ে এলে, পড়া তেমন হতে দেখলাম না। বাসায় গিয়ে ভালো মতো পড়ে পড়ে পরীক্ষাটা দেওয়ার চেষ্টা করো। পাসমার্ক যেন আসে।”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার শুরুতেই মাহতাব নিজেও রওনা হলো আজমাইনের সাথে। সে যাচ্ছে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে। ছুটি কাটিয়েই আবার ফিরে আসবে আজমাইনকে রেখে। একটা দিন ছুটি পেলেও এখন মন টিকে না এখানে। মনটা বড্ড আঁকুপাঁকু করে বাড়ি যেতে। ক’দিন পর ঘরের সদস্য বাড়লে তখন তার কি হবে? কাজে মন টিকবে তো? বাড়ি গেলে তো দুয়ার ছাড়তেই ইচ্ছে করবে না!

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৩৯
(নূর নাফিসা)
.
.
এবার মাহতাব জানিয়ে আসেনি, সে যে আসছে। রোজা যে এখন বাবার বাসায়! মাহতাবও জানে সে বেড়াতে এসেছে এখানে। তবুও বলেনি আসবে যে। বাড়ির সবার খাওয়াদাওয়া শেষ। ঘুমানোর প্রস্তুতি চলছে। হঠাৎ করেই আজমাইনকে দেখে চমকে গেলো রোজা। মৌসুমী এবং রোজা, দুজনেই মায়ের কাছে থাকছে। আজমাইন এসেও মায়ের ঘরের দরজাই ঠেলে মাকে ডেকে প্রবেশ করেছে। রোজা উৎসুক চোখে তাকিয়ে বললো,
“এতো রাতে তুই! আমি তো ভেবেছি আগামীকাল আসবি। আমরা আরও খেয়ে দেয়ে সাবার! তোর ভাইয়া না আমাকে বললো, শুক্রবার আসবি!”
“সুযোগ পেয়েছি, চলে আসছি। আমি একা আসি নাই। ভাইয়াও আসছে।”
রোজা যেন আরও বিস্মিত হয়ে উঠলো! মাহতাব আসবে জানলে তো সে ওবাড়িতে থাকতো। বিস্মিত গলায়ই জিজ্ঞেস করলো,
“তোর ভাইয়াও এসে গেছে? কোথায়, আমাকে তো একবারও বললো না এ সপ্তাহে আসবে সে। তবে কি আমি আগেই চলে যেতাম না!”
কেমন অস্থিরতা অনুভব করলো সে। দুয়েকদিনের জন্য লোকটা বাড়ি এসেছে, আর সে বাড়ি নেই। ওদিকে তার কথার পরপর হালিমা খাতুন বলছেন,
“থাক, কাল নাহয় মাহতাবকেই আইতে বলমু নে। একটু ভালোমন্দ রান্না করলে খাওয়াদাওয়া করে চলে যাইস সাথে।”
আজমাইন অপেক্ষা রাখলো না। পরপরই বলে উঠলো,
“এখনই রান্নাবান্না করতে যাও। মাহতাব ভাই ওই বাড়িতে না, এই বাড়িতেই আসছে। দাদাজানের ঘরের দিকে গেলো দেখা করতে।”
আফসোস জড়ানো মুখে যেন ফিক করেই হাসি ফুটে গেলো রোজার।
“হয়েছে এবার! মা, আবার রান্না বসাও। তোরা আসবি যে, বলে আসবি না?”
“আমার কাছে কি ফোন আছে?”
“তোর ভাইয়ার কাছে ছিলো না? দাদাজানের ফোনে কল করলেই তো হতো।”
“এতসব মনে নাই। পাড়াবেড়ানি কই? একদিনও এসে ঘরে পাই না। দিনরাত টইটই করে।”
হালিমা খাতুন বললেন,
“টইটই করে না। যা, হাতমুখ ধো। ওইঘরে গেছে। আমিই পাঠাইছি সুপারি আনতে। ওর দাঁত নাকি শিরশির করতাছে।”
আজমাইন কাঁধে ব্যাগ রেখেই নিজের ঘরের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। রোজাও দাদাজানের ঘরের উদ্দেশ্যে বের হলো মাহতাবের সাথে দেখা করতে। হালিমা খাতুন ব্যস্ত হলো তাদের জন্য রান্না বসাতে। এদিকে সেই ঘর থেকে এপাশে পুরুষ গলা শুনতেই মৌসুমী বেরিয়ে এলো। দাদাজানের ঘরে কথা শোনা যাচ্ছে! কে এসেছে? দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখা পেলো মাহতাবের। পান খাওয়া রঙিন মুখে সালাম দিলো, কেমন আছে জিজ্ঞেস করলো। সাক্ষাতের পরপরই নিজেদের ঘরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলো আজমাইনের দেখা পেতে। আজমাইন ব্যাগ থেকে কাপড়চোপড় গুলো খাবলে বের করে বিছানায় রাখছে। হাতাওয়ালা গেঞ্জিটা খুঁজছে। শহরের আবহাওয়ায় গ্রীষ্মকালীন আভাস পাওয়া গেলেও গ্রামের আবহাওয়া শীতলতা ছড়াচ্ছে যেন। বসন্তী হাওয়ায় হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে তাই হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরবে। পেয়েও গেছে। এমনি দরজার সামনে থেকে মৌসুমী সালাম দিতে দিতে প্রবেশ করলো,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাই সাহেব। থুক্কু, বেয়াই সাহেব।”
পানমুখে ভাইটা ভালো সাজে না। তাই বেয়াইকে স্মরণ করলো যেন! আজমাইন পেছনে ফিরে তার সম্বোধন এবং পান খাওয়া মুখ দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। রঙিন ঠোঁটে চাপা হাসি ফুটালো মৌসুমী। আজমাইন হাতের টিশার্ট রেখে বিরক্তিযোগে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বললো,
“তুই পান খাইতাছোস ক্যা?”
“বড় মা’র কাছে বলেই খাইতাছি।”
“মা তোরে পান খাইতে বলছে, না সুপারি?”
“তুমি জানো ক্যামনে!”
“জাদু দিয়া। তোর দাঁত শিরশির করছিলো না? সবই জানি। জলদি গিয়া মুখ ধুয়ে আয়।”
“হুহ্!”
“মাইর খাবি নয়তো! জলদি যা। আর বেয়াই ডাকলি কারে?”
“তুমি ছাড়া তো এখানে আর কেউ নাই।”
“আমি তোর বেয়াই হই?”
“হও তো। মাহতাব ভাই যদি আমার ভাই হয়, তার শ্যালক তুমি। মানে আমার বেয়াই। এছাড়াও, রোজা আপু যদি আমার আপু হয়। মাহতাব ভাই তোমার ভাই। দুইদিক থেকেই তুমি আমার বেয়াই। অংকের সমীকরণটা বুঝতে পারছো তো?”
“আমারে সমীকরণ বুঝাইতে কইছি?”
“বুঝোনা যখন, বুঝাইতে তো হইবোই। দুইবার মেট্রিক দিছো। এইবার তিনবার ইন্টারমেট্রিক দিতে হয় কি না, কে জানে!”
“ইন্টারমেট্রিক? না ইন্টারমিডিয়েট?”
“ওই একটাই।”
“ভাব লস আমার সাথে? তুই মেট্রিক পাস করছোস? দেখি খালি রেজাল্ট যে কি হয়।”
“দেইখো।”
“এদিকে আইতাছোস ক্যা? মুখ ধুইতে না কইলাম?”
“আমার ভাল্লাগতাছে চিবাইতে।”
“ভাল্লাগলেও খাইতে পারবি না। দৌড় দে!”
“না।”
মৌসুমী এগিয়েছিলো ব্যাগে কি নিয়ে এসেছে দেখতে। মুখের উপর না বলায় আজমাইন তার গাল দুটো চেপে ধরলো এক হাতে।
“না, না করতাছোস ক্যা? ফেলবি না তুই পান?”
“উম্ম! উম্মম্মম!”
মৌসুমী কথা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। একে তো গাল চাপা, দ্বিতীয়ত মুখে পান! হাত টানার পর মুখ না ছাড়ায় পুঁচ করে পানের পিক ছুঁড়ে দিলো আজমাইনের পরিধানকৃত শার্টে! সাথে সাথেই ছেড়ে দিয়ে গোল গোল আগুন চোখে বিস্মিতভাবে তাকালো আজমাইন।
“কি করলি এইটা? এর আগেও ফুপুর বাড়ি গিয়া এমন করছোস। পাইছোস কি তুই? দাঁড়া, খাওয়াইতাছি তোরে বেশি বেশি পান!”
চাপা রাখতে চেয়েও মৌসুমীর হাসি চাপা থাকতেই পারলো না! আজমাইন ধরার আগেই সে তার অবস্থার উপর হাসতে হাসতে পালিয়েছে। একদম উঠুনের মাঝখানে। আজমাইন এলেই সুযোগ বুঝে কোনো একদিকে দৌড় দিবে। আজমাইন গেলো না তাকে দৌড়াতে। শার্টটা খুলে দরজার বাইরে এসে মোড়ানো শার্ট বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
“এইটার দাগ যদি এক ছিটাও থাকে, কাল সারাদিন পান খামু আর তোর মাথায় ফেলমু।”
“উহ! সব ঠ্যাকা খালি আমার! মাইর দেওয়ার সময় ভাগটা কে নেয়?”
বিড়বিড় করলো মৌসুমী। ওদিকে তাকে ছুটে, লাফিয়ে উঠুনে নামতে দেখে বকেই যাচ্ছে হালিমা খাতুন। এভাবে তাকে লাফালাফি, ছোটাছুটি করতে হবে নাকি এখনো? নিষেধ যে করে, একদমই কানে নেয় না। কে শোনে কার কথা? মেঝে থেকে শার্ট তুলে দেখতে লাগলো কতটা দাগ হয়েছে? এখনই ধুয়ে দিবে কি না? হালিমা খাতুন আজমাইনকে এদিকে যেতে দেখে তার উদ্দেশ্যেও ফুসলানো শুরু করলেন, ছেলেটারও কি আক্কেল হবে না নাকি? এই যে হুটহাট দৌড়ানি দেয়, মাইরের ভয় দেখায়। হোঁচট খেয়ে কিংবা হুমড়ি খেয়ে পড়লে কেমন হবে? দেয়ালে ধাক্কা খেলেও তো মাথা ফাটবে! বিপদ কি বলে কয়ে আসে? পোলাপান এখনো না শুধরালে আর কবে? আজমাইন যেতে যেতে শুনলো, কিন্তু প্রত্যুত্তর করলো না। সে তো দৌড়ানি দেয়নি, তবে হুমকি দিয়েছিলো। অযথা দৌড়ালে তার কি দোষ? অবশ্য তারও এতো খেয়াল ছিলো না, তার দুষ্টু রানী যে হুটহাট দৌড় মেরে বসে। এর আগে বটির উপর গিয়ে পড়লো না? কতখানি হাত কেটে গেলো! একদমই মনে ছিলো না। এখন ওই ঘটনাটা মনে হতেই যেন শরীরে হালকা কাটা দিয়ে উঠলো। সেদিন আরও বড় কোনো দুর্ঘটনা যে ঘটে যায়নি, সেটাই রবের দরবারে শুকরিয়া। বটিটা তখন চোখেমুখে লেগে গেলে কেমন হতো? তাকে হুমকি দেওয়া থেকেও সাবধান হতে হবে। তবে টুকটাক শাসন করতে হবে। শাসন না করলে বড্ড বাঁদরামি করে তার সাথে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত সে-ও তো বাঁদরের ওস্তাদ ছিলো। ধীরে ধীরে অগাধ পরিবর্তন চলে আসছে যেন। ভাবতে গেলে নিজেই অবাক হয়ে ওঠে নিজের প্রতি!
হাতমুখ ধুয়ে আজমাইন ঘরে গেলেই মৌসুমী শার্ট নিয়ে এখানে এলো। ডিটারজেন্ট পাউডারে ভিজিয়ে রাখলো ধুয়ে দেওয়ার জন্য। মাহতাবও মামীর সাথে দেখা করলো। ছোট মামীকে বাইরে পেয়ে ছোট মামীর সাথেও সাক্ষাৎ করলো। হাতমুখ ধুয়ে ওদিকে মাকে কল করে জানালো সে গ্রামে এসেছে। আগামীকাল রোজাকে সাথে নিয়েই বাড়ি ফিরবে। মরিয়ম আপত্তি করলো না। আগামীকাল রোজাকে সাথে নিয়েই ফিরতে বললেন। এদিকে হালিমা খাতুন আবার গলা বাড়িয়ে বলে দিচ্ছেন তাকেও আগামীকাল সকাল সকাল আসতে। মরিয়ম জানালো, এখন সে আসবে না। পরবর্তী সপ্তাহে আসবে।
রান্নাবান্না, গল্পসল্পের পর খাওয়াদাওয়া হলো তাদের দুজনের। কতক্ষণে আবার ফ্রিজ থেকে মাংস নামিয়ে ভেজাতে যাবেন? তাই খোঁয়াড় থেকে মুরগি ধরে জবাই করিয়েছেন আজমাইন এবং মোয়াজ্জেম আলীকে দিয়ে। নদীর বড় পা ওয়ালা চিংড়ি ছিলো ফ্রিজে, সেগুলো নামিয়ে পেয়াজে কষালেন। আগামীকাল নাহয় পোলাও মাংস খাওয়ানো যাবে৷ জামাই এসেছে বলে কথা! মায়ের কাজে হাতে হাত লাগিয়েছিলো রোজাও। তাদের খাওয়ার সময় মৌসুমীকে আবারও ডাকলেন অল্প খাওয়ার জন্য। কিন্তু এখন খাওয়ার ইচ্ছে নেই তার।
এদিকে খেয়েদেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে ঘরে এলো আজমাইন। রাত অনেক হয়েছে, ঘুমাতে হবে। এসে বিছানাও গুছানোই পেলো। ধপাস করে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলেই হলো। কিন্তু এসেই দেখতে পেলো তার ব্যাগ হাতড়াচ্ছে মৌসুমী। একহাতে মুঠোয় ভরা টাকা, আরেক হাতে ব্যাগের ভেতরে নাড়াচাড়া চলছে। আজমাইনকে দেখেই বললো,
“কিছু নিয়ে আসো নাই আমার জন্য?”
“কি আনতো আবার?”
“কিছু-মিছু আনবা না? খালি হাতেই আইসা পড়ছে একেবারে! দুই টাকার বাদামও তো আনতে পারতা!”
“বাদাম খাওয়ার তৃপ্তি মিটে না তোর? ওইদিন না মাত্র বিশ টাকার বাদাম কিনে দিয়ে গেলাম!”
“ওইটা পুরা দুই দিন খাইছি। আরও দিন যাইতো?”
“দুই টাকার করে হইলেও তো দশ দিন যাওয়ার কথা।”
বলতে বলতে হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে নিলো। মৌসুমী বললো,
“কত্ত টাকা তোমার কাছে। একশো টাকা দিলেও তো পারো। আমার ব্যাংক থেকে যে টাকা নিছো। কই, দশটা টাকা যেন বেশি দিলা না ব্যাংকে রাখতাম!”
আজমাইন চুপচাপ টাকা রেখে দিলো। এটা তার দ্বিতীয় মাসের বেতন ছিলো। মাকে দিতে হবে টাকাটা। কিছু নিজের জন্যও রাখতে হবে। এই যেমন, মৌসুমীর দশ বিশ টাকার বায়নাও পূরণ করতে হয় আবার নিজেরও নানান খরচের চাহিদা রয়ে যায়। রেখে দেওয়া টাকা থেকেই আবার একশো টাকার একটা নোট নিয়ে তাকে দিলো,
“নে, ব্যাংকে রাখ।”
মৌসুমী খুশি হয়ে টাকা নিয়ে সাথে সাথেই ব্যাংকে রাখলো। আজমাইনের লক্ষ্য হঠাৎ পেটের দিকে যেতেই সে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“তোর যে শাস্তি পাওয়া বাকি, আমি তো ভুলেই গেছিলাম!”
মৌসুমীরও মনে পড়তেই সে সরে গিয়েও যেতে পারলো না। আজমাইনের হাতে ধরা পড়ে গেছে। এতো রাতে এখন আর যাবেই বা কোথায়? শাস্তিস্বরূপ আজমাইন গালের উপর জোরে কামড় বসাতে গিয়েও দিলো না। আগেই চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়েছে দুষ্টুপরী৷ মৃদু হেসে এ যাত্রায় সাজামুক্ত করলো তাকে। তবে এমনি এমনি ছাড়েনি। চোখেমুখে ইচ্ছাকৃত খানিক বিস্ময় জাগিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“মৌ, তোর পেটে সত্যি বাচ্চা আছে? বুঝা যায় না কেন? স্বাস্থ্যকর্মী ক্যামনে বুঝলো? দেখি!”
“এহ! যাও। সময় হইলে এমনেই দেখবা।”
“তোর পেট তো অনেক বড় হয়ে যাইবো। না?”
মৌসুমী লাজুক ভঙ্গিতে বললো,
“হুম।”
আজমাইন চোখেমুখে বিস্ময় জাগিয়ে রেখেই একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
“তুই হাঁটতে পারবি তখন?”
“ক্যা? হাঁটতে পারবো না ক্যা?”
“এই যে তোর পেট বড় হয়ে ভারি হয়ে যাইবো। এতো ওজন তুই ক্যামনে ধরে রাখবি?”
“আর দশজন মায়েরা যেমনে ধরে রাখে।”
“উহু! তুই তো বাতাসী। বাতাসের আগেই পইড়া যাস। তোর পেট তো সামনের দিকে বড় হইবো, না?”
“পেট কি কারো পেছন দিকে থাকে?”
আজমাইন চিন্তিত গলায় বললো,
“না, আমি সেইটাই ভাবতাছি। সামনের দিকে যখন পেট বেড়ে যাইবো, তুই উপুড় হয়ে পড়ে যাবি না?”
এমন জিজ্ঞাসায় মৌসুমী নিজেও চিন্তায় ডুবে গেলো। তাইতো! এটা তো সে ভাবেনি! পেট সামনের দিকে ভারি হয়ে গেলে সে উপুড় হয়ে পড়ে যাবে না? সে এমনিতেই তো কত পড়ে যায়। তখন পেট ধরে রাখবে কি করে! কিন্তু মমোর জন্মের আগে মায়ের পেটও তো বড় ছিলো। কোথায়, মাকে তো কখনো পড়তে দেখলো না। সে কেন পড়বে তবে? সে-ও পড়বে না। তবু ভেবেও চিন্তা সরলো না মাথা থেকে। এমনি তার মাথায় কত উদ্ভট উদ্ভট চিন্তা ঘুরপাক খায়৷ এখন যেন আজমাইন সেই চিন্তার হার আরও বাড়িয়ে দিলো। এটা কেমন হলো! এই চিন্তায় আজ তো তার ঘুমই নামবে না চোখে! সত্যিই কি সে হাঁটতে গেলে উপুড় হয়ে পড়ে যাবে? হায়! হায়!

চলবে।