“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৪০
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে পুলি ও পাটিসাপটা পিঠা বানিয়েছে সেলিনা বেগম। উপস্থিত সকলের নাস্তা জমেছে পিঠাতে। হালিমা খাতুনের ঘরে হয়েছে দুপুরের আয়োজন। জুমার আগে নদীতে গিয়ে দলবল নিয়ে ঝাঁপাঝাপি করে এসে বাড়িতে উঁকি দিয়ে গেলো আজমাইন। গেইটের ধারে থেকেই মৌসুমীকে ডেকে চেঁচিয়ে বলে গেলো সাবানটা পুকুর ঘাটে দিয়ে যেতে। গেইট পর্যন্ত এলো অথচ আরেকটু এগিয়ে সাবানটা সে নিজে নিয়ে কেন যেতে পারলো না, ভেবে বিরক্ত হলো মৌসুমী। তার চেঁচানোতে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো আর সে নেই। কথামতো না নিয়ে গেলেও অযথা মারতে আসবে। তাই কপালের ভাজে বিরক্তি নিয়েই সে সাবান নিয়ে গেলো পুকুর পাড়ে। একটু দূরে থাকতেই দেখেছে আজমাইন দৌড়ে গিয়ে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কেন দৌড় দিলো, জানলো না মৌসুমী। ভাবলোও না। তবে ঘাটে যাওয়ার পরপরই হৈচৈ শুনে পিছু ফিরে দেখলো আজমাইনের সমবয়সী দুজন কাদামাক্ত শরীরে কাদা হাতে নিয়ে গেইটের কাছাকাছি তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এবার বুঝলো কেন তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে সে তাকে সাবান নিয়ে আসতে বলে হুড়হুড় করে পুকুরে ঝাপিয়ে পড়লো। নদীতে গিয়ে তবে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করে এসেছে! এদিকে বাড়িতে প্রবেশের সাহস না হলেও মৌসুমীকে পুকুরের কাছে দেখে তাদের সন্দেহ হলো আজমাইন পুকুরেই আছে। তাই কাদা হাতে দৌড়ে এলো আবার এদিকে। তাদের দৌড়ে আসার গতি দেখে মৌসুমী গেছে ভয় পেয়ে! ভেবেছে তাকেই বুঝি কাদা মারতে আসছে! সে চিৎকার করে কোন দিকে যাবে দিশেহারা হয়ে ঝাঁপ দিলো পুকুরেই। পানিতে থাকা আজমাইন তার কাণ্ড দেখে হতবাক! ছুটে আসা দুজনও আর কাদা ছুঁড়বে কি? মৌসুমীর কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে শেষ! মৌসুমীও যেন পানিতে নামার পর বোকা বনে গেলো। পাশেই তাদের উঁচু জমির বিপরীত পাড়ে লাউ গাছের গোড়ালিতে নিড়ানি কাজ করছিলো মোয়াজ্জেম আলী। চিৎকার শুনে তিনি কাস্তে হাতে এপাশে এলেন। ছেলে দুটোকে ধমকাতে লাগলেন হাতে কাদা দেখায়। মৌসুমীও এবার রেগে বকা দিতে লাগলো উপরের দুজনকে। হাসতে হাসতেই দুজন আজমাইন বরাবর কাদা ছুঁড়ে চলে গেলো। আজমাইন ডুব দিয়ে পানির নিচে চলে যাওয়ায় কাদা লাগলো না তার গায়ে। মৌসুমী না নামলে হয়তো আবার এখানে কাদা ছোঁড়াছুড়ি কিংবা ডুবাডুবি চলতো কিছুক্ষণ। আজমাইন পানির নিচ থেকে মাথা ভাসিয়ে তাদের ফিরে যেতে দেখে এবার মৌসুমীর অবস্থার উপর হাসতে লাগলো ইচ্ছেমতো। মৌসুমী ক্ষেপা চোখে তাকিয়ে রইলো। আজমাইন দাঁত কেলাতে কেলাতেই বললো,
“তোর এমন পানিতে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করলো ক্যা? দিনের বেলা ভুত দেখে ভয় পাইছোস? এখন পানির ভুত তোরে চুবানি দিলে কেমন মজা পাবি?”
“বেদ্দপ! আবার কথা কও! বাড়ি যাও আজকা, বড় মা’র কাছে যদি বিচার না দিছি!”
“কি বিচার দিবি?”
“এই যে, তোমার জন্য আমি ভিজছি! আবার চুবানি দেয়ার ভয় দেখাও!”
আজমাইন হেসে পানিতে ভেসে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“আমি বলছি তোরে ভিজতে? ভীতুর ডিম! সাবান দে।”
মৌসুমী দুহাত তুলে দেখলো তার হাত খালি! এ কি! সাবান কোথায় গেলো? বিস্মিত গলায় বললো,
“হায়, হায়! সাবান কই! দুদিন আগে মাত্র সাবানটা কিনছি। নতুন সাবানটা ডুবে গেলো! তাড়াতাড়ি খুঁজো, নইলে ঠিকই বিচার দিমু বড় মা’র কাছে।”
আজমাইন সাথে সাথেই ডুব দিলো তার পায়ের কাছে। প্রথমেই হালকা টান দিলো মৌসুমীর পায়ে। মৌসুমী কেঁপে উঠলো ভয়ে। তবে ততটাও ভয় পায়নি, আজমাইন টান দিয়েছে জানেই বলে। মাটিতে হাতড়ে সাবান পেলো না সে। এক মুঠো কাদা ই তুলে আনলো হাতে করে। পায়ে টান পড়ায় মৌসুমী কিঞ্চিৎ সরে গিয়েছিলো তার পাশ থেকে। উপরে উঠে সে এগিয়ে গিয়ে হাতের কাদা মাথায় দিয়ে বললো,
“হারাবি তুই, নালিশ জমা করবি আমার নামে? নে তোর সাবান!”
মৌসুমীর মুখভঙ্গি সাথে সাথেই কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠলো। নিজের মাথার কাদা নিয়ে আজমাইনকে তাড়া করলো গায়ে মাখতে। আজমাইন এক ডুবেই অনেকটা সরে গেলো পালিয়ে। মৌসুমীও সাঁতরে গেলো৷ সে কি আদৌও পারবে তাকে ধরতে? তবুও রাগ না ফুরানো পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেলো সাঁতরে সাঁতরে আজমাইনকে ধরতে। আজমাইন হাসে আর সে হাঁপায়! হাঁপিয়ে হার মেনে নিজের মাথার কাদা ধুয়ে নিলো। আরও কিছুক্ষণ সাঁতার কাটলো এবার ধীরখুশিতে আনমনে। কতদিন সাঁতার কাটা হয় না এই পুকুরে। সেই ধানের সময় প্রায়ই করা হতো, আবার সরিষার সময়ে করা হয়েছিলো একবার। এইতো, এখন নিজের বোকামিতে আরেকবার। সে সাঁতার কাটছে, তাড়া করতে না দেখে আজমাইনও তার পাশে পাশেই সমানতালে আকাশমুখী হয়ে ভাসছে। মৌসুমীকে হার মানতে দেখে মিটিমিটি হাসছে। মৌসুমী এবার ক্ষেপে নয়, লাজুক চোখে দেখছে তাকে। এই মুখের নিরব হাসি যে তার বড্ড প্রিয়! এই মানুষটাও তো প্রিয়। ইচ্ছে করছে তার ভাসানো বুকের উপর ঠাঁই নিতে। তার বুকের ভেলায় পিঠ এলিয়ে আকাশমুখী হয়েই ভাসতে। ভারে ডুবে না গেলে হয়তো সত্যিই যেতো উঠে। আসলেই কি ডুবে যাবে ভারে? পরীক্ষা করে দেখতে তার সাঁতরানো এক হাতের ভর ফেললো আজমাইনের বুকে। সাথে সাথেই তলিয়ে গেলো আজমাইন, হেসে সরে এলো মৌসুমী। আজমাইন পুনরায় উঠে এসে নাক ঝাড়তে লাগলো। আচমকা তলিয়ে দেওয়ায় নাকে পানি চলে গেছে!
“তুই তো আমায় ডুবিয়ে মারার পরিকল্পনা করছিস রে!”
মৌসুমী ঘাটে উঠতে উঠতে দুষ্টু লাজুক হাসির সাথে তার জবাব দিলো,
“ডুবতে তো হবেই তোমাকে। মৌ এর প্রেমের জলে তুমি দিনরাত হাবুডুবু খাবে।”
কথার পরপর হাসির বেগ খিলখিল হাসিতে রূপান্তর করলো। আজমাইন তার প্রেমময় চোখদুটো বাঁকিয়ে তাকিয়ে নাক ঝাড়তে ঝাড়তেই উঠে আসার জন্য এগোত লাগলো। খাচ্ছেই তো। প্রেমের জলেই হাবুডুবু খাচ্ছে, মনোরমভাবে সহ্য করছে তাকে।
জুমা বাদ দুপুরের খাবার খেয়ে রোজাকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে মাহতাব। তিন চাকার রিকশায় পাশাপাশি বসে দুজন কাটিয়েছে স্বল্প দুরত্বের পথ। কিন্তু উপভোগ ও অনুভবের রেশটা রয় ভীষণ ভীষণ। মরিয়মের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে হালিমা খাতুন। সেলিনা বেগম কিছু পিঠাও দিয়ে দিয়েছেন। ভাইয়েরা কিছু পাঠালে বরাবরই ভীষণ খুশি হয় মরিয়ম। আজও হয়েছেন। ভাগ্য করে ভাইয়ের বউগুলো পেয়েছে সে। এ-যুগে বাড়িতে বাড়িতে ননদ ভাবিদের দ্বন্দ্বের শেষ হয় না। জমিজমা, ধন সম্পদের সূত্র ধরেই কত শত গণ্ডগোল চলে ভাইবোনদের মাঝে। তারউপর ছোটখাটো বিষয় তো আছেই। কিন্তু তাদের পরিবারের বন্ধনটা অন্যরকম। অন্যগতিতে বেঁধে আছে তারা। হয়তোবা বাবামায়ের সুশিক্ষা এবং সুশাসনের জন্যই।
এদিকে কপোত-কপোতীর বুনে রাখা ইচ্ছে পূরণ হলো মোটামুটি অনেকটা প্রতীক্ষার পর। মাহতাব চেয়েছিলো, রোজা তাদের পুকুর ঘাট দখল করবে। আর তখন সে পুকুরে সাঁতার কাটবে। গতকাল আজমাইনকে নদী থেকে ঝাঁপাঝাপি করে আসতে দেখেই সে ইচ্ছেপোষণ করেছিলো আবার এসে নদীতে সাঁতার কাটবে। সেই ইচ্ছের সূত্র ধরেই গতকাল থেকে রোজা ভেবে রেখেছে আজ পুকুরে সাঁতার কাটানোর সুযোগটা সে করে দিবে। দুপুর বাদে তো চলেই যাবে, তাই সকাল হতেই রোজা অল্প কিছু কাপড়চোপড় ধোয়ার অযুহাত ধরে মাহতাবকে প্রস্তাব করলো,
“চলো তবে, দখল করি ঘাট। কাটবে না সাঁতার? সুযোগ নিয়েছি যে লুফে আজ।”
মাহতাব গেলো তার ডাকে। ভেজালো পা দুটো পুকুর ঘাটে। ঠান্ডা জল শিহরিত করে দিলো গায়ের লোমকূপকে। দুজনেরই ছায়া প্রতিবিম্বিত হয়ে পড়লো স্বচ্ছ জলের বাঁকে বাঁকে। রোজা হাসলো তা দেখে। এইতো, একত্রিত প্রতিবিম্বতেও কি মিষ্টি দেখায় তাদের। মাহতাব সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে সাধলো তাকে,
“চলো? পুকুর জলে ভাসি নাহয় একসাথে?”
“উহুম। আমার কাজ আছে। তুমি সাঁতার কাটো। আমি দৃষ্টি জুড়াবো তোমায় দেখে।”
আশেপাশের মানুষ চলে আসতে পারে। ঘরেও যাওয়া যাবে না ভেজা কাপড়ে। চাচাচাচীর চোখে পড়তে পারে। তা নিয়ে ভারি সংকোচ রইলো রোজার ভেতর। তাই মাহতাবও জোর করলো না। তাকে স্বস্তির সাথে দৃষ্টি জুড়াতেই সম্মত হলো। নেমে পড়লো শীতলতা বহনকারী পুকুরে। বহুদিন পর আপন জলে ভিজিয়ে দিলো নিজেকে। একসময় প্রায়ই পুকুরে গোসল হতো। মাঠে খেলাধুলা শেষ করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো এই প্রাঙ্গণে। সেই সোনালী দিন আর আসবে না ফিরে। দিনকে দিন আরও যাবে হারিয়ে। বাঁচবে কেবলই স্মৃতি হয়ে। এই ঘাটে বসে মা কতবার শরীর মেজে দিতো আর বলতো, রোদেবনে ঘুরে গায়ের রঙ পুড়ে, যাচ্ছে কালো হয়ে। আজ বউ বসে কাপড় কেচে যায় তারই বায়নার অযুহাতে। এই দৃশ্যটাও তো প্রাণোবন্ত হয়েই আছে। থাকবে স্মৃতিতেও গেঁথে।
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৪১
(নূর নাফিসা)
.
.
বছরে যেন এই প্রথমবারের মতো আজমাইনকে বই নিয়ে বসতে দেখলো আজ মৌসুমী। আগামীকাল পরীক্ষা, তাই সারাদিন পাড় করে এই সন্ধ্যায় গদগদ করে পড়ে যাচ্ছে। যখনই কোনো প্রয়োজন হচ্ছে, মৌসুমী টিপটিপ পায়ে ঘরে আসছে আবার চলে যাচ্ছে। তার পড়ায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে। টানা দুইঘন্টা চললো এই গদগদ। এরপর আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হাই তুলতে তুলতে মায়ের ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। রান্নাবান্না শেষ করে মৌসুমী আর হালিমা খাতুন বসে বসে মশলাদি বেছে বোয়ামে রাখছে। আজমাইন দরজায় হেলে দাঁড়িয়ে বললো,
“মা, ক্ষুধা লাগছে। পেট থেকে আর পড়া আসে না।”
“ক্ষুধা লাগছে যখন ভাত খাইয়া যা। এমন কইরা যদি সারাবছর পড়তি, ফলাফল কতই না ভালো হইতো।”
“এখনো হইবো, চিন্তা কইরো না। খালি দোয়া আর দোয়া করো।”
মৌসুমী কুটিকুটি হেসে বললো,
“দোয়া দিয়া ভাসায় দাও বড় মা। খাতায় এমনি এমনি নম্বরে ভেসে যাইবো।”
হালিমা খাতুন বিড়বিড় করলো,
“মানষের পোলাপান ভালো রেজাল্ট কইরা কি গর্বের সাথে কথা কয়। শুনতেও ভাল্লাগে। আর আমার পোলা কথাতেই পটু। পড়ায় ঢেঙ্গা!”
“আরে, ঘ্যানঘ্যান কইরো না তো! ক্ষুধা লাগছে, খাইতে দাও। রেজাল্টের নানাকেও এইবার ধইরা আনমু। দেখো খালি।”
“হো, ওই যা। বড় বড় লেকচার না দিয়া খাইয়া পড়তে যা। মানসম্মান যাতে রাখতে পারোছ।”
পরপরই মৌসুমীর উদ্দেশ্যে বললো,
“যা তো, মৌসুমী। যা। কয়টা ভাত দে। তুইও খাইয়া সাইড়া ফেল।”
“হু, যাই।”
মৌসুমী রান্নাঘরে গেলে আজমাইনও গুনগুন করতে করতে পিছু পিছু গেলো। মৌসুমী প্লেট ধুতে ধুতে নিজেই মাদুর বিছিয়ে বসলো। ঝুড়িতে মুরগির ডিম দেখে কবুতরের কথা মনে হতেই সে বললো,
“তোর বাচ্চার আগে দেখি কবুতরের বাচ্চা ফুটে গেছে।”
“তো কি হইছে, আমি কি কবুতর? কবুতরের সাথে যে আমার তুলনা করতে আসো!”
আজমাইন দুষ্টু হেসে বললো,
“তুই শালিক। সারাক্ষণ খালি ক্যাচক্যাচ করোছ।”
“তুমি শকুন। সারাক্ষণ খালি ঠোকরাঠুকরি, মারামারি করো।”
আজমাইন আবারও হাসলো। পরপরই বললো,
“আমার কবুতর দুইটা কম ক্যা? জবাই করে খাইছোস?”
“আমি খাই নাই। তোমার নানায় খাইছে।”
“আমার নানায়!”
“হু, তোমার বাগডাশ নানায়।”
আজমাইন যেন কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হলো বাগডাশের পেটে তার কবুতর যাওয়ায়। ক্ষেপানো কণ্ঠেই বললো,
“তোরা এত্তগুলা মানুষ বাড়িতে থাকতে বাগডাশ খায় ক্যামনে?”
“রাতের বেলা ধরছে। আমরা কি জানি, তোমার বাগডাশ নানায় আইসা হামলা করবো?”
“কারবার! কবে ধরছে?”
“অনেক দিন আগেই। তুমি সেবার আসার পরে আবার চলে গেলা না? তার পরের দিনই।”
“কাজটা কি করছে!”
“হইছে, যেইটা যাওয়ার গেছে। আফসোস করার দরকার নাই।”
“তুই ঠ্যাঙে ধরে রাখতে পারলি না তোর নানা শ্বশুরের?”
বলত বলতে ভাতের প্লেট টানলো। মৌসুমীও কুটিকুটি হাসলো। খাওয়ায় মনযোগ দিলো দুজনেই। এখন আবার তার খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে। একটু পরপরই এটাসেটা খেতে মন চায়। বোয়াম ভর্তি চিড়ামিঠাই পাকিয়ে দিয়েছে সেলিনা বেগম। হালিমা খাতুন বাজার থেকে বিস্কুট আনিয়ে রেখেছে। ঘরে বাহারি রকম আঁচার দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে। নিজের জন্য এতো আয়োজন, ভাবতেও ভালো লাগে। দেখতেও ভালো লাগে।
খাওয়ার পর আবার দাদাজানের খাবার নিয়ে গেলো মৌসুমী। মাছের কাটা বেছে দিলো। পুরোটা সময় পাশে বসে রইলো। খাওয়া শেষ হতেও ওষুধ দিয়ে থালাবাটি নিয়ে বেরিয়ে এলো। বিয়ের আগে এই কাজগুলো বেশিরভাগ সময় রোজা করতো। সে-ও থাকতো সাথে সাথে। এখন তাকে দেখতে হয়। রোজা এখনো এলে দাদাজানের পিছু সময় দেয় আগে। মৌসুমী থালাবাটি নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় আজমাইনকে টেবিলের কোণে পা তুলে, মাথার পিছু হাত রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে গুনগুন করতে দেখলো। সামনে খোলা বই পড়ে আছে। সে জানালা দিয়েই ধামকি দিয়ে এলো,
“বই খুলে বসে বসে গান গাও? পরীক্ষায় এই গানই লিখে আসবা? দাঁড়াও, দিতাছি বিচার বড়মার কাছে।”
আজমাইন তার দিকে তাকালেও গান থামালো না। তবে মৌসুমী চলে যাওয়ার সময় গলা উঁচিয়ে বললো,
“এদিকে আসিস তো। একটা অংক দেখায় দিবি।”
মৌসুমী একটু উৎফুল্ল হয়ে উঠলো যেন! তাকে দিয়ে অংক করাবে? এই বইয়ের অংক কি সে পারবে, এমনই সহজ? বড় ক্লাসের অংক তো আরও কঠিন হওয়ার কথা। যাকগে, দেখলেই বুঝা যাবে পারবে কি না। শিক্ষকতা করা তো যাবে একটু। কিচ্ছু পারে না গোবরমাথাটা। মৌসুমী দ্রুত থালাবাটি ধুয়ে গুছিয়ে রেখে পা বাড়ালো সেদিকে। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রোজার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“কিসের অংক? তোমার না শুনলাম কালকে বাংলা পরীক্ষা? বাংলা বইয়েও অংক থাকে?”
আজমাইন তাকে দেখে জবাব না দিয়ে পা নামিয়ে বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। চেয়ারটা টেবিলের দিকে চাপিয়ে রেখে সিটি বাজাতে বাজাতে মৌসুমীর কাছে এসে তাকে বাইরের দিকে ঘুরিয়ে ঠেলতে লাগলো। মৌসুমী ঠেলার আগে যাচ্ছে না বলে পিঠে চিমটি দিয়ে সামনের দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত করে বললো,
“ওদিকে যা। অংক দেখাই।”
চিমটিতে ব্যাথা পেয়ে মুখটা বিকৃত হয়ে গেলো মৌসুমীর। ব্যাথাতুর শব্দও হলো মুখে। ভ্রু জোড়া একদম কুচকে রইলো। আজমাইন সিটি বাজাতে বাজাতে হাসলো তার বিকৃত মুখখানা দেখে। কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাদের ঘরে নিয়ে এসে আজমাইন বললো,
“মশারীর একটা কোণা বাঁধা আছে। ঘুমানোর জন্য আর কয়টা কোণা বাঁধা প্রয়োজন?”
মৌসুমী একইভাবে থেকে জবাব দিলো,
“তিনটা।”
“তবে তিনটা বেঁধে দে। একটু ঘুমায় থাকি। সকালে উঠে পরীক্ষা দিতে যাইতে হইবো।”
মৌসুমীর রাগ হলো। এইটাই তার অংক ছিলো? তার কি হাত নেই? তিনটা কোণা সে টানিয়ে নিতে পারলো না? রাগ হলেও ক্ষেপলো না। অভিমান জাগালো চোখেমুখে। কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে মশারীর কোণা টানিয়ে দিলো। ভেতরে গিয়ে চারদিকে মশারী গুজেও দিতে লাগলো চুপচাপ। তার প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে আজমাইন মুখে হাসি রেখে মশারীর ভেতর এলো ঘুমাতে। বালিশ ঠিক করতে করতে বললো,
“সকাল সকাল ডেকে দিস৷ পড়তে হবে। এখন ঘুমাই।”
কিছুই বললো না মৌসুমী। আজমাইন তার চুলের খোপা খুলে দিয়ে বললো,
“হুপ করে রইছোস ক্যা?”
মৌসুমী মুখে বিরক্তিকর শব্দ তুলে আবার খোপা বেঁধে নিলো। আজমাইন হাত ধরে কাজে বাঁধা দিয়ে নিরবে শরীর কাঁপানো হাসির সাথে বললো,
“ব্যাথা পাইছোস?”
মৌসুমী হাত টেনে কণ্ঠেও অভিমানের সুর তুলে বললো,
“না, ব্যাথা পামু ক্যা? আমার আবার ব্যাথা আছে? আমার গায়ে তো রক্তমাংস নাই। আমি তো মানুষই না।”
আজমাইন আদিক্ষেতা দেখাতে পিঠে চিমটি দেওয়া স্থানে হাত ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,
“সত্যিই ব্যাথা পাইছোস?”
“সরো! ভাল্লাগতাছে না তোমারে।”
“কারে ভাল্লাগে তবে?”
“যে যে আমারে ভালোবাসে, আমার ব্যাথা বুঝে তারেই ভাল্লাগে।”
“আমিও তো বাসি।”
“না, লাগবো না তোমার এই ভালোবাসা।”
“ক্যা?”
“দিনরাত মারে, আবার জিগায় ক্যা! ভালোবাসে না ছাই!”
“ভালোবাসি না?”
“কই বাসো? এমনে কেউ ভালোবাসে? ভালোবেসে কিছু করছো আমার জন্য?”
“ক্যা? ভালোবাসলে কি করে?”
“মহব্বত নিয়া অনেক কাজই করে। তুমি কিছুই করো নাই।”
আজমাইন যেন তার অভিযোগ শুনতে তাকে দুহাতে ঘেরাও করে আরও কাছাকাছি বসলো। ঠোঁটের ধারে হাসি রেখে বললো,
“কি করতাম তোর জন্য?”
“জানি না।”
“জানবি না ক্যা? কি করতাম, বল?”
“আমি তো তোমারে এমন ভাবে চাই নাই। আমি চাইছি একজন সখা হিসেবে। যে আমারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বুঝবো। আমার সঙ্গী হয়ে চলবো। আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগা বুঝবো৷”
“আর?”
আজমাইনের কোমল জিজ্ঞাসায় যেন অভিমানী সুরে একটু লাজুকতার রেশও ফুটে উঠলো এবার। চোখে এক পলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি নিচে নামিয়ে বলতে লাগলো,
“আমি তো তোমারে এমনভাবে কল্পনা করি, আমার হাসি দেখে তুমি হাসবা। আমার হাসির প্রশংসা করবা। কষ্ট দেখলে আমার মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করবা। প্রায়ই মুঠোয় লুকিয়ে বাদাম এনে মন ভালো করে দিবা। বলবা, এগুলো তোর। এই পৃথিবীর সব বাদাম ফলে শুধুমাত্র তোর জন্য। তুই প্রতিদিন বাদাম খাবি। আমি তোকে এনে দিবো। মাঝে মাঝে নিজ হাতে সাজিয়ে দিবা। পায়ে আলতা পরিয়ে দিবা। ঢালু পাড় থেকে বকুল ফুল এনে নিজ হাতে মালা গেঁথে আমার চুলে বেঁধে দিবা। কখনো কখনো খাদেম আনসারির গেইটে বড় বড় জবা ফুটতে দেখো না? সেই জবা এনে আমাকে চমকে দিবা। বলবা, জবারা শুধু তোর জন্যই ফুটে। এসবই না এক সখার ভালোবাসা। তুমি তো ঘোড়ার ডিমটা বাসো!”
আজমাইন প্রথমে শরীর কাঁপিয়ে হাসলো। পরক্ষণে গালের একপাশে আলতো কামড় বসিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে কাঁথা টানতে টানতে বললো,
“পাগলে পাইছে তো আমারে। জাবাদেরও খুব ঠেকা লাগছে তোর জন্য ফুটতে! জবা চুরির দায়ে এরপর আনসারি আমারে বাইন্ধা রাখুক! আর পৃথিবীর সব বাদাম যদি তোরই খাইতে হয়, বাকি লোকজন কি ঘাস খাইয়া থাকবো? আইছে বাদামখোর! ভাগ এখান থেকে! নাহয় বসে বসে আমার পা টিপ।”
বলতে বলতেই বালিশে মাথা রেখে একটা পা তুলে দিলো মৌসুমীর কোলে। তার ভালোবাসার আবেগকে নিয়ে হাসায় মৌসুমী এই পায়ের উপর অনবরত তিন ঘা কিল বসিয়ে দিয়ে নেমে এলো বিছানা ছেড়ে। কিল খেয়েও আজমাইন হাসছে বাদাম সুন্দরীর প্রত্যাশিত ভালোবাসার উপর। আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, সকালে ডেকে দিতে।
সকাল হলো, ডাকলোও। কিন্তু তার ঘুম ভাঙানো ভারি দায় হয়ে গেলো! ছয়টা থেকে ডাকতে ডাকতে আটটা বেজে গেছে। আজমাইন ধড়ফড়িয়ে উঠে রোজার রুমে এসে বই আর কলম নিয়ে বসলো৷ মৌসুমীকে তাড়া দিলো ভাত মেখে এখানে নিয়ে আসার জন্য। তার সময় নেই। দাঁতও মাজেনি, ভাত খাওয়ার জন্য প্রস্তুত! সে জানে, দশটা থেকে পরীক্ষা শুরু। এখনই সময় থাকবে না কেন? আরও তো দুই ঘন্টা বাকি! এতোক্ষণ ধরে ডাকছে, উঠেনি। রাতেও একটু গদগদ করে পড়ে আগে আগেই ঘুমিয়ে গেছে। এখন খুব পড়া দেখাতে এসেছে! একা একাই ফুসতে ফুসতে প্লেটে করে ভাত নিয়ে গেলো মৌসুমী। রোজার ঘরেই আছে সে। টেবিলের কাছে গিয়ে যেন মাথাটা ঘুরে গেলো আজমাইনের কাণ্ড দেখে! চোখ দুটোও ঘোলাটে হয়ে গেলো বিস্ময়ের প্রকোপে! হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কলম দিয়ে লিখে ভরে ফেলছে সে! সামনে বই খোলা! বই থেকে দেখছে আর লিখছে, দেখছে আর লিখছে। বাম পায়ে ইতিমধ্যে লিখে শেষ করে ফেলেছে। এটা ডান পা। পায়ের পশম, আর কলমের কালি পা দুটোকে কালো কুচকুচে করে ফেলছে যেন! করছেটা কি সে!
চলবে।