সোনালী আলোর ঘ্রাণ পর্ব-৪২+৪৩

0
398

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৪২
(নূর নাফিসা)
.
.
“দাঁড়ায় আছোস ক্যা? ভাত খাওয়ায় দে। আমার সময় নাই।”
ড্যাবডেবে চোখজোড়া পা থেকে তার মুখের দিকে নিক্ষেপ করলো মৌসুমী। থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি করতাছো এগুলা? নকল দিবা পরীক্ষায়?”
আজমাইন ছোটখাটো ধমক দিয়ে বললো,
“হুপ! এইটা নকল বলে? আমার মনে থাকে না, তাই লিখে নিতাছি। রাস্তায় রাস্তায়ও পড়া যাইবো।”
“আমারে তুমি নকল চিনাও, না? নকল কারে বলে, আমি জানি না?”
“হো, তুই তো জানবিই। তুই নকল দিতে দিতে আইছোস না এই পর্যন্ত। এমনি এমনি পাস করছোস নাকি!”
“জীবনে একটা কাগজের টুকরাও নিয়া যাই নাই।”
“বিদ্যাসুন্দরী, খুব গর্বে উতলা হইতাছো যেমন? জীবনে তুই নকল করছ নাই? বান্ধবীর থেকেও দেখোছ নাই?”
“ওইটা তো সবাই-ই দেখে।”
আজমাইন দুষ্টু হাসলো হাহা করে। পরপরই বললো,
“ওইটা আরও মহা নকল। একটা দেইখা সবগুলা কপি করস। সবাই বন্ধুবান্ধবের খাতা দেখে না। আমি দেখি না। নিজ চেষ্টায় পরীক্ষা দিয়া আসি। এই যে, এখনো নিজ চেষ্টায় লিখা নিয়া যামু। নিজ দায়িত্বে আবার নিজ হাতেই খাতায় তুলে দিয়ে আসমু।”
মৌসুমী বিড়বিড় করে বললো,
“চোর ছাত্র। এগুলার জন্যেই দেশটা গর্তে যাইতাছে। কালকে রাত্রে দেখেই বুঝতে পারছি, হুদাই গদগদ করছে। একটা লাইনও বলতে পারবো না।”
বলতে বলতে খাবার তুলে দিলো আজমাইমের মুখে। মুখ ভর্তি খাবার নিয়েই তাকে সাবধান করলো,
“কথা কম বল। ডিস্টার্ব করিস না।”
ভেঙচি কেটে নিজের কাজ করে গেলো সে। আজমাইন বাম হাতের কনুই থেকেও লেখা ধরলো। পেটেও লিখলো। মৌসুমী এতোক্ষণ দেখে দেখে শুধু বিস্ময় বাড়িতেই নিচ্ছে। এবার হেসেও উঠলো। বললো,
“স্যার যদি তোমার চুরিদারি ধরতে পারে, কনটা টেনে ধইরা ক্লাস থেকে বের করবো। কান্না করতে করতে বাড়ি ফেরা লাগবো তোমার। বলে রাখলাম।”
“তোর রাখারাখির দরকার নাই। চুপ থাক। এসব ম্যাজিক। স্যারের বুঝার বয়স হয় নাই, আর হইতোও না। যখন হইছিলো, তখন বুঝে নাই। আর যদি বুঝে থাকে, তবে নিজের ভুলটা মনে কইরা ক্ষমা কইরা দিবো। বুঝলি?”
মৌসুমী কুটিকুটি হাসলো। প্লেট শূন্য হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলো,
“আরও আনবো?”
“না। হাত ধুয়ে আয়। এই হাতে তুই লিখে দিবি।”
“আমি পারতাম না চুরির কাজ করতে।”
আজমাইন ঠোঁট কামড়ে চোখ রাঙালো।
“এইটা চুরি? এইটা মনে রাখার টেকনিক। তাড়াতাড়ি যা! বাদাম খাওয়ামু।”
হালকা করে ভেঙচি কেটে চলে গেলো মৌসুমী। তবে তার হাসি ফুরায় না আজমাইনের কৃতকর্মে। সে যেন খুশিতেই প্লেট ধুয়ে রেখে আবার এলো লিখে দিতে। ডান হাতের কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত তাকে দিয়ে লেখালো আজমাইন। পরপরই পিঠের নিম্নভাগে লিখে দিতে বললে মৌসুমী অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
“হাত, পা ঠিক আছে। পেটও নাহয় ঠিক আছে। কিন্তু পিঠে দেখবা ক্যামনে? তোমার কি পেছনেও দুইটা চোখ আছে?”
“আমার না থাকুক। আমার পেছনে মানুষ তো আছে। কানা বেডা তো আর যাইতাছে না পরীক্ষা দিতে। সে দেখবো, তার থেকে আমি লিখবো।”
“ওরে, বুদ্ধিরে! সে যদি স্যারের কাছে বলে দেয়, তখন?”
“তখন তোরে থাপড়ামু! বলদি কোনহানকার! এক লাইন দেখাইলে সে যেই দেশের বান্দাই হোক, খুশিতে আমারে মাথায় তুলে নাচবো। পরীক্ষার হলে তেল দিয়া কূল পায় না, আইছে স্যারের কাছে বিচারের চিন্তা নিয়া! আমার সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি লেখ। আমি বলি, তুই ঝটপট হাত চালিয়ে যা।”
মৌসুমী হেসে কুটিকুটি। সে আর লিখবে কি, মনে জেগেছে তার দুষ্টুমি! আজমাইন বই দেখে দেখে বলে, আর সে তার দুষ্টুমি চালিয়ে যায়। পিঠের মাঝামাঝি থেকে কোমড় পর্যন্ত লিখে দিলো। যথেষ্ট হলো লেখা। বাকিটা আন্দাজের উপর বানিয়ে লেখা যাবে। মূল অংশগুলো তো সংরক্ষণ করা হলো!
পরপরই তৈরি হলো শার্ট প্যান্ট পরে। কখনো তাকে হাতার বোতাম লাগিয়ে কলেজ যেতে দেখেনি মৌসুমী। আজ দেখছে, কাছেকাছে ঘুরেফিরে হাসছে। একদম নগেন বাবু হয়ে উঠেছে যেন! আজমাইন মোটেও বিরক্ত হলো না। মুখটা কোনোমতে ধুয়ে দাদাজানের কাছে, চাচীর কাছে এবং মায়ের কাছে দৌড়ের উপর দোয়া নিয়ে গেলো। গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে মৌসুমী সাথে সাথে গেলো।
“স্যারের সাথে কথাবার্তা দূর থেকে বইলো। দাঁত মাজো নাই কিন্তু। স্যার মফিজ ডাকবো নইলে!”
আজমাইন তীক্ষ্ণতা নিয়ে তাকালে মুখ টিপে হাসলো মৌসুমী। পরক্ষণে বললো,
“আমার কাছে দোয়া নিবা না?”
“তোর দোয়া, তোর কাছেই রাখ।”
“আমি বললে কিন্তু দুই জনের দোয়া করা হইবো। মানে দ্বিগুণ দোয়া পাইবা।”
বুঝতে পেরে চলতে চলতেই পিছু ফিরে এক গাল হাসলো আজমাইন। আবার সামনে ফিরে যেতে যেতেই বললো,
“দোয়া করতে থাক তবে।”
“ওই, আমার বাদাম কিনা দিয়া যাইবা না?”
“ফেরার সময় আনবো।”
দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে চলে গেলো আজমাইন। যেতে যেতে পথে হঠাৎ রোজার সাথে দেখা। রোজা তাকে দেখে একটু বিস্ময়ের সাথে বললো,
“দশটা বাজতে তো বেশি সময় বাকি নেই। প্রথম দিন, একটু আগে আগে যাবি না?”
“দেরি হইয়া গেছে। কই যাও?”
“পোস্ট অফিসে।”
“দোয়া কইরো।”
“ইনশাআল্লাহ। প্রশ্ন খেয়াল করে ঠিকঠাক লিখিস।”
“আচ্ছা। ফুপুকে বইলো।”
“ঠিক আছে।”
আজমাইন চলে গেলো। রোজা গেলো ডাকঘরে চিঠি ফেলতে। এই আলো তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। ভেবেছিলো ভাইটা খবর নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু আজমাইন খবর আনেনি শুনতে পেরে চিঠি লেখার সিদ্ধান্তই নিলো। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, দুটি পাখা কিনে সে-ই খোঁজ নিতে যাক উড়ে উড়ে। কিন্তু কে দিবে সেই পাখা তারে? নিরুপায় হয়ে তাই ফেলে দিলো এক টুকরো চিঠি, আলোর নামে ডাকঘরে।
“কে আপনি? আমাকে চিঠি কেন লিখেন? কেন এভাবে দুশ্চিন্তায় ফেলেন? কেন ঘুম কেড়ে নিতে বারবার ডাকেন? আমি কি আপনাকে চিনি? কোনো সম্পর্কে সম্পর্কিত আপনার সাথে? দয়া করে জানাবেন।”
সময়মতোই পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে পেরেছে আজমাইন। তবে খাতা দেওয়া নয়, প্রশ্নপত্র দেওয়ার সময়ে এসেছে সে। দরজার সামনে থেকে স্যারকে সালাম দিয়ে প্রবেশ করে বললো,
“স্যার, আমার সিট কই?”
স্যার কিছু বলার আগে বন্ধুবান্ধবই ডেকে নিলো।
“আজমাইন, এদিকে আয়। এদিকে আয়।”
খাতা নিয়ে হুটহাট গেলো তার সিটে। ভালো সিট পেয়েছে সে। সারিগুলোর মাঝামাঝি, জানালার পাশে। আরামে লেখা যাবে তবে। একদিকে দেয়াল আর তিন দিকেই সহপাঠীদের মেলা! আলোবাতাসেরও কম হবে না। শুধু স্যারের নজর এড়াতে পারলেই হলো। ঝটপট খাতা রেডি করলো। আশপাশে কেউ কেউ লেখা শুরু করে দিয়েছে। কেউবা শুরু থেকেই এদিকে সেদিক ঘাড় ঘুরাতে শুরু করেছে। প্রশ্নে কি লেখা আছে, কিছুই পড়েনি নিশ্চিত। শুধু অপেক্ষায় থাকে, কে কি লিখলো তা দেখা যায় কি না। দেখতে পারলেই নিজের খাতা ভরে ফেলবে। কিন্তু আজমাইন তেমন ছেলে নয়। সে নিজ প্রচেষ্টায় লিখবে। প্রয়োজনে জিজ্ঞেস করবে, বন্ধুবান্ধবদের খাতায় নজর দিবে। বাকিটা সম্পূর্ণই তার নিজস্ব সময়সম্পদ। মনে রাখার জন্য মাথা কাজ না করলেই কি? তার হাত, পা তো আছেই। তারা মনে রেখেছে। বাকিটা চোখ আর মাথার সাপোর্টে হয়ে যাবে। তবে চুরিদারির আগেও আল্লাহকে স্মরণ করতে ভুলে না। লেখা শুরু করে দিলো প্রশ্ন পড়ে পড়েই। খুঁজে নিতে সমস্যাও হবে না তেমন। সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই গাইডবইয়ের নকলনামা লিখে নিয়েছে। বাম পা থেকে ডান পা, বাম হাত থেকে ডান হাত। এরপর পেট ও পিঠ। যেই প্রশ্নটা তার নকলনামার মধ্যে নেই, সেটার প্রতি নজর দিবে পরীক্ষা শেষের দিকে। আগে নিজের সম্পদের কাজ চালাবে।
লিখতে লিখতে ভালোই লিখলো। আশপাশের জন তো তার খাতা থেকে চোখই সরাতে চাইছে না। স্যার ধমক দিলে ঘাড়টা একটু সোজা হয়। আবারও সাময়িক প্রতিবন্ধী হয়ে উঠে সব! মাঝে মাঝে তো তার শার্ট, প্যাট ধরে টানাটানিও শুরু করে দিয়েছে! আজমাইন কলমের নিপল দিয়েই মেরে দিচ্ছে দু-এক ঘা! স্বচক্ষে দেখা সম্পদ যখন কাজে লাগানো হলো, তখন পরচক্ষুকে ধার নিলো। পেছনের জনকে বললো,
“লাভলু, আমার পিঠে দ্যাখ ছয় নম্বর প্রশ্নের উত্তরটা আছে। ফিসফিসিয়ে এক লাইন করে বল দেখি একটু।”
লাভলু বিস্ময়ের সাথে ফিসফিসিয়ে বললো,
“পিঠেও লেখছিস! আর কোথায় লেখছিস রে?”
“যেখানে পারছি, লিখছি। চুপচাপ বল দেখি।”
“বলতাছি।”
স্যারের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে আজমাইন পিঠে চুলকানোর ভঙ্গিতে শার্ট অর্ধেকটা উপরে তুলে ফেললো প্রায়। বাজ পাখির ন্যায় সজাগ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে পেছনের ছেলেটা। শার্ট তুললেই সে দেখতে শুরু করবে। দেখলোও ঠিকঠাক। লেখাও স্পষ্ট। তবে আজমাইন তার প্রত্যাশিত উত্তর পেলো না। লাভলু লাভেরিয়া হয়ে উঠলো যেন হঠাৎ। পড়া না বলে আজমাইনকে বললো,
“আই লাভ ইউ।”
আজমাইন শার্ট ছেড়ে দিয়ে ঘাড়টা হালকা ঘুরিয়ে চোখ রাঙালো।
“থাপড়াইয়া দাঁত ফালায় দিমু! কাজের কাজ করস না, সব জায়গায় শয়তানি! সময় যে নাই দেখছোস?”
“আমি কি করতাম? তুই যা লেখছোস, তা-ই তো কইলাম!”
“আবার ফাইজলামি! একটা লেখাও দেখাইতাম না কিন্তু তোরে। ঠিকঠাক বল।”
আজমাইন আবারও শার্ট তুললো। লাভলু দেখলো। পিঠের সবটুকু লেখাতেই ভালোবাসার শব্দের মেলা। লাভলু লাইনের পর লাইন তাই পড়ে গেলো,
“ভালোবাসি, ভালোবাসি। নকল ছেলে, আমি তোমায় ভালোবাসি। স্যার না জানলেও, আমি জানি। চুরি করেই পাস করবে তুমি।”
এমন আরও কত লেখা! শেষ দিকে তো জাতীয় সংগীতও লিখে দিয়েছে! লাভলুকে বিশ্বাস না করে হালকা করে ঘুরে বসে পাশের জনকে দেখালেও সে একইরকম সাক্ষ্য হলো। অবশেষে আজমাইনের কাছে স্পষ্ট হলো মৌসুমীর চাতুরী। তখন হাসতে হাসতে এই অঘটনটাই সে ঘটিয়েছিলো তবে? এবার দশটা নম্বরই যে শেষ হয়ে গেলো তার! ভারি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো মৌসুমীর প্রতি। আজ যে তার চৌদ্দগুষ্ঠীর খবর নিয়ে ছাড়বে! যেখানে সেখানে তার ভালোবাসার ছড়াছড়ি? ভালোবাসার পাগলাপানি খায়িয়ে ছাড়বে আজ!

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৪৩
(নূর নাফিসা)
.
.
নিজের সম্পদ শেষ হওয়ার পর উঁকিঝুঁকি মেরে এদিক সেদিক উত্তর পত্র খাপাখাপি করে পরীক্ষা শেষ করে এসেছে আজমাইন৷ তবে শেষ হওয়ার পরপরই বাড়ি ফিরে আসেনি। মাঠ থেকে খেলাধুলা করে বাড়ি ফিরেছে বিকেলে। বাড়ির দিকে আসার সময় দূর থেকেই মৌসুমীকে দেখলো, বাচ্চাদের সাথে লগি দিয়ে তেঁতুল গাছে খোঁচাচ্ছে। মনে পড়লো তার সর্বত্র প্রয়োগযোগ্য ভালোবাসাকে। এগিয়ে আসতে আসতে আশপাশ তাকিয়ে ঝিঙে লতার মাচা থেকে পাটের আঁশ খুলে নিলো হাতে। কাছে এসে কথা নেই, বার্তা নেই, হাত থেকে লগি ফেলে ওই হাতদুটো বাঁধতে শুরু করলো আগে। মৌসুমী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ওমা! আমার হাত বাঁধো ক্যা? এই!”
জবাব দিলো না আজমাইন। চুপচাপ হাত বেঁধে তাকে ঠেলে দাঁড় করালো মোটা তেঁতুল গাছ ঘেঁষে। পরক্ষণে তেঁতুল গাছেই বেঁধে দিলো উতলা ভালোবাসাকে! মৌসুমীর বিস্ময় চোখে কান্নার আভাস। আজমাইন এবার জবাব দিলো,
“আমার পিঠে তোর ভালোবাসা লেখার জায়গা? এইবার তেঁতুল গাছের সাথে ভালোবাসা দেখা। তোর প্রেমে হাবুডুবু খেতে যদি এবার তেঁতুল গাছের ভুত নেমে আসে।”
কানে ধরে টানও মারলো! সেভাবে কান্না না এলেও মৌসুমী মুখ ভেঙ্গিয়ে অ্যা… করে কান্নার আওয়াজ তুলে রাখলো। ছোট বাচ্চারা তাকে দেখে হাসছে। আজমাইন তাদের বলে গেলো কেউ যেন না ধরে। আর সবাই যেন তার থেকে দূরে চলে যায়৷ তবে তাদের চকোলেট খাওয়াবে। চকোলেটের লোভে সবই সরে গেলো৷ মৌসুমী একা পড়ে রইলো। গলা ছেড়ে ডাকতে লাগলো মা, বড় মাকে। বড় মা নেই বাড়িতে। ভাইয়ের বাড়ি গেছে ঘন্টাখানেকের জন্য। সেলিনা বেগম ঘরে থেকে শুনলেও ভেবেছে এমনিতেই দুষ্টুমি করছে। কিংবা মমো, সিয়ামের সাথে ঝগড়া করছে আর মাকে ডাকছে। তাই এখান থেকেই তিনি গলা ছেড়ে দুয়েকবার ধমক দিয়েছেন, এসব ঢং যেন না দেখায়। অযথা কেন যায় ছোটদের সাথে খোঁচাখুঁচি করতে? একটা মেরে তো দুইটা খেয়ে আসবে! মা, চাচীর অনুপস্থিতির সূত্রে যেন শাস্তি ভালোই সফল হচ্ছে আজমাইনের। বাইরের দুয়েকজন চলাফেরা করতে গিয়ে যা-ই দেখছে, কেউ আসছে না তাকে বাঁধন ছাড়া করতে। উল্টো হেসে যাচ্ছে তার অবস্থার উপর। আজমাইন পোশাক ছেড়ে গোসলে যাওয়ার আগে একবার উঁকি দিয়ে হেসে এলো। ঘঁষে মেজে কলমের দাগ তুলে গোসল করে শরীরে সরিষার তেল মালিশ করে ভাত খেলো নিজ হাতেই নিয়ে। তারপর দেহে শার্ট চাপিয়ে মৌসুমীর দিকে হেসেই দোকানে গেলো। মৌসুমী ক্ষণে ক্ষমা চাইছে, আর কখনো এমন করবে না। তাতে লাভ না হওয়ায় আবার হুমকিও দিচ্ছে, একবার ছুটতে পারলে তার মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলবে। আজমাইন হাসে আর হাসে। বিছুবাচ্চাদের চকোলেট কিনে দিয়ে নিজের জন্য দোকান থেকে বাদাম এনে তার সামনে দাঁড়িয়ে খায় আর খোসা ছুঁড়ে মারে মৌসুমীর মুখে। রাগে কান্নায় ফুসছে মৌসুমী। যা ইচ্ছে, তা-ই বলছে মুখে। অবশেষে বড়মা এসেই তাকে মুক্তি দিলো। মাকে দূর থেকে দেখেই মিটিমিটি হেসে আজমাইন চলে গেলো বিপরীত পথে। হালিমা খাতুন বিরক্ত হলেন তাদের কর্মকাণ্ডে। না পারে এই ছেলেকে নিয়ে, আর না পারে মেয়েটাকে নিয়ে। সারাক্ষণ দস্তাদস্তি লেগেই থাকে। এদের বোধ হবে না বুঝি কোনোদিন!
মৌসুমী তার মুখে মারা সবগুলো খোসা আবার কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে ঘরে। সন্ধ্যায় আজমাইন এসে হেসে হেসে যখন জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন লাগলো তেঁতুল গাছের পিরিতি? ভুত নেমেছিলো নাকি?”
“আমিই নেমে এসেছি তোমার ঘাড় মটকাতে!”
মৌসুমী ক্ষেপে খোসাগুলো তার দিকে ছুঁড়ে মেরে প্রতিশোধ নিলো। আজমাইন হাসলোই। তার মন ভালো আছে। আজ আবারও বাগডাশ এসে আজমাইনের টংয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ঘরের সবাই বের হলো ভয়ে, আতঙ্কে। এই বুঝি আবারও দুচারটে কবুতর শেষ করে দিলো। অথচ আজমাইন বের হলো উৎফুল্লতা নিয়ে। আজ তিনদিন যাবত অপেক্ষা করছে বাগডাশ নানার। অবশেষে ধরা পড়লো তবে, তারই পাতানো ফাঁদে! রশিতে বেঁধে ইঁদুরের বড় কল পেতে রেখেছিলো টংয়ের পাশে। তৎক্ষনাৎ সে চালে উঠে গাছের ডালে বাঁধা রশি খুলে ছটফটকৃত বাগডাশ নিয়ে এলো নেমে। সিয়াম তো মহা খুশি! আজ দিবে আচ্ছা ধোলাই তবে! হাঁসমুরগি, কবুতর আরও খাবে?
শুক্রবার চেয়ারম্যানের মেয়ের বিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা এবং বিশিষ্ট গণমান্য ব্যক্তি হওয়ায় আহমদ আলীর সাথে সুপরিচিত আছেন চেয়ারম্যান। আহমদ আলীর পুরো পরিবারকেই দাওয়াত করেছেন তিনি। আহমদ আলী তো যেতে পারবেন না, তাই তার খাবারটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিবেন। পরিবারের সাথে দাওয়াতে যেতে যেতে আজমাইন বারবারই সাবধান করে দিচ্ছিলো মৌসুমীকে পান খাওয়ার ব্যাপারে। যত্রতত্র দাওয়াতে গিয়ে তার পান চিবানোর অভ্যাসটা একদম ভালো লাগে না আজমাইনের। মৌসুমী জবাব দেয় না। তার উত্তেজনা বাড়াতে শুধু মিটিমিটি হাসে। চেয়ারম্যানের মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য সানাই বাজিয়ে ভারি নকশাযুক্ত পালকি নিয়ে এসেছে বরযাত্রী। মৌসুমী দেখেই যেন মুগ্ধ হয়ে গেলো! বারবারই মুগ্ধ চোখে ফিরে তাকায় সৌখিনতার পালকিতে। মনের আফসোস তো মনে আছেই সাথে। ইশ! কেন তার পালকি চড়ে যাওয়া হলো না স্বামীর ঘরে? যাবেই বা কি করে? ঘর যে একই দুয়ারে! ধ্যাৎ! বিয়েশাদি কি এভাবে ঘর থেকে ঘরে হতে হয়? না হওয়া যায় নতুন মনের আয়না, না ধরা যায় বায়না! কিন্তু বায়না ধরার আগেই প্রেমিক পুরুষ এসে হঠাৎ প্রস্তাব ঢেলে দিলো।
“মৌ, পালকিতে বসবি?”
মৌসুমী ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো আজমাইনের দিকে। সে তখন থেকেই লক্ষ্য করছিলো মৌসুমী ঘুরে ঘুরে বারবার পালকির দিকে তাকায়। হয়তো মনে মনে ইচ্ছে পোষণ করে একবার বসার৷ তাই আজমাইন কথা বলে এলো পালকিবাহকের সাথে। প্রস্তাব করতেই তার মৌ খুশিতে নেচে উঠলো যেন! আজমাইন নিয়ে গেলো তাকে। আটপায়ে চলা হলো না ঠিক, তবে বসার সাধ মিটেছে ক্ষণিক। ইশ! একটু হলেও তো বসার সুযোগ হলো এই চৌকোণার ছোট্ট ঘরে! সেজেও তো আছে এক বধূ বেশে। আজ তার বিয়ের লাল টুকটুকে শাড়িটাই যে পরে এসেছে৷ দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে তার বর মশাইকে দেখতেও ভুলেনি যে। কি দারুণ লাগছে মুহুর্তটাকে! মনে হচ্ছে সে আবার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে পালকিতে চড়ে! আহ! পান খাওয়া তো সুখ না রে। স্বামীর এই উপহার টুকুই চোখেমুখে ঝলমল করে গেলো সারাদিন ভরে।
এদিকে রবিবার দিনই দ্বিতীয়বারের মতো বউ এসেছে সাইদুরের ঘরে। এবার একই গ্রামের অল্পবয়সী গেঁয়ো মেয়ে নিয়ে এসেছে চাচী, শাহিনুর বানু। ধীরে ধীরে তার হৃদয়টা যেন নরম হয়েছে। সেদিন কেমন ইতস্তত বোধ করে হঠাৎ মরিয়মকে প্রস্তাব করলো উত্তরপাড়ায় একটা দরিদ্র মেয়ের সন্ধান পেয়েছে। তাকে নিয়ে দেখতে যাবে মেয়েটা কেমন হবে। মরিয়ম মনে দাম্ভিকতা রাখলো না মোটেও। তবে সংকোচ ছিলো বটে। যে কথায় কথায় খোটা দেয়, তার সাধাসাধিতে আবার যাওয়া উচিত কি না? সংকোচটা কাটিয়ে দিলো রোজা। যেহেতু নিজে উচ্ছ্বসিত হয়ে একটা প্রস্তাব করেছে, তার অবশ্যই যাওয়া উচিত। গেলো মরিয়ম। অতি সাধারণ জীবযাপিত পরিবার। দুই ভাইয়ের একটাই বোন। ঘরে চলছে টানাপোড়েন। তালাকপ্রাপ্ত পাত্রের কাছেও বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেছেন মেয়ের পরিবার। বড় ঘরে যাচ্ছে, এটাই যেন অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার মনে করছে। বিয়েটা সেখানেই হয়ে গেলো পারিবারিকভাবে। মেয়েদের নেই আয়োজনের সামর্থ্য, আর ছেলেপক্ষের নেই মনমানসিকতা। বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে আসার পরই রোজা দেখলো তাকে। সরলতা সমৃদ্ধ চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। শ্যামকালো গায়ের রঙ। চলাফেরা তিড়িংবিড়িং প্রকৃতির। রোজার চোখে এ যেন আরেক মৌসুমী! কিন্তু তার নাম মিতালি। ভালোই লাগে তার এই চঞ্চলতা। সাইদুরের মনটা হয়তো আনন্দিত হলো না বউ সুন্দরী না হওয়ায়। তবে ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য। সে আর কি পুরুষ মন। চোখের সামনে দেখলে গুণ, মুগ্ধ হতে কতক্ষণ? শাহিনুর এবার আর মাথায় তুলে রেখে ভুল করবে না ছেলের বউকে। কোনো প্রয়োজনও নেই এক ঘরে সীমানা গেড়ে রাখার। যথাযথ আদর, শাসনে রাখবেন ঠিক করেছেন। দুদিন যাবত দেখছে রোজা, কাজের আগে আগেই তিনি ডাকেন পুত্রবধূকে। মেয়েটাও ধেইধেই করে চলে ডাকের সাথে সাথে। রোজা ঝাড়ু নিয়ে উঠুনে নামার আগেই দেখলো, বাড়ির আনাচে-কানাচে মিতালির হাতেই ফকফকে! আহা, কি প্রশংসা মরিয়ম ও শাহিনুরের মুখে। রোজাও প্রশান্তির সাথে হাসে। সেই হাসি নেভাতে জাবেদ কাকা এসে হাজির চিঠি হাতে।
আলোর ঠিকানা হতে রোজার চিঠির জবাব এসেছে,
“ঘুম কেড়ে নিতে চাই না রে খুকি। আমি তো বেলা শেষেও আয়না ভাঙার স্বপ্ন দেখি। একবার ইচ্ছে হয়, লুকিয়ে যাই গভীরে। হারিয়ে যাই চিরতরে। আবারও মায়া হয়, ভীষণ ব্যাথা হয়। ইচ্ছে হয় ছুটে যেতে নাড়ির টানে। ভাবি, নীড়ে ফিরে আসি সকল ধুলোমলিন পর্দা ছিঁড়ে।”

চলবে।