“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৪৪
(নূর নাফিসা)
.
.
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মৌসুমীর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলো। যদিও নম্বর কম পেয়েছে, তবুও সকল বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। আজমাইন তো যখন তার মুখ দেখে তখনই বিদ্রুপাত্মকভাবে বলে,
“কিরে, মৌটুসী। তুই নাকি সিগারেট পাইছোস?”
মৌসুমী ক্ষেপে, ভেঙচি কাটে। ভীষণ রাগ হলে বলে,
“ভালা করছি সিগারেট পাইছি। এইবার সেই সিগারেট পানিতে ভিজায়া খেয়ে নে শয়তান!”
আবার কখনো ভেটকিয়ে বলে,
“তোমার মতো দুইবার মেট্রিক তো দিতে হয় নাই আজমাইন!”
নাম ধরে ডাকলে আজমাইনও ক্ষেপে। চোখ কটমট করে তাকায়। তবে তাড়া করে না। সচেতন হয়েছে সে। ইদানীং বুঝা যায়, বাচ্চা মৌসুমী আরেক বাচ্চার বাহক। দুষ্টুমি করলেও একটু আগলেই রাখে তাকে। অন্যরকম মায়া জন্মায় হৃদয় গভীর হতে। বাদামের বায়না সবসময় করতে হয় না। নিজ থেকেই বাদাম এনে দেয়। মায়ের হাতে দেওয়া টাকা বাদে নিজের কাছে যা ছিলো, বাড়ি থেকে থেকে এমনি এমনি শেষ করে নিচ্ছে। পরীক্ষাগুলো সব নকলের সাথেই চলছে। একটু আধটু গদগদপাঠ যে হয় না, তেমনটাও নয়। চলছে চলার মতোই। শহরে ফেরার সময়ও ঘনিয়ে আসছে। ওদিকে সুখবার্তা পড়েছে মরিয়মের ঘরে। মরিয়মের প্রত্যাশাকে পূর্ণ করতে খুশি হওয়ার অধিকারটা যেন তাকেই আগে দিয়েছে রোজা। মাহতাবকে লিখেছে নানান অনুভূতির চিঠি। তার মধ্যে অন্যতম অনুভূতিপূর্ণ বাক্য,
“প্রিয় চাঁদ, চাঁদের স্নিগ্ধতা এবার আরও বেড়ে যাবে মনে হচ্ছে আমারও ঘরে। শীঘ্রই কোলে নিবে তুমি, গুটিগুটি হাতপায়ের স্নিগ্ধ ছবি। বুক ভরে চোখ জুড়িয়ে তাকিয়ে হাসবে তুমি প্রশান্তির হাসি।”
বার্তা পেয়েও মাহতাবের মুখে ফুটেছে তৃপ্তির হাসি। চিঠির আগে কৃত্রিম যন্ত্রের সাহায্যেই শুনে নিয়েছে তার কণ্ঠধ্বনি। আহা! সে কি আদানপ্রদান গল্প, অনুভূতি!
আজমাইনের পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র মাহতাব আবার ডেকেছে তাকে শহরে। নতুন কাজের ব্যবস্থা করেছে। যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরি। কাজের ধারাবাহিকতা ভালো হলে এবং এইচএসসির ফলাফল ভালো হলে পদোন্নয়নের সুযোগ পাবে। বেতন বাড়বে। এখনো বেড়েছে। আগের কাজ ছিলো হালকার উপর। সারামাস পরিশ্রম করে পাঁচ হাজার। এখন পাবে সাত হাজার। পদোন্নয়নে আরও হাজার চারেক বেড়ে যাবে। একটা সংসারের ভার প্রায় সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। নিজের হাত ও বলকে কাজে লাগালে বাবামায়ের কাছে হাত পেতে চাইতে হয় না। বরং বাবামায়ের হাত পূর্ণ করে দেওয়া যায়। চোখে আনন্দের অশ্রু এনে দেওয়া যায়। স্ত্রী সন্তানের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটানো যায়। নিজের কাছে নিজেকে বটবৃক্ষ মনে হয়। আশপাশকে ছায়া দেওয়ার বিশালত্ব জাগে। সেই জীবনের সূচনাতেই সংযুক্ত হয়েছে আজমাইন।
দুদিন হয় আজমাইন শহরের পথে গেছে। সেই শহরকেই মনে করে সকালবেলা কাঁপা কাঁপা হাতে আহমদ আলী সাদা কাগজে কালো দাগ ফেলে মনের বার্তা লিখতে বসেছেন হঠাৎ জানালার ধারে। ক্ষণে উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। ক্ষণে ধীর দৃষ্টি ফেরান ছোট ছোট লেখার দিকে। হাতের লেখার কত পরিবর্তন হয়েছে। হাতের পরিবর্তনও ব্যাপক। এই হাত একদিন কি মজবুতই না ছিলো। রাইফেল মুঠো ধরেছিলো শক্ত হাতের বাঁধনে। ‘নিজের প্রাণ ছেড়ে দিবো, তবুও দেশের মান ছাড়বো না রে।’ সেদিন সফল হলো। আরও ভালো মন্দ কত কাজই না সম্পন্ন হলো এই হাতে। কত চিঠিই না লিখলো কত প্রীতিজন আর যোদ্ধার ঠিকানাতে৷ ছেলের সাথেও তো কথা হতো কয়েকদিন আগে। কলম ধরতো স্পষ্ট হাতে। এখন সেই হাত কাঁপে ঝড়ের গতিতে। কবে না থেমেই যায় বেলা ফুরাবার সাথে! কাঁপা হাতের দাগে লেখা কাগজটা ভাজ করে রেখে দিলেন তিনি বিছানার নিচে। যে পাশে মাথা রেখে নিদ্রা যান তিনি, সে পাশেই বালিশের নিচে চাদরের আড়ালে রেখে দিলেন কণ্ঠ উচ্চারণে অনিচ্ছুক না বলা কথার ঝুলি। আবারও উদাস মনে তাকিয়ে রইলেন জানালার ওপারের পৃথিবীর সম্মুখে। ওই দূর আকাশ কি তবে পেরুবে সে? নাকি ভুবনের ভেজা মাটিতেই তার শেষটা গেঁথে যাবে? এমন নানান প্রশ্নের জাগান দেয় মাথার খুলির ধুলিতে।
তখন ছিলো সকাল আর এখন বিকেল। দিনের বাহিরটা ঝলমলে, সুবাসিত সোনালী আলোর ঘ্রাণে। ভেতরটা বৃষ্টিভেজা, বৈশাখী ঝড়ো হাওয়ায় যেন হঠাৎ ধাক্কালো। ভেঙে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। কি হলো, বুঝা গেলো না। তবে কিছু অপ্রকাশ্য, অবর্ণনীয় ব্যাথা এসে ঘিরে ধরলো অনুভূতির কাল হয়ে। এ যাত্রায় বোধহয় আর সোনালী আলোর সাথে দেখা করার সাধ্য হয়ে উঠলো না। মাটির অতল তাকে টানলো বুঝি নিমেষে।
আসরের আজান পড়েছে। সেলিনা তার পরপরই এলো শ্বশুরের ওজুর পানি এগিয়ে দিতে। অর্ধ খোলা দরজার ভেতর প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো প্রবীণ দেহটা বিছানার ধারে মাটিতে আধশোয়া অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। থরথর করে কাঁপছে মাথাসহ পুরো শরীর। উঠার চেষ্টা করেও পারছেন না উঠতে। জবানে কোনোরকম স্পষ্টতর শব্দ নেই। কাউকে ডাকার মতো গলায় জোরও নেই। কেবলই গোঙাচ্ছেন আহমদ আলী। বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো সেলিনা বেগমের। ছুটে গেলো উঠাতে,
“আব্বা, কি হইছে আপনের? আব্বা, পড়লেন ক্যামনে? কি হইছে? আব্বা, কথা কন না ক্যা?”
উঠার চেষ্টায় হাঁপানো আর গোঙানো ব্যতীত কোনো শব্দ নেই তার সাধ্যে। সেলিনা বেগম উঠাতে চেয়েও যেন উঠাতে পারছে না। আহমদ আলীর নিজস্ব প্রয়োগযোগ্য কোনো শক্তি নেই। এই অবস্থায় একটা মানুষকে একা টেনে তোলারও সাহস নেই সেলিনা বেগমের। কোনোরকম হয়ে গেলে কেমন হবে! সে ভীত গলা ছেড়ে দিলো বাইরের দিকে। তার চিৎকার শুনে হাড়িপাতিল ফেলে দৌড়ে এলো হালিমা খাতুন উঠুনের শেষ প্রান্ত থেকে। মৌসুমীও ছুটে বের হলো ঘর থেকে। গেইটের কাছে মমো আর সিয়াম খেলা করছিলো বালি দিয়ে। তারাও সবার দৌড় দেখে ছুটলো দাদাজানের ঘরের দিকে। বুকের ভেতরটা কাঁপছে হালিমা খাতুনের। ধরাধরি করে তারা আহমদ আলীকে তুলে বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন। কেউ হাত, কেউ পা ঘঁষে যাচ্ছে অনবরত। সিয়ামকে পাঠালো মোয়াজ্জেম আলীকে খুঁজে আনার জন্য। কি থেকে কি হয়ে গেলো, বুঝতে পারলো না কেউ। সিয়াম মৃগন্যায় লাফিয়ে ছুটে চলে মাঠ পেরিয়ে গেলো বাবাকে খুঁজে আনতে। মোয়াজ্জেম আলী ফসলের পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকেন দুপুরের পরবর্তী সময়। ছেলে এসে খবর পৌঁছাতেই তিনি কাজ ছেড়ে ছুটলেন। বাবার অবস্থা দেখে ভীত কম্পিত গলায় বাবাকে ডাকলেন,
“আব্বা, আব্বা।”
কোনো সারা নেই আব্বাজানের। কথা বলার শক্তি নেই। প্রাণটা যেন ছটফট করছে শুধু। চটজলদি রাস্তায় গিয়ে ভ্যান ডেকে নিয়ে এলেন। কোলে তুলে ভ্যানে করে বাবাকে নিয়ে ছুটলেন বাজারে ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার অবস্থা ভালো দেখলেন না৷ একই ভ্যানে পঠিয়ে দিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। যেতে যেতে হালিমা খাতুন শ্বশুরের ফোন হতে মৌসুমীকে দিয়ে কল করালেন মরিয়মকে। রোজা ও মরিয়ম দুজনেই গেলো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে। রোজাকে যেন খুবই দরকার সময়টাতে। জ্ঞানের দিক থেকে একটা ভালো পরামর্শ দেওয়ার তেমন কেউই নেই এই মুহুর্তে। ডাক্তার কি বলেন, না বলেন সবটা না-ও বুঝতে পারে তারা। ছেলেগুলো নেই পাশে, আমজাদ আলী থাকলেও কোনো হাঁপানো ঝাঁপানোর চিন্তা ছিলো না তাদের। একাই সকল ছোটাছুটি ও জ্ঞান বিবেচনায় ব্যবস্থাপনার কাজ চালিয়ে যেতে পারেন তিনি। মোয়াজ্জেম আলী বড় ভাইয়ের মতো ততটাও দক্ষ নয়। বাড়িতে সেলিনা বেগম ওজু করে নামাজ এবং মোনাজাতে বসে গেছেন। একটা সুসংবাদ ফিরে আসার প্রত্যাশা করছেন তিনি।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার দেখানো হলো, কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করা হলো। চাচার সাথে সর্বত্র ছোটাছুটি করলো রোজা। তারও হৃদয়টা কাঁপছে। দাদাজানের স্ট্রোক হয়েছে জেনে তো এতোক্ষণ মজবুত ভাবে ছোটাছুটি করা চোখদুটোও ভিজে উঠেছে। দাদাজান বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। কাউকে চিনতেও পারছেন না। তার অবস্থার উপর মর্মাহত হয়ে গেলেন প্রত্যেকে। একদিন সেখানেই চিকিৎসারত অবস্থায় রাখা হলো আহমদ আলীকে। সাথে রইলেন মোয়াজ্জেম আলী, মরিয়ম এবং রোজা। বাকিদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাহতাবের নিকটও খবর পৌঁছে গেছে রাতেই। ডাক্তার ভালো না পেলে প্রয়োজনে শহরে নিয়ে নানাজানের চিকিৎসা করাতে সে প্রস্তুত।
আহমদ আলীর ছটফট ধীরে ধীরে শান্ত হলো। জ্ঞানশক্তি স্বাভাবিক হলো। কিন্তু শারীরিক ক্ষমতা ও বাকশক্তির কোনো পরিবর্তন এলো না। পরদিন শহর থেকে সরকারি পদেরই বড় ডাক্তার এলো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। রিলিজ হওয়ার আগে তাকে দেখালো রোজা। তিনি রিপোর্ট দেখে বললেন, আহমদ আলী স্ট্রোকে বাকশক্তি হারিয়েছেন এবং প্যারালাইজড হয়ে গেছেন। জ্ঞানশক্তি ফিরলেও শারীরিক ক্ষমতা ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। ওষুধপত্র দিয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা চালু রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। এক রাশ ব্যাথা নিয়ে তারা বাড়ি ফিরে এলো। বিকেলের আগে আজমাইন ও মাহতাব ছুটে এলো তাকে দেখতে। কারো মুখভঙ্গিতেই স্বাভাবিকতা বজায় নেই। অপ্রত্যাশিত ব্যাথা ও গম্ভীরতা ধারণ করেছে আপনজনদের এক একটা মুখ। মেয়ে, ছেলের বউ এবং নাতনীরা তো নিরবে কেঁদেও চোখ মুছে যাচ্ছে আঁচলে। আমজাদ আলীকে ধীরেসুস্থে জানানো হলো পরবর্তী দিন। তিনি এমনিতেই দূরে আছেন, বাবার অবস্থার কথা ভেবে না আবার উত্তেজিত হয়ে নিজেরই অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন! তাই ধীরেসুস্থে জানানোরই উদ্যোগ। কিন্তু মন কি আর মানে? তিনি অস্থির হয়েছেনই বটে। দূরত্বের অস্থিরতা যেন একটু বেশিই প্রকটিত হয়। কিছুক্ষণ পরপরই ফোনকলে তিনি খবর নিচ্ছেন, ‘আব্বার অবস্থা এখন কেমন?’
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৪৫
(নূর নাফিসা)
.
.
কাজ ফেলে আসার পরদিনই শহরের ছেলেদের কর্মস্থলে ফিরে যেতে হচ্ছে। দুদিন যাবত মরিয়ম তো এখানেই আছেন। মাহতাব এসেও এখানেই থেকেছিলো। পরিবারের মনমানসিকতা এমনিতেই তো কারো ভালো নেই, তারউপর যাওয়ার আগে যেন মৌসুমীর মুখখানা কিছুক্ষণ আগের তুলনায় একটু বেশিই মলিন দেখলো আজমাইন। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো তোর? মন খারাপ কেন?”
“আবার কবে আসবা?”
তার জিজ্ঞাসায় আজমাইনের মলিন মুখে হাসি ফুটলো। এগিয়ে এসে কানের ধারের ছোট চুল পেছনে গুজে দিয়ে গালে স্পর্শ করে বললো,
“মাসখানেক পরে।”
মৌসুমী অভিমানে অভিযোগ তুলে দিলো হঠাৎ।
“মাহতাব ভাই একাধারে আপুরে কল দেয়। তুমি কল দিবাতো দূর, নিজে একটা ফোনই কিনো না। বুঝলাম ফোনের খুব দাম, না-ই বা খরচ করলা টাকা। একটা কলম আর কাগজ কিনে চিঠি তো লিখতে পারো? মাহতাব ভাই ক’দিন পরপরই চিঠি দেয় রোজা আপুরে। অথচ তুমি তা-ও দেও না। আমার বুঝি শখ লাগে না প্রেমের?”
“অন্যেরটা দেখে তুই জ্বলে যাস কেন? আমি যেমন করে তোরে ভালোবাসি, মাহতাব ভাই তেমন বাসতে পারে না।”
কথার পরপরই দুই আঙুলে গাল টিপে ছেড়ে দিয়ে ব্যাগটা তুলে কাঁধে নিলো। মৌসুমী অভিমানী কণ্ঠেই বিড়বিড় করলো,
“ভালোবাসে না ছাই!”
বিড়বিড় শুনে আজমাইন ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটালো। তারপর বললো,
“আয়, বাদাম কিনে দেই।”
“খামু না বাদাম। বমি আসে আমার।”
“মায়ের বোয়াম ভরা আঁচার আছে দ্যাখ গিয়ে।”
“শিখায় দিতে হইবো না তোমার।”
আজমাইন এগিয়ে এলো আবার। মুখের হাসি বিদ্যমান রেখে একহাতে জড়িয়ে ধরলো আলতো করে। জমে থাকা অভিমান যেন ভেজা কাপড়ের পানির ন্যায়ই ঝরে পড়ছে এবার। ভালোবাসার মুগ্ধতায় অভিমান কাটিয়ে এবার মৌসুমী মুখে লাজুক রশ্মি মেখে চোখ তুলে আজমাইনের দিকে তাকাতেই গলে কামড় বসিয়ে দিলো সে। লজ্জাবতী হেসে উঠলো এবার,
“যাও! ব্যাথা পাই না বুঝি?”
“মিস করিস আমাকে?”
“বাড়ির সীমানাটা পার হইলেই খুব খারাপ লাগে। ইচ্ছে করে দুনিয়ার কাছে অভিযোগ তুলি, কেন তোমাকে কাজের অজুহাতে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে?”
আজমাইন হাতের ব্যাগটা ছেড়ে দিয়ে দুহাতে একদম মিশিয়ে রাখলো নিরবে। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হতেই নিরবতা ভেঙে বললো,
“এইবার তো আরও বেশি কাঁদবি। এজন্যই ইচ্ছে করে না কিছু বলে যেতে। কিছু পাঠাতেও ইচ্ছে হয় না বারবার মনে করবি বলে যে, আমি দূরে আছি। এজন্যই করি না এতোসব। এখন যে ছাড়তেই ইচ্ছে হচ্ছে না, করি কি আমি?”
মৌসুমী তার বুকে কান্না চাপা দিয়ে দুহাতে শার্ট খামচে ধরে রাখলো। তারও ইচ্ছে করছে না ছাড়তে। আগেরবার যেতে দিয়েই কেমন জ্বলে যাচ্ছিলো। এখন আরও মারা যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। একদমই যেতে দিতে ইচ্ছে হয় না। অন্যরা থাকে কি করে বরকে দূরে পাঠিয়ে? তাদের হৃদয় জ্বালা করে না? নাকি আজমাইন তাকে এভাবে ভালোবাসে বলেই শুধু তারই এমন হয়? কষ্টের প্রকোপে ভাবে মৌসুমী। মিনিট দুয়েক পার হতেই আজমাইন সরিয়ে দিলো। এক হাতে ব্যাগ তুলে অন্য হাতে তার চোখ মুছে দিয়ে গেলো। যেতে যেতে তার দিকে তাকিয়ে এবার মুচকি হেসেছে তার দুষ্টু লোকটা। মৌসুমীর ঠোঁট ভেঙ্গিয়ে আরও কান্না আসছে। মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে মাহতাবের সাথে আজমাইন বাড়ির সীমানা পার হলে সে বারান্দা ছেড়ে দৌড়ে এসে গেইটের কাছে দাঁড়িয়েছে। হালিমা খাতুনও দাঁড়িয়ে আছে এখানে। আজমাইন দৃষ্টির সীমানা অতিক্রম করলে হালিমা খাতুন তাকে দেখে মাথায় হাত বুলালেন। হুশ ফিরলেই মৌসুমী কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ করলো। ইশ, এভাবে কাঁদার কি আছে? মাহতাব ভাইও তো যায়, রোজা আপু কি এভাবে কাঁদে? জেঠুও তো বহুদিনের জন্য যায় বহুদূরে, বড় মা কি এতোটা কান্না দেখায় কাউকে? সে এইটুকুতে কাঁদছে কেন তবে? একদমই কাঁদবে না। রোজা আপু আর বড় মা’র মতো বড় হতে হবে তাকে। ঘরে এসে হঠাৎ মাটির ব্যাংকে চোখ পড়লো। মৃদু হেসে এগিয়ে শুকনো জবা নিলো হাতে। এই জবা আনসারির বাড়ির গেইট থেকে চুরি করে এনেছিলো সেদিন শহরে যাওয়ার আগে। তার কানে গুজে দিয়ে লোকটা বলেছিলো,
“খাদেম আনসারির গাছের এই ফুলটা তোর জন্যই ফুটেছে রে, মৌ। তাই লুকিয়ে নিয়ে চলে এলাম। ভাগ্যিস! আনসারি দেখেনি আমাকে!”
দিনের বাকিটা সময় এই জবা সে কানে গুজানো রেখেই ঘুরেবেড়িয়েছিলো। পরে গেঁথে রেখেছিলো এই ব্যাংকে। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। তবুও ভালোবাসার জিনিস ফেলতে ইচ্ছে হয় না যে।
আহমদ আলীর অবস্থা একদিন উন্নত হলে আরেকদিন অবনতিতে যায়। এভাবেই চলছে দিনগুলো। ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে পরিজনদের মনে। কিছু হারিয়ে ফেলের ভয়। কিছু ছায়া সরে যাওয়ার ভয়। কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্যের ইতিটানা! অথচ তারা এসব চায় না। পাড়াপড়শিরাও টুকটাক দেখতে আসে প্রতিদিনই। চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকেও দেখতে এলো ফলমূল নিয়ে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তো আছেনই। পরবর্তী সপ্তাহেই আমজাদ আলী বাড়িতে হাজির! কেউ ভাবতেই পারেনি হুট করে তিনি চলে আসবেন। কিন্তু তার মন বড়ই আনচান করছিলো৷ কেন জানি মনে হচ্ছিলো দিন ফুরিয়ে এসেছে। বাবাকে একটু দেখার, বাবার পাশে কিছু সময় কাটাবার তাগিদে ছুটে এসেছে দূরদেশ থেকে। কি হবে টাকাপয়সা দিয়ে? যদি বিদায়কালে বাবার জানাজায়ও অংশগ্রহণ করতে না পারে? আর যাবেই না তিনি ওই দূর দেশে। যতদিন জীবন আছে, জীবনের এই সময়টুকু পরিবারের কাছেই কাটিয়ে দিবে। তাই কাউকে না জানিয়েই বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে সকল বন্দোবস্ত করে চলে এসেছেন। চমকে দিয়েছেন সকলকে। রোজা এখানেই আছে ক’দিন যাবত। মরিয়ম প্রতিদিনই ওবাড়ি যায় আবার আসে। সংসারের প্রয়োজনীয় কাজ ব্যতীত সকলেই অধিক সময় ব্যস্ত আহমদ আলীর খেদমতে। আমজাদ আলী বাড়ি ফিরেই জানিয়েছেন তিনি আর যাবেন না দূরে। ভালো লাগে না তার প্রবাস জীবন। পরপরই অবস্থান করেছেন আহমদ আলীর ঘরে। বাবার শায়িত দেহ খানা দেখে ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। পাশে বসে তিনি মাথায় হাত বুলালেন। নিথর হাতটা নিজের হাতে তুলে ডাকলেন,
“আব্বা?”
আহমদ আলী কানে শুনতে পায়। তবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সময় নেয়। বড় ছেলের ব্যাথাতুর গলার স্বর তার কানে প্রতিধ্বনি হলো। তিনি চোখ খুলে দৃষ্টি জোড়া হালকা ঘুরিয়ে তাকালেন। ছেলের মুখটা দেখে হাতের আঙুলগুলো নাড়ানোর চেষ্টা করলেন। ধার বেয়ে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এই অশ্রু যেন জানান দিচ্ছে তিনি সাড়া দিতে অক্ষম। তার খুব ইচ্ছে করছে মুখে বলার,
“তুই আমার জন্য চলে এসেছিস বড় খোকা? ছোট খোকা প্রতিদিন আমায় ছোঁয়, মুখে খাবার তুলে দেয়। সেদিন ডাক্তারের কাছেও কেমন পাগলের মতো ছোটাছুটি করলো। কিন্তু তোকে পাইনি আমি। বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো তোর দেখা, ছোঁয়া পাচ্ছিলাম না বলে।”
বাবার কিছু বাক্য প্রকাশের আপ্রাণ চেষ্টাটুকু দেখে কেঁদে ফেললেন আমজাদ আলী। হাতটা কপালে ঠেকিয়ে হু হু কান্না জুড়ে দিলেন। পাশেই রোজা দাঁড়িয়ে। বাবাকে শেষবার কাঁদতে দেখেছিলো দাদীজানের জন্য। আজ দাদাজানের শিয়রে বাবার কান্না। ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না চাপা দিয়েছে রোজা। বাবার কাঁধে রেখেছে সান্ত্বনার হাত। আমজাদ আলী সময় নিয়ে শান্ত হলেন। চোখ মুছলেন। বাবাকে আশ্বাসিত করলেন কিছু বাক্যে যে, তিনি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন। ছেলের কথা শুনে আহমদ আলী কাঁদেন। ছেলেই আবার চোখ মুছে দেয়। রোজার সাথে আমজাদ আলী ডাক্তারের ব্যাপারে কথা বলেন। সবই শুনলেন, জানলেন। বুকের ভেতর কষ্টটা বেঁধে রাখলেন।
একইদিনে আজমাইন সাপ্তাহিক ছুটি পেয়ে আবার সেই মহল্লায় যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। খুব ভোরেই জেগে রওনা হচ্ছিলো। মাহতাব যেন আটকে ধরেছিলো, আজ এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠলো যে? অন্যদিন নামাজের জন্য ডাকলেও তো উঠতে উঠতে দেরিতে নামাজ পড়লো। আজ আত্মোদ্যোগেই যেন উঠে নামাজ আদায় করলো আবার বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার তাড়া দেখালো। আজমাইন কোনোমতে কথা কাটিয়ে মুক্তি নিয়েছে। আজ তাকে ওই ঘরের লোকেদের সাথে দেখা করতেই হবে। ভোরের পরিবেশে হাটতে ভালোই লাগছে। মহল্লার কোনো কোনো ঘরের দরজা খোলা, কোনো কোনো ঘর এখনো ঘুমের ঘোরে বিলীন। আগের দিনগুলোর মতো কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ আজ অনুধাবন হচ্ছে না বলেই হয়তো ভালো লাগছে। একটা আঁধার রাতের ব্যবধানে জনমানুষের ঠেলাঠেলির পথ ফাঁকা ও শুকনো থাকায় যেন ভালো লাগাটা উপলব্ধি হচ্ছে। বস্তি যখন, পথে দুর্গন্ধ ও আবর্জনা তো থাকবেই। আশপাশ দেখে হাঁটতে হাঁটতে সে এসে থামলো সেই ছোট্ট ঘরের সামনে। আজ দরজায় তালা ঝুলানো নেই। ভেতর থেকে বন্ধ করা। ঘরে মানুষ তো নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তারা কি জেগেছে? দরজায় নক করা ঠিক হবে নাকি অপেক্ষা করবে, ভাবছে আজমাইন। অপেক্ষা করতে থাকলে দেখা যাবে কাজের তাড়নায় তারা বেরিয়ে গেছে আবার। কথা বলার সময়টুকু হবে না তখন আর। তাই ইতস্তত বোধ করে দরজায় টোকা দিলো আজমাইন। সাথে সাথেই এক পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো।
“কে?”
আজমাইন সাড়া দিলো,
“একটু বাইরে আসবেন?”
লোকটা গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করতে করতে এসে দরজা খুললো। খালি গায়ে আধ পুরনো লুঙ্গি পরহিত এক পঞ্চাশোর্ধ লোক। চোখে চশমা লাগানো। আজমাইন সালাম দিলো। ধীর কণ্ঠে সালামের জবাব দিতে দিতে তাকিয়ে রইলো লোকটা। যেন চেনার চেষ্টা করছে খুব। নাকি চিনেছেই, বুঝতে পারছে না আজমাইন। কিন্তু তার মনে হচ্ছে এই লোককে আজই প্রথম দেখেছে। সে ততো না ভেবে জিজ্ঞেস করলো,
“এটা কি আলোদের ঘর? উনার সাথে একটু কথা বলার ছিলো।”
চলবে।