#স্মৃতির শহর
#পর্বঃ১৫
#তানিশা সুলতানা
খুশির দিন গুলো ফুরিয়ে গেছে বিহানের। জীবনটা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। থমকে গেছে চারপাশটা
ছোট বেলা থেকেই খুব হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল ছিলো বিহান। বাবার মৃত্যুটাও ওর হাসিখুশি জীবনটাকে বদলাতে পারে নি। মাকে সামলানোর জন্যও হলেও সব সময় ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি রেখেই ঘুরে বেড়াতো। দুহাতে আগলে রেখেছে মাকে।
কতো সুন্দর একটা পরিবার হতো বিহানের। যেখানে থাকতো বিহান রাই মা আর পিচ্চিটা। সকাল বেলা ঘুম ভাঙতো পিচ্চির কান্নার শব্দে। রাই রান্না ঘর থেকে চিল্লিয়ে বলতো “বিহান বাবুকে একটু ধরো না? আমার হাত জোড়া কাজ”
বিহান তখন ঘুমঘুম কন্ঠে মাকে ডাকতো। মা এসে বাবুকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করতো। আর বিহান আবারও ঘুমানোর বাহানা খুঁজতে। আর তখনই রাই খুন্তি হাতে নিয়ে কর্কশ গলায় বিহানকে বলতো “অফিস আছে না তোমার? জলদি ওঠো। নাহলে খুন্তি দিয়ে ছ্যাকা দেবো”
বিহান মুচকি হাসে উঠতো।
এভাবে কতো সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত হতো ওদের।
চোখ দুটো ভরে ওঠে বিহানের। নিজের সন্তান অন্য কাউকে বাবা বলে ডাকবে ভাবতেই ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠছে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে। বিহান মরে গেলেও ওর মা ছাড়া আর কারো কিছু আসবে যাবে না। আচ্ছা রাই কি কখনোই জানতে দেবে তার সন্তানের আসল বাবা কে?
কেনই বা জানতে দেবে।বিহানতো বাবা হওয়ার যোগ্যই না।
এসব ভাবতে ভাবতে হাঁট ছিলো বিহান। কখন রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে বুঝতেই পারে নি। হঠাৎ করে ধাক্কা লাগায় তাল সামলাতে না পেরে রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর পড়ে যায় বিহান। আর সাথে সাথে ওর পাশ কাটিয়ে চলে যায় একটা ট্রাক।
ভ্রু কুচকে ফেলে বিহান। বলতেই হবে ওর কই মাছের না প্রাণ। নাহলে মৃত্যুর এতো কাছ থেকেও কি করে ফিরে আসলো?
কে ওকে ধাক্কা দিলো এটা দেখার জন্য পাশে তাকায় বিহান।
ছলছল চোখে অহি তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এই মেয়েটা সত্যিই একটু অন্য রকম। প্রথম থেকেই দেখছে কিছু হলেই চোখে পানি চলে আসে।
“এভাবে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলে কেনো? পাগল হয়ে গেছো তুমি?
যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো।
বিচলিত হয়ে ধরে আসা গলায় বলে অহি।
” কিছু হবে না রে আমার। কই প্রাণ আছে আমার শরীরে। কেঁটে কুটে কড়াইতে দিলেও জান বের হবে না।
তাচ্ছিল্য হেসে বলে বিহান।
“আজে বাজে কথা। এখানে কি করছো তুমি? আমাদের বাসায় কেনো গেলে না?
অহি চোখ মুছে বলে। বিহান চমকে ওঠে। ওদের বাসায় কি করে যাবে?
রাইয়ের সাথে বিহান এতসব কিছু করেছে এটা অহি জানে না। রাইকে বিহান কসম করে বলেছিলো যেনো অহিকে না বলে। রাইও তাই বলে নি। অহি বিহানকে ছোট থেকেই আদির বন্ধু হিসেবে চেনে।
” পরে একদিন যাবো।
বিহান আলতো হেসে বলে।
অহি সোজা হয়ে বিহানের পাশে বসে।
“তোমার কি মন খারাপ?
অহি বিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। আর বিহান তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।
” মন খারাপ না রে। কপাল খারাপ।
আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মাকে দেখে রাখিস।
বলেই বিহান ঝড়ের গতিতে উঠে পরে। অহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হনহনিয়ে চলে যায়। অহি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিহানের চলে যাওয়ার দিকে।
“তুমি কি কখনোই বুঝবে না আমি তোমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি?
🥀🥀🥀🥀
খাওয়ায় রুচি কোনো কালেই ছিলো না রাইয়ের। এখন আরও বেরে গেছে। খেতেই ইচ্ছে করে না সকালে আদি এক গ্লাস দুধ আর দুটো ডিম দিয়ে ফ্রেশ হতে গেছে। রাই খুব সাবধানে দুধের গ্লাস বইয়ের পেছনে লুকিয়ে রেখে অন্য একটা ফাঁকা গ্লাস নিজের সামনে নিয়ে বসে আছে। ডিমওলা তাই করেছে।
চিল মুডে বই পড়ছে রাই। যাক বাবা আজকের মতো এসব খাওয়া থেকে বাঁচা গেলো।
বেশ বড়সড় শব্দ করে দরজা খুলে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ায় আদি। রাই মিষ্টি করে হাসে। যার মানে সব ফিনিশ করে ফেলেছে।
আদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বইয়ের পেছন থেকে দুধ আর ডিম বের করে। রাইয়ের মুখটা চুপসে যায়।
” আমার সাথে চালাকি করবে তুমি?
এতো সোজা?
কোমরে হাত দিয়ে কপালে তিনটে ভাজ ফেলে বলে আদি।
রাই বাধ্য মেয়ের মতো দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে এক চুমুক দেয়।
“আপনার সাথে চালাকি করে বাঁচার উপায় আছে?
যাই হোক আজকে আমি ভার্সিটিতে যাবো।
বলেই আরেক চুমুকে গ্লাস ফাঁকা করে ফেলে রাই।
আদি ডেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নায় রাইয়ের দিকে তাকায়।
” ভার্সিটিতে যাবে কেনো? ইমপটেন্ট সব কিছু তো আমি তোমার জন্য নোট করে আনি।
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে আদি।
“আমার হ্যান্ডসাম সুইট কিউট হট জামাইটা ভার্সিটিতে গিয়ে কোন মেয়ের সাথে নিকনিক করে সেটাই দেখতে যাবো।
মুখ বাঁকিয়ে বলে রাই।
আদি থেমে যায়। বাঁকা চোখে রাইয়ের মুখের দিকে তাকায়। তারপর বাঁকা হাসে।
“ইউ মিন আমাকে পাহাড়া দিতে যাবে? দরকার নেই গো।আমি সুন্দরী মেয়েদের থেকে নিজেকে প্রটেক্ট করার ফরমুলা জানি।
এক গাল হেসে বলে আদি।
রাইয়ের রাগ হয়। অন্য মেয়েকে সুন্দরী বলা হচ্ছে?
কিন্তু রাই তো কিছুই বলবে না। ঝগড়া করার মুড নাই। আর থাপ্পড় খাওয়ার ও ইচ্ছে নেই। যা খুশি করুক। রাইয়ের কি? চাইলে আরও পাঁচটা বিয়ে করে নিক। রাই কিছুই বলবে না। এতে রাইয়ের কিচ্ছু এসে যায় না। একদম জেলাস হবে না রাই।
মনে মনে নিজেকে ধাতস্থ করে রাই। বার কয়েক জোরে শ্বাস নিয়ে বুক ফুলায়।
” আমি যাচ্ছি ব্যাস। কোনো না টা শুনবো না। তবে আর যাই হোক কোনো ছেলের সাথে নিকনিক করতে যাবো না আমি। গুড গার্ল তো। কোনো ছেলেকে সুন্দরও বলবো না।
মুখ বাঁকিয়ে বলে রাই।
আদি আস্তে ধিরে রাইয়ের পাশে এসে বসে। মেয়েদের সুন্দরী বলাতে রাইয়ের মনে লেগেছে এটা বেশ বুঝতে পারছে আদি।
রাই তাকায় না আদির দিকে। আদি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাইয়ের দিকে। চেহারার বেশ পরিবর্তন এসেছে মেয়েটার। এমনিতেই ধপধবে ফর্সা। এখন একদম দুধের মতো লাগে। চোখের নিচটা হালকা কালো হয়ে গেছে।যেটা রাইয়ের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আদি দুই হাত দিয়ে রাইয়ের দুই গালে হাত রাখে।
রাই চমকে ওঠে। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।
“কতোদিন পরে মন খুলে কথা বললে আমার সাথে। জানো কতোটা ভালো লাগছে আমার? তোমাকে ছাড়া আমার একটা সেকেন্ড চলে না। কখনো আমাকে ছেড়ে যেনো না প্লিজ। দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো আমি।
আদির আবেগ মাখানো কথা গুলো শুনে চোখ খুলে ফেলে রাই।আদির চোখের দিকে তাকায়। এই চোখ দুটোতে অসংখ্য আকুতি রয়েছে সবটা রাইকে ঘিরে।
মনের মধ্যে দমকা হওয়া বয়ে যায় রাইয়ের। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আধবসা ছায়ার এলটা মানুষের চেহারা। যার চোখ দুটো একদম আদির চোখের মতো।
” যাবে না বলো?
আবারও বলে আদি।
রাই মুচকি হাসে।আদির বুকে মাথা রাখে।
“মাকে আমার মনে নেই। কখনো বাবার ভালোবাসা পায় নি। একটু সুখের খোঁজে একজনের হাত ধরেছিলাম সেও মাঝ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলাম আর কাউকে বিশ্বাস করবো না। কিন্তু আপনার কেয়ার আপনার মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার পরে সিদ্ধান্ত বদলে নিলাম।
ঠকলে ঠকবো তবুও বিশ্বাস করেই ঠকবো।
তবে আরও একবার ঠকে গেলে আমি মরেই যাবো।
আদি রাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
” কখনো ঠকাবো না। ভালোবেসে সারাজীবন আগলে রাখবো। দেখে নিও তুমি।
রাই মুচকি হাসে।
“ভবিষ্যতে সুখ পাবো কি না জানি না। কিন্তু এখন যতটা সুখ পাচ্ছি এটাই অনেক একটা জীবন পার করার জন্য।
চলবে