#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
দ্বাবিংশ পর্ব
বাসার সবাইকে ইগনোর করছি। কারো সাথে কোনো কথা বলি না, ঠিকমতো খাবারও খাচ্ছি না। অয়নের সাথে দেখা হওয়ার পর প্রায় মাস পেরিয়ে গেছে কিন্তু নিজেকে শান্ত রেখে আমি এক কঠিন পরীক্ষা দিচ্ছি।
কান্না কাকে বলে ভুলে গেছি আমি নাকি চোখের পানি শুকিয়ে গেছে জানি না। তবে এখন আর চোখ ফে°টে কান্না আসে না।
আজও আমি মনে করি একটা মিরাকেল হবে। হয়তো একদিন বাবা বলবেন “ক্ষমা করে দিলাম, যাও তোমার অয়নের কাছে।” অথবা আমাকে অয়নের হাতে তুলে দিয়ে বলবেন “ভালো রেখো আমার ছোট আম্মুকে।”
পড়াশুনা আর পড়াশুনা, নিজেকে ব্যস্ত রাখার এই একটাই উপায় আছে আমার কাছে। সারাদিন রাত পড়ার টেবিলে কা°টাই। রাতে মাত্র দেড় থেকে দুইঘন্টা ঘুমাই।
আয়না দেখা ছেড়ে দিয়েছি, ফোনের গ্যালারি খুলে অয়নের ছবিও আর দেখি না।
আমার দেখাদেখি মানহাও সেকেন্ড টাইম পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে ওর আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে মানহা।
আজ অনেকদিন পর আপু বাসায় এসেছে। আমার রুমে এসে চেঁচিয়ে বলল,
“তনু, সারপ্রাইজ।”
শান্ত চোখে সেদিকে তাকিয়ে আবারো পড়ায় মনোযোগ দিলাম। আপু এসে বলল,
“কেমন আছিস?”
“তোমরা ভালো আছো, তাই আমিও ভালোই আছি।”
অভিমানের সুর ঠিক কতটা বুঝলো জানি না। আপু বলল,
“খুশি হসনি তুই?”
“আমি পড়ছি, বি°র°ক্ত করো না।”
আপু আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“কি করেছিস চেহারার? চোখের নিচে দাগ কেন?”
মলিন হেসে বললাম,
“সুখে থাকার ফলাফল এগুলো আপু। তুমি এখন অন্যরুমে যাও।”
আপু বেরিয়ে গেল। আমি আবারো পড়াশুনায় মন দিলাম।
কিছুক্ষণ পর আপু এসে বলল,
“একটা কথা বলতে চাইছিলাম।”
আমি জবাব না দেয়ায় আবারো বলল,
“বলবো কি?”
“হুম, বলো।”
বইয়ের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলাম।
“কালকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে, ইত্তাজা চাইছিলো তোর সাথে দেখা করতে।”
রাগ হলো প্রচুর। সবটা জেনেশুনে আপু কিভাবে এ কথাটা বলতে পারে।
“আপু, আমি কারো সাথে দেখা করবো না। দেখতে পাচ্ছো না আমি স্টাডি নিয়ে বিজি আছি।”
“অল্প কিছু সময়েরই তো ব্যাপার।”
“পারবো না।”
আপু এগিয়ে এসে বলল,
“অয়ন ভাই হলে না করতি?”
কথাটা খুব জোরে কানে বাজতে থাকলো। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। অয়নের হাসিমুখটা চোখের সামনে ভাসছে।
আপুকে কোনো উত্তর দিলাম না। বিয়ের পর আপু পালটে গেছে, আমাকে আর বুঝে না সে। এখন আর আমার কষ্টে কাঁদে না। স্বা°র্থ°প°র সবাই। এই স্বা°র্থ°প°র পৃথিবীতে অয়ন কেন ভালো মানুষ হতে গেল?
দিনটা কা°টলো, রাতও কা°টলো। আমি নিজেকে একঘরে ব°ন্ধী করে রেখেছি। সকালে উঠে হালকা গোলাপী রঙের জামদানি শাড়িটা পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। মানহার বাসায় যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গেলাম, এখন আর আমাকে কেউই সন্দেহ করে না।
মন যে বড্ড অশান্ত, একে যে শান্ত করতেই হবে৷ মনের ওষুধ আমার একটাই, অয়ন।
অয়নের অফিসের ঠিকানা আগেই নিয়ে রেখেছিলাম। সোজা চলে গেলাম সেখানে। সাথে নিলাম একগুচ্ছ লাল গোলাপ।
রিসিপশনে গিয়ে বললাম,
“আয়মান রহমান, অপারেটর আয়মান, উনার সাথে দেখা করতে চাই, উনি কি অফিসে আছেন?”
রিসিপশনের সুন্দরী নারী জানালো,
“সরি, উনি কয়েকদিন থেকে অফিসে আসেন না।”
“ছুটিতে আছেন?”
“জি।”
বিষয়টা চিন্তার। কোনো কারণ ছাড়া সপ্তাহের মাঝে অফিস থেকে ছুটি নেয়ার মতো মানুষ তো অয়ন নয়। নাম্বারে কল দিলাম, দুইবারের মাথায় রিসিভ হলো,
“হ্যালো।”
আধো আধো কন্ঠটা শুনে ভ°য়টা ঝেঁ°কে বসলো। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে অয়ন বলল,
“কে বলছেন?”
“অয়ন কোথায় তুমি?”
“তনুশ্রী, আমি অফিসে।”
“আমি তোমার অফিসে এসেছি, তুমি নেই বলল।”
অয়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আসছি আমি।”
আধঘন্টা পর অয়ন আসলো। কপালে ব্যা°ন্ডে°জ, ডানহাতের কবজি থেকে কনুই ব্যা°ন্ডে°জ দিয়ে প্যাঁ°চানো, হাঁটা দেখে মনে হলো পায়েও বোধহয় ব্য°থা আছে।
আমি এগিয়ে যেতেই হাতের ইশারায় শান্ত হতে বলে আমাকে নিয়ে বাইরে চলে আসলো। বামহাতে একপ্রকার জড়িয়েই রাখলো আমাকে।
“অফিসে বললে, অথচ বাইরে থেকে আসলে। এতো লুকোচুরি কেন অয়ন?”
আমার চোখের উৎ কন্ঠা সে বুঝে। হাসিমুখে বলল,
“হঠাৎ শাড়ি? ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করবি নাকি?”
“কি হয়েছে তোমার?”
“এ°ক্সি°ডে°ন্ট।”
“হলো কি করে?”
দুজনে পাশাপাশি হাঁটছি। অয়ন শান্তসুরে বলল,
“বাইক এ°ক্সি°ডে°ন্ট করেছি। বড়সড় কিছু হয়নি, আমি ঠিক আছি।”
হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম,
“ওসব বাইক টাইক চালানো লাগবে না। আমি হাত পা ভা°ঙা ছেলেকে বিয়ে করবো না।”
অয়ন ফিরে তাকালো। আমিও চুপ করে গেলাম। কি বললাম এটা? আমি জানি এ কথায় অয়ন কষ্ট পাবে।
অয়ন হেসে দিলো। আমি তাকিয়ে রইলাম। তাচ্ছিল্য লাগছে না, তবে কেন হাসছে সে?
“তোর ফ্যামিলি আমাকে খারাপ ভাবে তনুশ্রী। ইচ্ছা করছে এখন তোকে কি°ড°ন্যা°প করে নিয়ে যাই। বিয়ে ভে°ঙে যাক, তারপর ফেরত দিয়ে যাবো। কিন্তু হাত ভা°ঙা, এসব পারবো না।”
কিছুই বললাম না, চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। অয়ন আমার হাতের ফুলগুলো নিয়ে বলল,
“আমার জন্য এনেছিস? সুন্দর হয়েছে।”
উত্তর দিলাম না। আমার কথায় কষ্ট পেলেও নিজের কষ্টকে লুকাচ্ছে অয়ন।
“আমার বাসা বেশি দূরে না, নতুন বাসায় উঠেছি এইমাসে। আম্মু বাসায় আছে, চল দেখা করবি।”
“যাদেরকে অপমান করেছি, তাদের সাথে দেখা করবো?”
“আহা, সমস্যা নেই। চল তো, অথৈও আছে।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও অয়নের সাথে গেলাম। নয়তলায় ওদের বাসা। লিফটে উঠতেই মনে হলো আন্টি আর অয়নের মধ্যে যদি এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়। কি করবো আমি তবে? ক্ষমা করবো কিভাবে নিজেকে?
বাসার কলিং বেল বাজাতেই আমি অয়নের পিছনে লুকিয়ে গেলাম। ভ°য় লাগছে, একমাত্র এই মানুষটা ছাড়া সবাইকেই ভয় লাগছে আমার।
অথৈ আপু এসে দরজা খুলে ক°র্ক°শ গলায় বলল,
“এই শরীরে বেরিয়ে গেলে, ভাইয়া?”
হঠাৎ থেমে গিয়ে নরমসুরে বলল,
“কে সাথে?”
অয়ন আমার হাত ধরে সামনে এনে বলল,
“আমার বউ।”
বলেই সোজা ভিতরে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে আছি। অবলীলায় বলে দিলো আমি তার বউ?
অথৈ আপুর মুখে মলিন হাসি দেখলাম। বলল,
“আসো।”
আপুকে এখন খুব সুন্দর লাগছে। মাতৃকালীন সময় সব মায়েদের সুন্দর লাগে। ছোট একটা প্রাণ যে বেড়ে উঠছে তার ভিতরে। আমাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে দিয়ে আপু ভিতরে চলে গেল।
আমি উঠে ঘুরে ঘুরে বাসাটা দেখছি। একটা ঘরের সামনে আসতেই কিছু ফিসফিস শুনলাম।
“আম্মু, বাইরে গেছে। এসে যদি ওকে দেখে তবে কিন্তু তুলকালাম হবে ভাইয়া। (একটু থেমে) শুনতে পাচ্ছো তুমি? বাবা এসব জানলে কষ্ট পাবে। বড়চাচার সাথে আবার ঝা°মেলা হবে।”
অয়নের শক্ত কন্ঠ শুনতে পেলাম,
“পুরো দুনিয়া এলোমেলো হয়ে যাক। ইত্তাজাকে খু°ন করে হলেও তনুশ্রী আমার হবে।”
এ কি শুনলাম আমি? অয়নের মতো শান্ত মেজাজের কেউ এটা বলল?
“যা খুশি করো ভাইয়া।”
আমি আবারো গিয়ে আগের জায়গায় বসে পড়লাম। কেন আসলাম আমি এখানে?
অথৈ আপু শরবত এনে দিয়ে বলল,
“কেমন আছো?”
“হুম, ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“ভালো আছি। তন্বু..”
এমনসময় ফোন বেজে উঠায় আপু কথা শেষ না করেই চলে গেল। আমি অয়নের রুমের দরজার গিয়ে নক করলাম।
“আয় অথৈ।”
দরজা খুলে বললাম,
“অয়ন, বাইরে আসো। কথা আছে।”
অয়ন কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। না তাকিয়েই বলল,
“তনুশ্রী, কি বলবি বল।”
“বাইরে আসো।”
অয়ন উঠে এসে আমাকে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“বল কি বলবি?”
তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেদিনও তাকে ভ°য় লাগেনি আর আজও লাগছে না।
সে আমাকে কাছে টে°নে নিয়ে বলল,
“বল।”
“কি বলছিলে তুমি?”
“কোথায়?”
“আপুর সাথে।”
অয়ন চুপ করে থেকে বলল,
“রাগের মাথায় বলেছি।”
ওর কপালের ব্যা°ন্ডে°জে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিয়ে বললাম,
“পুরো দুনিয়াকে এলোমেলো করে দাও না অয়ন।”
অয়ন একটু নিচু হলো, কাছাকাছি চলে আসলাম দুজনে। নিশ্বাস ভারী থেকে ভারী হতে থাকলো।
“যদি ইত্তাজা বড়চাচার ছেলে না হতো তবে সত্যিই দুনিয়া এলোমেলো হতো।”
আমি কিছুই বললাম না। তার কাছে থেকে সরে আসতে চেয়েও পারলাম না, সে আরো কাছে টে°নে নিলো।
আমার কপালে ফুঁ দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল,
“এতোদিনে আমার ঘরের রানী হয়ে যেতে পারতি তনুশ্রী।”
আজ অনেকদিন পর চোখ থেকে পানি ঝরছে। অয়ন আমাকে কাঁদতে নি°ষে°ধ করছে না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে শুধু।
“তোকে বলেছিলাম স্বা°র্থ°প°র হয়ে সুখী হবো না। কিন্তু সত্যটা হলো স্বা°র্থ°প°র না হয়ে আমরা সুখী হইনি।”
অয়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। সেও একহাতে যতটা সম্ভব জড়িয়ে নিলো আমাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি আমি।
বেশ অনেকটা সময় পর বললাম,
“যে খারাপটা তোমাকে সবাই ভাবে সে খারাপটাই তোমার হওয়া উচিত ছিল।”
আমার মুখটা তুলে দিয়ে বলল,
“তোকে অসম্মান করা সম্ভব নয় আমার তনুশ্রী। সম্মান করে যে ভালোবাসাটা পেয়েছি, অসম্মান করে সেটা ঘৃ°ণা হয়ে যেতো।”
একটু চুপ থেকে আবারো বলল,
“আমাদের বাঙালি পরিবারের একটা নিয়ম আছে। পরিবারের যে সন্তান স্যা°ক্রি°ফাই°স করে, তাকে সবাই তুচ্ছ করে। তার ভালো-মন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা কেউ দেখে না। তার ভালো থাকার খোঁজটাও কেউ নেয় না।”
একটু সরে আসলাম। অয়নের যত কাছে যাবো, তার সাথে ততই নিজেকে জড়িয়ে ফেলবো। চোখ মুছে বললাম,
“আমি চলে যাবো অয়ন।”
সে হেসে বলল,
“বেঁ°ধে রাখার জন্য তো আনিনি। অবশ্যই যাবি।”
আলমারি খুলে একটা ব্যাগ বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল,
“খুলে দেখ তো।”
“কি আছে?”
“খুলে দেখ।”
ব্যাগটা খুলে দেখি ভিতরে বেনারসি শাড়ি আর বেশ কয়েকটা সুতি আর জামদানীও আছে।
“প্রথম মাসের স্যালারি দিয়ে বেনারসিটা কিনেছিলাম। ভাবনা ছিল এ শাড়ি পড়িয়েই তোকে আমার ঘরে আনবো।”
ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিলাম। ধপধপ করে শব্দ হলো। কাঁদতে কাঁদতে অয়নের বুকে ধা°ক্কা দিয়ে বললাম,
“কেন বলছো এসব? কি চাও তুমি?”
সে হাসলো।
“চাওয়াটা এখন না পাওয়া।”
“বড়চাচা, ইত্তাজা, পরিবার বলে বলে জ্ঞানের বানী শুনাতে পারো। এখন আবার এসব দেখাচ্ছো। কি করছো?”
“কি করছি নিজেও জানি না, বাকি শাড়িগুলো আমি জানুয়ারিতে কিনেছিলাম। কেন জানি না। কার জন্য জানি না। উত্তর আমার কাছেও নেই।”
কিছুই আর বললাম না। সোজা ওর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। শুধু ঘর না, ফ্ল্যাট থেকেই বেরিয়ে গেলাম। জানি আমি আবারো কাঁদবো, সেই কান্না আবারো ফিরে আসবে আমার কাছে। একান্তে, নিরবে, শুধুই আমার কাছে।
“তনুশ্রী।”
লিফটে অয়নও এসে আমার সাথে উঠলো। চোখের পানি মুছে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। অয়ন চুপ করে আছে।
“তোমার কি মনে হয় তুমি তোমার খারাপ থাকাটা আমার থেকে লুকাতে পারবে অয়ন?”
“না, লুকাতে চাচ্ছি না তোর থেকে।”
লিফট খুললো। দুজনেই বেরিয়ে গেলাম। আমি একটু আগে আগে হাঁটছি। হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে একটু চমকেই উঠলাম। অয়নের হাঁটা মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না।
অয়নকে ধরে বললাম,
“পায়ে ব্য°থা করছে?”
“একটু।”
“এসো।”
তার হাত ধরে খুব ধীরে ধীরে হাঁটছি আমরা।
“আন্টি যদি জানে আমি এসেছিলাম তবে রাগ করবেন?”
অয়ন কিছুই বলল না। আমি জানি আন্টি রাগ করবেন। অয়নকে যেমন আমার ফ্যামিলি খারাপ ভাবে, তেমনি তার ফ্যামিলিও আমাকে খারাপ ভাবছে। এটা খুবই স্বাভাবিক।
আমার নিরবতায় অয়ন বলল,
“অথৈয়ের কথায় এতো ভাবিস না।”
“তুমি ইত্তাজার সাথে কথা কেন বলছো না? ইত্তাজা যদি বিয়েটা ভে°ঙে দেয় তবেই তো হয়।”
অয়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমি জানি না ইত্তাজা বিষয়টাকে কিভাবে নিবে? তবে বড়চাচার সাথে বাবার সম্পর্কে আবারো ঘি ঢা°লা হবে, আ°গু°ন তো আগেই জ্ব°ল°ছে।”
অয়ন দাঁড়িয়ে পড়লো। পাশে থাকা বাসাটার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আব্বু একবার স্ট্রো°ক করেছে, আরেকবার যদি কিছু হয় তবে আমি কিভাবে নিজেকে ক্ষমা করবো। আমাদের সম্পর্ক কিছুদিনের তাতেই আমরা একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারছি না, আম্মু কিভাবে আব্বুকে ছাড়া থাকবে। তাদের একমাত্র ছেলে আমি, আমি যদি আব্বুর মৃ°ত্যু°র…”
কন্ঠ কেঁ°পে উঠলো তার, আর কথা বলতে পারলো না। অন্যদিকে চেয়ে রইলো।
অয়নের প্রত্যেকটা কথা ঠিক। কিন্তু না এটা আমি মানতে পারছি আর না সে মানতে পারছে।
“অয়ন?”
আমার দিকে তাকালো। ওর হাত ধরে বললাম,
“যোগাযোগ বন্ধ করো না প্লিজ। তোমার ভয়েজ না শুনে শুনে আমি ম°রে যাচ্ছিলাম।”
অয়ন মুচকি হাসলো।
“তবুও তো এতোদিন পর কল দিলি, তোর নতুন নাম্বারও তো ছিল না আমার কাছে।”
“প্লিজ।”
অনুনয়টা ফেলতে পারলো না। আমি জানি সে আমাকে ছাড়তে পারবে না। যে মানুষটা এতোটা অসুস্থতার মধ্যেও আমার কল পেয়ে ছুটে গেছে সে আমাকে নিজের করে নিয়ে যাবেই, বিশ্বাস আছে ওর উপর।
চলবে…….
#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ত্রয়োবিংশ পর্ব
দ্রুত গতিতে ২০২৩ সালটা চলে যাচ্ছে। চোখের পলকে সেপ্টেম্বর মাস চলে আসলো। এরমধ্যে বেশ কয়েক জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি৷ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার টিকেটটাও পেয়ে গেলাম। আমি একা না, মানহাও একই জায়গায় চান্স পেল, শুধু আমাদের ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন।
কাল ভার্সিটিতে ভর্তি হতে যাবো, সাথে কালকেই আমার বিশ তম জন্মদিন। বাসার সকলেই খুশি, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো এটা খুশির মুখ্য কারণ নয়। মুখ্য কারণটা হলো আগামী শুক্রবার অর্থাৎ ২২ সেপ্টেম্বর ইত্তাজার সাথে বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়ে গেছে, গতকালই তারিখ নিশ্চিত করেছে।
অয়নের সাথে যোগাযোগ আছে। ওকে ছেড়ে দেয়া সহজ নয় আমার জন্য, না ও আমাকে ছেড়ে দিতে পারবে। কল দিলে ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা চুপ থাকি। এখন আর আমাকে লজ্জা দেয় না অয়ন, তবে প্রায়ই আমার হাসির কারণ হয়।
অথৈ আপুর ছেলে বাবু হয়েছে। অয়ন ছবি পাঠিয়েছিল, দেখেছি। কিন্তু আন্টি বা অথৈ আপু কারো সাথেই কোনো কথা আমার হয়নি। আজও হয়তো আন্টি ভাবে আমার কারণেই অয়নের চরিত্রে এমন এক দাগ পড়েছে। তাদের ভাবনাটা ভুল নয়, আমিই দো°ষী।
রুমে বসে বই পড়ছি, অয়নের দেয়া সেই বই। হাজার বছর ধরে, মন্তু মিয়া আর টুনির জন্য কষ্ট সবাই পায়, কিন্তু আমার জন্য কারো কষ্ট হয় না।
আম্মু এসে দুইবার ডেকে গেল বিকালের নাস্তার জন্য। তৃতীয়বার আসলে জানিয়ে দিলাম আমি খাবো না।
রাতটুকু কাটলো না ঘুমিয়ে। এখন সারারাতেও ঘুম হয় না আমার। হয়তো অনিদ্রারোগে ধরেছে, কি যেন বলে সবাই? হ্যাঁ, ইন°সোম°নিয়া।
সকালে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়েই দেখি ইত্তাজা এসেছে।
আম্মু জানালো,
“ইত্তাজা আর তোমার সাথে ভার্সিটিতে যাবে।”
শুনে বি°র°ক্ত হলেও প্রকাশ করলাম না।
নাস্তা করে বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম মানহার বাসার সামনে। গতকাল থেকে প্রচন্ড জ্বরে ভু°গছে বেচারি, তাই ওকে নিয়েই যাবো আমি। একটা কল দিতেই সে বেরিয়ে এলো।
ইত্তাজা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকায় মানহাকে সে দেখেনি। মানহা ইত্তাজার দিকে তাকিয়ে আমাকে বলল,
“উনি কেন এসেছেন?”
ফিসফিস করে বললাম,
“আম্মু ঝুলিয়ে দিছে।”
ইত্তাজা মানহাকে দেখে বলল,
“আরে মানহামণি যে, কেমন আছো?”
মানহার সাথে মণি শব্দটা আমাকে অবাক করলো। মানহা একটু বিব্রতবোধ করছে বলে মনে হলো। আমতাআমতা করে বলল,
“ভা.. ভালো।”
আগে থেকেই সিএনজি ঠিক করা ছিল। সুতরাং যাত্রা খুব সহজেই শুরু হলো। মানহাকে মাঝে বসিয়ে আমি আর ইত্তাজা ওর দুদিকে বসেছি।
“মানহা তোর জ্বরের কি খবর?”
“এখন একটু কম।”
ইত্তাজা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানহামণি, তুমি কেন সেকেন্ড টাইম দিলে? কলেজে তো ভালোই ক্লাস করেছো, আমার জুনিয়র ছিলে।”
মানহা আলতো হেসে বলল,
“বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কেউ কলেজে থাকে না।”
আমি ইত্তাজাকে বললাম,
“আপনার জুনিয়র মানে?”
“আমিও তো তিতুমীরে পড়েছি। সেশনজটে আটকে এবারে মাস্টার্স শেষ করলাম।”
“ওহ।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ইত্তাজা নিজে থেকেই বলল,
“মানহার সাথে আমার কলেজেই ফার্স্ট কথা হয়েছে। কথায় কিউটনেস থাকায় ওকে মানহামণি বলে ডাকি।”
মানহার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও একদৃষ্টিতে বাইরে কিছু দেখছে। চোখের কোণায় পানি জমা হয়েছে৷ কপাল কুঁচকে গেল আমার। মানহার সেই ভালোবাসা ইত্তাজা নয় তো? পুরোপুরি জানতে হলে মানহাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। ও যেহেতু লুকাতে চাচ্ছে তার মানে এখানে কোনো একটা বড় সমস্যা আছে।
ভার্সিটি পৌঁছে মানহা চলে গেল জুলোজি ডিপার্টমেন্টে আর আমি যাবো জিওলজিতে। মানহা এতো দ্রুত চলে গেল যেন পা°লিয়ে যাচ্ছে সে। কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকিয়ে আলতো হাসলো।
আমি ইত্তাজাকে বললাম,
“একটা রিকুয়েষ্ট করি?”
“শিউর।”
“মানহার সাথে যান প্লিজ। ও অসুস্থ।”
“তুমি?”
“আমি সামলে নিতে পারবো।”
ইত্তাজা দ্রুত গতিতে মানহার দিকে এগিয়ে গেল। আমি ডিপার্টমেন্টে চলে গেলাম। সকল কাজ শেষ করে দুপুর প্রায় দুইটায় রেজিস্টার অফিসে কাগজ জমা দিলাম। মানহাকে রেজিস্টার অফিসে দেখলাম না। ও কি এখনো আসেনি? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওকে কল দিলাম।
“হ্যালো।”
মানহা নয়, এটা পুরুষ কন্ঠ। নিশ্চয়ই ইত্তাজা হবে।
“মানহা কোথায়?”
“ও একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওর কাগজপত্র জমা দেয়া হয়েছে, এখন মেডিক্যাল সেন্টারে এনেছি।”
“আমি আসছি।”
ফোন রেখে দ্রুত চলে গেলাম মেডিক্যাল সেন্টারে। মানহাকে একটা চেয়ারে বসে থাকতে দেখলাম, ইত্তাজা পাশে দাঁড়ানো। মানহা এখনো ইত্তাজার একটা হাত ধরে রেখেছে, কিছু বলছে ও।
রিকশা থেকে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে যেতেই মানহা ইত্তাজার হাত ছেড়ে দিলো। সন্দেহটা তীব্র হলো, মানহার সেই ভালোবাসা ইত্তাজা ছাড়া আর কেউ না।
ইত্তাজা আমাকে বলল,
“প্রে°শা°র লো হয়ে গিয়েছিল, তাই রেজিস্টার অফিস থেকে এখানে নিয়ে এসেছি।”
মানহা আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“আমি ঠিক আছি, বাসায় যাবো।”
“চল।”
আমি ধরে ওকে বাইরে নিয়ে আসলাম। রিকশা করে মেইন গেইট পর্যন্ত আসলেও এখানে একটাও সিএনজি নেই।
ইত্তাজা সিএনজি আনতে গেল। একটা দোকানের বেঞ্চিতে দুজনে বসলাম।
মানহার সাথে একটু রাগ দেখিয়ে বললাম,
“ইত্তাজাকে তুই ভালোবাসিস?”
চমকে উঠে তাকালো সে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“মিথ্যা বলিস না। আমার থেকে কেন লুকিয়েছিস?”
মানহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমি নিজেই শিউর হতে পারছিলাম না। যতদিনে আমি বুঝতে পারলাম ততদিনে সে তোকে ভালোবেসে ফেলেছে।”
“আজও কিছুই বলবি না? বাসায় জানা।”
“বলে কি আর কোনো লাভ হবে? আমার ফ্যামিলি কেমন তা জানিস। একজন সিংগারকে পছন্দ করা, ক্রা°শ খাওয়া উনারা মেনে নিলেও বিয়েটা মেনে নিবে না। (একটু থেমে) অয়ন ভাই একটু শক্ত থাকলেও হতো। কিন্তু উনি পড়ে আছেন সেই দায়িত্ব, কর্তব্য, হে°নতে°ন নিয়ে।”
চশমাটা ঠেলে দিয়ে চুপ করে রইলাম। মনে মনে ভাবছি,
“আমার ফ্যামিলি যদি এটা বুঝতো। ইত্তাজা ধীরে ধীরে সেলিব্রিটি হচ্ছে, শতশত মেয়ের সাথে উঠাবসা হচ্ছে। এই ইত্তাজাকে এক নজর দেখতে কত মেয়ের ভীড়। এগুলো বাবা দেখে না? শুধু অয়নের একটা ভুল নিয়েই পড়ে আছে।”
মানহার দিকে তাকিয়ে ওর ফ্যাকাসে মুখটা দেখলাম। ইত্তাজা কি আদৌ মানহার জন্য পারফেক্ট হবে?
মানহাকে বললাম,
“অয়নকে কেন দোষ দিচ্ছিস? দায়িত্ব তো সবারই আছে, নাহলে আমি কেন বিয়েতে রাজি হলাম।”
মানহা কিছু বলল না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
“ইত্তাজা জানে?”
“উহু।”
বলে মাথা নাড়লো।
“আমি জানাবো।”
আমাকে বাধা দিয়ে বলল,
“যদি রিজেক্ট করে বা অ°প°মান করে সহ্য করতে পারবো না। ইত্তাজা অয়ন ভাইয়ের মতো শান্ত নয়, প্রচন্ড রা°গী আর ব°দ°মেজাজী স্বভাবের।”
“তাই বলে..”
এরমধ্যেই ইত্তাজা সিএনজি নিয়ে আসলো, আমাদের কথা মাঝপথেই থেকে গেল।
রাস্তায় মোটামুটি ভালোই জ্যাম ছিল। হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠলো।
ফোন বের করে অয়নের নাম্বার দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। আড়চোখে ইত্তাজার দিকে তাকালে দেখলাম সে কানে হেডফোন লাগিয়ে রেখেছে।
রিসিভ করলাম,
“হ্যালো।”
“কোথায় আছিস তুই?”
“গাড়িতে, ভার্সিটি থেকে ফিরছি।”
“ওহ, ইত্তাজা সাথে আছে?”
“হুম।”
“বাসায় এসে কল দিস।”
মানহা আমার কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো। ফোন রেখে বললাম,
“খারাপ লাগছে?”
“হুম।”
মানহাকে ধরে রাখলাম। ইত্তাজা একবার আমাদের দিকে তাকালো। তারপর পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পানি লাগবে?”
মানহা আড়চোখে একবার ইত্তাজাকে দেখে আবারো চুপ থাকলো। আমি পানির বোতলটা নিয়ে মানহাকে খাইয়ে দিলাম।
“তুমি হাসলে
কাছে আসলে না।
কাছে আসলে
ভালোবাসলে না।
তুমি একি করলে আমার
আমি একা তুমি ছাড়া।
তুমি একি করলে আমার
আমি একা তুমি ছাড়া।
চেয়ে থাকলে
হাত বাড়ালে না।
হাত বাড়ালে
ছুঁয়ে দেখলে না।
কাছে এসেও
ভালোবাসলে না।
তুমি একি করলে আমার
আমি একা তুমি ছাড়া।
তুমি একি করলে আমার
আমি একা তুমি ছাড়া।”
ইত্তাজার হঠাৎ গাওয়া গানে মানহা-আমি দুজনেই ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মানহা আমার গা ঘেষে বসে আবারো কাঁধে মাথা রাখলো। ওর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানিটা আমার দৃষ্টি এড়ালো না। বুকটা ফে°টে যাচ্ছে আমার, মানহা কাঁদছে যে।
বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ ইত্তাজা আর বাসায় আসলো না। ফ্রেশ হয়ে আমি অয়নকে কল দিলাম।
“তনুশ্রী, একটু বের হতে পারবি?”
“কেন বলো তো।”
“১০ মিনিটের জন্য।”
“সারাজীবনের জন্য তো এমনিতেও নিবে না। ১০ মিনিটই সই।”
এই কথায় কষ্ট পাবে জেনেও বলেছি। অভিমান চেপে রাখা আর সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে অয়ন ইত্তাজাকে কিছুই জানালো না এতোদিনে।
ফোন রেখে ড্রেস পালটে একটু সাজলাম। অনেকদিন পর দেখা করবো বলে কথা। বের হওয়ার সময় আম্মুর সামনে পড়লাম।
“কোথায় যাচ্ছো এখন আবার?”
“মানহার শরীর ভালো ছিল না, দেখতে যাচ্ছি।”
“সকালে যেও।”
সবকিছুতেই বাধা পড়ছে। রাগ হলো, তাই না করা সত্ত্বেও বের হয়ে গেলাম। যা হবে দেখা যাবে।
বাসা থেকে বের হয়ে মেইন রাস্তায় গিয়ে দেখলাম অয়ন তো দূরের কথা তার ছিটাফোঁটাও নাই।
কল দিলাম, রিসিভ করলো না। ফোনের স্ক্রিনে অয়নের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ করে সামনে এসে বলল,
“ভা°উ।”
চমকে উঠে লাফ দিয়ে দুইপা সরে গেলাম। অয়ন হেসে একগুচ্ছ সাদা গোলাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এইদিন বারে বারে ফিরে আসুক।
ভালোবাসা বৃষ্টি হয়ে ঝরুক।”
ফুলগুলো হাতে নিলাম। আমার সাদা গোলাপ পছন্দ, কি করে এখনো মনে রেখেছে। আমার ফোনটা টেনে নিয়ে বলল,
“বাহ, আমার ছবি ওয়ালপেপারে দিয়ে রেখেছিস। সুন্দর লাগছে আমাকে, বল?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা নিয়ে ব্যাগে রাখলাম। বললাম,
“এইদিন বারে বারে ফিরে আসলেও তোমাকে ছাড়াই ফিরে আসবে।”
অয়ন কিছু বলল না। গিয়ে বাইকে উঠে পড়লো।
“অয়ন?”
“হুম।”
“চলে যাবে?”
“তুই বাসায় যা তনুশ্রী। রাত হয়ে গেছে, এখন বাইরে থাকলে অসুবিধা হবে।”
এগিয়ে গিয়ে বললাম,
“ঠিক কি অসুবিধা হবে বলতে চাও? ম°রে যাবো?”
কথায় জো°র ছিল, রাগ ছিল, অভিমান ছিল। অয়ন সবটা বুঝেছে, তবুও চুপ।
চলে আসতে নিলে অয়ন চিৎকার করে বলল,
“উনিশ নয়, আই লাভ দিস ডেইট ফর ইউ মাই তনুশ্রী।”
আশেপাশে বেশি মানুষ না থাকলেও যে দুই একজন আছে উনারা চেয়ে রইলো আমাদের দিকে। আমি ফিরে এসে বললাম,
“চিৎকার করবে না।”
অয়ন হেসে দিলো। আমিও মুচকি হাসলাম, নিজের অজান্তে। এতো কষ্টের মাঝে যে মানুষটা আমার হাসির কারণ সে কি করে আমাকে খারাপ রাখতে পারে।
“২২ তারিখে বিয়ে অয়ন।”
তার হাসিটা হুট করে উবে গেল। কিছু ভাবছে, হয়তো কিছু বলবে। কিন্তু না, কিছু না বলেই চলে গেল সে।
পেছন থেকে ডাকলাম কিন্তু সে ফিরলো না। খুব জোরে ড্রাইভ করে গেল। অ°ন্ত°রা°ত্মা কেঁ°পে উঠলো আমার, আবার না এ°ক্সি°ডে°ন্ট করে সে।
শান্ত মানুষগুলোর রাগ ভ°য়ংকর হয়। ভয়ে ভয়ে বাসায় ফিরলাম আমি। ফুলগুলো পড়ার টেবিলে রেখে খাটে বসে ওকে কল দিলাম, রিসিভ করলো না।
আম্মু এসে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলে?”
“বলেই তো গেলাম।”
ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“এগুলো?”
“মানহা দিয়েছে, আমার বার্থডে বলে।”
আম্মু কপাল কুঁচকে বলল,
“মানহা নাকি অয়ন?”
চমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। আম্মু হয়তো বুঝেছে আমি অয়নের সাথে দেখা করেছি।বলল,
“তোমার এ কাজগুলো আমার মোটেও পছন্দ না। ইত্তাজা বা রুম্মান যদি জানতে পারে, তবে কি ভাববে?”
আম্মু আর কিছু বলার আগেই বললাম,
“আম্মু, তোমাদের সব কথা মেনে নিয়েছি। এখন আমার একটা কথা শুধু মানো, একা থাকতে দাও।”
আম্মু চলে গেল। আমি দরজা বন্ধ করে গু°টিশু°টি মেরে বসে রইলাম। সত্যটা কতদিন চাপা থাকবে?
মনে পড়ছে একটা রাত। কুমিল্লায় কাটানো সেই রাত। যখন আমরা কাছাকাছি, অয়ন ফিসফিস করে বলেছিল “বৈ°ধ না করে তোকে আমার করবো না।”
সেই রাতে ফ্লোরে বসে গল্প করার সময়ও বারে বারে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে। আমি খেয়াল করেছি তাকে, আমার চোখের দিকে তাকায়নি। হয়তো কোনো ভুল হওয়ার ভ°য়েই তাকায়নি, তবুও তার চরিত্র নিয়ে এতো বড় একটা কথা রটে গেল।
ক্লান্ত থাকায় চোখ লেগে গেল। হঠাৎ ফোন কেঁ°পে উঠায় লাফিয়ে উঠে দেখি অয়নের কল।
“অয়ন?”
অপরপাশ থেকে কোনো কথা আসছে না। ভ°য়টা আবারো লাগছে।
“অয়ন? কিছু বলো প্লিজ।”
খুব নিম্নস্বরে বলল,
“তনুশ্রী, আমার তনুশ্রী, আমার তনুশ্রী।”
“কি বলছো?”
অয়ন কিছুই বলল না। আমিও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
“বাসায় পৌঁছে গেছো?”
“হুম।”
“এতো জোরে ড্রাইভ করো না। ভ°য় হয় আমার।”
“হুম।”
“অয়ন? তুমি কি শুনছো আমার কথা?”
আবারো নিরবতা বিস্তার করছে। হুট করে অয়ন বলে উঠে,
“ভালোবাসি তোকে তনুশ্রী। খুব করে ভালোবাসি৷ পরিণয়টা না হলো এবেলায়, আমরা হয়তো এক হবো কোনো এক গোধূলী বেলায়।”
অয়নের এলোমেলো কথায় কান্না পেল। দুজনেই চুপ করে রইলাম। খুব বিচ্ছিরি একটা মুহূর্তে আছি, যা কোনো ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।
অবশেষে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
“অয়ন, একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
“হুম, বলো।”
হঠাৎ তুমি ডাকটা অচেনা লাগলো, ওর মুখে তুই শুনেই তো আমি অভ্যস্ত।
“অয়ন, বলবো আমি?”
“বলো।”
কান্না আটকে বললাম,
“মানহা ইত্তাজাকে ভালোবাসে। কখন, কোথায়, কিভাবে ইত্তাজার সাথে ওর দেখা হয়েছে তা আমাকে বলেনি। তবে ওর কথায় বুঝেছি ওদের সম্পর্ক আছে, কিছু তো আছে।”
অয়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“কে বলেছে তোকে?”
“মানহা। ইত্তাজা ওকে মানহামণি বলে ডাকে৷ একদিনে নিশ্চয়ই এমন হয়নি।”
“ইত্তাজা?”
নামটা খুব শক্ত করেই উচ্চারণ করলো সে। রাগটা কি সে ইত্তাজার প্রতি করছে? তবে করুক, ইত্তাজার প্রতি রাগ তো আমারও আছে। মানহা এতো সিরিয়াস প্রেমে এমনি এমনি পড়ে যায়নি।
“এ দিনটা যে আসবে সেটা তুমিও জানতে আর আমিও জানতাম, তবে কেন এতোদিন চুপ করে ছিলে? আর মাত্র দুদিন, তারপরই আমি ইত্তাজার হয়ে যাবো।”
আমার প্রশ্নের উত্তর অয়নের কাছে নেই, তার নিরবতা আমাকে এটাই বোঝালো।
“অয়ন, তুমি চুপ থাকো। কিন্তু আমি আর চুপ থাকতে পারবো না। আমার বেস্টফ্রেন্ডের ভালোবাসাকে আর যাই হোক আমি বিয়ে করতে পারবো না।”
অয়ন আবারো নিরব। ওর নিরবতা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, কেন বুঝতে পারছে না সে?
অবশেষে নিরবতা নিধন হলো। অয়ন বলল,
“বিয়ে হবে না তোদের। মান গেলে যাক, সম্মান বিলীন হোক। তবুও ভালোবাসা বেঁচে থাকুক।”
চলবে……